www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

টটোগ্রাম (বর্ণালংকার) সনেট এবং অনুপ্রাস ও শ্লেষ অলংকার সনেট

টটোগ্রাম (tautogram) শব্দটি দুইটি গ্রিক শব্দ ’টটো (tauto)’ ও ’গ্রামা (gramma)’ শব্দের সমন্বয় গঠিত হয়েছে। ’টটো’ শব্দের অর্থ একই এবং ’গ্রামা’ শব্দের অর্থ অক্ষর বা বর্ণ। সাহিত্যে টটোগ্রাম শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সাহিত্যে টটোগ্রাম বলতে এমন এক সাহিত্যকে বোঝায়, যে সাহিত্যের প্রতিটি শব্দ শুরু হয়েছে একই বর্ণ দিয়ে। তাই টটোগ্রামকে আমি বর্ণালংকার বলি। কেননা প্রতিটি শব্দের আদিতে (প্রথমে) একই বর্ণ থাকে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখা যেমন- কবিতা, গান, গল্প, মহাকাব্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে টটোগ্রাম ব্যবহার করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত বেশিরভাগ টটোগ্রামই মহাকাব্যিকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও বাংলা সাহিত্যে এাটি একটি সম্পূর্ণ নতুন সংযোজন।

বাংলা সাহিত্যে টটোগ্রাম খুব বেশি নতুন নয়। তার কারন বাংলা লোকো সাহিত্যে এর সূচনা হয় বিংশশতাব্দীর শেষের দিক এবং একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকো সঙ্গীত শিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাস ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘চাচায় চা চায়’ নামে একটি নতুন গানের এলবাম বের করেন। যেখানে চ-বর্ণের টটোগ্রাম লক্ষ্যকরা যায়। গানটা অনেকটাই এরকম:
“চাচায় চা চায়
চাচী চ্যাঁচায়
চা চড়াতে চায়না চাচী চচ্চড়ি চুলায়।
চাচার চিকন চাকন চেহারাটা চান্দিটা চচকচে
চরণের চামড়ার চটি, চীনা চশমা চোখে
চাচা চিরকালই চালাক চতুর চাটুকারিতায়।।
চাচায় চায়রে চা চানাচুর চাচী চিড়া-চাল
চাচা-চাচীর চেঁচাচেচি চলছে চিরকাল
চাছা চটা চেছে চাচা চাচীরে চটায়।।

