হিদায়াত পাওয়ার শর্তসমূহ কী কী
হিদায়াত পাওয়ার শর্তসমূহ কী কী?
পৃথিবীতে আল্লাহ জ্বীন এবং মানুষ সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য। অর্থাৎ জ্বীন এবং মানুষ দুনিয়াতে তাদের জীবন অতিবাহিত করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারাটাই হচ্ছে "হিদায়াত" অর্থাৎ সৎপথ প্রাপ্ত হওয়া। যারা আল্লাহর রহমতে হিদায়াত তথা সৎপথ প্রাপ্ত হয় তাঁরাই শুধুমাত্র ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।
প্রতিটি মানুষের হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়াটা একমাত্র আল্লাহর হাতে। একমাত্র তিনিই যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত তথা সৎপথ দান করেন।
আল্লাহ বলেন,
"এমনিভাবে আমি সুস্পষ্ট আয়াত রূপে কোরআন নাযিল করেছি এবং আল্লাহ-ই যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন।" (সূরাঃ হাজ্জ্ব, আয়াতঃ ১৬)
অন্য আয়াতে বলেন,
"আল্লাহ্যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে রাখেন।" [সূরা আনআম ৬:৩৯]
তিনি আরও বলেনঃ
"আল্লাহ্ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন হিদায়াতকারী নেই।" [সূরা যুমার, ৩৯:২৩]
উপরোক্ত আয়াত গুলো থেকে সুস্পষ্ট যে, হিদায়াত তথা সঠিক পথে চলার তৌফিক একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হিদায়াত দিবেন শুধুমাত্র তিনিই হিদায়াত প্রাপ্ত হবেন। সুতরাং এখন দেখার বিষয় যে, তিনি কোন কোন শ্রেণীর মানুষদের হিদায়াত দান করে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন।
হিদায়াত মূলত দুই ধরনের। এক হচ্ছে- কাউকে বিধর্মী থেকে ইসালামের পথে আসতে হিদায়াত করা। দুই হচ্ছে- ঈমান আনার পর সঠিক পথে অবিচল থাকার ব্যাপারে হিদায়াত দান করা।
এখন জানার চেষ্টা করবো, আমরা যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করছি, তারা কীভাবে সঠিক হিদায়াত পেতে পারি সেইসব শর্তসমূহ কী কী।
১) রাসুল সাঃ এর অনুসরণ:
একজন ঈমানদার তখনই সঠিক হিদায়াত প্রাপ্ত হবেন, যখন তিনি তার জীবন রাসুলসাঃ এর আদর্শের অনুসরণে পরিচালিত করবেন। অর্থাৎ ঈমান আনার পর যারা যাবতীয় আমল শুধুমাত্র রাসুলসাঃ এর ত্বরিকায় পালন করেন একমাত্র তারাই হিদায়াত প্রাপ্ত হয়ে সফলকাম হবেন।
আল্লাহ বলেন,
‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩১)
এখানে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আল্লাহর ভালোবাসা তথা হিদায়াত পেতে চাইলে অবশ্যই রাসুলসাঃ কে ভালোবেসে তাঁকে অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে হবে।
এখন যদি কেউ রাসুলসাঃ এর সহীহ্ আকিদা এবং আমল অনুসরণ না করে নিজের মতো কিংবা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণে চলে তাহলে তারা কখনোই আল্লাহর ভালোবাসা এবং হিদায়াত কিছুই পাবে না।
২) দ্বীনের সঠিক জ্ঞানার্জন করা:
যারা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে না তারা সহজে আল্লাহর হিদায়াত পায় না। অর্থাৎ আল্লাহ এবং আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে জানার চেষ্টা এবং আগ্রহ থাকলে তবেই একজন ঈমানদার আল্লাহর হিদায়াত প্রাপ্ত হবেন।
আল্লাহ বলেন,
"যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।" [ সুরা যুমার ৩৯:৯ ]
অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
"যে ব্যক্তি জানে যে, যা কিছু পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে তা সত্য সে কি ঐ ব্যক্তির সমান, যে অন্ধ? তারাই বোঝে, যারা বোধশক্তি সম্পন্ন।" [ সুরা রা’দ ১৩:১৯ ]
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ দ্বীনের জ্ঞানার্জনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। অর্থাৎ সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সঠিক আকিদা এবং আমল করা। সুতরাং যারা সঠিক জ্ঞান অর্জনের দ্বারা আমল করার চেষ্টা করে আল্লাহ তাদের হিদায়াতের রাস্তায় পরিচালিত করেন। দ্বীনের ব্যাপারে যাদের জ্ঞান নেই, আর যাদের জ্ঞান আছে তারা কখনোই সমান নয়। সুতরাং জ্ঞানার্জন হিদায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩) কুরআন জানা:
আল্লাহর হিদায়াতের সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম উৎস হলো পবিত্র কুরআন। যারা সঠিকভাবে কুরআন বুঝে এবং জানার চেষ্টা করে তাঁরাই হিদায়াতের পথে থাকে। দ্বীনের যেকোনো বিষয়ে জানতে হলে সর্বপ্রথম কুরআনের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর কুরআন যিনি যতবেশী জানবেন তিনি ততবেশী হিদায়াতের পথে থাকবেন।
আল্লাহ বলেন,
"(হে রাসুলসাঃ) আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ (কুরআন) নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ।" [ সুরা নাহল ১৬:৮৯ ]
আল্লাহ আরো বলেন,
"এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে।" [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৯ ]
সুতরাং কুরআন হচ্ছে হিদায়াতের অন্যতম একটি মাধ্যম।
৪) সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা:
হিদায়াত পাওয়ার আরেকটি শর্ত হলো আল্লাহর উপর সর্বদা ভরসা রাখা। যারা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তারা অবশ্যই হিদায়াত প্রাপ্ত হয়। জীবনের প্রতিটি উত্থান পতনে সবসময় আল্লাহর ভরসা রাখা হিদায়াত প্রাপ্তির লক্ষণ।
আল্লাহ বলেন,
"যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন।" [ সুরা তালাক ৬৫:৩ ]"
৫) সৎপথে চলা:
অসৎ ব্যক্তি কখনোই হিদায়াতের উপযুক্ত নয়। যারা ব্যক্তি জীবনে প্রতিটি স্তরে সৎপথ অবলম্বন করে তারা হিদায়াত প্রাপ্ত হয়।
আল্লাহ বলেন,
"যারা সৎপথে চলে আল্লাহ তাদের পথপ্রাপ্তি বৃদ্ধি করেন এবং স্থায়ী সৎকর্মসমূহ তোমার পালনকর্তার কাছে সওয়াবের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসেবেও শ্রেষ্ট।" (সূরাঃ মারইয়াম, আয়াতঃ ৭৬)
অন্য আয়াতে বলেন,
"যারা সৎপথপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের সৎপথপ্রাপ্তি আরও বেড়ে যায় এবং আল্লাহ তাদেরকে তাকওয়া দান করেন।" [ সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৭ ]
৬) ফাসেকী পরিহার করা:
হিদায়াত প্রাপ্তির আরেকটি অন্যতম শর্ত হলো ফাসেকী পরিহার করা। ব্যক্তি জীবনে ফাসেক বা পাপী ব্যক্তি কখনো হিদায়াত প্রাপ্ত হয় না।
আল্লাহ বলেন,
"আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন অথবা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করুন একই কথা; আপনি সত্তর বার তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না। এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে কুফরী করেছে। আর আল্লাহ ফাসেক (পাপী) সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।" (সূরা তওবা: ৮০)
৭) সত্য গ্রহণে আগ্রহী:
যারা সর্বদা সত্যের অনুসন্ধান করে একমাত্র তারাই সত্যের আলো দেখতে পায়। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে যেকোনো সত্য যেকোনো সময় সামনে আসার সাথে সাথেই যারা তা মানতে পারে কেবলমাত্র তারাই হিদায়াতের অধিকারী হয়।
অর্থাৎ কারো সামনে এমন সত্য এসে উপস্থিত হয়েছে, যা তার অতীতের ঈমান এবং আমলের বিপরীত। এখন সমস্ত দলিলের বিবেচনায় যদি আগের ঈমান ও আমল ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে যা সঠিক তা মেনে নিতে যে প্রস্তুত কেবল সে ব্যক্তিই আল্লাহর হিদায়াত পাতে পারে।
আল্লাহ বলেন,
"তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের পালনকর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।" [ সুরা বাকারা ২:২৮৫ ]
৮) চেষ্টা করা:
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, ইবলিশ শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। এই শয়তানের কাজই হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করে আল্লাহর হিদায়াত থেকে দূরে রাখা। তাই যখনই মানুষ হতাশ হয় ব্যর্থ হয় অথবা প্রচুর প্রাচুর্যের দেখা পায়, তখনই শয়তান প্ররোচনা দেয়। কাউকে দুঃখ দেখিয়ে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কাউকে প্রাচুর্যের লোভ ক্ষমতা ইত্যাদি দেখিয়ে হিদায়াতের পথ থেকে দূরে নিয়ে যায়।
তাই চেষ্টা করতে হবে হাজারো দুঃখ কষ্টে আল্লাহকে ভুলে না যাওয়া। এবং প্রাচুর্যের সময় বেশী বেশী শুকরিয়া আদায় করা। অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহর রাস্তায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির মধ্যে থাকার জন্য চেষ্টা করা।
আল্লাহ বলেন,
"যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।" [ সুরা আনকাবুত ২৯:৬৯ ]
আল্লাহ আরো বলেন,
"মানুষ যা চেষ্টা করে, তাই সে পায়।" [সুরা আন নাজম : ৩৯ ]
"আর কারো ঈমান আনা হতে পারে না, যতক্ষণ না আল্লাহর হুকুম হয়। পক্ষান্তরে তিনি অপবিত্রতা আরোপ করেন যারা বুদ্ধি প্রয়োগ করে না তাদের উপর।" [ সুরা ইউনুস ১০:১০০ ]
সুতরাং হিদায়াতের পথে জ্ঞান বুদ্ধি ইত্যাদি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকাটাও হিদায়াত প্রাপ্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
৯) নিয়মিত আমল:
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিয়মিত আমল করাও হিদায়াতের একটি শর্ত। কেউ সালাতের আমল নিয়মিত করলে, এরমাধ্যমেও আল্লাহ তাকে হিদায়াত দিবেন। প্রতি ওয়াক্ত সালাতে প্রতিটি রাকাতে আমরা সূরা ফাতেহা পড়ি। যা একটি দোয়াময় সূরা। এই দোয়াতে রয়েছে হিদায়াতের পথে রাখার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন।
আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন, আমরা যেন প্রতিনিয়তই সালাতে বলি,
"(হে আল্লাহ) আমাকে সরল পথে অটল রাখুন।" [সূরা ফাতিহা, ১:৬]
সুতরাং জেনে বুঝে সালাতসহ অন্যান্য আমল নিয়মিত আদায় করতে পারাটা হচ্ছে হিদায়েতের লক্ষণ। ইসলামের যাবতীয় আমল নিয়মিত আদায় করাটা একটি আল্লাহর নিয়ামত। যা দ্বারা তিনি আমাদের হিদায়াতের পথে পরিচালিত করেন ।
১০) হিদায়াতে অটল থাকার দোয়া করা:
পৃথিবীতে সবচাইতে বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত ব্যক্তি হলেন নবী রাসুল (আঃ) গণ। আল্লাহ প্রতিটি নবী রাসুলদের নিজে হিদায়াত দিয়েছেন। এ সত্ত্বেও নবী রাসুলগণ প্রতিনিয়ত হিদায়াতের পথে অটল থাকার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।
আমাদের রাসুল (সাঃ) প্রতিনিয়ত হিদায়াতের দোয়া করতেন এবং সবাইকে এইসব দোয়া পড়তে ও আমল করতে শিক্ষা দিতেন। সুতরাং হিদায়াত প্রাপ্তি এবং এতে অটল থাকার জন্যও দোয়া করা একটি অন্যতম শর্ত।
১১) আল্লাহর স্বরণে থাকা:
সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্বরণে থাকাটা হিদায়াতের একটি শর্ত। অর্থাৎ জীবনযাপনের প্রতিটি সময় আল্লাহর স্বরণ থেকে গাফেল না হওয়া হচ্ছে হিদায়াতের লক্ষণ।
আল্লাহ বলেন,
"যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী।" [সুরা যূখরুফ ৪৩:৩৬]
অর্থাৎ কেউ আল্লাহ থেকে দূরে সরে গেলে তার জন্য আল্লাহ নিজেই একজন শয়তান নিয়োগ করেন। যাতে সেই শয়তান তাকে পথভ্রষ্ট করে হিদায়াত থেকে দূরে রাখতে পারে। শুধু তাইনয় এই শয়তান সেই আল্লাহ বিমুখ বান্দাকে দিয়ে এমন সব কাজ করিয়ে নেয় যা আল্লাহর বিধানের বিপরীত। অথচ সে মনে করে সে ভালো কাজই করছে।
এব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
"শয়তানরাই মানুষকে সৎপথে বাধা দান করে, আর মানুষ মনে করে যে, তারা সৎপথে রয়েছে।" [সুরা যূখরুফ ৪৩:৩৭]
১২) গোমরাহী পরিহার করা :
গোমরাহ ব্যক্তি কখনোই হিদায়াতের স্বাদ পায় না। গোমরাহী অর্থ হলো নিজে যা বুঝে সে মতেই অটল থাকা। সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরও সত্যকে গ্রহণ না করা। পূর্বপুরুষদের মত বা অধিকাংশের মতকে সত্যের মানদন্ড ধরে সেই মতকেই চিরসত্য মনে করা হচ্ছে গোমরাহী।
এইসব ব্যক্তি কখনোই নিজের মতের বাইরে কিছুই চিন্তা করতে পারে না। যারফলে তারা সত্যকে মেনে নিতে পারে না। আর এই কারণেই তারা হিদায়াতের স্বাদ থেকে দূরে সরে যায়।
আল্লাহ বলেন,
"তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে। বস্তুতঃ তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং তারা হেদায়েতও লাভ করতে পারেনি।" [সুরা বাকারা ২:১৬]
সুতরাং গোমরাহী করাটা হিদায়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি দিক। অতীতে অসংখ্য জাতি গোষ্ঠী শুধুমাত্র গোমরাহীর কারণে আল্লাহর আযাবে পতিত হয়েছে।
১৩) পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ না করা:
অতীতের অসংখ্য জাতি গোষ্ঠী শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের কারণে হিদায়াত প্রাপ্ত হয়নি। আমাদেরও অধিকাংশ মানুষ পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের কারণে হিদায়াতের আলো পায় না। কিছু মানুষের বদ্ধমূল ধারণা যে, তাদের বাপ দাদারা যুগ যুগ ধরে যা পালন করে আসছে তার সবই সঠিক। তাদের যুক্তি হলো বাপ দাদারা সঠিক না হলে কেন এইসব এতো যুগ ধরে পালন করে আসছে?
তাদের সামনে সমস্ত দলীল নিদর্শনের সত্য উন্মোচিত হলেও তারা তাদের বাপ দাদার আদর্শকেই সত্যের মাপকাঠি ধরে নিয়ে জীবনযাপন করে। যারফলে তারা হিদায়াত বঞ্চিত হয়।
আল্লাহ বলেন,
"যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রসূলের দিকে আসো। তখন তারা বলে, আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট, যার উপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ দাদারা কোন জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েত প্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে?" [সুরা মায়েদা ৫:১০৪]
আল্লাহ আরও বলেন,
"তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব। শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে দাওয়াত দেয়, তবুও কি?" [সুরা লুকমান ৩১:২১]
সুতরাং পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুসরণ হিদায়াতের পথে বড় বাঁধা। সত্য উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হিদায়াত বঞ্চিতদের লক্ষণ।
১৪) অত্যাচারী না হওয়া:
অত্যাচারী অসৎ ব্যক্তি কখনোই হিদায়াতের স্বাদ পায় না। নিজের জ্ঞান গরিমা, আত্ম অহংকার বিত্ত বৈভব ক্ষমতার ও প্রাচুর্যের কারণে অনেক ব্যক্তি অত্যাচারী হয়ে উঠে। যখন মানুষ অত্যাচারী হয়ে উঠে তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে সে সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। আর এই কারণেই আল্লাহ বলেন,
"নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।" [সুরা আন’য়াম ৬:১৪৪ ]
১৫) সামাজিক অনুসরণ না করা:
অন্ধ অনুসরণের মতো সামাজিক অনুসরণও মানুষকে আল্লাহর হিদায়াত থেকে দূরে রাখে। অর্থাৎ কিছু কিছু সামাজিক বিষয় আছে যার আচার অনুষ্ঠান পালন না করলে সমাজের মানুষ খারাপ বলবে। এইসব বিষয়ে সঠিক সত্য জানার পরও পরিহার না করে সামাজিক চাপে তা পালন করা এবং চালিয়ে যাওয়াও হিদায়াতের পথে অন্তরায়।
সঠিক ঈমান আমল জানার পরও শুধুমাত্র সামাজিক সম্মান মান মর্যাদা ইত্যাদির কারণে সত্যকে প্রকাশ না করা এবং সত্যকে গ্রহণ না করাও হিদায়াত প্রাপ্তির বাঁধা। আমাদের সমাজে মানুষের জন্ম মৃত্যু নিয়ে এমন এমন আচার অনুষ্ঠান আছে যা ইসলাম সম্মত নয়। তবুও আমরা অধিকাংশ এইসব আচার অনুষ্ঠান মেনে নিচ্ছে শুধুমাত্র সামাজিক কারণে।
সামাজিক কারণটা হচ্ছে অনেকটা সমাজের নেতাদের অনুসরণ। আমরা সমাজে আজ ইসলামের অনুসরণের চাইতে দুনিয়াবী নেতা নেতৃত্বের অনুসরণ করছি বেশী। এইসব অনুসরণ আমাদের হিদায়াতের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতৃত্বের অনুসরণে আজ আমরা নিজেদের ধর্মহীনতায় নামিয়ে এনেছি।
আল্লাহ এই বিষয়ে বলেন,
"তারা (পাপী জাহান্নামীরা) আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।" [সুরা আহযাব ৩৩:৬৭]
সুতরাং সামাজিক অনুসরণ এবং দুনিয়াবী নেতৃত্বের অনুসরণ হিদায়াতের অন্তরায়।
১৬) বিদআতের অনুসরণ না করা:
ইসলামী সুস্পষ্ট নীতিমালার বাইরে গিয়ে অনেক লোক বিদআতের অনুসরণে জড়িয়ে পড়ে। যারা জেনেশুনে বিদআতে জড়িয়ে যায় তাদের আল্লাহ সহজে হিদায়াতের রাস্তা দেখান না। সুতরাং বিদআতের অনুসরণ না করাও হেদায়েতের একটি শর্ত।
বিদআত নিয়ে রাসুলসাঃ বলেন,
জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হামদ ও ছালাতের পর বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হ’ল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হ’ল ভ্রষ্টতা’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১)। আর নাসাঈতে রয়েছে, ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)।
সুতরাং বিদআত করে কেউ হিদায়াতের আলো পাবে না। বিদআত মুক্ত থাকাটাই হচ্ছে হিদায়াতের পথ প্রাপ্তির শর্ত।
১৭) প্রবৃত্তির অনুসরণ না করা:
মানুষ মাত্রই প্রবৃত্তির অনুসারী। আল্লাহ মানুষকে এমন ভাবেই সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে নিজের খেয়ালখুশি মতো চলতে পারে। যারফলে মানুষ চাইলেই যা ইচ্ছা তা করতে পারে। আর এটাই হচ্ছে মানুষের প্রবৃত্তি।
এই প্রবৃত্তির অনুসারী ব্যক্তিরা সহজে হিদায়াতের আলো পায় না। কেননা তাদের যা বলা হয় তারা তা করতে ইচ্ছুক নয়। তারা তাদের মন মতো ইবাদত আমল করতে আগ্রহী। যারা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলে তাদের আল্লাহ হিদায়াত দেন না।
আল্লাহ বলেন,
"অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জানবেন, তারা শুধু নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহর হেদায়েতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না।" [সুরা কাসাস ২৮:৫০]
১৮) মূর্খতা পরিহার করা:
জ্ঞানহীন মানেই হচ্ছে মূর্খ! অর্থাৎ যার ভালো মন্দ বুঝার ক্ষমতা থাকলেও তা কাজে না লাগিয়ে জ্ঞানহীনের মতো সবকিছু বিবেচনা করে, সে হচ্ছে সবচেয়ে বড় মূর্খ। কেননা যেকোনো সত্য যখন সামনে আসে তখন তা নিজের জ্ঞান দ্বারা সত্যতা যাচাই বছাই করাটা জ্ঞানীর কাজ। আর জ্ঞান দ্বারা সত্যতা যাচাই না করে নিজের আগের ধারণার উপর অটল থাকাটা হচ্ছে মূর্খতা। যারা নিজেদের থেকে মূর্খতা পরিহার করতে পারে না তা কখনোই হিদায়াত পায় না।
আল্লাহ বলেন,
"(হে মুসা) আমি আপনাকে উপপদেশ দিচ্ছি যে, আপনি অজ্ঞদের (মূর্খদের) দলভুক্ত হবেন না।" [সুরা হুদ ১১:৪৬]
১৯) অহংকার না করা:
অহংকারী না হওয়া হিদায়াত প্রাপ্তির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। যে বা যারা অহংকারী তারা কখনোই আল্লাহর হিদায়াত প্রাপ্ত হন না। বংশমর্যাদা, অর্থ বৈভব, জ্ঞানগর্ভ, বিত্তশালীতা ইত্যাদি মানুষের অন্তরে হিংসা এবং অহংকারের জন্ম দেয়। এই অহংকারের কারণেই অনেক মানুষ সহজে সত্য গ্রহণ করতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।" (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)
২০) অন্তরের বক্রতা পরিহার করা:
অন্তরের বক্রতা হিদায়েতের অন্তরায়। এর কাজ হলো মানুষের মনে যেকোনো সত্য বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করিয়ে দেওয়া। যেকোনো সঠিক কাজে খুঁত ধরা, সত্য প্রমাণিত হওয়ার পরও বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করা।
আল্লাহ বলেন,
"স্মরণ কর, যখন মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা কেন আমাকে কষ্ট দাও, অথচ তোমরা জান যে, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রসূল। অতঃপর তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না। [ সুরা সফ ৬১:৫ ] "
অন্তরের বক্রতার আরেকটি দিক হলো, সহজ সরল বিষয় অন্বেষণ না করে জটিল ও কুটিল বিষয় অন্বেষণ এবং অনুসরণ করা।
যেমন আল্লাহ বলেন,
"তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর।" [সুরা ইমরান ৩:৭]
সুতরাং অন্তরের বক্রতা হিদায়াতের পথে বড় প্রতিবন্ধক। যারা এই রোগে আক্রান্ত হয় আল্লাহ তাদের রোগ আরো বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্তাআলা বলেন,
"কিন্তু তারা যখন বাঁকা পথ ধরল, তখন আল্লাহ্ও তাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিলেন।" [সূরা আছ-ছফ, ৬১:৫]
২১) অধিকাংশের অনুসরণ না করা:
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ করতে নিষেধ এবং নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা অধিকাংশ মানুষ যা করে তা সবসময়ই সঠিক হবে এমন নয়। অধিকাংশ মানুষ যা করছে তা নিজের জ্ঞান দিয়ে বিচার বিবেচনা না করে অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না। দল ভারী হলেই যে সেই দল সত্য তা কিন্তু কখনোই নয়।
এব্যাপারে আল্লাহ বিভিন্ন আয়াত নাযিল করেছেন।
তাদের অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই। (৫/১০৩) অধিকাংশই জানে না। (৬/৩৭) অধিকাংশই মূর্খ। (৬/১১১) আর তাদের অধিকাংশ লোককেই আমি প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নকারীরূপে পাইনি; বরং তাদের অধিকাংশকে পেয়েছি হুকুম অমান্যকারী। (৭/১০২) অধিকাংশ সত্যকে অপছন্দ করে। (২৩/৭০) অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়। (২৬/ ৮) অধিকাংশই মিথ্যাবাদী। (২৬/ ২২৩)
উপরোক্ত আয়াত ছাড়াও আরো অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ অধিকাংশ মানুষের বিরোধীতা করেছেন। অর্থাৎ অধিকাংশের মত সবসময় ঠিক নয়। অধিকাংশের মতের উপর জীবনযাপন করাটা হচ্ছে হিদায়াত বঞ্চিত হওয়ার লক্ষণ।
যারা নিজের বিবেক বুদ্ধি কাজে না লাগিয়ে অধিকাংশ মানুষের মতের সাথে নিজেকে একাত্ম ঘোষণা করে তারা কখনো হিদায়াতের রাস্তা পায় না। অতএব হিদায়াত পাওয়ার আরেকটি শর্ত হলো অধিকাংশ মানুষের অন্ধ অনুসরণ না করা।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা হিদায়েতের বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কে জানতে পারলাম। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম একটি সহজ সরল জীবনবিধান। যারা নিজেদের সৎ সরল এবং সত্য পথে পরিচালিত করবে, সেইসাথে কুরআন হাদিস থেকে জ্ঞানার্জন করবে কেবলমাত্র তাঁরাই আল্লাহর হিদায়াত প্রাপ্ত হবে।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
পৃথিবীতে আল্লাহ জ্বীন এবং মানুষ সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য। অর্থাৎ জ্বীন এবং মানুষ দুনিয়াতে তাদের জীবন অতিবাহিত করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারাটাই হচ্ছে "হিদায়াত" অর্থাৎ সৎপথ প্রাপ্ত হওয়া। যারা আল্লাহর রহমতে হিদায়াত তথা সৎপথ প্রাপ্ত হয় তাঁরাই শুধুমাত্র ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।
প্রতিটি মানুষের হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়াটা একমাত্র আল্লাহর হাতে। একমাত্র তিনিই যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত তথা সৎপথ দান করেন।
আল্লাহ বলেন,
"এমনিভাবে আমি সুস্পষ্ট আয়াত রূপে কোরআন নাযিল করেছি এবং আল্লাহ-ই যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন।" (সূরাঃ হাজ্জ্ব, আয়াতঃ ১৬)
অন্য আয়াতে বলেন,
"আল্লাহ্যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে রাখেন।" [সূরা আনআম ৬:৩৯]
তিনি আরও বলেনঃ
"আল্লাহ্ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন হিদায়াতকারী নেই।" [সূরা যুমার, ৩৯:২৩]
উপরোক্ত আয়াত গুলো থেকে সুস্পষ্ট যে, হিদায়াত তথা সঠিক পথে চলার তৌফিক একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হিদায়াত দিবেন শুধুমাত্র তিনিই হিদায়াত প্রাপ্ত হবেন। সুতরাং এখন দেখার বিষয় যে, তিনি কোন কোন শ্রেণীর মানুষদের হিদায়াত দান করে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন।
হিদায়াত মূলত দুই ধরনের। এক হচ্ছে- কাউকে বিধর্মী থেকে ইসালামের পথে আসতে হিদায়াত করা। দুই হচ্ছে- ঈমান আনার পর সঠিক পথে অবিচল থাকার ব্যাপারে হিদায়াত দান করা।
এখন জানার চেষ্টা করবো, আমরা যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করছি, তারা কীভাবে সঠিক হিদায়াত পেতে পারি সেইসব শর্তসমূহ কী কী।
১) রাসুল সাঃ এর অনুসরণ:
একজন ঈমানদার তখনই সঠিক হিদায়াত প্রাপ্ত হবেন, যখন তিনি তার জীবন রাসুলসাঃ এর আদর্শের অনুসরণে পরিচালিত করবেন। অর্থাৎ ঈমান আনার পর যারা যাবতীয় আমল শুধুমাত্র রাসুলসাঃ এর ত্বরিকায় পালন করেন একমাত্র তারাই হিদায়াত প্রাপ্ত হয়ে সফলকাম হবেন।
আল্লাহ বলেন,
‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩১)
এখানে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আল্লাহর ভালোবাসা তথা হিদায়াত পেতে চাইলে অবশ্যই রাসুলসাঃ কে ভালোবেসে তাঁকে অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে হবে।
এখন যদি কেউ রাসুলসাঃ এর সহীহ্ আকিদা এবং আমল অনুসরণ না করে নিজের মতো কিংবা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণে চলে তাহলে তারা কখনোই আল্লাহর ভালোবাসা এবং হিদায়াত কিছুই পাবে না।
২) দ্বীনের সঠিক জ্ঞানার্জন করা:
যারা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে না তারা সহজে আল্লাহর হিদায়াত পায় না। অর্থাৎ আল্লাহ এবং আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে জানার চেষ্টা এবং আগ্রহ থাকলে তবেই একজন ঈমানদার আল্লাহর হিদায়াত প্রাপ্ত হবেন।
আল্লাহ বলেন,
"যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।" [ সুরা যুমার ৩৯:৯ ]
অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
"যে ব্যক্তি জানে যে, যা কিছু পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে তা সত্য সে কি ঐ ব্যক্তির সমান, যে অন্ধ? তারাই বোঝে, যারা বোধশক্তি সম্পন্ন।" [ সুরা রা’দ ১৩:১৯ ]
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ দ্বীনের জ্ঞানার্জনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। অর্থাৎ সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সঠিক আকিদা এবং আমল করা। সুতরাং যারা সঠিক জ্ঞান অর্জনের দ্বারা আমল করার চেষ্টা করে আল্লাহ তাদের হিদায়াতের রাস্তায় পরিচালিত করেন। দ্বীনের ব্যাপারে যাদের জ্ঞান নেই, আর যাদের জ্ঞান আছে তারা কখনোই সমান নয়। সুতরাং জ্ঞানার্জন হিদায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩) কুরআন জানা:
আল্লাহর হিদায়াতের সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম উৎস হলো পবিত্র কুরআন। যারা সঠিকভাবে কুরআন বুঝে এবং জানার চেষ্টা করে তাঁরাই হিদায়াতের পথে থাকে। দ্বীনের যেকোনো বিষয়ে জানতে হলে সর্বপ্রথম কুরআনের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর কুরআন যিনি যতবেশী জানবেন তিনি ততবেশী হিদায়াতের পথে থাকবেন।
আল্লাহ বলেন,
"(হে রাসুলসাঃ) আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ (কুরআন) নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ।" [ সুরা নাহল ১৬:৮৯ ]
আল্লাহ আরো বলেন,
"এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে।" [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৯ ]
সুতরাং কুরআন হচ্ছে হিদায়াতের অন্যতম একটি মাধ্যম।
৪) সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা:
হিদায়াত পাওয়ার আরেকটি শর্ত হলো আল্লাহর উপর সর্বদা ভরসা রাখা। যারা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তারা অবশ্যই হিদায়াত প্রাপ্ত হয়। জীবনের প্রতিটি উত্থান পতনে সবসময় আল্লাহর ভরসা রাখা হিদায়াত প্রাপ্তির লক্ষণ।
আল্লাহ বলেন,
"যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন।" [ সুরা তালাক ৬৫:৩ ]"
৫) সৎপথে চলা:
অসৎ ব্যক্তি কখনোই হিদায়াতের উপযুক্ত নয়। যারা ব্যক্তি জীবনে প্রতিটি স্তরে সৎপথ অবলম্বন করে তারা হিদায়াত প্রাপ্ত হয়।
আল্লাহ বলেন,
"যারা সৎপথে চলে আল্লাহ তাদের পথপ্রাপ্তি বৃদ্ধি করেন এবং স্থায়ী সৎকর্মসমূহ তোমার পালনকর্তার কাছে সওয়াবের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসেবেও শ্রেষ্ট।" (সূরাঃ মারইয়াম, আয়াতঃ ৭৬)
অন্য আয়াতে বলেন,
"যারা সৎপথপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের সৎপথপ্রাপ্তি আরও বেড়ে যায় এবং আল্লাহ তাদেরকে তাকওয়া দান করেন।" [ সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৭ ]
৬) ফাসেকী পরিহার করা:
হিদায়াত প্রাপ্তির আরেকটি অন্যতম শর্ত হলো ফাসেকী পরিহার করা। ব্যক্তি জীবনে ফাসেক বা পাপী ব্যক্তি কখনো হিদায়াত প্রাপ্ত হয় না।
আল্লাহ বলেন,
"আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন অথবা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করুন একই কথা; আপনি সত্তর বার তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না। এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে কুফরী করেছে। আর আল্লাহ ফাসেক (পাপী) সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।" (সূরা তওবা: ৮০)
৭) সত্য গ্রহণে আগ্রহী:
যারা সর্বদা সত্যের অনুসন্ধান করে একমাত্র তারাই সত্যের আলো দেখতে পায়। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে যেকোনো সত্য যেকোনো সময় সামনে আসার সাথে সাথেই যারা তা মানতে পারে কেবলমাত্র তারাই হিদায়াতের অধিকারী হয়।
অর্থাৎ কারো সামনে এমন সত্য এসে উপস্থিত হয়েছে, যা তার অতীতের ঈমান এবং আমলের বিপরীত। এখন সমস্ত দলিলের বিবেচনায় যদি আগের ঈমান ও আমল ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে যা সঠিক তা মেনে নিতে যে প্রস্তুত কেবল সে ব্যক্তিই আল্লাহর হিদায়াত পাতে পারে।
আল্লাহ বলেন,
"তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের পালনকর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।" [ সুরা বাকারা ২:২৮৫ ]
৮) চেষ্টা করা:
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, ইবলিশ শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। এই শয়তানের কাজই হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করে আল্লাহর হিদায়াত থেকে দূরে রাখা। তাই যখনই মানুষ হতাশ হয় ব্যর্থ হয় অথবা প্রচুর প্রাচুর্যের দেখা পায়, তখনই শয়তান প্ররোচনা দেয়। কাউকে দুঃখ দেখিয়ে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কাউকে প্রাচুর্যের লোভ ক্ষমতা ইত্যাদি দেখিয়ে হিদায়াতের পথ থেকে দূরে নিয়ে যায়।
তাই চেষ্টা করতে হবে হাজারো দুঃখ কষ্টে আল্লাহকে ভুলে না যাওয়া। এবং প্রাচুর্যের সময় বেশী বেশী শুকরিয়া আদায় করা। অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহর রাস্তায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির মধ্যে থাকার জন্য চেষ্টা করা।
আল্লাহ বলেন,
"যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।" [ সুরা আনকাবুত ২৯:৬৯ ]
আল্লাহ আরো বলেন,
"মানুষ যা চেষ্টা করে, তাই সে পায়।" [সুরা আন নাজম : ৩৯ ]
"আর কারো ঈমান আনা হতে পারে না, যতক্ষণ না আল্লাহর হুকুম হয়। পক্ষান্তরে তিনি অপবিত্রতা আরোপ করেন যারা বুদ্ধি প্রয়োগ করে না তাদের উপর।" [ সুরা ইউনুস ১০:১০০ ]
সুতরাং হিদায়াতের পথে জ্ঞান বুদ্ধি ইত্যাদি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকাটাও হিদায়াত প্রাপ্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
৯) নিয়মিত আমল:
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিয়মিত আমল করাও হিদায়াতের একটি শর্ত। কেউ সালাতের আমল নিয়মিত করলে, এরমাধ্যমেও আল্লাহ তাকে হিদায়াত দিবেন। প্রতি ওয়াক্ত সালাতে প্রতিটি রাকাতে আমরা সূরা ফাতেহা পড়ি। যা একটি দোয়াময় সূরা। এই দোয়াতে রয়েছে হিদায়াতের পথে রাখার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন।
আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন, আমরা যেন প্রতিনিয়তই সালাতে বলি,
"(হে আল্লাহ) আমাকে সরল পথে অটল রাখুন।" [সূরা ফাতিহা, ১:৬]
সুতরাং জেনে বুঝে সালাতসহ অন্যান্য আমল নিয়মিত আদায় করতে পারাটা হচ্ছে হিদায়েতের লক্ষণ। ইসলামের যাবতীয় আমল নিয়মিত আদায় করাটা একটি আল্লাহর নিয়ামত। যা দ্বারা তিনি আমাদের হিদায়াতের পথে পরিচালিত করেন ।
১০) হিদায়াতে অটল থাকার দোয়া করা:
পৃথিবীতে সবচাইতে বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত ব্যক্তি হলেন নবী রাসুল (আঃ) গণ। আল্লাহ প্রতিটি নবী রাসুলদের নিজে হিদায়াত দিয়েছেন। এ সত্ত্বেও নবী রাসুলগণ প্রতিনিয়ত হিদায়াতের পথে অটল থাকার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।
আমাদের রাসুল (সাঃ) প্রতিনিয়ত হিদায়াতের দোয়া করতেন এবং সবাইকে এইসব দোয়া পড়তে ও আমল করতে শিক্ষা দিতেন। সুতরাং হিদায়াত প্রাপ্তি এবং এতে অটল থাকার জন্যও দোয়া করা একটি অন্যতম শর্ত।
১১) আল্লাহর স্বরণে থাকা:
সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্বরণে থাকাটা হিদায়াতের একটি শর্ত। অর্থাৎ জীবনযাপনের প্রতিটি সময় আল্লাহর স্বরণ থেকে গাফেল না হওয়া হচ্ছে হিদায়াতের লক্ষণ।
আল্লাহ বলেন,
"যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী।" [সুরা যূখরুফ ৪৩:৩৬]
অর্থাৎ কেউ আল্লাহ থেকে দূরে সরে গেলে তার জন্য আল্লাহ নিজেই একজন শয়তান নিয়োগ করেন। যাতে সেই শয়তান তাকে পথভ্রষ্ট করে হিদায়াত থেকে দূরে রাখতে পারে। শুধু তাইনয় এই শয়তান সেই আল্লাহ বিমুখ বান্দাকে দিয়ে এমন সব কাজ করিয়ে নেয় যা আল্লাহর বিধানের বিপরীত। অথচ সে মনে করে সে ভালো কাজই করছে।
এব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
"শয়তানরাই মানুষকে সৎপথে বাধা দান করে, আর মানুষ মনে করে যে, তারা সৎপথে রয়েছে।" [সুরা যূখরুফ ৪৩:৩৭]
১২) গোমরাহী পরিহার করা :
গোমরাহ ব্যক্তি কখনোই হিদায়াতের স্বাদ পায় না। গোমরাহী অর্থ হলো নিজে যা বুঝে সে মতেই অটল থাকা। সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরও সত্যকে গ্রহণ না করা। পূর্বপুরুষদের মত বা অধিকাংশের মতকে সত্যের মানদন্ড ধরে সেই মতকেই চিরসত্য মনে করা হচ্ছে গোমরাহী।
এইসব ব্যক্তি কখনোই নিজের মতের বাইরে কিছুই চিন্তা করতে পারে না। যারফলে তারা সত্যকে মেনে নিতে পারে না। আর এই কারণেই তারা হিদায়াতের স্বাদ থেকে দূরে সরে যায়।
আল্লাহ বলেন,
"তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে। বস্তুতঃ তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং তারা হেদায়েতও লাভ করতে পারেনি।" [সুরা বাকারা ২:১৬]
সুতরাং গোমরাহী করাটা হিদায়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি দিক। অতীতে অসংখ্য জাতি গোষ্ঠী শুধুমাত্র গোমরাহীর কারণে আল্লাহর আযাবে পতিত হয়েছে।
১৩) পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ না করা:
অতীতের অসংখ্য জাতি গোষ্ঠী শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের কারণে হিদায়াত প্রাপ্ত হয়নি। আমাদেরও অধিকাংশ মানুষ পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের কারণে হিদায়াতের আলো পায় না। কিছু মানুষের বদ্ধমূল ধারণা যে, তাদের বাপ দাদারা যুগ যুগ ধরে যা পালন করে আসছে তার সবই সঠিক। তাদের যুক্তি হলো বাপ দাদারা সঠিক না হলে কেন এইসব এতো যুগ ধরে পালন করে আসছে?
তাদের সামনে সমস্ত দলীল নিদর্শনের সত্য উন্মোচিত হলেও তারা তাদের বাপ দাদার আদর্শকেই সত্যের মাপকাঠি ধরে নিয়ে জীবনযাপন করে। যারফলে তারা হিদায়াত বঞ্চিত হয়।
আল্লাহ বলেন,
"যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রসূলের দিকে আসো। তখন তারা বলে, আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট, যার উপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ দাদারা কোন জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েত প্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে?" [সুরা মায়েদা ৫:১০৪]
আল্লাহ আরও বলেন,
"তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব। শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে দাওয়াত দেয়, তবুও কি?" [সুরা লুকমান ৩১:২১]
সুতরাং পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুসরণ হিদায়াতের পথে বড় বাঁধা। সত্য উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হিদায়াত বঞ্চিতদের লক্ষণ।
১৪) অত্যাচারী না হওয়া:
অত্যাচারী অসৎ ব্যক্তি কখনোই হিদায়াতের স্বাদ পায় না। নিজের জ্ঞান গরিমা, আত্ম অহংকার বিত্ত বৈভব ক্ষমতার ও প্রাচুর্যের কারণে অনেক ব্যক্তি অত্যাচারী হয়ে উঠে। যখন মানুষ অত্যাচারী হয়ে উঠে তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে সে সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। আর এই কারণেই আল্লাহ বলেন,
"নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।" [সুরা আন’য়াম ৬:১৪৪ ]
১৫) সামাজিক অনুসরণ না করা:
অন্ধ অনুসরণের মতো সামাজিক অনুসরণও মানুষকে আল্লাহর হিদায়াত থেকে দূরে রাখে। অর্থাৎ কিছু কিছু সামাজিক বিষয় আছে যার আচার অনুষ্ঠান পালন না করলে সমাজের মানুষ খারাপ বলবে। এইসব বিষয়ে সঠিক সত্য জানার পরও পরিহার না করে সামাজিক চাপে তা পালন করা এবং চালিয়ে যাওয়াও হিদায়াতের পথে অন্তরায়।
সঠিক ঈমান আমল জানার পরও শুধুমাত্র সামাজিক সম্মান মান মর্যাদা ইত্যাদির কারণে সত্যকে প্রকাশ না করা এবং সত্যকে গ্রহণ না করাও হিদায়াত প্রাপ্তির বাঁধা। আমাদের সমাজে মানুষের জন্ম মৃত্যু নিয়ে এমন এমন আচার অনুষ্ঠান আছে যা ইসলাম সম্মত নয়। তবুও আমরা অধিকাংশ এইসব আচার অনুষ্ঠান মেনে নিচ্ছে শুধুমাত্র সামাজিক কারণে।
সামাজিক কারণটা হচ্ছে অনেকটা সমাজের নেতাদের অনুসরণ। আমরা সমাজে আজ ইসলামের অনুসরণের চাইতে দুনিয়াবী নেতা নেতৃত্বের অনুসরণ করছি বেশী। এইসব অনুসরণ আমাদের হিদায়াতের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতৃত্বের অনুসরণে আজ আমরা নিজেদের ধর্মহীনতায় নামিয়ে এনেছি।
আল্লাহ এই বিষয়ে বলেন,
"তারা (পাপী জাহান্নামীরা) আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।" [সুরা আহযাব ৩৩:৬৭]
সুতরাং সামাজিক অনুসরণ এবং দুনিয়াবী নেতৃত্বের অনুসরণ হিদায়াতের অন্তরায়।
১৬) বিদআতের অনুসরণ না করা:
ইসলামী সুস্পষ্ট নীতিমালার বাইরে গিয়ে অনেক লোক বিদআতের অনুসরণে জড়িয়ে পড়ে। যারা জেনেশুনে বিদআতে জড়িয়ে যায় তাদের আল্লাহ সহজে হিদায়াতের রাস্তা দেখান না। সুতরাং বিদআতের অনুসরণ না করাও হেদায়েতের একটি শর্ত।
বিদআত নিয়ে রাসুলসাঃ বলেন,
জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হামদ ও ছালাতের পর বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হ’ল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হ’ল ভ্রষ্টতা’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১)। আর নাসাঈতে রয়েছে, ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)।
সুতরাং বিদআত করে কেউ হিদায়াতের আলো পাবে না। বিদআত মুক্ত থাকাটাই হচ্ছে হিদায়াতের পথ প্রাপ্তির শর্ত।
১৭) প্রবৃত্তির অনুসরণ না করা:
মানুষ মাত্রই প্রবৃত্তির অনুসারী। আল্লাহ মানুষকে এমন ভাবেই সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে নিজের খেয়ালখুশি মতো চলতে পারে। যারফলে মানুষ চাইলেই যা ইচ্ছা তা করতে পারে। আর এটাই হচ্ছে মানুষের প্রবৃত্তি।
এই প্রবৃত্তির অনুসারী ব্যক্তিরা সহজে হিদায়াতের আলো পায় না। কেননা তাদের যা বলা হয় তারা তা করতে ইচ্ছুক নয়। তারা তাদের মন মতো ইবাদত আমল করতে আগ্রহী। যারা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলে তাদের আল্লাহ হিদায়াত দেন না।
আল্লাহ বলেন,
"অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জানবেন, তারা শুধু নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহর হেদায়েতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না।" [সুরা কাসাস ২৮:৫০]
১৮) মূর্খতা পরিহার করা:
জ্ঞানহীন মানেই হচ্ছে মূর্খ! অর্থাৎ যার ভালো মন্দ বুঝার ক্ষমতা থাকলেও তা কাজে না লাগিয়ে জ্ঞানহীনের মতো সবকিছু বিবেচনা করে, সে হচ্ছে সবচেয়ে বড় মূর্খ। কেননা যেকোনো সত্য যখন সামনে আসে তখন তা নিজের জ্ঞান দ্বারা সত্যতা যাচাই বছাই করাটা জ্ঞানীর কাজ। আর জ্ঞান দ্বারা সত্যতা যাচাই না করে নিজের আগের ধারণার উপর অটল থাকাটা হচ্ছে মূর্খতা। যারা নিজেদের থেকে মূর্খতা পরিহার করতে পারে না তা কখনোই হিদায়াত পায় না।
আল্লাহ বলেন,
"(হে মুসা) আমি আপনাকে উপপদেশ দিচ্ছি যে, আপনি অজ্ঞদের (মূর্খদের) দলভুক্ত হবেন না।" [সুরা হুদ ১১:৪৬]
১৯) অহংকার না করা:
অহংকারী না হওয়া হিদায়াত প্রাপ্তির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। যে বা যারা অহংকারী তারা কখনোই আল্লাহর হিদায়াত প্রাপ্ত হন না। বংশমর্যাদা, অর্থ বৈভব, জ্ঞানগর্ভ, বিত্তশালীতা ইত্যাদি মানুষের অন্তরে হিংসা এবং অহংকারের জন্ম দেয়। এই অহংকারের কারণেই অনেক মানুষ সহজে সত্য গ্রহণ করতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।" (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)
২০) অন্তরের বক্রতা পরিহার করা:
অন্তরের বক্রতা হিদায়েতের অন্তরায়। এর কাজ হলো মানুষের মনে যেকোনো সত্য বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করিয়ে দেওয়া। যেকোনো সঠিক কাজে খুঁত ধরা, সত্য প্রমাণিত হওয়ার পরও বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করা।
আল্লাহ বলেন,
"স্মরণ কর, যখন মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা কেন আমাকে কষ্ট দাও, অথচ তোমরা জান যে, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রসূল। অতঃপর তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না। [ সুরা সফ ৬১:৫ ] "
অন্তরের বক্রতার আরেকটি দিক হলো, সহজ সরল বিষয় অন্বেষণ না করে জটিল ও কুটিল বিষয় অন্বেষণ এবং অনুসরণ করা।
যেমন আল্লাহ বলেন,
"তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর।" [সুরা ইমরান ৩:৭]
সুতরাং অন্তরের বক্রতা হিদায়াতের পথে বড় প্রতিবন্ধক। যারা এই রোগে আক্রান্ত হয় আল্লাহ তাদের রোগ আরো বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্তাআলা বলেন,
"কিন্তু তারা যখন বাঁকা পথ ধরল, তখন আল্লাহ্ও তাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিলেন।" [সূরা আছ-ছফ, ৬১:৫]
২১) অধিকাংশের অনুসরণ না করা:
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ করতে নিষেধ এবং নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা অধিকাংশ মানুষ যা করে তা সবসময়ই সঠিক হবে এমন নয়। অধিকাংশ মানুষ যা করছে তা নিজের জ্ঞান দিয়ে বিচার বিবেচনা না করে অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না। দল ভারী হলেই যে সেই দল সত্য তা কিন্তু কখনোই নয়।
এব্যাপারে আল্লাহ বিভিন্ন আয়াত নাযিল করেছেন।
তাদের অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই। (৫/১০৩) অধিকাংশই জানে না। (৬/৩৭) অধিকাংশই মূর্খ। (৬/১১১) আর তাদের অধিকাংশ লোককেই আমি প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নকারীরূপে পাইনি; বরং তাদের অধিকাংশকে পেয়েছি হুকুম অমান্যকারী। (৭/১০২) অধিকাংশ সত্যকে অপছন্দ করে। (২৩/৭০) অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়। (২৬/ ৮) অধিকাংশই মিথ্যাবাদী। (২৬/ ২২৩)
উপরোক্ত আয়াত ছাড়াও আরো অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ অধিকাংশ মানুষের বিরোধীতা করেছেন। অর্থাৎ অধিকাংশের মত সবসময় ঠিক নয়। অধিকাংশের মতের উপর জীবনযাপন করাটা হচ্ছে হিদায়াত বঞ্চিত হওয়ার লক্ষণ।
যারা নিজের বিবেক বুদ্ধি কাজে না লাগিয়ে অধিকাংশ মানুষের মতের সাথে নিজেকে একাত্ম ঘোষণা করে তারা কখনো হিদায়াতের রাস্তা পায় না। অতএব হিদায়াত পাওয়ার আরেকটি শর্ত হলো অধিকাংশ মানুষের অন্ধ অনুসরণ না করা।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা হিদায়েতের বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কে জানতে পারলাম। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম একটি সহজ সরল জীবনবিধান। যারা নিজেদের সৎ সরল এবং সত্য পথে পরিচালিত করবে, সেইসাথে কুরআন হাদিস থেকে জ্ঞানার্জন করবে কেবলমাত্র তাঁরাই আল্লাহর হিদায়াত প্রাপ্ত হবে।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
বোরহানুল ইসলাম লিটন ২৬/০৭/২০২২মূল্যবান ধর্মীয় উপস্থাপন!
-
আমান শেখ ২৩/০৭/২০২২আমাদের হেদায়েতের জন্য কবি তার লেখার মাধ্যমে ভূলে যাওয়া কথা মনে করিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ কবি গুরু।