বকখালি ভ্রমণ
বকখালি গেছিলাম দু বছর আগে। এক দিনের টুর। ভোর বেলা বেরিয়েছি, তখন সকাল সাতটা আর ফিরেছি রাত নয়টায়। গাড়ি ভাড়া করে গেছিলাম, দুটো পরিবার মিলে, আমরা তিন জন ও কোকো মামারা তিন জন। প্রথমে ওনারা যেতে রাজি হচ্ছিলেন না, বকখালি ওনাদের ঘোরা। 'একা একা যেতে মোটেই ভালো লাগে না, যাওয়ার আনন্দটাই মরে যায়। তাছাড়া তোরা গেলে একটা গাইডও পাওয়া যাবে'। কোকো মামাকে রাজি করলেন মা। আমাদের বাড়ি থেকেই যাত্রা শুরু হল। প্রথমে কথা ছিল বাসে যাওয়া হবে। বাবা বলেন, 'তোর মা অত ধকল সহ্য করতে পারবে না। বাসে দারুণ ঝাঁকুনি হয়'।
প্রথমে গাড়ি থামলো ডায়মন্ড হারবার-এর সাগরিকা হোটেলের সামনে। আমরা কেবল চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছিলাম, ওই হোটেলে জলখাবার খেলাম। বহু কাল আগে, তখন আমার কত বয়স মনে নেই, আমরা ডায়মন্ড হারবার-এ পিকনিক করতে এসেছিলাম। তখন সাগরিকা হোটেলটা পুরো তৈরী হয়নি। আমরা হোটেলের পাশের মাঠে পিকনিক করেছিলাম। খোলা আকাশের নীচে রান্না হয়েছিল, খোলা আকাশের নীচে খেয়েছিলাম। মনে পড়ে, কোথা থেকে একটা গরু এসে রান্নার স্টোভের সামনে গোবর ছড়িয়েছিলো। তাকে তাড়া করে তাড়ানো হয়েছিল, তখন সে কাজের কাজ সেরে ফেলেছে। কখন যে ঢুকেছিল, কেউ জানে না। রান্নার লোকেরা বাজারে গেছিলো আর আমরা গল্পে মত্ত। কেউ মজা করে বলেছিলো, 'ঘুঁটে বানিয়ে নে, ভালো রান্না হবে'। এখন সেই খোলা মাঠে কংক্রিটের বস্তি। আমরা লুচি আলুর তরকারি খেয়েছিলাম হোটেলে। খাওয়ার আগে কোকো মামাকে বলেছিলাম, 'আগে লুচি আসুক, তারপর ইন্সুলিন নেবে'। গতবার অয়ালা ঝড়ে হুগলী নদীর জল ঢুকেছিলো হোটেলে। দেখলাম নীচের গ্যারেজ-এর দেওয়ালে এখনো শ্যাওলা লেগে।
ডায়মন্ড হারবার থেকে হেনরিজ আইল্যান্ড কোকো মামাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছিলেন। হেনরিজ আইল্যান্ড-এ টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, মাথাপিছু কুড়ি টাকা। দেখার জিনিস বলতে একুশটা মাছের ভেড়ি, প্রচুর গাছ পালা ও একটা সমুদ্র সৈকত। কিন্তু যা বৃষ্টি, আমরা কোনো মতে একটা ছাউনির তলার আশ্রয় নিয়েছিলাম। ছাতা আনার কথা মনেই ছিল না, যখন বেরিয়েছিলাম তখন আকাশ পরিষ্কার ছিল। আমি বেশি ভিজেছিলাম। বৃষ্টি থামলে কাঠের পুল পার হয়ে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছলাম। একবারে একজনের বেশি পুল দিয়ে যাওয়া নিষেধ, এমনই নড়বড়ে। সমুদ্র সৈকতটা দেখার মতো। সমুদ্রের হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেছিলো। চোরাবালির ভয়ে আমরা বেশি এগোয়নি। বহু লোক সাহস করে সামনে এগিয়ে স্নান করছিলো। আমি বৃষ্টি ভেজা জামা সমুদ্রের হাওয়ায় শুকিয়ে নিয়েছিলাম, পরে ফল ভোগ করেছি। আমি জোরে জোরে বলেছিলাম, 'সমুদ্রের ঢেউ গুলো দেখে মনে হচ্ছে জীবনের পথে একটার পর একটা সময়ের বাধা, আমার পায়ের সামনে এসে মাথা ঠুকে মরছে আমার অধ্যবসায়কে সম্মান জানিয়ে'। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, 'কবি হয়ে গেছিস নাকি'! আমি মুচকি হেসেছিলাম।
ওখান থেকে আমরা গেছিলাম ফ্রেজার গঞ্জ। দেখার কিছুই নেই, কেবলই ধ্বংসাবশেষ। অয়ালা সব তছনছ করে দিয়েছে। ভাঙা সৈকত, ভাঙা মন্দির, ভাঙা বাড়ি, ভাঙা হোটেল, ভাঙা গাছ দেখে মনটাই ভেঙে গেলো। একটা বাতচক্র দেখেছিলাম সমুদ্র সৌকতে, পুরো অক্ষত। ধ্বংসের ভিড়েও সৃষ্টি হয়। বেশিক্ষণ আমরা ওখানে থাকিনি। কোকো মামা বলেন, 'আমি যখন দেখে গেছিলাম, তখন ধ্বংসের কোনো চিহ্ন মাত্র ছিল না'। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কত বছর আগে'? 'বছর পাঁচেক'।
ফ্রেজার গঞ্জ থেকে আমরা সোজা গেলাম বকখালি। কুড়ি মিনিটের পথ। মাঝে একবার গাড়ি থামিয়ে আমি নেমেছিলাম কুমীর চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে বকখালি ঢোকার মুখে। সামনের চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করতে বললো, 'এখানে এখন কোনো কুমীর নেই'। কুমীর দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার, তা হল না। বকখালি সমুদ্র সৈকতে বালুচর- সমুদ্র যেন দু ভাগ হয়ে গেছে এখানে। আমরা কেউ স্নান করতে নামিনি। আলাদা জামা কাপড় আমরা নিয়ে আসিনি। অগণিত নরনারী সমুদ্রে নেমে স্নান করছিল। কাছের জলাশয়টা সকলে হেঁটেই পার হচ্ছিলো, আমার বুক জল হবে। দূরে থেকে আমরা ঢেউয়ের মহিমা দেখছিলাম। তার ওপর সোনা রোদ পড়ে সেই মহিমাকে আরো মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলেছিল।
দুপুরে আমরা একটা সরকারি লজ-এ খাবার খেয়েছিলাম। গরম ভাত, সোনা মুগ ডাল, পোস্তর বড়া, বেগুন ভাজা ও মুরগির মাংসের ঝোল। বাবা বলেন, 'কোকোদের আমরা নিমন্ত্রণ করে এনেছি, তাই ওদের খাওয়ানোর দায়িত্ব আমাদের'। মা সায় দেন। চালককেও বাবা খাওয়ালেন, বাবা যে উদার তার পরিচয় দিলেন। খেয়ে দেয়ে আমরা চেয়ার ভাড়া করে দু ঘন্টা সৈকতে বসে ছিলাম, প্রতি ঘন্টায় মাথাপিছু দশ টাকা। দেখতে দেখতে দু ঘন্টা কেটে গেছিলো। আমি জোরে জোরে বলেছিলাম, 'আকাশ যেখানে জমির সাথে মেশে, সেখানে মানুষ দাঁড়িয়ে দিক নির্ণয় করে আর আকাশ যেখানে জলের সাথে মেশে, সেখানে মানুষ বসে ক্লান্তির গ্লানি দূর করে। আমি তাই করলাম। আসার সময় মনে হচ্ছিলো আমি পৃথিবীর সবথেকে ক্লান্ত জীব, এখন মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীর সবথেকে সজীব'। কোকো মামা বলেন, 'কবিতা লেখ'।
ফেরার পথে আমরা জুলফিয়া হয়ে ফিরলাম কোকো মামার কথা মতো, নইলে রাত এগারোটা বাজতো ফিরতে। ফেরার পথে একটা মজার ঘটনা বলি। নামখানা বাজারে বাবা ও কোকো মামা নেমেছিলেন ইলিশ মাছ কিনতে। কলকাতার লোক দেখেই দোকানদার হাজার টাকা কেজি বলেন মাছের দাম। আর মাছ কেনা হল না। একটা ট্রাকে করে ইলিশ মাছ নিয়ে যাচ্ছিলো, হতে পারে কলকাতার উদ্দেশ্যে। ট্রাক থেকে মাছ গুলো একে একে রাস্তায় পড়ছিলো আর গাড়ির চাকা তাদের পিষে দিয়ে যাচ্ছিলো। হাই ওয়েতে নেমে কে মাছ কুড়োবে? জীবনই যদি না থাকে, তাহলে ইলিশ মাছ খাবে কিভাবে? আমরা গাড়ি নিয়ে ট্রাকের আগে পৌঁছে, ট্রাক থামিয়ে উপদেশ দিয়েছিলাম, তাতে কাজ হয়েছিল। জায়গাটা নামখানা বাজারের কিছু পরেই।
প্রথমে গাড়ি থামলো ডায়মন্ড হারবার-এর সাগরিকা হোটেলের সামনে। আমরা কেবল চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছিলাম, ওই হোটেলে জলখাবার খেলাম। বহু কাল আগে, তখন আমার কত বয়স মনে নেই, আমরা ডায়মন্ড হারবার-এ পিকনিক করতে এসেছিলাম। তখন সাগরিকা হোটেলটা পুরো তৈরী হয়নি। আমরা হোটেলের পাশের মাঠে পিকনিক করেছিলাম। খোলা আকাশের নীচে রান্না হয়েছিল, খোলা আকাশের নীচে খেয়েছিলাম। মনে পড়ে, কোথা থেকে একটা গরু এসে রান্নার স্টোভের সামনে গোবর ছড়িয়েছিলো। তাকে তাড়া করে তাড়ানো হয়েছিল, তখন সে কাজের কাজ সেরে ফেলেছে। কখন যে ঢুকেছিল, কেউ জানে না। রান্নার লোকেরা বাজারে গেছিলো আর আমরা গল্পে মত্ত। কেউ মজা করে বলেছিলো, 'ঘুঁটে বানিয়ে নে, ভালো রান্না হবে'। এখন সেই খোলা মাঠে কংক্রিটের বস্তি। আমরা লুচি আলুর তরকারি খেয়েছিলাম হোটেলে। খাওয়ার আগে কোকো মামাকে বলেছিলাম, 'আগে লুচি আসুক, তারপর ইন্সুলিন নেবে'। গতবার অয়ালা ঝড়ে হুগলী নদীর জল ঢুকেছিলো হোটেলে। দেখলাম নীচের গ্যারেজ-এর দেওয়ালে এখনো শ্যাওলা লেগে।
ডায়মন্ড হারবার থেকে হেনরিজ আইল্যান্ড কোকো মামাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছিলেন। হেনরিজ আইল্যান্ড-এ টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, মাথাপিছু কুড়ি টাকা। দেখার জিনিস বলতে একুশটা মাছের ভেড়ি, প্রচুর গাছ পালা ও একটা সমুদ্র সৈকত। কিন্তু যা বৃষ্টি, আমরা কোনো মতে একটা ছাউনির তলার আশ্রয় নিয়েছিলাম। ছাতা আনার কথা মনেই ছিল না, যখন বেরিয়েছিলাম তখন আকাশ পরিষ্কার ছিল। আমি বেশি ভিজেছিলাম। বৃষ্টি থামলে কাঠের পুল পার হয়ে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছলাম। একবারে একজনের বেশি পুল দিয়ে যাওয়া নিষেধ, এমনই নড়বড়ে। সমুদ্র সৈকতটা দেখার মতো। সমুদ্রের হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেছিলো। চোরাবালির ভয়ে আমরা বেশি এগোয়নি। বহু লোক সাহস করে সামনে এগিয়ে স্নান করছিলো। আমি বৃষ্টি ভেজা জামা সমুদ্রের হাওয়ায় শুকিয়ে নিয়েছিলাম, পরে ফল ভোগ করেছি। আমি জোরে জোরে বলেছিলাম, 'সমুদ্রের ঢেউ গুলো দেখে মনে হচ্ছে জীবনের পথে একটার পর একটা সময়ের বাধা, আমার পায়ের সামনে এসে মাথা ঠুকে মরছে আমার অধ্যবসায়কে সম্মান জানিয়ে'। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, 'কবি হয়ে গেছিস নাকি'! আমি মুচকি হেসেছিলাম।
