রশিদ স্যার
রশিদ স্যারের মন ভাল নেই। একটা আধাসরকারী স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন। অধ্যক্ষের সাথে আজ কথা কাটাকাটি হয়েছে। অথচ কোন দোষ ছিলনা তাঁর । স্কুলের পরিচালনা পরিষদের এক সদস্যের মেয়েকে তিনি বকা দিয়েছিলেন। বকা দেবার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও ছিল। মেয়েটি তার সহপাঠীর সাথে হাত ধরে বসে ছিল। সেদিন ক্লাসেও আসেনি মেয়েটা । স্কুলের পেছনে কিছুটা নির্জন গাছপালা সমৃদ্ধ জায়গা আছে। সেখানেই তিনি সেই মেয়েকে দেখেছিলেন ছেলেটার সাথে। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। ছেলেটাকে বেশ কয়েকটা চড় থাপ্পড়ও মেরেছিলেন। মেয়েটাকে কড়া বকা দিয়েছিলেন। এজন্যেই আজ কথা শুনতে হল অধ্যক্ষের কাছ থেকে। সত্যিই আদর্শের কোন মুল্য নেই আজ । ভাল কথারও কোন দাম নেই। মাথাটা নিচু হয়ে যায় তার। বুকের ভেতর কেমন অস্বস্তি হয়। শিক্ষক হয়েও তাকে মাথা নিচু করে চলতে হয় । বেতন পান সর্বমোট একুশ হাজার টাকা । রশিদ স্যারের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা বুয়েটে পড়ে । মেয়েটা ছোট । তাঁর স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে । ছেলেকে মাসের প্রথমেই পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতে হয়। ইদানিং টাকা পাঠাতে নিষেধ করেছে তাঁর ছেলে শুভ । কোথায় নাকি প্রাইভেট যোগাড় করেছে। রশিদ স্যারের স্ত্রীর প্রাইভেট পড়ানোতে মৃদু আপত্তি ছিল। শুভ বলেছে বিকেলে সে পড়াবে । যাতে পড়াশুনার ক্ষতি না হয়। ছেলের প্রতি অগাধ আস্থা রশিদ স্যারের। কোন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া ছাড়াই সে এসএসসি আর এইচএসসি দুইটাতেই গোল্ডেন পেয়েছে। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম একশ জনের মধ্যেই ছিল। মাঝে মাঝে ঢাকায় যান রশিদ স্যার। ছেলের সাথে করে যখন রিকশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ান এক স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করেন। বুয়েটের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখিয়েছে ছেলে। আর্কিটেকচার বিল্ডিঙটা অপূর্ব লেগেছে তার। তিনি আর্টসের ছাত্র। তারপরেও ইঞ্জিনিয়ার তৈরির কারখানা তার কাছে খুব আপন মনে হয়। তাঁর ছেলে সেখানে পড়ে বলেই বোধহয় এমন হয়। স্ত্রী সাহিদার কাছে এসে সব গল্প করেন। সাহিদা চোখ বড়বড় করে শোনে । নামাজ পড়ে আল্লাহ্র কাছে ছেলের জন্যে প্রার্থনা করে। সেদিন অধ্যাক্ষের সাথে ঘটনার পর রশিদ স্যার কেমন জানি হয়ে যান । তিনি ভাবেন আর কাউকে বকবেন না।শাসন করবেন না! তাঁর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে । সেই সময়ের শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে । তার প্রিয় শিক্ষক ছিল কালিপদ স্যার। সন্ধ্যার সময় বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে যেয়ে যিনি পড়াশোনার খোঁজ করতেন ছাত্রদের । সবাই তাকে যমের মত ভয় করত আবার ভালওবাসত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী কালিপদ স্যারকে গুলি করে মেরে ফেলে। সেদিনের কথা স্পষ্টভাবে মনে পড়ে রশিদ স্যারের। কালিপদ স্যারের কোন শত্রু ছিলনা । বিয়েও তিনি করেননি। পড়াশোনা করা আর পড়ানোই ছিল তার একমাত্র কাজ। স্কুলের সবাই স্যারের মৃতদেহ দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছিল । রশিদ স্যারের সেসব কথা মনে পড়ে । আর এখন মাঝে মাঝে তাঁর স্কুলের শিক্ষকদের কথা ভাবেন। অঙ্কের শিক্ষক তো প্রাইভেট না পড়লে ইচ্ছে করে কম নম্বর দেন। ইংরাজির শিক্ষক দেন শর্ট সাজেশন। এক শিক্ষক তো সেদিন শেয়ার মার্কেটের গল্প করছিলেন! শিক্ষকদের কমনরুম রশিদ স্যারের ভাল লাগেনা। কোন জ্ঞানের চর্চা নেই। আছে অজ্ঞানতার চর্চা আর পরচর্চা । এসব শিক্ষকদের সাথে কালিপদ স্যারের কোন মিলই খুঁজে পান না। বাসায় এলে রশিদ স্যারের ভাল লাগে। তার বিশাল লাইব্রেরী থেকে বই বের করে তিনি পড়েন ।মসজিদে যেয়ে তিনি নামাজ পড়েন। মেয়েকে পড়াশোনায় সাহায্য করেন। । মেয়েটা যেমন মিষ্টি তেমন বুদ্ধিমতি। ভাবেন মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন । মেয়েকে স্কুলের বইয়ের বাইরেও অন্য বই পড়তে বলেন। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর সদস্য করে দিয়েছেন। বই পড়তে ভারী ভালবাসে তাঁর মেয়ে। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখেন ডাকপিয়ন এসে চিঠি দিয়ে গেছে। চিঠিটি এসেছে আমেরিকা থেকে। তিনি অবাক হয়ে যান । আমেরিকায় তাঁর বা সাহিদার দূর সম্পর্কেরও কোন আত্মীয় স্বজন থাকেনা। কে পাঠাল চিঠি ? খুলে পড়তে থাকেন। হাতের লেখা চিনতে অসুবিধা হয়না। । তাঁর এতদিনের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র সুমনের লেখা চিনতে অসুবিধা হয়না। যেমন ভদ্র তেমন বিনয়ী ছিল সুমন। চিঠি পড়ে চোখে পানি চলে আসে রশিদ স্যারের। শুভ পাশ করলে তাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থাই করে দিবে সুমন। ওখানে খুব ভাল অবস্থায় আছে। এখন সেখানকার সিটিজেন । পরিবারের একটা ছবিও পাঠিয়েছে । রশিদ স্যারের মনে হয় এতদিন শুধু বৃথাই শিক্ষকতা তিনি করেন নি। সুমনের মত ছাত্রকে তিনি পড়িয়েছেন। তৈরি করেছেন। এটা ভাবতেই তাঁর সব কষ্ট কর্পূরের মত উড়ে যায় । তিনি সহিদাকে সুমনের কথা বলার জন্যে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকেন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জয়শ্রী রায় মৈত্র ০৪/০৫/২০১৭বিষয় খুবই ভালো । বাস্তবধর্মী গল্প । কালিপদ স্যারের হাত ধরে উঠে এসেছিলেন রশিদ স্যার । রশিদ স্যারের হাত ধরে উঠে এল সুমন । এরপর শিক্ষকতার আদর্শের গন্তব্য কোথায় ... কে জানে ? তবুও আমরা আশায় বুক বেঁধে রই ।
-
অনন্ত গোস্বামী ২৮/০৪/২০১৭দারুন সুন্দর
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ২৭/০৪/২০১৭শিক্ষকদের কদর না করার ফলে আজ দেশের ভালো শিক্ষকরা হারিয়ে যাচ্ছেন আর তৈরি হচ্ছে পরিমল এবং এই টাইপের কসাই মার্কা শিক্ষক।
জাতির জন্য এক অশনি সংকেত- কারণ, শিক্ষকতায় ঢুকে যাচ্ছে শেয়ার ব্যবসায়ী, দালাল এবং মাস্তান টাইপের লোকেরা। -
সাঁঝের তারা ২৭/০৪/২০১৭অনবদ্য - মানবিকতা আছে এবং থাকবে নিশ্চয় ...
-
মোঃআব্দুল্লাহ্ আল মামুন ২৭/০৪/২০১৭সুন্দর ।।
-
মধু মঙ্গল সিনহা ২৬/০৪/২০১৭ভালো লাগলো।