ধর্মীয় বহুত্ববাদ
বাঙালি তার দীর্ঘ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন ধর্মের সংস্পর্শে এমন এক সামাজিক আচার-আচরণের ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল যা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে 'ধর্মীয় বহুত্ববাদ' (Religious Pluralism) ধারণাটির প্রায় সমার্থক। এর দ্বারা সাধারণত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক ও সহাবস্থান বোঝায়।
ইউরোপীয় দার্শনিক হবস তাঁর 'লেভিয়াথান' -এ বলেছিলেন যে, সমাজে শান্তি বিরাজ করবে কেবল ঐ সময়ে যখন একটিমাত্র ধর্ম বিদ্যমান থাকবে। ১৬৮৯ সনে জন লক তাঁর 'লেটার কনসার্নিং টলারেশন'-এ হবসের বিরোধিতা করে ধর্মীয় বহুত্ববাদের ধারণা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি রাষ্ট্র ও চার্চের ক্ষমতার মধ্যে বিভিন্নতা তুলে ধরেন, রাষ্ট্র নাগরিকদের বৈচিত্র্যকে রক্ষা করবে এবং নাগরিক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে চার্চ অবশ্যই নাগরিক সমাজের অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হবে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবে। আঠার শতকের ইউরোপের দার্শনিকবৃন্দ ধর্মীয় সংঘাতের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, রাষ্ট্র ও চার্চ উভয়কেই সহনশীল হতে হবে।
এরূপ সহনশীলতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার। বৌদ্ধ রাজন্যবর্গ কর্তৃক হিন্দু মন্দির ও ব্রাহ্মণদের জন্য ভূমিদানের মাধ্যমে ধর্মীয় বহুত্ববাদের প্রসারের এবং অনুসরণের দৃষ্টান্ত এত বেশি যে তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বেদ পড়ে শুনানোর জন্য ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করছে; আর এ ভূমিদানের ফলে মাতাপিতা ও নিজের পূণ্য সাধন হবে এরূপ বিশ্বাসের অভিপ্রকাশ ঘটেছে বৌদ্ধ রাজাদের শাসনামলে। বৌদ্ধ শাসনামলে শাসকগোষ্ঠী ছিল বৌদ্ধ কিন্তু বেশিরভাগ রাজকবি, প্রশস্তি রচয়িতা, মন্ত্রীবর্গ এবং বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিগণ ছিল সনাতনী ধর্মাবলম্বী।
পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার নির্মাণ করেন ধর্মপাল (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী), এটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই বিহারের দেয়ালের বহিরাংশে পোড়ামাটির ফলকে বিধৃত রয়েছে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের এর চাইতে প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে। বাংলা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সহাবস্থান এর দৃষ্টান্ত সুয়ান জাং এর ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লেখ রয়েছে।
মুসলিম সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় রামায়ণ-মহাভারত ও বাংলায় অনুদিত হয়েছে। সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে মঙ্গল কাব্যসম্ভার। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ শ্রীচৈতন্যের (বৈষ্ণববাদ) প্রতি এমন উদার নীতি গ্রহণ করেছিলেন যে শ্রীচৈতন্যের প্রচারকার্যের সব রকম ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র। দুই হিন্দু ব্রাহ্মণ রূপ ও সনাতনকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ দবীর-ই-খাস (ব্যক্তিগত সচিব) ও সরকার-ই-মূলক (প্রতিমন্ত্রী) পদে নিয়োগ দান করেন। হোসেন শাহ কেশব বসুকে নিয়োগ করেছিলেন তাঁর দেহরক্ষীদের প্রধান ; গোপীনাথ বসুকে উজির, রামচন্দ্র খানকে লস্কর উজির পদ প্রদান করেছিলেন।
পাটনা ও বিহার শরিফে ১৪০০ তাজিয়া মিছিলের মধ্যে ৬০০ মিছিলের আয়োজক ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়। শাহমত জঙ্গ ও সওলাত জঙ্গ কর্তৃক মুর্শিদাবাদের মতিঝিল উদ্যানে সাতদিনব্যাপী হোলি অনুষ্ঠান উদযাপিত হত। নবাব সিরাজ উদ দৌলা (৯ফেব্রুয়ারি,১৭৫৭) আলীনগরের সন্ধি সম্পাদন করে মুর্শিদাবাদে নবনির্মিত মনসুরগঞ্জ প্রাসাদে হোলি উদযাপন করেন।
সমাজদেহে যতদিন জীবনী শক্তি থাকে ততদিন ভিতর থেকে বা বাহির থেকে যত আঘাতই আসুক না কেন, সমাজ আপন শক্তিতেই তা প্রতিরোধ করবে। সমাজ এ শক্তি পাবে অতীতের ঐতিহ্য থেকে। অতীতে উত্তরাধিকার সম্পর্কে গভীর সচেতনতাই সৃষ্টি করবে এ-প্রাণশক্তি।
শোন হে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপর নাই।
'ধর্মীয় বহুত্ববাদ প্রাক-ঐপনিবেশিক বাংলায়' শিরোনামের ড. আব্দুল মমিন চৌধুরীর বক্তব্য থেকে লেখা।
ইউরোপীয় দার্শনিক হবস তাঁর 'লেভিয়াথান' -এ বলেছিলেন যে, সমাজে শান্তি বিরাজ করবে কেবল ঐ সময়ে যখন একটিমাত্র ধর্ম বিদ্যমান থাকবে। ১৬৮৯ সনে জন লক তাঁর 'লেটার কনসার্নিং টলারেশন'-এ হবসের বিরোধিতা করে ধর্মীয় বহুত্ববাদের ধারণা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি রাষ্ট্র ও চার্চের ক্ষমতার মধ্যে বিভিন্নতা তুলে ধরেন, রাষ্ট্র নাগরিকদের বৈচিত্র্যকে রক্ষা করবে এবং নাগরিক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে চার্চ অবশ্যই নাগরিক সমাজের অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হবে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবে। আঠার শতকের ইউরোপের দার্শনিকবৃন্দ ধর্মীয় সংঘাতের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, রাষ্ট্র ও চার্চ উভয়কেই সহনশীল হতে হবে।
এরূপ সহনশীলতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার। বৌদ্ধ রাজন্যবর্গ কর্তৃক হিন্দু মন্দির ও ব্রাহ্মণদের জন্য ভূমিদানের মাধ্যমে ধর্মীয় বহুত্ববাদের প্রসারের এবং অনুসরণের দৃষ্টান্ত এত বেশি যে তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বেদ পড়ে শুনানোর জন্য ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করছে; আর এ ভূমিদানের ফলে মাতাপিতা ও নিজের পূণ্য সাধন হবে এরূপ বিশ্বাসের অভিপ্রকাশ ঘটেছে বৌদ্ধ রাজাদের শাসনামলে। বৌদ্ধ শাসনামলে শাসকগোষ্ঠী ছিল বৌদ্ধ কিন্তু বেশিরভাগ রাজকবি, প্রশস্তি রচয়িতা, মন্ত্রীবর্গ এবং বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিগণ ছিল সনাতনী ধর্মাবলম্বী।
পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার নির্মাণ করেন ধর্মপাল (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী), এটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই বিহারের দেয়ালের বহিরাংশে পোড়ামাটির ফলকে বিধৃত রয়েছে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের এর চাইতে প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে। বাংলা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সহাবস্থান এর দৃষ্টান্ত সুয়ান জাং এর ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লেখ রয়েছে।
মুসলিম সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় রামায়ণ-মহাভারত ও বাংলায় অনুদিত হয়েছে। সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে মঙ্গল কাব্যসম্ভার। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ শ্রীচৈতন্যের (বৈষ্ণববাদ) প্রতি এমন উদার নীতি গ্রহণ করেছিলেন যে শ্রীচৈতন্যের প্রচারকার্যের সব রকম ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র। দুই হিন্দু ব্রাহ্মণ রূপ ও সনাতনকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ দবীর-ই-খাস (ব্যক্তিগত সচিব) ও সরকার-ই-মূলক (প্রতিমন্ত্রী) পদে নিয়োগ দান করেন। হোসেন শাহ কেশব বসুকে নিয়োগ করেছিলেন তাঁর দেহরক্ষীদের প্রধান ; গোপীনাথ বসুকে উজির, রামচন্দ্র খানকে লস্কর উজির পদ প্রদান করেছিলেন।
পাটনা ও বিহার শরিফে ১৪০০ তাজিয়া মিছিলের মধ্যে ৬০০ মিছিলের আয়োজক ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়। শাহমত জঙ্গ ও সওলাত জঙ্গ কর্তৃক মুর্শিদাবাদের মতিঝিল উদ্যানে সাতদিনব্যাপী হোলি অনুষ্ঠান উদযাপিত হত। নবাব সিরাজ উদ দৌলা (৯ফেব্রুয়ারি,১৭৫৭) আলীনগরের সন্ধি সম্পাদন করে মুর্শিদাবাদে নবনির্মিত মনসুরগঞ্জ প্রাসাদে হোলি উদযাপন করেন।
সমাজদেহে যতদিন জীবনী শক্তি থাকে ততদিন ভিতর থেকে বা বাহির থেকে যত আঘাতই আসুক না কেন, সমাজ আপন শক্তিতেই তা প্রতিরোধ করবে। সমাজ এ শক্তি পাবে অতীতের ঐতিহ্য থেকে। অতীতে উত্তরাধিকার সম্পর্কে গভীর সচেতনতাই সৃষ্টি করবে এ-প্রাণশক্তি।
শোন হে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপর নাই।
'ধর্মীয় বহুত্ববাদ প্রাক-ঐপনিবেশিক বাংলায়' শিরোনামের ড. আব্দুল মমিন চৌধুরীর বক্তব্য থেকে লেখা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৭/০৫/২০১৯এটা কি উনার লেখার কিছু অংশ কপি নাকি উনার লেখার সঙ্গে আপনার কিছু সংযুক্তি?
-
নাসরীন আক্তার রুবি ১৬/০৫/২০১৯অসাধারণ একটি লেখা।ধন্যবাদ