ওখান থেকে আমরা গেছিলাম ফ্রেজার গঞ্জ। দেখার কিছুই নেই, কেবলই ধ্বংসাবশেষ। অয়ালা সব তছনছ করে দিয়েছে। ভাঙা সৈকত, ভাঙা মন্দির, ভাঙা বাড়ি, ভাঙা হোটেল, ভাঙা গাছ দেখে মনটাই ভেঙে গেলো। একটা বাতচক্র দেখেছিলাম সমুদ্র সৌকতে, পুরো অক্ষত। ধ্বংসের ভিড়েও সৃষ্টি হয়। বেশিক্ষণ আমরা ওখানে থাকিনি। কোকো মামা বলেন, 'আমি যখন দেখে গেছিলাম, তখন ধ্বংসের কোনো চিহ্ন মাত্র ছিল না'। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কত বছর আগে'? 'বছর পাঁচেক'।
ফ্রেজার গঞ্জ থেকে আমরা সোজা গেলাম বকখালি। কুড়ি মিনিটের পথ। মাঝে একবার গাড়ি থামিয়ে আমি নেমেছিলাম কুমীর চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে বকখালি ঢোকার মুখে। সামনের চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করতে বললো, 'এখানে এখন কোনো কুমীর নেই'। কুমীর দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার, তা হল না। বকখালি সমুদ্র সৈকতে বালুচর- সমুদ্র যেন দু ভাগ হয়ে গেছে এখানে। আমরা কেউ স্নান করতে নামিনি। আলাদা জামা কাপড় আমরা নিয়ে আসিনি। অগণিত নরনারী সমুদ্রে নেমে স্নান করছিল। কাছের জলাশয়টা সকলে হেঁটেই পার হচ্ছিলো, আমার বুক জল হবে। দূরে থেকে আমরা ঢেউয়ের মহিমা দেখছিলাম। তার ওপর সোনা রোদ পড়ে সেই মহিমাকে আরো মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলেছিল।
দুপুরে আমরা একটা সরকারি লজ-এ খাবার খেয়েছিলাম। গরম ভাত, সোনা মুগ ডাল, পোস্তর বড়া, বেগুন ভাজা ও মুরগির মাংসের ঝোল। বাবা বলেন, 'কোকোদের আমরা নিমন্ত্রণ করে এনেছি, তাই ওদের খাওয়ানোর দায়িত্ব আমাদের'। মা সায় দেন। চালককেও বাবা খাওয়ালেন, বাবা যে উদার তার পরিচয় দিলেন। খেয়ে দেয়ে আমরা চেয়ার ভাড়া করে দু ঘন্টা সৈকতে বসে ছিলাম, প্রতি ঘন্টায় মাথাপিছু দশ টাকা। দেখতে দেখতে দু ঘন্টা কেটে গেছিলো। আমি জোরে জোরে বলেছিলাম, 'আকাশ যেখানে জমির সাথে মেশে, সেখানে মানুষ দাঁড়িয়ে দিক নির্ণয় করে আর আকাশ যেখানে জলের সাথে মেশে, সেখানে মানুষ বসে ক্লান্তির গ্লানি দূর করে। আমি তাই করলাম। আসার সময় মনে হচ্ছিলো আমি পৃথিবীর সবথেকে ক্লান্ত জীব, এখন মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীর সবথেকে সজীব'। কোকো মামা বলেন, 'কবিতা লেখ'।
ফেরার পথে আমরা জুলফিয়া হয়ে ফিরলাম কোকো মামার কথা মতো, নইলে রাত এগারোটা বাজতো ফিরতে। ফেরার পথে একটা মজার ঘটনা বলি। নামখানা বাজারে বাবা ও কোকো মামা নেমেছিলেন ইলিশ মাছ কিনতে। কলকাতার লোক দেখেই দোকানদার হাজার টাকা কেজি বলেন মাছের দাম। আর মাছ কেনা হল না। একটা ট্রাকে করে ইলিশ মাছ নিয়ে যাচ্ছিলো, হতে পারে কলকাতার উদ্দেশ্যে। ট্রাক থেকে মাছ গুলো একে একে রাস্তায় পড়ছিলো আর গাড়ির চাকা তাদের পিষে দিয়ে যাচ্ছিলো। হাই ওয়েতে নেমে কে মাছ কুড়োবে? জীবনই যদি না থাকে, তাহলে ইলিশ মাছ খাবে কিভাবে? আমরা গাড়ি নিয়ে ট্রাকের আগে পৌঁছে, ট্রাক থামিয়ে উপদেশ দিয়েছিলাম, তাতে কাজ হয়েছিল। জায়গাটা নামখানা বাজারের কিছু পরেই।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
বোরহানুল ইসলাম লিটন ২৭/১২/২০২৩অসাধারণ!
-
ফয়জুল মহী ২৬/১২/২০২৩চমৎকার