www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ছোট এই জীবনে

“মা , আমি মরে গেলে আমাকে মনে রেখোনা ।ভুলে যেও । তুমি যদি কথা না দাও তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো না”। মা কাঁদতে কাঁদতে বলে , “আমি ভুলে যাবো বাবা , আমি কখনোই মনে রাখবো না। আমি সব ভুলে যাব” । খুব জ্বর আসে ছেলেটার । মাত্র ১৭ বছর বয়স। এই বয়সেই তাকে কি নিদারুণ পরীক্ষাই না দিতে হচ্ছে। মা ওষুধ দেন। খেয়ে ঘুমিয়ে পরে ছেলেটা । মা নামাজে দাঁড়ান । নামাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করেন। কয়েক রাত ধরে ঘুম আসেনা। প্রায় সারারাত নামাজেই কেটে যায় । ঘুমন্ত ছেলের কাছে যান । মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। আসেনা। আজকাল চোখ থেকে আর পানিও আসতে চায়না। হয়তো চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কি চটপটেই না ছিল ছেলেটা । ভারী মায়াবী দেখতে। পড়াশোনায় ভাল ছিল। সারা বাসা মাতিয়ে রাখত। সেই ছেলের এমন অবস্থা মা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। বাবাও পারেন না। বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে বাবা চাকুরি করেন। একদিন স্কুল থেকে ফিরে ছেলেটার জ্বর এসেছিল। সেরে যাবে তাড়াতাড়ি এটাই ভেবেছিলেন বাবা মা । জ্বরের ওষুধ দেয়া হয়েছিল। কমেনি। সারারাত কষ্ট পেয়েছিল ছেলেটা । মা সারারাত জেগে মাথায় পানি দিইয়েছিলেন । শরীর মুছে দিয়েছিলেন। না ,পরেরদিনও জ্বর কমার কোন লক্ষণ দেখা গেলনা। কয়েকদিন ধরেই ছেলের স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছিল না। বাবা তার এক ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করে ওষুধ খাওয়াচ্ছিলেন। সেই বন্ধুই পরামর্শ দিয়েছিল ভাল একজন ডাক্তার দেখাতে। পরেরদিনই দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার কিছু ইতিহাস শুনলেন। পরীক্ষা করলেন।সবকিছুর পর মুখ থমথমে হয়ে গেল। রক্ত পরীক্ষা দিয়ে সেদিনই দেখা করতে বললেন । রাত এগারটার দিকে একাই চেম্বারে গেলেন ছেলের বাবা । ছেলেকে , ছেলের মাকে আর ছোট মেয়েকে আগেই বাসায় রেখে এসেছিলেন । ভয়ে ভয়ে ঢুকলেন রিপোর্ট নিয়ে। ডাক্তার রিপোর্ট হাতে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, “যা সন্দেহ করেছিলাম তাই, ব্লাড ক্যন্সার। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। নাহলে বেশীদিন বাঁচবে না”। ছেলেটার বাবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে । চোখ ভিজে যায় । বাচ্চাদের মত কান্না চলে আসে। ডাক্তারও কেমন অসহায় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। ছেলের বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন । পা চলতে চায়না। কোনভাবে খুব কষ্ট করে চেম্বার থেকে বের হয়ে আসেন। চোখ মোছেন রুমাল দিয়ে। রিকশা নিয়ে বাসায় চলে আসেন। এত অসহায় এত খারাপ কখনো লাগেনি। বাসায় ফিরলে ছেলের মা জিজ্ঞেস করেন, “এত রাত হলো কেন ? রিপোর্ট কি ? ডাক্তার কি বলল?”।ছেলেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তেমন কিছু না। ইনফেকশন । সেরে যাবে” । মা বলেন , “বলেছিলাম না বড় কিছু হবেনা । আমার ছেলে আবার ঠিক হয়ে যাবে”।সারারাত বসে বসে বাবা ভাবেন। বারবার চোখ মুছেন। সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে তার। পৃথিবীটা খুব অসহনীয় মনে হয় তার। সজ্ঞানে কোনদিন বড় অন্যায় করেছেন বলে মনে করতে পারেন না। কোথায় যেন পড়েছিলেন “যার ঈমান যত শক্ত তার পরীক্ষাও তত কঠিন”। কিন্তু এ কেমন পরীক্ষা ? কিছুই ভেবে পান না। তার নিজের ব্লাড ক্যন্সার শুনলেও বোধহয় এত বিচলিত হতেন না। ভোরে ছেলের মা নামাজ পড়তে উঠে । ছেলের বাবাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে। স্ত্রীকে কিভাবে বলবেন সারারাত অনেকবার ভেবেছেন। শেষে স্থির করেন সব খুলে বলবেন। কারণ চিকিৎসা শুরু হলে এমনিতেই সবাই সব জেনে যাবেন । ছেলের মা সব শোনার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন । কান্না শুরু করেন। অনেকক্ষণ কান্নার পর ছেলের কাছে যান । একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কি মায়াবি ভাবে ঘুমাচ্ছে।