www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কুমিল্লা

কুমিল্লার অভয় আশ্রম, বীরচন্দ্র গ্রন্থাগার ও মহেশাঙ্গন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে।
১৯২৬ সালের, ১৯ ফেব্রয়ারী অভয় আশ্রমের তিন বৎসর পুর্তিতে তিনি কুমিল্লায় আসেন। রবীন্দ্রনাথ অভয় আশ্রমের ত্রি- বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।অভয় আশ্রমের ত্রি- বার্ষিক সভায় মহাত্মা গান্ধীও এসেছিলেন।পুরনো এ অভয় আশ্রমটি এখন কেটিসিসিএ লিমিটেড নামেই পরিচিত।
১৯২৩ সালে কুমিল্লায় 'অভয় আশ্রম' নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন বলে জানা যায়।এতে ডা. সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কুমিল্লার আইনজীবী অখিলচন্দ্র দত্ত, কামিনী কুমার দত্ত, বিদ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও ইন্দুভূষণ দত্তের আর্থিক সহযোগিতা ছিল। চরকায় সুতা কেটে খাদি কাপড়ের প্রচলণ প্রথম এখান থেকেই শুরু হয়।
স্মরণ করার মত তথ্য হচ্ছে, ১৯২০ সালে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে "স্বদেশি পণ্য গ্রহণ ও বিদেশি পণ্য বর্জনে" মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাকদেন।জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যা কান্ডের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।
স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারি স্কুল কলেজে লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবাই চরকায় কাটা সুতা দিয়ে তৈরী খাদির কাপড় পরিধান করতে শুরু করেন।

ব্রিটিশ ভারতের "অভয় আশ্রম" শিক্ষা বিস্তার, কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ সেবা ও যাবতীয় আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডের মূলে ছিলো-- অনুশীলন দলের একটি কেন্দ্র :ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের এক মিলনক্ষেত্র।

কুমিল্লা অভয় আশ্রমের ত্রি- বার্ষিক সভায় যোগদানের আগে কুমিল্লা ভ্রমণকালীন কবি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন।অসুস্থতার জন্য তিনি ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করলেও পরে তিনি প্রাণের টানে সেখানে যান। তাই আগেই জানিয়েছেন, কোন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন,যেনো না করা হয়।
কবি ১৯, ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা পর্যন্ত কুমিল্লায় ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি অভয় আশ্রমের কর্মীরা কবিকে একটি মানপত্র দেন। সেই মানপত্রের জবাবে কবি বলেছিলেন:
'আত্মাই শান্তির উৎস', এই শক্তির সহিত পরিচয় লাভ করতে হলে আপনাকে সর্ম্পণরূপে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। অভয় আশ্রমের কর্মীরা এইরূপে আত্মত্যাগ করছেন বলে শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও আমি এখানে এসেছি'।
বিকালে অভয় আশ্রমের, ত্রি-বার্ষিক সভায় কবি সভাপতিত্ব করেন। বেশ কয়েকটা ইভেন্ট যেমন নাটক, খেলাধুলা, চরকায় সুতা কাটার প্রতিযোগিতা, সব কয়টা অনুষ্ঠান কবিগুরু উপভোগ করেন। দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন, শহরের বিখ্যাত সবাই কবির সাথে আপ্যায়িত হন। অভয় আশ্রমের কর্মী ছাড়াও, সেই সভায় সাত হাজরেরও বেশী লোকের সমাগম হয়েছিলো।

রবীন্দ্র গবেষক গোপালচন্দ্র রায়ের তথ্য সূত্রে জানা যায়, ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে কবিগুরু কুমিল্লা রেলস্টেশনে পৌঁছেন। স্টেশন থেকে তিনি সরাসরি চলে যান অভয় আশ্রমের নবনির্মিত হাসপাতাল ভবনে। তখন তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিমা দেবী, নন্দিনী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীমোহন ঘোষ ও মরিস প্রমুখ।
১৯ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কুমিল্লা অবস্থান করে ত্রিপুরার আগরতলায় চলে যান। এই চার দিন কুমিল্লা সফরকালে রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের শর্ত ভঙ্গ করেন। শুধু অভয় আশ্রম নয়, তিনি ঈশ্বর পাঠশালা-রামমালা ছাত্রাবাস, কুমিল্লা মহিলা সমিতির অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। একই সঙ্গে তিনি নাগরিকদের সাধারণ সভা, ভিক্টোরিয়া কলেজ, বিশিষ্ট ব্যক্তির বাসভবনে বেড়াতে যান। যার জন্য কবিগুরুকে দুই দিনের পরিবর্তে চার দিন কুমিল্লায় অবস্থান করতে হয়।

ভূঁইয়া ইকবালের ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অভয় আশ্রমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে কবিগুরু বলেন, ‘আত্মাই শক্তির উৎস, এই শক্তির সহিত পরিচয় লাভ করতে হলে আপনাকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দিতে হবে। অভয় আশ্রমের কর্মীরা এইরূপ আত্মত্যাগ করছেন বলে শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও আমি এখানে এসেছি।’ কোনো গবেষকদের মতে, ২১ ফেব্রুয়ারি কবিগুরু কুমিল্লা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এই দিন কুমিল্লা মহিলা সমিতি কবিগুরুকে সংবর্ধনা দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কুমিল্লা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি অখিলচন্দ্র দত্তের বাড়িতে গিয়ে প্রাতরাশ সম্পন্ন করেন। এরপর ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে শহরের ইন্দুভূষণ দত্তের বাড়িতে চা পান করেন। এখানে তিনি তাঁর রচিত একটি নতুন গান গেয়ে শোনান।[২]

বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন:
ত্রিপুরার মহারাজ ‘বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর’ ১৮৮৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এফ এইচ স্ক্রাইন এর অনুরোধে বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির উপর এটি নির্মাণ করা হয়। ১৮৮৫ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠিত ওই ভবনই কুমিল্লার গনপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। পাঠাগারে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রাজমালা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনীষীদের রচনাসমগ্র রয়েছে। এখানে বাংলা ভাষার ২৪ হাজার বই ও ইংরেজি ভাষার ছয় হাজার বই দিয়ে ৬৩টি আলমারি সজ্জিত। টাউন হলের নিচতলায় সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে ৪৪টি জাতীয় আঞ্চলিক, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী। টাউন হলে মহাত্মা গান্ধী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমূখ বিশিষ্টজনের আগমন ঘটেছে।
এ পাঠাগারেই বীরচন্দ্রের আমন্ত্রণে ১৯২১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও একবার কুমিল্লায় এসেছিলেন এবং বক্তৃতা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, ১৯০৫ সালেও তরুণ বয়সে বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের আমন্ত্রণে কবিগুরু আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে কুমিল্লা হয়ে যান।First en route to Kolkata from Agartala on July 16, 1905. On this stopover, Tagore was given a reception at the Comilla Town Hall.[৭]

কবির স্মৃতিবিজড়িত মহেশাঙ্গন:
দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯১৪ সালে মহেশাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে রামমালা গ্রন্থাগার, নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঈশ্বর পাঠশালা, মহেশ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, মহেশ হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয়, ছাত্রাবাস, মন্দিরসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী নিজেও পরিদর্শন করেছিলেন এই মহেশাঙ্গন। ২২ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহেশাঙ্গনে আসেন।রামমালা ছাত্রাবাসে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবি ছাত্র শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদান করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস গ্রন্থের লেখক মোঃ জহিরুল ইসলাম স্বপন বলেন, "১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সালে কুমিল্লায় মহেশ চন্দ্রের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তিন দিন অবস্থান করেন ।তৃতীয় দিন কবি বলেন, "যাঁর বাড়িতে থাকলুম, খেলুম তাঁর সঙ্গে কথা নেই।" মহেশবাবু বিনয়ে ভয়ে- পাবনার গেঞ্জি, গামছা কাঁধে ফেলে করজোরে হাজির।একজন সাহিত্যে বিশ্বনন্দিত, অন্যজন মহা দানবীর।"

২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ত্রিপুরার মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকুমারের বিশেষ আমন্ত্রণে কবিগুরু আগরতলার উদ্দেশ্যে কুমিল্লা ত্যাগ করেন।

এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও কুমিল্লায় কবিগুরুর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।তাঁর নামে গড়ে উঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান, তৈরি হয়নি কোনো ম্যুরাল! বিষয়টি সত্যিই হতাশাজনক।



➤তথ্য ঋণ:
[১] কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি'।। আহসানুল কবীর
[২] ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা’।।ভূঁইয়া ইকবাল
[৩] মোঃ জহিরুল ইসলাম স্বপন (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস গ্রন্থের লেখক)
[৪] কুমিল্লা জেলা তথ্য বাতায়ন
[৫] কুমিল্লার ইতিবৃত্ত
[৬] দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।। এস এম শাহনূর
[৭] Memories of Tagore in Comilla
The daily Star
May 08, 2008
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৮৮২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/১২/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অনবদ্য
  • সাঞ্জু ০৯/০৬/২০২১
    নতুন কিছু জানলাম।জেনে অনেক ভাল লাগলো
  • আমি-তারেক ১৫/১২/২০২০
    One notun kichu janar achey!!:):)
  • সুন্দর তথ্যবহুল লেখা।
  • কবীর হুমায়ূন ০৪/১২/২০২০
    অনেক তথ্যবহুল এবং শ্রমসাধ্য পোস্ট। শুভ কামনা আপনাকে।
 
Quantcast