কনে দেখা
কবিদের জন্য কি ঘর-সংসার? কবিদের জন্য কি সোহাগী বউ? কবিদের জন্য কি বাচ্চা-কাচ্চার কাপড় ধোয়া, বাজার সওদা করা? কবিরা সংসার নামক খাঁচায় পোষা ময়না পাখীর জীবন পছন্দ করে না- এটা উতপল মাষ্টারের বিখ্যাত উক্তি। তার মতে, 'কবিরা আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়াবে, মনে মনে শিউলী ফুলের মালা গেঁথে কবিতার স্বপ্ন রাণীর গলায় পড়াবে। কবিতার হাজারও পংতিমালায় খুঁজবে ভালোবাসার নির্যাস। সাদা মেঘের ভেলা থেকে খুঁজে আনবে হাজারো পংতিমালা।' নয়ন মাষ্টারের মতে,'কবিরা যদি ভুল বশতঃ বিয়েই করে ফেলে, তার ক্ষেত্রে কবিদের বউ হবে বুবি(বোবা)!চুপচাপ থাকবে।মুখে কোন কথা নাই। মুখে সেলাই! তবে উতপল বা নয়ন যে যা-ই ভাবুক। উতপল কবি জানে শিউলী ফুলের মালা গেঁথে, হাড়িখোলা রেল ষ্টেশনের ভাঙ্গা বেঞ্চিতে বসে কীভাবে প্রেমের কবিতা লিখতে হয়। আর নয়ন মাষ্টার জানে কৌশলে কীভাবে নারীদের মন জয় করা যায়! আর পেরেরা সাব???? না, বিয়ে নামক কমলাপুর টু চট্টগ্রামের লক্কর-ঝক্কর মাল গাড়ীতে বসে ঝিমানোর স্বভাব তার নেই। কবি বিপুলের মত সাত হাত পানি বা মাটির নীচ থেকে নোয়াখাইল্ল্যা গাছ খোঁজার ইচ্ছেও তার নেই। জীবন চলবে নিয়মের পথে, রেল লাইনের সমান্তরালে!
এর পরও বাঁধে ঝামেলা। যত ঝামেরলার মূলে আশিস জামাই। বোকা কিসিমের আশিস জামাইকে বাড়িতে নিয়েই পেরেরা সাবের সব আশা গুড়েবালি হয়ে যায়। পেরেরা সাবের মায়ের কাছে গিয়ে তার প্রথম কথা উমুক বাড়ির মেয়েটা খুব কাজের, উমুখ বাড়ীর মেয়েটা মনটা খুব ভাল। বদে একবারও বলে না উমুক বাড়ীর মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দরী! এর পর থেকে পেরেরা সাবের মা সরাসরি বিয়ের কথা না বললেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, তেনাগ বাড়ীর মেয়েটা ভালো, দড়িপাড়ার মেয়েটা ভালো। পেরেরা জানে তার মা কি বুঝাতে চায়! সব দোষ ঐ বদ আশিস জামাইয়ের। আশিস আসলে জামাই না। সবাই দুষ্টুমি করে ওকে জামাই ডাকে। সবাই চাইছিল আশিস চড়াখোলা গ্রামের জামাই হোক। এমন কি তার জন্য পেরেরা সাবের বাড়ীর এক ভাতিজি পর্যন্ত ঠিক করা হয়েছিল!
পেরেরা অনেকেটা বাধ্য হয়েই বিয়ের প্রজেক্টে হাত দিলেন। প্রজেক্ট ম্যানেজার আশিস জামাই, মুরুব্বি নয়ন মাষ্টার আর হাতে ছাতা ধরা বা রিক্সা ভাড়া সব দেখবে উতপল মাষ্টার। ইতোমধ্যে তাদের একটি 'বিয়ে প্রস্তুতি সভাও 'হয়ে গেছে। প্রথমে এলাকা বাছাই। কেয় বলে ১৮ গ্রাম, কেউ বলে দক্ষিণ বঙ্গ। উতপল মাষ্টারের যুক্ত,'জাতের মেয়ে কালো ভালো, হোক সে তিঁতপুটি(ছোট পুটি মাস) পুটি।' তাই ঘুরে ফিরে সে বার বার তুমিলিয়ার দিকে রিক্সা ভাড়া করে। আশিস জামাইয়ের মতে উত্তর বঙ্গের মেয়েরা হয় ঘরণী, শান্ত শিষ্ট, ভদ্র। তার যুক্তি উত্তরের ঠান্ডা হিমেল হাওয়া যেমন শরীরে মৃদু কাঁপন জাগায়, আর তখন হালকা-পাতলা একটা কম্বল গায়ে দিলে যেমন আরাম লাগে। উত্তর বঙ্গের মেয়েরা হলোও তাই, ঠান্ডা মনের, হালকা কাঁথা! পেরেরা সাব তো উত্তর ছাড়া কিছুই বুঝে না! তো শুরু 'প্রজেক্ট মিশন উত্তর বঙ্গ।'
লুসি উত্তর বঙ্গের মেয়ে। ব্যেস বেশী না। পেরেরা সাব লুসিকে খুব স্নেহ করেন। তার মতে লুসি খুব বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে।খুব ব্রিলিয়ান্ট, চটপটে, ভালো বক্তা, এব্ং সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। তার সবচেয়ে বড় গুন তার ব্যক্তিত্ব। যেকোন সমস্যা সমাধানে সে খুব ধীর স্থির ভাবে সমাধান দিবে।
পেরেরা সাবের ধারণা লুসি মেয়ে দেখার কাজ ও মেয়ে বাছাই করার কাজটি ভালো ভাবে করতে পারবে। তাই তিনি উত্তর বঙ্গ প্রজেক্টের দায়িত্বটা লুসিকে দিলেন। লুসি দায়িত্ব পেয়ে মহা খুশি দাদার জন্য মেয়ে দেখা সে এক অন্য অনুভূতি।এপ্রিলের ৫ তারিখে উত্তর বঙ্গ যাত্রা। ইতোমধ্যে লুসি পেরেরা সাবকে বিস্তারিত সিডিউল জানিয়ে দিল।
সকাল সাতটায় ঢাকা টু জোনাইল বাসের চারটি টিকিট কেনা হয়ে গেছে।পেরেরা সাব, উতপল মাষ্টার, নয়ন মাষ্টার ও আশিশ জামাই যাবে মেয়ে দেখতে।বিরাট আয়োজন। নয়ন মাষ্টার পাঞ্জাবীও কিনে ফেলেছে।
সাতটার আগেই সবাই গাবতলী বাসষ্ট্যান্ড এসে পড়েছে।বাস ছেড়ে দিয়েছে। নয়ন মাষ্টার কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, পেরেরা গাঞ্জা নিয়ে এসেছি।
-কয় পুইরা?
-৭/৮টি হবে।মাষ্টারের মুখ থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে খেয়ে এসেছে। গুন গুন করে আবার গানও ধরেছে। পিছন থেকে উতপল মাষ্টার বলল, 'নয়ন ভাই জোরে গান ধরে।' আর কথা নাই মাষ্টার গলা ছেড়ে গান ধরে, সেই গাঞ্জার গান,
'সাধু বাবা সাধু বাবা,
আমায় একটা তাবিজ দেন,
আমার ঘরে আমি মেম্বার
আমার বউ চেয়ারম্যান।'
উতপল মাষ্টারও সুর মেলাল, আমার ঘরে আমি মেম্বার আমার বউ চেয়ারম্যান।
বাস জোনাইল বাজারে পৌঁছতে চারটা বেজে গেল। পেরেরা লুসিকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আমরা এসেছি। বাস থেকে নেমেই রিক্সা। রিক্সা জোনাই্ল বাজার ব্রীজ ক্রস করতে যাবে এমন সময় বিরাট রিফিউজির দল কাকা আইছে কাকা আইছে বলেই তাদের ব্যাগ নিয়ে দে দৌঁড়। কিভাবে এরা খবব পেল আজ পেরেরা সাব আসছে। নয়ন -উতপ্ল হা করে তাকিয়ে আছে।রিফিউজিরা পেরেরা সাবের মেসোতো ভাইয়ের ঘরের ছেলেমেয়ে। ওরা পেরেরাকে খুব ভালোবাসে।
লুসি পরদিন ১১টার মধ্যে তার দুই বোনসহ একটি নসিমন নিয়ে পেরেরা সাবের মাসীর বাড়িতে হাজির।পেরেরা তার ব্যাগ খুঁজে দেখে পাঞ্জাবী আনা হয়নি। কি করা যায়? অবশেষে আশিস জামাই তার পাঞ্জাবী দিয়ে বলল এটা দিয়ে চালিয়ে দে। পাঞ্জাবীতে বিশ্রী ঘামের গন্ধ। পরা সম্ভব না। এটা পরে গেলে মেয়ের লোকেরা ভাববে ছেলে কৈবত, জেলে, মাছ ধরে! বাইরে চৈত্রের প্রচন্ড গরম। এর মধ্যে আশিস পরেছে স্যুট। ফিটফাট বাবু। মনে হচ্ছে সেই মেয়ে দেখতে যাচ্ছে।
মেয়ের বাড়ি পাবনার্ লেংড়ী গ্রামে। আঁকা বাঁকা মেঠো পথ। বেশ ভালই লাগছে। নয়নের মুঝ থেকে আবার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নসিমনে বসে হেলেদুলে সেই গান, সাধু বাবা সাধু বাবা... এবার উতপল গলা ছেড়ে গান ধরেছে। বুঝা যাচ্ছে সেও বাদ দেয়নি!
লুসি মেয়ের বাড়ী চিনে না। রাস্তায় একটি ছোট বালকে পাওয়া গেল। তাকে পারুলদের বারীর কথা বলতেই সে নিয়ে বাড়ীতে নিয়ে হাজির। বিরাট গেরস্থ বাড়ী। উঠান ভরা চৈতালী ফসল। ধান, গম, সরিষা, ডাল। উঠানে র এক কোনার বসে মধ্য বয়েসি এক লোক তামাক খাচ্ছে। বাড়ীতে লোক এসেছে এ ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই। রান্না ঘর থেকে মাথায় ঘোমটা দেয়া এক মহিলা বার বার উকি মেরে দেখছে কে এলো।বাড়ীর আঙ্গিনার আম গাছের ছায়ায় বসে এক বৃদ্ধা সব্জি কাটাকুটি করছে। লুসি বুড়িকে জিজ্ঞাস করল, ও ঠাকুমা পারুল আছে?
-তুমি কে? কোথা ত্থেকে এসেছ? এরা কারা? কোথায় যায়? কত প্রশ্ন! -কেন ঠাকু।
-আমরা তো খবর দিয়েছি?
-কিসের খবর? আমরা তো কোন খবর পাইনি? মনে হছে কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। লুসি সব খুলে বলল। এর পর সে কি আপ্যায়ন। বুড়ি চেঁচাতে লাগল, মন্টু(পারুলের বাপ),যা বাজারে যা, এই পারুর মা চা নাস্তা দাও, ঐ পলাশ যা তোর জ্যাঠারে খবর দে। বিরাট হৈহোল্লো।
উঠানের এক পাশে সবাইকে বসতে দেয়া হলো। বুড়ি পাটিতে বসা। পারুর বাবা খালি গায়ে কাঁধে একটি পাঞ্জাবী ঝুলিয়ে বাজারে চলে গেল।
-লুসি গিজ্ঞেস করে, ঠাকু পারুল কোথায়?
-মাইডালে গেছে।(মাইডাল মানে ছোট খাট পুকুর)
-ডাকেন তাকে।
-আসবেনে বস না তোমরা।পারুলকে দেখতে এসেছ আমার যে কি ভাল লাগছ্জে। পারুল খুব কামের। সকালে উঠে গাই দোয়ায়(গরু দোহন করে), ছাগল নিয়ে ক্ষেতে যায়। সব কাজ সে পারে। নয়ন মাষ্টার দারুণ খুশি, কারণ মেয়েটি অনেক গুনের অধিকারী। সব ধরনের কাজ সে জানে।বুড়ী উচ্চ স্বরে ডাকছে ও পারুর মা। পেরেরা ভাবে, বাঃ পারু নামটি খুব মিষ্টি। উতপল জিজ্ঞাস করে পারু আছে চন্দ্রমুখী নাই ঠাকু?
-কি পোড়ামুখী?
-না না পোড়ামুখী না, পারুরু কোন ভাই-বোন নাই?
-আছে, দুই ভাই দুই বোন। তার মানে চন্দ্রমুখী আছে।উতপল ও নয়নকে বেশ উত্ফুল্ল দেখাচ্ছে। বোন আছে কথা শুনে।
-ঠাকু ওরা কোথায়?
ভাই দুটি গেছে ইসকুলে, বোন বাড়ীতে।
-কোথায়, ডাকেন।
-ঐই তো। পাশে তিন চার বছরের একটি শিশু খেলা করছিল। বুড়ি তাকে ডাকল সিমু এদিকে আয়।সিমু আড়ালে পটি করছিল। সাথে সাথে মেয়েটি দৌঁড়ে এলো।সবার মুখে যেন কেউ চুন কালি মেখে দিয়েছে। আশিস জামাই জিজ্ঞেস করল,' এই খুকি কি নাম? মেয়েটি চট করে আশিসের কোলে বসে পড়ল। বেচারা আশিস, কি আর করবে পটি কন্যাকে কোলে নিয়ে বসে আছে মুখ ভার করে।
-এদিকে বুড়ির মুখে কথার খৈ ফুটেই চলেছে। নয়ন কানে কানে বলল, এ তো দেখছি কথা হাট খোলে বসে আছে। বুড়ির মতিগতি সুবিধার মনে হচ্ছে না। তুমি থেকে তুই এ নেমে এসেছে। জানিস তোদের দাদু যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিল, সেদিন আমি খালি গায়ে ডোমা পড়েছিলাম(ছোট কাপড়), কি বলব কি লজ্জা। নয়ন বেশ মনোযোগ দি্যেই বুড়ির কথা শুনছে। আর অকারণে হাসছে। বুড়ি বল, আজ কিন্তু তোদের খেয়ে যেতে হবে। উইছ্তার ছেনছি(উচ্ছ্বে ভাজি))দিয়ে চারটা ডাল ভাত খাবি।
এর মধ্যে পারু এসে গেছে। ও আল্লা এটা কি? ভূত নাকি। পেরেরার প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে টেনশনে। মেট্রোররেল ঔষধটা খাওয়া হয়নি। উতপল আর আশিস হা করে তাকিয়ে আছে। পারুর সারা গায়ে কাদা মাটি, সে মাছ ধরতে গিয়েছিল। হাতে একটি হাড়ি। বুড়ি তাকে ডাকল, পারু এদিকে আয় দেখ কে এসেছে। পারু কাছে আসল কিন্তু কারো দিকে তাকাল না। পারু হাড়ি দেখিয়ে বলল, ঠাকু আজ বেশী মাছ ধরতে পারি না। মাত্র কয়রটা বুচি আর তিত পুটি পেয়েছি। এই বলে সে সবাইকে দেখাতে লাগল। বুড়ি কি খুশি। বলছিলাম না পারু অনেক কাজের। পেরেরা ভাবছে, আশিসের গন্ধওলা পাঞ্জাবীটা পরড়ে আসলে ভালো হতো। কৈবতে-কৌবতনী জমতো ভাল! বুড়ি এবার বলল, তোর শশুর যে বাজারে গেলো এখনো ফেরার নাম নেই। বুড়ি বলে কি? কাকে বলছে? আসলে বুড়ি কার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে বুঝা মুশকিল। কারণ তার দুই চোখ টেরা। কানেও শুনে কম।কাকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'তোর শশুর?'
এর মধ্যে পারু চা আর ঝাল মুড়ি নিয়ে হাজির। একটি থালায় তিনটি চায়ের কাপ ও একটি পুরনো দিনের টিনের মগ।নয়ন বলল, তুমি পারু?
-আরে কাকা দেখি আমার নাম জানেন? নয়নের মুখটা চুপ মেরে গেল কাকা শব্দটি শুনে। সে আর প্রশ্ন করল না, মেয়েটি কি বলতে কি বলে ফেলে। পারু দেখতে বেশী সুন্দরী না হলেও বেশ সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ে।পড়াশোনা বেশী করেনি। অনেক সমন্ধ তার জন্য এসেছিল। কিন্তু কালো বেটে বলে দ্বিতীয় বার কেউ আর ফিরে আসেনি।
-নেন আপনারা চা খান, বলে সে এক এক করে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিছে।জানেন চারটা কাপ ছিল, একটা ভেঙ্গে গেছে, তাই একটা টিনের মগ দিলাম। এই যে কাকা আপনি মুরুব্বি মানুষ টিনের কাপ দিয়ে খান বলেই নয়নের দিকে মগটি এগিয়ে দিল। এদিকে অপমানের জালায় নয়নের গাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝড়ছে। ক্ষুধার পেট সবাই মজা করে মুড়ি খাচ্ছে, অবশ্য এ গুলো মুড়ি বলা যায়, না কারণ মুড়িতে বেশীর ভাগ ছিল মরিচ। অসম্ভব ঝাল। আশিস না জেনে একটা মরিচ কামড় দিয়েছে। আর যায় কোথায় ঝালে উহ আহ করতে লাগল। মুখ তার লাল হয়ে গেছে । সে আর খাচ্ছে না, কোন কথাও বলছে না। শুধু বড় হা করে বাইরে তাকিয়ে আছে।
বুড়ি এবার জিজ্ঞেস করল, পাত্র কে?
-আশিস কথাটি খেয়াল করেনি। পেরেরা তাড়াতাড়ি বলে দিল, ঐ যে ঐটা, হা করে তাকিয়ে আছে।ঝালের কারনে আশিসের কান স্তব্ধ হয়ে গেছে তাই কথাটি খেয়াল করেনি।
-ওমা নাতিন জামাই হা কইরা আছে কেন?
-ঠাকু মরিচ খেয়ে ফেলেছ। অনেক ঝাল তো তাই হা করে আছে।
- ক্ষেতের বাইন মরিচ তো খুব ঝাল। তা ছাড়া আমাগ লেংড়ি এলাকার মানুষ একটু ঝাল খায় বেশী।পারু যা পাটালী গুড় নিয়ে আয়। দে জামাইয়ের মুখে তুলে দে। যেই কথা সেই কাজ। জামাইকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু জামাই ঝালের কারনে বুঝতেও পারলনা তাকে জামাই বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। পেরেরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
যে অবস্থা দেখা যাছে মনে হয় আজ আশিস জামাই কপালে খারাপ কিছু আছে। লুসি চালাক মেয়ে কিছুটা আচ করতে পেরে বলল, ঠাকু আজ যাই।
-যাই মানে! না খেয়ে বিদাই নাই।তিথী নারায়ন। ছেলে আমাদের পছন্দ হয়ছে। আজই পাকা কথা হবে। এই সাধু যা তো, তোর পনতি মাসীকে খবর দে।
-পনতি মাসীটা কে?
-পারুর মাসী। বেশ সাহসী। এলাকার সবাই ভয় পায়। একবার এক জেলেকে থাপ্পড় দিয়ে দুই দাঁ ফেলে দিয়েছিল।সে আসলে আজকেই জবাজব হবে।
এ তো দেখি নয় নম্বর বিপদ সংকেত। পনতি মাসী আসার আগেই কেটে পড়তে হবে। পনতি মাসীর বাড়ী দারিকুশি অনেক দুর। আসতে দেরী হবে।
-লুসি বলল, ঠাকু যা আছে দেন খেয়ে যাই।
-এই পারুর মা খারা দেও। শোন তোরা যাও সমস্যা নাই কিন্তু জামাইকে ছাড়ব না। আগেও অনেকে পারুকে দেখতে এসেছে। খেয়ে দেয়ে, আসি বলে সেই যে গেছে আর খবর নাই। জামাইকে দড়ি দিয়ে বাইন্দা রাখব। লুসি মহা চিন্তায় পড়ে গেল। কার জন্য মেয়ে দেখতে আসলাম। আর কে পড়ল ফ্যাসাদে! ঠাকু শোন, তুমি তো জানো না এই ছেলের মাথায় কিঞ্চিত গন্ডোগোল আছে। দেখনা কেমন হা করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।
-ও তো ঝালের কারণের হা করে আছে।
-না না আমাবশ্যার রাতে তার পাগলামীর মাত্রা বেড়ে যায়। তখন গায়ে একটা জামাও থাকে না। রাম দা নিয়া যাকে খুশি তাকে তাড়া করে।
-ও যীশু কয় কি? এমন পাগল ছেলে আগে বল না কেন? পাগল কি বংশগত?
- সবাই না,আরও দুই ভাই আছে ঐগুলোর একই অবস্থা। ছেলে কিঞ্চিত নেশা করে।আমাবশ্যার রাতে আখড়ায় বসে, তিন বান্দরের সাথে গাঞ্জাও খায়।
-থাক থাক আর বলে হবে না। পাগলা জামাই দরকার নাই। এবার পেরেরাকে দেখে বলল, এইটা কেমন?
- না না ঠাকু এইটা বিবাহ করেছে। মেয়ে চাকমা।ধরা খেয়েছিল। চাকমারা ধরে দিছে বিয়ে পরিয়ে। পেরেরার মাথা থেকে এক মন বস্তা যেন নেমেছে মনে হলো। বুড়ি এবার বলল, 'ঠিক আছে তোরা তাড়াতাড়ি যা, নইলে পনতি আইলে খবর আছে, পাগলা জামাইরে দড়ি দিয়া বাইন্দা রাখব।'
পনতির খবর পেয়ে পারলে সবাই দৌড়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে যায়। লুসি নসিমনে উঠে বলে, 'দাদা আমাদের ভুল হয়েছে। এই পারুল আসল পারুল না। ছোট ছেলেটি আমাদের অন্য পারুলের বাড়ীতে নিয়ে গেছে। আমি দুঃখিত। তোমাদের উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে।'
-ও কিছু না, বেশ মজাও করেছি কই মাষ্টার গান ধর,
মাষ্টার গান ধরেছে-
'সাধু বাবা সাধু বাবা
আমায় একটা তাবিজ দেন,
আমার ঘরে আমি মেম্বার
আমার বউ চেয়ারম্যান।'
উতপল মাষ্টার কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে গাইছে, সাধু বাবা সাধু বাবা...
আশিস জামাইয়ের মুখে এখনো ঝাল লেগে আছে সে মুখে পাটালি গুড় নিয়ে হা করে বসে আছে।সে জানে দুই দিন তার পায়খানা-পেসাব হবে না।ঝাল বড়ই খারাপ জিনিষ! গাঞ্জার চেয়েও ভয়াবহ!!!
১০/০৯/২০১৩
এর পরও বাঁধে ঝামেলা। যত ঝামেরলার মূলে আশিস জামাই। বোকা কিসিমের আশিস জামাইকে বাড়িতে নিয়েই পেরেরা সাবের সব আশা গুড়েবালি হয়ে যায়। পেরেরা সাবের মায়ের কাছে গিয়ে তার প্রথম কথা উমুক বাড়ির মেয়েটা খুব কাজের, উমুখ বাড়ীর মেয়েটা মনটা খুব ভাল। বদে একবারও বলে না উমুক বাড়ীর মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দরী! এর পর থেকে পেরেরা সাবের মা সরাসরি বিয়ের কথা না বললেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, তেনাগ বাড়ীর মেয়েটা ভালো, দড়িপাড়ার মেয়েটা ভালো। পেরেরা জানে তার মা কি বুঝাতে চায়! সব দোষ ঐ বদ আশিস জামাইয়ের। আশিস আসলে জামাই না। সবাই দুষ্টুমি করে ওকে জামাই ডাকে। সবাই চাইছিল আশিস চড়াখোলা গ্রামের জামাই হোক। এমন কি তার জন্য পেরেরা সাবের বাড়ীর এক ভাতিজি পর্যন্ত ঠিক করা হয়েছিল!
পেরেরা অনেকেটা বাধ্য হয়েই বিয়ের প্রজেক্টে হাত দিলেন। প্রজেক্ট ম্যানেজার আশিস জামাই, মুরুব্বি নয়ন মাষ্টার আর হাতে ছাতা ধরা বা রিক্সা ভাড়া সব দেখবে উতপল মাষ্টার। ইতোমধ্যে তাদের একটি 'বিয়ে প্রস্তুতি সভাও 'হয়ে গেছে। প্রথমে এলাকা বাছাই। কেয় বলে ১৮ গ্রাম, কেউ বলে দক্ষিণ বঙ্গ। উতপল মাষ্টারের যুক্ত,'জাতের মেয়ে কালো ভালো, হোক সে তিঁতপুটি(ছোট পুটি মাস) পুটি।' তাই ঘুরে ফিরে সে বার বার তুমিলিয়ার দিকে রিক্সা ভাড়া করে। আশিস জামাইয়ের মতে উত্তর বঙ্গের মেয়েরা হয় ঘরণী, শান্ত শিষ্ট, ভদ্র। তার যুক্তি উত্তরের ঠান্ডা হিমেল হাওয়া যেমন শরীরে মৃদু কাঁপন জাগায়, আর তখন হালকা-পাতলা একটা কম্বল গায়ে দিলে যেমন আরাম লাগে। উত্তর বঙ্গের মেয়েরা হলোও তাই, ঠান্ডা মনের, হালকা কাঁথা! পেরেরা সাব তো উত্তর ছাড়া কিছুই বুঝে না! তো শুরু 'প্রজেক্ট মিশন উত্তর বঙ্গ।'
লুসি উত্তর বঙ্গের মেয়ে। ব্যেস বেশী না। পেরেরা সাব লুসিকে খুব স্নেহ করেন। তার মতে লুসি খুব বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে।খুব ব্রিলিয়ান্ট, চটপটে, ভালো বক্তা, এব্ং সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। তার সবচেয়ে বড় গুন তার ব্যক্তিত্ব। যেকোন সমস্যা সমাধানে সে খুব ধীর স্থির ভাবে সমাধান দিবে।
পেরেরা সাবের ধারণা লুসি মেয়ে দেখার কাজ ও মেয়ে বাছাই করার কাজটি ভালো ভাবে করতে পারবে। তাই তিনি উত্তর বঙ্গ প্রজেক্টের দায়িত্বটা লুসিকে দিলেন। লুসি দায়িত্ব পেয়ে মহা খুশি দাদার জন্য মেয়ে দেখা সে এক অন্য অনুভূতি।এপ্রিলের ৫ তারিখে উত্তর বঙ্গ যাত্রা। ইতোমধ্যে লুসি পেরেরা সাবকে বিস্তারিত সিডিউল জানিয়ে দিল।
সকাল সাতটায় ঢাকা টু জোনাইল বাসের চারটি টিকিট কেনা হয়ে গেছে।পেরেরা সাব, উতপল মাষ্টার, নয়ন মাষ্টার ও আশিশ জামাই যাবে মেয়ে দেখতে।বিরাট আয়োজন। নয়ন মাষ্টার পাঞ্জাবীও কিনে ফেলেছে।
সাতটার আগেই সবাই গাবতলী বাসষ্ট্যান্ড এসে পড়েছে।বাস ছেড়ে দিয়েছে। নয়ন মাষ্টার কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, পেরেরা গাঞ্জা নিয়ে এসেছি।
-কয় পুইরা?
-৭/৮টি হবে।মাষ্টারের মুখ থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে খেয়ে এসেছে। গুন গুন করে আবার গানও ধরেছে। পিছন থেকে উতপল মাষ্টার বলল, 'নয়ন ভাই জোরে গান ধরে।' আর কথা নাই মাষ্টার গলা ছেড়ে গান ধরে, সেই গাঞ্জার গান,
'সাধু বাবা সাধু বাবা,
আমায় একটা তাবিজ দেন,
আমার ঘরে আমি মেম্বার
আমার বউ চেয়ারম্যান।'
উতপল মাষ্টারও সুর মেলাল, আমার ঘরে আমি মেম্বার আমার বউ চেয়ারম্যান।
বাস জোনাইল বাজারে পৌঁছতে চারটা বেজে গেল। পেরেরা লুসিকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আমরা এসেছি। বাস থেকে নেমেই রিক্সা। রিক্সা জোনাই্ল বাজার ব্রীজ ক্রস করতে যাবে এমন সময় বিরাট রিফিউজির দল কাকা আইছে কাকা আইছে বলেই তাদের ব্যাগ নিয়ে দে দৌঁড়। কিভাবে এরা খবব পেল আজ পেরেরা সাব আসছে। নয়ন -উতপ্ল হা করে তাকিয়ে আছে।রিফিউজিরা পেরেরা সাবের মেসোতো ভাইয়ের ঘরের ছেলেমেয়ে। ওরা পেরেরাকে খুব ভালোবাসে।
লুসি পরদিন ১১টার মধ্যে তার দুই বোনসহ একটি নসিমন নিয়ে পেরেরা সাবের মাসীর বাড়িতে হাজির।পেরেরা তার ব্যাগ খুঁজে দেখে পাঞ্জাবী আনা হয়নি। কি করা যায়? অবশেষে আশিস জামাই তার পাঞ্জাবী দিয়ে বলল এটা দিয়ে চালিয়ে দে। পাঞ্জাবীতে বিশ্রী ঘামের গন্ধ। পরা সম্ভব না। এটা পরে গেলে মেয়ের লোকেরা ভাববে ছেলে কৈবত, জেলে, মাছ ধরে! বাইরে চৈত্রের প্রচন্ড গরম। এর মধ্যে আশিস পরেছে স্যুট। ফিটফাট বাবু। মনে হচ্ছে সেই মেয়ে দেখতে যাচ্ছে।
মেয়ের বাড়ি পাবনার্ লেংড়ী গ্রামে। আঁকা বাঁকা মেঠো পথ। বেশ ভালই লাগছে। নয়নের মুঝ থেকে আবার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নসিমনে বসে হেলেদুলে সেই গান, সাধু বাবা সাধু বাবা... এবার উতপল গলা ছেড়ে গান ধরেছে। বুঝা যাচ্ছে সেও বাদ দেয়নি!
লুসি মেয়ের বাড়ী চিনে না। রাস্তায় একটি ছোট বালকে পাওয়া গেল। তাকে পারুলদের বারীর কথা বলতেই সে নিয়ে বাড়ীতে নিয়ে হাজির। বিরাট গেরস্থ বাড়ী। উঠান ভরা চৈতালী ফসল। ধান, গম, সরিষা, ডাল। উঠানে র এক কোনার বসে মধ্য বয়েসি এক লোক তামাক খাচ্ছে। বাড়ীতে লোক এসেছে এ ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই। রান্না ঘর থেকে মাথায় ঘোমটা দেয়া এক মহিলা বার বার উকি মেরে দেখছে কে এলো।বাড়ীর আঙ্গিনার আম গাছের ছায়ায় বসে এক বৃদ্ধা সব্জি কাটাকুটি করছে। লুসি বুড়িকে জিজ্ঞাস করল, ও ঠাকুমা পারুল আছে?
-তুমি কে? কোথা ত্থেকে এসেছ? এরা কারা? কোথায় যায়? কত প্রশ্ন! -কেন ঠাকু।
-আমরা তো খবর দিয়েছি?
-কিসের খবর? আমরা তো কোন খবর পাইনি? মনে হছে কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। লুসি সব খুলে বলল। এর পর সে কি আপ্যায়ন। বুড়ি চেঁচাতে লাগল, মন্টু(পারুলের বাপ),যা বাজারে যা, এই পারুর মা চা নাস্তা দাও, ঐ পলাশ যা তোর জ্যাঠারে খবর দে। বিরাট হৈহোল্লো।
উঠানের এক পাশে সবাইকে বসতে দেয়া হলো। বুড়ি পাটিতে বসা। পারুর বাবা খালি গায়ে কাঁধে একটি পাঞ্জাবী ঝুলিয়ে বাজারে চলে গেল।
-লুসি গিজ্ঞেস করে, ঠাকু পারুল কোথায়?
-মাইডালে গেছে।(মাইডাল মানে ছোট খাট পুকুর)
-ডাকেন তাকে।
-আসবেনে বস না তোমরা।পারুলকে দেখতে এসেছ আমার যে কি ভাল লাগছ্জে। পারুল খুব কামের। সকালে উঠে গাই দোয়ায়(গরু দোহন করে), ছাগল নিয়ে ক্ষেতে যায়। সব কাজ সে পারে। নয়ন মাষ্টার দারুণ খুশি, কারণ মেয়েটি অনেক গুনের অধিকারী। সব ধরনের কাজ সে জানে।বুড়ী উচ্চ স্বরে ডাকছে ও পারুর মা। পেরেরা ভাবে, বাঃ পারু নামটি খুব মিষ্টি। উতপল জিজ্ঞাস করে পারু আছে চন্দ্রমুখী নাই ঠাকু?
-কি পোড়ামুখী?
-না না পোড়ামুখী না, পারুরু কোন ভাই-বোন নাই?
-আছে, দুই ভাই দুই বোন। তার মানে চন্দ্রমুখী আছে।উতপল ও নয়নকে বেশ উত্ফুল্ল দেখাচ্ছে। বোন আছে কথা শুনে।
-ঠাকু ওরা কোথায়?
