এসো করো স্নান নবধারা জলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে…। এমন আহ্বান চিরকালই সুমধুর! গ্রীষ্মের শেষবেলার ওষ্ঠাগত তাপদাহের মধ্যে নবধারাজলে স্নান করে শীতল হওয়ার এ আহ্বান কবির; সঙ্গে প্রকৃতিরও। আজবৃহস্পতিবার ১৪২৪ বঙ্গাব্দের পহেলা আষাঢ়। আনন্দ-স্পর্শ-আশাজাগানিয়া বর্ষা ঋতুর প্রথম দিবস। বাংলা প্রকৃতির ঐশ্বর্য ভরা ঋতু বর্ষার পঞ্জিকীয় অভিষেক। গাছের পাতা, টিনের চাল কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে এবং খোলা আকাশের প্রান্তরজুড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার দিন। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি হবে। না হলেও কী কিছু যায় আসে? গত কিছুদিন বৃষ্টি ছিল অঝোর ধারায়। তবুও বর্ষার বৃষ্টি শুরু হবে আজই। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার অঙ্গন আষাঢ়-বন্দনায় নিবেদিত, উচ্ছ্বসিত। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে, চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডে, নকশিকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারে বর্ষার অপরূপা রূপবর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত চিরকালীন হয়ে আছে।
বর্ষা কবি-সাহিত্যিকদের মাস। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এমন কোনো কবি নেই যিনি কি-না বর্ষা নিয়ে এক-দু’লাইন লেখেননি। আষাঢ়-শ্রাবণ, বর্ষা-বৃষ্টি এসব শব্দ কবিদের ভাবের জগতে বুঁদ করে, তাঁদের চোখ চকচক করতে থাকে,হাত নিশপিশ করতে থাকে, আর দেখতে দেখতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরিয়ে ফেলেন।
বাংলায় আষাঢ়-শ্রাবণ দু’মাস বর্ষা ঋতু। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। তাই চারপাশের পরিবেশ রূপ বদলায়। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলি, বকুল,জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এ মাসের তাৎপর্য কিছুটা ভিন্ন। আষাঢ় মানেই যেন মেঘবতী জলের মৌসুম। বর্ষার বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের হাসি তো ভুবন ভোলানো!কী গ্রাম, কী নগর সর্বত্রই বর্ষার আগমনী বার্তা জানান দেয় কদম। যেন একই কথার জানান দিতে পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির জল গায়ে নিয়ে নৃত্য করে।’
বর্ষায় প্রকৃতির এমন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- “রিমঝিম রিমঝিমঘন দেয়া বরষে/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে/কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে/কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে/মনের বনের মুকুল খোলে/নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে…।” বর্ষায় নিজের চিত্তচাঞ্চল্যের কথা জানিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- “মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণসঙ্গীতে/রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম…।”
রিমঝিম এ বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ বাঙালির আজীবন সঙ্গী। স্কুলে যেতে যেতে কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা। আর যত করে ব্যাগে পুড়ে রাখে রঙিন ছাতাটি। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষার এইতো রূপ। আষাঢ় মানেই সময়-অসময় ঝমঝম বৃষ্টি। কর্দমাক্ত পথঘাট। খাল-বিলে থৈ থৈ পানি। নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পালতোলা নৌকার সারি। বর্ষার নতুন জলে স্নান সেরে প্রকৃতির মনও যেন নেচে ওঠে। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল-তমাল শাল-পিয়াল আর মরাল কপতের বনবীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল।
উদ্দাম যৌবনকে যারপরনাই প্রভাবিত করে বর্ষা। প্রেমের বোধ জাগায় মনে। কবিগুরু তাই লেখেন- “তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা…।” একই ভাবনায় আক্রান্ত নজরুল লেখেন- “রিমঝিম রিমঝিম ঝরে শাওন ধারা/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা/ঘুমন্ত ধরা মাঝে/জল-নূপুর বাজে/বিবাগী মন মোর হ’ল পথহারা…।” একই কবিতার পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতার কথা জানিয়ে কবি লেখেন-“ চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে/অতীত স্মৃতি হ’য়ে ফিরে ফিরে আসে/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদলে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা…।”
এ ঋতু কখনো প্রেমের, আবার কখনোবা বিরহের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা ঋতুকে বিপুল বর্ণে আর রঙে তুলে ধরেছেন উজ্জ্বলভাবে। তিনি বলেছেন, “নীল নবঘনে/আষাঢ় গগনে/তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।” ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় কবি বলেছেন, “এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরিষায়/এমন মেঘস্বরে/বাদল ঝরঝরে…।”
বর্ষা বাঙালির জীবনে এক অনন্যসাধারণ ঋতু। বাঙালির জীবন, পরিবেশ , কৃষ্টি, সামাজিকতা, আনন্দ-বেদনা, চালচলনে, গানে, উৎসব, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঘিরে বিপুলভাবে এই ঋতুর আলোকবর্তিকা জড়িয়ে আছে। আবিষ্ট হয়ে আছে আমাদের বোধনে। মহাকবি কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহকাতর যক্ষ মেঘ’কে দূত করে কৈলাশে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়ার কাছে। যক্ষের সে বিরহ বারতা মেঘদূত যেন সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহকাতর চিত্তে, যুগ হতে যুগান্তরে।
কবি নির্মলেন্দু গুণের উপলব্ধিও মজার। যা বলে- “বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছেন মহাভারতের পঞ্চপা-ব!হয়তো এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বাড়ে।” পুরনো বিয়োগ ব্যথা বুকে বাজে। সে অনুভূতি জানিয়ে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন- “এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা ভাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর…। হয়তো একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন।” এমন দিনে প্রেয়সীকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে দুর্বিন শাহ লিখেছেন- “প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দু’টি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া…। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বলাটি এমন-“বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যুথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল…।”আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সব বিরহীর- “শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না…।” কবি অন্যত্র লেখেন - “অথৈ জলে মাগো,মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই…।”এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম হয় বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে,বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন তাঁর ভান্ডারপূর্ণতায়।
বর্ষা কবিদের আলোড়িত করলেও অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য, উপকারের এমনটি বললে কিছু বেশি বলা হবে বৈকি। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ি ঢলে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নেয়া সেও বর্ষার আরেক রূপ! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারা বছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। অবস্থা তুলে ধরে ভাটিবাংলার সাধক পুরুষ শাহ আবদুল করিম গান রচনা করেন-“ আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ঘরে বসে ভাবনা গোনা নৌকা বিনা চলা যায় না/বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়…।” একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকাটিও ফেরে না কত দিন! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্প তো প্রতিদিনের।
তবে সুখস্মৃতিগুলো মনে রেখেই প্রতিবছর বর্ষাকে বরণ করে নেয় বাঙালি। বিশেষ করে শহর-নগরে হরেক আয়োজনে চলে বর্ষাবন্দনা।উৎসবের মেজাজে এসব আয়োজনে ভিড় করে মানুষ। এভাবে প্রিয় ঋতু বর্ষাকে বরণ করে নেয়বাঙালি।
বর্ষা কবি-সাহিত্যিকদের মাস। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এমন কোনো কবি নেই যিনি কি-না বর্ষা নিয়ে এক-দু’লাইন লেখেননি। আষাঢ়-শ্রাবণ, বর্ষা-বৃষ্টি এসব শব্দ কবিদের ভাবের জগতে বুঁদ করে, তাঁদের চোখ চকচক করতে থাকে,হাত নিশপিশ করতে থাকে, আর দেখতে দেখতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরিয়ে ফেলেন।
বাংলায় আষাঢ়-শ্রাবণ দু’মাস বর্ষা ঋতু। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। তাই চারপাশের পরিবেশ রূপ বদলায়। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলি, বকুল,জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এ মাসের তাৎপর্য কিছুটা ভিন্ন। আষাঢ় মানেই যেন মেঘবতী জলের মৌসুম। বর্ষার বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের হাসি তো ভুবন ভোলানো!কী গ্রাম, কী নগর সর্বত্রই বর্ষার আগমনী বার্তা জানান দেয় কদম। যেন একই কথার জানান দিতে পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির জল গায়ে নিয়ে নৃত্য করে।’
বর্ষায় প্রকৃতির এমন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- “রিমঝিম রিমঝিমঘন দেয়া বরষে/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে/কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে/কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে/মনের বনের মুকুল খোলে/নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে…।” বর্ষায় নিজের চিত্তচাঞ্চল্যের কথা জানিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- “মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণসঙ্গীতে/রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম…।”
