www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সিকিম ভ্রমণ ১

আমার তখন বারো বছর বয়স, ছয় ক্লাস-এ পড়ি, সিকিম বেড়াতে গেছিলাম। মোট সাতজন- আমরা তিনজন, মায়ের বড় ভাই বুড়ো মামা, আরেকটা পরিবার: স্বামী, স্ত্রী ও কন্যা, যথাক্রমে দেবেন, জয়ী ও রিয়া। রিয়া তখন দুই ক্লাস-এ পড়ে, বয়স আট। আমরা শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল-এ উঠেছিলাম। আমার মনে আছে রাতে ট্রেন ছেড়েছিলো আর পরদিন সকাল বেলা আমরা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন-এ পৌঁছেছিলাম। পুজোটা প্রথম বারের জন্য বাইরে কাটানো। তখন আমি ছোট বলে বড়দের সাথে আলোচনা করার অনুমতি ছিল না। বড়দের কথা মেনেই আমাকে চলতে হতো। মনে আছে দেবেন কাকু আমাকে আগে থেকে বলে রেখেছিলেন, 'ছোট বুড়ো, রাতে ঘুমোলে চলবে না, ফারাক্কা ব্যারেজ দেখতে হবে। পৃথিবীর সব থেকে লম্বা ব্যারেজ, একশো বারোটা লক গেট আছে'। ঘুম চোখে আমি লক গেটের সংখ্যা গুণেছিলাম- লক গেট গুলোর ওপর দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় দারুণ আওয়াজ হচ্ছিলো। আমরা সবাই দেখেছি লক গেট টর্চ জ্বেলে, তবে অস্পষ্ট। তখন রাত কটা জানি না। লক গেট দেখতে গিয়ে সময় কেউ দেখেনি। দেবেন কাকু জানতে চান, 'কটা গুনলি'? 'একশো বারো'।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আমরা অটোয় চেপে শিলিগুড়িতে গেছিলাম, যেখান থেকে গ্যাংটক যাওয়ার বাস ছাড়ে, সেখানে। ওই বাস স্টপ-এই একটা ক্যানটিন-এ জলখাবার খেয়েছিলাম- টোস্ট, ওমলেট আর কফি।

বাস ছুটেছিল পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। এক দিকে পাহাড় আর আরেক দিকে খাদ বেয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। বাস-টা ঘুরে ঘুরে ক্রমশ ওপরে উঠতে লাগলো, এই বুঝি মেঘ ছুঁয়ে ফেলবে। কিন্তু যত ওপরে উঠতে লাগলো, মেঘও দূরে সরে যাচ্ছিলো আর খাদ ক্রমশ নামছিলো নীচে, এত নীচে যে তাকালেই মাথা ঘুরছিলো। দেখতে দেখতে চার ঘন্টায় পৌঁছেছিলাম গ্যাংটক। ধস নামার ভয় ছিল কিন্তু ধস নামেনি। আমি প্রকৃতি প্রেমে এতই মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম যে কারো কোনো কথাই কানে যায়নি। মাঝ পথে বাবা আমাকে বিস্কুট আর কলা খেতে দিয়েছিলেন।

গ্যাংটকে বেশ ঠাণ্ডা। জ্যাকেট পরে নিয়েছিলাম, মাথায় হনুমান টুপি। চড়াই উৎরাই রাস্তা। রাস্তার দু পাশে বড় বড় দোকান ও হোটেল। বাস স্টপ পাহাড়ের ওপরে। বাবা ও দেবেন কাকু হোটেল খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। আগে থেকে কোনো হোটেল বুক করা ছিল না। বুড়ো মামা আমাদের সাথে ছিলেন- একটা ছেলে সাথে থাকা দরকার।
ওনাদের দেখেছিলাম রাস্তা দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছিলেন। পাহাড়ের ওপর শহর। মনে হয় পাহাড় কেটেই বানানো। ভেবেছিলাম বরফ পাবো, কিন্তু পুজোর সময় বরফ পড়ে না। পাহাড়ের বুকে ঘন বসতি সবুজে মোড়া। সেদিন মহাষষ্ঠী- মনেই হচ্ছিলো না যে পুজো।

হোটেল সহজেই পেয়ে গেছিলাম। হোটেলের নাম মাউন্ট ভিউ। দুটো ঘর বুক করা হয়েছিল- একটা ঘরে আমরা চারজন আর আরেকটা ঘরে ওনারা তিনজন। ঘরে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে সোজা ডাইনিং হল-এ চলে গেছিলাম। সকলের দারুণ খিদে পেয়েছিল। মেনুতে ভাত, ডাল, সবজি ও মাছ। দাম বেশ ভালোই। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম- দেবেন কাকু ও জয়ী কাকিমা দু জনের জন্য দু প্লেট খাবার নিয়েছিলেন কিন্তু রিয়ার জন্য কোনো প্লেট নেন নি। জয়ী কাকিমা বলেন, 'ছোট বুড়োর সাথে এক সাথে খা'। আমি না বলতে পারলাম না। বড়দের মুখের ওপর কথা বলা যায় না। খাওয়া শেষ হলে মা আলাদা করে আমাকে ডেকে বলেছিলেন, 'এবার রিয়া তোর পাতে খেতে এলে কনুই দিয়ে এক গুঁতো দিবি'।

খেয়েদেয়ে দে ঘুম। যখন ঘুম থেকে উঠেছিলাম, তখন সন্ধ্যে নেমে গেছিলো। বাবা আর দেবেন কাকু ফ্লাস্ক-এ করে চা আনেন। বিসকুট আর চানাচুর আমাদের সাথেই ছিল। ঘরোয়া আড্ডায় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছিল। রাতের মেনুতে পরোটা আর আলুর দম।

সপ্তমী হোটেলে বসেই কেটে গেছিলো। বিকেলের দিকে আমরা পায়ে হেঁটে গ্যাংটক শহরটা বেশ অনেকটাই ঘুরেছিলাম। পাহাড়ের মতো পাহাড় দেখা, উঁচু ঢিপি নয়। যখন সন্ধ্যা নেমেছিল, ইলেক্ট্রিকের আলো পাহাড়ের কোলের শহরটাকে একটা মায়াবী রূপ দিয়েছিলো। দেখে মন প্রাণ অশান্ত জীবনকে হার মানিয়ে, শান্তির পথ খুঁজেছিলো।

দেবেন কাকুর মদ খাওয়া স্বভাব আর বুড়ো মামা পালে পড়ে মদ খান। বাবা মদ খাওয়াকে ঘৃণা করেন। দেবেন কাকু পরপর দু দিন দুটো বোতল কিনেছিলেন। মা বলেই দিলেন, 'রোজ রোজ মদ না গিলে মেয়ের জন্য এক্সট্রা একটা প্লেট নিন'। কথাটা জয়ী কাকিমার গায়ে লেগেছিলো- তিনি মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন।

অষ্টমী ও নবমী একই দিনে পড়েছিল। সেদিন সকালে আমরা রুমঠেক মঠ দেখতে গেছিলাম- বৌদ্ধ মন্দিরকে মনাস্ট্রি বলে। এটি ৪৯০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। বৌদ্ধদের মন্দির আমার প্রথম দেখা। গৌতম বুদ্ধের কত রকম রূপ, কত মূর্তি। কোনো পুজো আমরা দিই নি, কেবল ঘুরে দেখে ছিলাম স্থাপত্য। দেওয়ালে কত কি আঁকা, মানে বোঝা দায়। দেখেছিলাম উপাসনা গৃহ- পুরো ফাঁকা ঘরে কেবল একটা বিশাল বুদ্ধ মূর্তি ও তার পাশে প্রচুর ছোট ছোট মূর্তি ধাপে ধাপে রাখা। কথা বলা নিষেধ, তাই কোনো প্রশ্ন করতে পারিনি। আরো একটা মঠ দেখেছিলাম, নাম মনে নেই। সেখানে উপাসনা গৃহে প্রচুর মোমবাতি জ্বলছিল। সেই একেকটা মোমবাতি একেক জনের মনের আশার প্রতীক। বৌদ্ধ সাধুরা লাল কাপড় পরেন, পরার ধরণও আলাদা।

ট্রেকারে উঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'বুদ্ধ মূর্তির পাশে অত পুতুল ধাপে ধাপে রাখা কেন'? 'মানুষের কর্মফল- পাপ করলে নরকে যাবে আর পুণ্য করলে স্বর্গে যাবে'।

দেখেছিলাম গ্যাংটকের হস্তশিল্প কিন্তু যা দাম কোনো কিছু কিনি নি।

একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না- ট্রেকারে মাথাপিছু ভাড়া নেয়, রিয়াকে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো কিন্তু ওর ভাড়া দেওয়া হচ্ছিলো না। সেবারের জন্য বুড়ো মামা ভাড়া দিলেন। মা বলেছিলেন, 'বুড়োর তো ভাড়া দেওয়ার কথা নয়'। জয়ী কাকিমা বলেন, 'ও বাচ্চা মেয়ে, এবার থেকে বড় বুড়োর কোলে বসে যাবে'। 'তা কেন হবে দেবেন দা'! দেবেন কাকু চুপ, কোনো উত্তরই দেন নি। এর মানে তিনি তার স্ত্রীর দলে। বুড়ো মামা রিয়াকে খুব স্নেহ করতেন। মা বুড়ো মামাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'বুড়ো, তুই রিয়াকে কোলে বসালে, আমাদের ঘরে শুবি না'।

বিকেলে মা বাবার মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। মা সোর্ড মানে তলোয়ার কিনে বাড়িতে সাজিয়ে রাখতে চান। দেবেন কাকুরা কিনেছিলেন, সাথে বুড়ো মামাও। বাবা বেঁকে বসেন। 'এই তোমার রুচি'! 'তুমি কোনো দিনও আমাকে স্বাধীনতা দাও নি'। সোর্ড কি বলি। তলোয়ারের মতো দেখতে মদের বোতল! লোকে ঘরে সাজিয়েই রাখে। বাবা অন্য কিছু কিনে দিতে রাজি ছিলেন। মা নাছোড়বান্দা কেবল সোর্ডই কিনবেন।

দশমীতে আমরা জলখাবার খেয়ে ছাঙ্গু হ্রদ দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম।

(চলবে)
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ১৮৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৩/০৮/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast