সাদের বিখ্যাত হয়ে উঠা
পত্রিকারএকটা অংশে ছবিটা ছাপা হয়েছিল।অনেক গুরুত্ব দিয়েইছেপেছে ছবিটা। সাদ হয়তমনে মনে খুশিই হয়েছে।তাকে নিয়ে পত্রিকারকাড়াকাড়ি, টিভির মাতামাতি,টকশোতে বাড়াবাড়ি আরকর্তৃপক্ষের কুমিরেরকান্না ইয়ে না মানে মায়া কান্না দেখে।বিষয়টাকে সে পজেটিভলিইনিয়েছে। একটা মানুষেরজীবনে খ্যাতিতো আর কমপাওয়া নয়। সেখানে সাদেরখ্যাতিতো বাংলাদেশেরসীমানা পেড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে।সে তাকিয়ে থাকে তার রক্তমাখা ছবিটার দিকে।পত্রিকাগুলো এই খবরেরবদলৌতে ভালোইকাটতি পাচ্ছে। সম্পাদকসাহেবদের মূখেও তৃপ্তিরহাসি দেখা যাচ্ছে।বিশ্ববিদ্যালয়েরভিসি খুটিয়ে খুটিয়ে পত্রিকাগুলো পড়ছেন।বেচেরার জন্য সাদেরমায়া হচ্ছে। একটা চিংড়ী মাছজাতীয় অমেরুদন্ডি প্রাণী!ভিসি না হয়ে ছাত্রনেতা হলে বা শ্রমিকনেতা হলেও হয়ত কশেরুকায়কিছু জোর থাকত। কেনযে লোকটা এতলেখাপড়া করে ভিসি হতে গেল।যত সব ফালতু কাজ। সাদেরবন্ধুদেরপ্রতি সে কিছুটা বিরক্ত।বলদগুলা কেন লেখাপড়া বাদদিয়ে মিছিল মিটিং করছে?এদেশে কত সাদঝরে গেছে কারো কি কোনবিচার হয়েছে?বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রসরবরাহ কি বন্ধ হয়েছে?সাদের কিছুটা হাসি পায়। মানববন্ধনে ওর খুনিদের দু এক জনসংগী সাথীদের দেখে।ওরা কেনযে গলা ফাটাচ্ছে সাদ ঠিক বুঝতে পারেনা। আপাতত সাদ এসব নিয়ে ভাবছেনা।তাকে এখন সবাই চিনে এটাই বড়কথা!
এখন ৫২-র ভাষা আন্দোলন নেই, নেই উনসত্তরের গন অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারী আন্দোলন। তখন সবুজে মোড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থাকত ছাত্রদের গগন বিদারী স্লোগানে উত্তাল। এদেশের কোটি মানুষের আশা আকাংখা ও স্বপ্নের প্রতীক ছিল ছাত্ররা। জাতীয় জীবনের যেকোন দূর্যোগে ছাত্ররাই পালন করত অগ্রণী ভূমিকা। সাধারণ মানুষের মাঝে ছাত্র নেতাদের ছিল বিশেষ সম্মান। এখন সময় পাল্টেছে। নেতা হতে হলে চরিত্রবল বা মেধা নয় বরং হকিস্টিক ও হাতবোমার বিশেষ ব্যবহারে পারদর্শী হতে হয়। এখন ক্যান্টিনে খাবার বিল পরিশোধ না করে কিংবা বাসে ভাড়া না দিয়ে কন্টাকদারদের সাথে ঝগড়া ঝাটি করে প্রমান করতে হয় তিনি ছাত্র নেতা। বক্তৃতা বিবৃতিতে গঠন মূলক কথা নয় বরং উচু গলায় ষাড়ের মত চেঁচিয়ে প্রমাণ করতে হয় তিনি ই বাগ্মি! চাঁদাবাজি, নেশা, জুয়াখেলা কিংবা মেয়েদের নিয়ে হলে রাত কাটানো এখন বড় ছাত্র নেতার বিশেষ গুন হিসেবে ধরা হয়। বিপক্ষকে মোকাবেলায় মেধা কিংবা যুক্তি নয় বরং রড চাপাতির ভাষায় কথা বলে তারা। সব মিলিয়ে একটি ভ্রষ্ট সমাজের আদর্শ প্রতিনিধি হয়ে মত্স্যনায় যুগের নেতা হওয়ার সমস্ত গুণগুলো রপ্ত করেছে তারা। এদের কোন ব্যক্তিত্ব নেই, নেই কোন পার্টস পাট্টা তবে তৈল মর্দনের বিশেষ গুণটি এদের নখদর্পণে।
সাদ রাজশাহীর ছেলে। পদ্মা নদীর মায়াময় তীর থেকে সে উচ্চ শিক্ষার্থে ভর্তি হয়েছিল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্বপ্নময় ক্যাম্পাসে। মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে। সাদের ও স্বপ্ন ছিল। আকাশের তারা ছোঁয়া নয় কিংবা মেঘের ভাজে ওড়া নয়। স্বপ্নটা ছিল স্বাভাবিক, সাদামাটা। লেখাপড়া শেষ করা, একটা চাকুরি করা, মা বাবার মুখে হাসি ফুটানো ব্যাস। প্রতিটি ছেলেই স্বপ্ন দেখে, সাদ ও দেখেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসে, তার ডিপার্টমেন্টের প্রতিটি ইটের ভাজে কিংবা তার প্রিয় হলের ২০৫ নম্বর কক্ষে স্বপ্নগুলো বর্ণময় হয়ে উঠত। তার হাসি মাখা মুখে বন্ধুদের সাথে আড্ডার মাঝে কিংবা তার প্রিয় স্যারদের সাথে গল্প করার ফাঁকে প্রায় ই স্বপ্নগুলোর পালে হাওয়া লাগত। ছেলেটা দারুণ আড্ডা প্রিয় ছিল। একটু মিশুক প্রকৃতির হওয়ায় খুব সহজেই সবার সাথে মানিয়ে নিত সে। নিজের অজান্তেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল সাদ। রাজনীতি যে তার জন্য নয় এটা বুঝতে পারেনি সে। এখন রাজনীতি করবে ক্লাসের সবচেয়ে দূর্বল ছাত্রটি। যে কোনদিন ফার্স্ট ক্লাস পাবেনা, লেখাপড়া করবেনা শধু ঠ্যালা মার্কা কথা বলবে সে করবে রাজনীতি। ভালো ছাত্রদের কাজ হচ্ছে একটি ভারী কাঁচের চশমা পড়ে মাথা নিচু করে কলেজে যাবে আবার মাথা নিচু করে বের হবে। তারা হবে বাপুরাম সাপুড়ের সেই বিখ্যাত সাপের মত যে করেনাকো ফোঁসফাস, মারেনাকো ঢুঁসঢাস অথাত্ আলু পটল জাতীয় কিছু একটা। একসময় তারা ফার্স্ট ক্লাস পাবে. বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে বের হবে। আর তাদের ঠ্যালা মার্কা বন্ধুগুলো রাজনীতির সিড়ি বেয়ে অনেক উপরে উঠে যাবে। মন্ত্রি এমপি হবে আর আলু পটল মার্কা ভালো ছাত্র গুলো সচিব হয়ে বগলে ফাইল নিয়ে জ্বি হুজুর করতে করতে তাদের পিছনে ঘুরবে কেউ কেউ চিংড়ী মাছ জাতীয় কিংবা বাঘ আকৃতির বিড়াল হয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করবে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে সাদ ভুল পথে পা দিয়েছিল বলেই মনে হয়।
তখন মাঝ রাত। জেলে রোকনের ঘুম ভেঙে গেছে। একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছিল সে। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। রোকন নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বড় মাঠটাতে দেখতে পায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সমস্ত ছাত্র ছাত্রী মাঠের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা বলছে- তুই এটা কি করলি? ছিঃ রোকন ছিঃ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে তুই আরেকজন ছাত্রকে খুন করলি? স্বপ্নের মাঝেই রোকনের গাঁজা খেতে ইচ্ছে করছিল সাথে একটু ইয়াবা হলেও মন্দ হতনা! ছাত্র ছাত্রীরা অবিরাম চিত্কার করে যাচ্ছে। কিছুটা অসহায় বোধ করে সে। হঠাত্ ই রোকন ভীরের মাঝে তার মাকে দেখতে পায়। সে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। তার মা চিত্কার করে উঠে। তুই আমাকে ছুঁবিনা, তুই আমাকে ছুঁবিনা। তোর মত একটা কুলাঙ্গার আমার পেটে জন্ম নিয়েছে সেটা ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে। তোকে আমি ত্যাজ্য পূত্র ঘোষণা করলাম। রোকন ক্ষেপে যায়। আজ সব দোষ আমার তাইনা। তোমরা সবাই সাধু। যে পারিবারিক শিক্ষা, যে সমাজের শিক্ষা, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাকে খুনি হিসেবে তৈরি করেছে খুনের দায়ে তারাও সমানভাবে দোষি. তাদের ও ফাঁসি হওয়া উচিত। হঠাত্ রোকন দেখে পুরো মাঠটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কেউ নেই। তবে কে যেন ধীর পায়ে হেটে হেটে আসছে। থেতলানো মাথা. সারা গায়ে রক্তের চিহ্ন। ততক্ষণে রোকন সাদকে চিনতে পারে যাকে তারা হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। রোকন তোরা পারলি এইভাবে আমাকে নির্যাতন করতে। চাপাতি হকিস্টিক দিয়ে নির্মমভাবে পেটাতে। কি অপরাধ ছিল আমার? কি দোষ করেছিলাম আমি? আমার অপরাধ তোদের কথামত আমি স্যারদের পরীক্ষা পেছাতে বলিনি তাই বলে তোরা আমাকে মেরে ফেল্লি। এতটা নিচ তোরা? এখন ফিরিয়ে দে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, ফিরিয়ে দে আমার মায়ের স্বপ্ন ফিরিয়ে দে. ফিরিয়ে দে? রোকন অনেক কিছু বলতে চাইছে তবে তার মূখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। হঠাত্ সাদ তাকে জাপটে ধরে। ভয়ংকর ঠান্ডা তার হাত। প্রচন্ড শক্তিতে সে রোকনের গলা টিপে ধরেছে। রোকনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সামনের সবুজ ঘাসগুলোকে ঝাপসা মনে হয় তার কাছে।
যদিও সাদ এখন সব কিছু বুঝতে পারে কিন্তু সে বুঝতে পারেনা রাতের আঁধারে কারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। চাপতি রডের প্রচন্ড নির্যাতনে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ওরা তাকে এতটুকু দয়া দেখায়নি। সাদকে যখন নির্মমভাবে কোপাচ্ছিল তখন প্রচন্ড চিত্কারে সে মাকে ডাকে। মা ওমা আমাকে মেরে ফেল্ল। সে চিত্কার চাপাতি আর রডের আঘাতের ভীরে চার দেয়ালে এসে থেমে গিয়েছিল। ওরা যখন মনে করেছিল সাদ মারা গেছে তখন ই সেখান থেকে কেটে পরে।
ঠিক সেই সময়টাও সাদের কোন বন্ধুরা হয়ত হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তাদের ও ভয় ছিল যদি হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারটি ওরা টের পেয়ে যায় তবে তাদেরকেও মেরে ফেলবে ওরা! কেউ একজন রাজশাহীতে সাদের বড় ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়ে সাদের মুখে ধরেছিল। সাদ চিত্কার করে তার ভাইকে ডেকে ছিল- ভাইয়া ওরা আমারে বাঁচতে দিলনা আমাকে বাঁচতে দিলনা। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছিল আর্তনাদ- আমি অহন কি করুম ভাই আমি অহন কি করুম। পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় উক্তি! বন্ধুরা বেশিক্ষণ সাদের কাছে থাকতে পারেনি কারণ ওরা জানতে পারলে সমস্যা আছে। সাদ সারারাত হাসপাতালের মেঝেতে পড়েছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি, কারো দয়া হয়নি। জানিনা কোন বিশেষ কারণে সাদের চিকিত্সা হয়নি। হয়ত অভিবাবক বিহীন সাদের চিকিত্সার টাকা পাওয়া নিয়ে তারা শংকিত ছিল। আমি এসব চিকিত্সকদের কাদের সাথে তুলনা করব আমার বুঝে আসেনা। এরাতো ঠান্ডা মাথার খুনি। মানুষের মৃত্যুকে এরা মানবতার মৃত্যু ভাবেনা বরং একটা যন্ত্রের মৃত্যু ভাবে। কারণ এরা শিখেছে মানুষ হাত পা নামক কতগুলো যন্ত্রের সমষ্টি যেখানে মানবতা অর্থহীন। রাতের শেষের দিকে আবার তার অদৃশ্য বন্ধুরা তাকে স্থানীয় বেসরকারী ক্লিনিক ট্রমা সেন্টারে নিয়ে গিয়ে ছিল কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। সাদ চলে গেছে সকল হিসাব নিকাশের উর্দ্ধে না ফেরার দেশে।
সাদ নিজে এখন বিখ্যাত অবশ্য এর পিছনে তার অখ্যাত বন্ধুদের অবদান অনেক বেশি। তারা সাদের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবীতে লাগাতার কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে যা ইতিমধ্যে দেশী বিদেশী মিডিয়ায় ঝড় তোলেছে। তবে সাদ তারচেয়ে বিখ্যাত লোকদের কর্মকান্ডে যারপরনাই হতাশ। তার মৃত্যুর পর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ভিসির অস্বাভাবিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা এবং ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি তাকে বেশি হতাশ করেছে। তার দুই কূল রক্ষা নীতি শেষ পূর্যন্ত একটি বিশেষ কূলে এসে ডুবে গেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মানব বন্ধনে দেখা না গেলেও একটি রাজনৈতিক মানব বন্ধনে অংশ নিতে দেখা গেছে। সাদ আরেকজন বিখ্যাত লোকের কর্মকান্ডে অবাক হয়েছেন যিনি হচ্ছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। সাদের মৃত্যুতে তার বিড়াল মার্কা নিরবতা সাদের কাছে বড় রহস্যময় মনে হচ্ছে। এছাড়া সুশীল সমাজের বিখ্যাত ব্যক্তিদের ক্ষমাহীন নিরবতা তার মনে অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাতারে যেয়ে তারই মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের কর্মকান্ডে সাদ যারপরনাই হতাশ।
সাদ তার আম্মাকে দেখছে। তার মনে যে ব্যথা জমেছে তা দূর করার সাধ্য বিধাতা ছাড়া কারো নেই। সাদ যেন তার মায়ের বুকে জমাট বাঁধা ব্যাথাগুলো দেখতে পায়। ঘন কালো মেঘের মত থোক থোক ব্যাথা। মেঘরূপি এ ব্যাথাগুলো সাদের মায়ের
চোখ দিয়ে অশ্রু হয়ে বয়েছে।কিছু ব্যাথা জমে বরফ হয়ে গেছে। সে ব্যাথা কোনদিন গলবে কিনা তা সাদের জানা নেই। সাদের বাবা অবশ্য কাঁদছেনা তবে বেদনায় নির্বাক হয়ে গেছে সে। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত ভারী তা কেবল ভূক্তভোগীরাই বুঝে। সাদের কবরটি এতদিন শুকিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু মায়ের চোখের জল কবরটিকে শুকাতে দিচ্ছেনা। সে অবিরাম কবরের গায়ে কেঁদে যাচ্ছে। হয়ত কোন পথিকের ব্যস্ততা সে কান্নার শব্দে থেমে যায়। পথিক কিছুক্ষণ কান পেতে সাদের মায়ের কান্না শোনে। একসময় চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। হয়ত দূর মগডালে অচেনা পাখিগুলোর
উচ্ছলতা কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। তাদের চোখের কোণে জমে কিছুটা আবেগ। হয়ত বুনোফুলগুলো তাদের গান থামিয়ে নিরবে শোনে সাদের মায়ের কান্না। সাদ এর সব কিছুই লক্ষ্য করে। সে ধীরে ধীরে তার মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। কানে কানে বলে - তুমি কেঁদোনা মা, দেখো মা সারা দেশের মানুষ আজ আমায় চিনে কিছু হায়েনা বাদে সবাই তোমায় বেদনায় ব্যথিত। আজ আমি খবরের কাগজে, টিভির টকশোতে, ফেইসবুকের পাতাতে। সবত্রই আমার বিচরণ। তোমার ছেলে আজ বিখ্যাত মা তোমার ছেলে আজ বিখ্যাত! কিন্তু সাদের কন্ঠ তার মা শোনতে পায়না। ক্ষণিক বাদে আবার কান্না বাড়ে।
এখন ৫২-র ভাষা আন্দোলন নেই, নেই উনসত্তরের গন অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারী আন্দোলন। তখন সবুজে মোড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থাকত ছাত্রদের গগন বিদারী স্লোগানে উত্তাল। এদেশের কোটি মানুষের আশা আকাংখা ও স্বপ্নের প্রতীক ছিল ছাত্ররা। জাতীয় জীবনের যেকোন দূর্যোগে ছাত্ররাই পালন করত অগ্রণী ভূমিকা। সাধারণ মানুষের মাঝে ছাত্র নেতাদের ছিল বিশেষ সম্মান। এখন সময় পাল্টেছে। নেতা হতে হলে চরিত্রবল বা মেধা নয় বরং হকিস্টিক ও হাতবোমার বিশেষ ব্যবহারে পারদর্শী হতে হয়। এখন ক্যান্টিনে খাবার বিল পরিশোধ না করে কিংবা বাসে ভাড়া না দিয়ে কন্টাকদারদের সাথে ঝগড়া ঝাটি করে প্রমান করতে হয় তিনি ছাত্র নেতা। বক্তৃতা বিবৃতিতে গঠন মূলক কথা নয় বরং উচু গলায় ষাড়ের মত চেঁচিয়ে প্রমাণ করতে হয় তিনি ই বাগ্মি! চাঁদাবাজি, নেশা, জুয়াখেলা কিংবা মেয়েদের নিয়ে হলে রাত কাটানো এখন বড় ছাত্র নেতার বিশেষ গুন হিসেবে ধরা হয়। বিপক্ষকে মোকাবেলায় মেধা কিংবা যুক্তি নয় বরং রড চাপাতির ভাষায় কথা বলে তারা। সব মিলিয়ে একটি ভ্রষ্ট সমাজের আদর্শ প্রতিনিধি হয়ে মত্স্যনায় যুগের নেতা হওয়ার সমস্ত গুণগুলো রপ্ত করেছে তারা। এদের কোন ব্যক্তিত্ব নেই, নেই কোন পার্টস পাট্টা তবে তৈল মর্দনের বিশেষ গুণটি এদের নখদর্পণে।
সাদ রাজশাহীর ছেলে। পদ্মা নদীর মায়াময় তীর থেকে সে উচ্চ শিক্ষার্থে ভর্তি হয়েছিল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্বপ্নময় ক্যাম্পাসে। মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে। সাদের ও স্বপ্ন ছিল। আকাশের তারা ছোঁয়া নয় কিংবা মেঘের ভাজে ওড়া নয়। স্বপ্নটা ছিল স্বাভাবিক, সাদামাটা। লেখাপড়া শেষ করা, একটা চাকুরি করা, মা বাবার মুখে হাসি ফুটানো ব্যাস। প্রতিটি ছেলেই স্বপ্ন দেখে, সাদ ও দেখেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসে, তার ডিপার্টমেন্টের প্রতিটি ইটের ভাজে কিংবা তার প্রিয় হলের ২০৫ নম্বর কক্ষে স্বপ্নগুলো বর্ণময় হয়ে উঠত। তার হাসি মাখা মুখে বন্ধুদের সাথে আড্ডার মাঝে কিংবা তার প্রিয় স্যারদের সাথে গল্প করার ফাঁকে প্রায় ই স্বপ্নগুলোর পালে হাওয়া লাগত। ছেলেটা দারুণ আড্ডা প্রিয় ছিল। একটু মিশুক প্রকৃতির হওয়ায় খুব সহজেই সবার সাথে মানিয়ে নিত সে। নিজের অজান্তেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল সাদ। রাজনীতি যে তার জন্য নয় এটা বুঝতে পারেনি সে। এখন রাজনীতি করবে ক্লাসের সবচেয়ে দূর্বল ছাত্রটি। যে কোনদিন ফার্স্ট ক্লাস পাবেনা, লেখাপড়া করবেনা শধু ঠ্যালা মার্কা কথা বলবে সে করবে রাজনীতি। ভালো ছাত্রদের কাজ হচ্ছে একটি ভারী কাঁচের চশমা পড়ে মাথা নিচু করে কলেজে যাবে আবার মাথা নিচু করে বের হবে। তারা হবে বাপুরাম সাপুড়ের সেই বিখ্যাত সাপের মত যে করেনাকো ফোঁসফাস, মারেনাকো ঢুঁসঢাস অথাত্ আলু পটল জাতীয় কিছু একটা। একসময় তারা ফার্স্ট ক্লাস পাবে. বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে বের হবে। আর তাদের ঠ্যালা মার্কা বন্ধুগুলো রাজনীতির সিড়ি বেয়ে অনেক উপরে উঠে যাবে। মন্ত্রি এমপি হবে আর আলু পটল মার্কা ভালো ছাত্র গুলো সচিব হয়ে বগলে ফাইল নিয়ে জ্বি হুজুর করতে করতে তাদের পিছনে ঘুরবে কেউ কেউ চিংড়ী মাছ জাতীয় কিংবা বাঘ আকৃতির বিড়াল হয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করবে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে সাদ ভুল পথে পা দিয়েছিল বলেই মনে হয়।
তখন মাঝ রাত। জেলে রোকনের ঘুম ভেঙে গেছে। একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছিল সে। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। রোকন নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বড় মাঠটাতে দেখতে পায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সমস্ত ছাত্র ছাত্রী মাঠের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা বলছে- তুই এটা কি করলি? ছিঃ রোকন ছিঃ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে তুই আরেকজন ছাত্রকে খুন করলি? স্বপ্নের মাঝেই রোকনের গাঁজা খেতে ইচ্ছে করছিল সাথে একটু ইয়াবা হলেও মন্দ হতনা! ছাত্র ছাত্রীরা অবিরাম চিত্কার করে যাচ্ছে। কিছুটা অসহায় বোধ করে সে। হঠাত্ ই রোকন ভীরের মাঝে তার মাকে দেখতে পায়। সে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। তার মা চিত্কার করে উঠে। তুই আমাকে ছুঁবিনা, তুই আমাকে ছুঁবিনা। তোর মত একটা কুলাঙ্গার আমার পেটে জন্ম নিয়েছে সেটা ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে। তোকে আমি ত্যাজ্য পূত্র ঘোষণা করলাম। রোকন ক্ষেপে যায়। আজ সব দোষ আমার তাইনা। তোমরা সবাই সাধু। যে পারিবারিক শিক্ষা, যে সমাজের শিক্ষা, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাকে খুনি হিসেবে তৈরি করেছে খুনের দায়ে তারাও সমানভাবে দোষি. তাদের ও ফাঁসি হওয়া উচিত। হঠাত্ রোকন দেখে পুরো মাঠটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কেউ নেই। তবে কে যেন ধীর পায়ে হেটে হেটে আসছে। থেতলানো মাথা. সারা গায়ে রক্তের চিহ্ন। ততক্ষণে রোকন সাদকে চিনতে পারে যাকে তারা হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। রোকন তোরা পারলি এইভাবে আমাকে নির্যাতন করতে। চাপাতি হকিস্টিক দিয়ে নির্মমভাবে পেটাতে। কি অপরাধ ছিল আমার? কি দোষ করেছিলাম আমি? আমার অপরাধ তোদের কথামত আমি স্যারদের পরীক্ষা পেছাতে বলিনি তাই বলে তোরা আমাকে মেরে ফেল্লি। এতটা নিচ তোরা? এখন ফিরিয়ে দে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, ফিরিয়ে দে আমার মায়ের স্বপ্ন ফিরিয়ে দে. ফিরিয়ে দে? রোকন অনেক কিছু বলতে চাইছে তবে তার মূখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। হঠাত্ সাদ তাকে জাপটে ধরে। ভয়ংকর ঠান্ডা তার হাত। প্রচন্ড শক্তিতে সে রোকনের গলা টিপে ধরেছে। রোকনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সামনের সবুজ ঘাসগুলোকে ঝাপসা মনে হয় তার কাছে।
যদিও সাদ এখন সব কিছু বুঝতে পারে কিন্তু সে বুঝতে পারেনা রাতের আঁধারে কারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। চাপতি রডের প্রচন্ড নির্যাতনে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ওরা তাকে এতটুকু দয়া দেখায়নি। সাদকে যখন নির্মমভাবে কোপাচ্ছিল তখন প্রচন্ড চিত্কারে সে মাকে ডাকে। মা ওমা আমাকে মেরে ফেল্ল। সে চিত্কার চাপাতি আর রডের আঘাতের ভীরে চার দেয়ালে এসে থেমে গিয়েছিল। ওরা যখন মনে করেছিল সাদ মারা গেছে তখন ই সেখান থেকে কেটে পরে।
ঠিক সেই সময়টাও সাদের কোন বন্ধুরা হয়ত হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তাদের ও ভয় ছিল যদি হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারটি ওরা টের পেয়ে যায় তবে তাদেরকেও মেরে ফেলবে ওরা! কেউ একজন রাজশাহীতে সাদের বড় ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়ে সাদের মুখে ধরেছিল। সাদ চিত্কার করে তার ভাইকে ডেকে ছিল- ভাইয়া ওরা আমারে বাঁচতে দিলনা আমাকে বাঁচতে দিলনা। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছিল আর্তনাদ- আমি অহন কি করুম ভাই আমি অহন কি করুম। পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় উক্তি! বন্ধুরা বেশিক্ষণ সাদের কাছে থাকতে পারেনি কারণ ওরা জানতে পারলে সমস্যা আছে। সাদ সারারাত হাসপাতালের মেঝেতে পড়েছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি, কারো দয়া হয়নি। জানিনা কোন বিশেষ কারণে সাদের চিকিত্সা হয়নি। হয়ত অভিবাবক বিহীন সাদের চিকিত্সার টাকা পাওয়া নিয়ে তারা শংকিত ছিল। আমি এসব চিকিত্সকদের কাদের সাথে তুলনা করব আমার বুঝে আসেনা। এরাতো ঠান্ডা মাথার খুনি। মানুষের মৃত্যুকে এরা মানবতার মৃত্যু ভাবেনা বরং একটা যন্ত্রের মৃত্যু ভাবে। কারণ এরা শিখেছে মানুষ হাত পা নামক কতগুলো যন্ত্রের সমষ্টি যেখানে মানবতা অর্থহীন। রাতের শেষের দিকে আবার তার অদৃশ্য বন্ধুরা তাকে স্থানীয় বেসরকারী ক্লিনিক ট্রমা সেন্টারে নিয়ে গিয়ে ছিল কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। সাদ চলে গেছে সকল হিসাব নিকাশের উর্দ্ধে না ফেরার দেশে।
সাদ নিজে এখন বিখ্যাত অবশ্য এর পিছনে তার অখ্যাত বন্ধুদের অবদান অনেক বেশি। তারা সাদের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবীতে লাগাতার কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে যা ইতিমধ্যে দেশী বিদেশী মিডিয়ায় ঝড় তোলেছে। তবে সাদ তারচেয়ে বিখ্যাত লোকদের কর্মকান্ডে যারপরনাই হতাশ। তার মৃত্যুর পর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ভিসির অস্বাভাবিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা এবং ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি তাকে বেশি হতাশ করেছে। তার দুই কূল রক্ষা নীতি শেষ পূর্যন্ত একটি বিশেষ কূলে এসে ডুবে গেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মানব বন্ধনে দেখা না গেলেও একটি রাজনৈতিক মানব বন্ধনে অংশ নিতে দেখা গেছে। সাদ আরেকজন বিখ্যাত লোকের কর্মকান্ডে অবাক হয়েছেন যিনি হচ্ছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। সাদের মৃত্যুতে তার বিড়াল মার্কা নিরবতা সাদের কাছে বড় রহস্যময় মনে হচ্ছে। এছাড়া সুশীল সমাজের বিখ্যাত ব্যক্তিদের ক্ষমাহীন নিরবতা তার মনে অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাতারে যেয়ে তারই মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের কর্মকান্ডে সাদ যারপরনাই হতাশ।
সাদ তার আম্মাকে দেখছে। তার মনে যে ব্যথা জমেছে তা দূর করার সাধ্য বিধাতা ছাড়া কারো নেই। সাদ যেন তার মায়ের বুকে জমাট বাঁধা ব্যাথাগুলো দেখতে পায়। ঘন কালো মেঘের মত থোক থোক ব্যাথা। মেঘরূপি এ ব্যাথাগুলো সাদের মায়ের
চোখ দিয়ে অশ্রু হয়ে বয়েছে।কিছু ব্যাথা জমে বরফ হয়ে গেছে। সে ব্যাথা কোনদিন গলবে কিনা তা সাদের জানা নেই। সাদের বাবা অবশ্য কাঁদছেনা তবে বেদনায় নির্বাক হয়ে গেছে সে। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত ভারী তা কেবল ভূক্তভোগীরাই বুঝে। সাদের কবরটি এতদিন শুকিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু মায়ের চোখের জল কবরটিকে শুকাতে দিচ্ছেনা। সে অবিরাম কবরের গায়ে কেঁদে যাচ্ছে। হয়ত কোন পথিকের ব্যস্ততা সে কান্নার শব্দে থেমে যায়। পথিক কিছুক্ষণ কান পেতে সাদের মায়ের কান্না শোনে। একসময় চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। হয়ত দূর মগডালে অচেনা পাখিগুলোর
উচ্ছলতা কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। তাদের চোখের কোণে জমে কিছুটা আবেগ। হয়ত বুনোফুলগুলো তাদের গান থামিয়ে নিরবে শোনে সাদের মায়ের কান্না। সাদ এর সব কিছুই লক্ষ্য করে। সে ধীরে ধীরে তার মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। কানে কানে বলে - তুমি কেঁদোনা মা, দেখো মা সারা দেশের মানুষ আজ আমায় চিনে কিছু হায়েনা বাদে সবাই তোমায় বেদনায় ব্যথিত। আজ আমি খবরের কাগজে, টিভির টকশোতে, ফেইসবুকের পাতাতে। সবত্রই আমার বিচরণ। তোমার ছেলে আজ বিখ্যাত মা তোমার ছেলে আজ বিখ্যাত! কিন্তু সাদের কন্ঠ তার মা শোনতে পায়না। ক্ষণিক বাদে আবার কান্না বাড়ে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃওবায় দুল হক ২৫/০৭/২০১৪খুব ভাললাগল।
-
কবি মোঃ ইকবাল ২৪/০৭/২০১৪খুব ভালো লাগলো।।
-
মঞ্জুর হোসেন মৃদুল ২৪/০৭/২০১৪ভাল লাগল।