স্কুলের প্রথম দিন
গোয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
পৃথিবীতে অনেক মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন যাদের স্মৃতি শক্তি প্রচন্ড রকমের গভীর,ধারালো এবং গোছানো। একবার কোন একটি জিনিস দেখলে কিংবা পড়লেই হল। সারা জীবন স্মৃতির ক্যানভাসে থেকে যায়। পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাকি এমন একটি উর্বর মগজওয়ালা মাথা ছিল!
আর বিজ্ঞানের জনক আইনস্টাইনের মাথায় এত বুদ্ধিকণা থাকা সত্বেও নিজের বাড়ির ঠিকানাটাও তিনি মাঝে মধ্যে ভুলে যেতেন!
এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে,যদি কখনো কোন ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানের নাম কিংবা আকার আকৃতির গুরুত্ব কম মনে হয়েছে অথবা হালকা ভাবে নেওয়া হয় তবে তা অল্প সময়ের ব্যবধানেই স্মৃতি থেকে মুছে যায়।
আর জীবন চলার পথে কিছু কিছু বিষয় কে হালকা ভাবে গ্রহণ করার কারণেই শৈশব ও কৈশোরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো অাজ অার মনে পড়ছেনা।
সময়ের সাথে পাল্টে যায় মানুষের ভাললাগা, চাওয়া পাওয়া। মানুষ হিসাবে আমিও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। এক সময়ের চাওয়া গুলো এখন আর ওভাবে চাওয়া হয়না।ভাললাগার মতো জিনিসগুলো ওভাবে ভাললাগেনা। তাই আমার সকল চাওয়া পাওয়া সময়ের কাছে লীজ দিয়ে দিয়েছি। নিজের কাছে রেখেছি কেবল কিছু সুখ স্মৃতি। পৃথিবীর ডজন খানেক দেশের বহু শহর বন্দর আর নামীদামী অনেক কিছুই দেখেছি। অনেক কিছুই মনে ধরেছে। কিন্তু মনের গভীরে বাসা বাঁধতে পারেনি। যেমনি করে মনের খাঁচায় বাসা বেঁধে আছে আমার প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের খেলাঘর গোয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
★★নব্বই পূর্ববর্তী সময়ে আজকের সুন্দর এই বিদ্যালয়টির পুরাতন শ্যাওলা পরা বিল্ডিংয়ে না ছিল কোনো দরজা আর না ছিল জানালা! কেবল গোটা কয়েক কাঠের টোল, প্রতি ক্লাশে একটি করে ব্লাকবোর্ড জানান দিতো এটি একটি মানুষ গড়ার কারখানা!
আকাশে কালো মেঘ করে বৃষ্টি নামলে স্কুলের বারান্দায় এসে জড়ো হতো ছাগল, ভেড়া আর পথচারী মানুষের দল। কখনো সখনো শিলা বৃষ্টিতে বেশ মজা হতো; ক্লাশে বসেই কড়মড় করে খেতে পারতাম হিরার মত চকচকে বরফের টুকরো!
★★ প্রাইমারী স্কুলের অনেক স্মৃতিই আজ আর ততো একটা মনে করতে পারছিনা। তবে আমার যেদিন ছোটওয়ানে(আজকের প্লে) ভর্তি সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। মা গোসল করিয়ে সমস্ত শরীরে সরিষার তেল মাখিয়ে দিলেন। চুলে সিঁথিপাটি কাটলেন অার কপালে মায়ের আঙুলে কুপির কালির টিপ। পরতে দিলেন খাকি কালারের ইংলিশ প্যান্ট সাথে আকাশের তারার মতো ছাপা বেগুনী রঙের টি শার্ট। তখন গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের কেউ জুতো পরতোনা। তাই অামিও না। স্কুলে যাওয়ার সময় ছেলের যেন কোন অমঙ্গল না হয় থুপথুপিয়ে দিলেন মা। মা যত দিন দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন ছেলের মঙ্গল কামনায় প্রায়ই এমনটি করতেন।
মনে পড়ে ১৯৮৭ সাল। নির্মেঘ অাকাশ। রোদেলা সকাল। অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মাঝে আজ আমিও একজন। অামার অগ্রজ সহোদর জনাব এস এম শাহাবুদ্দিন আমাকে স্কুলে নিয়ে গেলেন। তিনি তখন ৫ম শ্রেণির ছাত্র এবং আমার ইমিডিয়েট সহোদরা মোছাম্মৎ আসমা ইসলাম তখন ৪র্থ শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী। যিনি বল্লভপুর গ্রামের নারীদের মধ্যে প্রথম গ্রাজুয়েশন অর্জনকারী নারীও বটে। বর্তমানে সরকারি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত অাছেন।
স্কুলের ক্লাশ রুম। একজন শিক্ষক একটি কাঠের চেয়ারে বসা। সুন্দর চেহারা। সুঠাম দেহের অধিকারী। স্পষ্ট ও গম্ভীর কথামালা। সামনে একটি টেবিল। টেবিলের একপাশে একটি জালিবেত,একটি চক ও ডাষ্টার। হাতে একটি ঝর্ণা কলম। সামনে একটি রোল করানো খোলা খাতা। অামাকে কাছে ডাকলেন। একটু ভয় পাচ্ছিলাম; সাহসও ছিল কারণ,ভাইতো কাছেই আছেন। স্যার জানতে চাইলেন,
"শাহাবুদ্দিন ও তোমার কি হয়?"
ভাইয়া বললেন,আমার ছোট ভাই।
ব্যাস। এবার আমাকে স্যার তিনটি প্রশ্ন করলেন।
-"এক থেকে দশ পর্যন্ত বলতে পারো"?
অামি থেমে থেমে বলতে লাগলাম ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ১০
দ্বিতীয় প্রশ্নে বললেন,"পাঁচটি ফলের নাম বল"?
আমি এক নিশ্বাসে বললাম, অাম,জাম,কাঠাল,কলা,অানারস।
তৃতীয় প্রশ্নে স্যার বললেন,"পাঁচটি ফুলের নাম বল"?
আমি বলেছিলাম,গোলাপ,জবা,বেলী, শাপলা,শিমুল।যদিও শিমুল ফুল আমি তখনো চিনতাম না।
স্যার ভাইকে বললেন,"পড়ে নাকি বেশি দুষ্টামি করে?"
ভাই ঘাড় সামনের দিকে খানিক ঝুকিয়ে বললেন,"পড়ে,পড়ে স্যার"।
আমি খেয়াল করলাম স্যারের সামনে রোল করানো খোলা হাজিরা খাতার ১নং ঘরটি ফাঁকা। ইতোমধ্যে অনেক ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে এবং ২নং ঘর থেকে অনেকগুলো নামও খাতায় লিখে নিয়েছেন। আমাকে বললেন,
"স্কুল মিস করা যাবেনা। ভালো করে পড়াশুনা করতে হবে। ঠিক অাছে,কেমন?"
★★আমিও অনুগত সুবোধ বালকের মত মাথা সামনে পিছনে করে স্যারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করলাম।
দুচোঁখ দিয়ে দেখলাম,হাজিরা খাতার ১নং ঘরের ফাঁকা জায়গাটিতে স্যারের হাতের ফাউনটেইন পেনটি খচখচ শব্দ করে অামার নামটি লিখে দিল।
আমি হয়ে গেলাম ক্লাশ ওয়ানের ক্লাশ ওয়ান বয়। তিনি জনাব শাহজাহান স্যার। ধন্যবাদ স্যার। অাপনার প্রতি অামার বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।
প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া সেই আমি স্কুল, কলেজ জীবন এবং কর্মজীবনেও বহু পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। তবে এখনো প্রথম শ্রেণির মানুষ হতে পারিনি! স্বার্থকে ত্যাগ করতে পারিনি, বয়স বাড়ার সাথে সাথে অন্ধ স্বার্থকে ঘৃণা করার রুচিবোধ কিছুটা জন্মেছে।
মধুময় শৈশব, দুরন্ত কৈশোর!!
১৯৮৮ সাল। সেবছর সারা বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় একই সাথে বন্যা দেখা দিয়েছিল। সেবার আমাদের গ্রামের বাড়ি বল্লভপুরের হাজী মঞ্জিলেও পানি উঠেছিল। ঘরের মধ্যে পানি বন্দি মানুষের নিদারুন কষ্ট দেখেছি। বড়দের অনুকরণে মশারীর নেট দিয়ে ঘরের মধ্যেই মাছ ধরতাম। উঠোনে বড়শী ফেলতাম। সন্ধ্যার পর লোকজন কুপি আর চল নিয়ে মাছ ধরতে বের হতো। কতজনার সাথে যে আমিও কুপি রাখার হেল্পার ছিলাম তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের ছিল বড় বড় পাট শোলার কাড়ি। তা দেখে লম্বা লম্বা ডিঙি নৌকায় মাছ ধরতে আসা জেলেরা আমাদের বাড়িতে এসে নাউ ভিড়াতো। মাছের বিনিময়ে তাদের জ্বালানির জন্য পাটকাঠি নিয়ে যেতো। সে বছর পুকুরের সকল পালা মাছ ভানের জলে ভেসে যাওয়ায় সারা বছরই মানুষ স্বল্প মূল্যে মাছ খেতে পেরেছে। প্রায় সব ঘরেই তখন কনিজাল,পেলুন কিংবা ময়াজাল থাকতো। তখনো কারেন্ট জালের আবির্ভাব তেমন একটি হয়নি। তখন জমিতে গোবর/ছাই ছাড়া কৃষককুল আধুনিক সার ও কিটনাশক তেমন একটা ব্যবহার করতেন না। তাই আমাদের শৈশব ছিল মাছে ভাতে।
লুংগি!! সেতো আমার নিজের বলে কিছুই ছিলনা।
বড়দের লুংগি ভাজ করে পরতাম। তাও ক্লাশ থ্রিতে যখন উঠেছি।
তার আগে কখনো হাফ প্যান্ট কখনো শুধু লম্বা শার্ট অথবা গেঞ্জি।
নিচের অংশ সবসময় ঢেকেই রাখতে হবে এমন প্রয়োজনীয়তা কখনো বোধ করিনি।
কারণ অনেক শিক্ষার্থীদেরই শরীরে একটির বেশি জামা থাকতো না। আজকালের ছেলে মেয়েদের মতো কে প্যান্ট পরলো আর পরলোনা তা বুঝার সক্ষমতা সে সময় ছিলনা।
তাই আমরা ছিলাম সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে।
অদের খাল। বাড়ির পাশে শৈশবের ভালবাসার খাল। স্বপ্নের জলাধার। এই খাল ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে অাসা আওড়া গাঙ্গের পানি নিয়ে মিলে যায় রাজার খালের সাথে। রাজার খালের পানি মিলিয়ে যায় বুড়ি নদীর জোয়ার ভাটার সাথে। এখন খালের সেই যৌবন আর নেই। এক সময় খালের পাড়ে বসে জোয়াড় ভাটা দেখতাম। কত ইট বালি বোঝাই বড় ডিঙা আর কোষা নৌকা,বেদে নৌকার বহর দেখতাম! মাঝি মাল্লাদের গলা ফাটানো সুরেলা গান শোনা যেত। খড়মপুর গামী সাজোয়া নৌকার সদর রাস্তা ছিল এটি। আজ তা কেবলি অতীত। অদের খালের পানিতে কত্ত রকমের মাছ সারি বেধে খেলা করতে করতে ভেসে যেতো। দুচোখ ভরে দেখতাম। কখনো কখনো খেজুর কাঁটার চল দিয়েও মাছ ধরেছি। ছোট মাছের ঝাঁকে ভুলেও কেউ চল মারতোনা কিংবা জাল ফেলতো না। কোথায় গেল সেই রূপালী মাছের সোনালী দিন? আজকের শিশুর নিকট, আজকের প্রজন্মের কাছে তা কেবল গল্পই মনে হবে।
ঘরে সব সময়ই দুধের গাভী দেখেছি। যেকারণে দুধ কিনতে বাজারে যেতে হতোনা। কাঁচা মরিচ,পেঁয়াজ, রসুন,ধনিয়া,তিলের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ গুলোও নিজেদের জমিতেই উৎপাদিত হতে দেখেছি।তাই লবন আর কেরোসিন তেল ছাড়া বাজার থেকে কেনার মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির তালিকায় তেমন কিছুই ছিলনা। বিজ্ঞানের আশ্চর্তম আবিস্কার বিদ্যুৎ গাঁও গেরামের অন্ধকার দূর করেছে। আজ গ্রামের মানুষের কেরোসিন কিনতে হয়না এ কথা শতভাগ সত্য। এছাড়া সবই কিনতে হয়!!
জুতা জোড়া। এ এক বড় মূল্যবান বস্তু। আমার শৈশবে জিতা জোড়ার কদর ছিল। দেখেছি সেই সময়ে মুরুব্বিরা কোথাও বেড়াতে গেলে জুতো জুড়া বগলের নিচে করে অথবা ব্যাগে নিয়ে যেতেন। আর কুটুমবাড়ির কাছকাছি গিয়ে কোন ডুবা কিংবা পুকুর থেকে পা ধুয়ে সযতনে জুতো জুড়া পরতেন। অভাব অনটনের কারণেই যে মানুষ জুতো পরতো না তা কিন্তু নয়, আসলে তখন রাস্তা ঘসটও এতটা ভাল ছিলনা। বাড়িতে বাড়িতে উঠোনের কোণায় কোণায় খেড় পাড়া,গোয়াল ঘরে গরু বাছুরের পাল, বছর জুড়ে নানান ফসল ঘরে তোলার তাড়া। জুতো পরার সময় কোথায়? আজকাল অবশ্য ডলার,দিনার,রিয়েল,দিরহাম আমদানির কারণে গ্রামে কোনো কৃষক নেই। হাল চাষের গরু নেই,লাঙ্গল জোয়াল নেই,রাতভর ধান মাড়াই আর সেদ্ধ করার তাড়াও নেই। দিনভর রোদে ধরধর ঘাম নিয়ে ধান শুকানোর প্রয়োজনীয়তাও নেই। তাই এখন আর আগের মত জুতো জুড়া ব্যাগে কিংবা বগলের নিচে রাখতে হয়না। এখন গ্রাম্য মানুষের বাহারী জুতোর ভাড়ে সু-রেকও নুয়ে পড়ে।।
পৃথিবীতে অনেক মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন যাদের স্মৃতি শক্তি প্রচন্ড রকমের গভীর,ধারালো এবং গোছানো। একবার কোন একটি জিনিস দেখলে কিংবা পড়লেই হল। সারা জীবন স্মৃতির ক্যানভাসে থেকে যায়। পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাকি এমন একটি উর্বর মগজওয়ালা মাথা ছিল!
আর বিজ্ঞানের জনক আইনস্টাইনের মাথায় এত বুদ্ধিকণা থাকা সত্বেও নিজের বাড়ির ঠিকানাটাও তিনি মাঝে মধ্যে ভুলে যেতেন!
এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে,যদি কখনো কোন ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানের নাম কিংবা আকার আকৃতির গুরুত্ব কম মনে হয়েছে অথবা হালকা ভাবে নেওয়া হয় তবে তা অল্প সময়ের ব্যবধানেই স্মৃতি থেকে মুছে যায়।
আর জীবন চলার পথে কিছু কিছু বিষয় কে হালকা ভাবে গ্রহণ করার কারণেই শৈশব ও কৈশোরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো অাজ অার মনে পড়ছেনা।
সময়ের সাথে পাল্টে যায় মানুষের ভাললাগা, চাওয়া পাওয়া। মানুষ হিসাবে আমিও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। এক সময়ের চাওয়া গুলো এখন আর ওভাবে চাওয়া হয়না।ভাললাগার মতো জিনিসগুলো ওভাবে ভাললাগেনা। তাই আমার সকল চাওয়া পাওয়া সময়ের কাছে লীজ দিয়ে দিয়েছি। নিজের কাছে রেখেছি কেবল কিছু সুখ স্মৃতি। পৃথিবীর ডজন খানেক দেশের বহু শহর বন্দর আর নামীদামী অনেক কিছুই দেখেছি। অনেক কিছুই মনে ধরেছে। কিন্তু মনের গভীরে বাসা বাঁধতে পারেনি। যেমনি করে মনের খাঁচায় বাসা বেঁধে আছে আমার প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের খেলাঘর গোয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
★★নব্বই পূর্ববর্তী সময়ে আজকের সুন্দর এই বিদ্যালয়টির পুরাতন শ্যাওলা পরা বিল্ডিংয়ে না ছিল কোনো দরজা আর না ছিল জানালা! কেবল গোটা কয়েক কাঠের টোল, প্রতি ক্লাশে একটি করে ব্লাকবোর্ড জানান দিতো এটি একটি মানুষ গড়ার কারখানা!
আকাশে কালো মেঘ করে বৃষ্টি নামলে স্কুলের বারান্দায় এসে জড়ো হতো ছাগল, ভেড়া আর পথচারী মানুষের দল। কখনো সখনো শিলা বৃষ্টিতে বেশ মজা হতো; ক্লাশে বসেই কড়মড় করে খেতে পারতাম হিরার মত চকচকে বরফের টুকরো!
★★ প্রাইমারী স্কুলের অনেক স্মৃতিই আজ আর ততো একটা মনে করতে পারছিনা। তবে আমার যেদিন ছোটওয়ানে(আজকের প্লে) ভর্তি সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। মা গোসল করিয়ে সমস্ত শরীরে সরিষার তেল মাখিয়ে দিলেন। চুলে সিঁথিপাটি কাটলেন অার কপালে মায়ের আঙুলে কুপির কালির টিপ। পরতে দিলেন খাকি কালারের ইংলিশ প্যান্ট সাথে আকাশের তারার মতো ছাপা বেগুনী রঙের টি শার্ট। তখন গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের কেউ জুতো পরতোনা। তাই অামিও না। স্কুলে যাওয়ার সময় ছেলের যেন কোন অমঙ্গল না হয় থুপথুপিয়ে দিলেন মা। মা যত দিন দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন ছেলের মঙ্গল কামনায় প্রায়ই এমনটি করতেন।
মনে পড়ে ১৯৮৭ সাল। নির্মেঘ অাকাশ। রোদেলা সকাল। অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মাঝে আজ আমিও একজন। অামার অগ্রজ সহোদর জনাব এস এম শাহাবুদ্দিন আমাকে স্কুলে নিয়ে গেলেন। তিনি তখন ৫ম শ্রেণির ছাত্র এবং আমার ইমিডিয়েট সহোদরা মোছাম্মৎ আসমা ইসলাম তখন ৪র্থ শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী। যিনি বল্লভপুর গ্রামের নারীদের মধ্যে প্রথম গ্রাজুয়েশন অর্জনকারী নারীও বটে। বর্তমানে সরকারি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত অাছেন।
স্কুলের ক্লাশ রুম। একজন শিক্ষক একটি কাঠের চেয়ারে বসা। সুন্দর চেহারা। সুঠাম দেহের অধিকারী। স্পষ্ট ও গম্ভীর কথামালা। সামনে একটি টেবিল। টেবিলের একপাশে একটি জালিবেত,একটি চক ও ডাষ্টার। হাতে একটি ঝর্ণা কলম। সামনে একটি রোল করানো খোলা খাতা। অামাকে কাছে ডাকলেন। একটু ভয় পাচ্ছিলাম; সাহসও ছিল কারণ,ভাইতো কাছেই আছেন। স্যার জানতে চাইলেন,
"শাহাবুদ্দিন ও তোমার কি হয়?"
ভাইয়া বললেন,আমার ছোট ভাই।
ব্যাস। এবার আমাকে স্যার তিনটি প্রশ্ন করলেন।
-"এক থেকে দশ পর্যন্ত বলতে পারো"?
অামি থেমে থেমে বলতে লাগলাম ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ১০
দ্বিতীয় প্রশ্নে বললেন,"পাঁচটি ফলের নাম বল"?
আমি এক নিশ্বাসে বললাম, অাম,জাম,কাঠাল,কলা,অানারস।
তৃতীয় প্রশ্নে স্যার বললেন,"পাঁচটি ফুলের নাম বল"?
আমি বলেছিলাম,গোলাপ,জবা,বেলী, শাপলা,শিমুল।যদিও শিমুল ফুল আমি তখনো চিনতাম না।
স্যার ভাইকে বললেন,"পড়ে নাকি বেশি দুষ্টামি করে?"
ভাই ঘাড় সামনের দিকে খানিক ঝুকিয়ে বললেন,"পড়ে,পড়ে স্যার"।
আমি খেয়াল করলাম স্যারের সামনে রোল করানো খোলা হাজিরা খাতার ১নং ঘরটি ফাঁকা। ইতোমধ্যে অনেক ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে এবং ২নং ঘর থেকে অনেকগুলো নামও খাতায় লিখে নিয়েছেন। আমাকে বললেন,
"স্কুল মিস করা যাবেনা। ভালো করে পড়াশুনা করতে হবে। ঠিক অাছে,কেমন?"
★★আমিও অনুগত সুবোধ বালকের মত মাথা সামনে পিছনে করে স্যারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করলাম।
দুচোঁখ দিয়ে দেখলাম,হাজিরা খাতার ১নং ঘরের ফাঁকা জায়গাটিতে স্যারের হাতের ফাউনটেইন পেনটি খচখচ শব্দ করে অামার নামটি লিখে দিল।
আমি হয়ে গেলাম ক্লাশ ওয়ানের ক্লাশ ওয়ান বয়। তিনি জনাব শাহজাহান স্যার। ধন্যবাদ স্যার। অাপনার প্রতি অামার বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।
প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া সেই আমি স্কুল, কলেজ জীবন এবং কর্মজীবনেও বহু পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি। তবে এখনো প্রথম শ্রেণির মানুষ হতে পারিনি! স্বার্থকে ত্যাগ করতে পারিনি, বয়স বাড়ার সাথে সাথে অন্ধ স্বার্থকে ঘৃণা করার রুচিবোধ কিছুটা জন্মেছে।
মধুময় শৈশব, দুরন্ত কৈশোর!!
১৯৮৮ সাল। সেবছর সারা বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় একই সাথে বন্যা দেখা দিয়েছিল। সেবার আমাদের গ্রামের বাড়ি বল্লভপুরের হাজী মঞ্জিলেও পানি উঠেছিল। ঘরের মধ্যে পানি বন্দি মানুষের নিদারুন কষ্ট দেখেছি। বড়দের অনুকরণে মশারীর নেট দিয়ে ঘরের মধ্যেই মাছ ধরতাম। উঠোনে বড়শী ফেলতাম। সন্ধ্যার পর লোকজন কুপি আর চল নিয়ে মাছ ধরতে বের হতো। কতজনার সাথে যে আমিও কুপি রাখার হেল্পার ছিলাম তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের ছিল বড় বড় পাট শোলার কাড়ি। তা দেখে লম্বা লম্বা ডিঙি নৌকায় মাছ ধরতে আসা জেলেরা আমাদের বাড়িতে এসে নাউ ভিড়াতো। মাছের বিনিময়ে তাদের জ্বালানির জন্য পাটকাঠি নিয়ে যেতো। সে বছর পুকুরের সকল পালা মাছ ভানের জলে ভেসে যাওয়ায় সারা বছরই মানুষ স্বল্প মূল্যে মাছ খেতে পেরেছে। প্রায় সব ঘরেই তখন কনিজাল,পেলুন কিংবা ময়াজাল থাকতো। তখনো কারেন্ট জালের আবির্ভাব তেমন একটি হয়নি। তখন জমিতে গোবর/ছাই ছাড়া কৃষককুল আধুনিক সার ও কিটনাশক তেমন একটা ব্যবহার করতেন না। তাই আমাদের শৈশব ছিল মাছে ভাতে।
লুংগি!! সেতো আমার নিজের বলে কিছুই ছিলনা।
বড়দের লুংগি ভাজ করে পরতাম। তাও ক্লাশ থ্রিতে যখন উঠেছি।
তার আগে কখনো হাফ প্যান্ট কখনো শুধু লম্বা শার্ট অথবা গেঞ্জি।
নিচের অংশ সবসময় ঢেকেই রাখতে হবে এমন প্রয়োজনীয়তা কখনো বোধ করিনি।
কারণ অনেক শিক্ষার্থীদেরই শরীরে একটির বেশি জামা থাকতো না। আজকালের ছেলে মেয়েদের মতো কে প্যান্ট পরলো আর পরলোনা তা বুঝার সক্ষমতা সে সময় ছিলনা।
তাই আমরা ছিলাম সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে।
অদের খাল। বাড়ির পাশে শৈশবের ভালবাসার খাল। স্বপ্নের জলাধার। এই খাল ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে অাসা আওড়া গাঙ্গের পানি নিয়ে মিলে যায় রাজার খালের সাথে। রাজার খালের পানি মিলিয়ে যায় বুড়ি নদীর জোয়ার ভাটার সাথে। এখন খালের সেই যৌবন আর নেই। এক সময় খালের পাড়ে বসে জোয়াড় ভাটা দেখতাম। কত ইট বালি বোঝাই বড় ডিঙা আর কোষা নৌকা,বেদে নৌকার বহর দেখতাম! মাঝি মাল্লাদের গলা ফাটানো সুরেলা গান শোনা যেত। খড়মপুর গামী সাজোয়া নৌকার সদর রাস্তা ছিল এটি। আজ তা কেবলি অতীত। অদের খালের পানিতে কত্ত রকমের মাছ সারি বেধে খেলা করতে করতে ভেসে যেতো। দুচোখ ভরে দেখতাম। কখনো কখনো খেজুর কাঁটার চল দিয়েও মাছ ধরেছি। ছোট মাছের ঝাঁকে ভুলেও কেউ চল মারতোনা কিংবা জাল ফেলতো না। কোথায় গেল সেই রূপালী মাছের সোনালী দিন? আজকের শিশুর নিকট, আজকের প্রজন্মের কাছে তা কেবল গল্পই মনে হবে।
ঘরে সব সময়ই দুধের গাভী দেখেছি। যেকারণে দুধ কিনতে বাজারে যেতে হতোনা। কাঁচা মরিচ,পেঁয়াজ, রসুন,ধনিয়া,তিলের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ গুলোও নিজেদের জমিতেই উৎপাদিত হতে দেখেছি।তাই লবন আর কেরোসিন তেল ছাড়া বাজার থেকে কেনার মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির তালিকায় তেমন কিছুই ছিলনা। বিজ্ঞানের আশ্চর্তম আবিস্কার বিদ্যুৎ গাঁও গেরামের অন্ধকার দূর করেছে। আজ গ্রামের মানুষের কেরোসিন কিনতে হয়না এ কথা শতভাগ সত্য। এছাড়া সবই কিনতে হয়!!
জুতা জোড়া। এ এক বড় মূল্যবান বস্তু। আমার শৈশবে জিতা জোড়ার কদর ছিল। দেখেছি সেই সময়ে মুরুব্বিরা কোথাও বেড়াতে গেলে জুতো জুড়া বগলের নিচে করে অথবা ব্যাগে নিয়ে যেতেন। আর কুটুমবাড়ির কাছকাছি গিয়ে কোন ডুবা কিংবা পুকুর থেকে পা ধুয়ে সযতনে জুতো জুড়া পরতেন। অভাব অনটনের কারণেই যে মানুষ জুতো পরতো না তা কিন্তু নয়, আসলে তখন রাস্তা ঘসটও এতটা ভাল ছিলনা। বাড়িতে বাড়িতে উঠোনের কোণায় কোণায় খেড় পাড়া,গোয়াল ঘরে গরু বাছুরের পাল, বছর জুড়ে নানান ফসল ঘরে তোলার তাড়া। জুতো পরার সময় কোথায়? আজকাল অবশ্য ডলার,দিনার,রিয়েল,দিরহাম আমদানির কারণে গ্রামে কোনো কৃষক নেই। হাল চাষের গরু নেই,লাঙ্গল জোয়াল নেই,রাতভর ধান মাড়াই আর সেদ্ধ করার তাড়াও নেই। দিনভর রোদে ধরধর ঘাম নিয়ে ধান শুকানোর প্রয়োজনীয়তাও নেই। তাই এখন আর আগের মত জুতো জুড়া ব্যাগে কিংবা বগলের নিচে রাখতে হয়না। এখন গ্রাম্য মানুষের বাহারী জুতোর ভাড়ে সু-রেকও নুয়ে পড়ে।।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ১৫/০২/২০২৩সুন্দর ব্যাখ্যা
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১২/০২/২০২২চমৎকার লেখনী
-
মোঃ আমিনুল ইসলাম মিঠু ০৭/০১/২০২২দারুণ
-
ফয়জুল মহী ০৪/০১/২০২২চমৎকার উপস্থাপন ।
-
একনিষ্ঠ অনুগত ০৪/০১/২০২২সুন্দর সুখস্মৃতি কথন। ছেলেবেলা সত্যিই এক অমুল্য স্মৃতিভাণ্ডার। যার ছেলেবেলাতে সুখস্মৃতি নেই মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠা তার জন্য সত্যিই কষ্টকর।
-
আলমগীর সরকার লিটন ০৪/০১/২০২২সত্যই প্রাইমারি স্কুল যেনো এখন বিস্মৃতির মতো তবু পড়তে পড়তে জল গড়ে গেলো