www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হানিফার গরু

প্রতি বছরের ন্যয় এ বছর ও নদি তীরে বড়ট ছোট ছেলে মেয়েগুলো সারাক্ষণ জাহাজের পাশে ঘুর ঘুর করছে। জাহাটি ভোলা থেকে এসেছে। আরিচা হয়ে রাজশাহীর দিকে যাবে। মাঝখানে যাত্রাবিরতি। পুরো জাহাজটি কয়লা ভর্তি। জাহাজের খালাসি ভালো মানুষ। সে বড় একটি সিড়ি পেতে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা সিড়ি দিয়ে খুব সহজেই জাহাজের ভিতরে ঢুকতে পারছে।
অবশ্য বড়রাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। হানিফার এদিকে খুব একটা খেয়াল নেই। সে জাহাজের পাশে খোলা মাঠে তার একমাত্র গুরুটাকে ঘাস খাওয়াচ্ছে। এ বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। মাঠের ঘাসগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হয়ে গেছে। হানিফা মহা উৎসবে সে ঘাস তার গরুটাকে খাওয়াচ্ছে। সামনে কোরবানির ঈদ। হানিফা ঈদে গরুটাকে বিক্রি করতে চায়।
হানিফার গরুটা কিছুটা রোগাটে। দেহের গড়ন তার মত লিকলিকে। এত স্লিম গরু তা দেখতে যত স্মার্ট ই হোক কোরাবানির বাজারে দাম যে বেশি পাওয়া যাবে না সে বিষয়টা পুরো নিশ্চিত। হানিফা চিন্তা করছে কীভাবে গুরুটাকে মোটাতাজা করা যায়। সে মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমা দেখে। সিনেমার নায়িকারা ভয়ংকর স্বাস্থ্যের অধিকারী! ওদের কাছ থেকে গুরু মোটা তাজাকরণের পদ্ধতিটা শিখে নিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সেটাতো সম্ভব না।
গরুর পিছনে থাকতে গিয়ে হানিফার এখনো বিয়ে করাটা হয়ে উঠেনি। এ বিষয়ে মাঝে মাঝে গাঁয়ের দুষ্ট ছেলেগুলো তাকে টিপ্পনি কাটে। তখন সে একটা অদ্ভুত জবাব দেয়। পাঠককুলের জ্ঞাতার্থে বিষয়টা তুলে ধরছি-‘ কিয়ের মিয়া বিয়া করুম? গরুর নাই ঘাস, মুরগের নাই আদার, হাঁসে করে প্যাঁ প্যাঁ! নদীর তীর ঘেঁষে হাসু দালালকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। তিনি এ এলাকার বিখ্যাত গরুর দালাল। গরু কেনা বেচার মাঝখানে কোথা থেকে যেন তিনি হঠাৎ উদয় হন। তাকে কমিশন না দিয়ে গরু বেচা কঠিন ই বটে।
লোকটার চেহেরায় বিশেষ কোন ব্যপার আছে যেটা গরুকূলের মনে বিশেষ ভীতির সৃষ্টি করে। তবে গো বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছুটা হলেও তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। তাই অনেকেই তার পরামর্শ মোতাবেক কাজ করে। হানিফা হাসু দালালকে ডাকে। –‘মিয়া ভাই কই যান একটু এদিকে আহেন।’
হাসু দালাল তার প্রকান্ড ভুড়িটা দোলাতে দোলাতে এগিয়ে আসে। বেটার ভুড়িতে গো মাংস থেকে আগত কেজি বিশেক চর্বি আছে! কি খবর হানিফা তোমার দেখা সাক্ষাত্ নাই।
-এইতো আছি মিয়া ভাই। তো কোরবানির ঈদে এইবার গরু বেচবানি?
-হ মিয়া ভাই এই যে ঘাস খাইতাছে এইডা ই বিক্রি করুম।
-এইডাতো একদম লিকলিক্যা।
-হ মিয়া ভাই চিন্তা করতাছি কয়েদিন আলু খাওয়াইমু।
-আরে ঐ সব আলু টালুতে কাম অইব না।
-তয় কি করন লাগব?
-গইন্যা গইন্যা উনিশটা ইকজেকশন দিতে অইব আর কয়ডা টেবুলেট খাওয়াইতে অইব। দেখবি গরু তোর ফুইল্যা বেলুন অইয়া যাইব।
- মিয়া ভাই এইসব কই পাইমু?
-হেইডা নিয়া তোর চিন্তা করণ লাগব না, তয় আমার কমিশনডা ঠিক রাহিস। আর হুন রহিম মাষ্টার তোরে গরু নিয়া উল্ডা পাল্ডা পরামর্শ দিতে পারে।
-দিলে কি করুম মিয়া ভাই।
-বলদ নাকি কি করবি মানে? এক কান দিয়া হুনবি আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দিবি।
-ঠিক আছে মিয়া ভাই।
হাসু দালালের গমন পথের দিকে হানিফা এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
হাসু দালাল এক সময় গুরু পালন করত। তবে তার কিছুটা বদরাগী স্বভাব ছিল। গুরুরাও যে তার ই মত একটি প্রাণি, গরুদের ও যে কিছু অধিকার আছে সেটা সে বুঝতে চাইতনা। গুরু আইনের বিভিন্ন ধারার প্রতি বৃধাঙ্গুলী দেখিয়ে সে প্রায় ই গরুদের উপর সপাং সপাং পাইচনের বাড়ি চালাত। একবার তো কন্নি দিয়ে একটা গরুর মাজাই ভেঙে ফেল্ল। সে আরেক এলাহি কান্ড। পরে তড়িঘড়ি করে গরুটাকে জবাই দেয়া হয়েছিল।
সবুজ পাড়ের শাড়িতে ময়নাকে দেখা যায়। মেয়েটি কুচকুচে কালো, লিকলিকে তার গড়ন। সূর্যের আলো তার কালো শরীরে প্রতিফলিত হচ্ছে। সে কলসি কাখে নদিতে পানি নিতে এসেছে। এই ভর দুপুরে ময়নাকে দেখে হানিফার মনে কি রকম যেন একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সে অব্যক্ত কথা প্রকাশে সে বাঁশিতে সুর তোলে। ময়নার চলার গতি থামে। সে এক দৃষ্টিতে বাঁশির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। সুর থেমে যায়।
-রাখাল বাঁশি থামাইলা যে বড়।
- কি করুম শোনারতো কেউ নাই।
-কি যে কও ঐ যে জংলার গাছ, আসমানের মেঘ. গাঙের পানি হগলতেই তোমার বাঁশির সুর শোনতাছে।
-আমিতো সবার লইগা বাজাইনা।
-কিন্তু যার লইগা বাজাই হে তো শোনে না।
রাখাল মনে তোমার রং লাগছে।
জানিনা তয় রংয়ের মিস্ত্রির তো দেখা নাই।
ময়না হাসে।
-হাসলা যে বড়?
-কেন হাসতে মানা নাকি?
- তো এই একটা গরু নিয়া আর কতকাল রাখাল।
-ভাইগ্য থাকলে এই একটাই বরকত দিব ময়না।
-তুমিতো রাখাল হাসের কিচ্ছা মনে করায় দিলা।
-কিরম কিচ্ছা?
-ঐ যে এক লোকের একটা হাস আছিল। হেয় স্বপ্ন দেহে হাসে ডিম পারব. ডিম থেইক্যা আরো হাস অইব এক সময় হে বড়লোক অইব তোমার অবস্থাতো সেইরকম।
কি যে কও তুমি!
-আমি ঠিকই কইছি।
ময়না ধীরপায়ে চলে যায়।
হানিফার মা মহা টেনশনে আছে। সে কিছুতেই গরুকে ইনজেকশন দিতে চাচ্ছে না। হানিফা ও নাছোরবান্দা।
-মা অহন বেবাক মাইনষেই ইনজেকশন দিয়া গরু মোটা করে।
-বেবাক মাইনষে করলেও আমগো করণ দরকার নাই।
-এমন রোগা গরু পরে ইনজেকশন দিলেতো মইরাই যাইব। তুই হেই কিচ্ছাডা জানস না। কোন কিচ্ছাডা মা? ঐ যে একটা ব্যাঙ ধান ক্ষেতের আইলে বড় একটা ষাড় দেখছিল। পরে তার মায়ের কাছে গিয়া কয় আমি আইজ অনেক বড় একটা ষাড় দেখছি। মা কত কয় কত বড় ? ব্যাঙের বাচ্চা কয় অনেক বড়। মা তখন পেট ফুলায়। বাচ্চা কয় আরো বড়। মা আরো বেশি কইরা ফুলায়। বাচ্চা কয় আরো বড়। একসময় আরো ফুলাইতে গিয়া পটাস কইরা ব্যাঙের পেট ফাইটা যায়। ইনজেকশন দিতে গেলে তোর গরু ও এইরম ফুইট্টা যাইব।
-মা যে কি কও! কই গরু আর কই ব্যাঙ! বাদ দেও দি ঐসব ফালতু চিন্তা ভাবনা।
-আমি ফালতু কতা কইনা পরে টের পাবি।
এমন সময় রহিম মাষ্টারের গলা শোনা যায়। মাষ্টারের গলা শোনেই হানিফার মা ঘরের ভিতরে ঢোকে যায়। হাসু দালালের বুদ্ধিতে হানিফা কোচরে কিছু তুলা রেখেছিল। মাষ্টারের গলা শোনেই সে কানে তুলা গুঁজে দেয়। মাষ্টার যা বলে বলুক হানিফা তা শোনতে চায় না।
কানে তুলা গুঁজতে গুঁজতে মাষ্টার মশায়ের উপস্থিতি ঘটে। হানিফা সালাম দেয়।
- কি খবর হানিফা কেমন আছ?
হানিফা আন্দাজেই মাথা কাত করে। কানে তুলা দেওয়ার কারনে সে কিছু শোনতে পারছেনা।
-শোনলাম কুরবানির ঈদে তোমার গুরুটি বেঁচতে নিবে?
হানিফা এবারো মাথা কাত করে। সে ধরেই নিয়েছে মাষ্টার মশাই তাকে নেগেটিভ কিছু বলবেনা।
- তোমার গরুতো অনেক শুকনো। তুমি একটা কাজ করতে পার একটু বেশী বেশী আলু খাওয়াও আর খড়ের ছোট ছোট করে কেটে রাব সাথে খাওয়াতে পার। মাঝে মাঝে খৈল ভূষির সাথে জাউ খাওয়ালে ভালো ফল পেতে পার। তবে খবরদার গুরুকে কোন ইনজেকশন পুশ করবেনা কিংবা কোন টেবুলেট খাওয়াবেনা। এসমস্ত ঔষুধ গুরুকে ফুলিয়ে দেয় কিন্তু গরু মারাত্নকভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। অনেক সময় নিদির্ষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে গরু মারাও যায়। এ গুরুর মাংস রান্না করার পর ও এর ঔষুধের ক্ষতিকর উপাদান দূর হয়না যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক হুমকি স্বরূপ। এসব মাংস খেলে কিডনী বিকল হওয়া, শিশুদের স্বায়ী পুঙ্গুত্ব বরণ সহ নানা বিধ রোগ হতে পারে। তাই মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিছু করা যাবেনা।
হানিফা পুরো লেকচারের মাঝে কিছুক্ষণ পর পর মাথা নাড়িয়েছে।
-মাষ্টার সাহেব এক সময় বলে উঠে তুমি কি বোবা হয়ে গেলে নাকি? তখন হানিফা আরো জোরে জোরে মাথা নাড়িয়েছে। মাষ্টার মশাই হানিফাকে বেয়াদপ জাতীয় কিছু একটা বলে সেখান থেকে চলে যায়। হানিফা সাথে সাথে কান থেকে তুলা খোলে ফেলে। মাষ্টার মশাই কি বলেছে কিছুই তার শোনা হয়নি!

হানিফা কালিখোলা গরুর হাটে এসেছে গুরু বিক্রি করতে। মূখে তার হাসি, হাতে রঙিন বাঁশি। সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে ক্রেতা সাধারণকে তার দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। হানিফার গরু ফুলে ফেঁপে ছোট খাট একটা হাতি আকৃতি ধারণ করেছে। অথচ গত এক মাস আগেও এটা ছিল লিকলিকে একটা বাছুর আকৃতির। আলাদিনের ম্যাজিক হানিফার ম্যাজিকের কাছে ফেল মেরেছে! এজন্য হানিফাকে অবশ্য কম কষ্ট করতে হয়নি। হাসু দালালকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ইনজেকশন ও গরু মোটা তাজাকরণের টেবুলেট আনিয়েছে। গত কিছু দিন যাবত সে গরুকে প্রতিদিন একটা করে ইনজেকশন দিয়েছে সাথে গরুর টেবুলেটতো ছিলই। যে গরু বিশ হাজারে কেউ কিনত না তার দাম এখন আশি হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে! আলাদিন হানিফার গরু দেখলে নির্ঘাত হার্টফেল করত!
ইতিমধ্যে কয়েকজন গ্রাহক পঞ্চাশ হাজার টাকা দামাদামি করেছে কিন্তু হানিফা তাদের কোন পাত্তাই দেয়নি। তার এক কথা- ভাই এইডা হইল খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান গরু এইসব দাম শোইনা আমার গরুডাকে খামোখাই শরম দিতাছেন। বিদেশী গরুতো এর লজ্জা শরম একটু বেশি।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে গরুর বাজার ধীরে ধীরে জমে উঠছে। হাসু দালাল হাসি হাসি ভাব নিয়ে পুরো বাজারটা বার বার চক্কর দিচ্ছে। সকাল থেকে ইনকামও খারাপ হয়নি। তাছাড়া তার কল্যাণে এ বছরও কিছু ভেজাল মোটা গরু এসেছে যা থেকে ভালো একটা কমিশন পাওয়ার ও সম্ভাবনা আছে। গরুর হাম্বা রব আর বেপারীদের চিত্কার মিলে এক অভাবনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
হানিফার গরুর পাশে ভীর দেখে হাসু দালাল এগিয়ে যায়। ক্রেতারা ষাট হাজার টাকার বেশি দেবেনা কিন্তু হানিফার এক কথা এই অস্ট্রেলিয়ান গরুর প্রতি এই দাম কইলে ইনছাফ হয়না।
হাসু দালাল উপযাচক হিসেবে মাঝখানে উপস্থিত হয়। ভাই খাটি মাল একটু বেশি দাম দিলেও ঠকবেন না।
ক্রেতারা একটু আমতা আমতা করে। আরে ভাই কুরবানি হইতাছে গিয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সেই খানে এত হিসাব করলে চলব।
- কিন্তু …।
আর কিন্তু কিন্তু কইরেন না, নেন আর পাঁচ হাজার কম দিয়েন।
হানিফা গরুর রশি খুলতে যায়। তার মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। পচিঁশ হাজার টাকার গরু পঁচাত্তর হাজার টাকায় বিক্রি! বিষয়টা স্বপ্নের মত লাগে তার কাছে।
হঠাত্ গরুটি ভয়ংকর শব্দে ডেকে উঠে। হানিফা কিছুটা হতচকিত হয়ে যায়। গরুটার মূখ দিয়ে ফেনা বের হতে লাগল।
মিয়া ভাই কি অইল? গরুতে এমন করে ক্যান?
হঠাত্ প্রচন্ড শব্দ তোলে গরুটি মাটিতে পড়ে তপড়াতে থাকে। ক্রেতারাও হতচকিত হয়ে গেছে। কি মিয়া অস্ট্রেলিয়ান গরুর এই অবস্থা কেন? ততক্ষণে গরুর অবস্থা আরো কাহিল। তার পেটটা আরো ফুলে উঠেছে। মনে হয় ফেটেই যাবে। গুরুর দু চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে। হাসু বিড় বিড় করে বলে হানিফারে ইনজেকশন বেশি মাত্রায় দিয়া ফালাইছস। কিছুক্ষণ তপড়াতে তপড়াতে গরুটি মারা যায়। হানিফা হাউমাউ করে কাঁদছে। হাসু দালাল সুযোগ বুঝে সটকে পড়ছে। চারপাশে কৌতূহলী মানুষের ভীর বাড়ছে। নিথর হয়ে পড়ে আছে গরুটি তবে তার চোখ দুটি খোলা। সে চোখ দিয়ে লোভী মানুষদের প্রতি ঝরে পড়ছে অবিরাম ঘৃণা।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯০৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০২/১০/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast