www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অপ্রয়োজনীয় নয় সে

--হ্যালো! অনির্বাণ? আমি তোদের দেবা বলছি। কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি, ফোন তুলছিস না কেন?
--হ্যাঁ। বল দেবা । আরে একটু ব্যস্ত ছিলাম রে। তারপর বল কেমন আছিস?
--আমি ভালো আছি রে। তোরা কেমন আছিস?
--আমরা ভালো আছি। আজ ছয় বছর পর বন্ধুটার মনে পড়ল। বল, কবে বাড়ি আসবি?
--হ্যাঁ, ওটাই বলবো বলে ফোন করলাম। আমার বাড়িতে এখন কিচ্ছু জানাবি না। আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাস। কাল এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিটে দমদম পৌঁচ্ছাবো।
--সেই যখন আসবি তো কয়েকদিন আগে আসলে ভালো হত না। আমার বিয়েটাও দেখতে পেলি না।
-- তাতে কি হয়েছে? এখন ফিরছি তো। আর সেজন্য ঠিক করেছি তোদের বাড়িতে আগে যাব।
-- ঠিক আছে। কাল দেখা হবে। রাখছি।
-- আচ্ছা। সময় মতো আসিস।

অনির্বাণের সাথে কথা শেষ করে ফোনটা রাখতেই মনে পড়ল অ্যান্টি কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা হল না তো। নিজেকে খুবই লজ্জিত মনে হচ্ছিল।আবার কল করতে যাবো ভাবতেই মনে পড়ল ও এখন ব্যস্ত। সেজন্য ফোন ধরতে দেরি হয়েছিল। তাই আর কল করিনি। কাল বিশ্ব মাতৃ দিবস। নিশ্চয়ই মা আমাকে দেখে খুব খুশি হবেন। আজ ছয় বছর পর লন্ডন থেকে বাড়ি যাবো। হয়ত ওদিকে সবকিছু পালটে গেছে। এসব ভাবতে খুব ভালো লাগছিল।

পরেরদিন অনির্বাণের গাড়িতে করে ওদের বাড়িতে গেলাম। অনির্বাণ বিয়ে করেছে এই ছয় মাস হলো। আমার সেসময় আসার কথা ছিল কিন্তু আসতে পারিনি। তবে যাই হোক, অবশেষে এসে পৌঁছালাম।

আসতে আসতে অনির্বাণের স্ত্রীর নাম জেনে নিয়েছিলাম। ওর নাম রূপালী। সবাই রূপা বলে ডাকে। আসতে আসতে একটা জিনিস লক্ষ করলাম যে অনির্বাণ প্রয়োজন থেকে একটু বেশি স্ত্রীর প্রশাংসা করছে। অনির্বাণ বাড়ির সামনে এসে রূপাকে দেখিয়ে বলল, " এই আমার রূপা। " তাতে দেখলাম রূপা একটু লজ্জা পেয়ে গেল। তারপর অনির্বাণ বলল, " আচ্ছা, দেবা। তুই বস। আমি তোর মালপত্র গুলো নামিয়ে নেই। " তখন আমি বাঁধা দিয়ে বললাম, " না থাক। আনতে হবে না। আমি বেশিক্ষণ এখানে থাকব না। বাড়ি যেতে হবে তো। " এতক্ষণে রূপা অন্য ঘরে চলে গেছে।আর যাওয়ার সময় বলে গেল আমাদের ফ্রেশ হয়ে নিতে।

-- আচ্ছা অনির্বাণ, অ্যান্টিকে দেখছি না যে ! কোথায় গিয়েছে অ্যান্টি?
--মা, বাড়িতে নেই।
-- বাড়িতে নেই? তবে কোথায় গিয়েছে? তোর তো কোনো দিদিও নেই যে অ্যান্টি মেয়ের বাড়ি যাবেন।
অনির্বাণ আমতা আমতা করে বলল, " মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি। তাছাড়া কি করতাম বল!
-- কি করতিস মানে? অ্যান্টি কি অন্যায় করেছে?
-- তুই তো জানিস,ভাই। মায়ের মুখের ভাষা কতটা খারাপ। তারপরও......
--তারপরও কি? বল .....থামলি কেন?
--আমার বিয়ের পর মা যদি ঐভাবে আমার স্ত্রীর সামনে গালিগালাজ করে বা বাজে কথা বললে খুব খারাপ দেখাবে। সেজন্য আগে থেকেই রেখে আসলাম।
-- মানে অ্যান্টি এই ছয় মাস বৃদ্ধাশ্রমে? ছি .... অনির্বাণ... ছি। আজ তোকে আমার বন্ধু বলতে লজ্জা করছে।
-- আচ্ছা। ঠিক আছে। বাদ দে।অনেকদিন পর আসলি .... নে ফ্রেশ হয়ে নে।
-- না ভাই। এটা বাদ দেওয়ার মতো ব্যাপার নই।
-- কিন্তু এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোর মাথা ঘামাতে হবে না।
-- হ্যাঁ জানি তো। কিন্তু আজ থেকে ছয় বছর আগে আমিও এই পরিবার নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি। তাই আজও ঘামাবো।কৈ সে সময় তো বারণ করিস নি। তুই কি জানিস তুই কত বড়ো অন্যায় করেছিস। তুইও বা জানবি কীভাবে? তোর মানবতা আজ কোথায় নেমেছে সেটা কোনোদিন জানার চেষ্টা করেছিস? করিস নি । করলে এই ভুলটা করতিস না। হ্যাঁ মানছি মানুষটা একটু গালিগালাজ করে কিন্তু তার জন্য তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে হবে? তুই আজ মানুষটার জায়গায় থাকলে তুইও করতিস।
তুই কি ভুলে গিয়েছিস, তোর যখন সাত বছর বয়স তখন তোর বাবা মারা যায়। তারপর থেকে যে মানুষটা তোকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে সেটাই তোর মা।
তুই একবেলা রাগ করে না খেয়ে থাকলে যে মানুষ তোকে জোর খাওয়ানোর চেষ্টা করত, তবুও না খেলে যে আমার কাছে গিয়ে অনুরোধ করত তোর রাগ কমানোর জন্য সেই মানুষটা তোর মা।
তোর কোনো শখ হলে যে মানুষটা প্রাণপণ চেষ্টা করত তোর শখ মেটানোর জন্য সেই মানুষটা তোর মা।
তোর বাবা তোদের জন্য কি রেখে গিয়েছিল? কিছুই রেখে যান নি। কিন্তু আজ এই অট্টালিকায় বাস করছিস এটা কে তৈরি করেছে? তোর মা।
এগুলো সবই আজ ঢাকা পড়েছে তোর মায়ের একটা দোষে? কত কষ্ট করে তোকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেটা কোনোদিন ভেবে দেখেছিস?একটা মানুষ কত কষ্ট করে সংসারটা নিজে হাতে তৈরি করেছেন তুই তাকে তার যোগ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছিস? মায়ের চোখের জল দেখতে খুব ভালো লাগে বল? নিজের মাকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করলি না। মাকে নিয়ে কখনও একটুও ভাবলি না কিন্তু পরের মেয়ে ঘরে আনার আগেই এত ভাবনা।
-- হ্যাঁ। ভাবতে তো হবেই। মা তো আর সারাজীবন থাকবেন না।
-- হ্যাঁ জানি। মা সারাজীবন থাকবেন না।তাহলে যখন ছোটো ছিলি তখনই মাকে মেরে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল। আসলে এতদিন মা রান্না করেছেন এখন রান্না করার জন্য স্ত্রী আছেন। সেজন্য বুঝতে পারিস নি মায়ের গুরুত্ব।
-- দেবা, আমাকে এত জ্ঞান না দিয়ে আমার মাকে তোর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখ তাহলে বুঝতে পারবি।
-- রাখতাম রে। কিন্তু আমার বাড়িতে থাকা আর বৃদ্ধাশ্রমে থাকার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য হবে না। সেই মানুষটার কষ্ট কিছুমাত্র কমাতে পারবো না। সন্তান থেকেও কাছে না পাওয়ার যন্ত্রনা বড়ো কষ্টের। তাছাড়া নিজে হাতে গড়া সংসার, এসব কিছুই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না রে। এটা একমাত্র তুই পারিস। তাই তোকে অনুরোধ করছি একবার মানুষটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়।
--তা আর সম্ভব নয়।
-- কেন? আমি জানি তোর স্ত্রী কখনও এ বিষয়ে কোনো আপত্তি করবে না।
-- আমার স্ত্রীকে তুই তো আজ প্রথম দেখলি তাহলে এত বিশ্বাস কি করে করলি?
--সেটা তোর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা কর।
অনির্বাণ ওর স্ত্রীকে ডাকলো। তারপর রূপাকে বললো, " তুমি কি দেবাকে আগে থেকে চিনতে?
রূপা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো, " আজ বিশ্ব মাতৃ দিবস। মাকে বাড়িতে নিয়ে এসো। যাও।
--তুমিও একই কথা বলছো। এটা আগে কেন বলোনি?
-- আমি তোমার মাকে তো আগে কোনোদিন দেখিনি তাছাড়া কেন বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছো সেটাও তো কোনোদিন বলোনি। অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তুমি বারবার এড়িয়ে গেছো। আজ শুনলাম আসল কারণটা।
--আচ্ছা। সবই তো বুঝলাম। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর এখনও পায়নি। দেবাকে তুমি কি আগে থেকে চিনতে?
-- হ্যাঁ। ও আমার দূর সম্পর্কের পিসির ছেলে। যখন তোমার থেকে অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি তখন একটু খোঁজ নিয়ে জানলাম। দেব'দা তোমার বন্ধু। তারপর তোমার ফোন থেকে দেবদাদা'র নম্বর নিয়ে দেবাদা'কে ফোন করে সব বললাম।কারণ এখানে বলার মতো আর কেউ ছিল না। তখন ও শুনে আবাক হয়ে যায়। তারপর ও ফিরবে ঠিক করে।
-- তাহলে দেবা, আসতে আসতে তাহলে তুই আমার স্ত্রী'র নাম জিজ্ঞাসা করলি কেন ?
-- যাতে তুই বুঝতে না পারিস যে আমি রূপা'কে চিনি। তোকে সারপ্রাইজ দিতে এটুকু নাটক আমাকে করতেই হত।
-- ভিতরে ভিতরে এত কিছু। আচ্ছা যাই হোক। চল মাকে নিয়ে আসি। মা আমার উপর খুব রাগ করে আছে। থাক ক্ষমা চেয়ে নেব, মা ক্ষমা করে দেবেন। আমার একটু বিশ্বাস আছে।
এবার আমি বললাম, " থাক। আর যেতে হবে না, কষ্ট করে। রূপা গিয়ে গেটটা খুলে দেখ অ্যান্টি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। "
আমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই অনির্বাণ দরজা খুলে দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। ও তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে পা ধরে ক্ষমা চাইলো। রূপা গিয়ে প্রনাম করলো। আমিও প্রনাম করলাম।

কিন্তু একটা বিষয়ে এখনও অনির্বাণের জট ছাড়ায় নি। ও আমাকে লাঞ্চ করতে করতে জিজ্ঞাসা করেছিল, " দেবা, তুই এত কিছু কখন করলি? " আমি হাসতে হাসতে বললাম, "আমি দমদমে পৌঁছেছিলাম ছটা বেজে দশ মিনিটে। "

লাঞ্চ শেষ করার পর অনির্বাণকে শুধু একটাই কথা বলার ছিল, "অনেকে হয়ত ভাবে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার পিছনে হয়ত বৌমার দোষ, কিন্তু সেটা কখনো হয় না।সবক্ষেত্রেই দোষটা সন্তানেরই কারণ স্ত্রী যতই মায়ের নামে নিন্দা করুক না কেন সন্তান হিসেবে সেটা কখনও মেনে নিতে নেই। বরং মাকে ও স্ত্রীকে দু'জনকেই সামলাতে হয়। এক্ষেত্রে কোনোরকম বিচার চলে না। একটা ছেলের জীবনে দু'জনের গুরুত্ব সমান।

তারপর অনির্বাণের গাড়িতেই আমার বাড়িতে আসতে মা, বাবা আবাক হয়ে যায়। মা, বাবা খুব খুশি হয়।



*******
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৪২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০২/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অনিন্দ্য সুন্দর
  • ফয়জুল মহী ০৯/০২/২০২২
    Excellent writen
 
Quantcast