কলেজস্ট্রিটে কলরব
দুজন একসাথেই বলে উঠল , " দাদা, বুদ্ধদেব গুহের 'হলুদ বসন্ত' আছে ?"
দোকানদার আর একজনের অর্পিতা সরকারের গোয়েন্দা উপন্যাস 'ট্রাফিক সিগন্যাল' দিতে দিতে একটু ব্যস্ততার সাথেই বললেন, "আছে, বোধ হয়। রথিন, ভেতরে দেখ তো বুদ্ধবাবুর 'হলুদ বসন্ত' আছে কিনা !"
সহকর্মী রথিন দোকানের ভেতর থেকে জোরে বললেন, " সমীরবাবু, একটাই আছে। দেব কি !"
আবার দু'জনে একসাথে বলে উঠল, "আমাকে দিন।"
সমীরবাবু সন্দিন্সু চোখে বললেন, "দু'জনে একটাই বই নেবে তো !"
এবার একসাথে নয়, মেয়েটি বললেন, " আমাকে একটা দিন।"
সঙ্গে ছেলেটি বললেন, "যেহেতু আমি আগে বলেছি, তাই বইটি আমাকে দেবেন।"
সমীরবাবু পড়লেন ঘোর সমস্যায় আর ছেলে মেয়ে দুটো জুড়ে দিল কলরব। হ্যাঁ, কলেজ স্ট্রিটে একটা 'হলুদ বসন্ত' আর দু'জনের কলরব।
অবশেষে বাধ্য হয়ে সমীরবাবু বললেন, " অন্য দোকানগুলো একবার দেখে এসো, অন্য দোকানে যদি আর একটা পাওয়া যায়। "
ছেলেটি সমীরবাবুর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বললেন, " অন্য কোনো দোকানে নেই, আমি সব কটা স্টল ঘুরেই এখানে এসেছি।"
মেয়েটি ছেলেটিকে সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ করে নরম সুরে বললেন, " তাহলে অনলাইনে কিনে নাও প্লিজ ...... একটাই তো বই, আমি নি প্লিজ......"
ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে বললেন, " সেটি হচ্ছে না ম্যাডাম। আমি আগে বলেছি তাই বইটি আমিই নেব। আর অনলাইনে বইটি 'আউট অফ স্টক' ... আমি দেখেছিলাম। তাছাড়া, আপনি অনলাইনে নিন না..!
মেয়েটি ভেবেছিলো ছেলেটিকে একটু নরম সুরে বললেই হয়ত অন্য পাঁচ জনের মতো গলে যাবে কিন্তু ছেলেটি গললোই না। মেয়েটি মনে মনে ভাবলো, " কি ঝগরুটে ছেলে রে বাবা !" কিন্তু মেয়েটিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় তাই সে ছেলেটির দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, " আমি আগে বলেছি, আপনি নন। তাই বইটি আমার প্রাপ্য। " তারপর সমীরবাবুকে বললেন, " দাদা, বইটি আমাকে দিন।" কিন্তু ছেলেটিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। চলতে থাকলো আবার তর্ক যুদ্ধ .......... ।
অবশেষে বাধ্য হয়ে সমীরবাবু বললেন, " তাহলে একটা কাজ করো, এই একটা বই তোমরা ফিফটি ফিফটি করে নাও। তুমি এক সপ্তাহ রাখবে আর তার পরের সপ্তাহ আরেকজন রাখবে।"
দু'জনে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, " তাহলে কে আগে রাখবে ?"
সমীরবাবু একটু সমস্যায় পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, "লেডিস ফার্স্ট। " মেয়েটির দিকে বইটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, " তুমি প্রথমে নেবে" ।
মেয়েটি মনে মনে খুশি হলেও এটা ভেবে একটু দুঃখ হলো যে এক সপ্তাহ পরে আবার ছেলেটিকে দিয়ে দিতে হবে। যাই হোক, নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো।
মেয়েটির ভাবনায় ঢিল ছুড়ে ছেলেটি বললেন, " আপনার নম্বরটা দেবেন। এক সপ্তাহ পরে কাজে লাগবে।" মেয়েটি নম্বরটা দিল। ছেলেটি শক্ত কন্ঠে বললেন, " কি নামে সেভ করবো ?" মেয়েটিও একইভাবে বললেন, " সুদীপ্তা, সুদীপ্তা সেন।" ছেলেটি নম্বরটি সেভ করে বললেন, " মিসডকল দিচ্ছি, আমার শেষে আটত্রিশ।" মেয়েটির ফোনে একটু রবীন্দ্র সংগীত বেজেই বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটি বললো, " আপনার নামটি কি নামে সেভ করবো ?" ছেলেটি বললো, " সঞ্জু, সঞ্জু রায়।"
তারপর দু'জনে মিলে টাকা শোধ করে বেরিয়ে পড়লেন দু'দিকে।
চলুন,আপনাদের সঙ্গে সুদীপ্তা আর সঞ্জু'র পরিচয় করিয়ে দি ।
সুদীপ্তা সেন, দেখতে বেশ সুন্দর। ছিমছিমে চেয়ারার মধ্যেও শরীরের গঠন একদম পারফেক্ট। চোখ দুটো অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো, টানা টানা। ঐ চোখে একরাশ ভালোবাসা আছে। জীবনে বহু প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে কিন্তু কখনও কোনো প্রস্তাব গ্রহন করেননি। এটা ওর অহংকার নয়। ও সবসময় চাই, এমন একটা ছেলে যার দেখতে সুন্দর না হলেও চলবে তবে মনটা যেন খুব সুন্দর হয় যেন তার হৃদয় জুড়ে শুধুই সুদীপ্তার বসবাস। আর একটা বিশেষ দাবি আছে সুদীপ্তা'র , ছেলেটি যেন গান গাইতে পারে।
আর অন্যদিকে সঞ্জু রায় দেখতে মুটামুটি। না বিশাল সুন্দর নয়। সামান্য রঙে চাপা তবে চোখ মুখের গঠনটা খুব সুন্দর। সঞ্জু হাসলে দুটো গজ দাঁত ওকে সৌন্দর্যের অন্য মাত্রায় নিয়ে যাই। তবে হ্যাঁ, সঞ্জু কখনও প্রেমে পড়েনি, মেয়েদের দিকে কখনও ফিরেও তাকায় না। পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, অবসরে গান শুনতে খুব পছন্দ করে। আর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য , সঞ্জু মায়ের খুব বাধ্য ছেলে।
আরও বেশ কয়েকটি বই কিনে সঞ্জু ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছে। ঘন্টা দুয়ের রাস্তা। রবীন্দ্রনাথের 'চোখের বালি', 'শেষের কবিতা' বর্তমানের লেখক সায়ক আমানের 'ভাসান বাড়ি' অর্পিতা সরকারের 'অনুভবে তুমি' সহ মোট বারোটি বই কিনেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু বই আছে যা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রেম, জীবনে সবার আসে। একটা সময় পরে মনে হয়, মা বাবা ছাড়াও জীবনে আরও একটা মানুষ থাকা খুব প্রয়োজন যে মানুষটার সাথে সেইসব কথা শেয়ার করতে পারব যেগুলো মা বাবার সাথে বলা যাই না। হয়ত একটা মানুষ থাকাটা সত্যি খুব প্রয়োজন যে মানুষটা বিপদে বন্ধুর মতো পাশে থাকবে, হাত বাড়িয়ে দেবে, একটু একটু ভালোবাসার মন্ত্র উচ্চারণ শেখাবে। হয়ত এটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর এর সূত্রপাত, প্রেমের উপন্যাস, ভালোবাসার উপন্যাস পড়ে। হয়ত সঞ্জু বা সুদীপ্তা এই পথেই হেঁটে চলছে।
হঠাৎই সঞ্জুর ফোনটা বেজে উঠল। মায়ের ফোন .....
-- কি ব্যপার ! কোথায় আছিস এখন ?
-- এই তো মা, ট্রেনে আছি। এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে, সাতটার মধ্যে পৌঁচ্ছে যাব।
-- ঠিক আছে। সাবধানে আয়। রাখছি।
মায়ের ফোনটা রাখতেই সঞ্জুর মনে হল, এই সময়টা যদি একটা প্রেমিকা থাকত তাহলে গল্প করতে করতে যেতে পারতাম। কত গল্প, কত আবেগ, সব এক নিমেশে বলে দিতাম। এসব ভাবতে ভাবতে সঞ্জু চোখটা বন্ধ করলো। জানালার ধারে বসেছে। বাইরের ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস সঞ্জুর ফুসফুসের প্রতিটি প্রেম কণাকে যেন চাঙ্গা করে তুললো। দু'চোখ বুজতেই ভেসে উঠল, কলেজ স্ট্রিটের সেই কলরব। কথা কাটাকাটি, তর্ক, ঝগড়া ....... । সঞ্জুর হাসি পেল আবার খারাপও লাগলো। কত'টা নীচ মানসিকতার কাজ করলো আজকে ও। আচ্ছা, এ কথা মাকে বললে, মা কি খুব বকবে...! হয়ত বকবে ....! না থাক, মাকে বলব না। সত্যি তো, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে তো অনলাইনে আবার পাওয়া যেত । তাহলে .......
আচ্ছা, সঞ্জু তো বাড়িতে মা'কে কখনও মিথ্যা বলেনি তাহলে আজ কেন এত সহজে এ কথা মাকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিল !
এত কেন প্রশ্নের সঠিক উত্তর একটাও সঞ্জুর কাছে নেই। সঞ্জু, এসব কি ভাবছে, বাধ্য হয়ে সঞ্জু চোখটা খুললো। ট্রেনে ভীড়টা অনেক কমেছে। সঞ্জু হেড ফোনটা বের করে কানে গুঁজে আবার চোখ বুজে 'প্রেম ডট কম' শুনতে শুনতে যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেল। যেখানে শুধু প্রেম, প্রেমিক আর প্রেমিকা ..... সবাই যেন ওর দিকে তাকিয়ে বলছে, 'তুমিও আমাদের দলে বারবার ...... ', 'আবার কেউ বলছে, 'প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ ..... '। একটা আতঙ্কের সঙ্গেই সঞ্জু চোখটা খুলে দেখলো ট্রেন মধ্যমপুর স্টশনে। আর একটা স্টেশন পরেই টাকি যেখানে সঞ্জু নামবে। তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিল সঞ্জু।
ট্রেন থেকে নেমে টোটো ধরে বাড়ি ফিরলো সঞ্জু।
হাত মুখ ধুয়ে, খাওয়া দাওয়া করে, একটু গল্পগুজব করে সঞ্জু বিছানায় গেল। কিন্তু সত্যি সত্যি একটা কথা মাকে গোপন করে গেল। এমনটা আগে কখনও করিনি সঞ্জু।
অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করেও যখন ঘুমের বদলে শুধু কলেজ স্ট্রিটের ঘটনা ভেসে উঠছে, ভেসে উঠছে একটা মিষ্টি মুখ, সেই কাজল কালো চোখ, সেই কন্ঠ সেই নাম সুদীপ্তা। সঞ্জুর ভাবতে ভালো লাগছে, কিন্তু ও ভাবতে চাইছে না। তবুও বারবার যেন সেই নরম কন্ঠে, ' প্লিজ ..... '। এই মুহুর্তে সঞ্জু ঠিক কি করবে বুঝতে না পেরে, জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘড়িতে এগারোটা বাজলো। কিন্তু ঘুম তো এলো না বরং মনে পড়লো সেই ফোন নম্বর। সঞ্জু তাড়াতাড়ি ফোনটা আনলক করে দেখলো ঐ নম্বরে কোনো WhatsApp আছে কিনা। হ্যাঁ, আছে। ডিপিটা সুদীপ্তা'র । সঞ্জু অনেকক্ষণ ধরে দেখলো ডিপিটা। তারপর মুচকি একটা হাসি। লাস্ট সিন, দশটা দুই। আরও কি সব ভাবতে ভাবতে সঞ্জু ঘুমিয়ে পড়লো।
পরের দিন মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। ফোনটা আনলক করতেই প্রথমেই সুদীপ্তা'র সেই ডিপিটা। মা বেড টি দিয়ে বললো, " অনেকবেলা হয়ে গেছে। গুছিয়ে এসো, সকালের জল খাবার টেবিলে রাখা আছে খেয়ে নাও।" সঞ্জুর আবার খারাপ লাগলো কালকে সুদীপ্তা'র সাথে ঐ ব্যবহারে। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলো আজ সরি বলে দেবে। কিন্তু কীভাবে বলবে, WhatsApp এ বলবে না হয় ....... এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সকালের খাবার খেতে বসলো। আবার চেক করে দেখলো সুদীপ্তা'র লাস্ট সিন নয়টা পনেরো। মাত্র কয়েক মিনিট আগে ..... এই সুযোগ, সঞ্জু এস এম এস করলো,
-- সরি, সরি
কিছুক্ষণ পর সুদীপ্তা (আবাক করা) ইমোজি দিয়ে লিখলো,
-- কেন ?
-- গতকাল আপনার সঙ্গে অত ভীড়ের মধ্যে অমনটা করা উচিত হয়নি।
সুদীপ্তা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়েই লজ্জার ইমোজি পাঠাল। তারপর লিখলো,
-- ইট'স ওকে। এখন কলেজ যাব পরে কথা হবে।
-- আপনার কোন কলেজ ?
প্রশ্নটা করে সঞ্জু বারবার ফোটা চেক করলো দুটো নীল দাগের জন্য। প্রায় তিরিশ মিনিট পর উত্তর এলো,
-- প্রথমত বলি, আপনি করে বলার প্রয়োজন নেই। আর দ্বিতীয়ত, আমার প্রেসিডেন্সি কলেজ
সঞ্জু ভাবলো, সুদীপ্তা ওকে হয়ত এই প্রশ্নটাই পাল্টা করবে কিন্তু করলো না। তখন বাধ্য হয়ে সঞ্জু লিখলো,
-- আমার টাকি গর্ভমেন্ট কলেজ, ফিজিক্স অনার্স থার্ড ইয়ার করছি।
-- আচ্ছা বেশ।
-- তোমার বিষয় কি ?
-- জিওগ্রাফি, থার্ড ইয়ার চলছে আমারও।
সঞ্জু দুটো হাসির ইমোজি পাঠিয়ে লিখলো,
-- বাহ্ দারুন তো !
সঞ্জু লিখে আবার ডিলিট করে দিল, তুমি কি কলেজ পৌঁচ্ছেছো ?
বেশি কথা বললো না সঞ্জু। একাবারে বেশি কথা বললে ভাববে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
আচ্ছা, সঞ্জু, সুদীপ্তা সম্পর্কে জানতে এতটা আগ্রহী কেন ? সঞ্জু কি তাহলে সুদীপ্তার উপর দূর্বল হয়ে পড়ছে ! কেন জানে না সঞ্জু, তবে ওর মধ্যে যেন কেমন একটা ফিল হচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না, ধরতে পারছে না সেই অনুভূতিটা। আচ্ছা, প্রেমে পড়লে কি এমনটা হয় ! মাকে জিজ্ঞাসা করবে ! না থাক, এসব বোধ হয় মাকে বলতে নেই।
এরপরে আরও অনেক কথা হয়েছিল সঞ্জুর, সুদীপ্তা'র সাথে। সুদীপ্তার পছন্দ, অপছন্দ, ভালো লাগা সবকিছু গল্পে গল্পে সঞ্জু জেনে নিয়েছিল। সুদীপ্তাও কিছু কিছু জেনে নিয়েছিল পাল্টা প্রশ্ন করে। সুদীপ্তা কলকাতার দক্ষিণে কোথাও থাকে, এমনটাই বলেছিল সঞ্জুকে। কিন্তু সুদীপ্তা হোস্টেলে থাকে বলেছিল। বাড়িতে মাসে একবার যাই। আর সঞ্জুর ঠিকানাও জানতে চেয়েছিল।
এভাবেই এক সপ্তাহ পূর্ণ হল। দু'জনের পুনরায় দেখা হল একটা পার্কে।
বই বিনিময়ের পাশাপাশি দু'জনের আরও কিছুটা গল্প হল। পরিচয় হল আরও খানিকটা। অবশেষে দু'জন ভালো বন্ধু হল। কিন্তু সঞ্জু্র মনে হল, আর কবে দেখা হবে আমাদের ? এমনকি মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো প্রশ্নটা। একটা ভয় কাজ করছে সঞ্জুর, যদি আর দেখা না হয়। প্রশ্নটা সুদীপ্তা কি শুনতে পাইনি ! একটু ভাবলো সঞ্জু। সঞ্জু এটুকু বুঝতে পারলো, সুদীপ্তা ওর একটা বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে, এই ক'দিনে। সুদীপ্তা চলে গেল। সঞ্জু একা, হঠাৎ মনে হল, এই পৃথিবীতে এই মুহুর্তে ও সম্পূর্ণ একা । একটু আগে কেন এমনটা মনে হয়নি !
বেশ কয়েকদিন ধরে, সঞ্জু নিজে থেকেই প্রথমে এস এম এস করছে। সুদীপ্তা রিপ্লাই দেয় প্রতিটি এস এম এসে কিন্তু নিজে খুব একটা প্রশ্ন করে না। সঞ্জুর একটা গান গাইতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, 'একবার বল নেই, তোর কেউ নেই, কেউ নেই।' সঞ্জু হঠাৎ ভাবলো, আচ্ছা, সুদীপ্তা নিজে খুব একটা এস এম এস করে না কেন ? সুদীপ্তা কি আগে কারোর সঙ্গে সম্পর্কে ছিল ? কিন্তু নিজেই নিজের মনকে বুঝ দিল।
একদিন হঠাৎ, সঞ্জু অনেক সাহস নিয়ে লিখেই ফেলো,
-- তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল ?
-- কি কথা ?
-- কীভাবে বলি বলো তো !
-- মনের কথা চেপে রেখো না। কষ্ট হবে।
-- তাহলি বলি বরং .....
অল্প কিছুক্ষণ পর সঞ্জু আবার লিখলো,
-- আগে বলো, কখনও বন্ধুত্ব নষ্ট করবে না ।
-- আচ্ছা বেশ। তাই হবে। বলো দেখি, কি বলবে। এত কথা আদায় করা উচিত নয়।
-- সরি, বলছি এবার .....
আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। বিশ্বাস করো, এই প্রথমবার আমি অনুভব করতে পারলাম যে আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।
সঞ্জুর বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো,
-- বন্ধু হয়ে পাশে থাকবো, কথা দিলাম।
অগত্যা বাধ্য হয়েই সঞ্জু লিখলো,
-- বেশ তাই হোক। আমার ভালোবাসা অপেক্ষার আন্তরালে থেকে যাক।
মানুষ প্রথম প্রেমে পড়ে ছাঁকা খেলে কবিতা লেখে আর কবি হয়। এতদিনে সঞ্জু এসব মানত না। সঞ্জুও কিন্তু এখন কবিতা লেখে। একবার তো সুদীপ্তা'কে সত্যি সত্যি পাঠিয়ে দিল,
'আমার নাছোড়বান্দা প্রেমকণাগুলো ফুসফুস শ্বাসরুদ্ধ করতে চাইছে
ভেঙে পড়ে যেতে চাইছে আমার সেই স্বপ্নের তাসের ঘর
লুটোপুটি খাচ্ছে, একদল বিচ্ছিরি রকমের এলোপাথারি রং মাখা স্বপ্ন
ভুলে যেতে বসেছে এই পৃথিবীতে কে বা আপন আর কে বা পর !
......... '
এক মাস খানেক কেটে গেল। প্রতিনিয়ত কথা হয় সঞ্জুর সাথে সুদীপ্তার। কখনও প্রসঙ্গ 'হলুদ বসন্ত' কখনও 'ভাসান বাড়ি' আবার কখনও 'চোখের বালি' আবার কখনও সুদীপ্তার প্রিয় দেবদাস', 'পল্লীসমাজ' ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতদিনে সুদীপ্তা অনুভব করলো, ও যেন সঞ্জুকে ভালোবেসে ফেলছে। ও আগে বহু প্রেমের প্রস্তাব পেলেও কখনও তারপরে সেই ছেলের সঙ্গে আর কথা বলেনি। কিন্তু কেন জানে না সুদীপ্তা, সঞ্জুর সাথে এত কথা কেন বলছে ? ও যেন ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে সঞ্জুর উপরে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। একদিন, সঞ্জু যখন আবার সেই পার্কে দেখা করার কথা বলে সুদীপ্তা সাত পাঁচ না ভেবেই রাজি হয়ে যায়। আচ্ছা, এজন্যই, সবাই বলে, প্রেমে পড়লে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। সুদীপ্তা অনুভব করলো, ও স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বার দেখা হল, সঞ্জু আর সুদীপ্তা'র সেই পার্কে......
আজ আর আদ্যপান্থ না ভেবে সঞ্জু বলেই বসলো, " আমি তোকে খুব ভালোবেসে ফেলছি। প্লিজ না বলিস না। আমার বিশ্বাস তুইও আমাকে ভালোবাসিস। একটু চোখটা বন্ধ কর, দেখ প্রথমে আমার ছবিই তোর মনের দর্পনে দেখতে পাবি।
সুদীপ্তা চোখ বন্ধ করলো। সত্যি তাই, সঞ্জু ঠিক বলেছে।
এতদিনে আপনি থেকে তুমি থেকে ওদের সম্পর্ক এখন তুই তে নেমেছে।
তারপর এক সঙ্গে রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল, কত গল্প, কত পার্ক যে তারা ঘুরলো এই একটা বছরে তার শেষ নেই। একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা, এই ছাতার তলায় বসে গল্প করা।
একদিন হঠাৎ সুদীপ্তার মনে হল, ওর সাথে সঞ্জুর মতের বহু অমিল। হয়ত এই সম্পর্কটা একপ্রকার জোরপূর্বক বা কম বুদ্ধির ফসল। তাই বাধ্য হয়েই সুদীপ্তা সঞ্জুকে লিখলো,
-- একটা কথা বলছি, কিছু মনে করিস না। আমার মনে এই সম্পর্কটা বেশি দূর এগোনোটা ঠিক হবে না। আমার আর তোর সব বিষয়ে মতের সম্পূর্ণ অমিল। আর সেইজন্যই, তুই আমাকে মাঝে মাঝে আমার ড্রেস সাজেস্ট করিস, তোর পছন্দ চুরিদার আর আমার পছন্দ জিন্স টপ, তোর পছন্দ লাল লিপস্টিক কিন্তু আমার পছন্দ হালকা গোলাপি, আর পছন্দ গান, আমার পছন্দ গায়ক, তুই আনন্দ , আড্ডা পছন্দ করিস না, কিন্তু আমি এগুলো পছন্দ করি। তোর চোখে এগুলো খারাপ হতে পারে কিন্তু আমার চোখে এগুলো ভালো লাগা। তোর জন্য আমি আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে পারবো না। আমি নিজেকে ভেঙে চুরমার করতে পারবো না। আমি আর পেরে উঠছি না সঞ্জু। আর পেরে উঠছি না, হাফিয়ে যাচ্ছি তোর নির্দেশনায় চলতে চলতে ..... আমারও তো একটু মুক্তি চাই বল। আমি দু'জনের ভালোর জন্য বলছি, দুটো মানুষের মনের মিল না থাকলে কখনও জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া যাই না। প্লিজ, কিছু মনে করিস না। আজ বাধ্য হয়ে দূরত্ব চাইছি।
সঞ্জু আর কিছুই বলতে পারলো না। শুধু চোখ থেকে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে এলো চিবুকের কাছে। একটা কথা লিখেও মুছে দিল,' কিছুই কি করা যাই না সুদীপ্তা ! '
এ প্রশ্নের উত্তর সঞ্জুর জানা। সঞ্জু'র এখন নিজেকে ভেঙে চুরমার করে নিজের খারাপ লাগাগুলোকে ভালো লাগাতে হবে। সেটা কি সঞ্জু পারবে নাকি সেটা ঠিক কাজ হবে ! সঞ্জু কিছু জানে না, তবে এটুকু জানে, 'ভালোবাসা - ভালোবাসি' খেলায় যন্ত্রণাটা একটা শেষ পদক্ষেপের মতো। এটাকে টপকাতে পারলে তুমি জিতে যাবে আর না পারলে নিঃসঙ্গতা তোমায় ভালোবাসবে। রবী ঠাকুরের একটা গান সঞ্জুর মনে পড়লো,
" সখী , ভাবনা কাহারে বলে ।
সখী , যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ,
'ভালোবাসা' 'ভালোবাসা'---
সখী, ভালোবাসা কারে কয় !
সে কি কেবলই যাতনাময় ।....."
দোকানদার আর একজনের অর্পিতা সরকারের গোয়েন্দা উপন্যাস 'ট্রাফিক সিগন্যাল' দিতে দিতে একটু ব্যস্ততার সাথেই বললেন, "আছে, বোধ হয়। রথিন, ভেতরে দেখ তো বুদ্ধবাবুর 'হলুদ বসন্ত' আছে কিনা !"
সহকর্মী রথিন দোকানের ভেতর থেকে জোরে বললেন, " সমীরবাবু, একটাই আছে। দেব কি !"
আবার দু'জনে একসাথে বলে উঠল, "আমাকে দিন।"
সমীরবাবু সন্দিন্সু চোখে বললেন, "দু'জনে একটাই বই নেবে তো !"
এবার একসাথে নয়, মেয়েটি বললেন, " আমাকে একটা দিন।"
সঙ্গে ছেলেটি বললেন, "যেহেতু আমি আগে বলেছি, তাই বইটি আমাকে দেবেন।"
সমীরবাবু পড়লেন ঘোর সমস্যায় আর ছেলে মেয়ে দুটো জুড়ে দিল কলরব। হ্যাঁ, কলেজ স্ট্রিটে একটা 'হলুদ বসন্ত' আর দু'জনের কলরব।
অবশেষে বাধ্য হয়ে সমীরবাবু বললেন, " অন্য দোকানগুলো একবার দেখে এসো, অন্য দোকানে যদি আর একটা পাওয়া যায়। "
ছেলেটি সমীরবাবুর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বললেন, " অন্য কোনো দোকানে নেই, আমি সব কটা স্টল ঘুরেই এখানে এসেছি।"
মেয়েটি ছেলেটিকে সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ করে নরম সুরে বললেন, " তাহলে অনলাইনে কিনে নাও প্লিজ ...... একটাই তো বই, আমি নি প্লিজ......"
ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে বললেন, " সেটি হচ্ছে না ম্যাডাম। আমি আগে বলেছি তাই বইটি আমিই নেব। আর অনলাইনে বইটি 'আউট অফ স্টক' ... আমি দেখেছিলাম। তাছাড়া, আপনি অনলাইনে নিন না..!
মেয়েটি ভেবেছিলো ছেলেটিকে একটু নরম সুরে বললেই হয়ত অন্য পাঁচ জনের মতো গলে যাবে কিন্তু ছেলেটি গললোই না। মেয়েটি মনে মনে ভাবলো, " কি ঝগরুটে ছেলে রে বাবা !" কিন্তু মেয়েটিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় তাই সে ছেলেটির দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, " আমি আগে বলেছি, আপনি নন। তাই বইটি আমার প্রাপ্য। " তারপর সমীরবাবুকে বললেন, " দাদা, বইটি আমাকে দিন।" কিন্তু ছেলেটিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। চলতে থাকলো আবার তর্ক যুদ্ধ .......... ।
অবশেষে বাধ্য হয়ে সমীরবাবু বললেন, " তাহলে একটা কাজ করো, এই একটা বই তোমরা ফিফটি ফিফটি করে নাও। তুমি এক সপ্তাহ রাখবে আর তার পরের সপ্তাহ আরেকজন রাখবে।"
দু'জনে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, " তাহলে কে আগে রাখবে ?"
সমীরবাবু একটু সমস্যায় পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, "লেডিস ফার্স্ট। " মেয়েটির দিকে বইটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, " তুমি প্রথমে নেবে" ।
মেয়েটি মনে মনে খুশি হলেও এটা ভেবে একটু দুঃখ হলো যে এক সপ্তাহ পরে আবার ছেলেটিকে দিয়ে দিতে হবে। যাই হোক, নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো।
মেয়েটির ভাবনায় ঢিল ছুড়ে ছেলেটি বললেন, " আপনার নম্বরটা দেবেন। এক সপ্তাহ পরে কাজে লাগবে।" মেয়েটি নম্বরটা দিল। ছেলেটি শক্ত কন্ঠে বললেন, " কি নামে সেভ করবো ?" মেয়েটিও একইভাবে বললেন, " সুদীপ্তা, সুদীপ্তা সেন।" ছেলেটি নম্বরটি সেভ করে বললেন, " মিসডকল দিচ্ছি, আমার শেষে আটত্রিশ।" মেয়েটির ফোনে একটু রবীন্দ্র সংগীত বেজেই বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটি বললো, " আপনার নামটি কি নামে সেভ করবো ?" ছেলেটি বললো, " সঞ্জু, সঞ্জু রায়।"
তারপর দু'জনে মিলে টাকা শোধ করে বেরিয়ে পড়লেন দু'দিকে।
চলুন,আপনাদের সঙ্গে সুদীপ্তা আর সঞ্জু'র পরিচয় করিয়ে দি ।
সুদীপ্তা সেন, দেখতে বেশ সুন্দর। ছিমছিমে চেয়ারার মধ্যেও শরীরের গঠন একদম পারফেক্ট। চোখ দুটো অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো, টানা টানা। ঐ চোখে একরাশ ভালোবাসা আছে। জীবনে বহু প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে কিন্তু কখনও কোনো প্রস্তাব গ্রহন করেননি। এটা ওর অহংকার নয়। ও সবসময় চাই, এমন একটা ছেলে যার দেখতে সুন্দর না হলেও চলবে তবে মনটা যেন খুব সুন্দর হয় যেন তার হৃদয় জুড়ে শুধুই সুদীপ্তার বসবাস। আর একটা বিশেষ দাবি আছে সুদীপ্তা'র , ছেলেটি যেন গান গাইতে পারে।
আর অন্যদিকে সঞ্জু রায় দেখতে মুটামুটি। না বিশাল সুন্দর নয়। সামান্য রঙে চাপা তবে চোখ মুখের গঠনটা খুব সুন্দর। সঞ্জু হাসলে দুটো গজ দাঁত ওকে সৌন্দর্যের অন্য মাত্রায় নিয়ে যাই। তবে হ্যাঁ, সঞ্জু কখনও প্রেমে পড়েনি, মেয়েদের দিকে কখনও ফিরেও তাকায় না। পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, অবসরে গান শুনতে খুব পছন্দ করে। আর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য , সঞ্জু মায়ের খুব বাধ্য ছেলে।
আরও বেশ কয়েকটি বই কিনে সঞ্জু ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছে। ঘন্টা দুয়ের রাস্তা। রবীন্দ্রনাথের 'চোখের বালি', 'শেষের কবিতা' বর্তমানের লেখক সায়ক আমানের 'ভাসান বাড়ি' অর্পিতা সরকারের 'অনুভবে তুমি' সহ মোট বারোটি বই কিনেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু বই আছে যা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রেম, জীবনে সবার আসে। একটা সময় পরে মনে হয়, মা বাবা ছাড়াও জীবনে আরও একটা মানুষ থাকা খুব প্রয়োজন যে মানুষটার সাথে সেইসব কথা শেয়ার করতে পারব যেগুলো মা বাবার সাথে বলা যাই না। হয়ত একটা মানুষ থাকাটা সত্যি খুব প্রয়োজন যে মানুষটা বিপদে বন্ধুর মতো পাশে থাকবে, হাত বাড়িয়ে দেবে, একটু একটু ভালোবাসার মন্ত্র উচ্চারণ শেখাবে। হয়ত এটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর এর সূত্রপাত, প্রেমের উপন্যাস, ভালোবাসার উপন্যাস পড়ে। হয়ত সঞ্জু বা সুদীপ্তা এই পথেই হেঁটে চলছে।
হঠাৎই সঞ্জুর ফোনটা বেজে উঠল। মায়ের ফোন .....
-- কি ব্যপার ! কোথায় আছিস এখন ?
-- এই তো মা, ট্রেনে আছি। এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে, সাতটার মধ্যে পৌঁচ্ছে যাব।
-- ঠিক আছে। সাবধানে আয়। রাখছি।
মায়ের ফোনটা রাখতেই সঞ্জুর মনে হল, এই সময়টা যদি একটা প্রেমিকা থাকত তাহলে গল্প করতে করতে যেতে পারতাম। কত গল্প, কত আবেগ, সব এক নিমেশে বলে দিতাম। এসব ভাবতে ভাবতে সঞ্জু চোখটা বন্ধ করলো। জানালার ধারে বসেছে। বাইরের ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস সঞ্জুর ফুসফুসের প্রতিটি প্রেম কণাকে যেন চাঙ্গা করে তুললো। দু'চোখ বুজতেই ভেসে উঠল, কলেজ স্ট্রিটের সেই কলরব। কথা কাটাকাটি, তর্ক, ঝগড়া ....... । সঞ্জুর হাসি পেল আবার খারাপও লাগলো। কত'টা নীচ মানসিকতার কাজ করলো আজকে ও। আচ্ছা, এ কথা মাকে বললে, মা কি খুব বকবে...! হয়ত বকবে ....! না থাক, মাকে বলব না। সত্যি তো, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে তো অনলাইনে আবার পাওয়া যেত । তাহলে .......
আচ্ছা, সঞ্জু তো বাড়িতে মা'কে কখনও মিথ্যা বলেনি তাহলে আজ কেন এত সহজে এ কথা মাকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিল !
এত কেন প্রশ্নের সঠিক উত্তর একটাও সঞ্জুর কাছে নেই। সঞ্জু, এসব কি ভাবছে, বাধ্য হয়ে সঞ্জু চোখটা খুললো। ট্রেনে ভীড়টা অনেক কমেছে। সঞ্জু হেড ফোনটা বের করে কানে গুঁজে আবার চোখ বুজে 'প্রেম ডট কম' শুনতে শুনতে যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেল। যেখানে শুধু প্রেম, প্রেমিক আর প্রেমিকা ..... সবাই যেন ওর দিকে তাকিয়ে বলছে, 'তুমিও আমাদের দলে বারবার ...... ', 'আবার কেউ বলছে, 'প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ ..... '। একটা আতঙ্কের সঙ্গেই সঞ্জু চোখটা খুলে দেখলো ট্রেন মধ্যমপুর স্টশনে। আর একটা স্টেশন পরেই টাকি যেখানে সঞ্জু নামবে। তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিল সঞ্জু।
ট্রেন থেকে নেমে টোটো ধরে বাড়ি ফিরলো সঞ্জু।
হাত মুখ ধুয়ে, খাওয়া দাওয়া করে, একটু গল্পগুজব করে সঞ্জু বিছানায় গেল। কিন্তু সত্যি সত্যি একটা কথা মাকে গোপন করে গেল। এমনটা আগে কখনও করিনি সঞ্জু।
অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করেও যখন ঘুমের বদলে শুধু কলেজ স্ট্রিটের ঘটনা ভেসে উঠছে, ভেসে উঠছে একটা মিষ্টি মুখ, সেই কাজল কালো চোখ, সেই কন্ঠ সেই নাম সুদীপ্তা। সঞ্জুর ভাবতে ভালো লাগছে, কিন্তু ও ভাবতে চাইছে না। তবুও বারবার যেন সেই নরম কন্ঠে, ' প্লিজ ..... '। এই মুহুর্তে সঞ্জু ঠিক কি করবে বুঝতে না পেরে, জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘড়িতে এগারোটা বাজলো। কিন্তু ঘুম তো এলো না বরং মনে পড়লো সেই ফোন নম্বর। সঞ্জু তাড়াতাড়ি ফোনটা আনলক করে দেখলো ঐ নম্বরে কোনো WhatsApp আছে কিনা। হ্যাঁ, আছে। ডিপিটা সুদীপ্তা'র । সঞ্জু অনেকক্ষণ ধরে দেখলো ডিপিটা। তারপর মুচকি একটা হাসি। লাস্ট সিন, দশটা দুই। আরও কি সব ভাবতে ভাবতে সঞ্জু ঘুমিয়ে পড়লো।
পরের দিন মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। ফোনটা আনলক করতেই প্রথমেই সুদীপ্তা'র সেই ডিপিটা। মা বেড টি দিয়ে বললো, " অনেকবেলা হয়ে গেছে। গুছিয়ে এসো, সকালের জল খাবার টেবিলে রাখা আছে খেয়ে নাও।" সঞ্জুর আবার খারাপ লাগলো কালকে সুদীপ্তা'র সাথে ঐ ব্যবহারে। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলো আজ সরি বলে দেবে। কিন্তু কীভাবে বলবে, WhatsApp এ বলবে না হয় ....... এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সকালের খাবার খেতে বসলো। আবার চেক করে দেখলো সুদীপ্তা'র লাস্ট সিন নয়টা পনেরো। মাত্র কয়েক মিনিট আগে ..... এই সুযোগ, সঞ্জু এস এম এস করলো,
-- সরি, সরি
কিছুক্ষণ পর সুদীপ্তা (আবাক করা) ইমোজি দিয়ে লিখলো,
-- কেন ?
-- গতকাল আপনার সঙ্গে অত ভীড়ের মধ্যে অমনটা করা উচিত হয়নি।
সুদীপ্তা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়েই লজ্জার ইমোজি পাঠাল। তারপর লিখলো,
-- ইট'স ওকে। এখন কলেজ যাব পরে কথা হবে।
-- আপনার কোন কলেজ ?
প্রশ্নটা করে সঞ্জু বারবার ফোটা চেক করলো দুটো নীল দাগের জন্য। প্রায় তিরিশ মিনিট পর উত্তর এলো,
-- প্রথমত বলি, আপনি করে বলার প্রয়োজন নেই। আর দ্বিতীয়ত, আমার প্রেসিডেন্সি কলেজ
সঞ্জু ভাবলো, সুদীপ্তা ওকে হয়ত এই প্রশ্নটাই পাল্টা করবে কিন্তু করলো না। তখন বাধ্য হয়ে সঞ্জু লিখলো,
-- আমার টাকি গর্ভমেন্ট কলেজ, ফিজিক্স অনার্স থার্ড ইয়ার করছি।
-- আচ্ছা বেশ।
-- তোমার বিষয় কি ?
-- জিওগ্রাফি, থার্ড ইয়ার চলছে আমারও।
সঞ্জু দুটো হাসির ইমোজি পাঠিয়ে লিখলো,
-- বাহ্ দারুন তো !
সঞ্জু লিখে আবার ডিলিট করে দিল, তুমি কি কলেজ পৌঁচ্ছেছো ?
বেশি কথা বললো না সঞ্জু। একাবারে বেশি কথা বললে ভাববে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
আচ্ছা, সঞ্জু, সুদীপ্তা সম্পর্কে জানতে এতটা আগ্রহী কেন ? সঞ্জু কি তাহলে সুদীপ্তার উপর দূর্বল হয়ে পড়ছে ! কেন জানে না সঞ্জু, তবে ওর মধ্যে যেন কেমন একটা ফিল হচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না, ধরতে পারছে না সেই অনুভূতিটা। আচ্ছা, প্রেমে পড়লে কি এমনটা হয় ! মাকে জিজ্ঞাসা করবে ! না থাক, এসব বোধ হয় মাকে বলতে নেই।
এরপরে আরও অনেক কথা হয়েছিল সঞ্জুর, সুদীপ্তা'র সাথে। সুদীপ্তার পছন্দ, অপছন্দ, ভালো লাগা সবকিছু গল্পে গল্পে সঞ্জু জেনে নিয়েছিল। সুদীপ্তাও কিছু কিছু জেনে নিয়েছিল পাল্টা প্রশ্ন করে। সুদীপ্তা কলকাতার দক্ষিণে কোথাও থাকে, এমনটাই বলেছিল সঞ্জুকে। কিন্তু সুদীপ্তা হোস্টেলে থাকে বলেছিল। বাড়িতে মাসে একবার যাই। আর সঞ্জুর ঠিকানাও জানতে চেয়েছিল।
এভাবেই এক সপ্তাহ পূর্ণ হল। দু'জনের পুনরায় দেখা হল একটা পার্কে।
বই বিনিময়ের পাশাপাশি দু'জনের আরও কিছুটা গল্প হল। পরিচয় হল আরও খানিকটা। অবশেষে দু'জন ভালো বন্ধু হল। কিন্তু সঞ্জু্র মনে হল, আর কবে দেখা হবে আমাদের ? এমনকি মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো প্রশ্নটা। একটা ভয় কাজ করছে সঞ্জুর, যদি আর দেখা না হয়। প্রশ্নটা সুদীপ্তা কি শুনতে পাইনি ! একটু ভাবলো সঞ্জু। সঞ্জু এটুকু বুঝতে পারলো, সুদীপ্তা ওর একটা বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে, এই ক'দিনে। সুদীপ্তা চলে গেল। সঞ্জু একা, হঠাৎ মনে হল, এই পৃথিবীতে এই মুহুর্তে ও সম্পূর্ণ একা । একটু আগে কেন এমনটা মনে হয়নি !
বেশ কয়েকদিন ধরে, সঞ্জু নিজে থেকেই প্রথমে এস এম এস করছে। সুদীপ্তা রিপ্লাই দেয় প্রতিটি এস এম এসে কিন্তু নিজে খুব একটা প্রশ্ন করে না। সঞ্জুর একটা গান গাইতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, 'একবার বল নেই, তোর কেউ নেই, কেউ নেই।' সঞ্জু হঠাৎ ভাবলো, আচ্ছা, সুদীপ্তা নিজে খুব একটা এস এম এস করে না কেন ? সুদীপ্তা কি আগে কারোর সঙ্গে সম্পর্কে ছিল ? কিন্তু নিজেই নিজের মনকে বুঝ দিল।
একদিন হঠাৎ, সঞ্জু অনেক সাহস নিয়ে লিখেই ফেলো,
-- তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল ?
-- কি কথা ?
-- কীভাবে বলি বলো তো !
-- মনের কথা চেপে রেখো না। কষ্ট হবে।
-- তাহলি বলি বরং .....
অল্প কিছুক্ষণ পর সঞ্জু আবার লিখলো,
-- আগে বলো, কখনও বন্ধুত্ব নষ্ট করবে না ।
-- আচ্ছা বেশ। তাই হবে। বলো দেখি, কি বলবে। এত কথা আদায় করা উচিত নয়।
-- সরি, বলছি এবার .....
আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। বিশ্বাস করো, এই প্রথমবার আমি অনুভব করতে পারলাম যে আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।
সঞ্জুর বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো,
-- বন্ধু হয়ে পাশে থাকবো, কথা দিলাম।
অগত্যা বাধ্য হয়েই সঞ্জু লিখলো,
-- বেশ তাই হোক। আমার ভালোবাসা অপেক্ষার আন্তরালে থেকে যাক।
মানুষ প্রথম প্রেমে পড়ে ছাঁকা খেলে কবিতা লেখে আর কবি হয়। এতদিনে সঞ্জু এসব মানত না। সঞ্জুও কিন্তু এখন কবিতা লেখে। একবার তো সুদীপ্তা'কে সত্যি সত্যি পাঠিয়ে দিল,
'আমার নাছোড়বান্দা প্রেমকণাগুলো ফুসফুস শ্বাসরুদ্ধ করতে চাইছে
ভেঙে পড়ে যেতে চাইছে আমার সেই স্বপ্নের তাসের ঘর
লুটোপুটি খাচ্ছে, একদল বিচ্ছিরি রকমের এলোপাথারি রং মাখা স্বপ্ন
ভুলে যেতে বসেছে এই পৃথিবীতে কে বা আপন আর কে বা পর !
......... '
এক মাস খানেক কেটে গেল। প্রতিনিয়ত কথা হয় সঞ্জুর সাথে সুদীপ্তার। কখনও প্রসঙ্গ 'হলুদ বসন্ত' কখনও 'ভাসান বাড়ি' আবার কখনও 'চোখের বালি' আবার কখনও সুদীপ্তার প্রিয় দেবদাস', 'পল্লীসমাজ' ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতদিনে সুদীপ্তা অনুভব করলো, ও যেন সঞ্জুকে ভালোবেসে ফেলছে। ও আগে বহু প্রেমের প্রস্তাব পেলেও কখনও তারপরে সেই ছেলের সঙ্গে আর কথা বলেনি। কিন্তু কেন জানে না সুদীপ্তা, সঞ্জুর সাথে এত কথা কেন বলছে ? ও যেন ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে সঞ্জুর উপরে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। একদিন, সঞ্জু যখন আবার সেই পার্কে দেখা করার কথা বলে সুদীপ্তা সাত পাঁচ না ভেবেই রাজি হয়ে যায়। আচ্ছা, এজন্যই, সবাই বলে, প্রেমে পড়লে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। সুদীপ্তা অনুভব করলো, ও স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বার দেখা হল, সঞ্জু আর সুদীপ্তা'র সেই পার্কে......
আজ আর আদ্যপান্থ না ভেবে সঞ্জু বলেই বসলো, " আমি তোকে খুব ভালোবেসে ফেলছি। প্লিজ না বলিস না। আমার বিশ্বাস তুইও আমাকে ভালোবাসিস। একটু চোখটা বন্ধ কর, দেখ প্রথমে আমার ছবিই তোর মনের দর্পনে দেখতে পাবি।
সুদীপ্তা চোখ বন্ধ করলো। সত্যি তাই, সঞ্জু ঠিক বলেছে।
এতদিনে আপনি থেকে তুমি থেকে ওদের সম্পর্ক এখন তুই তে নেমেছে।
তারপর এক সঙ্গে রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল, কত গল্প, কত পার্ক যে তারা ঘুরলো এই একটা বছরে তার শেষ নেই। একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা, এই ছাতার তলায় বসে গল্প করা।
একদিন হঠাৎ সুদীপ্তার মনে হল, ওর সাথে সঞ্জুর মতের বহু অমিল। হয়ত এই সম্পর্কটা একপ্রকার জোরপূর্বক বা কম বুদ্ধির ফসল। তাই বাধ্য হয়েই সুদীপ্তা সঞ্জুকে লিখলো,
-- একটা কথা বলছি, কিছু মনে করিস না। আমার মনে এই সম্পর্কটা বেশি দূর এগোনোটা ঠিক হবে না। আমার আর তোর সব বিষয়ে মতের সম্পূর্ণ অমিল। আর সেইজন্যই, তুই আমাকে মাঝে মাঝে আমার ড্রেস সাজেস্ট করিস, তোর পছন্দ চুরিদার আর আমার পছন্দ জিন্স টপ, তোর পছন্দ লাল লিপস্টিক কিন্তু আমার পছন্দ হালকা গোলাপি, আর পছন্দ গান, আমার পছন্দ গায়ক, তুই আনন্দ , আড্ডা পছন্দ করিস না, কিন্তু আমি এগুলো পছন্দ করি। তোর চোখে এগুলো খারাপ হতে পারে কিন্তু আমার চোখে এগুলো ভালো লাগা। তোর জন্য আমি আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে পারবো না। আমি নিজেকে ভেঙে চুরমার করতে পারবো না। আমি আর পেরে উঠছি না সঞ্জু। আর পেরে উঠছি না, হাফিয়ে যাচ্ছি তোর নির্দেশনায় চলতে চলতে ..... আমারও তো একটু মুক্তি চাই বল। আমি দু'জনের ভালোর জন্য বলছি, দুটো মানুষের মনের মিল না থাকলে কখনও জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া যাই না। প্লিজ, কিছু মনে করিস না। আজ বাধ্য হয়ে দূরত্ব চাইছি।
সঞ্জু আর কিছুই বলতে পারলো না। শুধু চোখ থেকে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে এলো চিবুকের কাছে। একটা কথা লিখেও মুছে দিল,' কিছুই কি করা যাই না সুদীপ্তা ! '
এ প্রশ্নের উত্তর সঞ্জুর জানা। সঞ্জু'র এখন নিজেকে ভেঙে চুরমার করে নিজের খারাপ লাগাগুলোকে ভালো লাগাতে হবে। সেটা কি সঞ্জু পারবে নাকি সেটা ঠিক কাজ হবে ! সঞ্জু কিছু জানে না, তবে এটুকু জানে, 'ভালোবাসা - ভালোবাসি' খেলায় যন্ত্রণাটা একটা শেষ পদক্ষেপের মতো। এটাকে টপকাতে পারলে তুমি জিতে যাবে আর না পারলে নিঃসঙ্গতা তোমায় ভালোবাসবে। রবী ঠাকুরের একটা গান সঞ্জুর মনে পড়লো,
" সখী , ভাবনা কাহারে বলে ।
সখী , যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ,
'ভালোবাসা' 'ভালোবাসা'---
সখী, ভালোবাসা কারে কয় !
সে কি কেবলই যাতনাময় ।....."
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৯/০১/২০২৩বেশ!
-
ফয়জুল মহী ১৬/০১/২০২৩খুব সুন্দর
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ১৬/০১/২০২৩দুর্দান্ত