চাচী চাচার চাল চলনে চটে চড়া চোখে চায়
চাচীর চোখের চাহনিতে চাচা চমকায়
চাচার চেয়ে চাঈ চালু চিন্তা-চেতনায়।
চাচায় চা চায়
চাচী চ্যাঁচায়
চাচীর চাবিতে চলে চাটুকার চাচায়।।”
——— নকুল কুমার বিশ্বাস
টটোগ্রাম সনেট
সনেট (Sonnet) কি জিনিস, আশাকরি এটা হয়তো কাউকে নতুন করে বলতে হবেনা। বিশেষকরে আমরা যারা বাংলা সাহিত্য একটু-আধটু পড়ি এবং সাহিত্যের এক-আধটু রস আস্বাদন করি। তার পড়েও বলছি, সনেটের জন্ম মধ্যযুগে ইতালির কবি সাহিত্যিক পেত্রাক-এর হাতে। তাঁকে সনেটের জনক বলা হয়। সনেট-কে বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতাও বলা হয়। মহাকবি ও বাংলা পদ্যের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত সর্বপ্রথম বাংলা সনেট রচনা করেন। সনেট কবিতায় মোট ১৪টি (কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮ চরণ) চরণ ও প্রত্যেক চরণে মোট ১৪ মত্রা বা ১৪টি করে অক্ষর থাকে। যেখনে মুক্তাক্ষর বা যুক্তাক্ষর একমাত্রা গণনা করা হয়। সনেটের প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক বলা হয়। অষ্টকে সাধারণত মূল ভাবের প্রবর্তনা এবং ষষ্টকে ভাবের পরিণতি বা ফলাফল প্রকাশিত হয়।
আমি টটোগ্রাম সম্পর্কে জানার আগে টটোগ্রাম বাংলা গান শুনেছি। তারপর অনেক খোঁজ-খবর করেছি যে, এরূপ কোনো সাহিত্য আছে কিনা। বিশেষকরে সনেট কবিতা খোঁজ করেছিলাম। তখনো আমি বাংলা সাহিত্যে কোনো টটোগ্রাম পাইনি। যেহেতু একই বর্ণ দিয়ে শুরু হওয়া শব্দগুলোকে টটোগ্রাম বলে, আমি তা জানতাম না। তাই এধরনের সাহিত্যের নাম করণ করেছিলাম- ’বর্ণালংকার’। যখন আমি এধরনের একই বর্ণ দিয়ে শুরু হওয়া শব্দ দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করি। ঠিক তখন থেকেই টটোগ্রামকে আমি বর্ণালংকার বলি। আমি মাধ্যমিকে পড়ার সময় (২০০৬) ‘অন্তরাত্মা’ নামে প্রথম বাংলা অক্ষর অ-বর্ণের টটোগ্রাম সনেট লেখি। তার কিছুদিন পর লেখি ‘মা’ নামে আর একটি বাংলা অক্ষর ম-বর্ণের টটোগ্রাম। তখন চিন্তা করছিলাম, যেহেতু বাংলা সাহিত্যে এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন ধারা, তাই একে নতুন ভাবেই রূপ দিতে হবে। আমি একই বর্ণের শব্দ দিয়ে শুরু হওয়া আমার কবিতাগুলোকে “বর্ণালংকার” নামক কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ করার চিন্তা করলাম।
অন্তরাত্মা
অনিত্য অস্থিত্বশীল অসু অভ্যুত্থান
অহমিকা অনুরক্ত অংশু অলংকার;
অন্তহীন অনুতপ্ত অগ্নি অহংকার
অবনির অবসান অহং অন্তর্ধান।
অব্যর্থ অভিশংসন অটল অর্চন
অতনু অবতারণা অজ অস্বীকার;
অপভ্রংশ অন্তরাত্মা অরি অধিকার
অতল অবগাহন অতৃপ্ত অর্জন।
অনন্ত অভিবাদন অহে অন্তর্যামী
অন্তর অবলোকন অভ্রম অলক্ষ্য;
অবিচল অভিলাষ অন্তর অভেদী
অহরহ অচেতন অন্ধ অনুগামী;
অলীক অভিগমন অয়ন অরক্ষ্য
অবান্তর অধিকৃত অমা অন্তর্ভেদী।

পেত্রাকীয় ধারায় বাংলা (অ-বর্ণ) টটোগ্রাম সনেট: বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম টটোগ্রাম সনেট।
অন্ত্যমিলঃ কখখক:কখখক::গঘঙ:গঘঙ।

মা
মহামায়া মহাকায় মেদিনী মোদের
মাতৃভূমি মাতৃদুগ্ধ মহাপ্রাণ মাই,
মহীয়সী মহাত্মা মা মহিমা মায়ের
মুখরিত মাতৃভাষা মাখন মিঠাই।।
মাতৃদেহ মহব্বত মায়ের মাসুল
মার্জনা মাগনে মাতা মুরারি মিনতি,
মা'র মধুর মমতা মিলেনা মাতুল
মানসিক মোকাবিলা মস্ত মেহনতি।।
মহামতি মর্মভেদী মোগো মাতবরি
মোরা মাতৃকা মায়ের মাকাল মানিক,
মনে মানে মহামূর্খ মাতাল মাৎসরী
মলিন মনে মুখর মোরা মর্মান্তিক।।
মমতাময়ী মঞ্জিল মায়ের মাধুর্য
মনের মতন মাগো মধুর মৌখর্য।।

শেক্সপীয়ার সনেটঃ ম-বর্ণের টটোগ্রাম সনেট। অন্ত্যমিলঃ (অষ্টক+ষষ্টক): কখকখ:গঘগঘ::ঙচঙচছছ।
অনুপ্রাস ও টটোগ্রামের মধ্যে পার্থক্য
অনুপ্রাস-এর ’অনু’ শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে বা শেষে এবং ’প্রাস’ শব্দের অর্থ বিন্যাস প্রয়োগ বা নিক্ষেপ। একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছের বার বার বিন্যাস করাকে অনুপ্রাস বলে। অন্যভাবে বলা যায়, একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যুক্তভাবে হোক আর বিযুক্তভাবেই হোক একাধিকবার উচ্চারিত হয়ে যদি কবিতায় ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্টি করে, তবে তাকে অনুপ্রাস অলংকার বলে। যেমন-
’গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি,নাহি ভরসা।’- (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
-এখানে অনুপ্রাস হল- বরষা/ ভরসা শব্দের ষা ও সা ধ্বনির মিল।
’কুশল কামনা কর কুসঙ্গ করিয়া।’- (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
-এখানে ‘ক’ ধ্বনি পাঁচবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।
’গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে।’- (রবীন্দ্রনাথ)
-এখানে ‘গ’ ধ্বনি আটবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।

শ্লেষ অলংকার ও শ্লেষ অলংকার সনেট
একই শব্দ একাধিক অর্থে একই চরণে বারংবার ব্যবহারের ফলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয়, তাকে শ্লেষ অলংকার বলে। এতে একবার মাত্রই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কিন্তু তাতে ভিন্ন অর্থের ব্যঞ্জনা থাকে। শ্লেষ অলংকার শব্দকেন্দ্রিক হওয়ায়, অনেকে একে শব্দ-শ্লেষও বলেন। যেমন-
’কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যপ্ত চরাচরে,
যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।’ – (ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত)
-এখানে প্রভাকর অর্থ সূর্য এবং সংবাদ প্রভাকর (পত্রিকা) কে বোঝানো হয়েছে।
’মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।’
-এখানে ‘রবি’ বলতে সূর্য ও রবীন্দ্রনাথকে বোঝানো হয়েছে।


শ্লেষ অলংকার দিয়ে সৃষ্ট সনেট-কে, শ্লেষ অলংকার সনেট বলে। নিচে আমার লেখা ’মহাগতি’ শিরোনামের কবিতাটি একটি অনুপ্রাস ও শ্লেষ উভয় অলংকার বিশিষ্ট সনেট।

মহাগতি
জন্মসৃষ্টি মহাপ্রাণে প্রাণে প্রাণে প্রাণ
মহাপ্রাণে প্রাণ প্রপ্তি মহালয়ে লয়:
জন্ম নয় মৃত নয় অজ্ঞাত সময়
শবে শব জড় শব নাই সৃষ্টি মান।
বারে বারে লয়প্রাপ্ত মহালয় প্রাণ
প্রাণে প্রাণে প্রাণ বয় অব্যক্ত অব্যয়:
দিবানিশি প্রাণবায়ূ লয় প্রাপ্ত হয়
অনন্ত বায়ূর মাঝে সদা লয় প্রাণ।
অজ্ঞাত সময় পর জন্ম লয় প্রাপ্ত
মহালয়ে মহাপ্রাপ্তি মহান মিলন;
কালে কাল মহাকাল প্রাপ্ত লয় সম।
সব্যয় সঞ্চয় সব কাল ক্ষণে ব্যপ্ত
কাল হলে কাল হবে মহালয় দম;
মহাগতি মহাপ্রাণে উন্নত জীবন।
পেত্রাকীয় ধারায় বাংলা (অনুপ্রাস অলংকার ও শ্লেষ অলংকার) সনেট: বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম অনুপ্রাস অলংকার সনেট ও শ্লেষ অলংকার সনেট।
কখখক:কখখক::গঘঙ:গঘঙ।
(সংক্ষেপিত)

কপিরাইট © ২০১৬ এস. কে. সুবল চন্দ্র মামাহাত্ম্য
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৩৭৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/০৩/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast