শিমুলতলা ভ্রমণ ৪
পিয়ারার সাথে আলাপ হয়েছিল। সে সুদর্শনের মামার বাড়ির রক্ষক। কত পর্যটক সেখানে আসতো। তাদের কাছে টাকা পয়সা থাকতো। সেখানে প্রত্যেক ঘরে আসবাবপত্র। মালিকের কাছেও টাকা পয়সা ভালোই থাকতো। সংক্ষেত্রে ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা জমা করে আসা যত না। মালিক ছিলেন সুদর্শনের বড় মামা, কৃষ্ণা। মাসে দু বার সুদর্শন ব্যাঙ্কে যেত, একবার টাকা জমা করতে, একবার টাকা তুলতে, সাথে থাকতো পিয়ারা। এই শুন্শান্ জায়গায় চুরি ডাকাতি লেগেই থাকতো। পিয়ারার আরো দু জন শাগরেদ ছিল, যারা এক সাথে রক্ষকের কাজ করতো। তাদের সাথে আলাপ হয়নি। এখানে প্রচুর বাঙালি এসে থাকতো, তার ওপর সুদর্শনরাও বাঙালি, তাই পিয়ারা বেশ ভালোই বাংলা বুঝতো, বলতো ভাঙা ভাঙা। ও পাকা তীরন্দাজ, সাথে খুব ভালো বল্লম চালাতে পারতো। ও শুয়োরের মাংস খেত, তাই গায়ে ভীষণ শক্তি।
পিয়ারা ওর অস্ত্র আমাকে দেখিয়ে বলেছিলো, 'তীরের মাথায়, বল্লমের মাথায় বিষ আছে বাবু। কারো রক্তে মিশলেই, সে মরবে'। 'বিষ কোথা থেকে পাও'? 'গাছের পাতা, বনে পাওয়া যায়'। 'তিনজন মিলে ডাকাত দলকে ধরবে কি করে'? 'আমি এক মিনিটে চারটে তীর চালাতে পারি। পাঁচ মিনিটে কুড়ি জনকে শেষ করে দেবো। আমরা যুদ্ধ করি আড়াল থেকে, কৌশলে'। 'বুঝলাম'।
দু দিন আমি পিয়ারার সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। ও আমার বেশ ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিল। ও দিনে ঘুমাতো, রাতে জাগতো।
ফিরে আসার তিন দিন আগে ঠিক হয়েছিল যে দেওঘর ঘোরা হবে। বেণু দাদু বলেন, 'এখন থেকে লোকাল ট্রেন ছাড়ে। পাক্কা দেড় ঘন্টা লাগে ট্রেনে। ট্রেন ছাড়ে সকাল সাড়ে সাতটায়'। ছানু দাদু বলেন, 'এতো দূর যখন এসেছি দেওঘরটা দেখে গেলেই ভাল হয়'। আমি ছোট হয়েও মুখ খুলেছিলাম, 'ছানু দাদু, জানোতো এখানে একজন শিল্পী এসে উঠেছেন। তিনি দেওঘর ঘুরে এসেছেন। ত্রিকূট পাহাড়ের ছবি তিনি এঁকেছেন। আমাকে দেখিয়েছেন। আমি ত্রিকূট পাহাড় দেখতে চাই'। 'আমি তোমাকে দেখাবো। এই কথা দিলাম'। বলেই, ছানু দাদু আমার হাতে হাত রাখেন। পরম স্নেহের স্পর্শ।
ঠিক সকাল নয়টায় দেওঘরের ধামে আমরা পা রেখেছিলাম। কিছু খেয়ে যাইনি, চা বিস্কুটও নয়, পুজো দিয়ে তারপরে খাবো। বেণু দাদু স্টেশনে নেমেই বলেছিলেন, 'আমার চেনাজানা পাণ্ডা আছে এখানে। রিক্সা করে তার বাড়ি চলো সকলে'। তার কথা মতো কাজ হয়েছিল। সেই পাণ্ডাই আমাদের নিয়ে গেলেন মন্দিরে। আমাদের ব্যাগ আর জুতো গুলো তার বাড়িতেই রেখেছিলাম। ওই ব্যাগ গুলোর মধ্যে বেণু দাদুর ক্যামেরার ব্যাগও ছিল। পাণ্ডার বাড়ি থেকে মন্দির হাঁটা পথে মাত্র পাঁচ মিনিট। আমরা নির্বিঘ্নে পুজো দিয়েছিলাম। প্রসাদও পেয়ে গেছিলাম সাথে সাথে। প্রসাদ খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেছিলাম। ওখানে কচুরির দোকান প্রচুর। জলখাবার খাওয়ার ভালোই ব্যবস্থা। জলখাবার খেয়ে আমরা পাণ্ডা মহাশয়ের বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম।
সেখানে পৌঁছে বেণু দাদু বলেছিলেন, 'তুলি ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ঘুরতে চায়। আমাদের দুটো ঘোড়ার গাড়ি হলেই হয়ে যাবে'। তার কথা মতোই কাজ হয়েছিল। পাণ্ডা মহাশয়ের বাড়ির সামনেই স্ট্যান্ড। বেণু দাদু আগে এগিয়ে গেছিলেন, তিনি দুটো গাড়ি ঠিক করেও ফেলেন। যেমন দুটো আলাদা ঘরে থাকতাম, তেমন দুটো আলাদা গাড়ি। প্রথম গাড়িতে আমরা উঠে পড়েছিলাম। দ্বিতীয় গাড়িতে দিদু, বেবি দিদা ও তুলি মাসি উঠে বসেছিলেন, বেণু দাদু উঠে বসতেই ঘোড়া দু পায়ে দাঁড়িয়ে গেছিলো। ঘোড়াটা বাচ্চা ঘোড়া, তাই মনে হয় অত ওজনের লোক তুলতে কষ্ট হয়েছিল, তাই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বেণু দাদু ও বেবি দিদা নেমে গেলেন সহজেই, তুলি মাসি গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন আর দিদু গাড়ির নীচে পড়ে গেছিলেন। তার হাতে, পায়ে ও কোমরে এমন লেগেছিলো যে তিনি উঠে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। আমরা গাড়ি থামিয়ে ছুটে এসেছিলাম। ভাগ্যিস গাড়ি বেশি দূর যাইনি। বেণু দাদু, বেবি দিদা ও তুলি মাসি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। আমরা এসে দিদুকে তুলেছিলাম। ছানু দাদু বলেছিলেন, 'আমরা অটোতে যাবো, ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে কোনো কাজ নেই'। বেণু দাদু বলেন, 'আমি আপনাদের নিয়ে এসেছি, অতএব আপনারা আমার কথা শুনতে বাধ্য'। বাবা চিৎকার করে ওঠেন, 'আমরা কি আপনার পয়সায় ঘুরতে এসেছি। আপনি নিয়ে এসেছেন মানে'? 'তুমি আমার সাথে বেটিং করছো'। 'আপনি থামুন'। তখনই আমরা রিক্সা নিয়ে স্টেশনে চলে এসেছিলাম। দিদুকে কোনো মতে রিক্সায় তোলা হয়েছিল। স্টেশনে এসেই ছানু দাদু টিকিট কেটে ফেলেন আমাদের পাঁচজনের। আধ ঘন্টা বাদে ট্রেন। ঠিক পনেরো মিনিট বাদে ওনারা তিনজন স্টেশনে এসে ওই একই ট্রেন-এর টিকিট কাটেন। মনে আছে, ছানু দাদু বেণু দাদুকে স্টেশনে সকলের সামনে বলেছিলেন, 'বেণু, তুমি নিজেকে বেশি পণ্ডিত মনে করো না'। ওদিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। সারা রাস্তা সকলেই চুপ ছিলেন। শিমুলতলায় নেমে আমরা লাইনের ওপারে একটা হোটেল থেকে ডিম ভাত খেয়েছিলাম। সেদিন রাতে ছানু দাদু আর বাবা স্টেশন থেকে রুটি তরকারি কিনে নিয়ে এসেছিলেন। ত্রিকূট পাহাড় দেখা আর আমার হলো না। আজও আমি ত্রিকূট পাহাড় দেখিনি, আশা অপূর্ণই থেকে গেছে। সুদর্শন আর্নিকার একটা শিশি দিয়ে গেছিলো ছানু দাদুকে, কোনো দাম নেয় নি।
বেণু দাদু বলেছিলেন, 'ছানু দা, আপনার স্ত্রীকে আপনার ঘরে রাখুন'। 'তাহলে আমি ওই ঘরের পুরো দাম দেবো না'। বাংলার মাস্টার বাংলা ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
চলে আসার আগের দিন ঘটেছিলো একটা বিশ্রী কাণ্ড। সুদর্শন সকালে যে টর্চ ব্যবহার করতো, বেণু দাদু সেই একই কোম্পানির একই রকম দেখতে একটা টর্চ নিয়ে গেছিলেন। সেই টর্চটা তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি চিৎকার করতে লাগলেন, 'আমি সুদর্শনের হাতে আমার টর্চ দেখেছি। ও আমার টর্চ চুরি করেছে'। সুদর্শনকে ডাকা হয়েছিল, সে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছিলো, 'মাস্টার মশাই আপনি জেনেশুনে বলছেনতো, দেখুন একটা চিহ্ন আছে'। 'সেটা তুমি বানিয়ে নিয়েছো'। এই নিয়ে প্রায় দশ মিনিট ঝগড়া চলেছিল। বেণু দাদুই বেশি অসভ্যতা করেছিলেন। সুদর্শন ভদ্রলোক। বেবি দিদা ওনার টর্চটা বেডিং থেকে আবিষ্কার করেন, কোনো ভাবে সেটা বেডিং-এর মধ্যে ঢুকে গেছিলো। সুদর্শন বলেছিলো, 'মাস্টার যদি এমন হয়, তাহলে ছাত্ররা কি শিখবে'? ছানু দাদু সুদর্শনের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। 'আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, দোষ তো করেছেন উনি। ক্ষমা তো ওনার চাওয়া উচিত'। বেণু দাদু কোনো ক্ষমা চাননি। একেবারে বেহায়া মানুষ।
চলে আসার দিন বেণু দাদু সকালে বলেন, 'বেনিয়া আমাদের সব মালপত্র ট্রেন-এ তুলে দেবে'। আমাদের বিকেল চারটেতে ট্রেন ছিল। শেষ দু দিন আমরা হোটেলেই খেয়েছিলাম। সুদৰ্শনরা কেবল নিজেদের জন্য রান্না করতো, তাই ওদের বারবার বলতে খারাপ লাগতো। ওখানে কোনো খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না, কেবল থাকার ব্যবস্থা। ছানু দাদু আগের থেকেই সুদর্শনকে সব বলে রেখেছিলেন। পূর্বা এক্সপ্রেস মাত্র দু মিনিট থামতো শিমুলতলা স্টেশনে। হাওড়া থেকে ওঠা এক আর শিমুলতলা থেকে ওঠা আরেক- আগের দিন টেনশনে মায়ের সারা রাত ঘুম হয় নি। ট্রেন যথা সময়ে স্টেশনে এসেছিলো। বেনিয়া কেবল বেণু দাদুদের বেডিংটা মাথায় নিয়েছিল আর হাতে একটা বালতি। সুদর্শন সব মিলিয়ে চোদ্দটা মালপত্র ট্রেন-এ তুলেছিল, বাকি গুলো আমরা। সুদর্শনকে ছানু দাদু বকশিস দিতে চেয়েছিলেন। 'আপনার সাথে আমার টাকার সম্পর্ক'। বেনিয়া বেশ মোটা টাকা বকশিস নিয়েছিল। মা ট্রেন-এ উঠে কেঁদেই ফেলেন, 'আমাদের সব জিনিস তোলা হয়েছে তো'? আমি, বাবা ও ছানু দাদু মেট্রোজিল খেয়ে ট্রেন-এ উঠেছিলাম।
স্মৃতি হিসাবে আমি একটা বেতের লাঠি নিয়ে এসেছিলাম শিমুলতলা থেকে।
ফিরে আসার এক সপ্তাহ পর থেকে বেণু দাদু বলে বেড়াতে লাগলেন, 'সুদর্শন দিনে দুপুরে ডাকাতি করে। ট্রাক-এ আসবাবপত্র চুরি করে আনে কলা পাতায় ঢেকে। ছানু দা আমাদের ডাকাতের বাড়িতে রেখেছিলেন'।
পিয়ারা ওর অস্ত্র আমাকে দেখিয়ে বলেছিলো, 'তীরের মাথায়, বল্লমের মাথায় বিষ আছে বাবু। কারো রক্তে মিশলেই, সে মরবে'। 'বিষ কোথা থেকে পাও'? 'গাছের পাতা, বনে পাওয়া যায়'। 'তিনজন মিলে ডাকাত দলকে ধরবে কি করে'? 'আমি এক মিনিটে চারটে তীর চালাতে পারি। পাঁচ মিনিটে কুড়ি জনকে শেষ করে দেবো। আমরা যুদ্ধ করি আড়াল থেকে, কৌশলে'। 'বুঝলাম'।
দু দিন আমি পিয়ারার সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। ও আমার বেশ ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিল। ও দিনে ঘুমাতো, রাতে জাগতো।
ফিরে আসার তিন দিন আগে ঠিক হয়েছিল যে দেওঘর ঘোরা হবে। বেণু দাদু বলেন, 'এখন থেকে লোকাল ট্রেন ছাড়ে। পাক্কা দেড় ঘন্টা লাগে ট্রেনে। ট্রেন ছাড়ে সকাল সাড়ে সাতটায়'। ছানু দাদু বলেন, 'এতো দূর যখন এসেছি দেওঘরটা দেখে গেলেই ভাল হয়'। আমি ছোট হয়েও মুখ খুলেছিলাম, 'ছানু দাদু, জানোতো এখানে একজন শিল্পী এসে উঠেছেন। তিনি দেওঘর ঘুরে এসেছেন। ত্রিকূট পাহাড়ের ছবি তিনি এঁকেছেন। আমাকে দেখিয়েছেন। আমি ত্রিকূট পাহাড় দেখতে চাই'। 'আমি তোমাকে দেখাবো। এই কথা দিলাম'। বলেই, ছানু দাদু আমার হাতে হাত রাখেন। পরম স্নেহের স্পর্শ।
ঠিক সকাল নয়টায় দেওঘরের ধামে আমরা পা রেখেছিলাম। কিছু খেয়ে যাইনি, চা বিস্কুটও নয়, পুজো দিয়ে তারপরে খাবো। বেণু দাদু স্টেশনে নেমেই বলেছিলেন, 'আমার চেনাজানা পাণ্ডা আছে এখানে। রিক্সা করে তার বাড়ি চলো সকলে'। তার কথা মতো কাজ হয়েছিল। সেই পাণ্ডাই আমাদের নিয়ে গেলেন মন্দিরে। আমাদের ব্যাগ আর জুতো গুলো তার বাড়িতেই রেখেছিলাম। ওই ব্যাগ গুলোর মধ্যে বেণু দাদুর ক্যামেরার ব্যাগও ছিল। পাণ্ডার বাড়ি থেকে মন্দির হাঁটা পথে মাত্র পাঁচ মিনিট। আমরা নির্বিঘ্নে পুজো দিয়েছিলাম। প্রসাদও পেয়ে গেছিলাম সাথে সাথে। প্রসাদ খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেছিলাম। ওখানে কচুরির দোকান প্রচুর। জলখাবার খাওয়ার ভালোই ব্যবস্থা। জলখাবার খেয়ে আমরা পাণ্ডা মহাশয়ের বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম।
সেখানে পৌঁছে বেণু দাদু বলেছিলেন, 'তুলি ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ঘুরতে চায়। আমাদের দুটো ঘোড়ার গাড়ি হলেই হয়ে যাবে'। তার কথা মতোই কাজ হয়েছিল। পাণ্ডা মহাশয়ের বাড়ির সামনেই স্ট্যান্ড। বেণু দাদু আগে এগিয়ে গেছিলেন, তিনি দুটো গাড়ি ঠিক করেও ফেলেন। যেমন দুটো আলাদা ঘরে থাকতাম, তেমন দুটো আলাদা গাড়ি। প্রথম গাড়িতে আমরা উঠে পড়েছিলাম। দ্বিতীয় গাড়িতে দিদু, বেবি দিদা ও তুলি মাসি উঠে বসেছিলেন, বেণু দাদু উঠে বসতেই ঘোড়া দু পায়ে দাঁড়িয়ে গেছিলো। ঘোড়াটা বাচ্চা ঘোড়া, তাই মনে হয় অত ওজনের লোক তুলতে কষ্ট হয়েছিল, তাই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বেণু দাদু ও বেবি দিদা নেমে গেলেন সহজেই, তুলি মাসি গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন আর দিদু গাড়ির নীচে পড়ে গেছিলেন। তার হাতে, পায়ে ও কোমরে এমন লেগেছিলো যে তিনি উঠে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। আমরা গাড়ি থামিয়ে ছুটে এসেছিলাম। ভাগ্যিস গাড়ি বেশি দূর যাইনি। বেণু দাদু, বেবি দিদা ও তুলি মাসি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। আমরা এসে দিদুকে তুলেছিলাম। ছানু দাদু বলেছিলেন, 'আমরা অটোতে যাবো, ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে কোনো কাজ নেই'। বেণু দাদু বলেন, 'আমি আপনাদের নিয়ে এসেছি, অতএব আপনারা আমার কথা শুনতে বাধ্য'। বাবা চিৎকার করে ওঠেন, 'আমরা কি আপনার পয়সায় ঘুরতে এসেছি। আপনি নিয়ে এসেছেন মানে'? 'তুমি আমার সাথে বেটিং করছো'। 'আপনি থামুন'। তখনই আমরা রিক্সা নিয়ে স্টেশনে চলে এসেছিলাম। দিদুকে কোনো মতে রিক্সায় তোলা হয়েছিল। স্টেশনে এসেই ছানু দাদু টিকিট কেটে ফেলেন আমাদের পাঁচজনের। আধ ঘন্টা বাদে ট্রেন। ঠিক পনেরো মিনিট বাদে ওনারা তিনজন স্টেশনে এসে ওই একই ট্রেন-এর টিকিট কাটেন। মনে আছে, ছানু দাদু বেণু দাদুকে স্টেশনে সকলের সামনে বলেছিলেন, 'বেণু, তুমি নিজেকে বেশি পণ্ডিত মনে করো না'। ওদিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। সারা রাস্তা সকলেই চুপ ছিলেন। শিমুলতলায় নেমে আমরা লাইনের ওপারে একটা হোটেল থেকে ডিম ভাত খেয়েছিলাম। সেদিন রাতে ছানু দাদু আর বাবা স্টেশন থেকে রুটি তরকারি কিনে নিয়ে এসেছিলেন। ত্রিকূট পাহাড় দেখা আর আমার হলো না। আজও আমি ত্রিকূট পাহাড় দেখিনি, আশা অপূর্ণই থেকে গেছে। সুদর্শন আর্নিকার একটা শিশি দিয়ে গেছিলো ছানু দাদুকে, কোনো দাম নেয় নি।
বেণু দাদু বলেছিলেন, 'ছানু দা, আপনার স্ত্রীকে আপনার ঘরে রাখুন'। 'তাহলে আমি ওই ঘরের পুরো দাম দেবো না'। বাংলার মাস্টার বাংলা ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
চলে আসার আগের দিন ঘটেছিলো একটা বিশ্রী কাণ্ড। সুদর্শন সকালে যে টর্চ ব্যবহার করতো, বেণু দাদু সেই একই কোম্পানির একই রকম দেখতে একটা টর্চ নিয়ে গেছিলেন। সেই টর্চটা তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি চিৎকার করতে লাগলেন, 'আমি সুদর্শনের হাতে আমার টর্চ দেখেছি। ও আমার টর্চ চুরি করেছে'। সুদর্শনকে ডাকা হয়েছিল, সে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছিলো, 'মাস্টার মশাই আপনি জেনেশুনে বলছেনতো, দেখুন একটা চিহ্ন আছে'। 'সেটা তুমি বানিয়ে নিয়েছো'। এই নিয়ে প্রায় দশ মিনিট ঝগড়া চলেছিল। বেণু দাদুই বেশি অসভ্যতা করেছিলেন। সুদর্শন ভদ্রলোক। বেবি দিদা ওনার টর্চটা বেডিং থেকে আবিষ্কার করেন, কোনো ভাবে সেটা বেডিং-এর মধ্যে ঢুকে গেছিলো। সুদর্শন বলেছিলো, 'মাস্টার যদি এমন হয়, তাহলে ছাত্ররা কি শিখবে'? ছানু দাদু সুদর্শনের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। 'আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, দোষ তো করেছেন উনি। ক্ষমা তো ওনার চাওয়া উচিত'। বেণু দাদু কোনো ক্ষমা চাননি। একেবারে বেহায়া মানুষ।
চলে আসার দিন বেণু দাদু সকালে বলেন, 'বেনিয়া আমাদের সব মালপত্র ট্রেন-এ তুলে দেবে'। আমাদের বিকেল চারটেতে ট্রেন ছিল। শেষ দু দিন আমরা হোটেলেই খেয়েছিলাম। সুদৰ্শনরা কেবল নিজেদের জন্য রান্না করতো, তাই ওদের বারবার বলতে খারাপ লাগতো। ওখানে কোনো খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না, কেবল থাকার ব্যবস্থা। ছানু দাদু আগের থেকেই সুদর্শনকে সব বলে রেখেছিলেন। পূর্বা এক্সপ্রেস মাত্র দু মিনিট থামতো শিমুলতলা স্টেশনে। হাওড়া থেকে ওঠা এক আর শিমুলতলা থেকে ওঠা আরেক- আগের দিন টেনশনে মায়ের সারা রাত ঘুম হয় নি। ট্রেন যথা সময়ে স্টেশনে এসেছিলো। বেনিয়া কেবল বেণু দাদুদের বেডিংটা মাথায় নিয়েছিল আর হাতে একটা বালতি। সুদর্শন সব মিলিয়ে চোদ্দটা মালপত্র ট্রেন-এ তুলেছিল, বাকি গুলো আমরা। সুদর্শনকে ছানু দাদু বকশিস দিতে চেয়েছিলেন। 'আপনার সাথে আমার টাকার সম্পর্ক'। বেনিয়া বেশ মোটা টাকা বকশিস নিয়েছিল। মা ট্রেন-এ উঠে কেঁদেই ফেলেন, 'আমাদের সব জিনিস তোলা হয়েছে তো'? আমি, বাবা ও ছানু দাদু মেট্রোজিল খেয়ে ট্রেন-এ উঠেছিলাম।
স্মৃতি হিসাবে আমি একটা বেতের লাঠি নিয়ে এসেছিলাম শিমুলতলা থেকে।
ফিরে আসার এক সপ্তাহ পর থেকে বেণু দাদু বলে বেড়াতে লাগলেন, 'সুদর্শন দিনে দুপুরে ডাকাতি করে। ট্রাক-এ আসবাবপত্র চুরি করে আনে কলা পাতায় ঢেকে। ছানু দা আমাদের ডাকাতের বাড়িতে রেখেছিলেন'।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।