কোরআন পুরাণ ও নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা
পরাধীন ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতাে।শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়,বিশ্ব সাহিত্যেও এমন কোন কবির নাম শুনা যায়না; যার নামের সাথে তার লেখা কবিতার নাম একই সাথে উচ্চারিত হয়। একমাত্র কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সবাই বিদ্রোহী কবি নজরুল বলে সম্বোধন করে থাকেন। নজরুল দ্রোহ-ভাবাপন্ন আরও অনেক কবিতা লিখলেও শুধু এক ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই তিনি বাঙালির চিরকালের ‘বিদ্রোহী কবি’। রুদ্ররোষে বলীয়ান যে কবিতাটি নজরুলকে তাঁর কবি-জীবনের শুরুতেই খ্যাতির চরম শিখরে নিয়ে যায়, তার নাম ‘বিদ্রোহী’।সমূলক হােক আর অমূলক হােক, বিদ্রোহের কোনাে স্বীকৃত ব্যাকরণ নেই। বিদ্রোহ স্বতঃস্ফুর্ত স্বতােৎসারিত, সর্বগ্রাসী ও সংক্রামক।
➤কবি তাঁর বিদ্রোহী কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দ বুননে, বাক্য প্রণয়নে বাবুইসুলভ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘বল বীর
বল চির উন্নত শির’।
শুধু ‘বল’ শব্দটির উপস্থাপনা কৌশল আজো অনুক্ত, অনালোকিত!
➤কবিরা বলে থাকেন, ‘”কবিতার প্রথম লাইন(ঐশী বাণী)স্বর্গ থেকে আসে।’ এরপর কবি স্বর্গের সেই লাইন সাজিয়ে কবিতাকে পূর্ণপ্রাণ করেন।” কবির ‘বিদ্রোহী’ সৃজনে ঐশী বাণী ওহির চেতনার প্রভাববলয় সুস্পষ্ট লক্ষণীয়। ১৯২১ সালে বিদ্রোহী রচনার পরথেকে অদ্যাবধি বিদ্রোহী’র পাঠকমাত্রই ‘আমি’ কিংবা ‘বল বীর’ কিংবা ‘উন্নত মম শির’ এর অধিকারী হয়ে ওঠে।
➤যুগে যুগে পথহারা মানবমণ্ডলীর কল্যাণের জন্য আল্লাহ অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করে তাঁদের মাধ্যমে তিনি ওহি বা অলৌকিক বাণী প্রেরণ করেছেন। ওহির অনুসরণে ইব্রাহীম যখন ক্বাবা ঘর থেকে মূর্তি অপসারণ করেন- তখন তার বিরোধিতা হয়েছে। ইালামের নবী মুহাম্মদ(সাঃ) ওহির প্রচারে নির্যাতিত হয়েছেন। পাগল ও জাদুকর বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। কবি নজরুলও বিদ্রোহী রচনার কারণে ‘কাফের কাজী’ বলে গালি খেয়েছেন। ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে জেলে গেছেন।
➤কৈশোরে গ্রামের মসজিদে ইমামতি, আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের পরিবেশ প্রতিবেশ, যৌবনে বাঙালি পল্টনে দীর্ঘ সময় হাফেজ সাহেবের সংস্পর্শে কবির ইসলামী মূল্যেবোধ সমৃদ্ধ হয়।আল কুরআনের কাব্যিক ও শৈল্পিক সৌকর্যে কবি অভিভূত হন।
➤পবিত্র কোরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে সূরা ‘আলক্ব’-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত সর্বপ্রথম মুহাম্মদের কাছে ওহিরূপে নাজেল হয়। প্রথম আয়াত হল-
‘ইক্বরা বিছমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক্ব’
– পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
➤সূরা মুযাম্মিল এর প্রথম আয়াত- ‘ইয়া- আইয়্যুহাল মুযম্মিলু’-হে বস্ত্রাচ্ছাদিত!’। তেমনি সূরা এখলাস, সূরা কাফেরুন, সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস-এর প্রথম শব্দ হচ্ছে ক্কুল- অর্থ বল বা বলুন। এই আদেশ (order) অলৌকিক!
পড়ুন> লেখকের সব লেখা
ওহি(সত্য কবিতা) ঐশী বাণী ও এক প্রকার শক্তি। শক্তির সঞ্চারে গতির সঞ্চার। হাদিস থেকে জানা যায়,ওহি নাজেলের প্রাগমুহূর্তে মুহাম্মদ(সাঃ) অস্থির হয়ে পড়তেন, কেঁপে কেঁপে ওঠতেন। জ্বরগ্রস্তের মতো কম্বল জড়াতেন তাঁর পবিত্র দেহে।
আরবের জাহেলিয়াত যুগে ওহির কার্যকর ভূমিকা সম্পর্কে নজরুল ছিলেন ওয়াকেবহাল। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, উপনিবেশ বঙ্গ-ভারতের পরাধীন জাতির মধ্যে জাগরণ ঘটাতে হবে। একরাতে ঠিক তাই করলেন।
“ক্কুল হু আল্লাহ হু আহাদ”
-বলো>বল (হে নবী) আল্লাহ এক। ওহির প্রকরণে ক্বুল শব্দের সফল প্রয়োগ করে লিখলেন-
‘বল বীর’।
কোরআনে একই আয়াত বা আয়াতাংশ একাধিক সূরায় আছে। একই আয়াত একই সূরায় একাধিকবার আছে।
সূরা আর রাহমান- এ ‘ফাবি আইয়্যি আলা-ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’- এই আয়াতটি ৩৩ বার আছে।[ -(তাঁর/স্রষ্টার) কোন কোন নিয়ামতকে (নিদর্শনকে) অস্বীকার করবে?] বারবার বহুবার এ জিজ্ঞাসা-বাক্যের তাৎপর্য হল- স্রষ্টার কোনো নিদর্শনকেই অস্বীকার করা যায় না। প্রভুর দয়া ও দান অনস্বীকার্য- এই চেতনাই পাঠকের মানসচেতনায় ভিত্তিভূমি হয়ে ওঠে। এ বাকশৈলীও ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় অনুসৃত। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় ১৩৯ (১৪১ টি লাইন) টি পঙক্তি রয়েছে। বক্তব্যের অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মোট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায়।
✪ কবিতায় ‘বল বীর’ শব্দদ্বয় যা চেতনাগুচ্ছ বা বিশ্বাসবন্ধন তৈরি করে- তা ৬ বার রয়েছে।
✪ ‘বল’ শব্দটি ৮ বার এবং
✪ ‘উন্নত মম শির’ ৬ বার ও
✪ ‘চির উন্নত শির’ উদ্দীপক শব্দবন্ধ রয়েছে ৬ বার।
✪‘আমি’ শব্দটি রয়েছে ১৩৭ বার।
এই আমি কবি নজরুলের ব্যক্তি আমিত্ব নয়। এই আমি- পরাধীন জাতির প্রত্যেকের একদেহে লীন জাতি- আমি। নিখিল বাঙালির বিশ্ব- আমি। ওহির অনুকরণে প্রযুক্ত এ ভঙ্গিটি সফল হয়েছে।
বিদ্রোহী কবিতায় ‘আমি’-র একাধিক ব্যবহার অনেকে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার কথা স্মরণ করেছেন। আবার কেউ কেউ এই কবিতায় ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেল্ফ’-এর অনুরণনও লক্ষ্য করেছেন।
মেরাজের রাতে সিদরাতুল মুনতাহা নামক মোকাম পর্যন্ত ফেরেশতা জিব্রাইল যেতে পেরেছিল। কিন্তু মুহাম্মদ থামেননি। আরশ পর্যন্ত পৌঁছেন। আমাদের নজরুলের মহামিও তাই।
তিনি বলেন, ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাধ!’ তাই তার বাধা নেই। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি, চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছেড়ে, ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদ করে, অনেক ক্ষুদ্র আমি এর ঐক্যের অখণ্ড আমি। যা কোরআনের আয়াতে কথিত আমি কিংবা আমরা অর্থে সেই পরম আমি।
বিদ্রোহী কবিতায় বারবার ‘বল বীর’ কিংবা ১৩৭ বার ‘আমি’ আদতে কোরআনের ‘ইক্বরা’ অর্থাৎ পাঠ কর; কিংবা ‘ক্বুল’ অর্থাৎ বল ধরনের আজ্ঞা ও কর্তৃবাচ্যের বাগপ্রতিমা। যা অব্যর্থ ভাবে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে জাতির জাগরণে। কবি জানতেন যে, কোরআনে ৮২ বার সালাতের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বহুবার বলা হয়েছে জাকাতের কথা। শুধু হতচেতন আদম সন্তানকে সচেতন আদম হয়ে ওঠার জন্য। ওহির এই কোরানীয় স্টাইলটি কাব্য প্রকরণে ব্যবহারের দৃষ্টান্তে নজরুল একক, অভূতপূর্ব ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
➤কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছেঃ
বিদ্রোহী’ কবিতাটি যেনো হিন্দু-মুসলিম পুরাণ বা মিথ প্রয়োগের এক জাদুঘর। এখানে হিন্দু-পুরাণের যেমন সার্থক ব্যবহার আছে, তেমনি আছে ইসলামি ঐতিহ্যের অভ্রান্ত অনুসরণ। রূপকার্থে বা প্রতীকার্থে পৌরাণিক এক-একটা চরিত্রের মধ্যদিয়ে কবি তাঁর ভাবনার জাল বুনেছেন। কবিতার ছত্রে ছত্রে আকাশভরা তারার মত পৌরাণিক , গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ছড়াছড়ি।
১। ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর।
২। মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)
৩। ‘আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড। আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র শিষ্য আমি দাবানল-দাহ দাহন করিব বিশ্ব।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)।
