www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ঘোলা জল

পদ্মা নদী। হাজারো গল্পের, হাজারো জীবনের, হাজারো কাব্যের এক জীবন্ত উপমা। পদ্মা যেন নিজেই একটি কবিতা, একটি মহাকাব্য। সে কাব্যের পড়তে পড়তে ছড়িয়ে আছে, ভালোবাসার ইতিহাস, ভালোলাগার ইতিহাস আছে বিরহ-বিলাপ আর দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস। পৃথিবীর নিষ্ঠুর সব রমণীরা যেমন তাদের রুপের মায়াজালে হাজারো প্রেম উন্মাদ যুবকদের কাছে টেনে নেয় অথচ একদিন সকল হিসাব নিকাশকে পাল্টে দিয়ে দূরে সরে যায় তেমনি পদ্মা ও যুগে যুগে তার দূরন্ত যৌবন দিয়ে মানুষকে কাছে টেনেছে অতঃপর তাদের হৃদয়ে এঁকে দিয়েছে অব্যক্ত যন্ত্রণার পাহাড়। সব হারিয়ে উদভ্রান্ত যুবকেরা তবুও ঐ সব রমণীদের পিছু নেয় তেমনি পদ্মার প্রচন্ড ছোবলে পোড় খাওয়া মানুষগুলো তাকেই আশ্রয় করে বেচেঁ থাকতে চায়। পদ্মার ঘোলা জলে তারা খুজে ফেরে জীবনের সন্ধান।
রহিম শেখ আজও নিয়মমত পদ্মার পাড়ে বসে আছে। পদ্মার ভাঙন আর তার জীবন যেন এক সুতোয় গেথেঁ আছে। জন্মের পর থেকে এ পদ্মাকে সে চিনেছে। পদ্মার ঘোলা জলকে ই পরম আদরে কাছে টেনে নিয়েছে। অথচ নিষ্ঠুর পদ্মা তাকে কখোনই কাছে টেনে নেয়নি। পদ্মা কে সে যতই ভালোবেসেছে ততই যেন পদ্মা তার বুকে এক একটি শেল বিদ্ধ করেছে। সেই ছোট বেলাতেই সে দেখেছে তার দাদা ভাঙনের সময় মাটি চাপা পড়ে মারা গেছে, মাছ ধরতে গিয়ে প্রচন্ড ঝড়ে পরে বাবা আর ফিরে আসেনি,চোখের সামনে পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙনের সময় ছেলেকে পানিতে তলিয়ে যেতে দেখেছে। নিজের গড়া সুখের সংসার বিণা নোটিশেই পদ্মার বুকে বার বার সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। সুদীর্ঘ এ জীবনে সে দেখেছে হাজারো মানুষের বোবা কান্না, হাজারো সম্পদশালীকে দেখেছে পথের ফকির হতে যার সব কিছুই ছিল এ সর্বগ্রাসী পদ্মার অবদান। অথছ নদীর তীরের আর সব মানুষের মত রহিম শেখ পদ্মাকে ভালোবেসে গেছে। পদ্মা বার বার তার ঘর ভেঙেছে, ভিটা বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে তবু সেই পদ্মার তীরেই বার বার ফিরে এসেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
রহিম শেখের ছোট বেলার গ্রামটি ছিল কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের নির্যাস যেন তাদেও গ্রামে এসে মিলিত হয়েছিল। গ্রামের মানুষগুলো ছিল আরও সুন্দর। প্রকৃতির উদারতা তাদের মন মানসে একে দিয়েছিল সরলতার জলছাপ। রহিম শেখ তখন ছোট। বয়স পাঁচ কি ছয়। মাঝে মাঝে স্কুলে যেত বলে মনে পড়ে। তাদেও বাড়ির সামনে ছিল রাস্তা। রাস্তার পাশে ছিল প্রশস্ত একটি খাল। এ খালে প্রায় সারা বছরই পানি থাকত। রহিমশেখ কতদিন যে তার চাচার সাথে এ খালে মাছ ধরেছে তার ইয়ত্তা নেই। একবার মাছ ধরতে গিয়েনৌকা ডুবি হয়েছিল। রহিম শেখ তলিয়ে যাচ্ছে হাঠাৎ তার চাচা তাকে ধওে ফেল্ল। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলসেদিন। তাদের গ্রমে ছিল বিভিন্ন ধরনের ফল গাছ। সবাই সবার গাছ থেকে ফল পাড়ত। বিশেষ করে তখন প্রচুর খেজুর গাছ দেখা যেত। খেজুরের রসেরমৌ মৌ সুরভিতে সারা গাঁয়ে একটা উৎসবের আমেজ তৈরী হত। কারও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে সারা গাঁয়ের সব মানুষ যেন উৎসবের আনন্দে একাকার হয়ে যেত। রহিম শেখের মনে আছে তখন বাশেঁর চটির উপর নানা রকম কাগজ দিয়ে বিয়ের গেইট বানানো হত। তারা একবার এক বিয়ের গেইটে অনেক গুলো জোনাকি পোকা লাগিয়ে দিয়েছিল বলে মনে পড়ে। বিকালে গ্রমে নানা রকম খেলা হত। এই যেমন- হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্দা, বরফপানি,বৌআছি,চোর-পুলিশ, সাত চারা, ফুল টোক্কা ইত্যাদি। গ্রামে অনেকছেলে মেয়ে ছিল যারা সারা গ্রামকে মাতিয়ে রাখত। এর মধ্যে রাসেল, মামুন, মাছুম, ঝর্না, শিউলীর কথা রহিম শেখের বিশেষ ভাবে মনে পড়ে। বৃষ্টি নামতে দেরী হলে তারা কুলা নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে চাল উঠাত আর গীত গাইত-আল্লাহ মেঘ দে, পনি দে, ছায়া দেরে তুই, আল্লাহ মেঘ দে---। অনেক সময় তাদেও গানের মাঝখানে প্রচন্ড কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়ে বৃষ্টি নামত। গাঁয়ের খালে যখন পানি কমেযেত তখন সারা গ্রাম বাসী মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠত। দিন নেই, রাত নেই সবাই মাছ ধরত। মা-চাচীরা মাছ কোটতে কোটতে আর জ্বাল দিতে দিতে সময় পার করে দিত।
গ্রামের প্রতিটি মূহুর্ত, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি ঘটনা রহিম শেখের মনে এক স্বর্গীয় অনুভ‚তি সৃষ্টি করত। জীবনানন্দ দাশের রুপসী বাংলার রুপের ছটায় সে যেন বিভোর হয়ে থাকত। কিন্তু সময়ের হিসাব নিকাশ কখনোই সরল পথে চলেনি। রহিম শেখদের বাড়ির পিছনেই ছিল পদ্মা নদী। তখন নদীটা এত বড় ছিলনা। ছিল শান্ত শিষ্ট। কিন্তু হঠাৎ ই একদিন সে অশান্ত হয়ে উঠল। প্রচন্ড ভাঙনে পুরো গ্রাম বাসীকে দিশেহারা করে ফেল্ল। ঘটনার সূত্রপাত রাসেল, মামুন, মাছুম, ঝর্ণা ও শিউলীকে নিয়ে। তারা নদী তীরে খেলা-ধুলা করছিল। হঠাৎ ই তাদের সহ বিশাল জায়গা নিয়ে মাটি নিচে নেমে যেতে লাগল। তারা সব বুঝতে পেরে দৌড় দিয়ে উপরে উঠতে ছিল কিন্তু তার আগেই প্রচন্ড বেগে তারা পদ্মার বুকে আছড়ে পড়ল। পানির প্রচন্ড ¯্রােত আর পাক তাদের এক টানে নদির মাঝখানে নিয়ে ফেল্ল। মূহুর্তেই গ্রামে বিষয়টা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই পাগলের মত ছোটে এল কিন্তু সব শেষ। সর্বগ্রাসী পদ্মার বুকে তখন পাঁচটি লাশ ভেসে উঠেছে। সবাই কে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গ্রামের সবচেয়ে প্রিয় ছেলেমেয়ে গুলো পদ্মার বুকে আশ্রয় নিয়েছে আর পদ্মা যেন প্রচন্ড হাসিতে তীরে দাড়ানো মানুষ গুলোর প্রতি বিদ্রুপ করছে।

তার পরের ইতিহাস বুকে পাথর বাধার ইতিহাস। সর্বগ্রাসী ভাঙনের ইতিহাস। পদ্মার প্রচন্ড উন্মত্ততা রহিম শেখের আজও মনে পড়ে। মাঠের পরে মাঠ, বাড়ির পরে বাড়ি সে ভেঙে চলছে।সে কাউকে বিশ্রাম দেয়নি, ভাবার সুযোগ দেয়নি শুধুই পিছন থেকে তাড়া করছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো পদ্মার এ উন্মত্ত আচরণে দিশেহারা, বিধ্বস্ত। বাড়িতে ডাকাত এলে কিছু রেখে যায় কিন্তু পদ্মা কিছুই রেখে যায়নি।সে সবকেড়ে নিয়েছে।সে কেড়েছে মানুষের সম্পদ, সুখ, একতা, বুকভরা আবেগ, মুখভরা হাসি দিয়েছে বেদনা, দীর্ঘশ্বাস আর অনিশ্চিত যাত্রার বার্তা। গায়েঁর কত মানুষ রহিমশেখের বাবার কাছ থেকে বিদায় নিল তার ইয়ত্তা নেই। ছমির মাঝি রহিম শেখের বাড়ি এসে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। বুক চাপড়ে বলেছিল, ভাইরে আরদেহা অইবনা, ঢাহা যাইতাছিগা । কিছু নিতে পারি নাইরে ভাই, সব গাঙের পেডে গেছে গা। বাবার হাত ধরে বলেছিল , আমাগো ভুইল্যা যাইসনারে ভাই। বাবা ছমির মাঝিকে ধরে শিশুর মত কেঁদেছিল। এরকম হাজারো ছমির মাঝি আজ গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছে যারা গতকালও ভাবেনি এই ছায়া-সুনিবিড় সুন্দর গ্রামছেড়ে তাদের চলে যেতে হবে। তারা জানেনা তাদের যাত্রার শেষ কোথায়, জানে যেতে হবে বহুদূরে ,যেকানে পদ্মা তাদের স্বপ্নের বুকে আর দুঃ স্বপ্নের ছবি আঁকার সাহস দেখাবেনা।

গ্রামের সেই সহজ-সরল মানুষ গুলো চিরদিনের জন্য রহিম শেখদের সামনেথেকে হারিয়ে গেল। শুধু মানুষই হারায়নি, হারিয়েছে সেই সুন্দর গ্রাম, প্রচন্ড বড় বড় আম, কাঠাল আর জাম গাছ। শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণ চ‚ড়া সাথে কোকিলের মন ভুলানো সুর। কত চেনা মুখ যে কত সহজে অচেনা হয়ে গেল, কিন্তু অচেনা হয়নি রহিমশেখদের মত কিছু হতভাগা, পোড় খাওয়া মানুষগুলো। তারা ঘুরে ফিরে পদ্মার তীরে এসেই ঠেকেছে। একবার ভাঙনের পড়ে আবার তারা বাড়ি করেছে। আবার নতুন নতুন মানুষের সাথে মিতালী গড়েছে, বাড়ির আঙিনায় আবার বেড়ে উঠেছে নানান ফল গাছ, আবার তারা সুখ স্বপ্নের দোলায় বিভোর হয়েছে। কিন্তু পদ্মা তাদেরসে সুখ সইবে কেন?সে শুধু তারা করে ফিরেছে।সে তালিকায় রহিম শেখ নিজেকে বরাবরই প্রথম দিকে দেখে এসেছে।

ভাঙা গড়ার হিসাব মেলাতে আজও রহিম শেখ পদ্মার পাড়ে এসে বসে থাকে। পদ্মার ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পদ্মার ঘোলা জল থেমে থাকেনা। সে নদি তীরে বার বার আছড়ে পড়ে। রহিম শেখ যেখানে বসেছে তার সামনে আরেক দলা মাটি চিরকালের জন্য বিলিন হয়ে যায়। কিন্তু বিলিন হয়না রহিম শেখদের মত মানুষদের কান্নার ইতিহাস, বুক ভাঙা হাহাকারের ইতিহাস। তারা নদী ভাঙা মানুষদের সার্থক উপমা হয়ে হয়ে বার বার নদী তীরে ফিরে আসে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১১৮৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৪/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast