www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

এবার তাজ মহল-এ পৃষ্টা দুই

তাজ মহলের রং সময় সময় বদলায়- সকালে গোলাপী, সন্ধ্যায় দুধ সাদা এবং চাঁদ যখন ওঠে তখন সোনালি। এই তথ্যটা আমার জানা আছে। আমরা তাজ মহলকে ঝলমলে সাদা দেখেছিলাম। তখন শীতের দুপুর। আরেকটা তথ্য আমার জানা আছে- যারা তাজ মহল তৈরির কাজে নিযুক্ত ছিলেন, সম্রাট তাদের আঙুল গুলো কেটে দিয়েছিলেন, যাতে তারা এরকম দ্বিতীয় স্থাপত্য তৈরী করতে না পারে। কি নৃশংস রে বাবা! কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- তাহলে দ্বিতীয় তাজ মহলটা তিঁনি কাদের দিয়ে বানাতেন?

তাজ মহলে ঢোকার মুখে আরো একটা তথ্য জানতে পেরেছিলাম। একটা বিশেষ জায়গা আছে, যেখান থেকে তাজ মহলের আকার নানা দিক থেকে দেখলে বাড়ে কমে। মুঘলদের বিজ্ঞান কত উন্নত ছিল, ভাবা যায়! সেই জায়গাটা পেরিয়ে বিরাট একটা বাগান। বাগানের দু ধরে দেবদারুর মতো দেখতে গাছ, একটা ছোট জলাশয়কে ঘিরে রেখেছে। জলাশয়ে নীল জল টলটল করছিল। জলে তাজ মহলের ছায়া পড়েছিল। বাগান পেরিয়ে আমরা লাইন-এ দাঁড়িয়েছিলাম। উৎসবের দিন বলে বিরাট লাইন। লাইন-এর মাথা আর পা দেখা যাচ্ছিলো না।

বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'গাছ গুলো কি শাহজাহান পুঁতেছিলেন'? বাবা গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন, 'তোর দাদু পুঁতেছিলেন'। গাইড বলেন, 'মার্বেলের দেওয়ালে কোরানের কাব্য কথা খোদাই করা'। অক্ষর গুলো আল্পনার মতো লাগছিলো। একটা অক্ষরও আমি পড়তে পারিনি। অবশেষে তিন ঘন্টা লাইন-এ দাঁড়ানোর পরে আমরা সম্রাটকে পেয়েছিলাম। লাইন-এ দাঁড়াবার কারণ ভিতরে কি আছে তা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। গাইড আমাদের বহুবার বলেছেন, 'ভিতরে শাহজাহান ও মমতাজের দুটো কবর আছে। বড় কবরটা শাহজাহানের আর ছোটটা মমতাজের'।

ভিতরে ঢুকে অত লোকের ভিড়ে দম একেবারে বন্ধ হয়ে গেছিলো। ভিতরে নিরাপত্তারক্ষীরা আমাদের দাঁড়াতে দিচ্ছিলো না। দুটো কবর আমি দেখেছিলাম, একটা বড় ও একটা ছোট, স্পষ্ট মনে আছে। একটা গোপন সুড়ঙ্গ পথ দেখেছিলাম- বোধহয় এই পথ আগ্রা ফোর্ট-এ গিয়ে উঠেছে। আরেকটা রাস্তা নীচে নেমে গেছে সিঁড়ি বেয়ে। সেখানে কি আছে বোঝার আগেই বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। বেরিয়ে এসে আমরা প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম। মা বলেন, 'মমতাজের মতো আমিও পাথরের নীচে চাপা পড়ে গেছিলাম। পরেরবার এলে ভিতরে আর ঢুকবো না। এই নমস্কার করলাম'। কিন্তু মা কাকে নমস্কার করেছিলেন, শাহজাহানকে না মমতাজকে? আমি আজও জিজ্ঞেস করিনি!

তখন সূর্য ডুবু ডুবু। আগ্রার বুকে সন্ধ্যা নেমে আসছিলো। প্রকৃতির আলো ক্ষীণ হয়ে এলে চেনা শহরকেও অচেনা লাগে। এ তো অচেনা জায়গা। কেবল আমরা তিনজন। আমাদের সঙ্গী সাথীদের আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না, গাইডকেও নয়। মা প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন, 'আমি তোকে বলেছিলাম বাবাই, ভিতরে ঢুকে কোনো কাজ নেই। এখন যদি বাস আমাদের না নিয়ে চলে যায়'। 'তোমাকে না নিয়ে বাস যাবেই না, আমাকে না নিয়ে যেতে পারে'। 'মজা করিস না'। বাস স্ট্যান্ড-এ গিয়ে আমরা নিজেদের বাসটাকে চিনতেই পারছিলাম না। কোন কোণে গিয়ে ঢুকেছিল। বাবা গাইডকে ফোন করেন। তিনি বাস থেকে নেমে এসে হাত নাড়েন, এক গাল হেসে বলেন, 'এখনো আধ ঘন্টা বাদে বাস ছাড়বে। বাস মিস হলে পরের বাস আছে'। মায়ের কান্না বন্ধ হল।

এতো জ্যাম যে আগ্রা থেকে মথুরা পৌঁছতে প্রায় দু ঘন্টা লেগে গেছিলো। গাইড বলেন, 'আমরা লেটে চলছি, সময় মতো দিল্লি পৌঁছতে পারবো না, তাই বাস মথুরায় থামবে না, সোজা বৃন্দাবনে যাবে। মথুরাতে বেশি কিছু দেখার নেই, কেবল মন্দির মসজিদ একসাথে একই দেওয়ালের দু দিকে'। টুরিস্ট বাস সব স্পট দেখাতে পারে না, এ কথা সত্য, তাও আবার উৎসবের দিনে। তিনি কৃষ্ণ লীলা সম্পর্কে বলতে শুরু করেছিলেন। আধ ঘন্টায় আমরা পৌঁছে গেছিলাম বৃন্দাবন। তখন রাত সাড়ে সাতটা কি আটটা হবে। নেমেই বুঝেছিলাম যে তুলসীবন দেখার এটা উপযুক্ত সময় নয়। গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন প্রেম মন্দিরে। এখানকার লোক সারাদিন 'রাধে শ্যাম' বলে। গাইড বোঝালেন, 'যদি কেউ আপনাকে সরাসরি ডাকে, তাহলে আপনি সাড়া নাও দিতে পারেন কিন্তু যদি সে আপনার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকে, তাহলে স্ত্রীর আগে আপনি এগিয়ে আসবেন তার সাথে কথা বলতে। এভাবেই এখানকার লোক ঈশ্বরকে ডাকে'।

প্রেম মন্দিরের পুরুত গুলো সাংঘাতিক। 'এতো টাকার পুজো দিলে, এই ফল পাবেন। অত টাকার পুজো দিলে ওই ফল পাবেন'। কেউ পুজো দিতে রাজি হচ্ছিলো না আর তাই পুরুতরা আমাদের মন্দির থেকে বেরোতে দিচ্ছিলো না। বাবা বোঝালেন, 'প্রত্যেক পরিবার যদি একশো এক টাকা করে দক্ষিণা দেয়, তাহলেও তো আপনাদের লাভ'। অগত্যা তারা বাবার কথা মেনে নিলেন। আমরা সকলে মুক্তি পেয়ে গেছিলাম। নারায়ণের দর্শনও পেয়েছিলাম। প্রেম মন্দিরে চমৎকারের গল্প শুনেছিলাম। বট গাছ দিয়ে ভগবান কৃষ্ণের স্টিল-এর হাত বেরিয়েছিল, সেই গাছ ও হাত দেখেওছিলাম, তবে অন্ধকারে সেভাবে পরীক্ষা করতে পারিনি। ওই ঠান্ডায় খালি পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়েছিল। রাস্তার ধারে দোকান গুলোতে নানা রকমের মিষ্টান্ন তৈরী হচ্ছিলো। গাইডের তাড়ায় আমরা আর কিনে খেতে পারিনি। ভারতের সব জায়গায় দেশী পানীয় পাওয়া যায় জানি, তবে ধর্মীয় স্থানে পাওয়া যায় সেটা জানা ছিল না। একজন 'রাধে শ্যাম' বলে আমার ঘাড়ে পড়ার আগেই, আমি পালিয়ে বেঁচেছিলাম।

সমাপ্ত
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৫৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/১২/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast