বাংলা কবিতায় স্বাধীনতার প্রত্যয়ী উচ্চারণ
'স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়/পরাধীনতার অর্গল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।’ আসলেই প্রতিটি মানুষই অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে চায়। উপভোগ করতে চায় পাখির মতো সীমাহীন নীলিমায় ওড়ার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা, এই শব্দটির সঙ্গে মানুষ তার নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে। কারণ প্রতিটি মানুষ মাত্রই অন্তরে স্বাধীনতার আকাঙ্খা লালন করে থাকে। আর এ স্বাধীনতা যদি হয় রক্তের বিনিময়ে, অনেক সংগ্রামের ফলে তাহলে তার স্বাদটাও পাল্টে যায়। তখন এই স্বাধীনতা হয়ে ওঠে আরো বেশি অর্থবহ। অনেক বেশি আনন্দের উপলক্ষ্য।
১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করার সময় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো পৃথক ভৌগোলিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করে যান। বাংলা দ্বিখন্ডিত হয় এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তান অংশে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে।জন্মের পর থেকেই বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের দ্বারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি সার্বিক জীবনযাপনে নানা রকম বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়। পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠছিল তাতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ জাতীয়তাবোধে উত্তাল রাজনৈতিক ঢেউ আছড়ে পড়ছিল বাংলা কবিতায়। পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সমাজ ও ঐতিহ্যনিষ্ঠতা, আবহমান বাঙলা ও বাঙালির লোকাচার, গ্রামীণ ও নিসর্গপ্রীতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে রোমান্টিকতা মিশ্রিত আবহ থাকলেও ষাটের দশকে অত্যধিক রাজনীতিমনস্কতা পরিলক্ষিত হয় ,সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপক আকারে উদ্ভাসিত।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম আরম্ভ হওয়ার প্রথম দিনগুলোতে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান একটা উদ্দীপনা অনুভব করেছে। অনেকের মনেই পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালিদের সঙ্গে মিলে মিশে বসবাস করার একটি আবেগ কাজ করেছে নিঃসন্দেহে। যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে বহুজাতির একত্র বাস পৃথিবীতে বিরল নয়। কিন্তু অল্প দিন পরেই বাঙালির মোহভঙ্গ ঘটে। এই মনোবেদনার কথা সিকান্দার আবু জাফর তুলে ধরেছেন কবিতায়- “একাত্মতার স্বপ্ন বিনিময়ে/মেঘ চেয়েছি ভিজিয়ে নিতে/যখন পোড়া মাটি/বারেবারেই তোমার খরা/আমার ক্ষেতে বসিয়ে গেছে ঘাটি/আমার প্রীতি তোমার প্রতারণা/যোগ-বিয়োগ মিলিয়ে নিলে/তোমার লাভের জটিল অংকগুলো,/
আমার কেবল হাড় জুড়োলো/ হতাশ্বাসের ধূলো।” (- বাঙলা ছাড়ো \ সিকান্দার আবু জাফর) । বাঙালির প্রীতির দুর্বলতার সুযোগে পাকিস্তানীদের প্রতারণার কথা তুলে ধরেছেন কবি এবং তাই তাঁর দীপ্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণাও একই কবিতায় -“আমার হাতেই নিলাম আমার/ নির্ভরতার চাবি;/তুমি আমার আকাশ থেকে/সরাও তোমার ছায়া,/তুমি বাঙলা ছাড়ো।”(- বাঙলা ছাড়ো \ সিকান্দার আবু জাফর)
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেই উত্তোলিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজ পতাকা। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কবিতায় সেই লাল-সবুজ পতাকা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস ও স্বপ্নিল সোনার বাংলার প্রতীকÑ ‘আবার বুকের রক্তে বাংলার শ্যামল প্লাবিত,/যেন কোন সবুজাভা নেই আর, সকল সবুজে/ছোপ ছোপ লাল রক্ত, আর সেই/সবুজের বদীর্ণ রক্তের গোলকে/সোনার বাংলার ছবি/মুহূর্তে পতাকা হয়ে দোদুল বাতাসে।’ (জার্নাল ১ : তেইশে মার্চ ১৯৭১)
পঁচিশে মার্চের কালো রাত সত্ত্বেও ছাব্বিশে মার্চ থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ আন্দোলন। রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবা থেকে শুরু করে সাধারণ বালকও যুক্ত হয়েছিল সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে। শহীদ কাদরীর কবিতায় তা পেয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনাÑ ‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,/একফালি টিন,/ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো/এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অর/‘স্বা-ধী-ন-তা’।’ (‘নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে’, শহীদ কাদরীর কবিতা)
পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে কবিরা কলমকে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে শাণিত রেখেছেন। দ্রোহ ও ঘৃণায় নরপশুদের কলঙ্কের বিরুদ্ধে কবিরা হাজারো পঙ্তি রচনা করেছেন। অনেকে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কবি জসীমউদ্দীন তার ‘দগ্ধগ্রাম’ কবিতায় যুদ্ধকালীন বাস্তবতা চিহ্নিত করেছেন এভাবে “কী যে কী হইল পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি/সারা গাঁও ভরি আগুনে জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।/মার কোল থেকে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান/পিতার সামনে শিশুরে কাটিল করিল রক্ত স্নান।/কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায়, যূপকাষ্ঠের গায়/শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়গ ধায়।’
কবি দিলওয়ার স্বাধীনতার কাছে সমর্পিত হয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন এভাবে - “সেই স্বাধীনতা তুমি, আকাশ পাতাল যার নামে/প্রচন্ড আনন্দে দোলে, আমাকে দোলাও প্রিয় সাথী/তোমার সম্মান রাখো নয়তো কামনা আত্মঘাতী/আঁধারে হানবে ছুরি যে বুক তোমারি পরিণাম”'। এ ছাড়াও স্বাধীনতা নামক যে সূর্য বাঙালির প্রাণে সবার আলো হয়ে ফুটে উঠবার প্রত্যয় সূচিত করেছিল তাকে সহস্র অন্ধকার রাতের গাঢ়তায় পথরোধ করতে পারেনি। কবি দিলওয়ার তাই স্বাধীনতার সোনালি সম্ভাবনাকে উচ্চারণ করেছিলেন_ “ঐ দেখো স্বাধীনতা জ্বলছে/স্বাধীনতা চৈতালী সূর্য/বিরুদ্ধ আকাশে রয়েছে/জনগণ! কই রণতূর্য/আর নয় মৌখিক উক্তি/আমি তোমারি যে প্রাণ সূর্য/শেষেবার চাই আজ মুক্তি”।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পর সত্তরের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাঙালির মানবিক মূল্যবোধের বিপর্যয় ঘটে। নিজ ভূমিতে থেকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার অনেকটা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এত কিছুর মাঝে থেকেও কবি নির্মলেন্দু গুণ মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বদেশের স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন এবং প্রতিটি মানুষের জীবনে তার নিজের যে অধিকার তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আহ্বান করেছিলেন সুন্দর কিছু প্রতীকের বর্ণনায়_ 'আমি দৃশ্যে-গন্ধে-রক্তে-স্পর্শে-গানে/সুন্দরের অবয়ব পেতে চাই/মধ্যরাত্রির স্বপ্নের মতো মাধবী কে চাঁদ দেবো, নীলিমাকে দেবো নীল আকাশ/আমাকে ফিরিয়ে দাও জীবনের সামান্য অধিকার'। এ ছাড়াও নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীনতাকে জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা উলঙ্গ শিশুরূপে দেখেছেন। একটি দেশের স্বাধীনতা যখন বস্ত্রহীন তখন কে না চায় ওই বস্ত্রহীন শিশুটি তার শরীরে পোশাক পরুক। কবির এই যে স্বাধীনতাকে উলঙ্গ সন্তানের মতো পোশাক পরিয়ে দেয়ার মতো সুন্দর উপমায় রূপায়িত করা তা অতুলনীয়। তা ছাড়া উলঙ্গতা কোনো স্বাধীনতা নয় এজন্য বাঙালির স্বাধীনতা যেন দীর্ঘজীবী হয় সেই স্বপ্নে বেঁচে থেকে নিজের তথা স্বদেশের অস্তিত্বের সন্ধান করেছেন- “জননীর নাভীমূল ক্ষতচিহ্ন রেখে/যে তুমি উলঙ্গ শিশু রাজপথে বেরিয়ে এসেছো/হে আমার দুঃখ স্বাধীনতা তুমি পোষাক পরো/স্বাধীনতা তুমি দীর্ঘজীবী হও, বেঁচে থাকো/আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে”।
স্বাধীনতার জন্য আকুল অপেক্ষা, প্রজন্মপ্রহর আর অর্থনৈতিক স্থিতি-অস্থিতির কালযাপনের ক্লান্তি শামসুর রাহমান অনুভব করেন ‘শূন্য থালা হাতে’ ‘পথের ধারে’ বসে-থাকা ‘হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী’র উপলব্ধির গাঢ়তায়। কবি বাঙালি জাতির মনন-চেতনকে আঁকছেন এভাবে : ‘তোমার জন্যে,/সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ন কৃষক,/কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,/মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,/গাজী গাজী ব’লে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে/ রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস/এখন পোকার দখলে/আর রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো/সেই তেজী তরুণ যার পদভারে/একটি নতুন পৃথিবী জন্ম হ’তে চলেছে-/ সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা) এ ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমান একই কবিতায় স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলেছেন। তাই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- “তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্য/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক,/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা”।
এখনো স্বাধীনতার চেতনার অবসান হয়নি। এ চেতনাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কবিরা অনুপ্রেরণা হিসেবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। মর্মে মর্মে মানুষের স্বাধীনতা একটি বোধের উন্মোচন;/চেতনা বিকাশে সত্তার নব জাগরণ, চির শাশ্বত অমস্নান। কবি বেলাল চৌধুরীর 'মর্মে মর্মে স্বাধীনতা' কবিতার শেষ পঙ্ক্তি দুটির মতোই স্বাধীনতা মানুষের একটি বোধের উন্মোচন। এ বোধ মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে নবজাগরণে উন্মোচিত করে যা সমাজ, রাষ্ট্র তথা নিজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিরসত্য। এ চেতনাই প্রভাবিত হোক আমাদের স্বাধীনতা এবং তৃতীয় বিশ্বে কবিতাই সাহসের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাক মারণাস্ত্র নিয়ে স্বাধীনতার জন্য এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করার সময় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো পৃথক ভৌগোলিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করে যান। বাংলা দ্বিখন্ডিত হয় এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তান অংশে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে।জন্মের পর থেকেই বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের দ্বারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি সার্বিক জীবনযাপনে নানা রকম বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়। পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠছিল তাতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ জাতীয়তাবোধে উত্তাল রাজনৈতিক ঢেউ আছড়ে পড়ছিল বাংলা কবিতায়। পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সমাজ ও ঐতিহ্যনিষ্ঠতা, আবহমান বাঙলা ও বাঙালির লোকাচার, গ্রামীণ ও নিসর্গপ্রীতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে রোমান্টিকতা মিশ্রিত আবহ থাকলেও ষাটের দশকে অত্যধিক রাজনীতিমনস্কতা পরিলক্ষিত হয় ,সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপক আকারে উদ্ভাসিত।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম আরম্ভ হওয়ার প্রথম দিনগুলোতে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান একটা উদ্দীপনা অনুভব করেছে। অনেকের মনেই পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালিদের সঙ্গে মিলে মিশে বসবাস করার একটি আবেগ কাজ করেছে নিঃসন্দেহে। যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে বহুজাতির একত্র বাস পৃথিবীতে বিরল নয়। কিন্তু অল্প দিন পরেই বাঙালির মোহভঙ্গ ঘটে। এই মনোবেদনার কথা সিকান্দার আবু জাফর তুলে ধরেছেন কবিতায়- “একাত্মতার স্বপ্ন বিনিময়ে/মেঘ চেয়েছি ভিজিয়ে নিতে/যখন পোড়া মাটি/বারেবারেই তোমার খরা/আমার ক্ষেতে বসিয়ে গেছে ঘাটি/আমার প্রীতি তোমার প্রতারণা/যোগ-বিয়োগ মিলিয়ে নিলে/তোমার লাভের জটিল অংকগুলো,/
আমার কেবল হাড় জুড়োলো/ হতাশ্বাসের ধূলো।” (- বাঙলা ছাড়ো \ সিকান্দার আবু জাফর) । বাঙালির প্রীতির দুর্বলতার সুযোগে পাকিস্তানীদের প্রতারণার কথা তুলে ধরেছেন কবি এবং তাই তাঁর দীপ্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণাও একই কবিতায় -“আমার হাতেই নিলাম আমার/ নির্ভরতার চাবি;/তুমি আমার আকাশ থেকে/সরাও তোমার ছায়া,/তুমি বাঙলা ছাড়ো।”(- বাঙলা ছাড়ো \ সিকান্দার আবু জাফর)
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেই উত্তোলিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজ পতাকা। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কবিতায় সেই লাল-সবুজ পতাকা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস ও স্বপ্নিল সোনার বাংলার প্রতীকÑ ‘আবার বুকের রক্তে বাংলার শ্যামল প্লাবিত,/যেন কোন সবুজাভা নেই আর, সকল সবুজে/ছোপ ছোপ লাল রক্ত, আর সেই/সবুজের বদীর্ণ রক্তের গোলকে/সোনার বাংলার ছবি/মুহূর্তে পতাকা হয়ে দোদুল বাতাসে।’ (জার্নাল ১ : তেইশে মার্চ ১৯৭১)
পঁচিশে মার্চের কালো রাত সত্ত্বেও ছাব্বিশে মার্চ থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ আন্দোলন। রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবা থেকে শুরু করে সাধারণ বালকও যুক্ত হয়েছিল সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে। শহীদ কাদরীর কবিতায় তা পেয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনাÑ ‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,/একফালি টিন,/ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো/এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অর/‘স্বা-ধী-ন-তা’।’ (‘নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে’, শহীদ কাদরীর কবিতা)
পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে কবিরা কলমকে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে শাণিত রেখেছেন। দ্রোহ ও ঘৃণায় নরপশুদের কলঙ্কের বিরুদ্ধে কবিরা হাজারো পঙ্তি রচনা করেছেন। অনেকে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কবি জসীমউদ্দীন তার ‘দগ্ধগ্রাম’ কবিতায় যুদ্ধকালীন বাস্তবতা চিহ্নিত করেছেন এভাবে “কী যে কী হইল পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি/সারা গাঁও ভরি আগুনে জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।/মার কোল থেকে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান/পিতার সামনে শিশুরে কাটিল করিল রক্ত স্নান।/কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায়, যূপকাষ্ঠের গায়/শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়গ ধায়।’
কবি দিলওয়ার স্বাধীনতার কাছে সমর্পিত হয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন এভাবে - “সেই স্বাধীনতা তুমি, আকাশ পাতাল যার নামে/প্রচন্ড আনন্দে দোলে, আমাকে দোলাও প্রিয় সাথী/তোমার সম্মান রাখো নয়তো কামনা আত্মঘাতী/আঁধারে হানবে ছুরি যে বুক তোমারি পরিণাম”'। এ ছাড়াও স্বাধীনতা নামক যে সূর্য বাঙালির প্রাণে সবার আলো হয়ে ফুটে উঠবার প্রত্যয় সূচিত করেছিল তাকে সহস্র অন্ধকার রাতের গাঢ়তায় পথরোধ করতে পারেনি। কবি দিলওয়ার তাই স্বাধীনতার সোনালি সম্ভাবনাকে উচ্চারণ করেছিলেন_ “ঐ দেখো স্বাধীনতা জ্বলছে/স্বাধীনতা চৈতালী সূর্য/বিরুদ্ধ আকাশে রয়েছে/জনগণ! কই রণতূর্য/আর নয় মৌখিক উক্তি/আমি তোমারি যে প্রাণ সূর্য/শেষেবার চাই আজ মুক্তি”।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পর সত্তরের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাঙালির মানবিক মূল্যবোধের বিপর্যয় ঘটে। নিজ ভূমিতে থেকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার অনেকটা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এত কিছুর মাঝে থেকেও কবি নির্মলেন্দু গুণ মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বদেশের স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন এবং প্রতিটি মানুষের জীবনে তার নিজের যে অধিকার তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আহ্বান করেছিলেন সুন্দর কিছু প্রতীকের বর্ণনায়_ 'আমি দৃশ্যে-গন্ধে-রক্তে-স্পর্শে-গানে/সুন্দরের অবয়ব পেতে চাই/মধ্যরাত্রির স্বপ্নের মতো মাধবী কে চাঁদ দেবো, নীলিমাকে দেবো নীল আকাশ/আমাকে ফিরিয়ে দাও জীবনের সামান্য অধিকার'। এ ছাড়াও নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীনতাকে জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা উলঙ্গ শিশুরূপে দেখেছেন। একটি দেশের স্বাধীনতা যখন বস্ত্রহীন তখন কে না চায় ওই বস্ত্রহীন শিশুটি তার শরীরে পোশাক পরুক। কবির এই যে স্বাধীনতাকে উলঙ্গ সন্তানের মতো পোশাক পরিয়ে দেয়ার মতো সুন্দর উপমায় রূপায়িত করা তা অতুলনীয়। তা ছাড়া উলঙ্গতা কোনো স্বাধীনতা নয় এজন্য বাঙালির স্বাধীনতা যেন দীর্ঘজীবী হয় সেই স্বপ্নে বেঁচে থেকে নিজের তথা স্বদেশের অস্তিত্বের সন্ধান করেছেন- “জননীর নাভীমূল ক্ষতচিহ্ন রেখে/যে তুমি উলঙ্গ শিশু রাজপথে বেরিয়ে এসেছো/হে আমার দুঃখ স্বাধীনতা তুমি পোষাক পরো/স্বাধীনতা তুমি দীর্ঘজীবী হও, বেঁচে থাকো/আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে”।
স্বাধীনতার জন্য আকুল অপেক্ষা, প্রজন্মপ্রহর আর অর্থনৈতিক স্থিতি-অস্থিতির কালযাপনের ক্লান্তি শামসুর রাহমান অনুভব করেন ‘শূন্য থালা হাতে’ ‘পথের ধারে’ বসে-থাকা ‘হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী’র উপলব্ধির গাঢ়তায়। কবি বাঙালি জাতির মনন-চেতনকে আঁকছেন এভাবে : ‘তোমার জন্যে,/সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ন কৃষক,/কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,/মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,/গাজী গাজী ব’লে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে/ রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস/এখন পোকার দখলে/আর রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো/সেই তেজী তরুণ যার পদভারে/একটি নতুন পৃথিবী জন্ম হ’তে চলেছে-/ সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা) এ ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমান একই কবিতায় স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলেছেন। তাই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- “তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্য/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক,/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা”।
এখনো স্বাধীনতার চেতনার অবসান হয়নি। এ চেতনাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কবিরা অনুপ্রেরণা হিসেবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। মর্মে মর্মে মানুষের স্বাধীনতা একটি বোধের উন্মোচন;/চেতনা বিকাশে সত্তার নব জাগরণ, চির শাশ্বত অমস্নান। কবি বেলাল চৌধুরীর 'মর্মে মর্মে স্বাধীনতা' কবিতার শেষ পঙ্ক্তি দুটির মতোই স্বাধীনতা মানুষের একটি বোধের উন্মোচন। এ বোধ মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে নবজাগরণে উন্মোচিত করে যা সমাজ, রাষ্ট্র তথা নিজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিরসত্য। এ চেতনাই প্রভাবিত হোক আমাদের স্বাধীনতা এবং তৃতীয় বিশ্বে কবিতাই সাহসের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাক মারণাস্ত্র নিয়ে স্বাধীনতার জন্য এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইবনে মিজান ০৬/০৪/২০১৮বেশ লিখেছেন
-
কামরুজ্জামান সাদ ২৭/০৩/২০১৮চাই বিশুদ্ধ স্বাধীনতা