আরজ আলী মাতবর
" আরজ আলী মাতবর "
'দারিদ্র নিবন্ধন
কোনো স্কুল-কলেজ
গিয়ে পয়সা দিয়ে বিদ্যা কিনতে পারি নি আমি দেশের
অন্যসব ছাত্র-
ছাত্রীদের মতো। তাই
কোনো স্কুল, কলেজ,
মাদ্রাসা আমার
বিদ্যাপীঠ নয়। আমার
বিদ্যাপীঠ হলো লাইব্রেরি। আশৈশব
আমি লাইব্রেরিকে ভালবেসে এসেছি এবং এখনও
বাসি। লাইব্রেরিই আমার তীর্থস্থান।
আমার মতে মন্দির, মসজিদ,
গির্জা থেকে লাইব্রেরি বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।
তাই আমি যখন কোনোরূপ
একটি জনকল্যাণমূলক কাজ করবার জন্য
মনস্থির করেছি, তখন আমার সেই লাইব্রেরি-
প্রীতিই
জাগিয়ে তুলেছে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার
প্রবণতা। আর তারই ফলশ্রুতি আমার এ
ক্ষুদ্র লাইব্রেরিটি। যেহেতু
আমি লাইব্রেরির কাছে ঋণী।
আমি লাইব্রেরির ভক্ত।'
এই লাইব্রেরী ভক্ত
মানুষটি হলেন 'আরজ মঞ্জিল পাবলিক
লাইব্রেরি'র শ্রষ্ঠা, প্রবীন
দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং মননশীল লেখক
আরজ আলী মাতুব্বর।
তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বশিক্ষিত একজন
মানুষ। তাঁর জন্মস্থান
লামচরি গ্রামে সে সময় ছিল
না কোনো স্কুল। ছিল না আর
কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আরজের বয়স
যখন ১৩ বছর তখন এই গ্রামের আবদুল করিম
মুনশি নামে একজন
বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি তাঁর বাড়িতেই
খুলে বসলেন একটি মক্তব।
ধীরে ধীরে মক্তবে ভর্তি হলো অল্প
কয়েকজন কিশোর। বগলদাবা করে বই-শ্লেট
নিয়ে ওরা হই হুল্লোড়
করে মক্তবে যাওয়া-আসা করত । তাই
দেখে আরজেরও
সেখানে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শিখার বড়
ইচ্ছে হলো। কিন্তু ভর্তি ও বইপত্রের
খরচ যোগাবে কে! আরজ রাস্তার
একপাশে দাঁড়িয়ে উদাস
চোখে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের মক্তবে আসা-
যাওয়া দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আরজের পড়াশোনায় আগ্রহ দেখে এবং এতিম
ছেলে বলে মুনশি সাহেব তাকে তাঁর
মক্তবে ভর্তি করে নিলেন বিনা বেতনে।
মক্তবে ভর্তি হলো কিন্তু তার
তো বইখাতা নেই। কিনে নেবার সামর্থও নেই।
অথচ আর সব ছেলে-
মেয়েরা দিব্যি বইখাতা নিয়ে পড়তে আসে।
মাস্টার সাহেব যখন ক্লাসে পড়ান তখন
ওরা সামনে বই খুলে ধরে পড়ে যায়। আরজ
মনে কষ্ট নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে ।
অগত্যা আর কি করে! তাল ও
কলাপাতা যোগাড় করে রোদের
তাপে শুকিয়ে নেয় সে। ক্লাসে এই
শুকনো পাতায় লেখাজোখা করে। বইয়ের
অভাব আরজকে খুব কষ্ট দিত। মাকে বইয়ের
কথা বলেছে। কিন্ত বই যোগাড় করে দেবার
সামর্থ তো তার মার নেই।
পড়াশোনায় প্রবল উৎসাহী আরজ
সহপাঠীদের বই ধার করে নিয়ে পড়ে। তাতে মন
ভরে না তার। আরজের পড়ালেখার
প্রতি আগ্রহ অনেকের নজরে পড়ে। তাই
একদিন তাঁর এক জ্ঞাতি চাচা দু
আনা দামের সীতারাম বসাক লিখিত
আদর্শলিপি বই কিনে দিলেন।
এটা মক্তবে ভর্তি হবার কয়েক মাস পরের
ঘটনা।
আদর্শলিপি বইখানা হাতে পেয়ে আরজের
সে কি আনন্দ।
কিন্তু মুনশি আবদুল করিমের মক্তবের
অধিকাংশ পড়ুয়াই দরিদ্র কৃষকের
সন্তান। ছেলেদের লেখাপড়া শেখানোর
ইচ্ছে অভিভাবকদের ছিল । কিন্তু
কোনোভাবে বই কিনে দিলেও মক্তবের বেতন
দেয়ার সামর্থ্য তাদের ছিল না।
ছাত্রদের বেতন
অনাদায়ে সৃষ্টি হলো অচলাবস্থা।
ফলে সেই বছরই বন্ধ হয়ে গেল মক্তবটি।
মুনশি আবদুল করিমের মক্তবের পাট
চুকে গেল।
সে সাথে উৎসাহী পড়ুয়া আরজের
পড়াশোনাও গেল বন্ধ হয়ে। সেসময়
লামচরি গ্রামে আর কোনো স্কুল-মক্তব
ছিল না। অন্য গ্রামে একটা ছিল ।
কিন্তু সেখানেও পড়ার জন্য বেতন
প্রয়োজন। আবদুল করিম মুনশির
মক্তবে শেখা স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ,
বানানকলা টুকুই আরজের সম্বল হলো। এর
পরের বাকি জীবনে তার
পড়ালেখা হয়েছে পৃথিবীর পাঠশালায়।
যে পাঠশালায় নেই কোন নির্দিষ্ট গন্ডি।
নেই বই-
খাতা হাতে নিয়ে ঢং ঢং ঘণ্টা বেজে ওঠার
সাথে সাথে ক্লাশে প্রবেশ করা। আরজ
আলী মাতুব্বর ভর্তি হলেন এই পৃথিবীর
পাঠশালায়।
আনুষ্ঠানিক অথবা প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষার অক্ষর জ্ঞানটুকু সম্বল
করে অদম্য স্পৃহায় পুস্তক
পাঠে মনোনিবেশ করলেন আরজ। বিভিন্ন
বিষয়ী বই। জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক
সম্ভ্রান্ত করে এমন যে কোন বই।
পাঠ্যশিক্ষা আরও কিছুটা রপ্ত করার
অভিপ্রায়ে বরিশাল শহরের পরিচিত
ছাত্রদের পুরনো পাঠ্য বইপত্র সংগ্রহ
করে পড়তে থাকে আরজ। এমন বই পাঠের
সূচনায় প্রথমেই নির্বাচন
করে পুঁথি সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের
আদি উপাদান পুঁথি সাহিত্য পাঠের
মধ্যে যে বইগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল
তার মধ্যে ছিল জয়গুন, সোনাভান,
জঙ্গনামা, মোক্তল হোসেন ইত্যাদি।
বরিশাল শহরের পুরনো জীর্ণ
একখানি বাড়িতে শহরের বিদ্যোৎসাহী জনদের
উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাবলিক
লাইব্রেরি। অপ্রশস্ত ঘর।
কয়েকখানা মাত্র বইয়ের আলমারি আর
টেবিল-বেঞ্চ। আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত
প্রবাহ নেই। তার মাঝে একান্ত
জ্ঞানার্জনে বাতিকগ্রস্ত
পাঠকরাই পাঠমগ্ন হয়। আরজ এই
লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলেন।
লামচরি গ্রাম থেকে প্রায় বার
কিলোমিটার পথ
হেঁটে গিয়ে লাইব্রেরিতে বসে সেদিনের
মতো পাঠক্ষুধা মিটিয়ে আবার দিনের
শেষে সমপরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম
করে বাড়ি ফেরেন তিনি।
বরিশাল পৌরবাসী নাগরিকের জন্য
প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরির বই গ্রামীণ
পাঠক পড়ার সুযোগ পেলেও বই ইস্যু
করে বাড়ি নেবার নিয়ম ছিল না। এর
ফলে আরজের প্রাচন্ড ইচ্ছা সত্ত্বেও
লাইব্রেরি থেকে বাড়িতে নিয়ে বই
পড়তে পারেন না। একে ওকে এ
ব্যাপারে সাহায্যের জন্য অনুরোধ
জানান। কেউ তেমন সাড়া দেয় না।
অবশেষে তার পরিচিত একজন
টুপি ব্যবসায়ী ওয়াজেদ
আলী তালুকদার প্রতশ্রুতি দিলেন
তিনি সহায়তা করবেন। তার নামে আরজ
লাইব্রেরি থেকে ইচ্ছেমতো বই
বাড়িতে নিয়ে পড়তে লাগলেন।
পরে লাইব্রেরিয়ান এয়াকুব
আলী মোক্তার সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। অপরিসীম
পাঠস্পৃহা দেখে প্রচলিত নিয়মের
ব্যাত্যয় ঘটিয়ে তিনি আরজকে বই
দিতে থাকেন। এভাবে তিনি আরও অনেক
লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ে তাঁর পাঠ
ক্ষুধা মিটিয়েছেন।
বাংলা ১৩৩০ সাল থেকে আরজ
আলী ব্যক্তিগত পাঠাগার
গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। বন্ধু-স্বজনদের
কাছে চেয়ে নেয়া এবং উপহার
পাওয়া সামান্য কটি বই জমেছিল। এছাড়া,
পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য
কৃষিকাজে যে শ্রম দেয়া দরকার তার
চাইতে অধিক সময় শ্রম দিয়ে যে বাড়তি আয়
হতো সেই অর্থে বই কিনতেন। সামান্য
পরিমাণ অর্থও বাজে ব্যয় না করে শুধুই
বই কিনেছেন। এভাবে আঠারো বছর বই
কিনে সংগ্রহের ফলে বইয়ের
সংখ্যা দাঁড়ায় নয় শ'তে। বই
গুছিয়ে রাখার জন্য আলমারি কেনার
সামর্থ্য না হওয়ায় বৈঠকখানার ঘরের
তাকে সাজিয়ে রাখা ছিল বইগুলো। ১৩৪৮
সালের ১২ জ্যৈষ্ঠ এক ভয়াবহ
বিনাশী ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয় এই
এলাকার ওপর দিয়ে। এই
সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় আরজদের
বৈঠকখানার ঘর এবং সে সাথে বৈঠক
ঘরে রাখা সবগুলো বই উড়িয়ে নিয়ে যায়।
একটি বইও অক্ষত উদ্ধার করতে পারেন
নি পরে। পরদিন পথঘাটে বইয়ের দু চার
খানা ছেঁড়া পাতা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।
মা মারা যাবার পর
মাতৃশোকে কান্না আসে নি আরজের।
কিন্তু এতকালের সংগৃহীত বইগুলোর
শোকে আরজ কেঁদেছিলেন খুব। বইয়ের
শোকে আরজ মর্মাহত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু
দমে যাননি। জীবনের এ এক মর্মান্তিক
বাস্তবতার পরম
অভিজ্ঞতা বলে মনকে প্রবোধ
দিয়ে পুনরায় বই সংগ্রহে ব্রতী হয়েছেন।
এবারও একই প্রক্রিয়া অর্থাৎ
বাড়তি শ্রম, বাড়তি আয় এবং তা থেকে বই
ক্রয়। নিরলস হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন।
এভাবে ১৭ বছর পর তার বইয়ের
সংখ্যা দাঁড়ায় চার শ'। ঠিক এ সময়
পুনরায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
১৭ বছরের ব্যবধানে আরেক
দফা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়।
উড়িয়ে নিয়ে যায় একই বৈঠকখানার ঘর
এবং একইভাবে রাখা সংগৃহীত বইগুলোও।
এই ঘটনা ঘটে ১৩৬৫ সালের ৬ কার্তিক।
শোকে-দুঃখে-ক্ষোভে আরজ এবার
প্রতিজ্ঞা করেন, 'না, আর বই সংগ্রহ
নয়, বই সংগ্রহের আগে বই সংরক্ষণের
জন্যে উপযুক্ত বাড়ি বানানো চাই।'
হ্যাঁ, সেদিনের দুঃখ-
তাপে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,
পরবর্তীকালে তা রক্ষা করেছিলেন
আরজ। দীর্ঘ একুশ বছর কঠোর পরিশ্রম
করে ক্রমে সঞ্চিত অর্থে শুধুমাত্র
বই রাখার জন্যই মজবুত দালান ঘর
বানিয়েছিলেন। ১৩৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত
করেছেন শুধুমাত্র বই সাজানো একটি ঘর-
আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি।
লাইব্রেরির কার্যক্রম
সুষ্ঠুভাবে শৃঙ্খলা মাফিক
পরিচালনার জন্য আরজ আলী মাতুব্বর
কতিপয় নিয়ম-নীতি বেঁধে দেন।
বৃত্তি প্রদানের জন্য গঠিত আরজ
ফান্ড থেকে দেওয়া বৃত্তির নাম
রাখা হয় আরজ বৃত্তি। অজ্ঞানান্ধ,
কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে আলোর
পথে টেনে আনতে আরজ স্থির করলেন
মানুষের মধ্যে জ্ঞানের
আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। পড়াশোনার
মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের
আলোকে মানুষকে যুক্তিবাদী করে তুলতে হবে।
এজন্য তিনি নিজ গ্রামে গড়ে তুললেন এই
লাইব্রেরি।
জ্ঞান পিপাষু ও জ্ঞানের
আলো বিতরণকারী আরজ আলী মাতুব্বর
জন্মগ্রহণ করেন ১৩০৭ সালের ৩ পৌষ।
বরিশাল শহর
থেকে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ১০/১২
কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম
করলে পড়বে এক শান্ত সমাহিত গ্রাম।
গ্রামটির নাম লামচরি। নদীর ঘাট
থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথের
দূরত্বে লামচরি গ্রামের
কেন্দ্রস্থলে একটি দরিদ্র
কৃষিজীবী পরিবারের বাস। 'মাতুব্বর
বাড়ি' বলে পরিচিত। লামচরি গ্রামের এ
বাড়িতেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর
পূর্বপুরুষের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী।
আরজের বাবার নাম এন্তাজ
আলী মাতুব্বর। আরজ
আলী মাতুব্বরের জন্মের ৪ বছর পর
১৩১১ সালে মারা যান তাঁর বাবা।
মৃত্যুর সময় তাঁর উত্তরাধিকারদের
জন্য রেখে যান সামান্য
আবাদি জমি এবং বসত বাড়িটি। জমির পরিমাণ
৫ বিঘা। আর টিনে ছাওয়া বসতের দুটো ঘর।
এসময় উপর্যুপরি কয়েক বছর প্রাকৃতিক
প্রতিকুলতার জন্য ফসল মারা যায়।
আরজ আলীরা ৫ ভাইবোন। ৩ ভাই ২ বোন।
জন্মের কিছুদিন পর এক ভাই কাছেম
আলী মারা যায় ১৩০১ সালে। একই বছর
আরেক ভাই ছোমেদ আলী ৩ বছর
বয়সে মারা যায়। এন্তাজ
আলী মাতুব্বর তার বড় মেয়ে জিগীর
জান বিবিকে বিয়ে দিয়ে যান। এন্তাজ আলীর
মৃত্যুর সময় থাকে দুই ছেলেমেয়ে,
কুলসুম বিবি ও আরজ আলী। আরজ আলীর
মা লালমন্নেছা বিবি স্বামী এবং ক্ষেতের
ফসল
হারিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের।
মা লালমন্নেছার অভাব অনটনের
সংসারে দুই ছেলেমেয়ে বড় হতে থাকে।
১৩২১ সালে আরজ আলীর প্রাতিষ্ঠানিক
পড়ালেখা বন্ধ হলে কিছুকাল ইতস্তত
ঘোরাফেরা করে ১৩২৬ সালে নিয়োজিত হন
পৈতৃক পেশা কৃষিকাজে। কৃষিকাজের
ফাঁকে ফাঁকে আরজ আলী আমিনের কাজ
(জমি জরিপকারী বা ইংরেজিতে ল্যান্ড
সার্ভেয়ার) শিখে ফেলেন। ক্রমে এই কাজের
প্রতি তাঁর আগ্রহ গাঢ় হতে থাকে।
পরবর্তীকালে জমি জরিপের কাজকেই
পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৩৩২
সালে আমিনি পেশা শুরু করেন। এই পেশায়
তাঁর দক্ষতার কথা উত্তরোত্তর
আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে খুব
অল্পকালের মধ্যেই আমিন পেশায় তাঁর
সাফল্য করায়ত্ত হয়। গাণিতিক ও
জ্যামিতিক নিয়মের ওপর অসম্ভব দখল
অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে সূক্ষ্ম
মাপ ও বন্টনে তাঁর বিস্ময়কর
দক্ষতা সুবিদিত। তাঁর
সূক্ষ্মভাবে মাপজোকের কৃতিত্বের
কথা বরিশাল অঞ্চলে মানুষের
মুখে মুখে ফেরে।
আরজ আলী মাতুব্বরের মা জীবনভর
সংগ্রাম করে, গৃহস্থের বাড়িতে শ্রম
দিয়ে, দুঃখে-দৈন্যে মানুষ করেছেন ছেলে-
মেয়েদের। মেয়ে বড় হলে যথাসময়ে বিয়ে দিয়ে,
ছেলে আরজের বিয়ের জন্য বায়না ধরলেন।
কিন্তু ছেলে কথা কানে তোলেন না। তাঁর
অনেক পড়াশোনা করা দরকার। অনেক কাজ
করা বাকি আছে। মানুষের মঙ্গলের জন্য,
সমাজের কল্যাণের জন্য তাঁর কিছু
কাজ করে যেতে হবে। এ দায় কেউ চাপিয়ে দেয়
নি তাঁর ওপর। তিনি নিজেই
তা বর্তে নিয়েছেন। স্বেচ্ছাদায়িত্ব।
কিন্তু স্নেহশীলা মা ছেলের এসব
অজুহাত মানবেন না। অবশেষে তিনি ঠিক
করে ফেললেন ছেলেন বিয়ে। ১৯ অগ্রহায়ণ
১৩২৯ সালে যথারীতি সম্পন্ন হয় বিয়ে। ১৩
বছর বয়স্কা কনের নাম লালমন্নেছা।
এই স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয় ১টি ছেলে ও
৩টি মেয়ে। পরে আরেকবার
পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন আরজ
আলী মাতুব্বর।
পার্শ্ববর্তী গ্রামের আবদুল করিম
মৃধার মেয়ে সুফিয়া খাতুনকে আরজ
বিয়ে করেন ২৯ আষাঢ় ১৩৪০ সালে।
সুফিয়া খাতুনের ঘরে জন্ম নেয়
৬টি ছেলেমেয়ে এর
মধ্যে ৪টি মেয়ে এবং দুটি ছেলে । সব
মিলিয়ে মোট ১০ জন ছেলে-মেয়ের জনক ছিলেন
আরজ আলী মাতুব্বর।
দৈনন্দিন জীবনের সাংসারিক ও সামাজিক
কাজকর্মের পরও লেখালেখিতে নিয়োজিত
থেকেছেন তিনি। জমিজমা চাষাবাদের
ফাঁকে একটুখানি জিরিয়ে নেবার
অবকাশে বই মেলে ধরেছেন। কাগজ-কলম
নিয়ে আঁচড় কেটে গিয়েছেন। সমস্ত দিনের
শেষে সন্ধ্যা নেমে এলে সব কাজের লেনদেন
চুকিয়ে তিনি পুনরায় রত হয়েছেন লেখাপড়ায়।
লেখালেখি সূচনার পর থেকে মৃত্যুর
পূর্ব পর্যন্ত তিনি ১৫
খানি পান্ডুলিপি রচনা করে গেছেন। এর
মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত ৪টি বইয়ের
নাম 'সত্যের সন্ধান', 'অনুমান',
'সৃষ্টি রহস্য' ও 'স্মরণিকা'। মৃত্যুর
কিছুকাল পরে প্রকাশিত হয় আরেকটি বই। এর
নাম 'মুক্তমন'।
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই
বইগুলো ছাড়াও
রয়েছে আরো কয়েকটি পান্ডুলিপি। এগুলোর
নাম হচ্ছে- সীজের ফুল (কবিতা), সরল
ক্ষেত্রফল (গলিত), জীবন
বাণী (আত্মজীবনী), ভিখারীর
আত্মকাহিনী (আত্মজীবনী), কৃষকের
ভাগ্য গ্রহ (প্রবন্ধ), বেদের অবদান
(প্রবন্ধ), পরিচয়, আমার জীবন দর্শন।
এছাড়া, ঘটনাবলী, জন্ম বংশাবলী, বংশ
পরিচয়, অধ্যয়নসার,
ডাইরী ইত্যাদি পান্ডুলিপিও
সংরক্ষিত রয়েছে।
বাংলাদেশ লেখক শিবির মননশীল লেখক-
দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে ১৩৫৮
সালে সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ ও
ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য হুমায়ূন
কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে।
ইংরেজী ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বরিশাল
শাখা বরণীয়
মনীষী হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে ।
এছাড়া, বাংলা একাডেমী আরজ
আলি মাতুব্বরকে আজীবন সদস্যপদ
এবং ১৩৯২ সালের
পয়লা বৈশাখে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
আজীবন মানব কল্যানে নিয়োজিত আরজ
আলী মাতুব্বর মৃত্যু
পরবর্তীকালে তাঁর মৃতদেহটিও
যাতে জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয় সেজন্য
তিনি বরিশাল মেডিকেল কলেজকে তাঁর দেহদান
করে যান। মৃত্যুর পর সমাধিস্থ
করা হলে মানবদেহ ক্রমে ক্ষয় হয়ে একসময়
মাটিতে লীন হয়ে যায়। কিন্তু এই অসাড়
দেহটিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের
পরীক্ষার কাজে লাগতে পারে।
জনকল্যাণে উৎসর্গীত প্রাণ আরজ
আলী তাঁর দেহটি মাটিতে বিলীন হবার
চেয়ে তা মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হবার
বাসনা থেকে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ
করেছিলেন। এটি যে কত বড় মহৎ
একটি দৃষ্টান্ত তা অতি সহজেই অনুমেয়।
এদেশে এমন বিরল উদাহরণ তিনিই প্রথম
সৃষ্টি করেন।
আরজ আলী জীবদ্দশাতেই তাঁর
সমাধি রচনা করে গেছেন। এও এক
ব্যতিক্রমী ঘটনা এই
ব্যতিক্রমী পুরুষের। যেহেতু তাঁর
মৃত শরীর প্রচলিত প্রথামাফিক
মাটিতে শয়ান করার সুযোগ রাখেন নি তাই
জীবৎকালেই এক অশ্রুতপূর্ব
ব্যবস্থা করে গেছেন। স্মৃতিরক্ষার
বাসনা থেকেই আরজ আলী দেহহীন অসনাতন
সমাধি নির্মাণ করেছেন নিজেই নিজের। আর
সমাধি গোচরে চলমান পথিক ক্ষণিকের জন্য
দাঁড়িয়ে হয়তো উচ্চারণ করবে - Here lies
Aroj Ali Matubbar, the Insurrectionist. Who
loved truth and wanted to find truth. Arises
questions to think people on their tradition
beliefs.
৩ পৌষ ১৩৮৬ সাল। প্রবীণ আরজ
আলী মাতুব্বরের ৮০ বছর বয়স পূর্ণ হয়।
এ দিনেই তিনি পূর্ব
পরিকল্পনানুযায়ী তাঁর
স্মৃতি সংরক্ষণার্থে সমাধি নির্মাণ
করেন। নিজ দেহের কয়েকটি অংশ
দ্বারা তিনি এই স্মৃতিধারক
সমাধিস্থল রচনা করেন। শারীরিক
অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে চুল, দাড়ি, নখ ও
কয়েকটি দাঁত। এক অনাড়ম্বর
অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর স্বপ্নের
সাধনার লাইব্রেরি ভবনের সীমানার
মধ্যে উঁচু বেদী আকারে নির্মিত
পাকা সমাধির মধ্যে একটি কাচের
বয়ামে করে এগুলো রাখা হয়। এরপর
থেকে তিনি জীবনের শেষ কটি দিন পরম
প্রশান্তি বোধ করেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বর ১ চৈত্র ১৩৯২
সালে ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল মেডিকেল
হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত
কারণে মৃত্যুবরণ করেন। অবসান হয়
আজন্ম সংগ্রামী লড়াকু সৈনিক, লৌকিক
স্বশিক্ষিত এক দার্শনিক-লেখকের নীরব
অথচ গতি-চঞ্চল উপস্থিতি।
একটি মুক্ত ও নির্মল বিবেকের
অধিকারী ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর।
নিজের চেষ্টা আর নিষ্ঠায় সকল
অন্ধবিশ্বাস আর সংস্কারের
ঊর্ধ্বে যেতে পেরেছিলেন।
প্রতিটি মূল্যবোধকে যুক্তির
কষ্টিপাথরে যাচাই করে গ্রহণ
কিংবা বর্জন করতেন। এর
মধ্যে কোনো ভাবালুতা স্থান পায় নি।
কোনো আপোষকামিতাকে প্রশ্রয় দেন নি তিনি।
আস্তিক্য নিয়ে তাঁর দুর্বলতা ছিল
না, মাথাব্যথাও ছিল না।
তবে নাস্তিকতারও প্রবল প্রমাণ
মেলে না। আচারে বিশ্বাস করতেন
না সে কথা সত্য।
তিনি সর্বাংশে অনুষ্ঠানিকতাকে পরিহার
করেছেন। আবার তাঁর পরিবারের সদস্যদের
আচার পালনে বাধাও দেন নি কখনও।
বস্তুত ইসলামসহ সকল ধর্মের
সাথে সংযুক্ত অবাস্তব চমকপ্রদ
গল্প-কাহিনীকে যুক্তির
মোড়কে নিরীক্ষা করে নাকচ করেছেন। তাঁর
ধারণা হলো-ধর্ম বা ধর্মীয় গ্রন্থ
হলো সনাতন, প্রাচীন সামাজিক আদলের
প্রেক্ষিতে প্রবর্তিত। তাই
সেগুলো সনাতন সামাজের জন্য
কল্যাণকর ব্যবস্থা হয়তো দিতে পেরেছে।
বর্তমান পৃথিবী জ্ঞানে, বিজ্ঞানে,
প্রযুক্তিতে, দর্শনে অনেক এগিয়েছে,
সাধিত হয়েছে সীমাহীন অগ্রগতি। এই
প্রগতির অভিযাত্রায় সমবেত
হতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের
আলোকে বিবেককে উত্তীর্ণ করতে হবে। এই
প্রক্রিয়ায় একজন মানুষ পরিশুদ্ধ ও
প্রগতিশীল জীবনাচরণ গড়ে তুলতে পারে।
তিনি তাঁর এই আদর্শের মাধ্যমে নিজের
জীবনযাপন পরিচালনা করে গেছেন
আমৃত্যু। যা বলেছেন, যা ভেবেছেন,
যা স্থির করেছেন তা শুধু তাত্ত্বিক
ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন নি।
নিজের জীবনে তা পলে পলে প্রতিপালন
করেছেন।
'দারিদ্র নিবন্ধন
কোনো স্কুল-কলেজ
গিয়ে পয়সা দিয়ে বিদ্যা কিনতে পারি নি আমি দেশের
অন্যসব ছাত্র-
ছাত্রীদের মতো। তাই
কোনো স্কুল, কলেজ,
মাদ্রাসা আমার
বিদ্যাপীঠ নয়। আমার
বিদ্যাপীঠ হলো লাইব্রেরি। আশৈশব
আমি লাইব্রেরিকে ভালবেসে এসেছি এবং এখনও
বাসি। লাইব্রেরিই আমার তীর্থস্থান।
আমার মতে মন্দির, মসজিদ,
গির্জা থেকে লাইব্রেরি বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।
তাই আমি যখন কোনোরূপ
একটি জনকল্যাণমূলক কাজ করবার জন্য
মনস্থির করেছি, তখন আমার সেই লাইব্রেরি-
প্রীতিই
জাগিয়ে তুলেছে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার
প্রবণতা। আর তারই ফলশ্রুতি আমার এ
ক্ষুদ্র লাইব্রেরিটি। যেহেতু
আমি লাইব্রেরির কাছে ঋণী।
আমি লাইব্রেরির ভক্ত।'
এই লাইব্রেরী ভক্ত
মানুষটি হলেন 'আরজ মঞ্জিল পাবলিক
লাইব্রেরি'র শ্রষ্ঠা, প্রবীন
দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং মননশীল লেখক
আরজ আলী মাতুব্বর।
তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বশিক্ষিত একজন
মানুষ। তাঁর জন্মস্থান
লামচরি গ্রামে সে সময় ছিল
না কোনো স্কুল। ছিল না আর
কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আরজের বয়স
যখন ১৩ বছর তখন এই গ্রামের আবদুল করিম
মুনশি নামে একজন
বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি তাঁর বাড়িতেই
খুলে বসলেন একটি মক্তব।
ধীরে ধীরে মক্তবে ভর্তি হলো অল্প
কয়েকজন কিশোর। বগলদাবা করে বই-শ্লেট
নিয়ে ওরা হই হুল্লোড়
করে মক্তবে যাওয়া-আসা করত । তাই
দেখে আরজেরও
সেখানে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শিখার বড়
ইচ্ছে হলো। কিন্তু ভর্তি ও বইপত্রের
খরচ যোগাবে কে! আরজ রাস্তার
একপাশে দাঁড়িয়ে উদাস
চোখে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের মক্তবে আসা-
যাওয়া দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আরজের পড়াশোনায় আগ্রহ দেখে এবং এতিম
ছেলে বলে মুনশি সাহেব তাকে তাঁর
মক্তবে ভর্তি করে নিলেন বিনা বেতনে।
মক্তবে ভর্তি হলো কিন্তু তার
তো বইখাতা নেই। কিনে নেবার সামর্থও নেই।
অথচ আর সব ছেলে-
মেয়েরা দিব্যি বইখাতা নিয়ে পড়তে আসে।
মাস্টার সাহেব যখন ক্লাসে পড়ান তখন
ওরা সামনে বই খুলে ধরে পড়ে যায়। আরজ
মনে কষ্ট নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে ।
অগত্যা আর কি করে! তাল ও
কলাপাতা যোগাড় করে রোদের
তাপে শুকিয়ে নেয় সে। ক্লাসে এই
শুকনো পাতায় লেখাজোখা করে। বইয়ের
অভাব আরজকে খুব কষ্ট দিত। মাকে বইয়ের
কথা বলেছে। কিন্ত বই যোগাড় করে দেবার
সামর্থ তো তার মার নেই।
পড়াশোনায় প্রবল উৎসাহী আরজ
সহপাঠীদের বই ধার করে নিয়ে পড়ে। তাতে মন
ভরে না তার। আরজের পড়ালেখার
প্রতি আগ্রহ অনেকের নজরে পড়ে। তাই
একদিন তাঁর এক জ্ঞাতি চাচা দু
আনা দামের সীতারাম বসাক লিখিত
আদর্শলিপি বই কিনে দিলেন।
এটা মক্তবে ভর্তি হবার কয়েক মাস পরের
ঘটনা।
আদর্শলিপি বইখানা হাতে পেয়ে আরজের
সে কি আনন্দ।
কিন্তু মুনশি আবদুল করিমের মক্তবের
অধিকাংশ পড়ুয়াই দরিদ্র কৃষকের
সন্তান। ছেলেদের লেখাপড়া শেখানোর
ইচ্ছে অভিভাবকদের ছিল । কিন্তু
কোনোভাবে বই কিনে দিলেও মক্তবের বেতন
দেয়ার সামর্থ্য তাদের ছিল না।
ছাত্রদের বেতন
অনাদায়ে সৃষ্টি হলো অচলাবস্থা।
ফলে সেই বছরই বন্ধ হয়ে গেল মক্তবটি।
মুনশি আবদুল করিমের মক্তবের পাট
চুকে গেল।
সে সাথে উৎসাহী পড়ুয়া আরজের
পড়াশোনাও গেল বন্ধ হয়ে। সেসময়
লামচরি গ্রামে আর কোনো স্কুল-মক্তব
ছিল না। অন্য গ্রামে একটা ছিল ।
কিন্তু সেখানেও পড়ার জন্য বেতন
প্রয়োজন। আবদুল করিম মুনশির
মক্তবে শেখা স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ,
বানানকলা টুকুই আরজের সম্বল হলো। এর
পরের বাকি জীবনে তার
পড়ালেখা হয়েছে পৃথিবীর পাঠশালায়।
যে পাঠশালায় নেই কোন নির্দিষ্ট গন্ডি।
নেই বই-
খাতা হাতে নিয়ে ঢং ঢং ঘণ্টা বেজে ওঠার
সাথে সাথে ক্লাশে প্রবেশ করা। আরজ
আলী মাতুব্বর ভর্তি হলেন এই পৃথিবীর
পাঠশালায়।
আনুষ্ঠানিক অথবা প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষার অক্ষর জ্ঞানটুকু সম্বল
করে অদম্য স্পৃহায় পুস্তক
পাঠে মনোনিবেশ করলেন আরজ। বিভিন্ন
বিষয়ী বই। জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক
সম্ভ্রান্ত করে এমন যে কোন বই।
পাঠ্যশিক্ষা আরও কিছুটা রপ্ত করার
অভিপ্রায়ে বরিশাল শহরের পরিচিত
ছাত্রদের পুরনো পাঠ্য বইপত্র সংগ্রহ
করে পড়তে থাকে আরজ। এমন বই পাঠের
সূচনায় প্রথমেই নির্বাচন
করে পুঁথি সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের
আদি উপাদান পুঁথি সাহিত্য পাঠের
মধ্যে যে বইগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল
তার মধ্যে ছিল জয়গুন, সোনাভান,
জঙ্গনামা, মোক্তল হোসেন ইত্যাদি।
বরিশাল শহরের পুরনো জীর্ণ
একখানি বাড়িতে শহরের বিদ্যোৎসাহী জনদের
উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাবলিক
লাইব্রেরি। অপ্রশস্ত ঘর।
কয়েকখানা মাত্র বইয়ের আলমারি আর
টেবিল-বেঞ্চ। আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত
প্রবাহ নেই। তার মাঝে একান্ত
জ্ঞানার্জনে বাতিকগ্রস্ত
পাঠকরাই পাঠমগ্ন হয়। আরজ এই
লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলেন।
লামচরি গ্রাম থেকে প্রায় বার
কিলোমিটার পথ
হেঁটে গিয়ে লাইব্রেরিতে বসে সেদিনের
মতো পাঠক্ষুধা মিটিয়ে আবার দিনের
শেষে সমপরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম
করে বাড়ি ফেরেন তিনি।
বরিশাল পৌরবাসী নাগরিকের জন্য
প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরির বই গ্রামীণ
পাঠক পড়ার সুযোগ পেলেও বই ইস্যু
করে বাড়ি নেবার নিয়ম ছিল না। এর
ফলে আরজের প্রাচন্ড ইচ্ছা সত্ত্বেও
লাইব্রেরি থেকে বাড়িতে নিয়ে বই
পড়তে পারেন না। একে ওকে এ
ব্যাপারে সাহায্যের জন্য অনুরোধ
জানান। কেউ তেমন সাড়া দেয় না।
অবশেষে তার পরিচিত একজন
টুপি ব্যবসায়ী ওয়াজেদ
আলী তালুকদার প্রতশ্রুতি দিলেন
তিনি সহায়তা করবেন। তার নামে আরজ
লাইব্রেরি থেকে ইচ্ছেমতো বই
বাড়িতে নিয়ে পড়তে লাগলেন।
পরে লাইব্রেরিয়ান এয়াকুব
আলী মোক্তার সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। অপরিসীম
পাঠস্পৃহা দেখে প্রচলিত নিয়মের
ব্যাত্যয় ঘটিয়ে তিনি আরজকে বই
দিতে থাকেন। এভাবে তিনি আরও অনেক
লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ে তাঁর পাঠ
ক্ষুধা মিটিয়েছেন।
বাংলা ১৩৩০ সাল থেকে আরজ
আলী ব্যক্তিগত পাঠাগার
গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। বন্ধু-স্বজনদের
কাছে চেয়ে নেয়া এবং উপহার
পাওয়া সামান্য কটি বই জমেছিল। এছাড়া,
পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য
কৃষিকাজে যে শ্রম দেয়া দরকার তার
চাইতে অধিক সময় শ্রম দিয়ে যে বাড়তি আয়
হতো সেই অর্থে বই কিনতেন। সামান্য
পরিমাণ অর্থও বাজে ব্যয় না করে শুধুই
বই কিনেছেন। এভাবে আঠারো বছর বই
কিনে সংগ্রহের ফলে বইয়ের
সংখ্যা দাঁড়ায় নয় শ'তে। বই
গুছিয়ে রাখার জন্য আলমারি কেনার
সামর্থ্য না হওয়ায় বৈঠকখানার ঘরের
তাকে সাজিয়ে রাখা ছিল বইগুলো। ১৩৪৮
সালের ১২ জ্যৈষ্ঠ এক ভয়াবহ
বিনাশী ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয় এই
এলাকার ওপর দিয়ে। এই
সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় আরজদের
বৈঠকখানার ঘর এবং সে সাথে বৈঠক
ঘরে রাখা সবগুলো বই উড়িয়ে নিয়ে যায়।
একটি বইও অক্ষত উদ্ধার করতে পারেন
নি পরে। পরদিন পথঘাটে বইয়ের দু চার
খানা ছেঁড়া পাতা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।
মা মারা যাবার পর
মাতৃশোকে কান্না আসে নি আরজের।
কিন্তু এতকালের সংগৃহীত বইগুলোর
শোকে আরজ কেঁদেছিলেন খুব। বইয়ের
শোকে আরজ মর্মাহত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু
দমে যাননি। জীবনের এ এক মর্মান্তিক
বাস্তবতার পরম
অভিজ্ঞতা বলে মনকে প্রবোধ
দিয়ে পুনরায় বই সংগ্রহে ব্রতী হয়েছেন।
এবারও একই প্রক্রিয়া অর্থাৎ
বাড়তি শ্রম, বাড়তি আয় এবং তা থেকে বই
ক্রয়। নিরলস হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন।
এভাবে ১৭ বছর পর তার বইয়ের
সংখ্যা দাঁড়ায় চার শ'। ঠিক এ সময়
পুনরায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
১৭ বছরের ব্যবধানে আরেক
দফা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়।
উড়িয়ে নিয়ে যায় একই বৈঠকখানার ঘর
এবং একইভাবে রাখা সংগৃহীত বইগুলোও।
এই ঘটনা ঘটে ১৩৬৫ সালের ৬ কার্তিক।
শোকে-দুঃখে-ক্ষোভে আরজ এবার
প্রতিজ্ঞা করেন, 'না, আর বই সংগ্রহ
নয়, বই সংগ্রহের আগে বই সংরক্ষণের
জন্যে উপযুক্ত বাড়ি বানানো চাই।'
হ্যাঁ, সেদিনের দুঃখ-
তাপে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,
পরবর্তীকালে তা রক্ষা করেছিলেন
আরজ। দীর্ঘ একুশ বছর কঠোর পরিশ্রম
করে ক্রমে সঞ্চিত অর্থে শুধুমাত্র
বই রাখার জন্যই মজবুত দালান ঘর
বানিয়েছিলেন। ১৩৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত
করেছেন শুধুমাত্র বই সাজানো একটি ঘর-
আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি।
লাইব্রেরির কার্যক্রম
সুষ্ঠুভাবে শৃঙ্খলা মাফিক
পরিচালনার জন্য আরজ আলী মাতুব্বর
কতিপয় নিয়ম-নীতি বেঁধে দেন।
বৃত্তি প্রদানের জন্য গঠিত আরজ
ফান্ড থেকে দেওয়া বৃত্তির নাম
রাখা হয় আরজ বৃত্তি। অজ্ঞানান্ধ,
কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে আলোর
পথে টেনে আনতে আরজ স্থির করলেন
মানুষের মধ্যে জ্ঞানের
আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। পড়াশোনার
মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের
আলোকে মানুষকে যুক্তিবাদী করে তুলতে হবে।
এজন্য তিনি নিজ গ্রামে গড়ে তুললেন এই
লাইব্রেরি।
জ্ঞান পিপাষু ও জ্ঞানের
আলো বিতরণকারী আরজ আলী মাতুব্বর
জন্মগ্রহণ করেন ১৩০৭ সালের ৩ পৌষ।
বরিশাল শহর
থেকে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ১০/১২
কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম
করলে পড়বে এক শান্ত সমাহিত গ্রাম।
গ্রামটির নাম লামচরি। নদীর ঘাট
থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথের
দূরত্বে লামচরি গ্রামের
কেন্দ্রস্থলে একটি দরিদ্র
কৃষিজীবী পরিবারের বাস। 'মাতুব্বর
বাড়ি' বলে পরিচিত। লামচরি গ্রামের এ
বাড়িতেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর
পূর্বপুরুষের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী।
আরজের বাবার নাম এন্তাজ
আলী মাতুব্বর। আরজ
আলী মাতুব্বরের জন্মের ৪ বছর পর
১৩১১ সালে মারা যান তাঁর বাবা।
মৃত্যুর সময় তাঁর উত্তরাধিকারদের
জন্য রেখে যান সামান্য
আবাদি জমি এবং বসত বাড়িটি। জমির পরিমাণ
৫ বিঘা। আর টিনে ছাওয়া বসতের দুটো ঘর।
এসময় উপর্যুপরি কয়েক বছর প্রাকৃতিক
প্রতিকুলতার জন্য ফসল মারা যায়।
আরজ আলীরা ৫ ভাইবোন। ৩ ভাই ২ বোন।
জন্মের কিছুদিন পর এক ভাই কাছেম
আলী মারা যায় ১৩০১ সালে। একই বছর
আরেক ভাই ছোমেদ আলী ৩ বছর
বয়সে মারা যায়। এন্তাজ
আলী মাতুব্বর তার বড় মেয়ে জিগীর
জান বিবিকে বিয়ে দিয়ে যান। এন্তাজ আলীর
মৃত্যুর সময় থাকে দুই ছেলেমেয়ে,
কুলসুম বিবি ও আরজ আলী। আরজ আলীর
মা লালমন্নেছা বিবি স্বামী এবং ক্ষেতের
ফসল
হারিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাদের।
মা লালমন্নেছার অভাব অনটনের
সংসারে দুই ছেলেমেয়ে বড় হতে থাকে।
১৩২১ সালে আরজ আলীর প্রাতিষ্ঠানিক
পড়ালেখা বন্ধ হলে কিছুকাল ইতস্তত
ঘোরাফেরা করে ১৩২৬ সালে নিয়োজিত হন
পৈতৃক পেশা কৃষিকাজে। কৃষিকাজের
ফাঁকে ফাঁকে আরজ আলী আমিনের কাজ
(জমি জরিপকারী বা ইংরেজিতে ল্যান্ড
সার্ভেয়ার) শিখে ফেলেন। ক্রমে এই কাজের
প্রতি তাঁর আগ্রহ গাঢ় হতে থাকে।
পরবর্তীকালে জমি জরিপের কাজকেই
পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৩৩২
সালে আমিনি পেশা শুরু করেন। এই পেশায়
তাঁর দক্ষতার কথা উত্তরোত্তর
আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে খুব
অল্পকালের মধ্যেই আমিন পেশায় তাঁর
সাফল্য করায়ত্ত হয়। গাণিতিক ও
জ্যামিতিক নিয়মের ওপর অসম্ভব দখল
অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে সূক্ষ্ম
মাপ ও বন্টনে তাঁর বিস্ময়কর
দক্ষতা সুবিদিত। তাঁর
সূক্ষ্মভাবে মাপজোকের কৃতিত্বের
কথা বরিশাল অঞ্চলে মানুষের
মুখে মুখে ফেরে।
আরজ আলী মাতুব্বরের মা জীবনভর
সংগ্রাম করে, গৃহস্থের বাড়িতে শ্রম
দিয়ে, দুঃখে-দৈন্যে মানুষ করেছেন ছেলে-
মেয়েদের। মেয়ে বড় হলে যথাসময়ে বিয়ে দিয়ে,
ছেলে আরজের বিয়ের জন্য বায়না ধরলেন।
কিন্তু ছেলে কথা কানে তোলেন না। তাঁর
অনেক পড়াশোনা করা দরকার। অনেক কাজ
করা বাকি আছে। মানুষের মঙ্গলের জন্য,
সমাজের কল্যাণের জন্য তাঁর কিছু
কাজ করে যেতে হবে। এ দায় কেউ চাপিয়ে দেয়
নি তাঁর ওপর। তিনি নিজেই
তা বর্তে নিয়েছেন। স্বেচ্ছাদায়িত্ব।
কিন্তু স্নেহশীলা মা ছেলের এসব
অজুহাত মানবেন না। অবশেষে তিনি ঠিক
করে ফেললেন ছেলেন বিয়ে। ১৯ অগ্রহায়ণ
১৩২৯ সালে যথারীতি সম্পন্ন হয় বিয়ে। ১৩
বছর বয়স্কা কনের নাম লালমন্নেছা।
এই স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয় ১টি ছেলে ও
৩টি মেয়ে। পরে আরেকবার
পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন আরজ
আলী মাতুব্বর।
পার্শ্ববর্তী গ্রামের আবদুল করিম
মৃধার মেয়ে সুফিয়া খাতুনকে আরজ
বিয়ে করেন ২৯ আষাঢ় ১৩৪০ সালে।
সুফিয়া খাতুনের ঘরে জন্ম নেয়
৬টি ছেলেমেয়ে এর
মধ্যে ৪টি মেয়ে এবং দুটি ছেলে । সব
মিলিয়ে মোট ১০ জন ছেলে-মেয়ের জনক ছিলেন
আরজ আলী মাতুব্বর।
দৈনন্দিন জীবনের সাংসারিক ও সামাজিক
কাজকর্মের পরও লেখালেখিতে নিয়োজিত
থেকেছেন তিনি। জমিজমা চাষাবাদের
ফাঁকে একটুখানি জিরিয়ে নেবার
অবকাশে বই মেলে ধরেছেন। কাগজ-কলম
নিয়ে আঁচড় কেটে গিয়েছেন। সমস্ত দিনের
শেষে সন্ধ্যা নেমে এলে সব কাজের লেনদেন
চুকিয়ে তিনি পুনরায় রত হয়েছেন লেখাপড়ায়।
লেখালেখি সূচনার পর থেকে মৃত্যুর
পূর্ব পর্যন্ত তিনি ১৫
খানি পান্ডুলিপি রচনা করে গেছেন। এর
মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত ৪টি বইয়ের
নাম 'সত্যের সন্ধান', 'অনুমান',
'সৃষ্টি রহস্য' ও 'স্মরণিকা'। মৃত্যুর
কিছুকাল পরে প্রকাশিত হয় আরেকটি বই। এর
নাম 'মুক্তমন'।
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই
বইগুলো ছাড়াও
রয়েছে আরো কয়েকটি পান্ডুলিপি। এগুলোর
নাম হচ্ছে- সীজের ফুল (কবিতা), সরল
ক্ষেত্রফল (গলিত), জীবন
বাণী (আত্মজীবনী), ভিখারীর
আত্মকাহিনী (আত্মজীবনী), কৃষকের
ভাগ্য গ্রহ (প্রবন্ধ), বেদের অবদান
(প্রবন্ধ), পরিচয়, আমার জীবন দর্শন।
এছাড়া, ঘটনাবলী, জন্ম বংশাবলী, বংশ
পরিচয়, অধ্যয়নসার,
ডাইরী ইত্যাদি পান্ডুলিপিও
সংরক্ষিত রয়েছে।
বাংলাদেশ লেখক শিবির মননশীল লেখক-
দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে ১৩৫৮
সালে সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ ও
ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য হুমায়ূন
কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে।
ইংরেজী ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বরিশাল
শাখা বরণীয়
মনীষী হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে ।
এছাড়া, বাংলা একাডেমী আরজ
আলি মাতুব্বরকে আজীবন সদস্যপদ
এবং ১৩৯২ সালের
পয়লা বৈশাখে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
আজীবন মানব কল্যানে নিয়োজিত আরজ
আলী মাতুব্বর মৃত্যু
পরবর্তীকালে তাঁর মৃতদেহটিও
যাতে জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয় সেজন্য
তিনি বরিশাল মেডিকেল কলেজকে তাঁর দেহদান
করে যান। মৃত্যুর পর সমাধিস্থ
করা হলে মানবদেহ ক্রমে ক্ষয় হয়ে একসময়
মাটিতে লীন হয়ে যায়। কিন্তু এই অসাড়
দেহটিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের
পরীক্ষার কাজে লাগতে পারে।
জনকল্যাণে উৎসর্গীত প্রাণ আরজ
আলী তাঁর দেহটি মাটিতে বিলীন হবার
চেয়ে তা মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হবার
বাসনা থেকে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ
করেছিলেন। এটি যে কত বড় মহৎ
একটি দৃষ্টান্ত তা অতি সহজেই অনুমেয়।
এদেশে এমন বিরল উদাহরণ তিনিই প্রথম
সৃষ্টি করেন।
আরজ আলী জীবদ্দশাতেই তাঁর
সমাধি রচনা করে গেছেন। এও এক
ব্যতিক্রমী ঘটনা এই
ব্যতিক্রমী পুরুষের। যেহেতু তাঁর
মৃত শরীর প্রচলিত প্রথামাফিক
মাটিতে শয়ান করার সুযোগ রাখেন নি তাই
জীবৎকালেই এক অশ্রুতপূর্ব
ব্যবস্থা করে গেছেন। স্মৃতিরক্ষার
বাসনা থেকেই আরজ আলী দেহহীন অসনাতন
সমাধি নির্মাণ করেছেন নিজেই নিজের। আর
সমাধি গোচরে চলমান পথিক ক্ষণিকের জন্য
দাঁড়িয়ে হয়তো উচ্চারণ করবে - Here lies
Aroj Ali Matubbar, the Insurrectionist. Who
loved truth and wanted to find truth. Arises
questions to think people on their tradition
beliefs.
৩ পৌষ ১৩৮৬ সাল। প্রবীণ আরজ
আলী মাতুব্বরের ৮০ বছর বয়স পূর্ণ হয়।
এ দিনেই তিনি পূর্ব
পরিকল্পনানুযায়ী তাঁর
স্মৃতি সংরক্ষণার্থে সমাধি নির্মাণ
করেন। নিজ দেহের কয়েকটি অংশ
দ্বারা তিনি এই স্মৃতিধারক
সমাধিস্থল রচনা করেন। শারীরিক
অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে চুল, দাড়ি, নখ ও
কয়েকটি দাঁত। এক অনাড়ম্বর
অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর স্বপ্নের
সাধনার লাইব্রেরি ভবনের সীমানার
মধ্যে উঁচু বেদী আকারে নির্মিত
পাকা সমাধির মধ্যে একটি কাচের
বয়ামে করে এগুলো রাখা হয়। এরপর
থেকে তিনি জীবনের শেষ কটি দিন পরম
প্রশান্তি বোধ করেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বর ১ চৈত্র ১৩৯২
সালে ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল মেডিকেল
হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত
কারণে মৃত্যুবরণ করেন। অবসান হয়
আজন্ম সংগ্রামী লড়াকু সৈনিক, লৌকিক
স্বশিক্ষিত এক দার্শনিক-লেখকের নীরব
অথচ গতি-চঞ্চল উপস্থিতি।
একটি মুক্ত ও নির্মল বিবেকের
অধিকারী ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর।
নিজের চেষ্টা আর নিষ্ঠায় সকল
অন্ধবিশ্বাস আর সংস্কারের
ঊর্ধ্বে যেতে পেরেছিলেন।
প্রতিটি মূল্যবোধকে যুক্তির
কষ্টিপাথরে যাচাই করে গ্রহণ
কিংবা বর্জন করতেন। এর
মধ্যে কোনো ভাবালুতা স্থান পায় নি।
কোনো আপোষকামিতাকে প্রশ্রয় দেন নি তিনি।
আস্তিক্য নিয়ে তাঁর দুর্বলতা ছিল
না, মাথাব্যথাও ছিল না।
তবে নাস্তিকতারও প্রবল প্রমাণ
মেলে না। আচারে বিশ্বাস করতেন
না সে কথা সত্য।
তিনি সর্বাংশে অনুষ্ঠানিকতাকে পরিহার
করেছেন। আবার তাঁর পরিবারের সদস্যদের
আচার পালনে বাধাও দেন নি কখনও।
বস্তুত ইসলামসহ সকল ধর্মের
সাথে সংযুক্ত অবাস্তব চমকপ্রদ
গল্প-কাহিনীকে যুক্তির
মোড়কে নিরীক্ষা করে নাকচ করেছেন। তাঁর
ধারণা হলো-ধর্ম বা ধর্মীয় গ্রন্থ
হলো সনাতন, প্রাচীন সামাজিক আদলের
প্রেক্ষিতে প্রবর্তিত। তাই
সেগুলো সনাতন সামাজের জন্য
কল্যাণকর ব্যবস্থা হয়তো দিতে পেরেছে।
বর্তমান পৃথিবী জ্ঞানে, বিজ্ঞানে,
প্রযুক্তিতে, দর্শনে অনেক এগিয়েছে,
সাধিত হয়েছে সীমাহীন অগ্রগতি। এই
প্রগতির অভিযাত্রায় সমবেত
হতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের
আলোকে বিবেককে উত্তীর্ণ করতে হবে। এই
প্রক্রিয়ায় একজন মানুষ পরিশুদ্ধ ও
প্রগতিশীল জীবনাচরণ গড়ে তুলতে পারে।
তিনি তাঁর এই আদর্শের মাধ্যমে নিজের
জীবনযাপন পরিচালনা করে গেছেন
আমৃত্যু। যা বলেছেন, যা ভেবেছেন,
যা স্থির করেছেন তা শুধু তাত্ত্বিক
ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন নি।
নিজের জীবনে তা পলে পলে প্রতিপালন
করেছেন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোস্তাফিজুর রহমান ২৩/০৩/২০১৪আমার মতে যে এখন ও আরজ আলি মাতুব্বর পড়েনি তার সাথে তর্ক করা আর পাগলের সাথে তর্ক করা একই কথা
-
মোস্তাফিজুর রহমান ২৩/০৩/২০১৪আমার মতে যে এখন ও আরজ আলি মাতুব্বর পড়েনি তার সাথে তর্ক করা আর পাগলের সাথে তর্ক করা একই কথা
-
মোস্তাফিজুর রহমান ২৩/০৩/২০১৪আমার মতে যে এখন ও আরজ আলি মাতুব্বর পড়েনি তার সাথে তর্ক করা আর পাগলের সাথে তর্ক করা একই কথা