রিমঝিম এ বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ বাঙালির আজীবন সঙ্গী। স্কুলে যেতে যেতে কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা। আর যত করে ব্যাগে পুড়ে রাখে রঙিন ছাতাটি। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষার এইতো রূপ। আষাঢ় মানেই সময়-অসময় ঝমঝম বৃষ্টি। কর্দমাক্ত পথঘাট। খাল-বিলে থৈ থৈ পানি। নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পালতোলা নৌকার সারি। বর্ষার নতুন জলে স্নান সেরে প্রকৃতির মনও যেন নেচে ওঠে। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল-তমাল শাল-পিয়াল আর মরাল কপতের বনবীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল।
উদ্দাম যৌবনকে যারপরনাই প্রভাবিত করে বর্ষা। প্রেমের বোধ জাগায় মনে। কবিগুরু তাই লেখেন- “তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা…।” একই ভাবনায় আক্রান্ত নজরুল লেখেন- “রিমঝিম রিমঝিম ঝরে শাওন ধারা/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা/ঘুমন্ত ধরা মাঝে/জল-নূপুর বাজে/বিবাগী মন মোর হ’ল পথহারা…।” একই কবিতার পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতার কথা জানিয়ে কবি লেখেন-“ চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে/অতীত স্মৃতি হ’য়ে ফিরে ফিরে আসে/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদলে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা…।”
এ ঋতু কখনো প্রেমের, আবার কখনোবা বিরহের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা ঋতুকে বিপুল বর্ণে আর রঙে তুলে ধরেছেন উজ্জ্বলভাবে। তিনি বলেছেন, “নীল নবঘনে/আষাঢ় গগনে/তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।” ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় কবি বলেছেন, “এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরিষায়/এমন মেঘস্বরে/বাদল ঝরঝরে…।”
বর্ষা বাঙালির জীবনে এক অনন্যসাধারণ ঋতু। বাঙালির জীবন, পরিবেশ , কৃষ্টি, সামাজিকতা, আনন্দ-বেদনা, চালচলনে, গানে, উৎসব, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঘিরে বিপুলভাবে এই ঋতুর আলোকবর্তিকা জড়িয়ে আছে। আবিষ্ট হয়ে আছে আমাদের বোধনে। মহাকবি কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহকাতর যক্ষ মেঘ’কে দূত করে কৈলাশে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়ার কাছে। যক্ষের সে বিরহ বারতা মেঘদূত যেন সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহকাতর চিত্তে, যুগ হতে যুগান্তরে।
কবি নির্মলেন্দু গুণের উপলব্ধিও মজার। যা বলে- “বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছেন মহাভারতের পঞ্চপা-ব!হয়তো এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বাড়ে।” পুরনো বিয়োগ ব্যথা বুকে বাজে। সে অনুভূতি জানিয়ে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন- “এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা ভাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর…। হয়তো একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন।” এমন দিনে প্রেয়সীকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে দুর্বিন শাহ লিখেছেন- “প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দু’টি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া…। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বলাটি এমন-“বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যুথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল…।”আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সব বিরহীর- “শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না…।” কবি অন্যত্র লেখেন - “অথৈ জলে মাগো,মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই…।”এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম হয় বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে,বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন তাঁর ভান্ডারপূর্ণতায়।
বর্ষা কবিদের আলোড়িত করলেও অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য, উপকারের এমনটি বললে কিছু বেশি বলা হবে বৈকি। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ি ঢলে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নেয়া সেও বর্ষার আরেক রূপ! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারা বছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। অবস্থা তুলে ধরে ভাটিবাংলার সাধক পুরুষ শাহ আবদুল করিম গান রচনা করেন-“ আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ঘরে বসে ভাবনা গোনা নৌকা বিনা চলা যায় না/বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়…।” একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকাটিও ফেরে না কত দিন! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্প তো প্রতিদিনের।
তবে সুখস্মৃতিগুলো মনে রেখেই প্রতিবছর বর্ষাকে বরণ করে নেয় বাঙালি। বিশেষ করে শহর-নগরে হরেক আয়োজনে চলে বর্ষাবন্দনা।উৎসবের মেজাজে এসব আয়োজনে ভিড় করে মানুষ। এভাবে প্রিয় ঋতু বর্ষাকে বরণ করে নেয়বাঙালি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জয়শ্রী রায় মৈত্র ১৫/০৬/২০১৭সুখস্মৃতিগুলো দারুণ ।
-
সাঁঝের তারা ১৫/০৬/২০১৭খুব ভাল