www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শিমুলতলা ভ্রমণ ৩

লাট্টু পাহাড় লাইন-এর ওপারে। স্টেশন থেকে মাত্র পনেরো মিনিট হাঁটা। চতুর্থ দিনে স্টেশনের কাছে সেই দোকান থেকে সকালের জলখাবার খেয়ে, আমি, বাবা ও ছানু দাদু বেরিয়েছিলাম লাট্টু পাহাড়ের সন্ধানে। মা ও দিদু বেবি দিদাকে রান্নায় সাহায্য করবেন বলে আমাদের সাথে যান নি। তুলি মাসিকে আমরা নিয়েই যেতে চাই নি। সে হয়তো আমাদের মুখ দেখেই বুঝে গেছিলো। বেণু দাদু বলেন, 'লাট্টু পাহাড় এখান থেকে অনেক দূর, পায়ে হেঁটে যেতে পারবে না'। আমরা বাজে কথার কোনো জবাব দিই নি। ঠিক পনেরো মিনিট লেগেছিলো লাট্টু পাহাড়ের সামনে পৌঁছতে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে মাত্র দশ মিনিট লেগেছিলো। চূড়ায় কোনো মন্দির নেই। কেবল একটা বেদী। পাশে লাল পতাকা হাওয়ায় উড়ছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, 'এখানে কোথায় মন্দির'? বাবা বলেছিলেন, 'বাজে কথায় কান দিস কেন'? ছানু দাদুর হার্টের সমস্যা, তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক জায়গায়। পাহাড়ের মাথা থেকে দেখেছিলাম অর্ধেক শহর ও অর্ধেক গ্রাম। তেমন কিছুই মনে নেই। ফিরে এসে মায়ের সাথে বাবার তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। কারণটা আমার মনে নেই। ছানু দাদু ও দিদু দু জন মিলে সামাল দিয়েছিলেন। বেবি দিদা আমাকে বলেন, 'ঝগড়া মন্দিরে পয়সা দিসনি বলেই তোর মা বাবার মধ্যে ঝগড়া হল'। 'মন্দির থাকলে তো পয়সা দেবো। কেবল বেদী ছিল, পাশে পতাকা'। 'ওটাই মন্দির'। 'ওখানে কেউ পয়সা দিচ্ছিলো না'।

পরের দিন আবহাওয়া উত্তপ্ত ছিল। তার পরের দিন, মানে ষষ্ঠ দিনে বেশ রোদ উঠেছিল। আমরা সকাল নয়টার মধ্যে জলখাবার খেয়ে ধারারা ঝর্ণা দেখতে গেছিলাম ট্রেকারে চেপে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। গ্রামের রাস্তা দিয়ে গেছিলো ট্রেকার। আসা যাওয়ার পথে গ্রামের বাচ্চারা আমাদের হাত নেড়েছিলো। তাদের সারা গায়ে ধুলো মাখা, অযত্নে মানুষ, দেখলেই বোঝা যাচ্ছিলো। শিমুলতলায় বহু বড়লোকের বাগান বাড়ি, এই দিকটায় কেউ বাগান বাড়ি বানাতো না। সুন্দর ঝর্ণা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো। দেখে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেছিলো। বহু লোক জলে নেমে পা ভেজাচ্ছিলেন, হাঁটু জল, আমার মোজা জুতো ভিজে যাবে বলে জলে নামিনি। বাবা আমাকে বলেন, 'এই জল মুখে দিবি না একদম'। আমি ক্যামেরাতে ছবি তুলেছিলাম প্রচুর। বেণু দাদুর একটা ছবি তুলতে এক ঘন্টা লাগতো। ওনার ক্যামেরার সামনে আমি কখনো স্থির হয়ে বসে থাকতে পারিনি, তাই তিনি বহুবার আমাকে তিরস্কার করেছেন ধৈর্য কম বলে। ফেরার পথে পাঁঠার মাংসের জায়গায় পাঁঠি দিয়ে দিয়েছিলো, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। সেদিন খেতে খেতে বেজেছিল বিকেল পাঁচটা। মাংস সবাই ছিবড়ে করে ফেলে দিয়েছিলাম। ছানু দাদু বেণু দাদুকে বলেন, 'বেণু, তুমি পুরো ঠকে গেছো'। সেদিন সন্ধ্যে সাতটায় আমরা বিকেলের জলখাবার খেতে বেরিয়েছিলাম। বেণু দাদুর পেটে মনে হয় পাঁঠি দুবার ডেকেছিল, 'আমি বাংলা শিখবো'।

নবম দিনে আমরা সিকটিয়া বেড়াতে গেছিলাম। দু ঘন্টার পথ- যাওয়া আসা মিলিয়ে চার ঘন্টা। আমারা চা বিস্কুট খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম। চাল, ডাল, সবজি, মুড়ি, মিষ্টি, ইত্যাদি সাথে ছিল। সিকটিয়াতে কোনো ট্রেকার যায় না, গরুর গাড়িই ভরসা। জীবনে আমি প্রথমবার গরুর গাড়ি চড়েছিলাম। দুটো গাড়ি আমাদের লেগেছিলো। একটা গাড়ির মালিকের নাম বেনিয়া। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম বেণুয়া কেন নয়? তবে এনারা দুই ভাই কোনো মতেই নন- বেণু দাদু পুরো সুকুমার রায়ের কুমড়ো পটাশ আর বেনিয়া রোগা পাতলা- লরেল এবং হার্ডি। বেনিয়াকে বেণু দাদু পনেরো বছর ধরে চেনেন। আরেকটা গাড়ি বেনিয়াই জোগাড় করে এনেছিল। তুলি মাসি বাবার একটা ফুল প্যান্ট পরে গেছিলেন, গ্রামের লোকেদের কাছে আধুনিক সাজবার জন্য। এমন ভাবে চেয়েছিলেন যে বাবা আর না করতে পারেন নি। বাবা নিজের একটা ঢলা জামাও ওকে দিয়েছিলেন। 'এই প্যান্টের সাথে এই জামাটা বেশ মানাবে'। যাকে যত কম পছন্দ হয়, তার সাথে ততো বেশি ভালো ব্যবহার করতে হয়।

যেমন চার চার আট জনের দুটো আলাদা ঘর, তেমন দুটো আলাদা গাড়িও। আমি সারা রাস্তা একটা গরুর পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে গেছিলাম। ওর নাম রাধা। চড়াই-উতরাই রাস্তা। মাঝে দুটো ছোট নদী পেরোতে হয়েছিল। জলে আমরা কেউ নিমিনি। নেমেছিল গরুর দল। জলে নামার সাথে সাথে রাধা এমন জোরে পা চালাচ্ছিল যে জল ছিটে আসছিলো গায়ে। এটা ওর খেলা। আমাদের গাড়ির অন্য গরুটা, নাম চম্পা, এমন দুরন্ত ছিল না। রাধা সুযোগ পেলেই তুলি মাসির জামাটা কামড়ে ধরছিল আর মাসির কি চিৎকার। মনে হচ্ছিলো ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ জানাচ্ছিলো। বেণু দাদুরা উঠেছিলেন বেনিয়ার গাড়িতে। আমাদের গাড়ির মালিকের নাম আমি জিজ্ঞেস করি নি। অচেনা গরুর নাম সহজেই জিজ্ঞেস করা যায়, কারণ সে নিজে তার নামটা বলে না; অচেনা মানুষের তা সবক্ষেত্রে করা যায় না।

সিকটিয়া পিকনিক স্পট। কয়েক ঘন্টার জন্য ভাল লাগে। কোনো শহরের মানুষ এক রাতও ওই গ্রামে কাটাতে পারবে না। গ্রামের নামও সিকটিয়া। ওই গ্রামে তখনও আলো আসেনি। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম। মানুষ এখানে চাষবাস করে খায়, সাথে পশু পালন করে। পাহাড় গুলো বেশি উঁচু নয়। সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। একটা গাছের নামও আমি জানতাম না। বেণু দাদু বলেছিলেন, 'এখানকার মানুষ বায়োগ্যাস দিয়ে রাতে বাতি জ্বালায়'। আমি দুটো পাথর ঘষে আগুন জ্বালাবার বৃথা চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ফুলকি আমি দেখেছিলাম। বাবাকেও দেখিয়েছিলাম। দূরে গিয়ে ছানু দাদু বলেন, 'বেণু যেটা পিছন দিয়ে ছাড়ে, সেটাই বায়োগ্যাস'।

ওখানে ছাউনির নীচে রান্নার ব্যবস্থা। দুটো পাম্প স্টোভ আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম। সাথে হাঁড়ি, কড়াই ও বাসন। দুটো বঁটিও ছিল। বেনিয়াই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। সকালের জলখাবারে আমরা মুড়ির সাথে আলুভাজা আর মিষ্টি খেয়েছিলাম আর দুপুরের খাবারে খিচুড়ি আর বেগুনি। বেবি দিদা সব নিজে হাতে রান্না করেছিলেন। মা আর দিদু হাতে হাতে ওনাকে সাহায্য করেছিলেন। তুলি মাসি সানগ্লাস পরে ঘুরছিল। বেণু দাদু কখনো ছবি তুলতে ব্যস্ত, কখনো জ্ঞান দিতে। আমি, বাবা ও ছানু দাদু যথাসম্ভব ওনার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছিলাম। গ্রামের বাড়ি গুলো সব খড়ের অথবা মাটির, ওপরে টালির চাল। গ্রামের ইস্কুল দেখেছিলাম। একটা উঁচু বেদী, শিক্ষকের বসার স্থান। তার সামনে গোটা ইটের মতো ছোট ছোট আসন ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্য। ওপরে কোনো ছাদ নেই, খোলা আকাশ। বেণু দাদু বেদীতে বসেন নি। গ্রামে আর কত দূর লেখাপড়া হবে। সেদিন ছিল রবিবার, ইস্কুল ছুটি ছিল। এই গ্রামে কোনো হাসপাতাল নেই- কুকুর বিড়ালের মতো মানুষ ঘাস পাতার ওপর নির্ভরশীল। আমরা জলখাবার খেয়েছিলাম দশটায় আর দুপুরের খাবার বেলা একটায়। মুড়ির জন্য বাটি পেয়েছিলাম কিন্তু খিচুড়ি খেয়েছিলাম শাল পাতায়। গাড়ির চালকদেরকেও খাওয়ানো হয়েছিল।

দুপুর দুটোয় আমরা সিকটিয়া থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম। বিকেল চারটে পনেরোর মধ্যে চলে এসেছিলাম নিজেদের বাসায়। বেণু দাদু বলেন, 'আজ পাঁচটায় বাজারের দিকে যাবো'। ছানু দাদু বলেন, 'সাড়ে পাঁচটায়'। বেণু দাদু ছানু দাদুর মুখের ওপর কথা বলতেই পারতেন না। রাতে সুদর্শন রুটি, আলুর তরকারি আর ডিম ভাজা দিয়ে গেছিলো।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ১০২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০৬/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast