প্রান্তরের পদার্পণ - হীরা চুরি - দ্বিতীয় পরিচ্ছদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছদ
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল প্রান্তরের ডাকে। ব্যস্ততার সাথে বলল, "তাড়াতাড়ি ওঠ। গুছিয়ে নে। রাজদীপদের বাড়িতে যেতে হবে।"
আমি অবাক হয়েই বললাম, " কেন? এখন ওদের বাড়িতে যাবো কেন?"
প্রান্তর গুছাতে গুছাতে বলল, " রাজের হীরের আংটির হীরেটা চুরি হয়ে গেছে। ও ফোন করেছিল। তাড়াতাড়ি যেতে বলল। এর বেশি আমি কিছু জানি না।"
তারপর মিনিট দশেকের মধ্যেই আমি গুছিয়ে নিয়ে প্রান্তরের সাথে রাজদের বাড়ির জন্য বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে প্রান্তরকে বললাম, " আচ্ছা, আমাদের ডাকার কারণটা কি? ওর কি সন্দেহ আমাদের প্রতি নাকি!" কিন্তু প্রান্তর কোনো উত্তর দিল না।
গিয়ে দেখি রাজদীপদের বাড়িতে যথেষ্ট শোরগোল পড়ে গিয়েছে। পুলিশও এসেছে দেখলাম। আমাদের দেখেই রাজদীপ ছুটে এলো। ওর মুখটা দেখে বুঝলাম, বেচারা বড়ো কষ্ট পেয়েছে হীরা চুরি হওয়ায়।সে প্রান্তরের হাতে হাত রেখে বলল, " শুনেছি, তুই ডিটেকটিভ গল্প পড়তে ভালোবাসিস। সত্য অন্বেষণ করতে ভালোবাসিস। তাহলে যে করেই হোক আমাদের ঐতিহ্যকে খুঁজে দে ভাই।"প্রান্তর আমতা আমতা করে বলল, " পুলিশ আছেন তো, ওরাই খুঁজে দেবেন। তুই আমাকে বলছিস কেন? " একথা বলে চলে আসার জন্য সবেমাত্র ঘুরেছি, অমনি রাজ বলল, " তুই যদি আমার ভালো বন্ধু ভাবিস তাহলে তুই কখনও এটা এড়িয়ে যাবি না। আমার বিশ্বাস, পুলিশের আগেই তুই এর রহস্যভেদ এবং অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারবি।" একথা শোনার পর, বলার মতো আর কোনো কথা থাকে না।অগত্যা প্রান্তরকে দায়িত্বটা নিতেই হলো।
তারপর প্রান্তর মিনিট দুয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর, মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, " আচ্ছা, আমরা কাল চলে যাওয়ার পর ঠিক কি ঘটেছিল?"
রাজ প্রথমটাই বোধ হয় শুনতে পেল না। আমি কথাটা আর একবার বলায় রাজ তাড়াতাড়ি করে বলল, " হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলছি .... কাল তোরা চলে যাওয়ার আগেই তো অনেকেই চলে গিয়েছিল। তারপর যারা ছিল তারা এখানেই আছে। আমার মামা-মামি, জ্যাঠা- জ্যেঠি, পিসি, মা- বাবা আর বাবার বন্ধু মলয় কাকু এনারাই। তোরা্ চলে যাওয়ার পর আরো কিছুক্ষণ সবাই এক জায়গায় বসে অনেক আড্ডা হয় তারপর রাত্রি প্রায় বারোটা নাগাদ সবাই যে যার রুমে চলে যায়। আমি যখন আমার রুমে ঘুমাতে যায় তখন হাতে আংটি ছিল, হীরাও ছিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হীরা নেই, আংটি আছে।" হঠাৎ পাশ থেকে একজন বলল, " দরজাটা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল? " তাকিয়ে দেখি বসিরহাট থানার ওসি দীপঙ্কর চক্রবর্তী। তিনি কখন তল্লাশি করে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ,বুঝতেই পারলাম না। এবার রাজ দীপঙ্কর বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, " হ্যাঁ, দরজাটা ভেতর থেকে লক ছিল। "তারপর আমি একটা প্রশ্ন করতে যাবো এমন সময় রাজ আমাদের দিকে নির্দেশ করে দীপঙ্কর বাবুকে বলল, "স্যার, এরা আমার বন্ধু। আপনি আপনার মতো তদন্ত করুন। এরা এদের মতো করবে। " তারপর আমি আর প্রান্তর দীপঙ্কর বাবুকে আমাদের পরিচয় দিলাম। দীপঙ্কর বাবু আমাদের দিকে একবার তাকালেন তারপর অভিলাশ কাকুকে বললেন, " যতদিন না এই কেস সমাধান হবে ততদিন কেউ এ বাড়ি থেকে বেরোবেন না। এই বলে দীপঙ্কর বাবু চলে গেলেন।
