শিমুলতলা ভ্রমণ ২
আমরা পাশাপাশি দুটো ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। একটা ঘরে ছিলেন বেণু দাদু, বেবি দিদা, দিদু, মানে আমার মায়ের মা, আর তুলি মাসি। আরেকটা ঘরে আমি, মা, বাবা ও ছানু দাদু ছিলাম। ছানু দাদু কোনো মতেই বেণু দাদুর সাথে একসাথে এক ঘরে থাকতে চান নি- এটা স্বয়ং মহাদেবও জানেন। তুলি মাসির মাথায় প্রচুর উকুন। এটা পুরো ভিতরকার খবর। উকুন তুলি মাসির মাথা থেকে বেবি দিদার মাথায় ছড়িয়েছিলো, তার থেকে দিদুর মাথায়। মায়ের মাথায় যাতে তা না ছড়ায়, সেই কারণে দিদুকে ছানু দাদু আমাদের ঘরে ঢুকতে দেন নি।
বেণু দাদু বলেছিলেন, 'সকাল ও বিকেলের জলখাবারটা আমরা ওপারে রেল লাইন পেরিয়ে খেতে যাবো। আমার চেনা দোকান আছে'। ছানু দাদু জিজ্ঞেস করেন, 'কি খাওয়ার পাওয়া যায় সেই দোকানে'? 'গরম গরম কচুরি, সাথে আলুর তরকারি, এখানকার বিখ্যাত ল্যাংচা'। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম এবার কুবের দেব ওপর থেকে নেমে এসে হয়তো বলবেন, 'আমি না, আপনিই আসল কুবের। আসুন আমার সাথে ওপরে। আমার আসন গ্রহণ করুন'। বেণু দাদু বলে চললেন, 'আমি নিজে বাজার করবো। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন। ফিরে এসে বেবি রান্না করবে'। বেবি দিদার হাতের রান্না সত্যি ভালো ছিল কিন্তু তিনি সবেতে ঘি দিতেন, আর আমার মতো কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না, আমার বাবারও না, ছানু দাদুরও না। বেণু দাদুর কথা মতো কাজ হয়েছিল। সুদর্শনের কাছ থেকে দুটি পাম্প স্টোভ জোগাড় করেই আমরা সেই দোকানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। পথে যেতে যেতে কেবল বেণু দাদুই কথা বলেছিলেন, 'দেখো সবাই রামকৃষ্ণ মিশনের একজন মাস্টার যাচ্ছেন'। আমি জানি না- রামকৃষ্ণ মিশনের সকল মাস্টাররা ওনার মতো কিনা, তবে মাতৃভাষা নিয়ে যারা একটু বেশি সাধনা করেন, সে যে ইস্কুলই হোক, তাদের গলা একটু লম্বা হয়।
যথারীতি তিনি দু প্লেট কচুরি খেলেন, সাথে চারটে ল্যাংচা। আমি উঁকি মারছিলাম কখন ফেস্টাল এন-এর পাতাটা ওনার ঝোলা থেকে বেরোবে। আমি, বাবা ও মা তিনজন মিলে দু প্লেট কচুরি খেয়েছিলাম, সাথে একটা করে ল্যাংচা। খেয়ে দেয়ে বেণু দাদু আমাদের বাজারে নিয়ে গেছিলেন, বলেছিলেন, 'এখানে চুনো মাছ, কাতলা মাছ আর পাঁঠার মাংস বিখ্যাত'। ছানু দাদু নাক গলিয়েছিলেন, 'আমাদের পাড়ার পুকুরে কাতলার চাষ হয়। আমাদের পাড়ার মাঠে পাঁঠা চরে বেড়ায়। রোজ আমি আমার বৌয়ের জন্য বাজার থেকে চুনো মাছ কিনে আনি'। বাবা বেশি কথা বলেন নি কারণ দু জনেই গুরুজন, অতএব চুপ থাকাই শ্রেয়। বেণু দাদু যা যা বলেছিলেন, তাই তাই কিনেওছিলেন, সাথে সবজিও। সবজি কেনার সময় তিনি বলেন, 'কলকাতার থেকে এখানে সবজির দাম সস্তা'। এই কথার তিনি কোনো উত্তর পান নি। সব কথার অবশ্য উত্তর হয় না। টাকা ভাগের ব্যাপারটা ঘরে ফিরেই হয়েছিল। তিনটে ভাগ- প্রথম ভাগে বেণু দাদু, বেবি দিদা ও তুলি মাসি; দ্বিতীয় ভাগে ছানু দাদু ও দিদু আর তৃতীয় ভাগে আমি, মা ও বাবা।
বাজার করে আমরা ফিরেছিলাম বেলা এগারোটায়। সব জোগাড় করে রান্না চাপাতে হয়ে গেছিলো বেলা একটা। মা ও দিদু বেবি দিদাকে সাহায্য করেছিলেন। তুলি মাসি এক গেলাস জল নিজে নিয়ে খেতে পারতেন না। রান্না শেষ হয়েছিল বেলা তিনটে। খাওয়া শেষ হতে হতে বেলা চারটে। কেবল তিনটে পদ রান্না হয়েছিল- চুনো মাছের ঝাল, সবজি দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল আর পাঁঠার মাংসের স্টু- স্বাদে গন্ধে ভরপুর কিন্তু গুরুপাক। সন্ধ্যে ছয়টায় আমরা বিকেলের জলখাবার খেতে বেরিয়েছিলাম- সেই একই জায়গায়, একই খাবার। তখন পাঁঠা পেটে ডাকছিলো। বেণু দাদু দেখালেন ফেস্টাল এন-এর কামাল- দু প্লেট কচুরির সাথে চারটে ল্যাংচা দিব্যি খেয়ে নিলেন। কেবল পাঁঠার পেটেই পাঁঠা হজম হয়। আমরা তিনজনে এক প্লেট কচুরি খেলাম, একটা ল্যাংচা তিনজনে ভাগ করে...।
ফিরে এসে বেণু দাদু আর বেবি দিদার রাজ্যের সমালোচনা শুরু হয়ে যেত। আমরা সেই সমালোচনায় ভাগ নিতাম না। দিদু চুপ করে এক কান দিয়ে শুনতেন আর আরেক কান দিয়ে বার করে দিতেন। আমরা পাশের ঘরে বসে লুডো খেলতাম।
রাতে সেই একই খাবার কিন্তু ভাতের জায়গায় রুটি। সুদর্শন রুটি দিয়ে যেত। থালার সাইজে রুটি। আমরা দুটোই খেতে পারতাম না। বেণু দাদু খেতেন ছয়টা। শুনেছি যাদের মাথামোটা, তারা পেটুক হয়। সেবার নিজের চোখে দেখেছিলাম। যেহেতু ঠাণ্ডা, তাই রাতে খাবার আগে বেবি দিদা খাবার গুলো পাম্প স্টোভে গরম করে নিতেন।
এতো প্রথম দিনের কথা বললাম। আমরা ছিলাম পনেরো দিন। এই প্রথম দিনের রুটিনটা রোজনামচা হয়ে গেছিলো। সকালের জলখাবার আর দুপুরের খাবারের মধ্যে প্রচুর ব্যবধান এবং দুপুরের খাবার হজম হওয়ার সময় না দিয়ে বিকেলের খাবার খাওয়া- এই দুই-য়ে মিলে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জায়গায় স্বাস্থ্য পতন হতে শুরু করেছিল। অবশ্য যারা কথায় কথায় ওষুধ খেতেন, তাদের জন্য নয়।
আরেকটা কথা না বললেই নয়। বেবি দিদা বলেছিলেন, 'ইঁদারার জল খেলে পেটের সব রোগ সেরে যায়'। ইঁদারার ওপর কোনো ছাউনি ছিল না- ওপর দিয়ে কত পাখি উড়ে যেত, কত কি জলে পড়তো, তার ওপর ওই একই জলে স্নান করা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ইত্যাদি। বেবি দিদা ইঁদারার জলেই রান্না করতেন। এতে নাকি রান্নার স্বাদ ভাল হতো। সব মিলিয়ে একেবারে বাজে অবস্থা। বাবা বলে ফেলেছিলেন, 'যেমন বরের মাথা, তেমন বৌয়ের'। মা বাবার হাত চেপে ধরেন। ভাগ্যিস আশেপাশে তারা কেউ ছিলেন না।
আমি বেণু স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'এখানকার বিখ্যাত লাট্টু পাহাড় কোথায়'? 'লাট্টু পাহাড় দেখে আর কাজ নেই'। আসলে তিনি খাওয়ার লোভে ঘোরার নেশা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বেবি দিদা বলেন, 'ওই পাহাড়ের মাথায় ঝগড়া মন্দির আছে। ওখানে গেলেই তোর মা বাবার মধ্যে ঝগড়া হবে'। আমার লাট্টু পাহাড় দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল। সেই ইচ্ছে পূর্ণ করেওছিলাম।
(চলবে)
বেণু দাদু বলেছিলেন, 'সকাল ও বিকেলের জলখাবারটা আমরা ওপারে রেল লাইন পেরিয়ে খেতে যাবো। আমার চেনা দোকান আছে'। ছানু দাদু জিজ্ঞেস করেন, 'কি খাওয়ার পাওয়া যায় সেই দোকানে'? 'গরম গরম কচুরি, সাথে আলুর তরকারি, এখানকার বিখ্যাত ল্যাংচা'। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম এবার কুবের দেব ওপর থেকে নেমে এসে হয়তো বলবেন, 'আমি না, আপনিই আসল কুবের। আসুন আমার সাথে ওপরে। আমার আসন গ্রহণ করুন'। বেণু দাদু বলে চললেন, 'আমি নিজে বাজার করবো। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন। ফিরে এসে বেবি রান্না করবে'। বেবি দিদার হাতের রান্না সত্যি ভালো ছিল কিন্তু তিনি সবেতে ঘি দিতেন, আর আমার মতো কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না, আমার বাবারও না, ছানু দাদুরও না। বেণু দাদুর কথা মতো কাজ হয়েছিল। সুদর্শনের কাছ থেকে দুটি পাম্প স্টোভ জোগাড় করেই আমরা সেই দোকানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। পথে যেতে যেতে কেবল বেণু দাদুই কথা বলেছিলেন, 'দেখো সবাই রামকৃষ্ণ মিশনের একজন মাস্টার যাচ্ছেন'। আমি জানি না- রামকৃষ্ণ মিশনের সকল মাস্টাররা ওনার মতো কিনা, তবে মাতৃভাষা নিয়ে যারা একটু বেশি সাধনা করেন, সে যে ইস্কুলই হোক, তাদের গলা একটু লম্বা হয়।
যথারীতি তিনি দু প্লেট কচুরি খেলেন, সাথে চারটে ল্যাংচা। আমি উঁকি মারছিলাম কখন ফেস্টাল এন-এর পাতাটা ওনার ঝোলা থেকে বেরোবে। আমি, বাবা ও মা তিনজন মিলে দু প্লেট কচুরি খেয়েছিলাম, সাথে একটা করে ল্যাংচা। খেয়ে দেয়ে বেণু দাদু আমাদের বাজারে নিয়ে গেছিলেন, বলেছিলেন, 'এখানে চুনো মাছ, কাতলা মাছ আর পাঁঠার মাংস বিখ্যাত'। ছানু দাদু নাক গলিয়েছিলেন, 'আমাদের পাড়ার পুকুরে কাতলার চাষ হয়। আমাদের পাড়ার মাঠে পাঁঠা চরে বেড়ায়। রোজ আমি আমার বৌয়ের জন্য বাজার থেকে চুনো মাছ কিনে আনি'। বাবা বেশি কথা বলেন নি কারণ দু জনেই গুরুজন, অতএব চুপ থাকাই শ্রেয়। বেণু দাদু যা যা বলেছিলেন, তাই তাই কিনেওছিলেন, সাথে সবজিও। সবজি কেনার সময় তিনি বলেন, 'কলকাতার থেকে এখানে সবজির দাম সস্তা'। এই কথার তিনি কোনো উত্তর পান নি। সব কথার অবশ্য উত্তর হয় না। টাকা ভাগের ব্যাপারটা ঘরে ফিরেই হয়েছিল। তিনটে ভাগ- প্রথম ভাগে বেণু দাদু, বেবি দিদা ও তুলি মাসি; দ্বিতীয় ভাগে ছানু দাদু ও দিদু আর তৃতীয় ভাগে আমি, মা ও বাবা।
বাজার করে আমরা ফিরেছিলাম বেলা এগারোটায়। সব জোগাড় করে রান্না চাপাতে হয়ে গেছিলো বেলা একটা। মা ও দিদু বেবি দিদাকে সাহায্য করেছিলেন। তুলি মাসি এক গেলাস জল নিজে নিয়ে খেতে পারতেন না। রান্না শেষ হয়েছিল বেলা তিনটে। খাওয়া শেষ হতে হতে বেলা চারটে। কেবল তিনটে পদ রান্না হয়েছিল- চুনো মাছের ঝাল, সবজি দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল আর পাঁঠার মাংসের স্টু- স্বাদে গন্ধে ভরপুর কিন্তু গুরুপাক। সন্ধ্যে ছয়টায় আমরা বিকেলের জলখাবার খেতে বেরিয়েছিলাম- সেই একই জায়গায়, একই খাবার। তখন পাঁঠা পেটে ডাকছিলো। বেণু দাদু দেখালেন ফেস্টাল এন-এর কামাল- দু প্লেট কচুরির সাথে চারটে ল্যাংচা দিব্যি খেয়ে নিলেন। কেবল পাঁঠার পেটেই পাঁঠা হজম হয়। আমরা তিনজনে এক প্লেট কচুরি খেলাম, একটা ল্যাংচা তিনজনে ভাগ করে...।
ফিরে এসে বেণু দাদু আর বেবি দিদার রাজ্যের সমালোচনা শুরু হয়ে যেত। আমরা সেই সমালোচনায় ভাগ নিতাম না। দিদু চুপ করে এক কান দিয়ে শুনতেন আর আরেক কান দিয়ে বার করে দিতেন। আমরা পাশের ঘরে বসে লুডো খেলতাম।
রাতে সেই একই খাবার কিন্তু ভাতের জায়গায় রুটি। সুদর্শন রুটি দিয়ে যেত। থালার সাইজে রুটি। আমরা দুটোই খেতে পারতাম না। বেণু দাদু খেতেন ছয়টা। শুনেছি যাদের মাথামোটা, তারা পেটুক হয়। সেবার নিজের চোখে দেখেছিলাম। যেহেতু ঠাণ্ডা, তাই রাতে খাবার আগে বেবি দিদা খাবার গুলো পাম্প স্টোভে গরম করে নিতেন।
এতো প্রথম দিনের কথা বললাম। আমরা ছিলাম পনেরো দিন। এই প্রথম দিনের রুটিনটা রোজনামচা হয়ে গেছিলো। সকালের জলখাবার আর দুপুরের খাবারের মধ্যে প্রচুর ব্যবধান এবং দুপুরের খাবার হজম হওয়ার সময় না দিয়ে বিকেলের খাবার খাওয়া- এই দুই-য়ে মিলে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জায়গায় স্বাস্থ্য পতন হতে শুরু করেছিল। অবশ্য যারা কথায় কথায় ওষুধ খেতেন, তাদের জন্য নয়।
আরেকটা কথা না বললেই নয়। বেবি দিদা বলেছিলেন, 'ইঁদারার জল খেলে পেটের সব রোগ সেরে যায়'। ইঁদারার ওপর কোনো ছাউনি ছিল না- ওপর দিয়ে কত পাখি উড়ে যেত, কত কি জলে পড়তো, তার ওপর ওই একই জলে স্নান করা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ইত্যাদি। বেবি দিদা ইঁদারার জলেই রান্না করতেন। এতে নাকি রান্নার স্বাদ ভাল হতো। সব মিলিয়ে একেবারে বাজে অবস্থা। বাবা বলে ফেলেছিলেন, 'যেমন বরের মাথা, তেমন বৌয়ের'। মা বাবার হাত চেপে ধরেন। ভাগ্যিস আশেপাশে তারা কেউ ছিলেন না।
আমি বেণু স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'এখানকার বিখ্যাত লাট্টু পাহাড় কোথায়'? 'লাট্টু পাহাড় দেখে আর কাজ নেই'। আসলে তিনি খাওয়ার লোভে ঘোরার নেশা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বেবি দিদা বলেন, 'ওই পাহাড়ের মাথায় ঝগড়া মন্দির আছে। ওখানে গেলেই তোর মা বাবার মধ্যে ঝগড়া হবে'। আমার লাট্টু পাহাড় দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল। সেই ইচ্ছে পূর্ণ করেওছিলাম।
(চলবে)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শ.ম. শহীদ ১৭/১১/২০২৪অতি সুন্দর বর্ণনা।
-
অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী ২১/০৭/২০২৪অসাধারণ হয়েছে
-
মো.রিদওয়ান আল হাসান ০১/০৭/২০২৪উপভোগ্য!
-
তাবেরী ২২/০৬/২০২৪সুন্দর