নীরব ছেলেটি
নীরব ছেলেটি
- শাহিন আলম সরকার
মা স্কুলের সময় তো হয়ে গেল, ফি-বেতন দিবা কখন?
- এখন টাকা দিবো কোথা থেকে? আমার কাছে তো বিষ খাওয়ার টাকাও নাই।
- কাল পরীক্ষা। আজ না দিলে কাল সমস্যা হবে তো।
- সমস্যা হলে আর কি করা। দিন এনে দিন খাওয়ার সংসার। তোর বাপের ঠিক মত কাজ কাম নাই। ঋণে ঋণে বোঝা হয়ে আছে। আজকের মত যা। কাল দেখা যাবে।
- ঠিক আছে। স্কুলে গেলাম।
- কিছু খাবি না?
- না। আমার খিদে নাই।
মন খারাব করে নিলু স্কুলে যায়। বন্ধু বান্ধব সবাই ফি-বেতন দেয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। কার আগে কে টাকা জমা দিতে পারে।
নিলু একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে - আজ স্কুলে আসাই ঠিক হল না। আজ তো কোন ক্লাশ নাই। সবাই ফি-বেতন নিয়েই ব্যস্ত। বাড়ি চলে যাই। এখানে থেকে কোন লাভ নাই। এমন সময় জাবেদ আসে।
- তুই ফি দিবি না? তাড়াতাড়ি চল ভিড় পড়ে যাবে তো।
- ভিড় পড়ে যাবে মানে? ভিড় তো পড়েই গেছে।
- তাহলে দাঁড়িয়ে কি করছিস? আয় তাড়াতাড়ি ফি দিয়ে বাড়ি চলে যাই। পড়তে হবে। অনেক পড়া বাকি আছে ।
- যা তুই। আমি কাল দিবো।
- আজ দিলে কত ভাল হত তা কি তুই জানিস? স্যার বার বার ক্লাশে বলেছে- পরীক্ষার আগেই ফি-বেতন পরিশোধ করতে হবে। তা তো তুই কানেই তুলছিস না। কাল একটু সকাল করে এসে দিয়ে দিস। তাছাড়া কিন্তু স্যার খাতা দিবে না, পরিষ্কার বলে দিয়েছে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তুই যা।
নিলুর মন আরো খারাব হয়ে গেল। চুপচাপ বাড়িতে চলে আসে। ভাবতে থাকে শুধু কি ফি? বেতনও তো অনেক বাকি আছে। এত টাকা মা কোথা থেকে দিবে? টাকা পরিশোধ না হলে স্যার পরীক্ষার খাতা দিবে না। কি করবো এখন?
কাল পরীক্ষা অথচ বইয়ে মন বসছে না। বই পড়তে আর ভাল লাগছে না। আহা যদি এমন হত ফি-বেতন লাগবে না, তাহলে কি মজাই না হতো। শুধুই পড়তাম।
সকাল বেলা। নিলু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে। আর তো বেশি সময় নাই। কাল টাকা পরিশোধ হলে কোন চিন্তা ছিল না। সোজা পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রবেশ করা যেতো।
মা টাকা দাও। একটু সকাল সকাল যেতে হবে। অফিসে ফি দিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকতে হবে।
- কত জনের কাছেই গেলাম। কেউ তো টাকা ধার দেয় না। তুই রিফাতের মায়ের কাছে যা। দিতে পারে।
- তুমি যাও। আমি গেলে দিবে না।
- এর আগে টাকা এনে অনেক দিন ঘুরিয়েছি। আমি আর তার কাছে যেতে পারবো না। টাকা তো দিবেই না আরো নানান কথা শুনিয়ে দিবে।
পড়া ফেলে রেখে নিলু রিফাতদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রিফাতের মা বাড়িতে নাই। রিফাত পরীক্ষার পড়া পড়ছে।
- রিফাত, চাচি কোথায়?
- মা তো বাড়িতে নাই। আয়শা ফুফু কোথায় যেন নিয়ে গেল। এখনই আসবে বলল। পড়া ফেলে আসার কারণ কি?
- এমনি এসেছি।
- এমনি কেউ পরীক্ষার পড়া ফেলে আসে?
রিফাত পড়তে থাকে। নিলু চুপচাপ পাশে বসে থাকে। তারপর ভাবে এখানে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। ওর তো পড়ায় সমস্যা হতে পারে। তাই বাহির বাড়ি আম গাছের নিচে বসে থাকে।
অনেকক্ষণ পরে রিফাতের মা আসে।
- কি রে নিলু পরীক্ষা দিবি না? এখানে কি করিস?
- চাচি পরীক্ষা দিবো কিভাবে? ফি পাবো কোথায়? তোমার কাছে টাকা হবে?
- আমার কাছে কোন টাকা নাই। রিফাতের ফি-বেতন দিয়েই শেষ। কারো কাছ থেকে নিয়ে দে। আগে কি করছিস? পরীক্ষার সময় তো হয়ে গেল।
- আগে থেকেই তো খোঁজ করছি। কেউ দিচ্ছে না তো।
- তোদের আর কে দিবে? এর আগে তোর মা টাকা নিয়ে গেল কাল দিবে বলে, তা এক মাসের মধ্যেও দিল না।
- ওসব কথা বাদ দাও। এখন কোন টাকা দিতে পারবে কি না তাই বলো।
- না এখন পারবো না। আমার কাছে কোন টাকা নাই। অন্য জনের কাছ থেকে যে ধার করে দিবো সে সাহসও পাই না। তোরা তো আর সময় মত দিতে পারবি না।
নিলু কোন কথা বলে না। রিফাত পরীক্ষার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিলু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। চাচিকে টাকার কথা আবার বলতে সাহস পায় না। ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। পিছন থেকে চাচি বলে আজ টাকা নাই, কাল এসে নিয়ে যাইস। আজকের মত স্যারদের বুঝিয়ে খাতা নিস।
স্কুলে খাতা দেয়া শেষ। নিলু ধীরে ধীরে ক্লাশে ঢোকে।
- এসো নবাবের ছেলে। এতক্ষণে আসার সময় হল?
- স্যার, একটু দেরি হয়ে গেল।
- রশিদ দেখি ।
- স্যার, রশিদ নাই। টাকা কাল দিবো। আজকের মত খাতা দেন।
- সিটে বয়। বিশ মিনিট পরে খাতা পাবি।
- স্যার কাল দিয়ে দিবো তো।
- মুখে মুখে কথা। বললাম না বয়।
নিলু আর কোন কথা বলে না। চুপচাপ বেঞ্চে বসে থাকে। সবাই মন দিয়ে লিখছে। হায় সবাই লিখছে, শুধু আমি ছাড়া। কেউ কেউ ফিস ফিস করে বলে, ফি না দিয়েই পরীক্ষা দিতে আসে। লজ্জা শরম কিছু থাকলে তো। নিলু সব শুনতে পায়। শরীরটা অবশ হয়ে আসে, ঘামতে থাকে। মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে যায়।
দশ বারো মিনিট যাওয়ার পর স্যার বলে - নিলু, হেড স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আয়। তাছাড়া আমার খাতা দেয়া নিষেধ। নিলু দৌড়ে প্রধান শিক্ষকের অফিসে যায়।
- কি হয়েছে?
- স্যার আমি কাল টাকা দিবো। আজ কোন টাকা নাই। স্যার খাতা দিচ্ছে না।
- তোমার তো অনেক টাকা বাকি। খাতা কিভাবে দিবে? আগে থেকে অল্প অল্প করে দিলেই তো ফুরিয়ে যেতো।
- জ্বি স্যার।
- তা দাও নি কেন?
- স্যার কাল দিবো।
- ঠিক আছে। কাল যেন মিস না হয়। আজকের মত দিয়ে দিলাম।
নিলু আর খাতায় কি লিখবে? মাথাটাই তো ভো ভো করে ঘুরছে। এদিকে বিশ মিনিট ফাঁকি পড়ে গেছে। তবু কলম চলে। কলম যে তাকে চালাতেই হবে।
বিকেল বেলা। মা নিলুকে বলে - চাচির কাছ থেকে টাকা আনার সময় দুলির মায়ের কাছে আধা সের চাউল কর্জ আনতে।
নিলু টাকা নিয়ে দুলিদের বাড়িতে যায়। দুলির মা বলে আমাদের খাওয়ার চালই নেই। তোমাদের কর্জ দিবো কিভাবে? অন্য বাড়ি দেখো। নিলু বাড়ির বাহির উঠানে আসতে না আসতেই দুলি মা কে বলে - চাউল তো আছে মা, দিলে না কেন?
- দূর পাগলি। ওদের চাউল দেয়া আর জলে ফেলে দেয়া এক কথা। আমরা ৬০ টাকা কেজি চাউল আর ওরা খায় ৪০ টাকা কেজি। ওই কম দামা চাউলের ভাত আমরা খেতে পারব? তাও আবার যদি সময় মত দেয়।
- তুমি এত বোঝ মা। চাউল না দিলে যে ওদের না খেয়ে থাকতে হবে এটা বোঝ না?
- চুপ হারামি। দিনে দিনে এই শিক্ষা হইছে তোর। বোকা কোথাকার। যারা কম দামি চাউল খায় তারা তো ঠিকই দিবে। সেখানে যাবে না, ভাল চাউলের আশায় আমাদের ধারে আসে। তোর চাচির ধারে গেল না তো?
- মা, চাচির ঘরে কি চাউল আছে নাকি? ওরাই তো দিন এনে দিন খায়। আবার অন্য কে কিভাবে দিবে?
- ওমা তুমি সবার এত খোঁজ রাখো, আগে জানতাম না তো। বেশ ভাল। তাহলে তোমার চাচি কেউ চাউল কর্জ দিয়ে আসো।
দুলি মনে মনে বলে মায়ের সাথে কথা বলে কোন লাভ নাই। তাই অন্যত্র চলে যায়।
পরীক্ষা শুরু হতে এখনো অনেক দেরি। নিলুর বন্ধু বান্ধব সবাই উপস্থিত। জাবেদ বলে চল দোকানে যাই। পরীক্ষা হতে অনেক দেরি। সবাই দোকানে যায়। যার যা খাওয়ার খেয়ে নেয়।
জাবেদ : আমি কাল টাকা দিয়ে ছিলাম, আজ অন্য কেউ দিয়ে দে।
রফিক : আমার আজ টাকা নাই তাই আগেই বলে দিলাম।
সামাদ : এই নিলু আজকেরটা তুই দিয়ে দে না। নাকি আজও নাই?
নিলু কোন কথা বলে না। মনটা ভার। তারপর ধীরে ধীরে জাবেদের কাছে যায় গিয়ে বলে -বিল টা তুই দিয়ে দে। আমি দুই তিন দিনের মধ্যে তোকে দিয়ে দিবো।
- না। আমি কি তোর জন্য টাকা নিয়ে বসে আছি? আমাদের মধ্যে তোকে জানি আর কোন না দেখি। প্রতিদিন শুধু খেয়েই যাবে। একদিনও খাওয়াবে না তাই কোন দিন হয়?
নিলুর মুখটা কালো হয়ে যায়। সে দোকানদারকে কিছু বলতে যাবে অমনি রফিক বিল দিয়ে দেয়।
সেই থেকে নিলু আর কোন দিন স্কুলের কারো সাথে মিশে না। যায় না কোন দোকানে। খায় না কারোর টাকা। একা একা চুপচাপ থাকে।
পরীক্ষা শেষ। গ্রীষ্মের ছুটি। সবাই খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত। বল কিনতে হবে, চাঁদা ধরা হয়েছে। প্রায় সবারই চাঁদা দেয়া শেষ। নিলুর এখনো চাঁদা দেয়া হয় নি। বাড়িতে বলার মত সাহস নেই। বুঝতেই তো পারে অভাবের সংসার। যেখানে চাল ডাল কেনারই টাকা হয় না, সেখানে খেলার চাঁদা দেয়ার টাকা চাইলে কেমন হয়?
দলনেতা রায়হান। সে ঘোষণা করে চাঁদা ছাড়া কাউকে খেলায় রাখা হবে না। যার যার বাকি ছিল সবাই দিয়ে দেয়।
নিলু ভাবতে থাকে, সব জায়গায় আমি একাই পড়ে যাই। যেখানে সবাই হাসতে পারে সেখানেই আমি চুপ। আমি কেন সবার থেকে আলাদা হলাম। জীবনে সবারই তো কোন না কোন শখ আছে। আমার শখ গুলো কেন এত অসহায়। আমার স্বপ্ন গুলো এত ছোট হওয়া সত্বেও কেন অপূর্ণই রয়ে যায়?
তারপর শুরু হয় একা থাকার। একলা আঁধার মাঝে নানা রঙে নানা ঢঙে সাজায় নিজের মন কে। সুখ খুঁজে পায় অন্য রকম একটা শখে। যে শখে লাগে না কোন টাকা, লাগে না অর্থ। স্বপ্ন গুলোকে সাজানো যায় নিজের মত করে, নিজের ডায়েরির পাতায়।
- শাহিন আলম সরকার
মা স্কুলের সময় তো হয়ে গেল, ফি-বেতন দিবা কখন?
