প্রবাস হালচাল
তারুন্যে আমার প্রিয় বল্গার দাদা মুহাইমিনের অনুপ্রেরণায় আমার এই লেখা। আমি প্রবাসে আছি গত তিন বছর ধরে। এই তিন বছরে আমার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই সব অভিজ্ঞতা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রথমত আমরা বাংলাদেশীরা এখানে যেসব কাজ করি, তার মধ্যে বেশিরভাগ কাজই পরিশ্রমের। বিশেষ করে এখানে যাবতীয় শ্রমিকের কাজ বাংলাদেশীরাই বেশি করে। এর প্রধান কারণ সল্প মজুরী। আমরা এখানে খুবই অল্প বেতনে চাকরি করি। এর কারণ ও রয়েছে অনেক। বিদেশী মালিক অল্প বেতনে কাজ করানোর জন্য ফ্রি ভিসা দিয়ে মানুষ আনে দেশ থেকে। কিন্তু যার মাধ্যমে মানুষ আনে, সে নিজেই অনেক টাকা নিয়ে বসে ঐ নতুন শ্রমিক টি থেকে। যার ফলে যখন নতুন শ্রমিক টি এদেশে এসে কম বেতন পায় তখন তা দিয়ে তার চলে না। চলবে কি করে? মালিক জানে সে শ্রমিক টি এনেছে ফ্রী তে। তাই বেতন কম। কিন্তু যিনি এসেছেন তিনি কম করে হলেও দুই আড়াই লাখ খরচ করে এসেছেন। কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরা এতো খারাপ যে, নিজ ভাই থেকেও টাকা নিতে লজ্জা করি না। যে মানুষটি এতো টাকা খরচ করে এখানে আসে তার বেতন পড়ে মাত্র 500/600 দিরহাম। মানে দশ, বার হাজার টাকা। আর সে কাজ করতে পারবে মাত্র তিন বছর। এখন অবশ্য দুই বছর। এই দুই বছরে সে কিভাবে এই বেতনে চাকরি করবে। তার টাকা উঠবে কখন আর সংসার চলবে কি করে। যদি সে ফ্রী তে আসতো তাহলে তার চিন্তার কিছু থাকতো না। প্রথম মেয়াদ শেষ হলে মালিক নিজেই আবার কাজের জন্য ভিসা রিনিউ করে দিবে। যেহেতু আমরা খারাপ সেহেতু আমাদের কপালে দুর্গতি। যখন একজন মানুষ কষ্ট করে হলেও এই দুই তিন বছর কাটায়। কিন্তু যখন সে এই সময়ে কাজ শিখে ফেলে তখন তার কাছে বেশি বেতনের অফার আসে। তখন বেশি বেতনের লোভে এক দল মানুষ পালিয়ে যায়। কিছু আছে যারা নিজ ইচ্ছায় কাজ ছেড়ে দিতে চায় কিন্তু মালিক ছাড়ে না। তখন বাধ্য হয়ে পালাতে হয়। কেননা এমনিতে মালিক ছেড়ে দিবে না। ছেড়ে দিলে তার নামে মামলা করে দিবে। এমন হরহামেশাই হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্গতি হয় মালিক বাঙ্গালী হলে। দেশ থেকে ইচ্ছা মতো টাকা নিয়ে লোক আনে। কিন্তু কাজ করানো র পর ঠিক মতো টাকা দেয় না। সেই সাথে মানসিক নির্যাতন। কম টাকার চাকরি। টাকা দিলেও তিন মাস কাজ করার পর এক মাসের পয়সা। এভাবে চলতে থাকে। আবার কাজ না থাকলে বসে থাকা। বসে থাকলে টাকা নাই। একসময় বাধ্য হয়ে ওখান থেকে চলে যেতে হয়। মালিকও চায় চলে যাক। চলে গেলে সে আবার দেশ থেকে লোক আনবে। আবার চলবে এভাবে। আইন অনুযায়ী মালিক শ্রমিকের সমস্ত দ্বায়িত্ব নিবে। তার ভিসার খরচ থেকে শুরু করে সব। কিন্তু আমরা না বুঝেই এখানে চলে আসার জন্য পাগল। এখানে বাঙালির যে কাজের কোম্পানি আছে তার বেশী র ভাগ পরিস্কার পরিছন্নতার, বিল্ডিং কন্সট্রাকশন, ইত্যাদি। এইসব কাজে প্রচুর পরিশ্রম। প্রচন্ড রোদে কাজ করতে হয়। আমাদের দেশে যেসব দিনমজুর কাজ করে ক্ষেতে খামারে ঠিক সেই রকম। ক্ষেত্রে বিশেষে এরচেয়ে কঠিন। যাক যখন লোক আনা হয় তখন বলা হয় আট ঘন্টা কাজ সেই সাথে ওভার টাইম। কিন্তু কাজ হয় বার ঘন্টা কোন ওভার টাইম নাই। ক্লিনিং কোম্পানির কষ্ট দেখেছি আমি। যখন মার্কেটে চাকরি করতাম। দেখি বার ঘন্টা তাদের কাজ। কোন বিশ্রাম নেই। বার ঘন্টা ই দাড়ানো। অথবা ব্রাশ নিয়ে হাটা। এতো বড় মার্কেট সারাদিন হাটা। অথচ কোন ময়লা নেই তার পরও। কোথাও একটু দাড়ালেই সমস্যা। সুপারভাইজর দেখলে গালমন্দ। সেই সাথে কম বেতন। আবার বেতন ও নিয়মিত নয়। বেশী ভোগান্তিতে পড়ে যখন কোন ফলস্ কোম্পানিতে কেউ আসে। অর্থাৎ তার কাজ নেই কিন্তু শ্রমিক আনে। আনা র পর কাগজ পত্র কিছু না দিয়ে বাইরে ছেড়ে দেয়। এখন ঐ লোক গুলো র কিছু করার থাকে না। কেননা তারা ভিসা কিনে এখানে আসে। তারা দুই তিন হাত বদল হওয়া ভিসা নিয়ে এখানে আসে। যার ফলে মূল কালপ্রিট কে কেউ ধরতে পারে না। কাগজ পত্র ছাড়া সে এখন কি করবে? তা কোন না কোন কিছু করতে হবে। সে তাই অল্প বেতনে চাকরি করতে থাকে। যেহেতু তার কাগজ পত্র নাই সেহেতু টাকাও নিয়মিত পাই না। এভাবে দিন দিন বিদেশে আমাদের কাগজ পত্র ছাড়া অবৈধ মানুষ বেড়ে গেছে। যেসব মানুষ অবৈধ হয়ে যায় তাদের সাহস ও বেশি। তারা যেকোন অপকর্ম করতে দ্বিধা বোধ করে না। কেননা তারা চিন্তা করে এমনিতেই অবৈধ আরও কিছু করলে আমাকে কি আর করবে। বড়জোর দেশে চলে যাব। আর আমাদের যারা এই দেশে আসে তার সিংহ ভাগই অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। তারা এখানকার আইন কানুন সম্পর্কে জানে না। তাই যত্রতত্র না জেনে আইন ভঙ্গ করে। এখানকার ভিসা বন্ধ হওয়ার মূল কারন প্রচুর পরিমাণ অবৈধ শ্রমিক বেড়ে যাওয়া সেই সাথে অপরাধ প্রবনতা বেড়ে যাওয়া। এখানকার জেল গুলোতে বাঙালির জন্য আলাদা রুমের প্রয়োজন হয়। কারন এতো বেশি অপরাধ অন্য কেউ করে না। আমরা এতো খারাপ যে একই রুমে থেকে একজন আরেক জনের সাথে মারামারি ঝগড়া ঝাটি করি। নিজেরা কোন সমাধানে আসতে পারি না। পুলিশ ডাকতে হয়। তাই এদের প্রসাশন আমাদের উপার যথেষ্ট নেতিবাচক ধারণা পোষন করে। আজ অনেক কিছুই বলে ফেললাম। লেখা অনেক বড় হয়ে গেছে। এইজন্য দুঃখিত। বাকি কথা আরেক দিন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রাশেদ ভুঁইঞা বিপ্লব ০৪/১১/২০১৩খুব চমৎকার লেখনি...দারুণ সুন্দর লিখা।
-
