তিতুমীর কিছু একটা করবে (হতভাগা)
বুঝ হওয়ার পর থেকে সংসারের অভাব আর টানাপোড়ন দেখতে দেখতে বড় হওয়া ছেলেটা এসএসসি দিয়েই বেরিয়ে পড়ে কিছু করবে বলে। কিছু বলতে টাকা আয় কিংবা ভালো কোনো কাজ শেখার অভিপ্রায়।
বাস্তবতা বড় নির্মম। গ্রাম ছেড়ে যে ছেলেটা থানা সদরে এল পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু করবে বলে সে এখানে তার স্বীয় অস্তিত্ব টিকানোর শংকায় ভুগছে। তবুও পরিচিতজনদের সহায়তায় দু'একটা টিউশনি করিয়ে পড়া শুনা চালিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারছেনা বলে মনটা সর্বদা খারাপ থাকে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ৩মাস আগে বাড়িওয়ালা বাড়ির কাজ করাবে বলে বাসা ছেড়ে দিতে বলায় তিতুমীর চিন্তায় পড়ে গেল। এসময় এত অল্প দামে বাসা কোথায় পাবে, কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছেনা, এমন সময় তার বন্ধু জাফর তাকে একটা জাগির (লজিং) এর ব্যাবস্থা করে দিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপায় নেই বলে তিতুমীর লজিং থাকার জন্য রাজি হয়ে গেল।
সকাল সন্ধ্যা ছাত্র পড়িয়ে নিজে কোনো রকম প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করল। পরীক্ষা শেষে বন্ধুরা সবাই যে যার সুবিধা মত ঢাকা, চট্টগ্রাম গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এ ভর্তি হয়ে গেল। তিতুমীর সাহস করে যেতে পারেনি শুধুমাত্র আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। সে গ্রামে থেকেই একটু একটু করে পড়ে প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্ত অভাবের ঘরে তিতুমীর পড়ায় সেভাবে মনোযোগী হতে পারতোনা। তাই গ্রামেই বেশ কয়েকটা টিউশনি শুরু করলো। টিউশনি আর খেলাধুলার সময়টাই তিতুমীরের বাহিরে ভালোই কাটত। ঘরে এলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত অজানা কারণে।
অপর্যাপ্ত চেষ্টায় অকৃতকার্য তিতুমীর কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ অর্জন করতে পারেনি।
চরম অসুস্থতার কারণে সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সে ভর্তি ফরমটা নিতে পারেনি। তখন সে কিছু মানুষের আসল চেহারা চিনেছে। অনেককে বলেও সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমটা নিতে পারেনি। ফলে মানসিকভাবে তিতুমীর ভেংগে পড়ে।
পড়াশুনার প্রতি চরম ইচ্ছা থাকায় তিতুমীর বছর লস না করে ওই বছরই কাউকে না জানিয়ে ডিগ্রীতে (পাস কোর্স) ভর্তি হল।
গ্রাম থেকে চলে এলো জেলা সদরে পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু করবে বলে। এসে একটা মেসে উঠল সে। ৫০০টাকা সীট ভাড়া। মেসের বড় ভাই ৫০০টাকার একটা টিউশিনি ঠিক করে দিল। সীট ভাড়ার ব্যাবস্থা হল, কিন্তু খাবে কি! তখন ওই বড় ভাই ই একটা লজিং এর ব্যাবস্থা করে দেয়। যেখানে ৪জন ছাত্রী পড়ানোর বিপরীতে ২ বেলা খাওয়াবে।
নিজের থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করতেই যেখানে তিতুমীর এর দিন শেষ, সেখানে সে কিভাবে পরিবারের জন্য কিছু করবে!
এমন কিছু কাজ শিখতে চায় তিতুমীর যা দিয়ে আয় করা যাবে, একসময় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। সে অবসর সময়ে ঘুরে ফিরে জেলা সদরে শিখার মত কাজ খুঁজে। কিন্তু কাজ শিখতে গেলে এক জায়গায় এক শর্ত কিংবা বাঁধা তাকে পিছু হটতে বাধ্য করে। শর্ত কিংবা বাঁধা গুলো এই রকম যে, কোথাও কোর্স ফী অনেক, কোথাও সারাদিন কাজ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিতুমীর ভাবে "কাজ শিখতে হলে বাড়ি থেকে টাকা আনতে হবে, যা সম্ভব নয়।"
আয় বাড়ানোর জন্য একটা সময় তিতুমীর টিউশনির পাশাপাশি একটা শো রুমে পার্ট টাইম জব নেয়।
টিউশনি, জব আর চিন্তা করার ফাঁকেফাঁকে স্নাতক(পাস কোর্স) সম্পন্ন করল তিতুমীর।
এবারতো স্নাতক পাশের সনদ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকুরীর জন্য আবেদন করা যাবে, এই ভেবে একটু ভালো লাগা কাজ করলো তিতুমীরের। কিন্তু সহজ সরল তিতুমীর জানেনা যে, চাকুরীর বাজারে নিজেকে বিক্রি করা কতটা কষ্টসাধ্য কাজ!
টাকা খরচ করে সে চাকুরীর আবেদন করে, পরীক্ষা দেয়ার জন্য ঢাকা যায়। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছেনা তিতুমীরের। পরীক্ষা ভাল দেয় কিন্তু সে পরীক্ষা গুলোর রেজাল্ট আর হয়না।
এবারতো কিছু একটা করতে পারবো কিংবা করতে হবেই এই আশায় তিতুমীর ঢাকায় মাস্টার্সে ভর্তি হয়। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের রেফারেন্সে প্রাইভেট একটা প্রতিষ্ঠানে সে একটা চাকুরীতে যোগদান করে নাম মাত্র বেতনে, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এখানে তিতুমীরের ডিউটি শুরু হয় সকাল ৮টায় কিন্তু শেষ হওয়ার নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। কখনো রাত ৯টায় কখনো রাত ২টা ৩টাও বাজতো। বেশ কয়েকবারতো পরেরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত টানা ২৪ঘন্টাও কাজ করতে হত। বেতন পেতনা মাস শেষ হলেও, অথচ এই তিতুমীর নিজ হাতেই কারখানার সব কর্মীদের ১০তারিখের মধ্যে বেতন দিত। তখন তিতুমীরের নিজের জন্য খুব খারাপ লাগতো। চাকুরী করে, বেতন পায়না, পেট আর পকেট চলে বন্ধুদের থেকে নেয়া ধারের টাকায়। ২বছর চাকুরী শেষে তিতুমীর যখন চাকুরী ছাড়ে তখন সে ওই প্রতিষ্ঠানে প্রায় লাখ খানেক টাকা পাওনা হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ওর থাকা খাওয়া বাবদ টকা কাটার পরও তিতুমীর প্রায় ৪৯হাজার টাকা পায় কিন্তু পরে দিবে পরে দিবে বলে টাকা গুলো আর দেয়নি।
ছেলেটা একটা গর্দভ, বোকা, মাত্রাতিরিক্ত সুহজ সরল।তবে অনেক ভালো, সৎ এবং নিষ্ঠাবান।
এর মাঝে মাস্টার্সের প্রিলি শেষ করল। ভর্তি হল মাস্টার্স ফাইনাল এর জন্য।এক বছরের মাস্টার্সের কোর্স ৪বছরের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে শেষ হল। না, এটা তিতুমীরের ব্যার্থতা নয়, এটা এ দেশের রাষ্ট্র এবং শিক্ষা ব্যাবস্থার ব্যার্থতা। ঢাকার ৭টা সরকারি কলেজকে হুটহাট করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে এল। যার ভুক্তভোগী তিতুমীরের মত হাজার হাজার তিতুমীর।
ভালো একটা চাকুরীর জন্য নিজ সাধ্যমত তিতুমীর তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আগের চাকুরীটা ছেড়ে দেয়ার পরের দিনই ভিন্ন ট্র্যাকের অন্য একটা চাকুরীতে যোগদান করে তিতুমীর। এখানেও বেতন অনেক কম, যা দিয়ে কোনোমতে তার থাকা খাওয়া চলবে। এখানে ১তারিখেই বেতন পায়, সপ্তাহে দুদিন ছুটি, অফিস টাইম সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত। বাকী সময়টাতে সে ব্যাংক জব এবং বিসিএস এর জন্য পড়তে পারবে এরকমটা ভেবে অল্প বেতনেও সে এখানে সন্তুষ্ট।
পড়ছে, অফিস করছে, চাকুরীর পরীক্ষা দিচ্ছে, পরীক্ষাও ভালো হচ্ছে কিন্তু ভাইভার ঢাক পাচ্ছেনা কোথাও থেকে। এভাবেই চলছে। মাঝে মাঝে যখন বাড়িতে মা বাবা ভাই বোনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য তিতুমীর ফোন দেয় তখন অভাব আর টানাপোড়নের কথা শুনলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। পড়ায় আর মন বসাতে পারেনা। ভাবনা জুড়ে শুধু কিভাবে বেশি টাকা আয় করা যায় এই চিন্তা ঘুরপাক খায়। অশান্ত মস্তিষ্ক একসময় দেহ মনকে নিস্তেজ করে ফেলে।
তিতুমীর বুঝতে পারে যে তাকে অনেক পড়তে হবে ভালো একটা ভবিষ্যৎ পেতে হলে, আবার ঠিক এই মুহুর্তে তাকে অনেক টাকা আয়ও করতে হবে পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য। দুটো একসাথে করতে গিয়ে তিতু কোনোটাই ভালোভাবে করতে পারছেনা।
অফিস শেষে সে এখন ২টা টিউশনি করে। বাসায় যখন ফিরে তখন রাত সাড়ে ৯টা বাজে। ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে সে যখন পড়তে বসে তখন বাজে সাড়ে ১০টা। সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সে পড়াশুনা করে। ১টা বাজার কিছুক্ষণ আগে সে শোয়। একটা কথা বলাই হয়নি। তিতুমীরের খুব ভালো একজন মনের মানুষ আছে। যে তাকে সবসময় উৎসাহ দেয়। সাহস যোগায়। রাত ১টার দিকে তার সাথে সে চ্যাট করে অথবা কিছুক্ষন কথা বলে। মাঝে মাঝে রাগ অভিমান হয় ওদের। কিন্তু ইদানিং বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে ওদের মাঝে। ফ্যামিলির চাপে পড়ে তার মনের মানুষ তাকে চাপ দিচ্ছে। ওরা দুজনই একই বয়সের। একই সাথে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। তারা একজন অন্যজনের সমস্যা বুঝে, কিন্তু সমাজ আর বাস্তবার মুখোমুখি হয়ে এই একটা বিষয় নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়।
প্রিয় মানুষটির সাথে কথা কিংবা চ্যাট শেষে তিতুমীর ঘড়িতে ২টা এলার্ম সেটিং করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। একটা ফজরের নামাজের জন্য অন্যটা অফিসের জন্য। ইদানিং প্রায় সময়ই ওর ঘুম আসার আগেই এলার্ম বেজে উঠে।
তিতুমীর কিছু একটা করবে! একদিন তিতুমীরের পক্ষে সফলতার রক্তিম সূর্য উদিত হবে, তিতুমীর এটা জানে এবং সেই শুরু থেকে বিশ্বাস করে আসছে।
বৈশাখী ঝড়, বজ্রের ভয়ানক গর্জন এবং নিকষ কালো মেঘ ভেদ করে কবে সে সূর্যের আত্ম প্রকাশ ঘটবে তিতুমীরের ভাগ্যে।
অপেক্ষায়ই একমাত্র সহায় এখন তিতুমীরের।
তিতুমীর ভাবে "সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ এই দেশে আমার মত তিতুমীরদের সফলতার সূর্য উদিত হওয়ার আগেই হয়তো বনানীর এফ আর টাওয়ার কিংবা চকবাজারের মত আকস্মিক কোনো অগ্নিকান্ডে, হয়তো আবরারদের মত বাস কিংবা ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আগেই জীবনটাই মিথ্যে হয়ে যেতে পারে।"
তবুও জীবনের জন্য, ভালোবাসা গুলোর জন্য, সুন্দর আগামীর জন্য কিছু একটা করার স্বপ্ন বুনেই যাচ্ছে তিতুমীরেরা।
বাস্তবতা বড় নির্মম। গ্রাম ছেড়ে যে ছেলেটা থানা সদরে এল পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু করবে বলে সে এখানে তার স্বীয় অস্তিত্ব টিকানোর শংকায় ভুগছে। তবুও পরিচিতজনদের সহায়তায় দু'একটা টিউশনি করিয়ে পড়া শুনা চালিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারছেনা বলে মনটা সর্বদা খারাপ থাকে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ৩মাস আগে বাড়িওয়ালা বাড়ির কাজ করাবে বলে বাসা ছেড়ে দিতে বলায় তিতুমীর চিন্তায় পড়ে গেল। এসময় এত অল্প দামে বাসা কোথায় পাবে, কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছেনা, এমন সময় তার বন্ধু জাফর তাকে একটা জাগির (লজিং) এর ব্যাবস্থা করে দিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপায় নেই বলে তিতুমীর লজিং থাকার জন্য রাজি হয়ে গেল।
সকাল সন্ধ্যা ছাত্র পড়িয়ে নিজে কোনো রকম প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করল। পরীক্ষা শেষে বন্ধুরা সবাই যে যার সুবিধা মত ঢাকা, চট্টগ্রাম গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এ ভর্তি হয়ে গেল। তিতুমীর সাহস করে যেতে পারেনি শুধুমাত্র আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। সে গ্রামে থেকেই একটু একটু করে পড়ে প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্ত অভাবের ঘরে তিতুমীর পড়ায় সেভাবে মনোযোগী হতে পারতোনা। তাই গ্রামেই বেশ কয়েকটা টিউশনি শুরু করলো। টিউশনি আর খেলাধুলার সময়টাই তিতুমীরের বাহিরে ভালোই কাটত। ঘরে এলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত অজানা কারণে।
অপর্যাপ্ত চেষ্টায় অকৃতকার্য তিতুমীর কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ অর্জন করতে পারেনি।
চরম অসুস্থতার কারণে সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সে ভর্তি ফরমটা নিতে পারেনি। তখন সে কিছু মানুষের আসল চেহারা চিনেছে। অনেককে বলেও সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমটা নিতে পারেনি। ফলে মানসিকভাবে তিতুমীর ভেংগে পড়ে।
পড়াশুনার প্রতি চরম ইচ্ছা থাকায় তিতুমীর বছর লস না করে ওই বছরই কাউকে না জানিয়ে ডিগ্রীতে (পাস কোর্স) ভর্তি হল।
গ্রাম থেকে চলে এলো জেলা সদরে পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু করবে বলে। এসে একটা মেসে উঠল সে। ৫০০টাকা সীট ভাড়া। মেসের বড় ভাই ৫০০টাকার একটা টিউশিনি ঠিক করে দিল। সীট ভাড়ার ব্যাবস্থা হল, কিন্তু খাবে কি! তখন ওই বড় ভাই ই একটা লজিং এর ব্যাবস্থা করে দেয়। যেখানে ৪জন ছাত্রী পড়ানোর বিপরীতে ২ বেলা খাওয়াবে।
নিজের থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করতেই যেখানে তিতুমীর এর দিন শেষ, সেখানে সে কিভাবে পরিবারের জন্য কিছু করবে!
এমন কিছু কাজ শিখতে চায় তিতুমীর যা দিয়ে আয় করা যাবে, একসময় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। সে অবসর সময়ে ঘুরে ফিরে জেলা সদরে শিখার মত কাজ খুঁজে। কিন্তু কাজ শিখতে গেলে এক জায়গায় এক শর্ত কিংবা বাঁধা তাকে পিছু হটতে বাধ্য করে। শর্ত কিংবা বাঁধা গুলো এই রকম যে, কোথাও কোর্স ফী অনেক, কোথাও সারাদিন কাজ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিতুমীর ভাবে "কাজ শিখতে হলে বাড়ি থেকে টাকা আনতে হবে, যা সম্ভব নয়।"
আয় বাড়ানোর জন্য একটা সময় তিতুমীর টিউশনির পাশাপাশি একটা শো রুমে পার্ট টাইম জব নেয়।
টিউশনি, জব আর চিন্তা করার ফাঁকেফাঁকে স্নাতক(পাস কোর্স) সম্পন্ন করল তিতুমীর।
এবারতো স্নাতক পাশের সনদ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকুরীর জন্য আবেদন করা যাবে, এই ভেবে একটু ভালো লাগা কাজ করলো তিতুমীরের। কিন্তু সহজ সরল তিতুমীর জানেনা যে, চাকুরীর বাজারে নিজেকে বিক্রি করা কতটা কষ্টসাধ্য কাজ!
টাকা খরচ করে সে চাকুরীর আবেদন করে, পরীক্ষা দেয়ার জন্য ঢাকা যায়। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছেনা তিতুমীরের। পরীক্ষা ভাল দেয় কিন্তু সে পরীক্ষা গুলোর রেজাল্ট আর হয়না।
এবারতো কিছু একটা করতে পারবো কিংবা করতে হবেই এই আশায় তিতুমীর ঢাকায় মাস্টার্সে ভর্তি হয়। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের রেফারেন্সে প্রাইভেট একটা প্রতিষ্ঠানে সে একটা চাকুরীতে যোগদান করে নাম মাত্র বেতনে, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এখানে তিতুমীরের ডিউটি শুরু হয় সকাল ৮টায় কিন্তু শেষ হওয়ার নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। কখনো রাত ৯টায় কখনো রাত ২টা ৩টাও বাজতো। বেশ কয়েকবারতো পরেরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত টানা ২৪ঘন্টাও কাজ করতে হত। বেতন পেতনা মাস শেষ হলেও, অথচ এই তিতুমীর নিজ হাতেই কারখানার সব কর্মীদের ১০তারিখের মধ্যে বেতন দিত। তখন তিতুমীরের নিজের জন্য খুব খারাপ লাগতো। চাকুরী করে, বেতন পায়না, পেট আর পকেট চলে বন্ধুদের থেকে নেয়া ধারের টাকায়। ২বছর চাকুরী শেষে তিতুমীর যখন চাকুরী ছাড়ে তখন সে ওই প্রতিষ্ঠানে প্রায় লাখ খানেক টাকা পাওনা হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ওর থাকা খাওয়া বাবদ টকা কাটার পরও তিতুমীর প্রায় ৪৯হাজার টাকা পায় কিন্তু পরে দিবে পরে দিবে বলে টাকা গুলো আর দেয়নি।
ছেলেটা একটা গর্দভ, বোকা, মাত্রাতিরিক্ত সুহজ সরল।তবে অনেক ভালো, সৎ এবং নিষ্ঠাবান।
এর মাঝে মাস্টার্সের প্রিলি শেষ করল। ভর্তি হল মাস্টার্স ফাইনাল এর জন্য।এক বছরের মাস্টার্সের কোর্স ৪বছরের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে শেষ হল। না, এটা তিতুমীরের ব্যার্থতা নয়, এটা এ দেশের রাষ্ট্র এবং শিক্ষা ব্যাবস্থার ব্যার্থতা। ঢাকার ৭টা সরকারি কলেজকে হুটহাট করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে এল। যার ভুক্তভোগী তিতুমীরের মত হাজার হাজার তিতুমীর।
ভালো একটা চাকুরীর জন্য নিজ সাধ্যমত তিতুমীর তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আগের চাকুরীটা ছেড়ে দেয়ার পরের দিনই ভিন্ন ট্র্যাকের অন্য একটা চাকুরীতে যোগদান করে তিতুমীর। এখানেও বেতন অনেক কম, যা দিয়ে কোনোমতে তার থাকা খাওয়া চলবে। এখানে ১তারিখেই বেতন পায়, সপ্তাহে দুদিন ছুটি, অফিস টাইম সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত। বাকী সময়টাতে সে ব্যাংক জব এবং বিসিএস এর জন্য পড়তে পারবে এরকমটা ভেবে অল্প বেতনেও সে এখানে সন্তুষ্ট।
পড়ছে, অফিস করছে, চাকুরীর পরীক্ষা দিচ্ছে, পরীক্ষাও ভালো হচ্ছে কিন্তু ভাইভার ঢাক পাচ্ছেনা কোথাও থেকে। এভাবেই চলছে। মাঝে মাঝে যখন বাড়িতে মা বাবা ভাই বোনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য তিতুমীর ফোন দেয় তখন অভাব আর টানাপোড়নের কথা শুনলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। পড়ায় আর মন বসাতে পারেনা। ভাবনা জুড়ে শুধু কিভাবে বেশি টাকা আয় করা যায় এই চিন্তা ঘুরপাক খায়। অশান্ত মস্তিষ্ক একসময় দেহ মনকে নিস্তেজ করে ফেলে।
তিতুমীর বুঝতে পারে যে তাকে অনেক পড়তে হবে ভালো একটা ভবিষ্যৎ পেতে হলে, আবার ঠিক এই মুহুর্তে তাকে অনেক টাকা আয়ও করতে হবে পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য। দুটো একসাথে করতে গিয়ে তিতু কোনোটাই ভালোভাবে করতে পারছেনা।
অফিস শেষে সে এখন ২টা টিউশনি করে। বাসায় যখন ফিরে তখন রাত সাড়ে ৯টা বাজে। ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে সে যখন পড়তে বসে তখন বাজে সাড়ে ১০টা। সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সে পড়াশুনা করে। ১টা বাজার কিছুক্ষণ আগে সে শোয়। একটা কথা বলাই হয়নি। তিতুমীরের খুব ভালো একজন মনের মানুষ আছে। যে তাকে সবসময় উৎসাহ দেয়। সাহস যোগায়। রাত ১টার দিকে তার সাথে সে চ্যাট করে অথবা কিছুক্ষন কথা বলে। মাঝে মাঝে রাগ অভিমান হয় ওদের। কিন্তু ইদানিং বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে ওদের মাঝে। ফ্যামিলির চাপে পড়ে তার মনের মানুষ তাকে চাপ দিচ্ছে। ওরা দুজনই একই বয়সের। একই সাথে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। তারা একজন অন্যজনের সমস্যা বুঝে, কিন্তু সমাজ আর বাস্তবার মুখোমুখি হয়ে এই একটা বিষয় নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়।
প্রিয় মানুষটির সাথে কথা কিংবা চ্যাট শেষে তিতুমীর ঘড়িতে ২টা এলার্ম সেটিং করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। একটা ফজরের নামাজের জন্য অন্যটা অফিসের জন্য। ইদানিং প্রায় সময়ই ওর ঘুম আসার আগেই এলার্ম বেজে উঠে।
তিতুমীর কিছু একটা করবে! একদিন তিতুমীরের পক্ষে সফলতার রক্তিম সূর্য উদিত হবে, তিতুমীর এটা জানে এবং সেই শুরু থেকে বিশ্বাস করে আসছে।
বৈশাখী ঝড়, বজ্রের ভয়ানক গর্জন এবং নিকষ কালো মেঘ ভেদ করে কবে সে সূর্যের আত্ম প্রকাশ ঘটবে তিতুমীরের ভাগ্যে।
অপেক্ষায়ই একমাত্র সহায় এখন তিতুমীরের।
তিতুমীর ভাবে "সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ এই দেশে আমার মত তিতুমীরদের সফলতার সূর্য উদিত হওয়ার আগেই হয়তো বনানীর এফ আর টাওয়ার কিংবা চকবাজারের মত আকস্মিক কোনো অগ্নিকান্ডে, হয়তো আবরারদের মত বাস কিংবা ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আগেই জীবনটাই মিথ্যে হয়ে যেতে পারে।"
তবুও জীবনের জন্য, ভালোবাসা গুলোর জন্য, সুন্দর আগামীর জন্য কিছু একটা করার স্বপ্ন বুনেই যাচ্ছে তিতুমীরেরা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সুপ্রিয় কুমার চক্রবর্তী ১৩/০৫/২০১৯আত্মবিশ্বাসী গল্পের বুনন ! এভাবেই নায়করা এগিয়ে যায় !
-
আব্দুল হক ১৬/০৪/২০১৯ধন্যববাদ!
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৫/০৪/২০১৯ভালো্