www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মৃত্যু নাকি জীবন দর্শন

মাষ্টারমশাই আপনি হঠাৎ এখানে ?
ধীরে পায়ে থানায় প্রবেশ করলেন বড় বাবু শৈলানন্দ ব্যানার্জীর ছোটোবেলার শিক্ষক কৃষ্ণকান্ত রায়। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি কোনো বিশেষ কারণে খুব চিন্তিত। শৈলানন্দ চেয়ার ছেড়ে উঠে সামনে একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিয়ে আবার বললেন, " মাষ্টারমশাই আপনি হঠাৎ এখানে কেন ? কেমন আছেন ?" এবার চিন্তিত কৃষ্ণকান্ত বাবু উত্তর দিলেন, " তোমার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি, রাখবে ?" শৈলানন্দ একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, " এসব কি বলছেন মাষ্টারমশাই, অনুরোধ কেন, আদেশ করুন। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য ?" তারপর একটা কফির অর্ডার দিয়ে বললেন, " মনে হচ্ছে, আপনি খুব ভালো নেই। কি হয়েছে বলুন।" কৃষ্ণকান্ত বাবু একটু চারদিকে দেখে নিয়ে বললেন, " অনির্বাণ, যাকে আজ সন্ধ্যের দিকে....." শৈলানন্দ হঠাৎ যেন নামটি শুনেই রেগে লাল হয়ে গেলেন, বললেন, " ওই হারামজাদা। কি করেছে আপনি জানেন ? আজ সন্ধ্যেবেলা অ্যারেস্ট করেছি। কিন্তু আগে করা উচিত ছিল।" তারপর ঘৃণার সাথে আফসোস মিশিয়ে বললেন, " নোংরা ছেলে একটা।" কৃষ্ণকান্ত বাবু শুধু উপর নীচে ঘাড় নাড়লেন। তারপর কফি এলো। একটু নিরাবতা। নিরাবতা ভেঙে শৈলানন্দ প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন, " অনির্বাণ কে হয় আপনার ?" কৃষ্ণকান্ত বাবু সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, " আমিও চাই ও কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি পাক। কারণ ও যে কাজ করেছে তার শাস্তি দিতে গেলে হয়ত মৃত্যুও কম হয়ে পড়ে।" তারপর একটু থেমে কৃষ্ণকান্ত বাবু আবার বললেন, " আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে যে আমার ছেলে হয়ে ধর্ষণের মতো নোংরা কাজে লিপ্ত হতে ওর বিবেকে বাঁধলো না ! " শৈলানন্দের মুখটা হাঁ হয়ে গেলো । মুখ থেকে অস্পষ্ট ভাবে বেরিয়ে এলো, " আপনার ছেলে ?" কৃষ্ণকান্ত আফসোসের সুরে বললেন, " হ্যাঁ। ছোটো ছেলে। মানুষ করতে পারলাম না। আমারই ব্যর্থতা।ওর মা ঠিকই বলত, আমি একজন ব্যর্থ পিতা। " আবার কিছুক্ষণ নিরাবতা । সেই নিরাবতা যেন কেউ ভাঙতেই চায় না। তবুও ভাঙতে হয়। কৃষ্ণকান্ত বাবু হাতজোড় করে বললেন, " ওকে কি শুধুমাত্র আজকে রাতের জন্য মুক্তি দেওয়া যাবে ? শুধুমাত্র আজকে রাতের জন্য।" শৈলানন্দ যেন ভাবতেই পারেনি যে মাষ্টারমশাই এরকম ধরণের কিছু অনুরোধ রাখবেন। তবুও কিছুক্ষণ ভেবে, তারপর বললেন, " এরকম করলে তো আইনশৃঙ্খলা লঙ্ঘন করা হবে।" এখনও কৃষ্ণকান্ত বাবু হাতজোড় করে রয়েছেন, " প্লিজ, ভোরের মধ্যেই আমি নিজে ওকে তোমার হাতে তুলে দেব। প্লিজ একবার।" শৈলানন্দ বুঝলেন, মাষ্টারমশাই 'না' বললে শুনবেন না। তাই বললেন, " আচ্ছা। আমাদের দুজন পুলিশ অফিসার আপনাদের সঙ্গে থাকবে।" কৃষ্ণকান্ত একটু আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত বললেন, " ঠিক আছে। তবে কিছুটা দূরে দূরে থাকতে হবে। আমাকে বিশ্বাস করো, আমি ওকে পালাতে দেব না, ভয় নেই। আমি নিজে হাতে দিয়ে যাব।" শৈলানন্দ আবার কিসব ভেবে বললেন, " আচ্ছা, দুজন পুলিশ অফিসার নয়, আমি নিজে থাকব আপনাদের সঙ্গে।" কৃষ্ণকান্ত বাবু বললেন, " ঠিক আছে।" শৈলানন্দ চেয়ার ছেড়ে উঠে কারাগারের চাবি নিয়ে তালা খুলে অনির্বাণকে বাইরে আনলেন। অনির্বাণ, বাবা কৃষ্ণকান্ত রায়ের সামনে এসে মুখের এমন এক বিশ্রী ভাব করলেন যেন ও মানুষটাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করে। কৃষ্ণকান্ত বাবুর বাইরে গাড়ি রাখা ছিল। অনির্বাণকে নিয়ে উনি ব্যক্তিগত গাড়িতে উঠলেন। নিজে ড্রাইভার সিটে বসলেন। অনির্বাণ পাশের সিটে। পিছনের জিপে শৈলানন্দ ব্যানার্জী। অনির্বাণের মুখে একটু হালকা হাসি ফুটলো। হয়ত ও ভেবেছে, ওর বাবা ওকে বোধ হয় জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। তাই অনির্বাণ কৃষ্ণকান্ত বাবুকে বললেন, " বাবা, তুমি তো অপরাধীদের সহ্য করতে পারো না। তাহলে আমাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনলে কেন ?" কৃষ্ণকান্ত বাবু কোনো উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ পর অনির্বাণ নিজে নিজেই বললেন, " ও বুঝেছি। আমি তোমার ছেলে বলে, তাই না বাবা ?"
হঠাৎ গাড়িটা মহাকালী শ্মশানের দিকে ঘুরলো। অনির্বাণ তাড়াতাড়ি বাবাকে বললো, " বাবা আমরা বাড়িতে যাচ্ছি না ? এত রাতে শ্মশানে কি করতে যাচ্ছ ?"
গাড়িটা শ্মশানের পাঁচিলের বাইরে থামলো। গাড়ি থেকে নামলেন দুজন। কিছুটা দূরে জিপ এসে দাঁড়ালো।
ছেলের হাত ধরে টেনে গেট দিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন কৃষ্ণকান্ত বাবু। তারপর কাতর কন্ঠে বললেন, " এখানে বছর সাত আগে তোর মাকে নিয়ে এসেছিলাম। তুই আসিস নি, তোর শ্মশানে ভয় করে। মনে পড়ছে ?" একটু থেমে আবার বললেন, আফসোসের সুরে, " তোর মা ঠিক বলেছিল। তুই বিগড়ে গিয়েছিলি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগে আমাকে বারবার বলত, ছোটো ছেলেটাকে মানুষ করে তুলো। আমি পারিনি। আসলে বুঝতে পারিনি সেদিন, ওর দূরদর্শিতা ছিল। আজ সাত বছর পর বুঝতে পারছি, আমি আজও উপযুক্ত বাবা হতে পারিনি।"
তারপর হাটতে হাটতে ইলেকট্রিক চুল্লির কাছে, খোলা বারান্দায় নিয়ে গেলেন। বারান্দায় গিয়েই অনির্বাণ দু পা পিছিয়ে এলো, সামনে পর পর কতকগুলো লাশ । সবার পাশের ধূপ জ্বলছে। মুখে কালো মতন কিসব দেওয়া। একটা আলো জ্বলছে বটৈ তবে তা খুব জোরালো নয়। কিছুই যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।সবাই কত শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। পাশে কোনো লোকজন নেই। শ্মশান এখন একদম ফাঁকা। তারপর ওর নজর গেল ইলেকট্রিক চুল্লির দিকে, সেখানে ও দুটো ছায়া মতো কিছু দেখতে পেলো। তাদের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ওরা অনির্বাণের দিকেই ফিরে আছে। এরা কি মরা পোড়ায় ? অনির্বাণ ভয় পেলো, ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো 'বাবা' শব্দটি। কিন্তু কোথায় বাবা ? পাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। ওর হাত পা আবশ হয়ে এলো। পালাতে ইচ্ছা করছে কিন্তু শরীরে জোর পাচ্ছে না। তারপর সেই দুটো কালো ছায়া মূর্তি আরও একটা লাশ তুলে, টলি ঠেলে চুল্লির মধ্যে দিয়ে দিল। নিমেষে গনগনে আগুন ছেঁকে ধরলো মানুষের শরীরটা। যেন কেউ শরীরটাকে গিলে নিচ্ছে। তারপর চুল্লির মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।
হঠাৎ অনির্বাণ উপলব্ধি করলো, ওর হাত ধরে কেউ টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর ওর কানে এলো, " ওই যে গাঢ় কালো ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছিস ?" এই গলাটা ও চেনে ওর বাবা, কৃষ্ণকান্ত রায়। অনির্বাণ দেখলো, বাইরে আকাশ ছোঁয়া একটা পাইপের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে কালো ধোঁয়া। উড়ে চলে যাচ্ছে অসীমের দিকে। এটাই কি তবে জীবন ? কি হবে এত পাপ করে, সেই তো ওই চুল্লির আগুনই এই শরীরটা কালো ধোঁয়া করে অনন্তে উড়ে যাবে। তাহলে শরীরের এত ক্ষিদে কিসের ?
অনির্বাণ ভয় পেয়ে গেলো। জীবনের আসল সংঙ্গা তাহলে কি ? মৃত্যু ?
অনির্বাণ অনুভব করলো। ওর ডানপাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে, না এটা বাবা নয়, বাবা তো বামপাশে। ওর গায়ে একটা হাতের স্পর্শ, ও এই স্পর্শ চেনে, সাত বছর আগে এই স্পর্শে ওর ঘুম ভাঙত, আর আজ এই স্পর্শে ও উপলব্ধি করলো জীবনের আসল মানে ..... ও শুনতে পেলো, " জীবন খুব ক্ষণস্থায়ী খোকা। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন স্মরণীয় করার চেষ্টা করো, এমন কিছু করো যাতে মানুষ সারাজীবন মানুষ তোমায় মনে রাখবে।" ওর মনে পড়লো ' খোকা' বলে ওর মা ওকে ডাকত। অস্পষ্টভাবে অনির্বাণের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, "মা"।

সমাপ্ত
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩০৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৫/১২/২০২৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast