www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ঋষিকেশ হরিদ্বার ভ্রমণ ২

গাইড বলেন, 'গঙ্গার মূল ঘাটে এখন এক ফোঁটাও জল নেই। দূর্গা পুজোর এই কটাদিন জল শুদ্ধকরণ করা হয়। তাই দর্শনীয় ঘাট এখন স্রোতহীন'।

সত্যি তাই। বাস যখন মূল ঘাটের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল, তথন জানলা দিয়ে দেখেছিলাম শুকনো গঙ্গা। তাতে কেবল নুড়ি পড়ে ছিল, জল এক ফোঁটাও নেই। এদিকে দু চারজনের গঙ্গাস্নান করে জ্বর এসেগেছিলো। তাদের আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না। তাদের গোঙানোর শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। বাবা বলেন, 'পুণ্য করতে গিয়ে একেবারে আনন্দ শূন্য হয়ে গেছে'।

হরিদ্বার ঘিঞ্জি শহর। ঋষিকেশের থেকেও ঘিঞ্জি। শুনেছি সেই কারণেই কোনো সাধু আর এখানে বসবাস করেন না। তাঁরা নিরিবিলি স্থানের খোঁজে কেদার বদ্রীর পথে বহুকাল আগে পাড়ি জমিয়েছেন আর লোকালয়ে ফিরে আসেননি। এত ভিড় যে হরিদ্বার দেখে আমার মনে হচ্ছিলো যে আমি নিউ মার্কেট বা বড় বাজারের কাছাকাছি কোথাও আছি। কিন্তু সবুজে ঢাকা পাহাড় আর মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনি আমাকে পরক্ষণেই মনে করিয়ে দিয়েছিল যে আমি কোনো পুণ্যস্থানেই আছি।

মা বলেন, 'এখানে দাদা বৌদির হোটেল নিরামিষ খাবারের জন্য বিখ্যাত'। হরিদ্বারে আমিষ পাওয়া যায় না। বেড়াতে বেরোলে খাবার চিন্তা সকলেরই থাকে।

গাইড বলেন, 'আমাদের হাতে সময় কম। তাই যে কোনো একটা মন্দির আমরা দেখাতে পারবো, চণ্ডী বা মনসা'। গাইডের সাথে গেলে সব দেখা হয় না, যেটা নিজেরা গাড়ি বুক করে গেলে হয়। আমরা চণ্ডী মায়ের দর্শন করবো ঠিক করেছিলাম। দুই পাহাড়ের মাথায় দুটো মন্দির। রোপওয়ে বা রজ্জুপথে সেখানে যেতে হয়। চণ্ডী পাহাড় মনসা পাহাড়ের থেকে উঁচু, কত ফিট সেটা গাইড জানতেন না। দুটো পাহাড় একে অপরের বিপরীতে। আমরা অটোয় চেপে চণ্ডী পাহাড়ের রোপওয়ে স্ট্যান্ডে পৌঁছেছিলাম। রোপওয়ের ভাড়া নিজেদের দিতে হয়েছিল, টিকিট কেটেছিলেন গাইড, পঞ্চাশ টাকা মাথাপিছু। প্রায় আধ ঘন্টা আমরা লাইন-এ দাঁড়িয়েছিলাম। রোপওয়ে-তে মাত্র পনেরো মিনিট লেগেছিল গন্তব্যে পৌঁছতে। মা পুরো রাস্তা চোখ বন্ধ করে ছিলেন। বাবা জ্ঞানের ডালা খুলে বসেন, 'নীচে দেখ জাল দেওয়া। তার ছিঁড়ে পড়ে গেলেও কোনো ভয় নেই। জালে আটকে যাবে। কোনো প্রাণহানি হবে না। একবার একটা গোটা পরিবার হারিয়ে গেছিলো, তার পর থেকে সরকার এই ব্যবস্থা করেছে'। আমি নীচে তাকিয়ে দেখেছিলাম মোটা লোহার জাল দেওয়া। নীচে তাকালে আমার মাথা ঘোরে। সাথে সাথে ঘাড় তুলে নিয়েছিলাম। বাবা সারা রাস্তা আমাদের সাহস জুগিয়েছিলেন- আমার ভয় কাটলেও মায়ের ভয় কাটেনি।

রোপওয়ে থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠতে হয়েছিল। পথের এক ধারে দোকান- কেউ ডালা সাজিয়ে বসেছিল, কেউ কাঁচের চুড়ি বিক্রি করছিল, কেউ বা বাচ্চাদের খেলনা, আবার কেউ কেউ খাবারের হোটেল খুলে বসেছিল। সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা ওঠার পরে লাইন-এ দাঁড়াতে হয়েছিল। পথে প্রচুর বাঁদর। আমার সামনে যেতেই ভয় লাগছিল। একেকটার যা চেহারা।

মন্দিরের চারদিক রেলিং-এ মোড়া। তার মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে শুরু পথ। মনে হয় ভিড় সামাল দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। অবশেষে আমরা চণ্ডী মায়ের দর্শন পেয়েছিলাম। আমরা গঙ্গাস্নান করিনি বলে পুজো দিই নি। তাছাড়া আমাদের জামাকাপড়ও এক রাতের বাসি ছিল। অনেকে মাথায় গঙ্গা জল ছিটিয়ে পুজো দিয়েছিলেন। আমরা আর পাপের বোঝা বাড়াইনি। চণ্ডী মায়ের মূর্তি লাল কাপড়ে মোড়া, কমলা সিঁদুর মাখানো। হিন্দুস্থানীদের সিঁদুরের রং কমলাই হয়।

মাকে দর্শন করে আমরা নেমে এসে সোজা খাবার হোটেলে ঢুকেছিলাম। কেনাকাটার আমাদের কিছু ছিল না। কোন সকালে জলখাবার খেয়েছি, পেটে বাঁদর মাল্টি জিম করছিল। মা ডাল সবজি দিয়ে ভাত খেলেন, আমি ও বাবা খেয়েছিলাম চোলে ভাটুরে। বেশ তৃপ্তি করেই খেয়েছিলাম। নিরামিষের স্বাদ অপূর্ব। খেয়েদেয়ে রোপওয়ে চেপে ফিরে গেছিলাম। তার পর অটো ধরে বাস স্ট্যান্ডে। সেবার দিল্লিতে ফিরে আসার পালা। গাইড বলেন, 'হাইওয়ে ধরার আগে আমাদের বাস এই শহরটা পুরো ঘোরাবে'।

যাদের পাহাড়ের ওপরে দোকান, তারা রোপওয়ে-তে চেপে আসে না, সিঁড়ি দিয়ে রোজ ওঠা নামা করে। তাদের শুনেছিলাম গ্রামে বাড়ি। কিন্তু শহরের ভিড়ে গ্রামের চিহ্নই খুঁজে পাই নি। চারদিকে সবুজে মোড়া পাহাড়। তার পদতলে গঙ্গা বয়ে চলেছে। গঙ্গার দু ধারে গায়ে গায়ে লাগানো মন্দির, হোটেল, দোকান ও বাড়ি। মানুষের ভিড় কলকাতার বই মেলার মতো।

বাস থেকে শহর দেখতে দেখতে মা বলেন, 'পরের বার এলে দাদা বৌদির হোটেলে খাবো। যা সুন্দর খেয়েছি আজ'। আমি বলেছিলাম, 'মনসা মন্দির দেখে তার পরে খাবো'।

সমাপ্ত
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ২১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/১০/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast