রহস্যময় মৃত্যু লীলা - প্রথম পরিচ্ছদ
প্রথম পরিচ্ছদ
" সখী , ভাবনা কাহারে বলে ।
সখী , যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ,
'ভালোবাসা' 'ভালোবাসা'---
সখী, ভালোবাসা কারে কয় !
সে কি কেবলই যাতনাময় ।....."
--- অনেকক্ষণ ধরে রবী ঠাকুরের এই গানটা মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎই মনে পড়লো প্রান্তরের ডাইরির কথা। যাই হোক, সে বিষয়ে যাওয়ার আগে বলে রাখি, আমরা যাচ্ছি এখন মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। মোট দুটো গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। একটাতে আমি, আমার বন্ধুরা সহ ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী আর অন্যটিতে আমাদের মা ও বাবারা। এখন আমরা যে রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত ছুটে যাচ্ছি তার দুই প্রান্ত শুনসান ও ঘন জঙ্গল। একটু আগে এদিকে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে যার ফলে গাছগুলো বেশ সতেজ বলে মনে হচ্ছে।
প্রান্তর আমার পাশেই বসে। দেখলাম, ও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সবুজ গাছপালা দেখছে আর মুখের ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ভাবছে। চারিদিকে নীরাবতা, সেই নীরবতার মাঝে একটু হাসির আভাস আনতে প্রান্তরকে বললাম, "তোর ডাইরিতে বেশ কয়েকটি প্রেমের কবিতা দেখছিলাম। তুই লিখেছিস বুঝি !" আমার কথার উত্তর না দিয়ে প্রান্তর তখনও বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আমার আগ্রহী প্রশ্নে আরও আগ্রহ দেখিয়ে রাজ জিজ্ঞাসা করলো, " কি রকম কবিতা, দেবা ?" আমি বললাম, "ব্যর্থ প্রেমের ... "। আরও কিছু বলতে যাবো এমন সময় প্রান্তর বাঁধা দিয়ে ইনস্পেক্টরকে বললো, " স্যার, সামনে একটু গাড়িটা দাঁড়াতে বলুন।" আঙুল দিয়ে দূরে একটা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িকে নির্দেশ করে বললো, "ওই গাড়িটার পাশেই.. " একটা গাড়ি কিছুটা দূরে ডানদিকে রাস্তার ধারে একটু কাত করে রাখা ছিল, প্রান্তর অবশ্যই সেটিকেই নির্দেশ করছিল। ইনস্পেক্টর প্রান্তরকে বললেন, " কেন ? কি হয়েছে ?" ইতিমধ্যে গাড়িটা থেমেছে। প্রান্তর গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, " একটু পরেই বুঝতে পারবেন।" তারপর আমাকে বললেন,"দেবা, মায়েদের গাড়িটা, না দাঁড়ায় যেন, চলে যেতে বল।" আমি মায়েদের গাড়িটাকে চলে যেতে বললাম। তারপর পিছন দিকে ঘুরে দেখি, প্রান্তর ও ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী জঙ্গলের দিকে যাচ্ছেন। আমি ও আমার বাকি দুই বন্ধু (রাজ ও কমল) অগত্যা ওদের পিছু নিলাম। জঙ্গলে ঢুকতে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল সেটার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একটা মৃত দেহ গাছ থেকে ঝুলছে। তবে এটা আত্মহত্যা তো নয়ই। কারণ মৃতদেহটাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, তারপর এখানে এসে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে সেজন্য নীচে রক্তের ফোঁটা ধুয়ে যাচ্ছে। প্রান্তর ও ইনস্পেক্টর মৃতদেহটার খুব কাছে গেল। প্রান্তর ফাঁসির যে দড়িটা গাছের সাথের বাঁধা সেটা সহ পুরো বিষয়টা মনে মনে বোধ হয় ভাববার চেষ্টা করলো। এদিকে ইনস্পেক্টর লোকাল পুলিশ স্টেশনের ইনস্পেক্টরকে ফোন করলেন।
মিনিট কুড়ির মধ্যে এখানকার ইনস্পেক্টর আসলেন। দীপঙ্কর চক্রবর্তীর সাথে কথা বলার সময় জানতে পারলাম লোকাল থানার ইনস্পেক্টরের নাম অভিজিৎ কর্মকার। ইনস্পেক্টর অভিজিতের তৎপরতায় মৃতদেহটাকে নীচে নামানো হল। একটু কাছে যেতেই দেখলাম, ছেলেটিকে খুব কষ্ট, যন্ত্রনা দিয়ে খুন করা হয়েছে। সারা শরীরে কাটার দাগ। সম্ভবত ব্লেড বা ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে। মৃতদেহটাকে ফরেন্সিকের জন্য পাঠানো হল।
আমি, প্রান্তর, ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও আমার দুই বন্ধু একধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। এবার ইনস্পেক্টর অভিজিৎ আমাদের দিকে আসলেন। তিনি আমাদের দিকে ফিরে একটু ইতস্তত করলে দীপঙ্কর চক্রবর্তী আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। অভিজিৎ স্যার প্রথমে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চাইলেন আমরা কীভাবে জানলাম যে এখানে খুন হয়েছে। হয়ত আমরাও সেই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলাম।
এবার প্রান্তর বলতে শুরু করলো, " খুন হয়েছে প্রথমে এমনটা ভাবেনি। তবে কোনো না কোনো সমস্যা তো হয়েছিল, এটুকু ধারণা করেছিলাম মাত্র।" ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী আগ্রহের সুরে প্রান্তরকে বললেন," তুমি কীভাবে বুঝলে, এখানে সমস্যা হয়েছে।" প্রান্তর পিছনে ঘুরে রাস্তার ধারে একটু কাত করে যে গাড়িটা রাখা আছে, ওটার দিকে নির্দেশ করে বলল, " ওই গাড়িটা দেখে বুঝেছি। ধরুন, আপনি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছেন। আপনাকে রাস্তার ধারে দাঁড়াতে হলে গাড়িটা বাম পাশে নাকি ডান পাশে দা্ঁড় করাবেন ?" ইনস্পেক্টর অভিজিৎ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, " অবশ্যই বামপাশে।" প্রান্তর বললো, " হ্যাঁ। একদমই তাই। কিন্তু ঐ গাড়িটা ডান পাশে কাত করে রাখা । সুতরাং এটা স্পষ্ট যে গাড়িটা রেখেছে তার মধ্যে একটা ভয়, আর একটা ব্যস্ততা কাজ করছিল। আর ভয় ও ব্যস্ততা একসঙ্গে থাকলে সেখানে তো সমস্যা তৈরি হবেই।" এতক্ষণে আমরা রাস্তার কাছে চলে এসেছি। আগেই দেখেছিলাম একটা দুটো সাংবাদিকও এসেছেন। আর এটা হওয়া স্বাভাবিক। দেখলাম, সেই গাড়িটাকে পুলিশ ব্যারিকেড করছে। আমাদের গাড়িতে ওঠার সময় প্রান্তর অভিজিৎ স্যারকে বললেন, " স্যার, আগে খুন করা হয়েছে তারপরে এই গাড়িটি এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু খুনিকে এই গাড়িতে অবশ্যই আনা হয়নি। " দেখলাম অভিজিৎ স্যারের মুখটা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো হয়ে গেল। " আর একটা কথা, ফিংগার প্রিন্ট গুলো দেখবেন, কোনো সূত্র মিলে যেতে পারে।" আবার আমাদের গাড়িটা ছুটলো মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে।
যেতে যেতে আমি প্রান্তরকে বললাম, " আচ্ছা, তুই কীভাবে বুঝলি আগে খুন করা হয়েছে পরে গাড়িটা আনা হয়েছে ?" প্রান্তর বললো,"বুদ্ধি কাজে লাগাও ;বন্ধু" কিছুক্ষণ ভাবার পরেও যখন কেউ কিছু বুঝতেই পারলো তখন আমি আবার বাধ্য হয়েই বললাম,
--- "বল না ভাই! এত সাসপেন্স সত্যি ভালো লাগে না।"
--- " খুব সহজ। মৃতদেহের কাছে গিয়ে দেখলাম দেহটির থেকে রক্ত ধুয়ে গেছে
কিন্তু গাড়ির কাছে দেখলাম, গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট। এটা থেকেই ...... ।"
--- "বাহ্। এভাবেই তো ভাবাই হয়নি।"
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে আমরা মুর্শিদাবাদ পৌচ্ছালাম। সেখানে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠার কথা। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি বাবা, মা সহ প্রথম গাড়িতে যারা এসেছিলেন তারা সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন। কি নিয়ে আলোচনা করছেন সেটা যদিও পরে জানতে পারি। আগে কথা দেওয়া থাকলেও বাড়ির মালিক এই মুহূর্তে বাড়িটিকে ভাড়া দিতে চান না। কারণ'টা তারা পরিষ্কার করে না বললেও প্রান্তরের বুঝতে বাকি থাকলো না, হয়ত সে বুঝলো কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছেন, যার মধ্যে তারা আমাদের জড়াতে চান না। বেগতিক দেখে প্রান্তর, ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর বাবুকে উনাদের সাথে কথা বলতে বললেন, যদিও সঙ্গে এটাও বলে দিলেন যে তিনি প্রথমেই যেন নিজের পরিচয় না দেন কারণ তারা ঘাবড়ে যেতে পারে। যেমন কথা তেমনি কাজ। দীপঙ্কর বাবু বাড়ির মালিকের কাছে গেলেন। কিছু সময় তাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হওয়ার পর দীপঙ্কর বাবু বাইরে এসে যে যার রুমে যেতে বললেন।
আমাদের দোতলায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমার রুমে আমি আর দেবা ছিলাম। পাশের রুমেই ইনস্পেক্টর অভিজিৎ চক্রবর্তী। এবং তার পাশের রুমে রাজ ও কমল। বাকি ঘরগুলোতে অন্যান্যরা....... ।
সকালে সবাই মিলে ব্রেক ফাস্ট করতে করতে বাবার হাতে থাকা কাগজের একটা খবরের দিকে দৃষ্টি গেল। কিছু দূর থেকে হেডলাইন দেখলাম 'যৌনপল্লী্ থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দেওয়া হল একটা মেয়েকে'। খবরটা ভালো লাগলেও নূন্যতম লজ্জার কারণে কাউকে বলতে পারলাম না। আজকের মতো সময়ে দাঁড়িয়ে এরকম খবর সত্যিই নারী সমাজকে এক একটু সাহস জোগায়। কাগজটা হাতে নিয়ে সবটা পড়ার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগটা আর হল না। কারণটা আর কিছুই নয়, দীপঙ্কর বাবু আমাকে নিয়ে বাইরের দিকে নিয়ে আসলেন আশপাশটা দেখবেন বলে।
অগত্যা ব্রেক ফাস্ট শেষ করে বাইরের খোলা হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে আমি দীপঙ্কর বাবু'কে জিজ্ঞাসা করলাম,
- আচ্ছা, স্যার , কি কথা হল যার ফলস্বরূপ আমরা এখানে থাকতে পারলাম ?
- "সবই প্রান্তরের প্রখর বুদ্ধিমত্তার ফলস্বরূপ।
সত্যি! মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যায় তোমার বন্ধুর বুদ্ধি দেখে ... । কি অসাধারণ কল্পনাশক্তি। "
- " হ্যাঁ। আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। "
- "আচ্ছা, দেবা। তোমার ডিটেকটিভ বন্ধুকে দেখছি না তো ! কোথায় গিয়েছে এত সকালে ?"
- "তা মন্দ বলেননি। আমিও সকাল থেকে দেখছি না। ফোন করছি কিন্তু ফোন অফ করে রেখেছে। ভোরের দিকে একবার বাইরে বেরোতে দেখেছিলাম, তারপর আর দেখিনি।"
- তোমারা দুজনে তো একই রুমে !
- হ্যাঁ। আচ্ছা, বলছি, বাড়ির মালিকের কি সমস্যা হয়েছিল যার জন্য আমাদের রাখতে চাইছিল না। কিছু জানতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে ?"
- না দেবা। সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করছি। প্রান্তরের মতো বলতে ইচ্ছে করছে কিছু একটা তো সমস্যা আছেই।
চলছে .....
" সখী , ভাবনা কাহারে বলে ।
সখী , যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ,
'ভালোবাসা' 'ভালোবাসা'---
সখী, ভালোবাসা কারে কয় !
সে কি কেবলই যাতনাময় ।....."
--- অনেকক্ষণ ধরে রবী ঠাকুরের এই গানটা মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎই মনে পড়লো প্রান্তরের ডাইরির কথা। যাই হোক, সে বিষয়ে যাওয়ার আগে বলে রাখি, আমরা যাচ্ছি এখন মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। মোট দুটো গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। একটাতে আমি, আমার বন্ধুরা সহ ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী আর অন্যটিতে আমাদের মা ও বাবারা। এখন আমরা যে রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত ছুটে যাচ্ছি তার দুই প্রান্ত শুনসান ও ঘন জঙ্গল। একটু আগে এদিকে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে যার ফলে গাছগুলো বেশ সতেজ বলে মনে হচ্ছে।
প্রান্তর আমার পাশেই বসে। দেখলাম, ও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সবুজ গাছপালা দেখছে আর মুখের ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ভাবছে। চারিদিকে নীরাবতা, সেই নীরবতার মাঝে একটু হাসির আভাস আনতে প্রান্তরকে বললাম, "তোর ডাইরিতে বেশ কয়েকটি প্রেমের কবিতা দেখছিলাম। তুই লিখেছিস বুঝি !" আমার কথার উত্তর না দিয়ে প্রান্তর তখনও বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আমার আগ্রহী প্রশ্নে আরও আগ্রহ দেখিয়ে রাজ জিজ্ঞাসা করলো, " কি রকম কবিতা, দেবা ?" আমি বললাম, "ব্যর্থ প্রেমের ... "। আরও কিছু বলতে যাবো এমন সময় প্রান্তর বাঁধা দিয়ে ইনস্পেক্টরকে বললো, " স্যার, সামনে একটু গাড়িটা দাঁড়াতে বলুন।" আঙুল দিয়ে দূরে একটা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িকে নির্দেশ করে বললো, "ওই গাড়িটার পাশেই.. " একটা গাড়ি কিছুটা দূরে ডানদিকে রাস্তার ধারে একটু কাত করে রাখা ছিল, প্রান্তর অবশ্যই সেটিকেই নির্দেশ করছিল। ইনস্পেক্টর প্রান্তরকে বললেন, " কেন ? কি হয়েছে ?" ইতিমধ্যে গাড়িটা থেমেছে। প্রান্তর গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, " একটু পরেই বুঝতে পারবেন।" তারপর আমাকে বললেন,"দেবা, মায়েদের গাড়িটা, না দাঁড়ায় যেন, চলে যেতে বল।" আমি মায়েদের গাড়িটাকে চলে যেতে বললাম। তারপর পিছন দিকে ঘুরে দেখি, প্রান্তর ও ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী জঙ্গলের দিকে যাচ্ছেন। আমি ও আমার বাকি দুই বন্ধু (রাজ ও কমল) অগত্যা ওদের পিছু নিলাম। জঙ্গলে ঢুকতে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল সেটার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একটা মৃত দেহ গাছ থেকে ঝুলছে। তবে এটা আত্মহত্যা তো নয়ই। কারণ মৃতদেহটাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, তারপর এখানে এসে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে সেজন্য নীচে রক্তের ফোঁটা ধুয়ে যাচ্ছে। প্রান্তর ও ইনস্পেক্টর মৃতদেহটার খুব কাছে গেল। প্রান্তর ফাঁসির যে দড়িটা গাছের সাথের বাঁধা সেটা সহ পুরো বিষয়টা মনে মনে বোধ হয় ভাববার চেষ্টা করলো। এদিকে ইনস্পেক্টর লোকাল পুলিশ স্টেশনের ইনস্পেক্টরকে ফোন করলেন।
মিনিট কুড়ির মধ্যে এখানকার ইনস্পেক্টর আসলেন। দীপঙ্কর চক্রবর্তীর সাথে কথা বলার সময় জানতে পারলাম লোকাল থানার ইনস্পেক্টরের নাম অভিজিৎ কর্মকার। ইনস্পেক্টর অভিজিতের তৎপরতায় মৃতদেহটাকে নীচে নামানো হল। একটু কাছে যেতেই দেখলাম, ছেলেটিকে খুব কষ্ট, যন্ত্রনা দিয়ে খুন করা হয়েছে। সারা শরীরে কাটার দাগ। সম্ভবত ব্লেড বা ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে। মৃতদেহটাকে ফরেন্সিকের জন্য পাঠানো হল।
আমি, প্রান্তর, ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও আমার দুই বন্ধু একধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। এবার ইনস্পেক্টর অভিজিৎ আমাদের দিকে আসলেন। তিনি আমাদের দিকে ফিরে একটু ইতস্তত করলে দীপঙ্কর চক্রবর্তী আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। অভিজিৎ স্যার প্রথমে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চাইলেন আমরা কীভাবে জানলাম যে এখানে খুন হয়েছে। হয়ত আমরাও সেই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলাম।
এবার প্রান্তর বলতে শুরু করলো, " খুন হয়েছে প্রথমে এমনটা ভাবেনি। তবে কোনো না কোনো সমস্যা তো হয়েছিল, এটুকু ধারণা করেছিলাম মাত্র।" ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর চক্রবর্তী আগ্রহের সুরে প্রান্তরকে বললেন," তুমি কীভাবে বুঝলে, এখানে সমস্যা হয়েছে।" প্রান্তর পিছনে ঘুরে রাস্তার ধারে একটু কাত করে যে গাড়িটা রাখা আছে, ওটার দিকে নির্দেশ করে বলল, " ওই গাড়িটা দেখে বুঝেছি। ধরুন, আপনি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছেন। আপনাকে রাস্তার ধারে দাঁড়াতে হলে গাড়িটা বাম পাশে নাকি ডান পাশে দা্ঁড় করাবেন ?" ইনস্পেক্টর অভিজিৎ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, " অবশ্যই বামপাশে।" প্রান্তর বললো, " হ্যাঁ। একদমই তাই। কিন্তু ঐ গাড়িটা ডান পাশে কাত করে রাখা । সুতরাং এটা স্পষ্ট যে গাড়িটা রেখেছে তার মধ্যে একটা ভয়, আর একটা ব্যস্ততা কাজ করছিল। আর ভয় ও ব্যস্ততা একসঙ্গে থাকলে সেখানে তো সমস্যা তৈরি হবেই।" এতক্ষণে আমরা রাস্তার কাছে চলে এসেছি। আগেই দেখেছিলাম একটা দুটো সাংবাদিকও এসেছেন। আর এটা হওয়া স্বাভাবিক। দেখলাম, সেই গাড়িটাকে পুলিশ ব্যারিকেড করছে। আমাদের গাড়িতে ওঠার সময় প্রান্তর অভিজিৎ স্যারকে বললেন, " স্যার, আগে খুন করা হয়েছে তারপরে এই গাড়িটি এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু খুনিকে এই গাড়িতে অবশ্যই আনা হয়নি। " দেখলাম অভিজিৎ স্যারের মুখটা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো হয়ে গেল। " আর একটা কথা, ফিংগার প্রিন্ট গুলো দেখবেন, কোনো সূত্র মিলে যেতে পারে।" আবার আমাদের গাড়িটা ছুটলো মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে।
যেতে যেতে আমি প্রান্তরকে বললাম, " আচ্ছা, তুই কীভাবে বুঝলি আগে খুন করা হয়েছে পরে গাড়িটা আনা হয়েছে ?" প্রান্তর বললো,"বুদ্ধি কাজে লাগাও ;বন্ধু" কিছুক্ষণ ভাবার পরেও যখন কেউ কিছু বুঝতেই পারলো তখন আমি আবার বাধ্য হয়েই বললাম,
--- "বল না ভাই! এত সাসপেন্স সত্যি ভালো লাগে না।"
--- " খুব সহজ। মৃতদেহের কাছে গিয়ে দেখলাম দেহটির থেকে রক্ত ধুয়ে গেছে
কিন্তু গাড়ির কাছে দেখলাম, গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট। এটা থেকেই ...... ।"
--- "বাহ্। এভাবেই তো ভাবাই হয়নি।"
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে আমরা মুর্শিদাবাদ পৌচ্ছালাম। সেখানে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠার কথা। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি বাবা, মা সহ প্রথম গাড়িতে যারা এসেছিলেন তারা সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন। কি নিয়ে আলোচনা করছেন সেটা যদিও পরে জানতে পারি। আগে কথা দেওয়া থাকলেও বাড়ির মালিক এই মুহূর্তে বাড়িটিকে ভাড়া দিতে চান না। কারণ'টা তারা পরিষ্কার করে না বললেও প্রান্তরের বুঝতে বাকি থাকলো না, হয়ত সে বুঝলো কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছেন, যার মধ্যে তারা আমাদের জড়াতে চান না। বেগতিক দেখে প্রান্তর, ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর বাবুকে উনাদের সাথে কথা বলতে বললেন, যদিও সঙ্গে এটাও বলে দিলেন যে তিনি প্রথমেই যেন নিজের পরিচয় না দেন কারণ তারা ঘাবড়ে যেতে পারে। যেমন কথা তেমনি কাজ। দীপঙ্কর বাবু বাড়ির মালিকের কাছে গেলেন। কিছু সময় তাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হওয়ার পর দীপঙ্কর বাবু বাইরে এসে যে যার রুমে যেতে বললেন।
আমাদের দোতলায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমার রুমে আমি আর দেবা ছিলাম। পাশের রুমেই ইনস্পেক্টর অভিজিৎ চক্রবর্তী। এবং তার পাশের রুমে রাজ ও কমল। বাকি ঘরগুলোতে অন্যান্যরা....... ।
সকালে সবাই মিলে ব্রেক ফাস্ট করতে করতে বাবার হাতে থাকা কাগজের একটা খবরের দিকে দৃষ্টি গেল। কিছু দূর থেকে হেডলাইন দেখলাম 'যৌনপল্লী্ থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দেওয়া হল একটা মেয়েকে'। খবরটা ভালো লাগলেও নূন্যতম লজ্জার কারণে কাউকে বলতে পারলাম না। আজকের মতো সময়ে দাঁড়িয়ে এরকম খবর সত্যিই নারী সমাজকে এক একটু সাহস জোগায়। কাগজটা হাতে নিয়ে সবটা পড়ার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগটা আর হল না। কারণটা আর কিছুই নয়, দীপঙ্কর বাবু আমাকে নিয়ে বাইরের দিকে নিয়ে আসলেন আশপাশটা দেখবেন বলে।
অগত্যা ব্রেক ফাস্ট শেষ করে বাইরের খোলা হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে আমি দীপঙ্কর বাবু'কে জিজ্ঞাসা করলাম,
- আচ্ছা, স্যার , কি কথা হল যার ফলস্বরূপ আমরা এখানে থাকতে পারলাম ?
- "সবই প্রান্তরের প্রখর বুদ্ধিমত্তার ফলস্বরূপ।
সত্যি! মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যায় তোমার বন্ধুর বুদ্ধি দেখে ... । কি অসাধারণ কল্পনাশক্তি। "
- " হ্যাঁ। আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। "
- "আচ্ছা, দেবা। তোমার ডিটেকটিভ বন্ধুকে দেখছি না তো ! কোথায় গিয়েছে এত সকালে ?"
- "তা মন্দ বলেননি। আমিও সকাল থেকে দেখছি না। ফোন করছি কিন্তু ফোন অফ করে রেখেছে। ভোরের দিকে একবার বাইরে বেরোতে দেখেছিলাম, তারপর আর দেখিনি।"
- তোমারা দুজনে তো একই রুমে !
- হ্যাঁ। আচ্ছা, বলছি, বাড়ির মালিকের কি সমস্যা হয়েছিল যার জন্য আমাদের রাখতে চাইছিল না। কিছু জানতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে ?"
- না দেবা। সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করছি। প্রান্তরের মতো বলতে ইচ্ছে করছে কিছু একটা তো সমস্যা আছেই।
চলছে .....
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
Md. Rayhan Kazi ১৮/০৬/২০২২অনন্য লেখনশৈলী
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৭/০৬/২০২২চলবে!
-
ফয়জুল মহী ১৭/০৬/২০২২গভীর ভাবনার সুনিপুণ প্রকাশ
-
সুকান্ত ঘোষ ১৭/০৬/২০২২বেশ