ভাই দুটি গেছে ইসকুলে, বোন বাড়ীতে।
-কোথায়, ডাকেন।
-ঐই তো। পাশে তিন চার বছরের একটি শিশু খেলা করছিল। বুড়ি তাকে ডাকল সিমু এদিকে আয়।সিমু আড়ালে পটি করছিল। সাথে সাথে মেয়েটি দৌঁড়ে এলো।সবার মুখে যেন কেউ চুন কালি মেখে দিয়েছে। আশিস জামাই জিজ্ঞেস করল,' এই খুকি কি নাম? মেয়েটি চট করে আশিসের কোলে বসে পড়ল। বেচারা আশিস, কি আর করবে পটি কন্যাকে কোলে নিয়ে বসে আছে মুখ ভার করে।
-এদিকে বুড়ির মুখে কথার খৈ ফুটেই চলেছে। নয়ন কানে কানে বলল, এ তো দেখছি কথা হাট খোলে বসে আছে। বুড়ির মতিগতি সুবিধার মনে হচ্ছে না। তুমি থেকে তুই এ নেমে এসেছে। জানিস তোদের দাদু যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিল, সেদিন আমি খালি গায়ে ডোমা পড়েছিলাম(ছোট কাপড়), কি বলব কি লজ্জা। নয়ন বেশ মনোযোগ দি্যেই বুড়ির কথা শুনছে। আর অকারণে হাসছে। বুড়ি বল, আজ কিন্তু তোদের খেয়ে যেতে হবে। উইছ্তার ছেনছি(উচ্ছ্বে ভাজি))দিয়ে চারটা ডাল ভাত খাবি।
এর মধ্যে পারু এসে গেছে। ও আল্লা এটা কি? ভূত নাকি। পেরেরার প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে টেনশনে। মেট্রোররেল ঔষধটা খাওয়া হয়নি। উতপল আর আশিস হা করে তাকিয়ে আছে। পারুর সারা গায়ে কাদা মাটি, সে মাছ ধরতে গিয়েছিল। হাতে একটি হাড়ি। বুড়ি তাকে ডাকল, পারু এদিকে আয় দেখ কে এসেছে। পারু কাছে আসল কিন্তু কারো দিকে তাকাল না। পারু হাড়ি দেখিয়ে বলল, ঠাকু আজ বেশী মাছ ধরতে পারি না। মাত্র কয়রটা বুচি আর তিত পুটি পেয়েছি। এই বলে সে সবাইকে দেখাতে লাগল। বুড়ি কি খুশি। বলছিলাম না পারু অনেক কাজের। পেরেরা ভাবছে, আশিসের গন্ধওলা পাঞ্জাবীটা পরড়ে আসলে ভালো হতো। কৈবতে-কৌবতনী জমতো ভাল! বুড়ি এবার বলল, তোর শশুর যে বাজারে গেলো এখনো ফেরার নাম নেই। বুড়ি বলে কি? কাকে বলছে? আসলে বুড়ি কার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে বুঝা মুশকিল। কারণ তার দুই চোখ টেরা। কানেও শুনে কম।কাকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'তোর শশুর?'
এর মধ্যে পারু চা আর ঝাল মুড়ি নিয়ে হাজির। একটি থালায় তিনটি চায়ের কাপ ও একটি পুরনো দিনের টিনের মগ।নয়ন বলল, তুমি পারু?
-আরে কাকা দেখি আমার নাম জানেন? নয়নের মুখটা চুপ মেরে গেল কাকা শব্দটি শুনে। সে আর প্রশ্ন করল না, মেয়েটি কি বলতে কি বলে ফেলে। পারু দেখতে বেশী সুন্দরী না হলেও বেশ সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ে।পড়াশোনা বেশী করেনি। অনেক সমন্ধ তার জন্য এসেছিল। কিন্তু কালো বেটে বলে দ্বিতীয় বার কেউ আর ফিরে আসেনি।
-নেন আপনারা চা খান, বলে সে এক এক করে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিছে।জানেন চারটা কাপ ছিল, একটা ভেঙ্গে গেছে, তাই একটা টিনের মগ দিলাম। এই যে কাকা আপনি মুরুব্বি মানুষ টিনের কাপ দিয়ে খান বলেই নয়নের দিকে মগটি এগিয়ে দিল। এদিকে অপমানের জালায় নয়নের গাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝড়ছে। ক্ষুধার পেট সবাই মজা করে মুড়ি খাচ্ছে, অবশ্য এ গুলো মুড়ি বলা যায়, না কারণ মুড়িতে বেশীর ভাগ ছিল মরিচ। অসম্ভব ঝাল। আশিস না জেনে একটা মরিচ কামড় দিয়েছে। আর যায় কোথায় ঝালে উহ আহ করতে লাগল। মুখ তার লাল হয়ে গেছে । সে আর খাচ্ছে না, কোন কথাও বলছে না। শুধু বড় হা করে বাইরে তাকিয়ে আছে।
বুড়ি এবার জিজ্ঞেস করল, পাত্র কে?
-আশিস কথাটি খেয়াল করেনি। পেরেরা তাড়াতাড়ি বলে দিল, ঐ যে ঐটা, হা করে তাকিয়ে আছে।ঝালের কারনে আশিসের কান স্তব্ধ হয়ে গেছে তাই কথাটি খেয়াল করেনি।
-ওমা নাতিন জামাই হা কইরা আছে কেন?
-ঠাকু মরিচ খেয়ে ফেলেছ। অনেক ঝাল তো তাই হা করে আছে।
- ক্ষেতের বাইন মরিচ তো খুব ঝাল। তা ছাড়া আমাগ লেংড়ি এলাকার মানুষ একটু ঝাল খায় বেশী।পারু যা পাটালী গুড় নিয়ে আয়। দে জামাইয়ের মুখে তুলে দে। যেই কথা সেই কাজ। জামাইকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু জামাই ঝালের কারনে বুঝতেও পারলনা তাকে জামাই বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। পেরেরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
যে অবস্থা দেখা যাছে মনে হয় আজ আশিস জামাই কপালে খারাপ কিছু আছে। লুসি চালাক মেয়ে কিছুটা আচ করতে পেরে বলল, ঠাকু আজ যাই।
-যাই মানে! না খেয়ে বিদাই নাই।তিথী নারায়ন। ছেলে আমাদের পছন্দ হয়ছে। আজই পাকা কথা হবে। এই সাধু যা তো, তোর পনতি মাসীকে খবর দে।
-পনতি মাসীটা কে?
-পারুর মাসী। বেশ সাহসী। এলাকার সবাই ভয় পায়। একবার এক জেলেকে থাপ্পড় দিয়ে দুই দাঁ ফেলে দিয়েছিল।সে আসলে আজকেই জবাজব হবে।
এ তো দেখি নয় নম্বর বিপদ সংকেত। পনতি মাসী আসার আগেই কেটে পড়তে হবে। পনতি মাসীর বাড়ী দারিকুশি অনেক দুর। আসতে দেরী হবে।
-লুসি বলল, ঠাকু যা আছে দেন খেয়ে যাই।
-এই পারুর মা খারা দেও। শোন তোরা যাও সমস্যা নাই কিন্তু জামাইকে ছাড়ব না। আগেও অনেকে পারুকে দেখতে এসেছে। খেয়ে দেয়ে, আসি বলে সেই যে গেছে আর খবর নাই। জামাইকে দড়ি দিয়ে বাইন্দা রাখব। লুসি মহা চিন্তায় পড়ে গেল। কার জন্য মেয়ে দেখতে আসলাম। আর কে পড়ল ফ্যাসাদে! ঠাকু শোন, তুমি তো জানো না এই ছেলের মাথায় কিঞ্চিত গন্ডোগোল আছে। দেখনা কেমন হা করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।
-ও তো ঝালের কারণের হা করে আছে।
-না না আমাবশ্যার রাতে তার পাগলামীর মাত্রা বেড়ে যায়। তখন গায়ে একটা জামাও থাকে না। রাম দা নিয়া যাকে খুশি তাকে তাড়া করে।
-ও যীশু কয় কি? এমন পাগল ছেলে আগে বল না কেন? পাগল কি বংশগত?
- সবাই না,আরও দুই ভাই আছে ঐগুলোর একই অবস্থা। ছেলে কিঞ্চিত নেশা করে।আমাবশ্যার রাতে আখড়ায় বসে, তিন বান্দরের সাথে গাঞ্জাও খায়।
-থাক থাক আর বলে হবে না। পাগলা জামাই দরকার নাই। এবার পেরেরাকে দেখে বলল, এইটা কেমন?
- না না ঠাকু এইটা বিবাহ করেছে। মেয়ে চাকমা।ধরা খেয়েছিল। চাকমারা ধরে দিছে বিয়ে পরিয়ে। পেরেরার মাথা থেকে এক মন বস্তা যেন নেমেছে মনে হলো। বুড়ি এবার বলল, 'ঠিক আছে তোরা তাড়াতাড়ি যা, নইলে পনতি আইলে খবর আছে, পাগলা জামাইরে দড়ি দিয়া বাইন্দা রাখব।'
পনতির খবর পেয়ে পারলে সবাই দৌড়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে যায়। লুসি নসিমনে উঠে বলে, 'দাদা আমাদের ভুল হয়েছে। এই পারুল আসল পারুল না। ছোট ছেলেটি আমাদের অন্য পারুলের বাড়ীতে নিয়ে গেছে। আমি দুঃখিত। তোমাদের উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে।'
-ও কিছু না, বেশ মজাও করেছি কই মাষ্টার গান ধর,
মাষ্টার গান ধরেছে-
'সাধু বাবা সাধু বাবা
আমায় একটা তাবিজ দেন,
আমার ঘরে আমি মেম্বার
আমার বউ চেয়ারম্যান।'
উতপল মাষ্টার কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে গাইছে, সাধু বাবা সাধু বাবা...
আশিস জামাইয়ের মুখে এখনো ঝাল লেগে আছে সে মুখে পাটালি গুড় নিয়ে হা করে বসে আছে।সে জানে দুই দিন তার পায়খানা-পেসাব হবে না।ঝাল বড়ই খারাপ জিনিষ! গাঞ্জার চেয়েও ভয়াবহ!!!
১০/০৯/২০১৩
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
suman ০৭/১০/২০১৩দারুন হয়েছে ...অনেকদিন পর অনেক হেসেছি ...আহারে বেচারা পারু !!!!
-
সহিদুল হক ০৬/১০/২০১৩সুখপাঠ্য গল্প।
-
ডাঃ প্রবীর আচার্য নয়ন ০৬/১০/২০১৩বেশ মজা পেয়েছি পড়ে। খুব ভালো
-
দাদা মুহাইমিন চৌধূরী ০৬/১০/২০১৩অসাধারন সাধুবাবা। বেচারা পারুর আর বিয়া হইলনা খারাপ লাগল >>
আপনারে একখান গান দেই ২০১১ তে কয়েকজন বসে রাতে মেডিকেলে গাইছিলাম মোবাইল দিয়া রেকর্ড করছিলাম। >> https://copy.com/eqjCQID4Z0GO -
ইব্রাহীম রাসেল ০৬/১০/২০১৩--অনেক ধৈর্য্য আপনার এত্তবড়ো গল্প!--খুব ভালো লিখেছেন।--
-
Înšigniã Āvî ০৬/১০/২০১৩খুব ভালো
-
אולי כולנו טועים ০৬/১০/২০১৩khub valo akti golpo porlam !