- এখন টাকা দিবো কোথা থেকে? আমার কাছে তো বিষ খাওয়ার টাকাও নাই।
- কাল পরীক্ষা। আজ না দিলে কাল সমস্যা হবে তো।
- সমস্যা হলে আর কি করা। দিন এনে দিন খাওয়ার সংসার। তোর বাপের ঠিক মত কাজ কাম নাই। ঋণে ঋণে বোঝা হয়ে আছে। আজকের মত যা। কাল দেখা যাবে।
- ঠিক আছে। স্কুলে গেলাম।
- কিছু খাবি না?
- না। আমার খিদে নাই।
মন খারাব করে নিলু স্কুলে যায়। বন্ধু বান্ধব সবাই ফি-বেতন দেয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। কার আগে কে টাকা জমা দিতে পারে।
নিলু একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে - আজ স্কুলে আসাই ঠিক হল না। আজ তো কোন ক্লাশ নাই। সবাই ফি-বেতন নিয়েই ব্যস্ত। বাড়ি চলে যাই। এখানে থেকে কোন লাভ নাই। এমন সময় জাবেদ আসে।
- তুই ফি দিবি না? তাড়াতাড়ি চল ভিড় পড়ে যাবে তো।
- ভিড় পড়ে যাবে মানে? ভিড় তো পড়েই গেছে।
- তাহলে দাঁড়িয়ে কি করছিস? আয় তাড়াতাড়ি ফি দিয়ে বাড়ি চলে যাই। পড়তে হবে। অনেক পড়া বাকি আছে ।
- যা তুই। আমি কাল দিবো।
- আজ দিলে কত ভাল হত তা কি তুই জানিস? স্যার বার বার ক্লাশে বলেছে- পরীক্ষার আগেই ফি-বেতন পরিশোধ করতে হবে। তা তো তুই কানেই তুলছিস না। কাল একটু সকাল করে এসে দিয়ে দিস। তাছাড়া কিন্তু স্যার খাতা দিবে না, পরিষ্কার বলে দিয়েছে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তুই যা।
নিলুর মন আরো খারাব হয়ে গেল। চুপচাপ বাড়িতে চলে আসে। ভাবতে থাকে শুধু কি ফি? বেতনও তো অনেক বাকি আছে। এত টাকা মা কোথা থেকে দিবে? টাকা পরিশোধ না হলে স্যার পরীক্ষার খাতা দিবে না। কি করবো এখন?
কাল পরীক্ষা অথচ বইয়ে মন বসছে না। বই পড়তে আর ভাল লাগছে না। আহা যদি এমন হত ফি-বেতন লাগবে না, তাহলে কি মজাই না হতো। শুধুই পড়তাম।
সকাল বেলা। নিলু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে। আর তো বেশি সময় নাই। কাল টাকা পরিশোধ হলে কোন চিন্তা ছিল না। সোজা পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রবেশ করা যেতো।
মা টাকা দাও। একটু সকাল সকাল যেতে হবে। অফিসে ফি দিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকতে হবে।
- কত জনের কাছেই গেলাম। কেউ তো টাকা ধার দেয় না। তুই রিফাতের মায়ের কাছে যা। দিতে পারে।
- তুমি যাও। আমি গেলে দিবে না।
- এর আগে টাকা এনে অনেক দিন ঘুরিয়েছি। আমি আর তার কাছে যেতে পারবো না। টাকা তো দিবেই না আরো নানান কথা শুনিয়ে দিবে।
পড়া ফেলে রেখে নিলু রিফাতদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রিফাতের মা বাড়িতে নাই। রিফাত পরীক্ষার পড়া পড়ছে।
- রিফাত, চাচি কোথায়?
- মা তো বাড়িতে নাই। আয়শা ফুফু কোথায় যেন নিয়ে গেল। এখনই আসবে বলল। পড়া ফেলে আসার কারণ কি?
- এমনি এসেছি।
- এমনি কেউ পরীক্ষার পড়া ফেলে আসে?
রিফাত পড়তে থাকে। নিলু চুপচাপ পাশে বসে থাকে। তারপর ভাবে এখানে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। ওর তো পড়ায় সমস্যা হতে পারে। তাই বাহির বাড়ি আম গাছের নিচে বসে থাকে।
অনেকক্ষণ পরে রিফাতের মা আসে।
- কি রে নিলু পরীক্ষা দিবি না? এখানে কি করিস?
- চাচি পরীক্ষা দিবো কিভাবে? ফি পাবো কোথায়? তোমার কাছে টাকা হবে?
- আমার কাছে কোন টাকা নাই। রিফাতের ফি-বেতন দিয়েই শেষ। কারো কাছ থেকে নিয়ে দে। আগে কি করছিস? পরীক্ষার সময় তো হয়ে গেল।
- আগে থেকেই তো খোঁজ করছি। কেউ দিচ্ছে না তো।
- তোদের আর কে দিবে? এর আগে তোর মা টাকা নিয়ে গেল কাল দিবে বলে, তা এক মাসের মধ্যেও দিল না।
- ওসব কথা বাদ দাও। এখন কোন টাকা দিতে পারবে কি না তাই বলো।
- না এখন পারবো না। আমার কাছে কোন টাকা নাই। অন্য জনের কাছ থেকে যে ধার করে দিবো সে সাহসও পাই না। তোরা তো আর সময় মত দিতে পারবি না।
নিলু কোন কথা বলে না। রিফাত পরীক্ষার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিলু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। চাচিকে টাকার কথা আবার বলতে সাহস পায় না। ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। পিছন থেকে চাচি বলে আজ টাকা নাই, কাল এসে নিয়ে যাইস। আজকের মত স্যারদের বুঝিয়ে খাতা নিস।
স্কুলে খাতা দেয়া শেষ। নিলু ধীরে ধীরে ক্লাশে ঢোকে।
- এসো নবাবের ছেলে। এতক্ষণে আসার সময় হল?
- স্যার, একটু দেরি হয়ে গেল।
- রশিদ দেখি ।
- স্যার, রশিদ নাই। টাকা কাল দিবো। আজকের মত খাতা দেন।
- সিটে বয়। বিশ মিনিট পরে খাতা পাবি।
- স্যার কাল দিয়ে দিবো তো।
- মুখে মুখে কথা। বললাম না বয়।
নিলু আর কোন কথা বলে না। চুপচাপ বেঞ্চে বসে থাকে। সবাই মন দিয়ে লিখছে। হায় সবাই লিখছে, শুধু আমি ছাড়া। কেউ কেউ ফিস ফিস করে বলে, ফি না দিয়েই পরীক্ষা দিতে আসে। লজ্জা শরম কিছু থাকলে তো। নিলু সব শুনতে পায়। শরীরটা অবশ হয়ে আসে, ঘামতে থাকে। মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে যায়।
দশ বারো মিনিট যাওয়ার পর স্যার বলে - নিলু, হেড স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আয়। তাছাড়া আমার খাতা দেয়া নিষেধ। নিলু দৌড়ে প্রধান শিক্ষকের অফিসে যায়।
- কি হয়েছে?
- স্যার আমি কাল টাকা দিবো। আজ কোন টাকা নাই। স্যার খাতা দিচ্ছে না।
- তোমার তো অনেক টাকা বাকি। খাতা কিভাবে দিবে? আগে থেকে অল্প অল্প করে দিলেই তো ফুরিয়ে যেতো।
- জ্বি স্যার।
- তা দাও নি কেন?
- স্যার কাল দিবো।
- ঠিক আছে। কাল যেন মিস না হয়। আজকের মত দিয়ে দিলাম।
নিলু আর খাতায় কি লিখবে? মাথাটাই তো ভো ভো করে ঘুরছে। এদিকে বিশ মিনিট ফাঁকি পড়ে গেছে। তবু কলম চলে। কলম যে তাকে চালাতেই হবে।
বিকেল বেলা। মা নিলুকে বলে - চাচির কাছ থেকে টাকা আনার সময় দুলির মায়ের কাছে আধা সের চাউল কর্জ আনতে।
নিলু টাকা নিয়ে দুলিদের বাড়িতে যায়। দুলির মা বলে আমাদের খাওয়ার চালই নেই। তোমাদের কর্জ দিবো কিভাবে? অন্য বাড়ি দেখো। নিলু বাড়ির বাহির উঠানে আসতে না আসতেই দুলি মা কে বলে - চাউল তো আছে মা, দিলে না কেন?
- দূর পাগলি। ওদের চাউল দেয়া আর জলে ফেলে দেয়া এক কথা। আমরা ৬০ টাকা কেজি চাউল আর ওরা খায় ৪০ টাকা কেজি। ওই কম দামা চাউলের ভাত আমরা খেতে পারব? তাও আবার যদি সময় মত দেয়।
- তুমি এত বোঝ মা। চাউল না দিলে যে ওদের না খেয়ে থাকতে হবে এটা বোঝ না?
- চুপ হারামি। দিনে দিনে এই শিক্ষা হইছে তোর। বোকা কোথাকার। যারা কম দামি চাউল খায় তারা তো ঠিকই দিবে। সেখানে যাবে না, ভাল চাউলের আশায় আমাদের ধারে আসে। তোর চাচির ধারে গেল না তো?
- মা, চাচির ঘরে কি চাউল আছে নাকি? ওরাই তো দিন এনে দিন খায়। আবার অন্য কে কিভাবে দিবে?
- ওমা তুমি সবার এত খোঁজ রাখো, আগে জানতাম না তো। বেশ ভাল। তাহলে তোমার চাচি কেউ চাউল কর্জ দিয়ে আসো।
দুলি মনে মনে বলে মায়ের সাথে কথা বলে কোন লাভ নাই। তাই অন্যত্র চলে যায়।
পরীক্ষা শুরু হতে এখনো অনেক দেরি। নিলুর বন্ধু বান্ধব সবাই উপস্থিত। জাবেদ বলে চল দোকানে যাই। পরীক্ষা হতে অনেক দেরি। সবাই দোকানে যায়। যার যা খাওয়ার খেয়ে নেয়।
জাবেদ : আমি কাল টাকা দিয়ে ছিলাম, আজ অন্য কেউ দিয়ে দে।
রফিক : আমার আজ টাকা নাই তাই আগেই বলে দিলাম।
সামাদ : এই নিলু আজকেরটা তুই দিয়ে দে না। নাকি আজও নাই?
নিলু কোন কথা বলে না। মনটা ভার। তারপর ধীরে ধীরে জাবেদের কাছে যায় গিয়ে বলে -বিল টা তুই দিয়ে দে। আমি দুই তিন দিনের মধ্যে তোকে দিয়ে দিবো।
- না। আমি কি তোর জন্য টাকা নিয়ে বসে আছি? আমাদের মধ্যে তোকে জানি আর কোন না দেখি। প্রতিদিন শুধু খেয়েই যাবে। একদিনও খাওয়াবে না তাই কোন দিন হয়?
নিলুর মুখটা কালো হয়ে যায়। সে দোকানদারকে কিছু বলতে যাবে অমনি রফিক বিল দিয়ে দেয়।
সেই থেকে নিলু আর কোন দিন স্কুলের কারো সাথে মিশে না। যায় না কোন দোকানে। খায় না কারোর টাকা। একা একা চুপচাপ থাকে।
পরীক্ষা শেষ। গ্রীষ্মের ছুটি। সবাই খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত। বল কিনতে হবে, চাঁদা ধরা হয়েছে। প্রায় সবারই চাঁদা দেয়া শেষ। নিলুর এখনো চাঁদা দেয়া হয় নি। বাড়িতে বলার মত সাহস নেই। বুঝতেই তো পারে অভাবের সংসার। যেখানে চাল ডাল কেনারই টাকা হয় না, সেখানে খেলার চাঁদা দেয়ার টাকা চাইলে কেমন হয়?
দলনেতা রায়হান। সে ঘোষণা করে চাঁদা ছাড়া কাউকে খেলায় রাখা হবে না। যার যার বাকি ছিল সবাই দিয়ে দেয়।
নিলু ভাবতে থাকে, সব জায়গায় আমি একাই পড়ে যাই। যেখানে সবাই হাসতে পারে সেখানেই আমি চুপ। আমি কেন সবার থেকে আলাদা হলাম। জীবনে সবারই তো কোন না কোন শখ আছে। আমার শখ গুলো কেন এত অসহায়। আমার স্বপ্ন গুলো এত ছোট হওয়া সত্বেও কেন অপূর্ণই রয়ে যায়?
তারপর শুরু হয় একা থাকার। একলা আঁধার মাঝে নানা রঙে নানা ঢঙে সাজায় নিজের মন কে। সুখ খুঁজে পায় অন্য রকম একটা শখে। যে শখে লাগে না কোন টাকা, লাগে না অর্থ। স্বপ্ন গুলোকে সাজানো যায় নিজের মত করে, নিজের ডায়েরির পাতায়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০২/০৫/২০১৮নীরব ভাললাগা।