অথচ এত বড় অসুখ শরীরে । কাঁদতে কাঁদতে আবার ছেলের বাবার কাছে ফিরে আসেন। “চল ঢাকায় যাই । ওখানে অনেক বড় বড় ডাক্তার আছে তাদের দেখাই। নিশ্চয় কোন না কোন সমাধান আছে”। ছেলের বাবা মুহূর্তেই রাজী হয়। সেদিন দুপুরেই মেয়েকে আত্মীয়ের বাসায় রেখে ঢাকায় রওনা দেন। পরেরদিনই ডাক্তারের সাক্ষাৎ পান। তিনি দেশ বরেণ্য রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ । আবার কিছু রিপোর্ট করতে দেন। রিপোর্ট দেখে একই কথা বলেন। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের কথা বলেন। দেশেই এসব হচ্ছে সেকথাও বলেন। ছেলের বাবা সব শুনে আরও ভেঙ্গে পড়েন । টাকা যোগাড় করতে এলাকায় চলে আসেন। ছেলের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায় । এর মধ্যে কয়েকজন পরামর্শ দেয় ভারত নিয়ে যাবার । ছেলের বাবার তখন মাথা খারাপ অবস্থা। সাগরে পড়লে মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায় ছেলের বাবার ছিল তেমন অবস্থা। পাসপোর্ট ভিসা দ্রুতই হয়ে যায় । ভারতেও একই কথা। সবশেষে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে দেশে ফিরেন। ছেলে আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যেতে থাকে। আবার স্কুল শুরু করে। জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করে। মাঝে একবার ভারতে যান সবাই। চিকিৎসকও ভাল কথা বলেন। অনেক জায়গা ঘুরে বেড়ানো হয়। জীবনকে অনেক ভাল লাগতে থাকে।সব কষ্ট যেন কর্পূরের মতো উড়ে যায় । দেশে ফিরে আবার জ্বর আসে ছেলেটার । আবার সেই আগের মতই লক্ষণ । ভয় পেয়ে যায় ছেলের বাবা মা। আগের অভিজ্ঞতাই তাদের ভয় পাওয়াতে বাধ্য করে। আবার ভারতে যান সবাই। এবার চিকিৎসক আর ভাল কথা বলেন না। পুনরায় আবার ব্লাড ক্যন্সার ডায়াগনোসিস হয়। এবার খুব খারাপ লাগে।ভালই ছিল এতদিন। আবার সেই অসহায়তা । এবার অসহায়ত্ব আরও বেড়ে যায় । কোন আশার বাণী তারাও আর শোনায় না। দেশে নিয়ে আসেন তারা ছেলেকে। ছেলেও এতদিন সব বুঝে গেছে । সেও বুঝতে পারে জীবন আর বেশীদিন নেই। কোন রুচি নেই। প্রচণ্ড জ্বর । বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনা ছেলেটা । তার মধ্যেই মাকে অনেক কথাই বলে। মা ও কেমন জানি হয়ে গেছেন। সারাদিন জায়নামাজে থাকেন। ধর্মগ্রন্থ নিয়ে পড়েন । ছেলেটার খুব বাঁচতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবী ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয়না। বন্ধুদের সাথে খেলতে ইচ্ছে হয়। নদীতে সাঁতার কাটার সাধ হয়। কিন্তু ছেলেটা ভাবে আমাদের আর কতই ক্ষমতা আছে? সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাই চূড়ান্ত । তিনি যা চান তাই হয়। তার বিধান রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই। একদিন খুব ভোরে পানি খেতে চায় ছেলেটা । মা নিয়ে এসে দেখে ঘুমিয়ে গেছে। চিরশান্তির ঘুমে তলিয়ে গেছে ছেলেটা । তার আদরের ছেলে। ভালবাসার ছেলে। সেই যে তখন চিৎকার দিয়ে কেঁদেছিলেন এখন একেবারেই নির্বাক হয়ে গেছেন। ছেলের বাবা এখন প্রতি জুম্মার পর ছেলের কবর এর কাছে যেয়ে দোয়া করেন। অনেকবার ভেবেছেন এইবার কাঁদবেন না। পারেন না। প্রতিবারই কিভাবে জানি কান্না চলে আসে। তিনিও বুঝতে পারেন এই জীবনে কান্না ছাড়া তিনি থাকতে পারবেন না।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৯১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০৫/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast