আশুরার ইতিহাস করণীয় বর্জনীয়
আরবি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের নাম হচ্ছে “মহররম”। মহররম মাসের দশম দিনকে বলা হয় “আশুরা”। আরবি “আশারা ” হচ্ছে দশ। সেই “আশারা ” থেকেই এসেছে “আশুরা ” তথা মহররম মাসের দশ তারিখ।
পৃথিবীতে মহরমের দশ তারিখে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ঘটেছে। যেকারণে এই তারিখটি ইহুদী, নাসারা, মুসলিম সকলের কাছে খুবই সম্মানিত। আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে আশুরা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
ইসলামে আশুরার গুরুত্ব
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন। সেই চার মাসের একটি হলো মহররম।
আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা: আত তাওবাহ, আয়াত: ৩৬)
উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘তিনটি মাস ধারাবাহিক; আর তাহলো জিলকদ, জিলহজ এবং মহররম। আর অপরটি হলো রজব। যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারি)
সুতরাং কুরআন হাদিসের আলোকে ইসলামে মুহররম একটি সম্মানিত মাস। আর এই মাসের দশম দিন তথা আশুরার গুরুত্বও অপরিসীম।
মুহররমের ফজিলত
পবিত্র হাদিস থেকে জানা যায় মুহররম এবং আশুরার দিনে ইবাদত বন্দেগীর অপরিসীম ফজিলত রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রমাদান মাসের পর সর্বোত্তম সাওম হল মুহররম মাসের সাওম (আশুরার সাওম) এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাত্রের সালাত।” (সুনানে আন-নাসায়ী ১৬১৩, ইবনু মা-জাহ ১৭৪২)
আবূ কাতাদাহ আল-আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আরাফাহর দিনে সওম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-এর দ্বারা বিগত ও আগত এক বছরের গোনাহ (পাপ) মোচন হয়। “আশুরাহর দিনের সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-বিগত এক বছরের পাপ মোচন হয়।” (বুলুগুল মারাম ৬৮০, মুসলিম ১১৬২, তিরমিযী ৬৭৬, নাসায়ী ২৩৮২, আবু দাউদ ২৪২৫, ইবনু মাজাহ ১৭১৩, আহমাদ ২২০২৪)
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন- “রমাদান মাসের সাওমের পরে আল্লাহ্ তা’আলার মাস মুহররমের সাওমই সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ।” (তিরমিজি ৭৪০)
উপর্যুক্ত হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, রমাদানের পরে মুহররম মাস এবং এই মাসে পালন কৃত সাওমের ফজিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশী। কেননা এই মাসের সাওমের বিনিময়ে আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেন। আর মুহররম মাসের দশম দিন তথা আশুরা হচ্ছে ফজিলতপূর্ণ দিন। যেদিনে সাওম পালনের কথা হাদিসে এসেছে।
আশুরা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আমরা ইসলামী ইতিহাস, হাদিস পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন ইসরাইলী সূত্র থেকে আশুরার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। যেগুলো আল্লাহর প্রেরিত বিভিন্ন নবী রাসূলের সাথে সম্পর্কিত। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে এই আশুরা। যেকারণে এই দিনটি সকল আহলে কিতাবিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বুখারি ৩৩৯৭, ও মুসলিম ১১৩৯ নং হাদিস থেকে এই দিনে ঘটিত দুটি ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট জানতে পারি।
যার একটি হলো ফেরাউনের নির্যাতনের কবল থেকে- হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি। যখন আল্লাহ সাগরে রাস্তা সৃষ্টি করে তাঁদের নিরাপত্তা দিয়ে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
অন্যটি হলো ফেরাউনের মৃত্যু। যখন আল্লাহ কতৃক সাগরের রাস্তা দিয়ে মুসা (আ.) ও তাঁর সাথীরা চলে যাচ্ছিলেন, তখন ফেরাউনও তার সৈন্যদল নিয়ে সেই রাস্তা দিয়ে তাদের ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝ পথে রাস্তা পানিতে একাকার হয়ে ফেরাউনের মৃত্যু হয়।
উপর্যুক্ত দুটি ঘটনার পরিপূর্ণ সত্যতা পাওয়া গেলেও- আরো কিছু ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন কিতাবে বিক্ষিপ্তাবে এসেছে। যার অধিকাংশেরই সূত্র হচ্ছে ইসরাইলী কাহিনী।
এইসব কাহিনী সুদীর্ঘকাল থেকে আমাদের উপমহাদেশের ইসলামে প্রচলিত আছে। সুন্নী বিশ্বকোষ ওয়েবসাইটসহ উপমহাদেশের অসংখ্য আলেম ওলামাদের বর্নণায় অসংখ্য কাহিনী প্রচারিত হয়। যার কোনো সঠিক তথ্যসূত্র সহিহ হাদিস থেকে পাওয়া যায় না। এমনসব কাহিনী গুলো হচ্ছে-
১) মহান আল্লাহ এই দিনে প্রথম মানব আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেন এবং জান্নাতে স্থান দেন। পরবর্তীতে এই দিনেই আদম-হাওয়া (আ.) কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। একইসাথে এই দিনেই তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেন।
২) মহান আল্লাহ পাক এই মুহররমের ১০ তারিখে সৃষ্টির সূচনা করেন।
৩) এই দিনে হযরত নূহ (আ.) এবং তাঁর সাথীরা বন্যা-প্লাবন থেকে মুক্তি পান।
৪) আশুরার দিন শুক্রবার ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।
৫) এ দিনই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র ওজুদ (সৃষ্টি) মুবারক হয় এবং ইছমত, সম্মান ও খুছূছিয়ত এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়।
৬) এই দিনে হযরত আদম আলাইহিস সালামের দোয়া কবুল করা হয়।
৭) এই দিনে হযরত ইদ্রিস (আ.) কে সম্মানিতস্থানে তথা আকাশে তুলে নেয়া হয়।
৮) আল্লাহ পাক এদিনে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে কথা বলেন এবং তাঁর উপর তাওরাত শরীফ নাযিল করেন।
৯) মহররমের দশ তারিখ হযরত ইউনুস (আ.) ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তি লাভ করেন।
১০) এই দিনে হযরত মরিয়ম (আ.) এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন।
১১) হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থতা লাভ করেন।
১২) এদিনে দীর্ঘ দিন বিচ্ছেদের পর হযরত ইউসূফ (আ.) তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) এর সাথে মিলিত হন।
১৩) আল্লাহ পাক এ দিনে হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে তুলে নেন।
১৪) এদিনে হযরত ইবরাহীম (আ.) খলীল উপাধি লাভ এবং নমরূদের অগ্নিকু- থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন।
১৫) এ দিনে হযরত দাঊদ (আ.) এর দোয়া কবুল এবং তাঁর পুত্র হযরত সুলায়মান (আ.) কে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে।
উপর্যুক্ত এইসব ঘটনাবলী ছাড়াও আরো অসংখ্য কাহিনী আমাদের সমাজে চালু আছে। যার কোনো সঠিক তথ্যপ্রমাণ নেই। উপর্যুক্ত কাহিনী গুলোর- কিছু কিছু বর্নণা বিভিন্ন কিতাবে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
বিশেষকরে এই দিনে হজরত আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হয়েছে বলে আবুল কাসিম ইস্পাহানী (রাহ.) কর্তৃক সংকলিত “আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব ” কিতাবে ১৮৬৮ নং রেওয়ায়েতে একটি হাদিস এসেছে। তবে সনদ দুর্বলতার কারণে মুহাদ্দিসগণের বিশুদ্ধতার মানদন্ডে তা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
অবশ্য ইমাম ইবনে রজব (রাহ.) কৃত “লাতাইফুল মাআরিফ” এবং আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ (রাহ.) কৃত “আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল” গ্রন্থে কোনো কোনো তাবেয়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হওয়ার কথা এসেছে।
হাদিস গ্রন্থ মুসনাদে আহমাদে, এই দিনে হযরত নুহ (আ.) এর নৌকা নোঙর সম্পর্কিত একটি হাদিস এসেছে যার সূত্র মুসনাদে আহমাদ ১৪/৩৩৫, হাদীস ৮৭১৭। যা শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা। যদিও তা মুহাদ্দিসগণের বিবেচনায় দুর্বল বলা হয়েছে।
“আত-তারগিব ওয়াত-তারহিবে” কিতাবে হজরত ঈসা (আ.) এর জন্ম আশুরার দিন হয়েছে বলে একটি সনদে এসেছে। এবং যথারীতি এই সনদও দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
উপর্যুক্ত ঘটনাবলী ইসলামী ভিত্তি না থাকলেও বিভিন্ন ইসরাইলী বর্নণায় উপমহাদেশের ইসলামে প্রবেশ করেছে। আর তা বিভিন্ন আলেম ওলামাদের দ্বারা সর্বব্যাপী প্রচারিত হয়ে আসছে।
আশুরার সুন্নাহ
পবিত্র আশুরার সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। রাসূল (সা.) হিজরতের আগে থেকেই আশুরার দিনে সাওম পালন করতেন এবং অন্যান্যদেরও তাগিদ দিতেন। পরবর্তীতে রমাদানের সাওম ফরজ হলেও আশুরা সাওম পালনের উৎসাহ দিতেন। শুধু তাইনয়, হিজরতের পরে যখন তিনি জানতে পারলেন- ইহুদী নাসারাও এই দিনে সাওম পালন করে। তখন তিনি দুটি সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন যাতে তাদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ‘আশুরার দিন সিয়াম পালন করেন এবং লোকদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এই দিনের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও সিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম ২৫৫৬)
উপর্যুক্ত হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, আশুরার দিনে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। এবং তা দুটি। একটি ৯ তারিখে এবং ১০ তারিখ। অথবা ১০ তারিখ এবং ১১ তারিখ।
সৃষ্টির শুরু থেকেই আশুরা সম্মানিত
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই আশুরার গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষকরে আহলে কিতাবের অনুসারীদের বিভিন্ন নবী রাসূলদের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে আশুরা। যেকারণে ইহুদী, নাসারা, মুসলিম এমনকি মক্কার কুরাইশরাও সুদীর্ঘ কাল থেকে এই দিনকে সম্মান করে আসছে। শুধু তাইনয় রাসূলুল্লাহও (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার আগে থেকেই এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করে এসেছেন।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুম থেকে বর্ণিত: “আশুরা দিবস এমন একটি দিবস ছিল, যে দিবসে জাহিলিয়া যুগে কুরাইশগণ রোযা রাখত। জাহিলিয়া যুগে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও সে দিবসে রোযা রাখতেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদীনায় এলে পরে তিনি সেই রোযা রাখলেন এবং লোকদেরকেও সেই দিনের রোযা রাখতে হুকুম করলেন। অতঃপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল, উহাই ফরয হিসেবে রইল। আশুরা দিবসের রোযা ছেড়ে দেয়া হল। অতঃপর যে ইচ্ছা করত ঐ দিবসে রোযা রাখত, আর যে ইচ্ছা করত না সে তা ছেড়ে দিত।” (বুখারী ২০০২, মুসলিম ১১২৫, মুয়াত্তা ইমাম মালিক ৬৪৯)
উপর্যুক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, আশুরার দিনটি সকলের কাছেই পরিচিত এবং ফজিলতপূর্ণ ছিলো। যে কারণে মক্কার কাফের মুশরিকরাও এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করতো।
আশুরার ইসলামিক ট্র্যাজেডি
সুদীর্ঘকাল থেকে আশুরা সুসংবাদের বার্তা বহন করলেও- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের প্রায় ৫০ বছর পর ইসলামে যোগ হয় এক মর্মান্তিক বিয়োগগাঁথা।
হিজরী সাল ৬১, যখন পৃথিবীর চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিদায়ের পরে যখন ইসলামে নেমে এসেছিল দূর্যোগের ঘোর ঘনঘটা। সেই অস্থিরতা থেকে সবেমাত্র সবকিছু থিতু হয়ে আসছে। ঠিক সেই সময়েই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পৃথিবীর মানুষ কারবালার প্রান্তের দেখে নির্মম পাশবিক ঘটনা।
ক্ষমতালোভী ইয়াজিদের নির্মমতার শিকার হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.)। বিশ্বের মানুষ অবাক নিস্তব্ধ! কীভাবে সম্ভব? একজন মুসলিম হয়ে কী করে সম্ভব হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণভোমরার গলায় ছুরি দিতে?
৬১ হিজরির মুহররমের দশ তারিখ আশুরার পড়ন্ত বেলায় দিনে হত্যা করা হয় পিপাসার্ত হুসাইন (রা.) কে। পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ হয় নতুন একটি অধ্যায়। যেখানে আশুরার আনন্দ উৎসবের সাথে রচিত হয় নির্মম শোকগাথা। আজও পৃথিবীর মানুষ সেই নির্মমতার চিত্র ভেবে শিউরে উঠে।
কারবালা এবং শিয়া সম্প্রদায়
ইসলামে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পরবর্তীতে, হযরত আলী (রা.) কে কেন্দ্র করে একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যারা আমাদের কাছে শিয়া নামে পরিচিত। এই শিয়ারা আলী (রা.) কে প্রধান করে নতুন একটি বিশ্বাস নিয়ে সরাসরি প্রকৃত ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও তারা নিজেদের প্রকৃত মুসলিম এবং তাদের ধর্মই প্রকৃত ইসলাম বলে দাবি করে।
এই শিয়ারাই কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন ঈমান আকিদার জন্ম দেয়। কারবালার ইতিহাস দেখলে জানা যায়- এই শিয়ারাই হযরত হুসাইন (রা.) কে বারবার চিঠি দিয়ে তাঁকে কুফায় যেতে বাধ্য করে।
তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হুসাইন (রা.) তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর পথিমধ্যে কারবালার প্রান্তেরে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁকে আটকে দেয়। কেননা সেইসময় হযরত হুসাইন (রা.) ছিলেন প্রকৃত খিলাফতের অধিকারী। যদিও মুয়াবিয়া (রা.) তার ছেলে ইয়াজিদকেই খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে দেয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এইসব টানাপোড়েনে ইয়াজিদ কতৃক হুসাইন (রা.) কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন কারবালার প্রান্তেরে হাজারো শিয়া মুসলিম থাকার পরও তারা হুসাইন (রা.) কে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি।
আর এইসব শিয়ারাই পরবর্তীতে হুসাইন (রা.) জন্য মায়াকান্না করতে থাকে। তারা প্রতিবছর আশুরার দিনে তাদের কৃতকর্মের জন্য শোক প্রকাশ করতে থাকে। তাদের শোক প্রকাশ আজ বিশ্ব বিবৃত। যদিও তারা নিজেদের ইসলামের অনুসারী দাবি করে। অথচ তারা আজও আশুরার দিনে শোক প্রকাশ করে ইসলামের বিরোধিতা করে। কেননা ইসলামে চারদিনের বেশী শোক প্রকাশ হারাম।
হুসাইন (রা.) হত্যাকাণ্ডের পরে ইসলামে আশুরার ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হতে থাকে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রের নির্মম হত্যাকাণ্ড কখনোই স্বাভাবিক এবং ছোটখাটো বিষয় হতে পারে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পরবর্তীতে সাধারণ মুসলমানেরাও আশুরার প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে শোকে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
আশুরা বনাম কারবালা
আমরা ইতিমধ্যে কুরআন হাদিসের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানতে পেরেছি যে, আশুরার ইতিহাস সৃষ্টির শুরু থেকেই। বিভিন্ন নবী রাসূলগণ (আ.) এই দিনকে গুরুত্বের সাথে শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসব এবং সম্মান দিয়ে এসেছে।
একইসাথে আমাদের নবী মুহাম্মদও (সা.) এই দিনে মুসলিমের করণীয় কী তাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.) এর পরবর্তীতে নতুন করে কোনো কিছু ইসলামী শরিয়তে সংযোজন বিয়োজন করা সম্ভব নয়। কেননা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মালিক ছিলেন একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের ৫০ বছর পরে সংঘটিত ঘটনা কখনোই শরিয়ত হতে পারে না। অর্থাৎ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো আমল সৃষ্টি করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরার জন্য যেসব আমলের কথা বলে গেছেন, শুধুমাত্র সেই আমল ব্যতিরেকে নতুন কোনো আমল এই আশুরা উপলক্ষে করা যাবে না।
যদি কেউ আশুরা উপলক্ষে নতুন কোনো আমল চালু করে, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টি করেননি কিংবা নির্দেশও দেননি। তাহলে তা হবে “বিদআত”। আর ইসলামে বিদআত একটি জঘন্য অপরাধ।
সুতরাং আশুরা উপলক্ষে শোক প্রকাশ কিংবা আরও যেসব নতুন নতুন আমল আমরা করে থাকি তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে, কারবালা ঘটনা খুবই মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে, সত্যের জন্য আমাদের জীবন দিয়ে হলেও মিথ্যাকে প্রতিহত করতে হবে।
আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় রাসূলের (সা.) প্রিয় নাতিকে কেন সত্যের জন্য এই দিনেই তাঁর জীবন দানকে বেছে নিলেন? তার কারণ পৃথিবীবাসীকে এটাই জানাতে যে, আশুরার দিনে আল্লাহ তোমাদের সবাইকে দয়া করেছেন। আর আশুরার দিনেই আমি আমার বন্ধুর বন্ধুকে সত্যের জন্য কুরবানি দিলাম।
এই কুরবানীর কথা সকল ধর্মের সকল মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত স্বরণ রাখুক। যাতে তারাও সত্যের জন্য কখনোই পিছপা না হয়। এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। তাই এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়াটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।
আশুরার করণীয় আমল
আমরা হাদিস থেকে আগেই জেনেছি যে এই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে সাওম পালন করা। এবং তা শুধু একটি নয় বরং দুটি। আর এই সাওমের দ্বারা আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করবেন ইনশা আল্লাহ।
আশুরাসহ মুহররমের পুরো মাস বেশী বেশী তাওবা-ইসতেগফার করা। কেননা অতীতের সকল নবী এবং নবীর উম্মতকে এই দিনেই ক্ষমা করা হয়। সুতরাং আশাকরা যায় যে, আল্লাহও এইদিনে আমাদের সাগর পরিমাণ গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন ইনশা আল্লাহ।
এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহররম হলো আল্লাহ তাআলার (কাছে একটি মর্যাদার) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতিতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি)
সুতরাং আশুরা উপলক্ষে আমাদের বেশী দোয়া দরুদ পড়া এবং তাওবা-ইসতেগফার করা উচিত।
এইদিনে যেহেতু ইসলামী ইতিহাসে একটি চরম হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়েছে- সেহেতু সেই ঘটনা থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই ঘটনা আমাদের ঈমানকে জাগ্রত করে। সত্যের জন্য প্রয়োজনে জান দিয়ে দিতে হবে। তবুও মিথ্যার কাছে শয়তানের কাছে জালিম শাসকগোষ্ঠীর কাছে কখনোই মাথানত করা যাবে না।
হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, নিজেদের ঈমান আমল ঠিক রাখার জন্য যথাসাধ্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। কখনোই দুনিয়াবী লোভে, প্রবৃত্তির তাড়নায়, শাসকগোষ্ঠীর চাপে নিজেদের ঈমান বিলিয়ে দেওয়া যাবে না।
আশুরা সম্পর্কে ভুল ধারণা
ইসলাম সম্পর্কে বিশদ না জনার কারণে এবং জানার চেষ্টা না করার কারণেও উপমহাদেশে আশুরাসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে অসংখ্য ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। যা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। এইসব ধারণা সমূহ হলো:
১) এই মাসে বিয়েশাদি না করা।
২) নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা।
৩) কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা।
৪) গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা।
৫) পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা।
৬) সব ধরনের আনন্দ উৎসব পরিহার করা ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত কাজগুলো হচ্ছে কুসংস্কার। এইসব কখনোই ইসলাতী রীতিনীতি নয়। ইসলামের সাথে এইসবের কোনো সম্পর্ক নেই।
আশুরার বিদআতী আমল
রাসূলুল্লাহ (সা.) কতৃক আশুরার আমল থেকে সরে গিয়ে আমরা দিনদিন নিত্যনতুন বিদআতে জড়িত হয়ে গেছি। বিশেষকরে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শিয়াদের বাড়াবাড়ির কারণে- সুন্নীদের মাঝেও এইসবের প্রচলন শুরু হয়েছে। যেমন:
১) হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর স্মরণে কাল্পনিক তাযিয়া বা নকল কবর নিয়ে মিছিল করা।
২) এইসব নকল তাযিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা।
৩) এইসব নকল তাযিয়ায় বা কবরে নজরানা স্বরূপ অর্থ প্রদান করা।
৪) কারবালার শোক প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেদের দেহে ছুরি ব্লেড ইত্যাদি দ্বারা আঘাত বা রক্তাক্ত করা।
৫) হুসাইন (রা.) শাহাদাতের স্বরণে হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে শোক, মাতম কিংবা বিলাপ ইত্যাদি করা।
৬) যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা।
৭) বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের প্রদর্শনী করা।
হুসাইনের (রা.) নামে শোকগাথার প্রচলন
আজ বিশ্বের শিয়াসহ সুন্নীদের কিছু অংশ আশুরার দিনে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শোক প্রকাশের যে পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে, তা হুসেইন (রা.) শাহাদাতের তিনশ বছরেও ছিলো না। আমরা ইবনুল আসীর কর্তৃক রচিত ‘আল-কামেল ফিত তারীখ’ ৭/২৭৯, ইবনে কাসীর (রাহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ ‘১৫/২৬১ (৩৫২ হিজরীর ঘটনাবলী) ও হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী (রাহ.) কৃত ‘ইবতালে আযাদারী’ কিতাব থেকে জানতে পারি- আশুরা উপলক্ষে শিয়াদের এইসব তাযিয়া মিছিল, কান্নাকাটি, আহাজারি, বুক পিঠ চাপড়ানো, ছুরি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের আঘাত করা ইত্যাদির সূচনা করেন “মুঈযযুদ দাওলা দাইলামী” নামে একজন শিয়া।
এই ব্যক্তি সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরীতে এইসব শোক তাযিয়া মিছিল করার হুকুম জারি করেন। যা পরবর্তীতে ৩৬৩ হিজরীতে আল-মুঈযযু লিদীনিল্লাহি ফাতিমী (বেদ্বীন কট্টর শিয়া) মিশরেও এই হুকুম জারি হয়।
সুতরাং এইসব শোক মিছিল কখনোই ইসলামের অংশ ছিলো না এবং নেই। যদি কেউ এইসব করে এবং সমর্থন করে তাহলে তার ঈমান সন্দেহে পতিত হবে।
সুতরাং আসুন পবিত্র এবং সম্মানিত মাস মহররমের দশ তারিখ আশুরার দিনকে আমরা ইবাদতের দিন হিসাবে পালন করি। সাওম পালনের পাশাপাশি যথাসাধ্য তাওবা-ইসতেগফারের মাধ্যমে নিজের পাপ সমূহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। একইসাথে আশুরার দিনে সত্যের জন্য হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে নিজেদের ঈমানকে উজ্জীবিত করি।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
৩ আগস্ট, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
পৃথিবীতে মহরমের দশ তারিখে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ঘটেছে। যেকারণে এই তারিখটি ইহুদী, নাসারা, মুসলিম সকলের কাছে খুবই সম্মানিত। আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে আশুরা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
ইসলামে আশুরার গুরুত্ব
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন। সেই চার মাসের একটি হলো মহররম।
আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা: আত তাওবাহ, আয়াত: ৩৬)
উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘তিনটি মাস ধারাবাহিক; আর তাহলো জিলকদ, জিলহজ এবং মহররম। আর অপরটি হলো রজব। যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারি)
সুতরাং কুরআন হাদিসের আলোকে ইসলামে মুহররম একটি সম্মানিত মাস। আর এই মাসের দশম দিন তথা আশুরার গুরুত্বও অপরিসীম।
মুহররমের ফজিলত
পবিত্র হাদিস থেকে জানা যায় মুহররম এবং আশুরার দিনে ইবাদত বন্দেগীর অপরিসীম ফজিলত রয়েছে।
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রমাদান মাসের পর সর্বোত্তম সাওম হল মুহররম মাসের সাওম (আশুরার সাওম) এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাত্রের সালাত।” (সুনানে আন-নাসায়ী ১৬১৩, ইবনু মা-জাহ ১৭৪২)
আবূ কাতাদাহ আল-আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আরাফাহর দিনে সওম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-এর দ্বারা বিগত ও আগত এক বছরের গোনাহ (পাপ) মোচন হয়। “আশুরাহর দিনের সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-বিগত এক বছরের পাপ মোচন হয়।” (বুলুগুল মারাম ৬৮০, মুসলিম ১১৬২, তিরমিযী ৬৭৬, নাসায়ী ২৩৮২, আবু দাউদ ২৪২৫, ইবনু মাজাহ ১৭১৩, আহমাদ ২২০২৪)
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন- “রমাদান মাসের সাওমের পরে আল্লাহ্ তা’আলার মাস মুহররমের সাওমই সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ।” (তিরমিজি ৭৪০)
উপর্যুক্ত হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, রমাদানের পরে মুহররম মাস এবং এই মাসে পালন কৃত সাওমের ফজিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশী। কেননা এই মাসের সাওমের বিনিময়ে আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেন। আর মুহররম মাসের দশম দিন তথা আশুরা হচ্ছে ফজিলতপূর্ণ দিন। যেদিনে সাওম পালনের কথা হাদিসে এসেছে।
আশুরা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আমরা ইসলামী ইতিহাস, হাদিস পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন ইসরাইলী সূত্র থেকে আশুরার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। যেগুলো আল্লাহর প্রেরিত বিভিন্ন নবী রাসূলের সাথে সম্পর্কিত। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে এই আশুরা। যেকারণে এই দিনটি সকল আহলে কিতাবিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বুখারি ৩৩৯৭, ও মুসলিম ১১৩৯ নং হাদিস থেকে এই দিনে ঘটিত দুটি ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট জানতে পারি।
যার একটি হলো ফেরাউনের নির্যাতনের কবল থেকে- হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি। যখন আল্লাহ সাগরে রাস্তা সৃষ্টি করে তাঁদের নিরাপত্তা দিয়ে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
অন্যটি হলো ফেরাউনের মৃত্যু। যখন আল্লাহ কতৃক সাগরের রাস্তা দিয়ে মুসা (আ.) ও তাঁর সাথীরা চলে যাচ্ছিলেন, তখন ফেরাউনও তার সৈন্যদল নিয়ে সেই রাস্তা দিয়ে তাদের ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝ পথে রাস্তা পানিতে একাকার হয়ে ফেরাউনের মৃত্যু হয়।
উপর্যুক্ত দুটি ঘটনার পরিপূর্ণ সত্যতা পাওয়া গেলেও- আরো কিছু ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন কিতাবে বিক্ষিপ্তাবে এসেছে। যার অধিকাংশেরই সূত্র হচ্ছে ইসরাইলী কাহিনী।
এইসব কাহিনী সুদীর্ঘকাল থেকে আমাদের উপমহাদেশের ইসলামে প্রচলিত আছে। সুন্নী বিশ্বকোষ ওয়েবসাইটসহ উপমহাদেশের অসংখ্য আলেম ওলামাদের বর্নণায় অসংখ্য কাহিনী প্রচারিত হয়। যার কোনো সঠিক তথ্যসূত্র সহিহ হাদিস থেকে পাওয়া যায় না। এমনসব কাহিনী গুলো হচ্ছে-
১) মহান আল্লাহ এই দিনে প্রথম মানব আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেন এবং জান্নাতে স্থান দেন। পরবর্তীতে এই দিনেই আদম-হাওয়া (আ.) কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। একইসাথে এই দিনেই তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেন।
২) মহান আল্লাহ পাক এই মুহররমের ১০ তারিখে সৃষ্টির সূচনা করেন।
৩) এই দিনে হযরত নূহ (আ.) এবং তাঁর সাথীরা বন্যা-প্লাবন থেকে মুক্তি পান।
৪) আশুরার দিন শুক্রবার ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।
৫) এ দিনই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র ওজুদ (সৃষ্টি) মুবারক হয় এবং ইছমত, সম্মান ও খুছূছিয়ত এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়।
৬) এই দিনে হযরত আদম আলাইহিস সালামের দোয়া কবুল করা হয়।
৭) এই দিনে হযরত ইদ্রিস (আ.) কে সম্মানিতস্থানে তথা আকাশে তুলে নেয়া হয়।
৮) আল্লাহ পাক এদিনে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে কথা বলেন এবং তাঁর উপর তাওরাত শরীফ নাযিল করেন।
৯) মহররমের দশ তারিখ হযরত ইউনুস (আ.) ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তি লাভ করেন।
১০) এই দিনে হযরত মরিয়ম (আ.) এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন।
১১) হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থতা লাভ করেন।
১২) এদিনে দীর্ঘ দিন বিচ্ছেদের পর হযরত ইউসূফ (আ.) তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) এর সাথে মিলিত হন।
১৩) আল্লাহ পাক এ দিনে হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে তুলে নেন।
১৪) এদিনে হযরত ইবরাহীম (আ.) খলীল উপাধি লাভ এবং নমরূদের অগ্নিকু- থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন।
১৫) এ দিনে হযরত দাঊদ (আ.) এর দোয়া কবুল এবং তাঁর পুত্র হযরত সুলায়মান (আ.) কে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে।
উপর্যুক্ত এইসব ঘটনাবলী ছাড়াও আরো অসংখ্য কাহিনী আমাদের সমাজে চালু আছে। যার কোনো সঠিক তথ্যপ্রমাণ নেই। উপর্যুক্ত কাহিনী গুলোর- কিছু কিছু বর্নণা বিভিন্ন কিতাবে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
বিশেষকরে এই দিনে হজরত আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হয়েছে বলে আবুল কাসিম ইস্পাহানী (রাহ.) কর্তৃক সংকলিত “আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব ” কিতাবে ১৮৬৮ নং রেওয়ায়েতে একটি হাদিস এসেছে। তবে সনদ দুর্বলতার কারণে মুহাদ্দিসগণের বিশুদ্ধতার মানদন্ডে তা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
অবশ্য ইমাম ইবনে রজব (রাহ.) কৃত “লাতাইফুল মাআরিফ” এবং আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ (রাহ.) কৃত “আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল” গ্রন্থে কোনো কোনো তাবেয়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হওয়ার কথা এসেছে।
হাদিস গ্রন্থ মুসনাদে আহমাদে, এই দিনে হযরত নুহ (আ.) এর নৌকা নোঙর সম্পর্কিত একটি হাদিস এসেছে যার সূত্র মুসনাদে আহমাদ ১৪/৩৩৫, হাদীস ৮৭১৭। যা শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা। যদিও তা মুহাদ্দিসগণের বিবেচনায় দুর্বল বলা হয়েছে।
“আত-তারগিব ওয়াত-তারহিবে” কিতাবে হজরত ঈসা (আ.) এর জন্ম আশুরার দিন হয়েছে বলে একটি সনদে এসেছে। এবং যথারীতি এই সনদও দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
উপর্যুক্ত ঘটনাবলী ইসলামী ভিত্তি না থাকলেও বিভিন্ন ইসরাইলী বর্নণায় উপমহাদেশের ইসলামে প্রবেশ করেছে। আর তা বিভিন্ন আলেম ওলামাদের দ্বারা সর্বব্যাপী প্রচারিত হয়ে আসছে।
আশুরার সুন্নাহ
পবিত্র আশুরার সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। রাসূল (সা.) হিজরতের আগে থেকেই আশুরার দিনে সাওম পালন করতেন এবং অন্যান্যদেরও তাগিদ দিতেন। পরবর্তীতে রমাদানের সাওম ফরজ হলেও আশুরা সাওম পালনের উৎসাহ দিতেন। শুধু তাইনয়, হিজরতের পরে যখন তিনি জানতে পারলেন- ইহুদী নাসারাও এই দিনে সাওম পালন করে। তখন তিনি দুটি সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন যাতে তাদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ‘আশুরার দিন সিয়াম পালন করেন এবং লোকদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এই দিনের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও সিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম ২৫৫৬)
উপর্যুক্ত হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, আশুরার দিনে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। এবং তা দুটি। একটি ৯ তারিখে এবং ১০ তারিখ। অথবা ১০ তারিখ এবং ১১ তারিখ।
সৃষ্টির শুরু থেকেই আশুরা সম্মানিত
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই আশুরার গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষকরে আহলে কিতাবের অনুসারীদের বিভিন্ন নবী রাসূলদের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে আশুরা। যেকারণে ইহুদী, নাসারা, মুসলিম এমনকি মক্কার কুরাইশরাও সুদীর্ঘ কাল থেকে এই দিনকে সম্মান করে আসছে। শুধু তাইনয় রাসূলুল্লাহও (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার আগে থেকেই এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করে এসেছেন।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুম থেকে বর্ণিত: “আশুরা দিবস এমন একটি দিবস ছিল, যে দিবসে জাহিলিয়া যুগে কুরাইশগণ রোযা রাখত। জাহিলিয়া যুগে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও সে দিবসে রোযা রাখতেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদীনায় এলে পরে তিনি সেই রোযা রাখলেন এবং লোকদেরকেও সেই দিনের রোযা রাখতে হুকুম করলেন। অতঃপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল, উহাই ফরয হিসেবে রইল। আশুরা দিবসের রোযা ছেড়ে দেয়া হল। অতঃপর যে ইচ্ছা করত ঐ দিবসে রোযা রাখত, আর যে ইচ্ছা করত না সে তা ছেড়ে দিত।” (বুখারী ২০০২, মুসলিম ১১২৫, মুয়াত্তা ইমাম মালিক ৬৪৯)
উপর্যুক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, আশুরার দিনটি সকলের কাছেই পরিচিত এবং ফজিলতপূর্ণ ছিলো। যে কারণে মক্কার কাফের মুশরিকরাও এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করতো।
আশুরার ইসলামিক ট্র্যাজেডি
সুদীর্ঘকাল থেকে আশুরা সুসংবাদের বার্তা বহন করলেও- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের প্রায় ৫০ বছর পর ইসলামে যোগ হয় এক মর্মান্তিক বিয়োগগাঁথা।
হিজরী সাল ৬১, যখন পৃথিবীর চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিদায়ের পরে যখন ইসলামে নেমে এসেছিল দূর্যোগের ঘোর ঘনঘটা। সেই অস্থিরতা থেকে সবেমাত্র সবকিছু থিতু হয়ে আসছে। ঠিক সেই সময়েই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পৃথিবীর মানুষ কারবালার প্রান্তের দেখে নির্মম পাশবিক ঘটনা।
ক্ষমতালোভী ইয়াজিদের নির্মমতার শিকার হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.)। বিশ্বের মানুষ অবাক নিস্তব্ধ! কীভাবে সম্ভব? একজন মুসলিম হয়ে কী করে সম্ভব হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণভোমরার গলায় ছুরি দিতে?
৬১ হিজরির মুহররমের দশ তারিখ আশুরার পড়ন্ত বেলায় দিনে হত্যা করা হয় পিপাসার্ত হুসাইন (রা.) কে। পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ হয় নতুন একটি অধ্যায়। যেখানে আশুরার আনন্দ উৎসবের সাথে রচিত হয় নির্মম শোকগাথা। আজও পৃথিবীর মানুষ সেই নির্মমতার চিত্র ভেবে শিউরে উঠে।
কারবালা এবং শিয়া সম্প্রদায়
ইসলামে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পরবর্তীতে, হযরত আলী (রা.) কে কেন্দ্র করে একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যারা আমাদের কাছে শিয়া নামে পরিচিত। এই শিয়ারা আলী (রা.) কে প্রধান করে নতুন একটি বিশ্বাস নিয়ে সরাসরি প্রকৃত ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও তারা নিজেদের প্রকৃত মুসলিম এবং তাদের ধর্মই প্রকৃত ইসলাম বলে দাবি করে।
এই শিয়ারাই কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন ঈমান আকিদার জন্ম দেয়। কারবালার ইতিহাস দেখলে জানা যায়- এই শিয়ারাই হযরত হুসাইন (রা.) কে বারবার চিঠি দিয়ে তাঁকে কুফায় যেতে বাধ্য করে।
তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হুসাইন (রা.) তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর পথিমধ্যে কারবালার প্রান্তেরে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁকে আটকে দেয়। কেননা সেইসময় হযরত হুসাইন (রা.) ছিলেন প্রকৃত খিলাফতের অধিকারী। যদিও মুয়াবিয়া (রা.) তার ছেলে ইয়াজিদকেই খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে দেয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এইসব টানাপোড়েনে ইয়াজিদ কতৃক হুসাইন (রা.) কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন কারবালার প্রান্তেরে হাজারো শিয়া মুসলিম থাকার পরও তারা হুসাইন (রা.) কে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি।
আর এইসব শিয়ারাই পরবর্তীতে হুসাইন (রা.) জন্য মায়াকান্না করতে থাকে। তারা প্রতিবছর আশুরার দিনে তাদের কৃতকর্মের জন্য শোক প্রকাশ করতে থাকে। তাদের শোক প্রকাশ আজ বিশ্ব বিবৃত। যদিও তারা নিজেদের ইসলামের অনুসারী দাবি করে। অথচ তারা আজও আশুরার দিনে শোক প্রকাশ করে ইসলামের বিরোধিতা করে। কেননা ইসলামে চারদিনের বেশী শোক প্রকাশ হারাম।
হুসাইন (রা.) হত্যাকাণ্ডের পরে ইসলামে আশুরার ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হতে থাকে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রের নির্মম হত্যাকাণ্ড কখনোই স্বাভাবিক এবং ছোটখাটো বিষয় হতে পারে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পরবর্তীতে সাধারণ মুসলমানেরাও আশুরার প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে শোকে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
আশুরা বনাম কারবালা
আমরা ইতিমধ্যে কুরআন হাদিসের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানতে পেরেছি যে, আশুরার ইতিহাস সৃষ্টির শুরু থেকেই। বিভিন্ন নবী রাসূলগণ (আ.) এই দিনকে গুরুত্বের সাথে শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসব এবং সম্মান দিয়ে এসেছে।
একইসাথে আমাদের নবী মুহাম্মদও (সা.) এই দিনে মুসলিমের করণীয় কী তাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.) এর পরবর্তীতে নতুন করে কোনো কিছু ইসলামী শরিয়তে সংযোজন বিয়োজন করা সম্ভব নয়। কেননা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মালিক ছিলেন একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের ৫০ বছর পরে সংঘটিত ঘটনা কখনোই শরিয়ত হতে পারে না। অর্থাৎ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো আমল সৃষ্টি করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরার জন্য যেসব আমলের কথা বলে গেছেন, শুধুমাত্র সেই আমল ব্যতিরেকে নতুন কোনো আমল এই আশুরা উপলক্ষে করা যাবে না।
যদি কেউ আশুরা উপলক্ষে নতুন কোনো আমল চালু করে, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টি করেননি কিংবা নির্দেশও দেননি। তাহলে তা হবে “বিদআত”। আর ইসলামে বিদআত একটি জঘন্য অপরাধ।
সুতরাং আশুরা উপলক্ষে শোক প্রকাশ কিংবা আরও যেসব নতুন নতুন আমল আমরা করে থাকি তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে, কারবালা ঘটনা খুবই মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে, সত্যের জন্য আমাদের জীবন দিয়ে হলেও মিথ্যাকে প্রতিহত করতে হবে।
আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় রাসূলের (সা.) প্রিয় নাতিকে কেন সত্যের জন্য এই দিনেই তাঁর জীবন দানকে বেছে নিলেন? তার কারণ পৃথিবীবাসীকে এটাই জানাতে যে, আশুরার দিনে আল্লাহ তোমাদের সবাইকে দয়া করেছেন। আর আশুরার দিনেই আমি আমার বন্ধুর বন্ধুকে সত্যের জন্য কুরবানি দিলাম।
এই কুরবানীর কথা সকল ধর্মের সকল মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত স্বরণ রাখুক। যাতে তারাও সত্যের জন্য কখনোই পিছপা না হয়। এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। তাই এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়াটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।
আশুরার করণীয় আমল
আমরা হাদিস থেকে আগেই জেনেছি যে এই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে সাওম পালন করা। এবং তা শুধু একটি নয় বরং দুটি। আর এই সাওমের দ্বারা আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করবেন ইনশা আল্লাহ।
আশুরাসহ মুহররমের পুরো মাস বেশী বেশী তাওবা-ইসতেগফার করা। কেননা অতীতের সকল নবী এবং নবীর উম্মতকে এই দিনেই ক্ষমা করা হয়। সুতরাং আশাকরা যায় যে, আল্লাহও এইদিনে আমাদের সাগর পরিমাণ গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন ইনশা আল্লাহ।
এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহররম হলো আল্লাহ তাআলার (কাছে একটি মর্যাদার) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতিতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি)
সুতরাং আশুরা উপলক্ষে আমাদের বেশী দোয়া দরুদ পড়া এবং তাওবা-ইসতেগফার করা উচিত।
এইদিনে যেহেতু ইসলামী ইতিহাসে একটি চরম হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়েছে- সেহেতু সেই ঘটনা থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই ঘটনা আমাদের ঈমানকে জাগ্রত করে। সত্যের জন্য প্রয়োজনে জান দিয়ে দিতে হবে। তবুও মিথ্যার কাছে শয়তানের কাছে জালিম শাসকগোষ্ঠীর কাছে কখনোই মাথানত করা যাবে না।
হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, নিজেদের ঈমান আমল ঠিক রাখার জন্য যথাসাধ্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। কখনোই দুনিয়াবী লোভে, প্রবৃত্তির তাড়নায়, শাসকগোষ্ঠীর চাপে নিজেদের ঈমান বিলিয়ে দেওয়া যাবে না।
আশুরা সম্পর্কে ভুল ধারণা
ইসলাম সম্পর্কে বিশদ না জনার কারণে এবং জানার চেষ্টা না করার কারণেও উপমহাদেশে আশুরাসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে অসংখ্য ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। যা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। এইসব ধারণা সমূহ হলো:
১) এই মাসে বিয়েশাদি না করা।
২) নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা।
৩) কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা।
৪) গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা।
৫) পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা।
৬) সব ধরনের আনন্দ উৎসব পরিহার করা ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত কাজগুলো হচ্ছে কুসংস্কার। এইসব কখনোই ইসলাতী রীতিনীতি নয়। ইসলামের সাথে এইসবের কোনো সম্পর্ক নেই।
আশুরার বিদআতী আমল
রাসূলুল্লাহ (সা.) কতৃক আশুরার আমল থেকে সরে গিয়ে আমরা দিনদিন নিত্যনতুন বিদআতে জড়িত হয়ে গেছি। বিশেষকরে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শিয়াদের বাড়াবাড়ির কারণে- সুন্নীদের মাঝেও এইসবের প্রচলন শুরু হয়েছে। যেমন:
১) হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর স্মরণে কাল্পনিক তাযিয়া বা নকল কবর নিয়ে মিছিল করা।
২) এইসব নকল তাযিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা।
৩) এইসব নকল তাযিয়ায় বা কবরে নজরানা স্বরূপ অর্থ প্রদান করা।
৪) কারবালার শোক প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেদের দেহে ছুরি ব্লেড ইত্যাদি দ্বারা আঘাত বা রক্তাক্ত করা।
৫) হুসাইন (রা.) শাহাদাতের স্বরণে হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে শোক, মাতম কিংবা বিলাপ ইত্যাদি করা।
৬) যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা।
৭) বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের প্রদর্শনী করা।
হুসাইনের (রা.) নামে শোকগাথার প্রচলন
আজ বিশ্বের শিয়াসহ সুন্নীদের কিছু অংশ আশুরার দিনে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শোক প্রকাশের যে পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে, তা হুসেইন (রা.) শাহাদাতের তিনশ বছরেও ছিলো না। আমরা ইবনুল আসীর কর্তৃক রচিত ‘আল-কামেল ফিত তারীখ’ ৭/২৭৯, ইবনে কাসীর (রাহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ ‘১৫/২৬১ (৩৫২ হিজরীর ঘটনাবলী) ও হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী (রাহ.) কৃত ‘ইবতালে আযাদারী’ কিতাব থেকে জানতে পারি- আশুরা উপলক্ষে শিয়াদের এইসব তাযিয়া মিছিল, কান্নাকাটি, আহাজারি, বুক পিঠ চাপড়ানো, ছুরি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের আঘাত করা ইত্যাদির সূচনা করেন “মুঈযযুদ দাওলা দাইলামী” নামে একজন শিয়া।
এই ব্যক্তি সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরীতে এইসব শোক তাযিয়া মিছিল করার হুকুম জারি করেন। যা পরবর্তীতে ৩৬৩ হিজরীতে আল-মুঈযযু লিদীনিল্লাহি ফাতিমী (বেদ্বীন কট্টর শিয়া) মিশরেও এই হুকুম জারি হয়।
সুতরাং এইসব শোক মিছিল কখনোই ইসলামের অংশ ছিলো না এবং নেই। যদি কেউ এইসব করে এবং সমর্থন করে তাহলে তার ঈমান সন্দেহে পতিত হবে।
সুতরাং আসুন পবিত্র এবং সম্মানিত মাস মহররমের দশ তারিখ আশুরার দিনকে আমরা ইবাদতের দিন হিসাবে পালন করি। সাওম পালনের পাশাপাশি যথাসাধ্য তাওবা-ইসতেগফারের মাধ্যমে নিজের পাপ সমূহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। একইসাথে আশুরার দিনে সত্যের জন্য হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে নিজেদের ঈমানকে উজ্জীবিত করি।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
৩ আগস্ট, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৫/০৮/২০২২ইমাম হোসেনকে ভালোবাসাই ঈমান।
-
সিবগাতুর রহমান ০৪/০৮/২০২২আল্লাহ্ আমাদের সকলের সহায় হোন