ইসমাত ইয়াসমিন ০৪/১১/২০১৩আমি ও প্রবাসে থাকি। ভাল লাগল প্রবাসীদের কথা তুলে ধরার জন্য। আসলে বিদেশ মানে " দূর থেকে কাশবন ঘন দেখা যায়"। তারপরে ও আছি, কি আর করা।যে যেখানে আছেন, ভাল থাকবেন এই দোয়া রইল। খুব বাস্তবমম্মত লেখা, যা আমাদের জানা খুবই জরুরী। শুভকামন রইল।
-
আহমাদ সাজিদ ০৩/১১/২০১৩খুব মনোযোগের সাথে আপনার লেখাটা পড়লাম আর ভাবলাম, জাতি হিসেবে আমরা আসলেই জঘণ্য। আপনি মনে হয় মধ্য-প্রাচ্যের কোনো দেশ সম্ভবত সৌদি বা দুবাইতে থাকেন। সেখানে সমস্যা বেতন আর কাজের মান নিয়ে। আমরা আছি ইউরোপে; এখানে সমস্যা কাজ পাওয়া আর বৈধতা নিয়ে। মনে হয় একদিন সবার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করি। যদিও এ বিষয়ে দেশের পত্রিকাগুলোতে প্রায়ই লেখা হয়, তারপরও মানুষ অনেক টাকা খরচ করে এসব দেশে আসে। তারপর জেনে বুঝে পস্তাতে থাকে।
আপনার এই লেখা পড়ে আমাদের দেশের ভাই-বোনেরা আর অভিভাবকেরা সচেতন হবে বলে আশা রাখি। ধন্যবাদ -
দাদা মুহাইমিন চৌধূরী ০৩/১১/২০১৩খুব সুন্দর ব্যাপারটা উপস্থাপন করেছেন সাখাওয়াত ভাই। আসলে এসব সমস্যা হতনা যদি এসব অল্প শিক্ষিত মানুষের পাশে শিক্ষিত মানুষ গুলো দাড়াতো। সরকারী ভাবে শ্রমিক পাঠানো হয় কিন্তু তাও মানুষ দালাল ধরে অজ্ঞতার কারনে। এ জন্য দায়ী যারা এ বিষয়ে জানে কিন্তু কিছু বলেনা।
আর ব্লগের শুরুতে আমার নাম দেখে অবাক হয়েছি। আমাকে কৃতজ্ঞ করে ফেললেন আপনি। -
মরুভূমির জলদস্যু ০৩/১১/২০১৩সাখাওয়াৎ ভাই আপনার এই লেকার অনেকটাই পরলাম। বুঝতে পারলাম আপনি দুবাই থাকেন। আপনার লেখা যতটুকু পরেছি তাতে এটাই উপলব্ধি করলাম- "প্রদীপের নিচেই অন্ধকার বেশি থাকে" প্রবাদটা ঠিকই আছে।
।
ভাই এতো বড় লেখায় যদি কয়েকটা প্যারা করে দিতেন তাহলে পড়তে সুবিধা হতো। -
suman ০৩/১১/২০১৩আমি অনেকের কাছে এই দূর্ভাগ্যের কথা শুনেছি ...আপনার লেখা থেকে detail আমরা জাতি হিসাবে কবে কবে এতো জঘন্য হয়ে যাচ্ছি ...খারাপের ভীড়ে ভালো মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে ...তাকেও সন্দেহ করা হবে নির্বিচারে ...খুব বাস্তবসম্মত লেখা ...আরো লিখুন ...
-
জহির রহমান ০৩/১১/২০১৩ভাই, অনেক কষ্ট করে লেখাটা দাঁড় করিয়েছেন। মনের সব আবেগ ঢেলে দিয়েছেন এই লেখাটিতে তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু সময়ের অভাবে পুরোটা পড়তে পারিনি বলে দুঃখিত। তবে যতদূর চোখ বুলালাম- প্রবাসীদের সমস্যা গুলোই চোখে পড়ছে।
-এমনিতে প্রবাসে যেতে মন চায়না। কখনো যাবোওনা। কিন্তু পরিবারের চাপে আর জীবন-জীবিকার তাগিদে যদি যেতে হয়, তখন হয়তো আপনার এই কথাগুলোই সত্য হবে।
তাই, যা করার দেশেই করবো।
দিন মজুরের কাজ করেও শান্তিতে থাকতে চাই।
রাজপ্রাসাদে শান্তি নাই, আবার কুঁড়ে ঘরেও শান্তি আছে।