যুবকের চোখের পরিচিত মায়া
দুই.
একটি দূর্ঘটনার পর সে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে, কিন্তু জীবনের অনেক কিছুই সে ভুলে গেছে। জীবনের একুশ বসন্ত পেরুনো বালিকাটি রাগ আর জিদের এক প্রচণ্ডমূর্তি। তার রাগ আর জিদের কাছে বরাবরই পরাস্ত তার পরিজন। তবুও কেউ কিছু বলে না ওকে; ও ভালো থাকে ওর নিজের মতো করে।
সেদিন বৃহস্পতিবার। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে কেবল। সে ক্যাম্পাস হতে ফিরছিল। পথিমধ্যে ক্যাম্পাসের একটি জামগাছের নিচে পুরনো জীর্ণদশা প্রাচীর। সেই প্রাচীরে একজন জিন্স আর টি-শার্ট পরিহিত যুবক বসে। যুবকের কাছাকাছি যেতেই হাত ইশারায় ডাকলো, 'এই বালিকা শুনো।' বালিকা যুবকের সমুখে দাঁড়িয়ে। যুবকের মুখভর্তি খোঁচাখুঁচি দাঁড়ি, অশ্রু টলমলা লাল টকটকে দু'টি চোখ, মাথাভর্তি অগোছালো চুল। যেনো কতরাত নির্ঘুম কাটিয়ে, বুক চাপা বালিশে ব্যথিত হৃদয় নিয়ে কত অশ্রুপাত ঘটিয়েছে। যুবকের চেহারার সঙ্গে ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে একটি সিগারেট খুব করে মানাতো, যদিও তা নেই।
'এই বালিকা, তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো?'
মাথা নিচু করে কম্পিত কণ্ঠে বালিকা মাথা নাড়ালো।
'কিছুক্ষণ আমার পাশে বসবে?'
বালিকা কোনো কথা না বলেই দ্রুতপদে প্রস্থান করলো।
বালিকা বাসায় ফিরে রুমের দরজা লাগিয়ে বালিশ বুকে চেপে নিশ্চুপ শুয়ে পড়লো। সিলিং ফ্যান ঘুরছে, বালিকা ঘামছে। যেনো মধ্যদুপুরে সূর্য মাথায় নিয়ে খোলামাঠে শুয়ে সে। কয়েক মুহূর্ত তার মাথা নির্ভাবনায় কেটে গেলো। অতঃপর সে সংবিৎ ফিরে পেলো। সে তার বন্ধু মহলে শুনেছিল, ক্যাম্পাসে একজন আধপাগল যুবক রয়েছে। সে যুবক নাকি কাউকে একা পেলে পাশে বসিয়ে কীসব আজগুবি গল্প শোনায়। এই সেই যুবক? তাইতো মনে হলো। কিন্তু এই যুবকের চোখে সে পরিচিত মায়া দেখেছে; যেনো কতকালের পরিচিত একটি মুখ। বালিকা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, কেনো এমন হচ্ছে? শুধু বারবার মনেহচ্ছে, তার এভাবে ফিরে আসা উচিৎ হয় নি। পাশে বসে না হোক, অন্তত পুরনো প্রাচীরে হেলান দিয়ে কিংবা সমুখে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কথা বলা উচিৎ ছিলো, সে কী বলতে চায়? সে যুবকের অশ্রু টলমলা রক্তবর্ণ চোখে যে মায়া দেখেছে, তা তাকে অপরাধী করে তুলছে। না, সে যুবকের সমুখে আবার দাঁড়াবে। যুবক বসতে বললে, বসবে। গল্প শোনাতে চাইলে, শুনবে।
পরদিন শুক্রবার। বালিকার ক্যাম্পাসে যাওয়া হলো না। ছটফটানো একটি দিন যেতে লাগলো। তার কিছুই ভালো লাগছে না, কোনো কিছুতেই মন বসছে না। মাঝেমাঝে সে ভাবছে, পৃথিবীতে এতো নিয়ম কেনো? আজ শুক্রবার হতে হবে কেনো? না হয় হলো, কিন্তু শুক্রবার ছুটি থাকতে হবে কেনো? প্রতিটি সেকেণ্ড পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সেকেণ্ড মনে হচ্ছে তার। আহা, যুবক! আহা, পরিচিত মায়া!!
পরদিন সকাল। বালিকার দৃষ্টি বারবার ঘড়ি কাঁটায় পরিভ্রমণ করতে করতে অবশেষে ন'টা বাজলো। সে তড়িঘড়ি করে তার ক্যাম্পাস অভিমুখে রওয়ানা দিলো। পথিমধ্যে ক্যাম্পাসে সেই জামগাছ, সেই জীর্ণদশা প্রাচীর— কিন্তু সেই যুবক নেই। বালিকা এপাশ-ওপাশ চোখ ফেললো, যুবকের সন্ধান পেলো না। নিরাশ চিত্তে বালিকা ক্লাসে ঢুকলো। মাথায় যুবকময় ভাবনা নিয়ে সে অতিবাহিত করলো অস্বস্তিকর ক্লাস পিরিয়ড। ফেরার পথে সেই জামগাছের নিচের জীর্ণদশা প্রাচীরের উপরেই যুবককে বসে থাকতে দেখলো। না ডাকতেই বালিকা তার সমুখে গিয়ে দাঁড়ালো।
'কেমন আছো, যুবক?'
'জ্বী, ভালো। তুমি কে?'
'গত মধ্যাহ্নের পালিয়ে যাওয়া বালিকা। চিনতে পেরেছো?'
'পারিনি, পারবো না। আমার চেনা কেউ নেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। আমি প্রথম দেখার পর দ্বিতীয় দেখায় কাউকেই চিনতে পারি না, বালিকা। তুমি চিনেছো আমায়, এই বড্ড সুখের কথা! পাশে বসো গল্প করি।'
আজও যুবকের পরনে জিন্স আর টি-শার্ট। আজও খোঁচাখুঁচি দাঁড়ি মুখভর্তি, অশ্রু টলমলা টকটকে লাল দু'টি চোখ আর অগোছালো চুল। কিন্তু আজ বালিকা দ্রুত প্রস্থান করলো না। বালিকা যুবকের পাশে বসলো। যুবক তার গল্পের দিকে এগিয়ে গেলো—
'এই শহরেই তার বাসা ছিলো, এখনো আছে— ভুলে গেছি। ভুলে গেছি তার নামটিও। মেয়েটি ভীষণ জিদি আর রাগি ছিলো। কিন্তু তার হৃদয় ছিলো প্রেমপূর্ণ— নিরেট। আমি তাকে ভীষণ ভালোবেসেছিলাম, সেও সমান্তরাল ভালো আমাকে বাসতো। আমি আঁধার প্রিয় বলে সেও আঁধার ভালোবাসতো। সে প্রগাঢ় আঁধারের জোনাকি পছন্দ করতো বলে আমি জোনাকি ভালোবাসতাম। দুজনের প্রিয়-অপ্রিয় গুলো কী করে যেনো একটি বিন্দুতে মিলে যেতো। আমার মনে আছে, ওর একটি অ্যালবাম ছিলো, যেটাতে শুধু ওর আর আমার ছবি ছিলো। এরমধ্যে একটি ছবি ছিলো অ্যালবামের শেষ পৃষ্ঠায়— ওর পড়নে নীল একটি শাড়ি, কানে নীল অপরাজিতা, কপালে নীল টিপ, হাতে নীল কাচের চুড়ি আর আমার পড়নে কালো পাঞ্জাবি, চোখে কালো রোদচশমা। দুজনে হাত ধরে হাঁটছি। ছবিটি তুলেছিলো ওর এক বান্ধবী। এই ছবিটি আমাদের দুজনের চোখে সবচেয়ে প্রিয়। ও যেদিন করে অভিমান করতো, সেদিন পুরো শহর আমার কাছে থমথমে বিরাজ করতো। ওর অভিমান ভাঙতে আমি ওকে এই ক্যাম্পাসে বসিয়ে মজার মজার গল্প শুনাতাম, যাতে সে হাসে। কিন্তু সে হাসতো না। আমি নিজেই গল্প বলে হেসে গড়াগড়ি খেতাম। হঠাৎ ও হেসে ফেলতো কান্নাভেজা চোখে। ওর এই হাসিটা ছিলো আমার দেখা সেরা হাসি, যে হাসিতে বিশ্বজয়ের অনুভূতি ছিলো। মজার ব্যাপার হলো, ও নাকি কখনোই আমার গল্প শুনে হাসেনি, হাসতো আমার হাসিতে অকারণ গড়াগড়ি দেখে। এছাড়াও ওর মান ভাঙাতে কখনো চিঠি লিখতাম, কখনো কান ধরে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম, মাঝেমাঝে খুব ঝাঁল করে চানাচুর খাওয়াতাম। আরও কতভাবে ওর মান ভাঙাতাম। তবে ওর সর্বশেষ মান ভাঙিয়েছিলাম থাপড় দিয়ে; পরে অবশ্য নিজকেই খারাপ লেগেছে ভীষণ। ও পায়েল পড়ে খালি পায়ে বৃষ্টিতে হাটতে ভীষণ আনন্দ পেতো। ওর একজোড়া রূপোর পায়েল ছিলো। কীভাবে যেনো সেই পায়েল হারিয়ে ফেললো একদিন। সেদিন সে আমাকে জড়িয়ে ছোট বাচ্চার মতো ভীষণ কেঁদেছিলো। পরে ওকে এক বর্ষায় একজোড়া রূপোর পায়েল কিনে দিয়েছিলাম। সেদিন ওর চোখে এক আনন্দের ঝিলিক দেখেছিলাম, যা আজও আমার চোখে ভাসে। আমরা একদিন ঘুরতে যাবো। উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। সেদিনও আমরা সেই নীল-কালো সাজে সেজেছিলাম। বাস জার্নি। সকালের দিকে গেলাম। পঞ্চগড় ঘুরলাম— চা বাগান, রকস মিউজিয়াম আরও কোথায় কোথায় যেনো। সন্ধ্যার দিকে ফিরতি বাসে উঠি। ও ভীষণ ক্লান্ত। আমার কাঁধে ও মাথা নেতিয়ে ঘুমিয়েছিলো। বাস চলছে। আকস্মিক একটি বিকট শব্দে মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো।'
'তারপর কী হলো, যুবক?'
'তারপর? তারপর কিছুই জানি না আমি। একদিন এক সুশীতল প্রভাতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম পাবনার হেমায়েতপুরে। যেদিন বুঝলাম আমি হেমায়েতপুরে, তার পরেরদিন আমাকে ফিরেয়ে নিয়ে আসা হলো এই শহরে। শুনেছি, আমি নাকি মাস তিনেক পাগল ছিলাম। এখনো অনেকে তাই ভাবে। তুমিও হয়তো তাই ভাবছো।'
'মেয়েটির কী হলো?'
'এ শহর পরিচিত মনেহয়, কিন্তু মেয়েটির বাসার ঠিকানা মনে পড়ে না। মেয়েটির সব মনে পড়ে খুব, ওর মুখটি শুধু মনে ভাসে না। মনে পড়ে না ওর নাম। অনেক ভেবেছি— পাইনি। তাই রোজ এই ক্যাম্পাসে বসি কাউকে গল্পটা শোনাবো বলে, যদি কেউ গল্পের সূত্র ধরে ওর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়। কিন্তু কেউ গল্পই শুনতে চায়না পাগল ভেবে।'
দুই.
সেদিন সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। বালিকাটি নীল শাড়ি পরেছে, হাতে নীল কাচের চুড়ি, পায়ে রূপোর পায়েল, কপালে নীলটিপ, দু'কানে দুটি নীল অপরাজিতা। হাতে একটি ফটো অ্যালবাম।
'এই সকালবেলা বৃষ্টিতে সেজেগুজে কই যাচ্ছিস মা?'
'ক্যাম্পাসে?'
'কেনো? কারও সঙ্গে দেখা করবি?'
'বেশি প্রশ্ন ভালো লাগে না বাবা। আমি যাচ্ছি, যেতে দাও।'
বালিকার বাবা আর কিছু বলে না। তা ঠিক, ওকে বেশি বিরক্ত করা ঠিক হবে না। ও ওর মতই চলুক। সবেমাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে, মানসিক চাপ না দেয়াই বরং ভালো। ও ওর মতো চলে যায়। বাবা ছাতা নিতে বলেছিলেন, সে নেয় নি। সে ভিজেই চলছে।
বৃষ্টিতে জনশূন্য ক্যাম্পাস। তবু যুবককে যথাস্থানে বসে ভিজতে দেখা গেলো। বালিকা যুবকের সমুখে দাঁড়ালো। যুবকের চোখে বিস্ময়।
'হাসান, চিনতে পেরেছো আমায়?'
'না। কে তুমি?'
'চলো খোলা মাঠে বৃষ্টিতে হাটতে হাটতে কথা বলি?'
যুবক না করেনি। যুবক আর বালিকা পাশাপাশি হাটছে। খোলা মাঠ; ঝুম বৃষ্টি; শিরশিরে হালকা শীতল বাতাস বইছে।
'হাসান, আমি নিতু। তোমার নীল শাড়ি নিতু।'
'নিতু? কে নিতু? কোন নিতু?
'তোমার হারিয়ে যাওয়া নিতু; তুমি যার গল্প নিয়ে বেঁচে আছো।'
'বালিকা, আমার সঙ্গে মজা করা হচ্ছে, তাই না?'
'সত্যি হাসান আমি মজা করছি না। আমি কি তোমার নাম শুনেছি, তবুও কীভাবে বলতে পারি?'
'এটা অবশ্য ভাববার বিষয়। তবে কারও নাম জানা ব্যাপার না।'
'এই ছবিটার দিকে তাকাও। দেখো এটা তুমি, এটা তোমার আমি। চিনতে পেরেছো?'
'না। ও হেসেছিলো এভাবে? না, ওতো আমার কাঁধে ক্লান্ত বদনে ঘুমিয়ে ছিলো। তুমি মিথ্যে বলছো বালিকা।'
'হাসান, তোমার হাতজোর করে বলছি, তুমি আমাকে চিনতে চেষ্টা করো। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো... তাকিয়ে দেখো হাসান, আমি তোমার নিতু।'
'হাত ছাড়ো, মিথ্যুক বালিকা।'
যুবক বালিকার হাত ঝাড়ি মেরে চলে গেলো। অ্যালবামটি মাটিতে পড়ে গেলো। বালিকাটিও মাটিতে বসে পড়লো। বালিকা যুবকের যাওয়ার পথে চেয়ে আছে, যুবক একটিবার ফিরেও চাইলো না। বালিকার ভিতরটা হু হু করে উঠলো। এই বৃষ্টিতে তার চোখের জল বোঝার সাধ্য নেই।
বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেছে। খোলা মাঠে কাদাজলে লুটিয়ে একাকার একটি মেলে থাকা ফটো অ্যালবাম ও একুশ পেরুনো বালিকা। অ্যালবামের ছবির বালিকা ও কাদায় লুটানো বালিকার বড্ড মিল। পার্থক্য শুধু— একজন উচ্ছল হাসিমুখে; একজন বিষণ্ণ বদনে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
এস এম আলমগীর হোসেন ২০/০৯/২০১৭ভাল লেখা
-
ফয়জুল মহী ১৯/০৯/২০১৭আবিষ্ট হলাম