www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নারী

আমি তখন খুব ছোট, শহরের বড় একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়তাম। বাবার ইচ্ছে ছিল আমাকে কুরআনে হাফেজ বানাবেন। কে বা কারা যেন বাবাকে নিজের ছেলেকে হাফেজ বানালে পরকালে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার লোভ দেখিয়েছিল! যাইহোক, আমি সেদিকে যাচ্ছি না!

হাফিজিয়া মাদ্রাসার অনেকগুলো কড়া নিয়মের মধ্যে একটি নিয়ম হলো, কিছুতেই বিল্ডিংয়ের বাইরে যাওয়া যাবে না! আমরা যেতে পারতাম না, আমাদেরকে যেতে দেওয়া হতো না! বিকেল বেলা কিছুক্ষণের জন্য বেরুতে দিলেও সেই সীমানা ছিল হুজুরদের চোখের কালো অংশের বিশ্রী ক্ষমতা পর্যন্ত।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার বড় বোনের বিয়েতে আমাকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল মাত্র তিন ঘন্টা সতের মিনিটের! আমার আরেক বন্ধুর বড় ভাই মারা যাওয়ায় সে ছুটি পেয়েছিল মাত্র আড়াই ঘন্টার! যাইহোক, আমি সেদিকেও যাচ্ছি না!

সারাদিন যখন সবাইকে ইট বালুর প্রাচীর ও লোহার গ্রিলের মধ্যে আটকে রাখা হতো, তখন সকলের কেমন লাগতো জানিনা, তবে আমার ভালো লাগতো না। আমি মাঝেই মাঝেই পালিয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। মাদ্রাসার সামনে একটি কিন্ডার গার্টেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঘাসে সমৃদ্ধ বড় দুটি খোলা মাঠ ছিল! আমি তাকিয়ে থাকতাম সেই মাঠে জন্মানো ঘাসের দিকে, তাকিয়ে থাকতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের চোখের দিকে- যেই চোখ দিয়ে তারা পুরো পৃথিবী দেখতে পায়! আর তাকিয়ে থাকতাম চাঞ্চল্যে ভরা ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখভরা হাসির দিকে। এর জন্য আমাকে কম মার খেতে হয় নি! মার খেয়েছি, আবার তাকিয়েছি! যাইহোক, আমি সেদিকেও যাচ্ছি না!

আমাদের মাদ্রাসায় সপ্তাহে একদিন হুজুরেরা ছোট একটি জলসার আয়োজন করতো। সেখানে হুজুরেরা আমাদেরকে একসাথে বসিয়ে বড় বড় কিতাব খুলে নানারকম ওসীয়তনামা শুনাতো! মাঝে মাঝে কোনো বড় হুজুর বেড়াতে এলেও জলসা হতো ও আমরা সবাই একত্র হয়ে সেই বড় হুজুরের ওসীয়ত শুনতাম, মনযোগ দিয়েই শুনতাম। এদের সকলের ওসীয়তের প্রধান ভিত্তি ছিল নারী!

হ্যাঁ, আমি সেদিকেই যাচ্ছি-
আমাদের হুজুরেরা আমাদের বলতো, নারীদের দিকে তাকালে পবিত্র মন মুহুর্তেই অপবিত্র হয়ে যায়। আর অপবিত্র মনে পবিত্র কুরআন কখনো আসবে না। তাই কুরআনকে অন্তরে বা মনে ধারণ করতে হলে নারীদের থেকে দূরে থাকতে হবে, তাদের দিকে ভুল করেও তাকানো যাবে না। আমি তখনো বুঝি নি, মেমোরী বলতে যেটা বুঝায় সেটা হলো মানুষের মস্তিষ্ক! হুজুর আরো বলতো, কোনো নারীর দিকে ইচ্ছে করে তাকানো শুধু পাপই নয়, মহাপাপ- যা ক্ষমার অযোগ্য। নারীর কোনো রূপ নেই, শয়তানের রূপ নারী ধারণ করে। সত্তর বছর একটানা স্রষ্টার ইবাদত করার পরও যদি কেউ ইচ্ছে করে কোনো নারীর দিকে তাকায় তাহলে সাথে সাথে তার সমস্ত ইবাদত পাপে পরিণত হবে, নারীরা এতটাই পাপী। নারীদের জন্ম হয়েছে পুরুষের বুকের বাঁকা হাড় থেকে। স্রষ্টা নারী তৈরী করেছেন শুধুমাত্র পুরুষদের বাঁদী থাকার জন্য। আসলে পৃথিবীতে নারী বলতে কিছু নেই, যা আছে তা হলো শয়তানের ফাঁদ বা শয়তান নিজেই। শয়তান খুব সহজেই নারীর রূপ ধারণ করতে পারে। নারীর বেহেশতি নাম হলো হুর, যা বেহেশতবাসীদের জন্য সত্তরটা করে ফ্রী থাকবে! এরকম আরো অনেক কিছু বলতো আমাদের হুজুরেরা! সব কথা এখন খেয়াল নেই। এই ওসীয়ত শুনার পর আমার বন্ধু ও বড় ভাইয়েরা কেউ কেউ মনে মনে আবার কেউ কেউ জোরে জোরে আসতাগফিরুল্লাহ্ পুরোটা পড়তো! আমি অনেককেই দেখেছি, তারা দুই রাকাত তওবা নামায পড়ে স্রষ্টার দরবারে হাত তুলো অঝোরে কাঁদছে! আমি মূলত কিছুই করিনি, শুধু অবাক হয়েছিলাম!

আমার বন্ধু ও বড়ভাইরা যখন নারীদের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে ব্যস্ত, তখন আমি চোখ মেলে ধরলাম সেই রাস্তায়, যেই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সী মানুষকে দেখি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চোখ মেলে হেঁটে বেড়াতে, আমি তাকাই মাঠের সেই ঘাসের দিকে- বিকেল হলেই যেই ঘাসের উপর গোল হয়ে বসে বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা আড্ডায় ব্যস্ত থেকে বারে বারে তাকায় আকাশের দিকে আর প্রাণ খুলে হাসে! কিন্তু কোথাও নারী খুঁজে পাই না। আমি নারী দেখতে পাগল হয়ে মাদ্রাসা ত্যাগ করে চলে আসলাম বাড়িতে। বাড়িতে দেখি আমার মা বসে বোনের চুলে তেল মালিশ করে দিচ্ছে। আমি আমার মায়ের দিকে তাকাই, বোনের দিকে তাকাই- কিন্তু নারী খুঁজে পাইনা!

আমি তাকাই আমার সেই বাল্যবন্ধুর দিকে। খেলতে গিয়ে পা কেটে ফেলাতে যে তার ফ্রক ছিঁড়ে আমার পা বেঁধে দিয়েছিল- কিন্তু আমি নারী খুঁজে পাইনা! হতাশ হয়ে ফিরে আসি রাস্তায়, পা বাড়াই শহরের দিকে। যেখানে ঢল আছে লাখো মানুষের। সেই লাখো মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে খুঁজতে থাকি নারী, কিন্তু হায় এখানেও আমি নারী খুঁজে পাইনা! আমি তাকাই পথে পাঁচটাকা দরে গোলাপ ফুল বিক্রি করা লম্বা ছেঁড়া জামা গায়ে দেওয়া এক কিশোরীর দিকে। যে কিনা ফুল বিক্রি করে পৃথিবীতে দুদিন বেঁচে থাকার আশায়, কিন্তু আমি নারী খুঁজে পাই না! অবশেষে আমি নারী দেখার আশায় ভর্তি হই স্কুলে, কলেজে- ধীরে ধীরে এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে! কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজও কোনো নারীকে পেলাম না আমি!

যতোবার আমি নারী দেখার লোভে চোখকে মেলে ধরেছি উন্মক্ত আকাশের মতো ততোবারই আমি দেখেছি- সুডৌল স্তন বিশিষ্ট সুষ্ঠু নিতম্বের অধিকারী নিঁখুত কোনো মানুষকে! যার চোখের কালি দিয়ে আমি লিখতে পারবো পৃথিবী থেকেও ভারী একটি কবিতা! কিন্তু, তবু নারী দেখতে পাই না!

অতঃপর, আমি নারী দেখতে চেয়ে রাতের গাঢ় অন্ধকারে সিগারেট মুখে নিয়ে ঈশ্বরকে ডেকে বলি, হে ঈশ্বর- আমি নারী দেখতে চাই, তুমি আমাকে নারী দেখাও! ঈশ্বর মৃদু হেসে কি যেন বললো, ধোঁয়ার অস্পষ্ট গোঙানিতে তা আমার কর্ণ কুহরে একেবারেই প্রবেশ করলো না!!
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৮০০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/১১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • দীপঙ্কর বেরা ০৬/১২/২০১৭
    বাহ। বেশ ভাল কথা ।
  • অনেক সুন্দর লিখেছেন
  • সাঁঝের তারা ২৩/১১/২০১৭
    অনবদ্য
  • এম এম মেহেরুল ২২/১১/২০১৭
    অসাধারন
  • আপনার গল্পটা পড়লাম । কিন্তু হুজুরদের বাণী বা নসিহতের সাথে ইসলামী নীতিমালার কোন মিল বা সংস্রব নেই । কেন যে তারা বাড়তি নসিহত করে । হ্যাঁ মাদ্রাসা শিক্ষার একটা সাইট ফুটে তুলেছেন । তবে আপনার জন্য একটা পরামর্শ আবদুর রহীম সাহেবের পরিবার ও পারিবারিক জীবন বইটা অধ্যয়ন করুন ।অনেক ভুল শোধরানো যাবে । ধন্যবাদ ।
    • বিমূর্ত পথিক ২২/১১/২০১৭
      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালোবাসা সহ শুভকামনাও জানালাম। আমি অবশ্যই আপনার পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে আবদুর রহীম সাহেবের পরিবার ও পারিবারিক জীবন বইটা অধ্যয়ন করবো।
      আবারো ধন্যবাদ আপনাকে।
  • বাচনভঙ্গি দারুণ ছিলো।সমাজের কিছু ট্যাবু ভেঙে দেওয়া দরকার...
    • বিমূর্ত পথিক ২১/১১/২০১৭
      মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম। সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়া খুবই দরকার। এই অসুস্থ সমাজে সুস্থরা বাঁচতে পারে না।
      ভালোবাসা নিবেন, ভালো থাকবেন সবসময়।
  • মনোবর ২০/১১/২০১৭
    সুন্দর!
  • সোলাইমান ২০/১১/২০১৭
    খুব ভাল!!
    সাথে রইল ভালোবাসা.........
  • দীপঙ্কর বেরা ২০/১১/২০১৭
    ভাল লেখা
 
Quantcast