এক বৈশাখে দুজনের দেখা
“অরণী!!! আর কতক্ষণ লাগাবি তুই? আজ
কি আদৌ বের হতে পারবো??” “আর
পাঁচ মিনিট, নিশাপু!!” উত্তর
দিয়ে আয়নায়
একটা ভেংচি কাটলো অরণী।
নিশাপুটা যে কি অদ্ভুত!! সব সময়
তাড়াহুড়া! পহেলা বৈশাখে মানুষ
সাজবে নাতো কবে সাজবে? আর
শাড়ি পড়ে সাজ শেষ করতে মানুষের
একটু দেরীতো হবেই। নিশাপু সকাল
থেকে তাড়া দিয়েই যাচ্ছে। শুধু উৎসব
দেখেই অরণী সহ্য করছে! নিশাপুর
তাড়া খেয়ে, মার কাছে বিচার
দেয়ার পালা শেষ করে শেষমেশ
সাজ শেষ করে ১০ টায় দুই কাজিন
নিশা আর অদ্রিকে নিয়ে বের
হলো অরণী। লাল শাড়ি, লাল টিপ,
লাল চুড়ি আর সনাতন
বাঙালি সাজে অরণী তার
স্বভাবজাত উচ্ছলতায় মুগ্ধ। দুই বোনের
সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছে সে।
শুনছে কম, বলছে বেশী। অবশ্য
অরণী সবসময়ই এরকম। বাচাল
বলে কিঞ্চিৎ দুর্নাম আছে তার।
কাছের মানুষরা অবশ্য এজন্যই
বেশী ভালবাসে তাকে।
অরণী বরাবরি প্রাণোচ্ছল, দুরন্ত।
উৎসবের দিনগুলো আবীরের কখনোই
ভালো লাগেনা। বড্ড বেশী ভিড় আর
হইচই। আবীরের মত ঘরকুনো মানুষের
কাছে তা যেন এক বিপত্তি।
আবীরের
ভালো লাগে ঘরে বসে গান শুনতে,
মাঝেসাঝে টুকটাক লেখালেখিও
করে বসে অবশ্য। অবশ্য অন্য সব দিন কোন
বাহানা বানাতে পারলেও আজ
বন্ধুদের এড়াতে পারেনি সে। কোন
মতেই তাদের
বোঝাতে না পেরে প্রতিবাদ
করতেই যেন
সে কালো পাঞ্জাবী পড়ে বের
হয়েছে। এখন আফসোসের বাকি নেই।
একেতো প্রচণ্ড গরম লাগছে, তার উপর
চারপাশের রংবেরঙের মানুষের
মাঝে নিজেকে একটা এলিয়েন
মনে হচ্ছে!! বিরক্তিতে নিচের
দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল আবীর।
হঠাৎই প্রচণ্ড এক
ধাক্কা খেয়ে চিতপটাং হতে গিয়ে সামলে নিলো।
অপর ব্যক্তিকে প্রচণ্ড এক ধমক দেয়ার
চিন্তা করে তাকিয়ে দেখলো টুকটুকে লাল
শাড়ি পড়া টুকটুকে লাল এক পুতুল!
আবীরের কি যেন হলো! কেমন যেন
শ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো,
কথা আটকে আসলো। চোখও
সরাতে পারছিলো না!
পুতুলটা কি তবে জাদু করলো তাকে???
অরণী যে কখন অদ্রির সাথে তর্ক
করতে করতে ধাক্কা খেয়ে বসলো,
নিজেই বুঝতে পারেনি।
ধাক্কা লাগার পরই বুঝতে পারলো।
কিন্তু আজিব তো! ছেলেটা এমন
ড্যাবড্যাব
করে তাকিয়ে আছে কেনো?
অরণী বলল, “সরি সরি!
ব্যথা পেয়েছেন??
দেখতে পারিনি আমি! আর
শাড়ি পড়ে হাঁটছিলাম তো!
ব্যালাল্ন্স রাখতে পারিনি।“
অরণী হয়তো আরো অনেক কিছু বলতো,
কিন্তু নিশা আর
অদ্রি ওকে টেনে নিয়ে গেলো।
আবীর শুধু চেয়েই রইলো।
ধাক্কা নিয়ে নিশাপুর সাথে তর্ক
শেষে সোহরাওয়ারদী উদ্যানে নাগরদোলা চরতে এসেছে অরণীরা।
তার খুবই পছন্দ নাগরদোলা। কিন্তু
একা বসতে ও ভয় পায়। অদ্রিকে তাই
অরণী বললো, “এদিকে আয়, আমার
পাশে বস।“ অদ্রি সাথে সাথে ধনুক
বাঁকা হয়ে বললো, “না!!
আমি নিশাপুর সাথে বসবো। তুমি ভয়
পেয়ে আমাকে খামচি দিবা!”
অরণী তর্ক করতে গেলে নিশা বললো,
“ঠিকই তো বলেছে ও। তুই সবসময়
খামচে ধরিস। তোর
পাশে বসা যাবেনা।“ অরণী আর কিছু
না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।
কেউ দেখেনি, কিন্তু তার
চোখে পানি টলমল করছিলো।
বন্ধুরা বলে, আবীরের
মাঝে রোমান্টিক ব্যাপারস্যাপার
একটু কমই আছে। তার বন্ধুরা যখন
প্রেমিকার হাত ধরে প্রেমের
কথা বলে, তখন সে ভ্রু
কুঁচকে গোমড়া মুখে সিগারেটে টান
দেয়। কিন্তু কেউ আসলে জানেনা,
আবীরের মনে আসলে কি আছে।
আবীরের মনের সব কথা, সব
অনুভূতিগুলো তার লেখায় প্রকাশ পায়।
তাই দুই বন্ধু যখন তাদের
প্রেমিকাকে নিয়ে নাগরদোলায়
চরতে এলো, তখন আবীর
দূরে দাড়িয়ে সিগারেট
টানছিলো আর সেই
মেয়েটিকে খুঁজছিলো। পুতুল পুতুল সেই
মেয়েটি যে কোথায় গেলো?? নামও
জানা হলোনা তার! আচ্ছা,
কখনোতো কাউকে দেখে এরকম হয়নি!
কখনো কোন
মেয়েকে দেখে বলতে ইচ্ছে করেনি,
“তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার
সর্বনাশ” কখনো কোন মেয়ের
হাতটি ধরতে ইচ্ছে করেনি,
কখনো কাউকে দেখে “Background
Music” বাজেনি! তাহলে হঠাৎ
কি হলো আজ? আবীরের
বন্ধুরা প্রেমিকাদের
নিয়ে অলরেডি নাগরদোলায়
উঠে গেছে। আবীরের এক বন্ধু বললো,
“আরে,
ঐযে ডানদিকে একটা খালি আছে!
উঠে যা দোস্ত! শুধু শুধু
দাড়িয়ে থাকবি কেনো?” আবীর
সেদিকে তাকাতেই বুকের ভেতর
ধাক্কা খেলো যেন! আরে!!
এটাতো সেই পুতুল!! পুতুলটার
পাশে জায়গা খালি আছে! আবীর
তড়িঘড়ি করে একদম অরণীদের
কাছাকাছি চলে গেলো। অরণী এখন
একদম এক হাত দূরে! আবীরের আবার
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো! হুমায়ুন
আহমেদের “কবি”
উপন্যাসে পড়েছিলো, “পৃথিবীর
অন্যতম সুন্দর দৃশ্যগুলোর
মধ্যে একটা হচ্ছে,
একটা মেয়ে কেঁদে ফেলার ঠিক
আগের মুহূর্ত”। মেয়েটার
চোখে পানি টলমল করছে! এই
পড়লো বলে!! আবীরের খুব
ইচ্ছা করলো ওর চোখের
পানি গড়িয়ে পড়লে হাত
বাড়িয়ে মুছে দেয়। চমক
ভাঙ্গে নাগরদোলা চালকের কথায়,
“মামা, খালি আছে, উঠবেন নাকি?
১০ টাকা মাত্র!” আবীর কোন
কথা না বলে উঠে বসলো!
অরণী দেখল তার
পাশে একটা ছেলে বসেছে, কিন্তু
তাকালো না সে। খুব রাগ
হচ্ছে বোনদের উপর! নেমেই বাসায়
চলে যাবে ঠিক করলো। কিন্তু হঠাৎ
দেখলো একটা হাত তার দিকে টিস্যু
বাড়িয়ে দিয়েছে। রাগত
মুখে পাশে তাকিয়েই দেখলো আজব
এক ব্যাপার! এটাতো সেই ছেলেটা!
যার সাথে ও ধাক্কা খেয়েছিলো!!
ছেলেটা হাসিমুখেই
অরণীকে বললো, “চোখের
পানি মুছে নিন! বছরের প্রথম দিন
কাঁদলে সারা বছর কেঁদেই
কাটাতে হবে!!
অরণী টিস্যুটা নিয়ে আবার
অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো! কিন্তু
রাগটা বেশিক্ষণ থাকলোনা!
নাগরদোলা চলা শুরু করতেই
অরণী ভয়ে চিৎকার
করে উঠলো এবং বোনদের
কথা সত্যি প্রমাণ করতেই আবীরের
হাত খামচে ধরলো এবং ধরেই
রাখলো!
নাগরদোলা থামলে দেখলো আবীরের
হাতে দাগ বসে গেছে!
অরণী লজ্জিত হয়ে বললো, “আমি খুবই
দুঃখিত, আসলে আমি ভয় পাইতো! তাই
দেখেন না, আমার বোনরাও আমার
সাথে বসেনি!”
আবীর হাসিমুখে বললো, “It’s Ok”!
আপনার মন ভালো হয়েছে?
হুম, তা হয়েছে, ওদের সাথেই রাগ
করেছিলাম, আমার
সাথে বসেনি দেখে! কত্ত খারাপ
না?? ভাবছিলাম বাসায় চলে যাবো,
কিন্তু এখন ভাবছি শুধু শুধু ওদের জন্য
মজা নষ্ট করবো কেন??
তা, আপনার নামটি??
ওহ! বলিনি এখনো? আমি অরণী!
আপনি??
আমি আবীর। কোথায় পড়েন?
আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে।
“Management এ BBA 1st year. আপনি?
আমিও DU তেই। Economics 2nd year.
ওহ! তাহলে তো আপনি সিনিয়ার
ভাইয়া!
এদের কথাবার্তায় বাগড়া দেয়
অরণীর কাজিন।
ওকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ও।
অরণী কোনমতে বাই বলে চলে যায়!
১৫ এপ্রিল বিকেলে আবীর
ভার্সিটির বাস ধরার জন্য কার্জনের
দিকে হাঁটছিলো। সেন্ট্রাল
লাইব্রেরীর
সামনে যেতে না যেতেই দেখলো,
একটা মেয়ে ফোনে ঝগড়া করছে এবং মেয়েটি অন্য
কেউনা, অরণী! আবীর ওকে ডাকতেই
অরণী উচ্ছল হাসি দিয়ে বললো,
“আরে আপনি আবীর ভাইয়া না!!
ভালো আছেন??” কই যান??”
হুম, ভালো। তুমি কেমন আছো?
ভালো আছি, আপনি কই যান?
কার্জন হলে যাচ্ছি, বাস ধরবো।
আল্লাহ!! আমিও তো ওখানে যাবো,
দেখেন তো, আমার বান্ধবির জন্য
আধাঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে আছি, এখন
বলে, সে যাবেনা! রাগ হয়না?
যাবিনা তো আগে বলবি না?”
“তাহলে আমার সাথেই চলো।“
কথাটা বলেই আবীর
ভাবলো,অরণী কি কিছু মনে করলো?
কিন্তু অরণী হাসিমুখেই
রওনা দিলো আবীরের সাথে।
যেতে যেতেই হাজারটা গল্প
করে ফেললো অরণী! তার
সম্পর্কে অনেক কিছুই
জানা হয়ে গেলো আবীরের।
ব্যাপারটা শুধু সেদিনেই সীমাবদ্ধ
থাকলোনা অবশ্য। এরপর থেকে প্রায়ই
অরণী–আবীরকে দেখা যেত কলাভবন,
কার্জন হল, চারুকলা, ছবির হাট,
পাবলিক
লাইব্রেরী বা চিরচেনা TSC তে।
যেকোনো অনুষ্ঠানে তো অবশ্যই!
আবার কখনো হয়তো পড়ন্ত
বিকেলে ফুচকা আর চা’র সাথে নিছক
গল্পে দুজন মুখর।
সম্পর্কটা “আপনি থেকে তুমি,” আর
ভাইয়া থেকে “আবীরের”
গণ্ডিতে নামতে খুব
একটা দেরি হলোনা। এক সময় তো এমন
হলো যে অরণীর বই
কিনতে নীলক্ষেতে যেতে আবীরকে ছাড়া চলবেনা,
আবার আবীরের বোনের জন্য গিফট
কিনতে দোয়েল চত্বরে অরণীকেই
চাই! অরণীর কাজিনের
সাথে কি নিয়ে ঝগড়া হলো সেটা আবীরকেই
ফোনে জানাতে হবে! আবার যত
রাতই হোক, নতুন লেখা শেষ
করে সেটা ফোনে অরণীকেই
আগে শোনাতে হবে!
অরণী বেশ কয়েকদিন ধরেই
দেখছিলো, আবীর কেমন উদাসীন!
অনেক জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর
সে পায়নি! অরণীর কেন যেন বড় ভয়
হচ্ছিলো। আবীরের উদাসীনতা এর
আগেও দেখেছে সে। লেখক মানুষ,
হতেই পারে ভেবে ইগনোর
করে গেছে। কিন্তু এবার কেমন যেন
অস্থির লাগছিলো অরণীর। নিজের
অস্থিরতা দেখে সে নিজেই অবাক
হচ্ছিলো! কখনো এরকমতো হয়নি তার
সাথে! এমন অদ্ভুত লাগছে কেন তার?
ক্যাম্পাসে আজ বর্ষাবরণ উৎসব।
অরণী আজ বড় সুন্দর করে সেজেছে।
নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, নীল টিপ! সবাই
তাকে দেখে মুগ্ধ!! কিন্তু
সদা হাস্যময়ীর আজ মন খারাপ! কাল
রাত থেকে আবীরের ফোন বন্ধ!
আজকের দিনেই আবীর কোথায়
উধাও? অরণী ক্যাম্পাসে এসে অনেক
খুজেছে তাকে, কিন্তু পায়নি! এসব
চিন্তা করে মন খারাপ ছিলো তার।
কিন্তু অনেক আগের প্রোগ্রাম ঠিক
করা, আজ গান গাইবে সে। কষ্ট হলেও
তা লুকিয়ে ষ্টেজে উঠে অরণী গাইলো “বাদল
দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান”।
তার গান শেষ হতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো!
সবাই দৌড়ে মাথার উপর ছাদ
খুঁজছিলো। অরণী তার কিছুই
করলো না। খুব মন খারাপ
থাকলে বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি মন
ভালো হয়! অরণী বরং হাঁটা শুরু করলো।
হাঁটতে হাঁটতে কেন যেন
সোহরাওয়ারদি উদ্যানের
দিকে এগুলো অরণী! হঠাৎ
মনে পড়লো আবীরের সাথে এখানেই
প্রথম দেখা হয়েছিলো তার।
অরণী বুঝলো এখন কাঁদবে সে। হঠাৎ
পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো,
“মেকআপ তো পুরাই গেলো!!”
অরণী চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো হাসিমুখে আবীর
দাড়িয়ে! নীল
পাঞ্জাবি পড়া এবং চুপচুপে ভেজা!
অভিমান উথলে উঠলো অরণীর মনে। মুখ
ফিরিয়ে নিলো সে। আবীর
বলে উঠলো,
আমিতো লুকিয়ে তোমার গান
শুনলাম, তুমি নাহয় এবার আমার গান
শুনো। বলেই আবীর গেয়ে উঠলো,
“এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন
ঘনঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়, এমন
মেঘস্বরে বাদল ঝরঝোর তপন হীনঘন
তমসায়...”
আবীরের গান শেষ
হলে অরণী পেছনে তাকিয়ে অবাক
হয়ে দেখলো আবীর একগুচ্ছ কদম ফুল ওর
দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসছে।
আবীর অরণীর হাত ধরে বললো,
“সারা জীবন আমিই তোমাকে প্রথম
কদম ফুলটি দিতে চাই, তোমার
সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই,
বৈশাখে তোমার
সাথে নাগরদোলায়
উঠে তোমাকে আগলে ধরে রাখতে চাই,
তোমার সাথে পথ চলতে চাই, তোমার
সুখ দুঃখের সাথী হতে চাই!
আমি তোমাকে ভালোবাসি অরণী!!”
অরণী লাজুক
হাসি হেসে ফুলগুলো নিয়ে বললো,
“বৈশাখে পরিচয়, বর্ষায় পরিণয়”!!
সেদিন রাস্তার সব মানুষ অবাক
হয়ে দুজন তরুণ তরুণীকে ঝুম
বৃষ্টিতে হেঁটে যেতে দেখলো!
তরুণীর হাতে কদম ফুল, তরুণের
হাতে তরুণীর হাত!
২৮-০৩-২০১২
কি আদৌ বের হতে পারবো??” “আর
পাঁচ মিনিট, নিশাপু!!” উত্তর
দিয়ে আয়নায়
একটা ভেংচি কাটলো অরণী।
নিশাপুটা যে কি অদ্ভুত!! সব সময়
তাড়াহুড়া! পহেলা বৈশাখে মানুষ
সাজবে নাতো কবে সাজবে? আর
শাড়ি পড়ে সাজ শেষ করতে মানুষের
একটু দেরীতো হবেই। নিশাপু সকাল
থেকে তাড়া দিয়েই যাচ্ছে। শুধু উৎসব
দেখেই অরণী সহ্য করছে! নিশাপুর
তাড়া খেয়ে, মার কাছে বিচার
দেয়ার পালা শেষ করে শেষমেশ
সাজ শেষ করে ১০ টায় দুই কাজিন
নিশা আর অদ্রিকে নিয়ে বের
হলো অরণী। লাল শাড়ি, লাল টিপ,
লাল চুড়ি আর সনাতন
বাঙালি সাজে অরণী তার
স্বভাবজাত উচ্ছলতায় মুগ্ধ। দুই বোনের
সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছে সে।
শুনছে কম, বলছে বেশী। অবশ্য
অরণী সবসময়ই এরকম। বাচাল
বলে কিঞ্চিৎ দুর্নাম আছে তার।
কাছের মানুষরা অবশ্য এজন্যই
বেশী ভালবাসে তাকে।
অরণী বরাবরি প্রাণোচ্ছল, দুরন্ত।
উৎসবের দিনগুলো আবীরের কখনোই
ভালো লাগেনা। বড্ড বেশী ভিড় আর
হইচই। আবীরের মত ঘরকুনো মানুষের
কাছে তা যেন এক বিপত্তি।
আবীরের
ভালো লাগে ঘরে বসে গান শুনতে,
মাঝেসাঝে টুকটাক লেখালেখিও
করে বসে অবশ্য। অবশ্য অন্য সব দিন কোন
বাহানা বানাতে পারলেও আজ
বন্ধুদের এড়াতে পারেনি সে। কোন
মতেই তাদের
বোঝাতে না পেরে প্রতিবাদ
করতেই যেন
সে কালো পাঞ্জাবী পড়ে বের
হয়েছে। এখন আফসোসের বাকি নেই।
একেতো প্রচণ্ড গরম লাগছে, তার উপর
চারপাশের রংবেরঙের মানুষের
মাঝে নিজেকে একটা এলিয়েন
মনে হচ্ছে!! বিরক্তিতে নিচের
দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল আবীর।
হঠাৎই প্রচণ্ড এক
ধাক্কা খেয়ে চিতপটাং হতে গিয়ে সামলে নিলো।
অপর ব্যক্তিকে প্রচণ্ড এক ধমক দেয়ার
চিন্তা করে তাকিয়ে দেখলো টুকটুকে লাল
শাড়ি পড়া টুকটুকে লাল এক পুতুল!
আবীরের কি যেন হলো! কেমন যেন
শ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো,
কথা আটকে আসলো। চোখও
সরাতে পারছিলো না!
পুতুলটা কি তবে জাদু করলো তাকে???
অরণী যে কখন অদ্রির সাথে তর্ক
করতে করতে ধাক্কা খেয়ে বসলো,
নিজেই বুঝতে পারেনি।
ধাক্কা লাগার পরই বুঝতে পারলো।
কিন্তু আজিব তো! ছেলেটা এমন
ড্যাবড্যাব
করে তাকিয়ে আছে কেনো?
অরণী বলল, “সরি সরি!
ব্যথা পেয়েছেন??
দেখতে পারিনি আমি! আর
শাড়ি পড়ে হাঁটছিলাম তো!
ব্যালাল্ন্স রাখতে পারিনি।“
অরণী হয়তো আরো অনেক কিছু বলতো,
কিন্তু নিশা আর
অদ্রি ওকে টেনে নিয়ে গেলো।
আবীর শুধু চেয়েই রইলো।
ধাক্কা নিয়ে নিশাপুর সাথে তর্ক
শেষে সোহরাওয়ারদী উদ্যানে নাগরদোলা চরতে এসেছে অরণীরা।
তার খুবই পছন্দ নাগরদোলা। কিন্তু
একা বসতে ও ভয় পায়। অদ্রিকে তাই
অরণী বললো, “এদিকে আয়, আমার
পাশে বস।“ অদ্রি সাথে সাথে ধনুক
বাঁকা হয়ে বললো, “না!!
আমি নিশাপুর সাথে বসবো। তুমি ভয়
পেয়ে আমাকে খামচি দিবা!”
অরণী তর্ক করতে গেলে নিশা বললো,
“ঠিকই তো বলেছে ও। তুই সবসময়
খামচে ধরিস। তোর
পাশে বসা যাবেনা।“ অরণী আর কিছু
না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।
কেউ দেখেনি, কিন্তু তার
চোখে পানি টলমল করছিলো।
বন্ধুরা বলে, আবীরের
মাঝে রোমান্টিক ব্যাপারস্যাপার
একটু কমই আছে। তার বন্ধুরা যখন
প্রেমিকার হাত ধরে প্রেমের
কথা বলে, তখন সে ভ্রু
কুঁচকে গোমড়া মুখে সিগারেটে টান
দেয়। কিন্তু কেউ আসলে জানেনা,
আবীরের মনে আসলে কি আছে।
আবীরের মনের সব কথা, সব
অনুভূতিগুলো তার লেখায় প্রকাশ পায়।
তাই দুই বন্ধু যখন তাদের
প্রেমিকাকে নিয়ে নাগরদোলায়
চরতে এলো, তখন আবীর
দূরে দাড়িয়ে সিগারেট
টানছিলো আর সেই
মেয়েটিকে খুঁজছিলো। পুতুল পুতুল সেই
মেয়েটি যে কোথায় গেলো?? নামও
জানা হলোনা তার! আচ্ছা,
কখনোতো কাউকে দেখে এরকম হয়নি!
কখনো কোন
মেয়েকে দেখে বলতে ইচ্ছে করেনি,
“তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার
সর্বনাশ” কখনো কোন মেয়ের
হাতটি ধরতে ইচ্ছে করেনি,
কখনো কাউকে দেখে “Background
Music” বাজেনি! তাহলে হঠাৎ
কি হলো আজ? আবীরের
বন্ধুরা প্রেমিকাদের
নিয়ে অলরেডি নাগরদোলায়
উঠে গেছে। আবীরের এক বন্ধু বললো,
“আরে,
ঐযে ডানদিকে একটা খালি আছে!
উঠে যা দোস্ত! শুধু শুধু
দাড়িয়ে থাকবি কেনো?” আবীর
সেদিকে তাকাতেই বুকের ভেতর
ধাক্কা খেলো যেন! আরে!!
এটাতো সেই পুতুল!! পুতুলটার
পাশে জায়গা খালি আছে! আবীর
তড়িঘড়ি করে একদম অরণীদের
কাছাকাছি চলে গেলো। অরণী এখন
একদম এক হাত দূরে! আবীরের আবার
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো! হুমায়ুন
আহমেদের “কবি”
উপন্যাসে পড়েছিলো, “পৃথিবীর
অন্যতম সুন্দর দৃশ্যগুলোর
মধ্যে একটা হচ্ছে,
একটা মেয়ে কেঁদে ফেলার ঠিক
আগের মুহূর্ত”। মেয়েটার
চোখে পানি টলমল করছে! এই
পড়লো বলে!! আবীরের খুব
ইচ্ছা করলো ওর চোখের
পানি গড়িয়ে পড়লে হাত
বাড়িয়ে মুছে দেয়। চমক
ভাঙ্গে নাগরদোলা চালকের কথায়,
“মামা, খালি আছে, উঠবেন নাকি?
১০ টাকা মাত্র!” আবীর কোন
কথা না বলে উঠে বসলো!
অরণী দেখল তার
পাশে একটা ছেলে বসেছে, কিন্তু
তাকালো না সে। খুব রাগ
হচ্ছে বোনদের উপর! নেমেই বাসায়
চলে যাবে ঠিক করলো। কিন্তু হঠাৎ
দেখলো একটা হাত তার দিকে টিস্যু
বাড়িয়ে দিয়েছে। রাগত
মুখে পাশে তাকিয়েই দেখলো আজব
এক ব্যাপার! এটাতো সেই ছেলেটা!
যার সাথে ও ধাক্কা খেয়েছিলো!!
ছেলেটা হাসিমুখেই
অরণীকে বললো, “চোখের
পানি মুছে নিন! বছরের প্রথম দিন
কাঁদলে সারা বছর কেঁদেই
কাটাতে হবে!!
অরণী টিস্যুটা নিয়ে আবার
অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো! কিন্তু
রাগটা বেশিক্ষণ থাকলোনা!
নাগরদোলা চলা শুরু করতেই
অরণী ভয়ে চিৎকার
করে উঠলো এবং বোনদের
কথা সত্যি প্রমাণ করতেই আবীরের
হাত খামচে ধরলো এবং ধরেই
রাখলো!
নাগরদোলা থামলে দেখলো আবীরের
হাতে দাগ বসে গেছে!
অরণী লজ্জিত হয়ে বললো, “আমি খুবই
দুঃখিত, আসলে আমি ভয় পাইতো! তাই
দেখেন না, আমার বোনরাও আমার
সাথে বসেনি!”
আবীর হাসিমুখে বললো, “It’s Ok”!
আপনার মন ভালো হয়েছে?
হুম, তা হয়েছে, ওদের সাথেই রাগ
করেছিলাম, আমার
সাথে বসেনি দেখে! কত্ত খারাপ
না?? ভাবছিলাম বাসায় চলে যাবো,
কিন্তু এখন ভাবছি শুধু শুধু ওদের জন্য
মজা নষ্ট করবো কেন??
তা, আপনার নামটি??
ওহ! বলিনি এখনো? আমি অরণী!
আপনি??
আমি আবীর। কোথায় পড়েন?
আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে।
“Management এ BBA 1st year. আপনি?
আমিও DU তেই। Economics 2nd year.
ওহ! তাহলে তো আপনি সিনিয়ার
ভাইয়া!
এদের কথাবার্তায় বাগড়া দেয়
অরণীর কাজিন।
ওকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ও।
অরণী কোনমতে বাই বলে চলে যায়!
১৫ এপ্রিল বিকেলে আবীর
ভার্সিটির বাস ধরার জন্য কার্জনের
দিকে হাঁটছিলো। সেন্ট্রাল
লাইব্রেরীর
সামনে যেতে না যেতেই দেখলো,
একটা মেয়ে ফোনে ঝগড়া করছে এবং মেয়েটি অন্য
কেউনা, অরণী! আবীর ওকে ডাকতেই
অরণী উচ্ছল হাসি দিয়ে বললো,
“আরে আপনি আবীর ভাইয়া না!!
ভালো আছেন??” কই যান??”
হুম, ভালো। তুমি কেমন আছো?
ভালো আছি, আপনি কই যান?
কার্জন হলে যাচ্ছি, বাস ধরবো।
আল্লাহ!! আমিও তো ওখানে যাবো,
দেখেন তো, আমার বান্ধবির জন্য
আধাঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে আছি, এখন
বলে, সে যাবেনা! রাগ হয়না?
যাবিনা তো আগে বলবি না?”
“তাহলে আমার সাথেই চলো।“
কথাটা বলেই আবীর
ভাবলো,অরণী কি কিছু মনে করলো?
কিন্তু অরণী হাসিমুখেই
রওনা দিলো আবীরের সাথে।
যেতে যেতেই হাজারটা গল্প
করে ফেললো অরণী! তার
সম্পর্কে অনেক কিছুই
জানা হয়ে গেলো আবীরের।
ব্যাপারটা শুধু সেদিনেই সীমাবদ্ধ
থাকলোনা অবশ্য। এরপর থেকে প্রায়ই
অরণী–আবীরকে দেখা যেত কলাভবন,
কার্জন হল, চারুকলা, ছবির হাট,
পাবলিক
লাইব্রেরী বা চিরচেনা TSC তে।
যেকোনো অনুষ্ঠানে তো অবশ্যই!
আবার কখনো হয়তো পড়ন্ত
বিকেলে ফুচকা আর চা’র সাথে নিছক
গল্পে দুজন মুখর।
সম্পর্কটা “আপনি থেকে তুমি,” আর
ভাইয়া থেকে “আবীরের”
গণ্ডিতে নামতে খুব
একটা দেরি হলোনা। এক সময় তো এমন
হলো যে অরণীর বই
কিনতে নীলক্ষেতে যেতে আবীরকে ছাড়া চলবেনা,
আবার আবীরের বোনের জন্য গিফট
কিনতে দোয়েল চত্বরে অরণীকেই
চাই! অরণীর কাজিনের
সাথে কি নিয়ে ঝগড়া হলো সেটা আবীরকেই
ফোনে জানাতে হবে! আবার যত
রাতই হোক, নতুন লেখা শেষ
করে সেটা ফোনে অরণীকেই
আগে শোনাতে হবে!
অরণী বেশ কয়েকদিন ধরেই
দেখছিলো, আবীর কেমন উদাসীন!
অনেক জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর
সে পায়নি! অরণীর কেন যেন বড় ভয়
হচ্ছিলো। আবীরের উদাসীনতা এর
আগেও দেখেছে সে। লেখক মানুষ,
হতেই পারে ভেবে ইগনোর
করে গেছে। কিন্তু এবার কেমন যেন
অস্থির লাগছিলো অরণীর। নিজের
অস্থিরতা দেখে সে নিজেই অবাক
হচ্ছিলো! কখনো এরকমতো হয়নি তার
সাথে! এমন অদ্ভুত লাগছে কেন তার?
ক্যাম্পাসে আজ বর্ষাবরণ উৎসব।
অরণী আজ বড় সুন্দর করে সেজেছে।
নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, নীল টিপ! সবাই
তাকে দেখে মুগ্ধ!! কিন্তু
সদা হাস্যময়ীর আজ মন খারাপ! কাল
রাত থেকে আবীরের ফোন বন্ধ!
আজকের দিনেই আবীর কোথায়
উধাও? অরণী ক্যাম্পাসে এসে অনেক
খুজেছে তাকে, কিন্তু পায়নি! এসব
চিন্তা করে মন খারাপ ছিলো তার।
কিন্তু অনেক আগের প্রোগ্রাম ঠিক
করা, আজ গান গাইবে সে। কষ্ট হলেও
তা লুকিয়ে ষ্টেজে উঠে অরণী গাইলো “বাদল
দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান”।
তার গান শেষ হতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো!
সবাই দৌড়ে মাথার উপর ছাদ
খুঁজছিলো। অরণী তার কিছুই
করলো না। খুব মন খারাপ
থাকলে বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি মন
ভালো হয়! অরণী বরং হাঁটা শুরু করলো।
হাঁটতে হাঁটতে কেন যেন
সোহরাওয়ারদি উদ্যানের
দিকে এগুলো অরণী! হঠাৎ
মনে পড়লো আবীরের সাথে এখানেই
প্রথম দেখা হয়েছিলো তার।
অরণী বুঝলো এখন কাঁদবে সে। হঠাৎ
পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো,
“মেকআপ তো পুরাই গেলো!!”
অরণী চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো হাসিমুখে আবীর
দাড়িয়ে! নীল
পাঞ্জাবি পড়া এবং চুপচুপে ভেজা!
অভিমান উথলে উঠলো অরণীর মনে। মুখ
ফিরিয়ে নিলো সে। আবীর
বলে উঠলো,
আমিতো লুকিয়ে তোমার গান
শুনলাম, তুমি নাহয় এবার আমার গান
শুনো। বলেই আবীর গেয়ে উঠলো,
“এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন
ঘনঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়, এমন
মেঘস্বরে বাদল ঝরঝোর তপন হীনঘন
তমসায়...”
আবীরের গান শেষ
হলে অরণী পেছনে তাকিয়ে অবাক
হয়ে দেখলো আবীর একগুচ্ছ কদম ফুল ওর
দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসছে।
আবীর অরণীর হাত ধরে বললো,
“সারা জীবন আমিই তোমাকে প্রথম
কদম ফুলটি দিতে চাই, তোমার
সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই,
বৈশাখে তোমার
সাথে নাগরদোলায়
উঠে তোমাকে আগলে ধরে রাখতে চাই,
তোমার সাথে পথ চলতে চাই, তোমার
সুখ দুঃখের সাথী হতে চাই!
আমি তোমাকে ভালোবাসি অরণী!!”
অরণী লাজুক
হাসি হেসে ফুলগুলো নিয়ে বললো,
“বৈশাখে পরিচয়, বর্ষায় পরিণয়”!!
সেদিন রাস্তার সব মানুষ অবাক
হয়ে দুজন তরুণ তরুণীকে ঝুম
বৃষ্টিতে হেঁটে যেতে দেখলো!
তরুণীর হাতে কদম ফুল, তরুণের
হাতে তরুণীর হাত!
২৮-০৩-২০১২
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।