এবার এতক্ষণ পর প্রান্তর মুখ খুলল। ও বলল, " তোর রুমে ঢোকার অন্য কোনো পথ আছে? " রাজ একটু ভেবে বলল, " না নেই।একটাই পথ আমার ঘরে ঢোকার।"
" আচ্ছা, ঠিক আছে। "- বলে প্রান্তর অভিলাষ কাকুর সামনে গিয়ে বললেন, " কেসটা যখন নিতেই হল, তখন সমাধান তো করতেই হবে। তো ভাবছি বাড়িতে এখনও পর্যন্ত যারা আছেন তাদের সব্বাইকে আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করব। এজন্য আপনার অনুমতি চাইছি। "অভিলাষ কাকু তখন একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও মুখে বললেন, " ঠিক আছে। করো। "প্রান্তর এবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজকে বলল, " একটা ঘর .....। " প্রান্তরের মুখের কথা শেষ না করেই রাজ বলল," আমার ঘরে থেকে জেরা করতে পারিস।"
আমি আর প্রান্তর দোতলায় রাজের ঘরে গেলাম।রাজকে বললাম তলায় থাকতে আর যখন যাকে বলব তখন তাকে পাঠাতে। আমি রাজের ঘরের বাইরে দাঁড়ালাম।
তারপর একে একে সব্বাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। এমনকি রাজের মা, বাবা সহ রাজকেও।আমি যেহেতু ঘরের বাইরে ছিলাম তাই ভেতরে কি জিজ্ঞাসাবাদ চলছে সেটা জানতে পারিনি। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল। জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় অভিলাষ কাকুর বন্ধু একটু অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। পরে জেনেছিলাম উনি একজন স্কুল শিক্ষক। উনার নাম মলয় ব্যানার্জী।
এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর প্রান্তর বাড়ি ফিরে আসি।কিন্তু আবেগী মনকে বেশিক্ষণ সামলে রাখতে পারিনি।একটা প্রশ্নের উত্তর অনেকক্ষণ ধরে জানতে ইচ্ছা করছে। অবশেষে লাঞ্চ করতে করতে প্রান্তরকে জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। বললাম, " জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে পারলে?" প্রান্তর মুখ না তুলেই বলল, " খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। পরে নিশ্চয়ই বলবো। এটুকুই জেনে রাখ এখন যে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু নেই, যা থেকে সন্দেহ করা যায়। " আমি যে এই উত্তরে খুশি হলাম তা নয় তবুও আর একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। বললাম, " তুই নিজে তল্লাশি করলি না কেন? "এবার ও আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো, " পুলিশ করেছে তো। আমার উনাদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আছে। " আমি অবশেষে বললাম, " ভালো। "
বিকেলে মাঠে যাওয়ার জন্য যখন প্রান্তরকে ডাকতে গেলাম তখন দেখি জানালার দিকে ফিরে ও একটা পেন সুন্দর করে দেখছে। আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ওর পেছন থেকে দেখার চেষ্টা করবো ভাবছি এমনি সময় ও বললো, " আচ্ছা দেবা,বন্ধ ঘর থেকে কীভাবে চুরি হতে পারে বলে তোর মনে হয়?"আমি আবাক হয়ে বললাম, " তার মানে তুই্ বলছিস চুরি হয়নি, আর হলেও হীরা রাজের ঘরেই আছে? "প্রান্তর জামা পরতে পরতে বলল, " আমি কিছু বলছি না। সবকিছু সময় বলবে।"চল, আজ আর মাঠে যাব না, একটু রাজ'দের বাড়িতে যেতে হবে। যেতে যেতে প্রান্তর আমায় কি কি করতে হবে সবই বলে দিল।
রাজ'দের বাড়িতে পৌঁচ্ছে শুনলাম রাজ বাড়িতে নেই। আর সেজন্য অত্যন্ত বাধ্য হয়েই মতলবটা পরিবর্তন করতে হল। অবশেষে, অভিলাষ কাকু'র থেকে অনুমতি নিয়েই প্রান্তর শুধুমাত্র রাজের ঘর তল্লাশি করল। আর আমি বাইরে অভিলাষ কাকুর সঙ্গে গল্প করছিলাম। শুনলাম কোথা থেকে আংটি তৈরি করা হয়েছিল। ইত্যাদি। প্রায় মিনিট দশেক পরে প্রান্তর বাইরে এসে বলল, " না। এ ঘরেও নেই। "তারপর রাজ'দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা একটু সাহিত্য সংঘ লাইব্রেরীর দিকে গেলাম।দু'জনে কিছু বই ঘাটাঘাটি করে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে এসে প্রান্তর পকেট থেকে একটা আংটি বের করে বলল," এই হল সেই হীরা। " আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, " তাহলে অভিলাষ কাকু'র সামনে মিথ্যা বললে কেন?"এবার প্রান্তর হাসতে হাসতে বলল, " অঙ্কের উত্তর মিললেও একবার ক্রসচেক করে নেওয়া ভালো। না হলে বলা যায় না ভেতরে কোথাও ভুল আছে কিনা! "
রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমি একবার প্রান্তরের ঘরে গেলাম। দেখলাম হীরাটাকে মুখের সামনে ধরে মুখের নিঃশ্বাস ওই হীরার উপর দিচ্ছে। তারপর ওর মুখে দেখলাম একটা হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে। ও আমার দিকে ফিরে বলল, "তোর কাছে শিরিষ কাগজ আছে?" আমি বললাম, " হ্যাঁ। আছে। " যেহেতু বাড়িতে একটা পুরোনো সাইকেল ছিল, সেটাই কয়েকদিন ধরে অসময়ে ঘষছি। আমি নীচে আমার ঘর থেকে এক টুকরো শিরিষ কাগজ এনে প্রান্তরকে দিলাম। ও সেটা নিয়ে হীরার উপর ঘষতে শুরু করলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল, "আমাকে ঠকানো এত সহজ নয়।" আমি কি হয়েছে জানতে চাইলে প্রান্তর বলল, " কাল একবার সেই দোকানে যেতে হবে যেখান থেকে হীরার আংটি তৈরি করা হয়েছিল।
পরের দিন সকালে আমি আর প্রান্তর দোকানের মালিক অর্থাৎ প্রকাশ রায়ের থেকে হীরার ব্যাপারে জানতে চাইলে, প্রকাশ কাকু বললেন,"অভিলাষ আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু।তাছাড়া ও মাঝে মাঝেই আমার এখানে এসে বসে,গল্প করে।ওর ছেলের জন্মদিনেও তো আমার নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ওদিন প্রচন্ড ব্যস্ত থাকায় যেতে পারিনি। তাই তাকে ঠকানোর কোনো প্রশ্নই নেই।" তারপর, প্রকাশ কাকু'র মাথার ঠিক পেছনে বাঁধানো একটা ছবি দেখে কথাটা বিশ্বাস করলাম। ছবিটি প্রকাশ কাকু আর অভিলাষ কাকু'র দীঘা'য় সমুদ্র তীরে তোলা।
বাড়িতে ফিরে প্রান্তর হতাশ হয়ে বলল, " যা ভেবেছিলাম সব তো ভেস্তে গেল। এ তো এবার আরো জটিল হয়ে গেল। তাছাড়া সময়ও হাতে খুব কম।"
বিকেল বেলা প্রান্তর চ্যাটার্জী লাইব্রেরি থেকে বইটা নিয়ে এল। দেখলাম রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর কবিতার বই। বাংলাদেশের এই কবি আমারও খুব প্রিয়। বইটা কয়েকটি পৃষ্ঠা পরে একটা কবিতা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম, 'আমার ভেতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে' এটা রবি ঠাকুরের নয়, এনারই লেখা।
আজ তৃতীয় দিন সকাল বেলা। প্রান্তরকে আজই এই রহস্য ভেদ করতে হবে। কারণ কাল আমরা স্বপরিবারে ভ্রমণে যাবো, মুর্শিদাবাদে। আর প্রান্তরও আমাদের সঙ্গে যাবে। প্রান্তরের মা বাবা আজ সন্ধ্যাবেলা এখানে আসবে।
চলছে ......
