বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন সার্ভিস- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর এক আধুনিকতম স্বাস্থ্যসেবা
বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন সার্ভিস- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর এক আধুনিকতম স্বাস্থ্যসেবা
আলতামাস পাশা
রুমানার প্রতিদিন সন্ধ্যায় জ্বর আসতো। বাংলাদেশের ডাক্তাররা তার নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন। সবাই এক বাক্যে জানালেন রুমানার ক্যানসার হয়েছে। ভেঙ্গে পড়েন রুমানার বাবা-মা। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি যুগের মেয়ে রুমানার ভেঙ্গে পড়ে না। কম্পিটার এবং টেলিফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চিকিৎসা সুবিধা প্রাপ্তি বা টেলিমেডিসিনের কথা রুমানার শুনেছিল। এবার নিজের ক্ষেত্রে সে পদ্ধতিটি ব্যবহার করার ইচ্ছা হল ওর। বাংলাদেশের একটি টেলিমেডিসিন সার্ভিস সেন্টার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শীর্ষস্থানীয় মেডিক্যাল সেন্টারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে চলে গেল রুমানার ডিজিটাইড করা এক্সরে, বিশেষ ক্যামেরায় তোলা ফুসফুসের ছবি। পরদিনই যুক্তরাষ্ট্রের মেডিক্যাল সেন্টারের মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট ই- মেলে ঢাকায় চলে আসলো। ফলাফল অবাক করা। রুমানার ফুসফুসের যে ক্ষতটিকে ক্যানসার বলে মনে করা হয়েছিল তা আদতেও ক্যানসার কোষের রূপ নিতে পারেনি। তবে বেশ কিছু দিন রুমানাকে বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে রোগীর সাথে বিদেশী বিশেষজ্ঞরা সরাসরি কথাও বলেন। পাঠক, ভাবুন তো দেখি ব্যাপারখানা! রুমানাকে কোথাও যেতে হল না, কিছু খরচপাতি অবশ্য লাগলো কিন্তু যে কারণে সিঙ্গাপুর বা আমেরিকায় যেতে হত তা দেশে থেকেই সম্ভবপর হল আইসিটি প্রযুক্তির বদৌলতে। আর এ পুরো ব্যবস্থাটিকে বলা হচ্ছে টেলিমেডিসিন। গ্রীক শব্দ টেলি অর্থ হচ্ছে দূরত্ব। ব্যাপারটি দূর চিকিৎসাও বলা যেতে পারে। তবে টেলিমেডিসিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা একে বলছেন ‘দ্বিতীয় মতামত নেয়া’ বা সেকেন্ড ওপেনিয়ন। পাশ্চাত্যে টেলিমেডিসিন বিষয়টি খুব একটা অবাক করা বিষয় নয়। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা অনেকেই হয়তোবা জানি না যে, উপমহাদেশে প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস চালু হয় বাংলাদেশের সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুর্নবাসন কেন্দ্র সিআরপিতে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে। এখানকার টেলিমেডিসিন সার্ভিস মূলত সেবাধর্মী। মাত্র ১০০০ টাকায় কমপক্ষে ২৪ ঘন্টায় ইল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ দেয়া হয় ই-মেইলের মাধ্যমে।
বিশ্বকব্যাপী টেলিমেডিসিনের জনপ্রিয়তা ও চাহিদার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ খাতের প্রসার ঘটছে।
ডিএনএস টেলিমেডিসিন লিমিটেড ঢাকার বনানীতে স্থাপন করেছে আন্তর্জাতিকমানের যন্ত্রপাতি। সাম্প্রতিকমত এসব যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে এএমডি টেলিমেডিসিন, ইউএস’র কাছে থেকে। এসব যন্ত্রপাতি আইসিটির সর্বোচ্চমানের নিশ্চয়তা বিধান করে। এ সব যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে।
৫০% ইস-ইন ক্ষমতাসম্পন্ন লেন্স: এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে ৫০% জুম-ইন ক্ষমতাসম্পন্ন লেন্স যা যেকোন ক্ষতের স্পষ্ট ছবি তুলে আনতে সক্ষম।
ই-স্টেথোস্কোপ: এটি, হার্ট ফুসফুস বা দেহের অন্যান্য স্থানের স্পন্দন ধারণ করে তা অডিও ফরমেটে বিশ্বের অন্য কোন প্রান্তের চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
ইএনটি: এ যন্ত্রটি কান, নাক এবং গলার যেকোন ক্ষতের ছবি তুলে এর যথাযথ রূপ মান বজায় রেখে তা অন্যত্র প্রেরণে সক্ষম।
অপথ্যালমাস্কোপ: এ যন্ত্রটি চোখের বিভিন্ন রোগের লক্ষণ চিহ্নিত করে এবং ফান্ডোস্কোপীর জন্য চোখ পরীক্ষা করে এবং তা ভিডিও ফরমেটে প্রেরণ করে বিশ্বের অন্য প্রান্তের টেলিমেডিসিন সেন্টারে।
এক্স -রে ডিজিটাইজার: এ যন্ত্রটি এক্স- রে, এমআরআই (সিটি) থেকে প্রাপ্ত ইমেজসমূহ স্ক্যান করে থাকে। ম্যামোগ্রাফির পেট স্ক্যান করে বিদেশী কনসালটেন্টের কাছে পাঠানো হয়।
১২ লিড ইসিজি মেশিন: ঐতিহ্যগত ইসিজি মেশিন থেকে এই ইসিজি মেশিনটি কিন্তু ভিন্নতর। কারণ এ মেশিন হৃদপিন্ডের স্পন্দন এর ট্রেসিং রেকর্ড করে নেয় এবং তা সরাসরি কম্পিউটারে পাঠিয়ে দেয়। ভিডিও ফরমেটে এ ইসিজি রিপোর্ট বিদেশে পাঠানো হয়।
পিসিএমসিআই্এ স্পিরোমিটার: এ যন্ত্রটি আমাদের ফুসফুসের সকল ক্ষমতা পরিপূর্ণ রেকর্ড লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম । গ্রাফিক্যালভাবে এ রেকর্ড উপস্থাপিত হয়।
সিআরপিতে এ উপমহাদেশের প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়
টেলিমেডিসিনের ব্যাপারটি এ উপমহাদেশে খুবই সাম্প্রতিক একটি সার্ভিস। এ উপমহাদেশে প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস চালু হয় বাংলাদেশের সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে। এদেশে উক্ত টেলিমেডিসিন সার্ভিসের কন্ট্রিবিউটর ব্রিটেনের লর্ড ও লেডি সুইনফেন।
১৯৯৮ সালের আগস্ট মাস। ওয়ার্ল্ড টেলিমেডিসিন অথরিটি প্রফেসর উটন ব্রিটেনের লর্ড ও লেডি সুইনফেনের সঙ্গে সিআরপি পরিদর্শন করেন। প্রফেসর উটন উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্যওসেবাকে টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে ব্যবহারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থিত সিআরপিকে যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে টেলিমেডিসিন পাইলট সার্ভিস পরিচালনার একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়।
এর পর ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে সিআরপিতে এ উপমহাদেশের প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়। এতদিন যেসব গরীব রোগীর চিকিৎসার পরামর্শ নেয়া ছিল জরুরি তারা টেলিমেডিসিন সার্ভিসের সুবিধা নিয়ে মাত্র ১০০০ টাকায় কমপক্ষে ২৪ ঘন্টায় ইংল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে সিআরপি টেলিমেডিসিন লিংক সার্ভিসের সাহায্য নিতে শুরু করে। প্রথমদিকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন লিংক সার্ভিস কিছু দিন চালু ছিল। তবে এটি ব্যয়সাপেক্ষ তাই বর্তমানে স্যাটেলাইটের পরিবর্তে শুধুমাত্র ই-মেইল এর মাধ্যমে এ সেবা সহজলভ্য করা হয়েছে।
যদি চিকিৎসকগণ রোগীর রোগ নির্ণয়ে দ্বিতীয় মতামত গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করেন সেক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন একটি কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে। সিআরপির টেলিমেডিসিন সার্ভিস মূলত ইংল্যান্ডের রয়েল হ্যাসলার হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করে। এ হাসপাতালের অর্থপেডিক, প্লাস্টিক সার্জারি, রেডিওলজি, প্যাথলজি, ইএনটি, ডিষ্ট্রোপ্যাথলজি, গাইনোকলজি,পেডিয়াট্রিশিয়ান, নিউরোলজি, ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপির বিশেষজ্ঞগণ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে সিআরপির টেলিমেডিসিন লিংকে কাজ করেন। সিআরপির টেলিমেডিসিন টিম শক্তিশালী ডিজিটাল ক্যামেরায় রোগীর এক্সরে, এমআরআই, মাইলোগ্রামের ছবি ধারণ করে রোগীর যাবতীয় ইতিহাস ও মেডিক্যাল রিপোর্ট ই-মেইলের মাধ্যমে রয়েল হ্যাসলার হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে তাঁরা এ ই-মেইলের উপর যথাযথ পরামর্শ প্রেরণ করেন। ১৯৯৯ এর জুলাই থেকে অদ্যাবধি বহু রোগী এই সার্ভিসের চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছে, যার সাফল্য শতকরা ৯৯ ভাগ।
বর্তমানে বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন সার্ভিস সেবা দিচ্ছে- মেডিনোভা টেলিমেডিসিন, সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড, বাংলাদেশ ইন্সটিাটউট ফর রিসার্চ ডায়বেটিক, এনডোকরাইন এন্ড মেটাবলিক ডিজওর্ডার (বার্ডেম), বাংলাদেশ টেলিমেডিসিন সার্ভিসেস এবং ডিএনএস টেলিমেডিসিন।
টেলিমেডিসিন সার্ভিস ও চিকিৎসকদের কথা....
শুধুমাত্র বিদেশেই নয় টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার চিকিৎসক সরাসরি দেশের দূরবর্তী যে কোন স্থানের বিশেষজ্ঞের কাছে রোগবৃত্তান্ত, ল্যাব রিপোর্ট যেমন ইসিজি, এক্সরে, হিস্টোপ্যাথোলজি, আলট্র্া সনোগ্রাম এমনকি রোগীর হার্ট ও ফুসফুসের শব্দও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠিয়ে পরামর্শ নিতে পারবেন। এর ফলে রোগীদের বিদেশে যাবার প্রয়োজন যেমন কমে যাবে, তেমনি বাঁচবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সত্যি তারা এ সেবা পাবেন কি? পেলেও কতখানি কম খরচে? টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মান নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করবে কে? বরাবরের মত এ সার্ভিসও সরকারের মনিটরিং এর আওতায় নেই। ফলে আগামী কিছু দিনের মধ্যেই গড়ে উঠবে বিভিন্ন টেলিমেডিসিন সার্ভিস সেন্টার। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, স্বাস্থ্য সেবার নামে যে ভাবে ক্লিনিক ব্যবসা জমে উঠেছে ঠিক সেভাবেই হয়তোবা টেলিমেডিসিন ব্যবসাও গড়ে উঠবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্লিনিকের মান নিয়ন্ত্রণে যেমন কোন সরকারি মনিটরিং সেল নেই, তেমনি টেলিমেডিসিন সার্ভিস সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে কিনা সে নিশ্চয়তা কে দেবে? গরীব এ দেশের মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন টেলিমেডিসিন এমন একটি পদ্ধতি যা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা তথা ‘দ্বিতীয় মতামত’ গ্রহণ করা সম্ভব। ব্যবহারকারীদের প্রয়োজন ও পদ্ধতি বাছাইয়ের ওপর নির্ভর করে টেলিমেডিসিন সূচনা করতে পারে ই-মেইলের ব্যবহার, স্টিল ও ভিডিও ফটোগ্রাফির ব্যবহার এবং একই সময় পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে টেলিকনফারেন্সিং এর সুবিধা। বর্তমানে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি ঘটছে। নিত্য নতুন প্রযুক্তি এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীর পেশাগত উন্নয়নে, বিশেষত বাংলাদেশের মত দেশের ক্ষেত্রে, যেখানে সুযোগ- সুবিধার প্রবেশ কম এবং বিশেষ উপকরণও সীমিত সেখানে টেলিমেডিসিন পদ্ধতি ব্যবহার হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কাজের গুণগতমান অবশ্যই রক্ষা করে চলতে হবে।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার চিকিৎসকগণ দরকারে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দাবি করতে পারেন। এক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন মেডিক্যাল বোর্ডের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এমনকি শিক্ষামূলক গবেষণায় দূর শিক্ষণের ক্ষেত্রেও টেলিমেডিসিনের সহায়তা নেয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতে হবে। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে পুঁজি করে যদি কেউ এই টেলিমেডিসিন সার্ভিস চালু করে থাকেন তবে সে মনোভাব তাকে অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে। কারণ স্বাস্থ্য সার্ভিস একটি সেবামূলকখাত। এখাতে অর্থের আদান-প্রদান জড়িত থাকলেও নৈতিকতাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া উচিত। সেবার মনোভাব এবং নৈতিকতার ব্যাপারটি মাথায় থাকলে টেলিমেডিসিন পদ্ধতি বাংলাদেশের মানুষকে সত্যিকার অর্থেই একটি ‘দ্বিতীয় মতামত’ দিতে সক্ষম হবে। মনে রাখতে হবে যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর এ সার্ভিস সর্বোত্তম ভাবে ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামোর উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
আলতামাস পাশা
রুমানার প্রতিদিন সন্ধ্যায় জ্বর আসতো। বাংলাদেশের ডাক্তাররা তার নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন। সবাই এক বাক্যে জানালেন রুমানার ক্যানসার হয়েছে। ভেঙ্গে পড়েন রুমানার বাবা-মা। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি যুগের মেয়ে রুমানার ভেঙ্গে পড়ে না। কম্পিটার এবং টেলিফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চিকিৎসা সুবিধা প্রাপ্তি বা টেলিমেডিসিনের কথা রুমানার শুনেছিল। এবার নিজের ক্ষেত্রে সে পদ্ধতিটি ব্যবহার করার ইচ্ছা হল ওর। বাংলাদেশের একটি টেলিমেডিসিন সার্ভিস সেন্টার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শীর্ষস্থানীয় মেডিক্যাল সেন্টারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে চলে গেল রুমানার ডিজিটাইড করা এক্সরে, বিশেষ ক্যামেরায় তোলা ফুসফুসের ছবি। পরদিনই যুক্তরাষ্ট্রের মেডিক্যাল সেন্টারের মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট ই- মেলে ঢাকায় চলে আসলো। ফলাফল অবাক করা। রুমানার ফুসফুসের যে ক্ষতটিকে ক্যানসার বলে মনে করা হয়েছিল তা আদতেও ক্যানসার কোষের রূপ নিতে পারেনি। তবে বেশ কিছু দিন রুমানাকে বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে রোগীর সাথে বিদেশী বিশেষজ্ঞরা সরাসরি কথাও বলেন। পাঠক, ভাবুন তো দেখি ব্যাপারখানা! রুমানাকে কোথাও যেতে হল না, কিছু খরচপাতি অবশ্য লাগলো কিন্তু যে কারণে সিঙ্গাপুর বা আমেরিকায় যেতে হত তা দেশে থেকেই সম্ভবপর হল আইসিটি প্রযুক্তির বদৌলতে। আর এ পুরো ব্যবস্থাটিকে বলা হচ্ছে টেলিমেডিসিন। গ্রীক শব্দ টেলি অর্থ হচ্ছে দূরত্ব। ব্যাপারটি দূর চিকিৎসাও বলা যেতে পারে। তবে টেলিমেডিসিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা একে বলছেন ‘দ্বিতীয় মতামত নেয়া’ বা সেকেন্ড ওপেনিয়ন। পাশ্চাত্যে টেলিমেডিসিন বিষয়টি খুব একটা অবাক করা বিষয় নয়। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা অনেকেই হয়তোবা জানি না যে, উপমহাদেশে প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস চালু হয় বাংলাদেশের সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুর্নবাসন কেন্দ্র সিআরপিতে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে। এখানকার টেলিমেডিসিন সার্ভিস মূলত সেবাধর্মী। মাত্র ১০০০ টাকায় কমপক্ষে ২৪ ঘন্টায় ইল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ দেয়া হয় ই-মেইলের মাধ্যমে।
বিশ্বকব্যাপী টেলিমেডিসিনের জনপ্রিয়তা ও চাহিদার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ খাতের প্রসার ঘটছে।
ডিএনএস টেলিমেডিসিন লিমিটেড ঢাকার বনানীতে স্থাপন করেছে আন্তর্জাতিকমানের যন্ত্রপাতি। সাম্প্রতিকমত এসব যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে এএমডি টেলিমেডিসিন, ইউএস’র কাছে থেকে। এসব যন্ত্রপাতি আইসিটির সর্বোচ্চমানের নিশ্চয়তা বিধান করে। এ সব যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে।
৫০% ইস-ইন ক্ষমতাসম্পন্ন লেন্স: এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে ৫০% জুম-ইন ক্ষমতাসম্পন্ন লেন্স যা যেকোন ক্ষতের স্পষ্ট ছবি তুলে আনতে সক্ষম।
ই-স্টেথোস্কোপ: এটি, হার্ট ফুসফুস বা দেহের অন্যান্য স্থানের স্পন্দন ধারণ করে তা অডিও ফরমেটে বিশ্বের অন্য কোন প্রান্তের চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
ইএনটি: এ যন্ত্রটি কান, নাক এবং গলার যেকোন ক্ষতের ছবি তুলে এর যথাযথ রূপ মান বজায় রেখে তা অন্যত্র প্রেরণে সক্ষম।
অপথ্যালমাস্কোপ: এ যন্ত্রটি চোখের বিভিন্ন রোগের লক্ষণ চিহ্নিত করে এবং ফান্ডোস্কোপীর জন্য চোখ পরীক্ষা করে এবং তা ভিডিও ফরমেটে প্রেরণ করে বিশ্বের অন্য প্রান্তের টেলিমেডিসিন সেন্টারে।
এক্স -রে ডিজিটাইজার: এ যন্ত্রটি এক্স- রে, এমআরআই (সিটি) থেকে প্রাপ্ত ইমেজসমূহ স্ক্যান করে থাকে। ম্যামোগ্রাফির পেট স্ক্যান করে বিদেশী কনসালটেন্টের কাছে পাঠানো হয়।
১২ লিড ইসিজি মেশিন: ঐতিহ্যগত ইসিজি মেশিন থেকে এই ইসিজি মেশিনটি কিন্তু ভিন্নতর। কারণ এ মেশিন হৃদপিন্ডের স্পন্দন এর ট্রেসিং রেকর্ড করে নেয় এবং তা সরাসরি কম্পিউটারে পাঠিয়ে দেয়। ভিডিও ফরমেটে এ ইসিজি রিপোর্ট বিদেশে পাঠানো হয়।
পিসিএমসিআই্এ স্পিরোমিটার: এ যন্ত্রটি আমাদের ফুসফুসের সকল ক্ষমতা পরিপূর্ণ রেকর্ড লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম । গ্রাফিক্যালভাবে এ রেকর্ড উপস্থাপিত হয়।
সিআরপিতে এ উপমহাদেশের প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়
টেলিমেডিসিনের ব্যাপারটি এ উপমহাদেশে খুবই সাম্প্রতিক একটি সার্ভিস। এ উপমহাদেশে প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস চালু হয় বাংলাদেশের সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে। এদেশে উক্ত টেলিমেডিসিন সার্ভিসের কন্ট্রিবিউটর ব্রিটেনের লর্ড ও লেডি সুইনফেন।
১৯৯৮ সালের আগস্ট মাস। ওয়ার্ল্ড টেলিমেডিসিন অথরিটি প্রফেসর উটন ব্রিটেনের লর্ড ও লেডি সুইনফেনের সঙ্গে সিআরপি পরিদর্শন করেন। প্রফেসর উটন উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্যওসেবাকে টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে ব্যবহারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থিত সিআরপিকে যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে টেলিমেডিসিন পাইলট সার্ভিস পরিচালনার একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়।
এর পর ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে সিআরপিতে এ উপমহাদেশের প্রথম টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়। এতদিন যেসব গরীব রোগীর চিকিৎসার পরামর্শ নেয়া ছিল জরুরি তারা টেলিমেডিসিন সার্ভিসের সুবিধা নিয়ে মাত্র ১০০০ টাকায় কমপক্ষে ২৪ ঘন্টায় ইংল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে সিআরপি টেলিমেডিসিন লিংক সার্ভিসের সাহায্য নিতে শুরু করে। প্রথমদিকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন লিংক সার্ভিস কিছু দিন চালু ছিল। তবে এটি ব্যয়সাপেক্ষ তাই বর্তমানে স্যাটেলাইটের পরিবর্তে শুধুমাত্র ই-মেইল এর মাধ্যমে এ সেবা সহজলভ্য করা হয়েছে।
যদি চিকিৎসকগণ রোগীর রোগ নির্ণয়ে দ্বিতীয় মতামত গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করেন সেক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন একটি কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে। সিআরপির টেলিমেডিসিন সার্ভিস মূলত ইংল্যান্ডের রয়েল হ্যাসলার হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করে। এ হাসপাতালের অর্থপেডিক, প্লাস্টিক সার্জারি, রেডিওলজি, প্যাথলজি, ইএনটি, ডিষ্ট্রোপ্যাথলজি, গাইনোকলজি,পেডিয়াট্রিশিয়ান, নিউরোলজি, ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপির বিশেষজ্ঞগণ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে সিআরপির টেলিমেডিসিন লিংকে কাজ করেন। সিআরপির টেলিমেডিসিন টিম শক্তিশালী ডিজিটাল ক্যামেরায় রোগীর এক্সরে, এমআরআই, মাইলোগ্রামের ছবি ধারণ করে রোগীর যাবতীয় ইতিহাস ও মেডিক্যাল রিপোর্ট ই-মেইলের মাধ্যমে রয়েল হ্যাসলার হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে তাঁরা এ ই-মেইলের উপর যথাযথ পরামর্শ প্রেরণ করেন। ১৯৯৯ এর জুলাই থেকে অদ্যাবধি বহু রোগী এই সার্ভিসের চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছে, যার সাফল্য শতকরা ৯৯ ভাগ।
বর্তমানে বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন সার্ভিস সেবা দিচ্ছে- মেডিনোভা টেলিমেডিসিন, সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড, বাংলাদেশ ইন্সটিাটউট ফর রিসার্চ ডায়বেটিক, এনডোকরাইন এন্ড মেটাবলিক ডিজওর্ডার (বার্ডেম), বাংলাদেশ টেলিমেডিসিন সার্ভিসেস এবং ডিএনএস টেলিমেডিসিন।
টেলিমেডিসিন সার্ভিস ও চিকিৎসকদের কথা....
শুধুমাত্র বিদেশেই নয় টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার চিকিৎসক সরাসরি দেশের দূরবর্তী যে কোন স্থানের বিশেষজ্ঞের কাছে রোগবৃত্তান্ত, ল্যাব রিপোর্ট যেমন ইসিজি, এক্সরে, হিস্টোপ্যাথোলজি, আলট্র্া সনোগ্রাম এমনকি রোগীর হার্ট ও ফুসফুসের শব্দও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠিয়ে পরামর্শ নিতে পারবেন। এর ফলে রোগীদের বিদেশে যাবার প্রয়োজন যেমন কমে যাবে, তেমনি বাঁচবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সত্যি তারা এ সেবা পাবেন কি? পেলেও কতখানি কম খরচে? টেলিমেডিসিন সার্ভিসের মান নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করবে কে? বরাবরের মত এ সার্ভিসও সরকারের মনিটরিং এর আওতায় নেই। ফলে আগামী কিছু দিনের মধ্যেই গড়ে উঠবে বিভিন্ন টেলিমেডিসিন সার্ভিস সেন্টার। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, স্বাস্থ্য সেবার নামে যে ভাবে ক্লিনিক ব্যবসা জমে উঠেছে ঠিক সেভাবেই হয়তোবা টেলিমেডিসিন ব্যবসাও গড়ে উঠবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্লিনিকের মান নিয়ন্ত্রণে যেমন কোন সরকারি মনিটরিং সেল নেই, তেমনি টেলিমেডিসিন সার্ভিস সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে কিনা সে নিশ্চয়তা কে দেবে? গরীব এ দেশের মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন টেলিমেডিসিন এমন একটি পদ্ধতি যা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা তথা ‘দ্বিতীয় মতামত’ গ্রহণ করা সম্ভব। ব্যবহারকারীদের প্রয়োজন ও পদ্ধতি বাছাইয়ের ওপর নির্ভর করে টেলিমেডিসিন সূচনা করতে পারে ই-মেইলের ব্যবহার, স্টিল ও ভিডিও ফটোগ্রাফির ব্যবহার এবং একই সময় পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে টেলিকনফারেন্সিং এর সুবিধা। বর্তমানে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি ঘটছে। নিত্য নতুন প্রযুক্তি এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীর পেশাগত উন্নয়নে, বিশেষত বাংলাদেশের মত দেশের ক্ষেত্রে, যেখানে সুযোগ- সুবিধার প্রবেশ কম এবং বিশেষ উপকরণও সীমিত সেখানে টেলিমেডিসিন পদ্ধতি ব্যবহার হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কাজের গুণগতমান অবশ্যই রক্ষা করে চলতে হবে।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার চিকিৎসকগণ দরকারে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দাবি করতে পারেন। এক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন মেডিক্যাল বোর্ডের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এমনকি শিক্ষামূলক গবেষণায় দূর শিক্ষণের ক্ষেত্রেও টেলিমেডিসিনের সহায়তা নেয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতে হবে। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে পুঁজি করে যদি কেউ এই টেলিমেডিসিন সার্ভিস চালু করে থাকেন তবে সে মনোভাব তাকে অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে। কারণ স্বাস্থ্য সার্ভিস একটি সেবামূলকখাত। এখাতে অর্থের আদান-প্রদান জড়িত থাকলেও নৈতিকতাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া উচিত। সেবার মনোভাব এবং নৈতিকতার ব্যাপারটি মাথায় থাকলে টেলিমেডিসিন পদ্ধতি বাংলাদেশের মানুষকে সত্যিকার অর্থেই একটি ‘দ্বিতীয় মতামত’ দিতে সক্ষম হবে। মনে রাখতে হবে যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর এ সার্ভিস সর্বোত্তম ভাবে ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামোর উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
মন্তব্যসমূহ
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ১৫/০৪/২০২১Excellent post. Thanks
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৫/১১/২০১৮খুব ভালো লাগলো। তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০৫/১১/২০১৮অসাধারণ। ।