যখন রাজধর্ম থাকে না তখন ব্যক্তিধর্ম নিরর্থক
মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান নিয়ামক হলো সত্যধর্ম, স্রষ্টাপ্রদত্ত ধর্ম। মানবজাতির ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাযখন রাজধর্ম থাকে না তখন ব্যক্তিধর্ম নিরর্থক
য়, রাজ্যে ধর্মের উপস্থিতিই কেবল সমাজকে শান্তিপূর্ণ করতে পেরেছে । ধর্মের পথে আত্মবিসর্জন দিয়ে বহু মহামানব আজও আমাদের কাছে পূজনীয় হয়ে আছেন। আজও মানুষ ধর্মের বিধান মেনে চলতে চেষ্টা করছে। পৃথিবীর সাতশ’ কোটি মানুষের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী হিসেবে নিজেকে দাবি করে। নিজ নিজ ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী তারা নামাজ, রোজা, হজ্ব, পূজা-আর্চনা, উপবাস, তীর্থযাত্রা, প্রার্থনা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাসনা, আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব, রীতি-নীতি পালন করছে। তাদের মধ্যে এমনও ধার্মিক ব্যক্তি আছেন যারা জীবনে কোনোদিন মিথ্যা বলেন নি, কোনো পাপ কাজ করেন নি, হারাম ভক্ষণ করেন নি। এমন অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন, দল বা প্রতিষ্ঠান আছে যারা সব ধরনের সংঘর্ষ, যুদ্ধ, মারামারি ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকতে সাধারণ জনতাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্য এটাই যে, এই ধর্মোপদেশ ও সচেতনতা মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। সব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই অন্যায়-অবিচার, অনাচার, ঘাত-প্রতিঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, বৈষম্য, নিপীড়ন ইত্যাদি মহামারী আকার ধারণ করেছে। এক কথায়, প্রচলিত ধর্ম মানুষকে শান্তি দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এর কারণ কী? কোটি কোটি ধার্মিক লোক পৃথিবীতে থাকা সত্ত্বেও এমন পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো? আসুন এর উত্তর বের করতে সচেষ্ট হই।
মহাভারতের বর্ণনামতে, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রের সবারই চরিত্র ছিল বেশ উশৃঙ্খল। তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্য্যােধন ছিল সর্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রুর, দুর্মতি, পাপাচারী ও ঐশ্বর্য্যলোভী। এই শতপুত্রকে নিয়ে সাধারণ জনগণ সর্বদাই চিন্তিত থাকতো। দুর্য্যােধন রাজা হলে তাদের যে কী পরিমাণ দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হতে হবে- তা সবাই অনুধাবন করতো। কারণ তারা জানতো যে, দুর্য্যােধন কোনদিনও রাজ্যে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত রাখবে না। আর যে রাজা রাজধর্মকে অবজ্ঞা করে সে স্বয়ং প্রজার অধিকারকেই অস্বীকার করে। এ নিয়ে জনগণের আশঙ্কার কোনো শেষ ছিল না। কিন্তু কিছুই করার নেই। কারণ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছা ছিল এই যে, তার (ধৃতরাষ্ট্রের) পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্য্যােধনই সিংহাসনে বসবে। অবস্থা যখন এই, তখন রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে আশার আলো ছড়াতে হস্তিনাপুরে আসলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরসহ পাণ্ডবগণ। তাদের আচার-আচরণ, নিষ্ঠা, সততা, দয়া-মায়া, ধর্মে অবিচলতা এবং রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি ভালোবাসা দেখে সকলে বিমুগ্ধ হলো। কি মহামন্ত্রী বিদুর, কি পিতামহ ভীষ্ম, সবারই চাওয়া ছিল এই যে, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির (আ:) ধৃতরাষ্ট্রের পর রাজা হোক। কারণ দুর্য্যােধনের চেয়ে বয়স, বুদ্ধি, ধর্মজ্ঞান, সহনশীলতা, যুদ্ধবিদ্যা সব দিক দিয়েই যুধিষ্ঠির (আ.) ছিলেন শ্রেষ্ঠ।
কিন্তু পাপাচারী দুর্য্যােধন বিষয়টিকে এতটা সহজ থাকতে দিল না। সে তার পাপাচারী মামা শকুনীর সাথে হাত মিলিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে শুরু করলো। প্রথমে ভীমকে বিষ খাওয়ালো, পরে অর্জুনকে প্রতিযোগিতার আসরে হত্যা করার ফন্দি আঁটলো, তারপর জতুগৃহ নির্মাণ করে মা কুন্তিসহ পুরো পাণ্ডবকূলকেই ভস্ম করে দেওয়ার প্রয়াস করলো। তাছাড়া রাজমহলে পাঁচ পাণ্ডবদের সাথে তাদের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, সেখানে পাণ্ডবদের পক্ষে এক মুহূর্ত নিশ্চিন্তভাবে কাটানো সম্ভব নয়। সর্বদায় আতঙ্কের মাঝে বসবাস করতে হতো তাদের। পাণ্ডবরা কেবল চেয়েছে শান্তি, সৌহার্দ্য ও কৌরব-পাণ্ডব সহাবস্থান। কিন্তু যখন তারা বুঝলো যে, তাদের সহাবস্থান কখনোই সম্ভব নয় এবং এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তাদেরকে সংঘাতের পথ বেছে নিতে হবে তখন তারা রাজমহল ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। সংঘর্ষের পথে না গিয়ে তারা সব ধরনের সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার ব্রত নিল। বারনাবত থেকেই তারা কাউকে না জানিয়ে অরণ্যের পথে যাত্রা করলো। আশা ছিল- সে অরণ্যে কিছু থাকুক আর না থাকুক, সেখানে সংঘর্ষ থাকবে না, অধর্ম থাকবে না, অনিশ্চয়তা থাকবে না; থাকবে না ষড়যন্ত্রের ভয়। কিন্তু সব ধরনের সংঘর্ষকে এড়িয়ে চলার নামই কি ধর্ম? কখনোই নয়, বরং মিথ্যার সাথে সংঘর্ষই হলো সত্যধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। হয়তবা সে কারণেই পাণ্ডবদের পালিয়ে থাকার মনোবাসনা পূর্ণ হয় নি। তারা সংঘর্ষ থেকে খুব বেশিদিন নিজেদের আড়াল করে রাখতে সক্ষম হন নি। খুব শিগগিরই তাদেরকে সেই সংঘর্ষের জীবনে ফিরে যেতে হয়েছে। শুধু ফিরে যেতে হয়েছে তাই নয়, নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তারা হস্তিনাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ইতিহাস আমরা জানি। মানবজাতির ইতিহাসে এই যুদ্ধটি কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না। সে যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহিনী আদম সন্তান জীবন হারিয়েছিল। ঐ যুগের তুলনায় এ সংখ্যা ছিল অতি ভয়ংকর। যে পাণ্ডবরা স্বজনদের সাথে সামান্য পরিমাণ সংঘর্ষ বা রেষারেষি করতেও আগ্রহী ছিলেন না, যার কারণে তারা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বনে গিয়ে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তারাই স্বজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এটাই ধর্ম। ধর্মকে যে ধারণ করবে সে কখনো মিথ্যার সাথে সহাবস্থান করতে পারবে না, আবার মিথ্যা থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারবে না। মিথ্যাকে বধ করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেই তাকে বাঁচতে হবে।
পাণ্ডবরা যখন রাজ্য ছেড়েছে তখন তাদের সামনে বিবেচ্য ছিল নিজেদের সুবিধার-অসুবিধা। তাদের অনুপস্থিতিতে রাজ্যের জনসাধারণের কী পরিণতি হবে তা তখন বিবেচ্য ছিল না। কিন্তু যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে স্বজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে তখন সে সিদ্ধান্ত তাদের ব্যক্তিগত লাভ-লোকশানের খাতিরে ছিল না, ছিল জনসাধারণের শান্তি-অশান্তির ভিত্তিতে। এই লড়াই হয়েছে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের লড়াই। পাণ্ডবরা সংগ্রাম করেছেন রাজধর্মকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধর্মই তাদেরকে বাধ্য করেছে স্বজনদের বিরুদ্ধে লড়তে। কারণ, অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা ধর্মের প্রধান শিক্ষা। যে রাজ্যে অধর্মের জয়জয়কার, যেখানে মানুষ শান্তির আশায় হাহাকার করছে, সেখানে অধর্মকে নস্যাৎ করে ধর্মের বিধান প্রতিষ্ঠা করাই হলো ধর্মের প্রথম দাবি। মানুষের শান্তির বীজ নিহিত রয়েছে ধর্মে। তবে সে ধর্ম ব্যক্তিধর্ম নয়, রাজধর্ম। যে রাজ্যে রাজধর্ম লোপ পায়, সে রাজ্যের জনগণ যদি প্রত্যহ জজ্ঞ-আরাধনাও করে তবুও তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে না। তাই ইতিহাসে দেখি- রাজধর্মকে পুনঃস্থাপনের জন্য পাণ্ডবরা নিজের ভ্রাতা, গুরুজন, পিতামহ, মাতুল, পৌত্রগণ ও শ্যালকগণের সাথে যুদ্ধ করেছেন, তাদের রক্তপাত ঘটিয়েছেন, হত্যা করেছেন। যে ধর্মের রক্ষা করতে তারা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গিয়েছিলেন সেই ধর্মই তাদেরকে যুদ্ধ করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাদের এই যুদ্ধ ছিল ধর্মযুদ্ধ। অধর্মের হাত থেকে আর্তপীড়িত মানুষকে মুক্ত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ঐ ধর্মযুদ্ধের লক্ষ্য।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কখনোই পাণ্ডবদের রাজ্যজয়ের যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল রাজধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এর প্রমাণ আমরা পাই গীতায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুন শত্র“পক্ষের সৈন্যদের অবলকন করে শ্রীকৃষ্ণকে (আ:) বললেন- “হে কৃষ্ণ, আত্মীয়বর্গকে যুদ্ধার্থ উপস্থিত দেখিয়া আমার অঙ্গপ্রত্যাঙ্গাদি অবসন্ন ও মুখ শুষ্ক হইতেছে। আমার শরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হইতেছে। আমার হস্ত হইতে গাণ্ডীব-ধনু খসিয়া পড়িতেছে এবং চর্ম যেন দগ্ধ হইতেছে।” (গীতা, ১: ২৮-২৯)। অর্থাৎ তিনি আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মোটেও স্বজনদের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। এবং তিনি যে রাজ্যের লোভে পড়ে তাদের সামনে অস্ত্র হাতে দাঁড়ান নি তারও প্রমাণ রয়েছে গীতায়। যেখানে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে (আ:) উদ্দেশ্য করে বলছেন- “হে গোবিন্দ, আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন, আর সুখভোগে বা জীবন-ধারণেই কি প্রয়োজন? কারণ, যাঁহাদের নিমিত্ত রাজ্য, ভোগ ও সুখাদি আমাদের অভিলাষিত, সেই আচার্যগণ, পিতৃব্যগণ, পুত্রগণ, পিতামহগণ, মাতুলগণ, শ্বশুরগণ, পৌত্রগণ, শ্যালকগণ ও স্বজনগণই প্রাণ ও ধনাদির আশা পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধে উপস্থিত হইয়াছেন। (গীতা, ১: ৩২-৩৩)
এভাবে বহু যুক্তি দেখিয়ে এক পর্যায়ে অর্জুন যুদ্ধ না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ (আ.) শেষ পর্যন্ত অর্জুনের ভুল ভাঙাতে সক্ষম হন। তিনি অর্জুনকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এই যুদ্ধ রাজ্য জয়ের বা রাজ্য ফিরে পাবার যুদ্ধ নয়, এমনকি নিজের অধিকার রক্ষার যুদ্ধও (যা শাস্ত্রসম্মত) নয়। এটা ধর্মযুদ্ধ, ধর্মের জন্য যুদ্ধ, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ। এক কথায় এটা রাজধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ কেবল পাণ্ডবদের ভাগ্য বিধায়কই নয়, এটা আপামর জনতার ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। জনগণের শান্তি-অশান্তি নির্ভর করছে এই যুদ্ধে। ধর্মযুদ্ধে জয়ী হলে যেমন রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হয়, তেমনি পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও স্বর্গলাভ হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণ (আ.) বলেছেন- “আর স্বধর্ম লক্ষ্য করিয়াও তোমার ভীত হওয়া উচিত নয়। কারণ, ধর্মসঙ্গত যুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নাই। (গীতা, ২: ৩১)। আর যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তাহা হইলে স্বীয় ক্ষত্রিয়ধর্ম ও কীর্তি পরিত্যাগহেতু তুমি পাপভাগী হইবে। (গীতা, ২: ৩৩)। অর্থাৎ স্বজনকে হত্যা করতে হবে বা আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুর কারণ হতে হবে, এই ভয়ে যদি কেউ ধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তাহলে সে পাপী হবে। কারণ, আত্মীয় স্বজনদের হত্যা করার চেয়েও বড় পাপ হলো সাধারণ মানুষকে অধার্মিক রাজার হাতে ছেড়ে দেওয়া। এতে সমগ্র রাজ্যে অশান্তির সৃষ্টি হয়। আর রাজ্যের জনসাধারণকে অশান্তির মধ্যে ছেড়ে ব্যক্তিগতভাবে যতই ধর্ম-কর্ম করা হোক, পূজা-আর্চনা করা হোক, যজ্ঞ-আরাধনা করা হোক না কেন তা কোনো ফল বয়ে আনে না। তা করলে বরং সেটাই হবে সবচেয়ে বড় অধর্ম। সুতরাং মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে, রাজধর্ম না থাকলে ব্যক্তিধর্ম নিরর্থক। যখন রাজধর্ম লোপ পায় তখন সকলের জন্য রাজধর্ম পুনঃস্থাপন করাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় ব্যক্তিধর্ম।
রাজধর্ম সম্পর্কে মহাভারতের শান্তিপর্বে উল্লেখ আছে, যেখানে মহামহীম ভীষ্ম ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে (আ:) উদ্দেশ্য করে বলছেন- “মঙ্গললাভার্থী ব্যক্তিদিগের পক্ষে একজনকে নরপতিপদে অভিষেক করা অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজ্য অরাজক হইলে কেহই নির্ব্বিঘেœ স্ত্রীসম্ভোগ ও ধর্ম্ম-উপভোগ করিতে পারে না। ঐ সময় পাপাত্মারা অন্যের ধন অপহরণ করিয়া মহা আহ্লাদিত হয়, কিন্তু যখন অপরাপর ব্যক্তিরা তাহার ধন হরণ করে, তখন সে রাজার সাহায্য প্রাপ্ত হইতে বাসনা করে; অতএব অরাজকতা পাপাত্মাদিগেরও সুখজনক নহে। ঐ সময় দু’জন পাপাত্মা একত্র হইয়া এক ব্যক্তির এবং অনেক লোক একত্র হইয়া সেই দুইজনের ধন অপহরণ করে। বলবান ব্যক্তি দুর্ব্বলকে আপনার দাস করিয়া রাখে এবং বলপূর্ব্বক পরস্ত্রীহরণে প্রবৃত্ত হয়। হে ধর্ম্মরাজ! ঐ সকল দৌরাত্ম্য নিবারণের নিমিত্তই দেবতারা রাজ্যমধ্যে নরপতির আবশ্যকতা নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছেন। যদি পৃথিবীমধ্যে রাজা দণ্ড ধারণ না করেন, তাহা হইলে সলিলস্থ বৃহৎ মৎস্যেরা যেমন ক্ষুদ্র মৎস্যসমুদয়কে ভক্ষণ করে, সেইরূপ বলবান ব্যক্তিরা দুর্ব্বলদিগকে ভক্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হয়।”
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, যে কোনো দেশের জনসাধারণের শান্তি নিশ্চিত হয় সে দেশের শাসনকর্তার হাত ধরে। শাসকই পারেন সত্যযুগ ফিরিয়ে আনতে। আবার শাসকের ভুলেই জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি ধার্মিক ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলছেন। কিন্তু তাদের জাতীয় জীবন চলছে এমন সব তন্ত্র-মন্ত্র, জীবনব্যবস্থা দ্বারা যেখানে স্রষ্টার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে শাসকের ধর্মবর্জিত শাসনে ধার্মিক জনতার জীবনে নেমে এসেছে অজস্র দুঃখ-কষ্ট, অন্যায়-অবিচার, অনাচার, বৈষম্য, নিপীড়ন, দারিদ্র্য। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে ব্যক্তিধর্মের ক্ষুদ্র গণ্ডিকে অতিক্রম করে রাজধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বুঝতে হবে যে, একমাত্র স্রষ্টার দেওয়া বিধানই মানুষের শান্তি নিশ্চিত করতে পারে।
য়, রাজ্যে ধর্মের উপস্থিতিই কেবল সমাজকে শান্তিপূর্ণ করতে পেরেছে । ধর্মের পথে আত্মবিসর্জন দিয়ে বহু মহামানব আজও আমাদের কাছে পূজনীয় হয়ে আছেন। আজও মানুষ ধর্মের বিধান মেনে চলতে চেষ্টা করছে। পৃথিবীর সাতশ’ কোটি মানুষের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী হিসেবে নিজেকে দাবি করে। নিজ নিজ ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী তারা নামাজ, রোজা, হজ্ব, পূজা-আর্চনা, উপবাস, তীর্থযাত্রা, প্রার্থনা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাসনা, আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব, রীতি-নীতি পালন করছে। তাদের মধ্যে এমনও ধার্মিক ব্যক্তি আছেন যারা জীবনে কোনোদিন মিথ্যা বলেন নি, কোনো পাপ কাজ করেন নি, হারাম ভক্ষণ করেন নি। এমন অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন, দল বা প্রতিষ্ঠান আছে যারা সব ধরনের সংঘর্ষ, যুদ্ধ, মারামারি ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকতে সাধারণ জনতাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্য এটাই যে, এই ধর্মোপদেশ ও সচেতনতা মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। সব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই অন্যায়-অবিচার, অনাচার, ঘাত-প্রতিঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, বৈষম্য, নিপীড়ন ইত্যাদি মহামারী আকার ধারণ করেছে। এক কথায়, প্রচলিত ধর্ম মানুষকে শান্তি দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এর কারণ কী? কোটি কোটি ধার্মিক লোক পৃথিবীতে থাকা সত্ত্বেও এমন পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো? আসুন এর উত্তর বের করতে সচেষ্ট হই।
মহাভারতের বর্ণনামতে, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রের সবারই চরিত্র ছিল বেশ উশৃঙ্খল। তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্য্যােধন ছিল সর্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রুর, দুর্মতি, পাপাচারী ও ঐশ্বর্য্যলোভী। এই শতপুত্রকে নিয়ে সাধারণ জনগণ সর্বদাই চিন্তিত থাকতো। দুর্য্যােধন রাজা হলে তাদের যে কী পরিমাণ দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হতে হবে- তা সবাই অনুধাবন করতো। কারণ তারা জানতো যে, দুর্য্যােধন কোনদিনও রাজ্যে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত রাখবে না। আর যে রাজা রাজধর্মকে অবজ্ঞা করে সে স্বয়ং প্রজার অধিকারকেই অস্বীকার করে। এ নিয়ে জনগণের আশঙ্কার কোনো শেষ ছিল না। কিন্তু কিছুই করার নেই। কারণ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছা ছিল এই যে, তার (ধৃতরাষ্ট্রের) পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্য্যােধনই সিংহাসনে বসবে। অবস্থা যখন এই, তখন রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে আশার আলো ছড়াতে হস্তিনাপুরে আসলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরসহ পাণ্ডবগণ। তাদের আচার-আচরণ, নিষ্ঠা, সততা, দয়া-মায়া, ধর্মে অবিচলতা এবং রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি ভালোবাসা দেখে সকলে বিমুগ্ধ হলো। কি মহামন্ত্রী বিদুর, কি পিতামহ ভীষ্ম, সবারই চাওয়া ছিল এই যে, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির (আ:) ধৃতরাষ্ট্রের পর রাজা হোক। কারণ দুর্য্যােধনের চেয়ে বয়স, বুদ্ধি, ধর্মজ্ঞান, সহনশীলতা, যুদ্ধবিদ্যা সব দিক দিয়েই যুধিষ্ঠির (আ.) ছিলেন শ্রেষ্ঠ।
কিন্তু পাপাচারী দুর্য্যােধন বিষয়টিকে এতটা সহজ থাকতে দিল না। সে তার পাপাচারী মামা শকুনীর সাথে হাত মিলিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে শুরু করলো। প্রথমে ভীমকে বিষ খাওয়ালো, পরে অর্জুনকে প্রতিযোগিতার আসরে হত্যা করার ফন্দি আঁটলো, তারপর জতুগৃহ নির্মাণ করে মা কুন্তিসহ পুরো পাণ্ডবকূলকেই ভস্ম করে দেওয়ার প্রয়াস করলো। তাছাড়া রাজমহলে পাঁচ পাণ্ডবদের সাথে তাদের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, সেখানে পাণ্ডবদের পক্ষে এক মুহূর্ত নিশ্চিন্তভাবে কাটানো সম্ভব নয়। সর্বদায় আতঙ্কের মাঝে বসবাস করতে হতো তাদের। পাণ্ডবরা কেবল চেয়েছে শান্তি, সৌহার্দ্য ও কৌরব-পাণ্ডব সহাবস্থান। কিন্তু যখন তারা বুঝলো যে, তাদের সহাবস্থান কখনোই সম্ভব নয় এবং এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তাদেরকে সংঘাতের পথ বেছে নিতে হবে তখন তারা রাজমহল ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। সংঘর্ষের পথে না গিয়ে তারা সব ধরনের সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার ব্রত নিল। বারনাবত থেকেই তারা কাউকে না জানিয়ে অরণ্যের পথে যাত্রা করলো। আশা ছিল- সে অরণ্যে কিছু থাকুক আর না থাকুক, সেখানে সংঘর্ষ থাকবে না, অধর্ম থাকবে না, অনিশ্চয়তা থাকবে না; থাকবে না ষড়যন্ত্রের ভয়। কিন্তু সব ধরনের সংঘর্ষকে এড়িয়ে চলার নামই কি ধর্ম? কখনোই নয়, বরং মিথ্যার সাথে সংঘর্ষই হলো সত্যধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। হয়তবা সে কারণেই পাণ্ডবদের পালিয়ে থাকার মনোবাসনা পূর্ণ হয় নি। তারা সংঘর্ষ থেকে খুব বেশিদিন নিজেদের আড়াল করে রাখতে সক্ষম হন নি। খুব শিগগিরই তাদেরকে সেই সংঘর্ষের জীবনে ফিরে যেতে হয়েছে। শুধু ফিরে যেতে হয়েছে তাই নয়, নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তারা হস্তিনাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ইতিহাস আমরা জানি। মানবজাতির ইতিহাসে এই যুদ্ধটি কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না। সে যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহিনী আদম সন্তান জীবন হারিয়েছিল। ঐ যুগের তুলনায় এ সংখ্যা ছিল অতি ভয়ংকর। যে পাণ্ডবরা স্বজনদের সাথে সামান্য পরিমাণ সংঘর্ষ বা রেষারেষি করতেও আগ্রহী ছিলেন না, যার কারণে তারা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বনে গিয়ে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তারাই স্বজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এটাই ধর্ম। ধর্মকে যে ধারণ করবে সে কখনো মিথ্যার সাথে সহাবস্থান করতে পারবে না, আবার মিথ্যা থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারবে না। মিথ্যাকে বধ করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেই তাকে বাঁচতে হবে।
পাণ্ডবরা যখন রাজ্য ছেড়েছে তখন তাদের সামনে বিবেচ্য ছিল নিজেদের সুবিধার-অসুবিধা। তাদের অনুপস্থিতিতে রাজ্যের জনসাধারণের কী পরিণতি হবে তা তখন বিবেচ্য ছিল না। কিন্তু যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে স্বজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে তখন সে সিদ্ধান্ত তাদের ব্যক্তিগত লাভ-লোকশানের খাতিরে ছিল না, ছিল জনসাধারণের শান্তি-অশান্তির ভিত্তিতে। এই লড়াই হয়েছে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের লড়াই। পাণ্ডবরা সংগ্রাম করেছেন রাজধর্মকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধর্মই তাদেরকে বাধ্য করেছে স্বজনদের বিরুদ্ধে লড়তে। কারণ, অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা ধর্মের প্রধান শিক্ষা। যে রাজ্যে অধর্মের জয়জয়কার, যেখানে মানুষ শান্তির আশায় হাহাকার করছে, সেখানে অধর্মকে নস্যাৎ করে ধর্মের বিধান প্রতিষ্ঠা করাই হলো ধর্মের প্রথম দাবি। মানুষের শান্তির বীজ নিহিত রয়েছে ধর্মে। তবে সে ধর্ম ব্যক্তিধর্ম নয়, রাজধর্ম। যে রাজ্যে রাজধর্ম লোপ পায়, সে রাজ্যের জনগণ যদি প্রত্যহ জজ্ঞ-আরাধনাও করে তবুও তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে না। তাই ইতিহাসে দেখি- রাজধর্মকে পুনঃস্থাপনের জন্য পাণ্ডবরা নিজের ভ্রাতা, গুরুজন, পিতামহ, মাতুল, পৌত্রগণ ও শ্যালকগণের সাথে যুদ্ধ করেছেন, তাদের রক্তপাত ঘটিয়েছেন, হত্যা করেছেন। যে ধর্মের রক্ষা করতে তারা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গিয়েছিলেন সেই ধর্মই তাদেরকে যুদ্ধ করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাদের এই যুদ্ধ ছিল ধর্মযুদ্ধ। অধর্মের হাত থেকে আর্তপীড়িত মানুষকে মুক্ত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ঐ ধর্মযুদ্ধের লক্ষ্য।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কখনোই পাণ্ডবদের রাজ্যজয়ের যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল রাজধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এর প্রমাণ আমরা পাই গীতায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুন শত্র“পক্ষের সৈন্যদের অবলকন করে শ্রীকৃষ্ণকে (আ:) বললেন- “হে কৃষ্ণ, আত্মীয়বর্গকে যুদ্ধার্থ উপস্থিত দেখিয়া আমার অঙ্গপ্রত্যাঙ্গাদি অবসন্ন ও মুখ শুষ্ক হইতেছে। আমার শরীর কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হইতেছে। আমার হস্ত হইতে গাণ্ডীব-ধনু খসিয়া পড়িতেছে এবং চর্ম যেন দগ্ধ হইতেছে।” (গীতা, ১: ২৮-২৯)। অর্থাৎ তিনি আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মোটেও স্বজনদের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। এবং তিনি যে রাজ্যের লোভে পড়ে তাদের সামনে অস্ত্র হাতে দাঁড়ান নি তারও প্রমাণ রয়েছে গীতায়। যেখানে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে (আ:) উদ্দেশ্য করে বলছেন- “হে গোবিন্দ, আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন, আর সুখভোগে বা জীবন-ধারণেই কি প্রয়োজন? কারণ, যাঁহাদের নিমিত্ত রাজ্য, ভোগ ও সুখাদি আমাদের অভিলাষিত, সেই আচার্যগণ, পিতৃব্যগণ, পুত্রগণ, পিতামহগণ, মাতুলগণ, শ্বশুরগণ, পৌত্রগণ, শ্যালকগণ ও স্বজনগণই প্রাণ ও ধনাদির আশা পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধে উপস্থিত হইয়াছেন। (গীতা, ১: ৩২-৩৩)
এভাবে বহু যুক্তি দেখিয়ে এক পর্যায়ে অর্জুন যুদ্ধ না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ (আ.) শেষ পর্যন্ত অর্জুনের ভুল ভাঙাতে সক্ষম হন। তিনি অর্জুনকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এই যুদ্ধ রাজ্য জয়ের বা রাজ্য ফিরে পাবার যুদ্ধ নয়, এমনকি নিজের অধিকার রক্ষার যুদ্ধও (যা শাস্ত্রসম্মত) নয়। এটা ধর্মযুদ্ধ, ধর্মের জন্য যুদ্ধ, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ। এক কথায় এটা রাজধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ কেবল পাণ্ডবদের ভাগ্য বিধায়কই নয়, এটা আপামর জনতার ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। জনগণের শান্তি-অশান্তি নির্ভর করছে এই যুদ্ধে। ধর্মযুদ্ধে জয়ী হলে যেমন রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হয়, তেমনি পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও স্বর্গলাভ হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণ (আ.) বলেছেন- “আর স্বধর্ম লক্ষ্য করিয়াও তোমার ভীত হওয়া উচিত নয়। কারণ, ধর্মসঙ্গত যুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নাই। (গীতা, ২: ৩১)। আর যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তাহা হইলে স্বীয় ক্ষত্রিয়ধর্ম ও কীর্তি পরিত্যাগহেতু তুমি পাপভাগী হইবে। (গীতা, ২: ৩৩)। অর্থাৎ স্বজনকে হত্যা করতে হবে বা আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুর কারণ হতে হবে, এই ভয়ে যদি কেউ ধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তাহলে সে পাপী হবে। কারণ, আত্মীয় স্বজনদের হত্যা করার চেয়েও বড় পাপ হলো সাধারণ মানুষকে অধার্মিক রাজার হাতে ছেড়ে দেওয়া। এতে সমগ্র রাজ্যে অশান্তির সৃষ্টি হয়। আর রাজ্যের জনসাধারণকে অশান্তির মধ্যে ছেড়ে ব্যক্তিগতভাবে যতই ধর্ম-কর্ম করা হোক, পূজা-আর্চনা করা হোক, যজ্ঞ-আরাধনা করা হোক না কেন তা কোনো ফল বয়ে আনে না। তা করলে বরং সেটাই হবে সবচেয়ে বড় অধর্ম। সুতরাং মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে, রাজধর্ম না থাকলে ব্যক্তিধর্ম নিরর্থক। যখন রাজধর্ম লোপ পায় তখন সকলের জন্য রাজধর্ম পুনঃস্থাপন করাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় ব্যক্তিধর্ম।
রাজধর্ম সম্পর্কে মহাভারতের শান্তিপর্বে উল্লেখ আছে, যেখানে মহামহীম ভীষ্ম ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে (আ:) উদ্দেশ্য করে বলছেন- “মঙ্গললাভার্থী ব্যক্তিদিগের পক্ষে একজনকে নরপতিপদে অভিষেক করা অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজ্য অরাজক হইলে কেহই নির্ব্বিঘেœ স্ত্রীসম্ভোগ ও ধর্ম্ম-উপভোগ করিতে পারে না। ঐ সময় পাপাত্মারা অন্যের ধন অপহরণ করিয়া মহা আহ্লাদিত হয়, কিন্তু যখন অপরাপর ব্যক্তিরা তাহার ধন হরণ করে, তখন সে রাজার সাহায্য প্রাপ্ত হইতে বাসনা করে; অতএব অরাজকতা পাপাত্মাদিগেরও সুখজনক নহে। ঐ সময় দু’জন পাপাত্মা একত্র হইয়া এক ব্যক্তির এবং অনেক লোক একত্র হইয়া সেই দুইজনের ধন অপহরণ করে। বলবান ব্যক্তি দুর্ব্বলকে আপনার দাস করিয়া রাখে এবং বলপূর্ব্বক পরস্ত্রীহরণে প্রবৃত্ত হয়। হে ধর্ম্মরাজ! ঐ সকল দৌরাত্ম্য নিবারণের নিমিত্তই দেবতারা রাজ্যমধ্যে নরপতির আবশ্যকতা নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছেন। যদি পৃথিবীমধ্যে রাজা দণ্ড ধারণ না করেন, তাহা হইলে সলিলস্থ বৃহৎ মৎস্যেরা যেমন ক্ষুদ্র মৎস্যসমুদয়কে ভক্ষণ করে, সেইরূপ বলবান ব্যক্তিরা দুর্ব্বলদিগকে ভক্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হয়।”
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, যে কোনো দেশের জনসাধারণের শান্তি নিশ্চিত হয় সে দেশের শাসনকর্তার হাত ধরে। শাসকই পারেন সত্যযুগ ফিরিয়ে আনতে। আবার শাসকের ভুলেই জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি ধার্মিক ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলছেন। কিন্তু তাদের জাতীয় জীবন চলছে এমন সব তন্ত্র-মন্ত্র, জীবনব্যবস্থা দ্বারা যেখানে স্রষ্টার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে শাসকের ধর্মবর্জিত শাসনে ধার্মিক জনতার জীবনে নেমে এসেছে অজস্র দুঃখ-কষ্ট, অন্যায়-অবিচার, অনাচার, বৈষম্য, নিপীড়ন, দারিদ্র্য। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে ব্যক্তিধর্মের ক্ষুদ্র গণ্ডিকে অতিক্রম করে রাজধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বুঝতে হবে যে, একমাত্র স্রষ্টার দেওয়া বিধানই মানুষের শান্তি নিশ্চিত করতে পারে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।