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল প্রান্তরের ডাকে। ব্যস্ততার সাথে বলল, "তাড়াতাড়ি ওঠ। গুছিয়ে নে। রাজদীপদের বাড়িতে যেতে হবে।"
আমি অবাক হয়েই বললাম, " কেন? এখন ওদের বাড়িতে যাবো কেন?"
প্রান্তর গুছাতে গুছাতে বলল, " রাজের হীরের আংটির হীরেটা চুরি হয়ে গেছে। ও ফোন করেছিল। তাড়াতাড়ি যেতে বলল। এর বেশি আমি কিছু জানি না।"
তারপর মিনিট দশেকের মধ্যেই আমি গুছিয়ে নিয়ে প্রান্তরের সাথে রাজদের বাড়ির জন্য বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে প্রান্তরকে বললাম, " আচ্ছা, আমাদের ডাকার কারণটা কি? ওর কি সন্দেহ আমাদের প্রতি নাকি!" কিন্তু প্রান্তর কোনো উত্তর দিল না।
গিয়ে দেখি রাজদীপদের বাড়িতে যথেষ্ট শোরগোল পড়ে গিয়েছে। পুলিশও এসেছে দেখলাম। আমাদের দেখেই রাজদীপ ছুটে এলো। ওর মুখটা দেখে বুঝলাম, বেচারা বড়ো কষ্ট পেয়েছে হীরা চুরি হওয়ায়।সে প্রান্তরের হাতে হাত রেখে বলল, " শুনেছি, তুই ডিটেকটিভ গল্প পড়তে ভালোবাসিস। সত্য অন্বেষণ করতে ভালোবাসিস। তাহলে যে করেই হোক আমাদের ঐতিহ্যকে খুঁজে দে ভাই।"প্রান্তর আমতা আমতা করে বলল, " পুলিশ আছেন তো, ওরাই খুঁজে দেবেন। তুই আমাকে বলছিস কেন? " একথা বলে চলে আসার জন্য সবেমাত্র ঘুরেছি, অমনি রাজ বলল, " তুই যদি আমার ভালো বন্ধু ভাবিস তাহলে তুই কখনও এটা এড়িয়ে যাবি না। আমার বিশ্বাস, পুলিশের আগেই তুই এর রহস্যভেদ এবং অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারবি।" একথা শোনার পর, বলার মতো আর কোনো কথা থাকে না।অগত্যা প্রান্তরকে দায়িত্বটা নিতেই হলো।
তারপর প্রান্তর মিনিট দুয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর, মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, " আচ্ছা, আমরা কাল চলে যাওয়ার পর ঠিক কি ঘটেছিল?"
রাজ প্রথমটাই বোধ হয় শুনতে পেল না। আমি কথাটা আর একবার বলায় রাজ তাড়াতাড়ি করে বলল, " হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলছি .... কাল তোরা চলে যাওয়ার আগেই তো অনেকেই চলে গিয়েছিল। তারপর যারা ছিল তারা এখানেই আছে। আমার মামা-মামি, জ্যাঠা- জ্যেঠি, পিসি, মা- বাবা আর বাবার বন্ধু মলয় কাকু এনারাই। তোরা্ চলে যাওয়ার পর আরো কিছুক্ষণ সবাই এক জায়গায় বসে অনেক আড্ডা হয় তারপর রাত্রি প্রায় বারোটা নাগাদ সবাই যে যার রুমে চলে যায়। আমি যখন আমার রুমে ঘুমাতে যায় তখন হাতে আংটি ছিল, হীরাও ছিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হীরা নেই, আংটি আছে।" হঠাৎ পাশ থেকে একজন বলল, " দরজাটা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল? " তাকিয়ে দেখি বসিরহাট থানার ওসি দীপঙ্কর চক্রবর্তী। তিনি কখন তল্লাশি করে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ,বুঝতেই পারলাম না। এবার রাজ দীপঙ্কর বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, " হ্যাঁ, দরজাটা ভেতর থেকে লক ছিল। "তারপর আমি একটা প্রশ্ন করতে যাবো এমন সময় রাজ আমাদের দিকে নির্দেশ করে দীপঙ্কর বাবুকে বলল, "স্যার, এরা আমার বন্ধু। আপনি আপনার মতো তদন্ত করুন। এরা এদের মতো করবে। " তারপর আমি আর প্রান্তর দীপঙ্কর বাবুকে আমাদের পরিচয় দিলাম। দীপঙ্কর বাবু আমাদের দিকে একবার তাকালেন তারপর অভিলাশ কাকুকে বললেন, " যতদিন না এই কেস সমাধান হবে ততদিন কেউ এ বাড়ি থেকে বেরোবেন না। এই বলে দীপঙ্কর বাবু চলে গেলেন।
এবার এতক্ষণ পর প্রান্তর মুখ খুলল। ও বলল, " তোর রুমে ঢোকার অন্য কোনো পথ আছে? " রাজ একটু ভেবে বলল, " না নেই।একটাই পথ আমার ঘরে ঢোকার।"
" আচ্ছা, ঠিক আছে। "- বলে প্রান্তর অভিলাষ কাকুর সামনে গিয়ে বললেন, " কেসটা যখন নিতেই হল, তখন সমাধান তো করতেই হবে। তো ভাবছি বাড়িতে এখনও পর্যন্ত যারা আছেন তাদের সব্বাইকে আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করব। এজন্য আপনার অনুমতি চাইছি। "অভিলাষ কাকু তখন একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও মুখে বললেন, " ঠিক আছে। করো। "প্রান্তর এবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজকে বলল, " একটা ঘর .....। " প্রান্তরের মুখের কথা শেষ না করেই রাজ বলল," আমার ঘরে থেকে জেরা করতে পারিস।"
আমি আর প্রান্তর দোতলায় রাজের ঘরে গেলাম।রাজকে বললাম তলায় থাকতে আর যখন যাকে বলব তখন তাকে পাঠাতে। আমি রাজের ঘরের বাইরে দাঁড়ালাম।
তারপর একে একে সব্বাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। এমনকি রাজের মা, বাবা সহ রাজকেও।আমি যেহেতু ঘরের বাইরে ছিলাম তাই ভেতরে কি জিজ্ঞাসাবাদ চলছে সেটা জানতে পারিনি। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল। জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় অভিলাষ কাকুর বন্ধু একটু অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। পরে জেনেছিলাম উনি একজন স্কুল শিক্ষক। উনার নাম মলয় ব্যানার্জী।
এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর প্রান্তর বাড়ি ফিরে আসি।কিন্তু আবেগী মনকে বেশিক্ষণ সামলে রাখতে পারিনি।একটা প্রশ্নের উত্তর অনেকক্ষণ ধরে জানতে ইচ্ছা করছে। অবশেষে লাঞ্চ করতে করতে প্রান্তরকে জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। বললাম, " জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে পারলে?" প্রান্তর মুখ না তুলেই বলল, " খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। পরে নিশ্চয়ই বলবো। এটুকুই জেনে রাখ এখন যে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু নেই, যা থেকে সন্দেহ করা যায়। " আমি যে এই উত্তরে খুশি হলাম তা নয় তবুও আর একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। বললাম, " তুই নিজে তল্লাশি করলি না কেন? "এবার ও আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো, " পুলিশ করেছে তো। আমার উনাদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আছে। " আমি অবশেষে বললাম, " ভালো। "
বিকেলে মাঠে যাওয়ার জন্য যখন প্রান্তরকে ডাকতে গেলাম তখন দেখি জানালার দিকে ফিরে ও একটা পেন সুন্দর করে দেখছে। আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ওর পেছন থেকে দেখার চেষ্টা করবো ভাবছি এমনি সময় ও বললো, " আচ্ছা দেবা,বন্ধ ঘর থেকে কীভাবে চুরি হতে পারে বলে তোর মনে হয়?"আমি আবাক হয়ে বললাম, " তার মানে তুই্ বলছিস চুরি হয়নি, আর হলেও হীরা রাজের ঘরেই আছে? "প্রান্তর জামা পরতে পরতে বলল, " আমি কিছু বলছি না। সবকিছু সময় বলবে।"চল, আজ আর মাঠে যাব না, একটু রাজ'দের বাড়িতে যেতে হবে। যেতে যেতে প্রান্তর আমায় কি কি করতে হবে সবই বলে দিল।
রাজ'দের বাড়িতে পৌঁচ্ছে শুনলাম রাজ বাড়িতে নেই। আর সেজন্য অত্যন্ত বাধ্য হয়েই মতলবটা পরিবর্তন করতে হল। অবশেষে, অভিলাষ কাকু'র থেকে অনুমতি নিয়েই প্রান্তর শুধুমাত্র রাজের ঘর তল্লাশি করল। আর আমি বাইরে অভিলাষ কাকুর সঙ্গে গল্প করছিলাম। শুনলাম কোথা থেকে আংটি তৈরি করা হয়েছিল। ইত্যাদি। প্রায় মিনিট দশেক পরে প্রান্তর বাইরে এসে বলল, " না। এ ঘরেও নেই। "তারপর রাজ'দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা একটু সাহিত্য সংঘ লাইব্রেরীর দিকে গেলাম।দু'জনে কিছু বই ঘাটাঘাটি করে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে এসে প্রান্তর পকেট থেকে একটা আংটি বের করে বলল," এই হল সেই হীরা। " আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, " তাহলে অভিলাষ কাকু'র সামনে মিথ্যা বললে কেন?"এবার প্রান্তর হাসতে হাসতে বলল, " অঙ্কের উত্তর মিললেও একবার ক্রসচেক করে নেওয়া ভালো। না হলে বলা যায় না ভেতরে কোথাও ভুল আছে কিনা! "
রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমি একবার প্রান্তরের ঘরে গেলাম। দেখলাম হীরাটাকে মুখের সামনে ধরে মুখের নিঃশ্বাস ওই হীরার উপর দিচ্ছে। তারপর ওর মুখে দেখলাম একটা হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে। ও আমার দিকে ফিরে বলল, "তোর কাছে শিরিষ কাগজ আছে?" আমি বললাম, " হ্যাঁ। আছে। " যেহেতু বাড়িতে একটা পুরোনো সাইকেল ছিল, সেটাই কয়েকদিন ধরে অসময়ে ঘষছি। আমি নীচে আমার ঘর থেকে এক টুকরো শিরিষ কাগজ এনে প্রান্তরকে দিলাম। ও সেটা নিয়ে হীরার উপর ঘষতে শুরু করলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল, "আমাকে ঠকানো এত সহজ নয়।" আমি কি হয়েছে জানতে চাইলে প্রান্তর বলল, " কাল একবার সেই দোকানে যেতে হবে যেখান থেকে হীরার আংটি তৈরি করা হয়েছিল।
পরের দিন সকালে আমি আর প্রান্তর দোকানের মালিক অর্থাৎ প্রকাশ রায়ের থেকে হীরার ব্যাপারে জানতে চাইলে, প্রকাশ কাকু বললেন,"অভিলাষ আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু।তাছাড়া ও মাঝে মাঝেই আমার এখানে এসে বসে,গল্প করে।ওর ছেলের জন্মদিনেও তো আমার নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ওদিন প্রচন্ড ব্যস্ত থাকায় যেতে পারিনি। তাই তাকে ঠকানোর কোনো প্রশ্নই নেই।" তারপর, প্রকাশ কাকু'র মাথার ঠিক পেছনে বাঁধানো একটা ছবি দেখে কথাটা বিশ্বাস করলাম। ছবিটি প্রকাশ কাকু আর অভিলাষ কাকু'র দীঘা'য় সমুদ্র তীরে তোলা।
বাড়িতে ফিরে প্রান্তর হতাশ হয়ে বলল, " যা ভেবেছিলাম সব তো ভেস্তে গেল। এ তো এবার আরো জটিল হয়ে গেল। তাছাড়া সময়ও হাতে খুব কম।"
বিকেল বেলা প্রান্তর চ্যাটার্জী লাইব্রেরি থেকে বইটা নিয়ে এল। দেখলাম রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর কবিতার বই। বাংলাদেশের এই কবি আমারও খুব প্রিয়। বইটা কয়েকটি পৃষ্ঠা পরে একটা কবিতা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম, 'আমার ভেতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে' এটা রবি ঠাকুরের নয়, এনারই লেখা।
আজ তৃতীয় দিন সকাল বেলা। প্রান্তরকে আজই এই রহস্য ভেদ করতে হবে। কারণ কাল আমরা স্বপরিবারে ভ্রমণে যাবো, মুর্শিদাবাদে। আর প্রান্তরও আমাদের সঙ্গে যাবে। প্রান্তরের মা বাবা আজ সন্ধ্যাবেলা এখানে আসবে।
চলছে ......
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০৬/০৪/২০২২সুন্দর উপস্থাপন
-
মোঃ আমিনুল ইসলাম মিঠু ০১/০৩/২০২২অসাধারণ গল্প। ভাল লাগল
-
ফয়জুল মহী ১৯/০২/২০২২অসাধারণ লেখনী ..
খুব ভালো লাগলো