যেমন: ভূলােক মানে পৃথিবী, দ্যুলােক মানে স্বর্গ, আর গােলক মানে বিষ্ণুলােক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্থান। কৃষ্ণ রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত।
[পুরাণ বা মিথ বলতে সামাজিক ঘটনাবলি সম্বন্ধে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ব্যাখ্যামূলক কল্পকাহিনি বা অলীক কাহিনি বোঝায়। আর ঐতিহ্য বা ট্র্যাডিশন বলতে বোঝায় পরম্পরাগত কথা, পুরুষানুক্রমিক ধারা, কিংবদন্তি, বিশ্রতি বা লোকপ্রসিদ্ধি।]
✔ঋগ্বেদে রুদ্র বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ‘থর’ এর মতাে ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন, ইনি ব্রহ্মার পুত্রাতার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী। মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়।
✔পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। প্রজা কল্যাণার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু।
✔চেঙ্গিস খান ছিলেন মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক। যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরন করে নিয়ে যায় আরেক গােত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গােত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরনকারী গােত্রকে নৃশংস ভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মােঙ্গল গােত্রদের একীভূত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন।
✔ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে হযরত ইসরাফিল (আ:) নামক ফেরেস্তা শৃঙ্গায় ফু দেবেন
➤অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত মিশিয়ে মুক্ত ছন্দে কবিতাটি লিখে নজরুল দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। কবিতায় তিনি ব্যবহার করেছেণ অজস্র যৌগিক শব্দগুচ্ছ, তৎসম-তদ্ভব- আরবি-ফারসি-গ্রিক শব্দ । করেছেন সুসমঞ্জস্য প্রয়োগ। পুরাণ, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তী কিছুই বাদ যায়নি তাঁর ও কুশলী কলম থেকে।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও গবেষক
২৬ আগস্ট ২০২১
➤কবি তাঁর বিদ্রোহী কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দ বুননে, বাক্য প্রণয়নে বাবুইসুলভ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘বল বীর
বল চির উন্নত শির’।
শুধু ‘বল’ শব্দটির উপস্থাপনা কৌশল আজো অনুক্ত, অনালোকিত!
➤কবিরা বলে থাকেন, ‘”কবিতার প্রথম লাইন(ঐশী বাণী)স্বর্গ থেকে আসে।’ এরপর কবি স্বর্গের সেই লাইন সাজিয়ে কবিতাকে পূর্ণপ্রাণ করেন।” কবির ‘বিদ্রোহী’ সৃজনে ঐশী বাণী ওহির চেতনার প্রভাববলয় সুস্পষ্ট লক্ষণীয়। ১৯২১ সালে বিদ্রোহী রচনার পরথেকে অদ্যাবধি বিদ্রোহী’র পাঠকমাত্রই ‘আমি’ কিংবা ‘বল বীর’ কিংবা ‘উন্নত মম শির’ এর অধিকারী হয়ে ওঠে।
➤যুগে যুগে পথহারা মানবমণ্ডলীর কল্যাণের জন্য আল্লাহ অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করে তাঁদের মাধ্যমে তিনি ওহি বা অলৌকিক বাণী প্রেরণ করেছেন। ওহির অনুসরণে ইব্রাহীম যখন ক্বাবা ঘর থেকে মূর্তি অপসারণ করেন- তখন তার বিরোধিতা হয়েছে। ইালামের নবী মুহাম্মদ(সাঃ) ওহির প্রচারে নির্যাতিত হয়েছেন। পাগল ও জাদুকর বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। কবি নজরুলও বিদ্রোহী রচনার কারণে ‘কাফের কাজী’ বলে গালি খেয়েছেন। ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে জেলে গেছেন।
➤কৈশোরে গ্রামের মসজিদে ইমামতি, আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের পরিবেশ প্রতিবেশ, যৌবনে বাঙালি পল্টনে দীর্ঘ সময় হাফেজ সাহেবের সংস্পর্শে কবির ইসলামী মূল্যেবোধ সমৃদ্ধ হয়।আল কুরআনের কাব্যিক ও শৈল্পিক সৌকর্যে কবি অভিভূত হন।
➤পবিত্র কোরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে সূরা ‘আলক্ব’-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত সর্বপ্রথম মুহাম্মদের কাছে ওহিরূপে নাজেল হয়। প্রথম আয়াত হল-
‘ইক্বরা বিছমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক্ব’
– পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
➤সূরা মুযাম্মিল এর প্রথম আয়াত- ‘ইয়া- আইয়্যুহাল মুযম্মিলু’-হে বস্ত্রাচ্ছাদিত!’। তেমনি সূরা এখলাস, সূরা কাফেরুন, সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস-এর প্রথম শব্দ হচ্ছে ক্কুল- অর্থ বল বা বলুন। এই আদেশ (order) অলৌকিক!
পড়ুন> লেখকের সব লেখা
ওহি(সত্য কবিতা) ঐশী বাণী ও এক প্রকার শক্তি। শক্তির সঞ্চারে গতির সঞ্চার। হাদিস থেকে জানা যায়,ওহি নাজেলের প্রাগমুহূর্তে মুহাম্মদ(সাঃ) অস্থির হয়ে পড়তেন, কেঁপে কেঁপে ওঠতেন। জ্বরগ্রস্তের মতো কম্বল জড়াতেন তাঁর পবিত্র দেহে।
আরবের জাহেলিয়াত যুগে ওহির কার্যকর ভূমিকা সম্পর্কে নজরুল ছিলেন ওয়াকেবহাল। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, উপনিবেশ বঙ্গ-ভারতের পরাধীন জাতির মধ্যে জাগরণ ঘটাতে হবে। একরাতে ঠিক তাই করলেন।
“ক্কুল হু আল্লাহ হু আহাদ”
-বলো>বল (হে নবী) আল্লাহ এক। ওহির প্রকরণে ক্বুল শব্দের সফল প্রয়োগ করে লিখলেন-
‘বল বীর’।
কোরআনে একই আয়াত বা আয়াতাংশ একাধিক সূরায় আছে। একই আয়াত একই সূরায় একাধিকবার আছে।
সূরা আর রাহমান- এ ‘ফাবি আইয়্যি আলা-ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’- এই আয়াতটি ৩৩ বার আছে।[ -(তাঁর/স্রষ্টার) কোন কোন নিয়ামতকে (নিদর্শনকে) অস্বীকার করবে?] বারবার বহুবার এ জিজ্ঞাসা-বাক্যের তাৎপর্য হল- স্রষ্টার কোনো নিদর্শনকেই অস্বীকার করা যায় না। প্রভুর দয়া ও দান অনস্বীকার্য- এই চেতনাই পাঠকের মানসচেতনায় ভিত্তিভূমি হয়ে ওঠে। এ বাকশৈলীও ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় অনুসৃত। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় ১৩৯ (১৪১ টি লাইন) টি পঙক্তি রয়েছে। বক্তব্যের অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মোট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায়।
✪ কবিতায় ‘বল বীর’ শব্দদ্বয় যা চেতনাগুচ্ছ বা বিশ্বাসবন্ধন তৈরি করে- তা ৬ বার রয়েছে।
✪ ‘বল’ শব্দটি ৮ বার এবং
✪ ‘উন্নত মম শির’ ৬ বার ও
✪ ‘চির উন্নত শির’ উদ্দীপক শব্দবন্ধ রয়েছে ৬ বার।
✪‘আমি’ শব্দটি রয়েছে ১৩৭ বার।
এই আমি কবি নজরুলের ব্যক্তি আমিত্ব নয়। এই আমি- পরাধীন জাতির প্রত্যেকের একদেহে লীন জাতি- আমি। নিখিল বাঙালির বিশ্ব- আমি। ওহির অনুকরণে প্রযুক্ত এ ভঙ্গিটি সফল হয়েছে।
বিদ্রোহী কবিতায় ‘আমি’-র একাধিক ব্যবহার অনেকে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার কথা স্মরণ করেছেন। আবার কেউ কেউ এই কবিতায় ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেল্ফ’-এর অনুরণনও লক্ষ্য করেছেন।
মেরাজের রাতে সিদরাতুল মুনতাহা নামক মোকাম পর্যন্ত ফেরেশতা জিব্রাইল যেতে পেরেছিল। কিন্তু মুহাম্মদ থামেননি। আরশ পর্যন্ত পৌঁছেন। আমাদের নজরুলের মহামিও তাই।
তিনি বলেন, ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাধ!’ তাই তার বাধা নেই। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি, চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছেড়ে, ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদ করে, অনেক ক্ষুদ্র আমি এর ঐক্যের অখণ্ড আমি। যা কোরআনের আয়াতে কথিত আমি কিংবা আমরা অর্থে সেই পরম আমি।
বিদ্রোহী কবিতায় বারবার ‘বল বীর’ কিংবা ১৩৭ বার ‘আমি’ আদতে কোরআনের ‘ইক্বরা’ অর্থাৎ পাঠ কর; কিংবা ‘ক্বুল’ অর্থাৎ বল ধরনের আজ্ঞা ও কর্তৃবাচ্যের বাগপ্রতিমা। যা অব্যর্থ ভাবে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে জাতির জাগরণে। কবি জানতেন যে, কোরআনে ৮২ বার সালাতের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বহুবার বলা হয়েছে জাকাতের কথা। শুধু হতচেতন আদম সন্তানকে সচেতন আদম হয়ে ওঠার জন্য। ওহির এই কোরানীয় স্টাইলটি কাব্য প্রকরণে ব্যবহারের দৃষ্টান্তে নজরুল একক, অভূতপূর্ব ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
➤কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছেঃ
বিদ্রোহী’ কবিতাটি যেনো হিন্দু-মুসলিম পুরাণ বা মিথ প্রয়োগের এক জাদুঘর। এখানে হিন্দু-পুরাণের যেমন সার্থক ব্যবহার আছে, তেমনি আছে ইসলামি ঐতিহ্যের অভ্রান্ত অনুসরণ। রূপকার্থে বা প্রতীকার্থে পৌরাণিক এক-একটা চরিত্রের মধ্যদিয়ে কবি তাঁর ভাবনার জাল বুনেছেন। কবিতার ছত্রে ছত্রে আকাশভরা তারার মত পৌরাণিক , গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ছড়াছড়ি।
১। ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর।
২। মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)
৩। ‘আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড। আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র শিষ্য আমি দাবানল-দাহ দাহন করিব বিশ্ব।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)।
যেমন: ভূলােক মানে পৃথিবী, দ্যুলােক মানে স্বর্গ, আর গােলক মানে বিষ্ণুলােক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্থান। কৃষ্ণ রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত।
[পুরাণ বা মিথ বলতে সামাজিক ঘটনাবলি সম্বন্ধে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ব্যাখ্যামূলক কল্পকাহিনি বা অলীক কাহিনি বোঝায়। আর ঐতিহ্য বা ট্র্যাডিশন বলতে বোঝায় পরম্পরাগত কথা, পুরুষানুক্রমিক ধারা, কিংবদন্তি, বিশ্রতি বা লোকপ্রসিদ্ধি।]
✔ঋগ্বেদে রুদ্র বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ‘থর’ এর মতাে ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন, ইনি ব্রহ্মার পুত্রাতার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী। মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়।
✔পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। প্রজা কল্যাণার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু।
✔চেঙ্গিস খান ছিলেন মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক। যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরন করে নিয়ে যায় আরেক গােত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গােত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরনকারী গােত্রকে নৃশংস ভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মােঙ্গল গােত্রদের একীভূত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন।
✔ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে হযরত ইসরাফিল (আ:) নামক ফেরেস্তা শৃঙ্গায় ফু দেবেন
➤অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত মিশিয়ে মুক্ত ছন্দে কবিতাটি লিখে নজরুল দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। কবিতায় তিনি ব্যবহার করেছেণ অজস্র যৌগিক শব্দগুচ্ছ, তৎসম-তদ্ভব- আরবি-ফারসি-গ্রিক শব্দ । করেছেন সুসমঞ্জস্য প্রয়োগ। পুরাণ, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তী কিছুই বাদ যায়নি তাঁর ও কুশলী কলম থেকে।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও গবেষক
২৬ আগস্ট ২০২১
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ১৫/০২/২০২৩দারুণ
-
ড. সুলতান আশরাফী ২৪/১১/২০২১এর আগে কবিতাটির এমন সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ পড়িনি। অসাধারণ কাজ করেছেন। আপনার জন্য শুভকামনা রইলো।
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৪/১০/২০২১Yes A Great writing between Our religion and with Our National Poet Kazi Nazrul Islam.
-
ফয়জুল মহী ০১/১০/২০২১Good post
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ০১/১০/২০২১কবি নজরুল
চিনতে না করি ভূল।