www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আমেরিকায় পক্ষকাল (২)

# 'আমেরিকায় পক্ষকাল' # (২)
(২)-ওফ্-(২)

পোর্টল্যান্ড-এ যে কম্পানিতে গেছিলাম আমরা, তার নাম নামটা সঠিক মনে আসছে না...বোধহয় "সেরিন আন্ড সেরিন"। আমেরিকায় বেশ বড় ইন্জিনিয়ারিং কনসালটান্টস্। ওরা ইন্ডিয়াতে ক্লিনরুম তৈরিতে কারিগুরি সাহায্য করার বরাত পেয়েছে।

প্রথম দিন, কাজের কথা বলার আগে চল্ল পরিচয়ের পালা। ওদের সব লিড্ ইন্জিনিয়ারই সাদা চামড়া।পরিচয়ের পর সবাই জানল, কে কার কাউন্টার পার্ট । ওরা জানতে চাইলো কে কতদিন আমরা কাজ করছি আমাদের কম্পানিতে। আমি বল্লাম দশ বছর, কেউ বল্ল পনের বছর, কেউ বল্ল কুড়ি বছর। ওরা শুনছে আর চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম ওদের আশ্চর্য হওয়ার কারন। ওরা বল্ল ওদের গ্ৰুপের ইলেকট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ার বহু বছর ধরে ওদের কম্পানিতে কাজ করছে, যা ভাবা যায় না। জিজ্ঞাসা করাতে বল্ল, "ফোর ইয়ারস"! শুনে, আমাদের চোখ ছোট হওয়ার পালা।

আমার কাউন্টার পার্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের নাম ছিল "বব"। আমার থেকে অনেক জুনিয়র। ওর কাছ থেকে আমার কাজ বুঝে নিচ্ছি। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেছে। ভালোই চলছে সব। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম..."বব, তুমি় কেমন আছ আমেরিকায়"? আমার হয়তো জিজ্ঞাসা করাটা ঠিক হয়নি। আসলে সামাজিক দিকটা ওখানকার জানতে চাইছিলাম। যাহোক্, বব তো খুব রেগে মেগে উঠে চলে গেল আমার আস্পর্ধা দেখে। সেদিন তো আমার সাথে প্রায় কথাই বল্ল না। আমি একটু গিল্টি ফিল করলাম, ভাবলাম না বল্লেই ঠিক ছিল।

অফিসের সামনেটা ছিল ফুল গ্লাস ফাসাড্। দোতালায় আমরা বসতাম। অফিসটা ছিল "অরিগন" ডিসট্রিক্টের "ক্রিসউড্" এস্টেটে। চারদিকে সবুজ অফিস গুলো সব দূরে দূরে। মাঝের জায়গা গুলোতে সব বাহারি রংএর গাছ। অফিসের সামনে রাস্তার ওপারে কোন বিল্ডিং নেই। সবুজ লন আর মাঝে মাঝে বড় গাছ। অবাক হয়ে দেখতাম একটা গাছের পাতাও পড়ে নেই লনে। কারনটা পরে জেনেছিলাম। যার লন সে যদি পরিস্কার না রাখে তবে সরকার করবে পরিস্কার কিন্তু হেভি পেনাল্টি দিতে হবে মালিককে।
অফিস থেকে দেখতাম নীচে ছোট্ট একটা দোকান ঘরে ইন্টেরিয়রের কাজ চলছে। একজন একাই কাজ করছেন। কোমড়ের বেল্টে সব যন্ত্রপাতি লোড় করা। কোন ফাঁকি নেই। সিগারেট খেতে খেতেও কাজ করত। অবাক হতাম।
যাকগে....
এবার ববের কথায় আসি। পরের দিন আমাকে ডেকে কাঁচের ফাসাডের সামনে নিয়ে ওই ইন্টেরিয়র মিস্ত্রিকে দেখিয় বল্ল, ওই মিস্ত্রী আর ইন্জিনিয়ারদের মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই আমেরিকায়। আমেরিকায় বেশি ভালো আছে ডাক্তার আর উকিল। আলাদা ভাবে সামাজিক কোন স্টাটাস নেই ইন্জিনিয়ারদের। আর বল্ল.... "তোমরা অনেক ভালো আছো। সামাজিক ভাবে তোমাদের ইন্জিনিয়ার বলে সন্মান আছে। তোমরা একে অপরকে কত সুন্দর ভাবে দাদা, দিদি...ইত্যাদি বলে সম্বোধন করো। আমার ছেলে আমাকে 'ডাড্' বলে, আমার ভাইকে 'মিস্টার' বলে। কোমড়ে পিস্তল গোঁজা থাকে। ফ্যামেলিতে কোন ইনট্রেগ্ৰিটি নেই তোমাদের মত। সারাদিন ডলারের পেছনে ঘুরি। আমার বাড়ি একটা টিলার উপর। খুব ডাকাতি হয় সেখানে। রাত্রে যখন বাড়ি ফিরি বৌ স্টেনগান নিয়ে দরজা খোলে। কোনদিন ভুলকরে হয়ত চালিয়েই দেবে"।এরপর হো হো করে হেসে উঠে বল্ল..."চলো এবার কাজে যাই"। আমারও ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

একদিন আমরা ওদের অফিসকে বল্লাম আমাদের একদিন মশলাদার লাঞ্চ হলে ভালো হয়। প্রতিদিন মশলা ছাড়া দুপুরের খাওয়াটা ভালো লাগছিল না। একদিন বব্ আমাদের একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে গেল। ছোট চিংড়ি মাছের একটা ডিস্ ছিল আমাদের দেশের রান্নার মত। জানলাম আমাদের মত মেক্সিকানরাও মশলাদার খাওয়া পছন্দ করে।

অফিসটা ছিল শহরের অনেক বাইরে। ঠিক হোল,এক ছুটির দিন আমরা শহর দেখতে যাব সবাই। কিন্তু গাড়িতে না গিয়ে "ভিন্টেজ ট্রেন"-এ যাওয়া হবে। সেই মত স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরা হোল। স্টেশনের চেহারাও পুরোনো দিনের মত। একটা ছোট টিকিট ঘর ব্যাস। সামনে বারান্দা। কোন প্লাটফর্ম নেই। ওপেন এয়ার সব। ট্রেন এল, ছোট্ট পুরোনো দিনের স্টিম ইঞ্জিন। কামড়াও সেই রকম। রট্ আয়রনের বেঞ্চ। সাইড ট্যাগে ঝক্-ঝকে পেতলে ডিটেল খোদাই করা। সবথেকে মজার হোল স্টেশন মাস্টার, ড্রাইভার, চেকার ও অনান্য স্টাফদের কারোই বয়েস আশির নীচে নয় ! ট্রেন নদীর পাশ দিয়ে, বহু ফাক্টরির পাশ দিয়ে, আস্তে আস্তে চলে শহরে পোঁছে দিল। অপূর্ব সে এক অভিজ্ঞতা। শহরকে ওরা বলে ডাউন টাউন। আমাকে সবথেকে বেশী অবাক করেছিল একটা জায়গায় ফ্লাই ওভার ক্রসিং। সেই পয়েন্টে বহু লেভেলে ক্রসিং ছিল। নীচে দাঁড়িয়ে কিছু সময় গুম গুম তীব্র আওয়াজ শুনলাম আর অসংখ্য গাড়ির ছোটাছুটি দেখলাম বিষ্ময়ে। তারপর সামন্য কিছু কেনাকাটা করে টাক্সি করে ফিরেছিলাম। আমেরিকার তৈরী নিদর্শন হিসেবে মেয়ের জন্য ছোট টেড়ি-বিয়ার কিনেছিলাম যদিও বাড়িতে ফিরে ভালকরে দেখে জানলাম ওটা চায়েনা মেড যা হামেশাই এদেশে পাওয়া যায় অনেক সস্তায় !

ওদের অফিসে প্যাটেল বলে একজন পুরোনো টেকনিক্যাল স্টাফ ছিল। দেখতাম ওর কোন স্বাধীনতা নেই বল্লেই চলে। বব্ ওর থেকে অনেক জুনিয়র ছিল। কিন্তু সব ব্যপারে ওনাকে বব্-এর পারমিশন নিতে হোতো। কোন ড্রয়িং এ হাত দিতে পারত না নিজে থেকে। একদিন দুঃখ করে বলেছিল "কালা আদমি" ব্যপারটা তখনও প্রকট। মুখে যতই হ্যাই-হ্যালো করুক সাহেবরা।

আমেরিকার কাজ শেষ আমাদের। এবার দেশে ফেরার পালা। হোটেল থেকে দূরে হাইওয়েতে তাকালে রাত্রে মনে হোত গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আসলে সব একই স্পিডে যাচ্ছে। আমি বাতাসে কেরোসিনের গন্ধ পেতাম। ভালো লাগত না।

দেশের বাড়ির চিন্তা হচ্ছিল। ছোট ছেলে মেয়েকে একা বৌএর জিম্বায় ভাড়া বাড়িতে রেখে এসেছি। নূতন পাড়ায় গেছি। পরিচিতি নেই। তখনতো এখনকার মত মোবাইল ছিলনা যে সবসময় খোঁজ খবর নেব।

সানফ্রান্সিসকো, সিঙ্গাপুর হয়ে আমরা সবাই ফিরব দেশে।খুব অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম যে ভদ্রমহিলা পোর্টল্যান্ড এয়ারপোর্টে ডকুমেন্ট কন্ট্রোল করছিলেন তিনি ইন্ডিয়ার নামই শোনেননি। পাশের স্টাফ থেকে জানলেন। আমরা ওনাকে আমাদের দেশ দেখার রিকোয়েস্ট করলাম। বল্লেন আসবেন। আমরা কৃতার্থ হলাম।

আমরা সানফ্রান্সিসকো ফিরে নাইট হল্ট করলাম। পরের দিন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ধরে ফিরব রাত্রে।পরের দিন সকালে আমরা লোকাল সাইট সিয়িং করতে গোল্ডেন ব্রীজ দেখলাম।আরো কয়েকটা পয়েন্ট দেখলাম। পাহাড়ি পথ। একটা উঁচুপয়েন্টে গেলাম যেখান থেকে সমস্ত শহরটা দেখা যায়। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম বেশ খাড়াই রাস্তা ধরে এক কামরার ট্রামগাড়ি সুন্দর উঠে যাচ্ছে। স্লিপ করে নেমে আসার কথা ! ট্রামের উপরে ইলেকট্রিক তারও নেই ! চোখ পরিস্কার করে আবার দেখলাম। ঠিকই দেখেছি। পরে জানলাম একটা রোপওয়ে ট্রাম লাইনের নীচ দিয়ে যাচ্ছে যার সাথে ট্রাম "ক্লাচ্" করা আছে। লিভার দিয়ে "আনক্লাচ্" করলেই থেমে যাবে। শহরটা ঘুরতে ঘুরতে মনে হোল কোন চাইনিজ সিটিতে আছি। রাস্তায় বেশির ভাগ লোক ঐ শ্রেনীর। পরে জানলাম রাস্তা তৈরী করতে চীন থেকে অনেক শ্রমিক আনা হয়েছিল তারাই খুব দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে থেকে গেছে। আর এক ধরনের লোক দেখলাম, সাহেবের মত বিশাল বড়ি কিন্তু মুখটা ছোট গোলগাল চাইনিজ। আফিসে-ও আমি এমন লোক দেখে অবাক হয়ে গেছি। এরা চাইনিজ আমেরিকান মিক্সড্।
সমুদ্রের পাড়ে দেখলাম সুন্দর সাজানো ঠেলা গাড়ি, টুরিষ্ট সব জাপানি। সাহেব প্যাডেল করে ঠেলা চালাচ্ছে। ভাবা যায় ! আর দেখলাম শহরে কোনায় কোনায় বৃদ্ধ অসমর্থ কিছু লোক টুপি উল্টো করে আর যুবক যুবতীরা কোথাও কোথাও গান করে, গীটার বাজিয়ে সামনে সতরঞ্চি পেতে টাকা চাইছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। টি ভি খুলে হোটেলে দেখে ছিলাম এমপ্লয়মেন্ট নিয়ে খুব খারাপ অবস্থা তখন আমেরিকায়।

বিকেলে সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে এলাম তখনোও জানিনা কি বিশাল চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কেবিন ব্যাগেজ জমা দিয়ে বোর্ডিংপাস নিয়ে চেক্ইন করছি। হ্যান্ডব্যাগ এক্সরে করতে কনভেয়ার বেল্টে দিয়েছি। হটাৎ দেখি বেল্ট রিওয়াইন্ড করিয়ে আমার হ্যান্ডব্যাগ তুলে জিজ্ঞাসা করল আমার ব্যাগ কিনা। আমি বল্লাম হ্যাঁ। অফিসার বল্লেন..." ইউ আর ক্যারিং ওয়েপন"। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। শেষে গ্ৰেপ্তার হতে হবে "টেরোরিস্ট" হিসেবে!! ততক্ষনে এক্সরেতে ব্যাগটি দিয়ে আমাকে বন্ধুকটা দেখাচ্ছে। অবিকল পিস্তল। দেখি আমার পাশে কয়েক জন সিকিউরিটি এসে দাঁড়াল যেন পালাতে না পারি। অফিসার ব্যাগ দেখিয়ে দিয়ে বল্লেন কোথায় রাখা আছে "ওয়েপনটা"। আমি চুড়ান্ত নার্ভাস ফিল করছি। আমার ট্রুপের সবাই হতভম্ভ। অফিসার ব্যাগ দিয়ে বল্লেন খুলে সামনের পকেট থেকে "ওয়েপনটা" বার করতে। হাত ঢুকিয়ে একটা বড় মোমবাতি আর দুই-বাই তিন- বাই হাফ ইঞ্চি থিকনেসের পুরান লক্ বার করলাম যেটা ওই হ্যান্ড ব্যাগেরই। খারাপ হয়ে যাওয়াতে আমেরিকা যাওয়ার আগ রিপ্লেস করে ছিলাম। ব্যাগের ফ্লাপেই থেকে গেছিল ভুলকরে। আর মোমবাতি​ নিয়ে ছিলাম যদি আমেরিকায় লোড়সেড়িং হয়!! তখন কোলকাতায় খুব লোড়সেড়িং হোত। এখন ভেবে খুব হাসি পায়। এই দুটো পাশাপাশি থেকে পিস্তলের চেহারা নিয়েছিল এক্সরে ছবিতে। ওরা নিজেরা সবচেক করে বল্ল মনে হচ্ছে বন্দুক নয়, কিন্তু এগুলো এখানেই ফেলে যেতে হবে। তাই করে "টেরোরিস্ট" হতে হতে বেঁচে গেলাম। তারপর সিঙ্গাপুর হয়ে কোলকাতা ফিরি আমরা নির্বিঘ্নে। আমার আমেরিকা সফর শেষ।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
******************************
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৩৪১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৭/০৯/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • জানবক্স খান ৩০/০৯/২০২১
    আপনার অভিজ্ঞতা জেনে ভালো লাগলো। আর কিছু লিখুন না কেন?
  • ফয়জুল মহী ২৭/০৯/২০২১
    বেশ ভালো লেগেছে।
 
Quantcast