অভিমান এবং সম্পর্ক
অবন্তি আর আনিস, প্রেমিক যুগলের নাম। ভালোই চলছে ওদের। অনেক দিনের নয় বরং অনেক বছরের সম্পর্ক । সম্পর্ক কি এবং কি ভাবে টিকে থাকে, বন্ধু এবং পরিচিতমহল ওদের দিকে ইংগিত দিয়ে শব্দ দুটির সংজ্ঞা খুঁজে পায় কিংবা নেয়। ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে অবগত যারা তারা সবাই ওদের খুব প্রশংসা করে।
সম্পর্কের এতগুলো বছরে তাদের বর্তমান অবস্থা সবাই ভালো জানলেও আলাদা আলাদা করে ওদের দুজনেরই মনের ভাবনা এক যে, "সম্পর্কটা আর আগের মত নেই।"
যে কোন সম্পর্কে সন্দেহ নামক ভাইরাসটা খুবই কমন একটা ইস্যু। আনিস আর অবন্তির মাঝে সে ভাইরাসটা নেই।
আনিস ব্যস্ততা কিংবা ঝামেলার জন্যে মাঝে মাঝে যথা সময়ে অবন্তির খোজ-খবর নিতে পারেনা। অনেক সময় ইচ্ছে করেই ফ্রি সময়ে অবন্তির সাথে যোগাযোগ না করে হাতের কাজটা শেষ করে নেয়। এক্ষেত্রে আনিস এর যুক্তি- "কয়েক মিনিটের ফ্রি সময় আমার জন্য যথেষ্ট নয় ওর সাথে যোগাযোগ করার জন্য, তাছাড়া তখন মাইন্ডটাও রিলাক্স থাকেনা, কথা বললে প্রশান্তির বিপরীতে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। ওর সাথে রিলাক্স মোডে আন্তরিক হয়ে মধুর কথা হবে। তাহলে অবন্তিও খুশি থাকলো, আমিও শান্ত থাকলাম।"
আনিস যথা সময়ে যোগাযোগ রাখছেনা। সারাদিনে একটুর জন্যও খোজ নিচ্ছেনা এ জন্য অবন্তির মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, আউলা-বাউলা চিন্তা ভাবনা শুরু করে। অবন্তি ভাবে আনিস ইচ্ছে করেই খোজ নিচ্ছেনা, ভাব দেখাচ্ছে, ওর কাছে বুঝি আমার মূল্য ফুরিয়ে আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ভাবে আর মাঝে মাঝে দু একটা টেক্স করে ফেবুতে, যার ভাষা থাকে খুবই কঠিন।
আনিস টেক্স গুলো নোটিফিকেশনেই দেখে পড়ে নেয়, সীন করার প্রয়োজন হয়না। টেক্স গুলো পড়ে আনিস হাসে। কেও বুঝেনা এ হাসি বিরক্তির নাকি সুখের। আনিস তাৎক্ষণিক কোনো রিপ্লাই দেয়না। এক্ষেত্রেও আনিস মুক্ত সময় খুজে।
রোমান্টিক কথা বার্তার ছেয়ে ওদের মাঝে সব সময় টম এন্ড জেরি টাইপ একটা ঝগড়া লেগেই থাকে। দুজনের জায়গা থেকে কারোরই দোষ নেই।
অবন্তির কিছু পছন্দের ব্যাপার যা আনিস পছন্দ করেনা। আবার আনিসের কিছু পছন্দের বিষয় যা অবন্তি মেনে নিতে পারেনা।
শুরুর দিকে অবন্তির ব্যাপারে আনিসের অনেক অভিযোগ ছিল এবং প্রতিনিয়ত সে অবন্তিকে তা মনে করিয়ে দিত। অবন্তি খুব বিরক্ত হয়েও চেষ্টা করত সেসব মেনে চলতে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছিলনা।
ব্যাপারটা আনিস একটু দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিল এবং অবন্তিকে বলেছিল, "যেটা মন থেকে না আসে তা করার বৃথা চেষ্টা আর কোরোনা। এতে করে তুমি যেমন সুখ পাচ্ছোনা তেমনি আমিওনা।" তবুও আনিস ভেবেছিল অবন্তি ওর পছন্দ অপছন্দ মেনে চলার চেষ্টা করবে।
অবন্তি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে মূল্যায়নের চেষ্টা করছিল আনিসের পছন্দ অপছন্দকে। কিন্তু কিছুদিন পর সব আগের মত হয়ে যাচ্ছে অবন্তির।
এখনো প্রতিদিন কথা হয়। যখন তখন না। শুধু রাতে। রাত ১২টার আগে ওরা কথা শুরু করতে পারেনা। কারণ অবন্তির রুম মেইটরা না ঘুমালে অবন্তি কথা বলতে পারেনা। মেয়ে গুলো শুধু শুধু ডিস্টার্ব করে। আনিস অফিস শেষ করে বাসায় ফিরে রাত ৯টায়। এসে একটু রেস্ট নেয়, কখনো আবার বুয়া না এলে রান্না করতে হয়। অত:পর খেয়ে দেয়ে পড়াশুনা করার একটু ব্যার্থ চেষ্টা করে, যে চেষ্টা ফেইসবুকে গিয়ে থামে। এরপর অবন্তির জন্য অপেক্ষা।
অবন্তি সারাদিনই বাসায় ফ্রি থাকে। সন্ধার পর দুটা টিউশনি করে। বাসায় ফিরে রাত সাড়ে ৯টায়। এসে রুমমেইট বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেয়, মা বোনের সাথে ফোনে কথা বলে। ফেইসবুকে আসে। আনিস কেমন আছে, বাসায় আসছে কিনা এসব জানতে চেয়ে আনিসকে মেসেঞ্জারে টেক্স করে। আনিস অনলাইনে থাকলে হয়ত রিপ্লাই দেয়।
রাত ১২টা বেজে ২১ মিনিট। ফোনে রিং হচ্ছে আনিস ধরছেনা। এদিকে অবন্তি একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছে। খুব বিরক্ত হচ্ছে অবন্তি। আনিসের মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। আনিস অনলাইনে একটা জব এপ্লিকেশন ফরম ফিলাপ করছিল।
আনিস বিছানা ঘুছিয়ে শুয়ে অবন্তিকে কল ব্যাক করল। তিনবার কল দেয়ার পর অবন্তি রিসিভ করলো।
আনিসঃ কেমন আছো?
অবন্তিঃ ভালো আছি। তুমি?
আনিসঃ ভালো। আচ্ছা অবন্তি কয়বার কল দেয়ার পর রিসিভ করেছো?
অবন্তিঃ জানিনা। কেনো কোনো সমস্যা?
আনিস বুঝতে পারলো রিপ্লাই বুঝে শুনে দিতে হবে নয়তো কালবৈশাখী হতে পারে।
অবন্তিঃ কি ব্যাপার চুপ কেনো??
আনিসঃ না কোনো সমস্যা না। এমনি। খেয়েছো?
অবন্তিঃ সেটা জেনে তোমার কি?
উদ্ভট রিপ্লাই শুনে আনিসের খিটখিটে মেজাজ আরো উত্তেজিত হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
আনিসঃ মানে?
অবন্তিঃ কিসের মানে?
আনিসঃ প্রশ্ন করেছি, উত্তর না দিয়ে উলটা কথা বললে কেনো?
অবন্তিঃ বুঝোনা?
আনিসঃ কি বুঝতাম?
অবন্তিঃ এখন কয়টা বাজে দেখছোস?
আনিসঃ ১২টা ৫০।
অবন্তিঃ তোরে ফোন দিচ্ছিলাম কয়টা থেকে?
এবার আনিস একটু চওড়া গলায় বলল-
আনিসঃ যখন কল রিসিভ করছিনা তখন বুঝে নিতে পারোনা কেনো যে আমি ব্যস্ত আছি। ফ্রি হয়েতো ফোন দিবোই। এত অস্থির হয়ে যাও কেনো? সমস্যা কি তোমার? তুমি কি আমায় বুঝবেনা?
অবন্তিঃ আমারতো কমন সেন্সের অভাব!
আনিসঃ ধ্যাত্ আমি কি তা বলেছি নাকি? আজিব।
অবন্তিঃ এখন বলতে হবে কেনো আগেইতো বলেছো।
আনিসঃ ওহহো অবন্তি! ভাল্লাগছেনা এত রাতে ঝগড়া করতে। প্লিজ।
অবন্তিঃ আমিতো ঝগড়াইট্টা। ঝগড়াতো আমিই করি। সারাদিন আশায় থাকি এই মুহূর্তটার। তোমার সাথে কথা বলার জন্য। আর তার প্রতিদান প্রতিদিনই পাই এইরকম করে।
আনিসঃ আরে আজিব! আমি কি এমন খারাপ প্রতিদান দিলাম। প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা কর।
অবন্তিঃ কি বুঝব? কি বুঝাতে চাও? আমার ভালো কেও চায়না।
আনিসঃ আরে ভাই ন্যাকামি ছাড়ো
ভাল্লাগেনা।
অবন্তিঃ অই ন্যাকামি কারে কয় বুঝস?
আনিসঃ বুঝি বলেই বলেছি।
অবন্তিঃ ৮/১০টা মাইয়ার মত ন্যাকামি যদি দেখাইতাম তুইতো পাগল হইয়া যাইতি। ন্যাকামি ন্যাকামি করবিনা। অসহ্য লাগে।
আনিসঃ অকে বলবোনা।
অবন্তিঃ আর কিছু কইবি?
আনিসঃ কেনো? রেখে দিবে?
অবন্তিঃ অনেক রাত হইছে।
আনিসঃ তো? এ আর নতুন কি?
দুজনই চুপ। একের কানে অপরের নিখুঁত নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে। প্রায় ৫ থেকে ৮ মিনিট চুপ। অবন্তি চাচ্ছে ভালো করে আবার কথা স্টার্ট করতে, হ্যালো বলতে চেয়েও পারছেনা। তাই ইচ্ছে করই চুপ থাকছে। অবন্তি চাচ্ছে আনিস আগে কথা বলবে। আনিসের সিক্স সেন্স খুব ভালো। তাই সে বিষয়টা বুঝতে পারে সবসময়ই। তাই সে নিরবতা ভেংগে এক নিশ্বাসে কিছুক্ষন কথা বলে যায়। তারপর আবার কথা হয় দুজনের মাঝে। রিলেশনের কথা। রোমান্টিক কথা। সংসার বাধার স্বপ্নের কথা।
যতবারই দুজনের কথা হবে ততবারই ঝগড়া হবে। ঝগড়া শেষে আবার রোমান্টিকও হয়ে যেতে পারে ওরা। কিন্তু ইদানিং ঝগড়া বাধলে তা মিমাংসার আগে দুজনেই লাইন কেটে দেয়। রাগ করে কেও আগে ফোন ব্যাক করতে চায়না। আগে অবন্তি রাগ করে লাইন কেটে দিলে অবন্তি ফোন রিসিভ করা পর্যন্ত আনিস ১০০বার ২০০বার ফোন দিত।
এখন আনিস ক্লান্ত। আনিসের মনে হয়, " সব সময় আমাকেই কেনো আগে কল দিতে হবে? আমাকেই কেনো রাগ ভাঙাতে হবে? আমার প্রতি ওর কি কোনো রেসপন্সিবিলিটি নেই? রাগ দেখাবে, মেজাজ দেখাবে, কথার মাঝে লাইন কেটে দিবে! আর আমাকেই তোষামোদ করতে হবে??
এবার আমি চুপ করে থাকি, দেখি ও কি রিএকশন দেখায়!!"
প্রতিবার ঝগড়ার শেষেই অবন্তির মন্টা ভেংগে চুরমার হয়ে যায়। নিরব হিয়ে যাও। খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চিন্তা ভাবনার সমস্তটা জুড়ে শুধু আনিস। অবন্তি ভাবে, "আনিস আগের মত নেই। কেয়ারলেস হয়ে গেছে, আমার রাগ-অভিমান ওকে আর ভাবায়না, আমার সাথে যোগাযোগ না করে থাকতে পারলেই ও ভালো থাকে। দেখি কতদিন পারে আমাকে ফোন এসএমএস না দিয়ে থাকতে।"
এভাবেই ঝগড়া-ঝাটি, মান-অভিমান চলতে থাকে। ২৪ ঘন্টার মাঝেই হয় অবন্তি না হয় আনিস ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। কিন্তু আবার শুরু হয়।
ক্যারিয়ার, ফ্যামিলি, বিয়ে, অফিস আর দুজনের মাঝের প্রতিদিনের বুঝা বুঝির ভুলের দ্বন্দ্বে দুজনের মেজাজ এখন খিটখিটে থাকে। এখন ঝগড়া হলেই দুজনে ভাবে "এবার ব্রেকে যাওয়া উচিত।"
কিন্তু কেউ কাউকে বলার সাহস হয়না, কারণ অবন্তির চোখে আনিসের মত ভালো মনের মানুষ হয়না, আনিস অনেক কেয়ারফুল। অন্যদিকে আনিসের কাছে অবন্তির চেয়ে লক্ষি মেয়ে আর একটাও হয়না। অবন্তিকে হারাতে চায়না আনিস।
অবন্তি আনিসের সম্পর্কের কথা দুজনেরই মা বাবা না জানার মত করে জানে। অবন্তির মা বাবা দুজনেই আনিসকে খুব পছন্দ করত।
যখন অবন্তির বাবা অবন্তির বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করল, তখন আনিস অবন্তির বাবাকে বুঝাতে চেয়েছিল শুধু যে, ও অবন্তিকে পছন্দ করে। অবন্তির বাবা আনিসকে ডেকে নিয়ে বুঝালো যে, "দেখো বাবা, আমি জানি তুমি খুব ভালো ছেলে, অবন্তিও তোমাকে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু আমি চাইনা তোমাদের বিয়ে হউক। তুমি চাকুরি বাকরি করো, সংসারের হাল ধর, বয়সের হিসেবে যদিও তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে, তবে পারিপার্শ্বিক সব মিলিয়ে তোমার বিয়ের বয়স এটা না। তোমার করার এখনো অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। তুমি সংসারের বড়, তোমার ছোট আরো চারজন আছে। বোনের বিয়ের বয়স হয়েছে, বোনকে বিয়ে দাও, আমরা আছি দেখব। তোমার জন্য দোয়া থাকবে সব সময়। আর শুনো এ বিষয়ে তোমার কোনো মতামত শুনতে চাইনা এবং আমিও এর পরে এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে চাইনা। বললে তা শুনতে তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।"
আনিস অনিচ্ছা সত্ত্বেও অষুধ সেবনের ন্যায় জলিল সাহেবের সব কথা গিলেছে । খুব জিদ হচ্ছে অবন্তির বাবার উপর। কথা গুলো শুনার পর আনিসের মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর অর্ধেক এখন তার মাথার উপর। বসা থেকে উঠে দাড়াতে গিয়ে পড়ে যেতে লাগলো, কিন্তু না পড়ে জলিল সাহেবের সামনে থেকে দ্রুত পায়ে হেটে বেরিয়ে গেল।
রাত ১টা বাজে। কেউ কাওকে ফোন দিচ্ছেনা। সন্ধ্যা থেকে আনিস খোজ নেয়নি দেখে অবন্তি অভিমান করে ফোন দিচ্ছেনা। অন্য দিকে আনিসের মন মেজাজ দুটোই খারাপ সন্ধ্যায় অবন্তির বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে। এদিকে অবন্তি কিছুক্ষন পর পর মোবাইল হাতে নিয়ে দেখছে কিন্তু আনিস লাপাত্তা।
দুদিন হয়ে গেল আনিসের খোজ নেই। এদিকে অবন্তির বিয়ের ডেট ফাইনাল। মানুষিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছে অবন্তি। অবন্তির মা অবন্তিকে বুঝাচ্ছে, "দেখ মা এভাবে কান্না কাটি করিসনা। দুদিনপর তোর বিয়ে। খেয়ে নে প্লিজ।"
অবন্তিঃ দুদিন পর আমার লাশের বিয়ে দিও।
মাঃ কি যা তা বলছিস।
অবন্তিঃ মা তুমি যাও এখান থেকে।
মাঃ দেখ মা তুই এমন করলে আমি ভালো থাকতে পারছিনা।
অবন্তিঃ মা আমিও ভালো থাকতে পারছিনা। পারলে আমাকে আনিসের কাছে পাঠিয়ে দাও নয়তো বিষ এনে দাও।প্লিজ মা প্লিজ।
মাঃ আনিসের মত একটা কেয়ারলেস ছেলেকে এখনো মনে ধরে আছিস? আজ এতদিন হল ও কি তোর কোন খোজ নিয়েছে? ওকে ভুলে যা। তোর বাবার পছন্দের ছেলেটাও অনেক ভালো এবং হ্যান্ডসাম।
অবন্তিঃ মা তুমি যাও। আমি একা থাকতে চাচ্ছি।
অবন্তি ভাবছে "আনিসের সমস্যাটা কি? ও কি আসলেই আমাকে চায়না? এভাবে ডুব দেয়ার মানে কি? ও কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? সিরিয়াস সময়ে ওর গায়েব হয়ে যাওয়া, খোজ না নেওয়াই কি প্রমাণ করে না যে ও আমাকে চায়না! এতদিন তাহলে আমার সাথে প্রতারণা করেছে?
দুদিন দেখবো ফোন এসএমএস দেয় কিনা। এর পর কপালে যা আছে তাই হবে।
অবন্তির মাষ্টার্স পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়েছিল তার পরের দিন অবন্তির বাবা ঢাকা এসে অবন্তির সাথে দেখা করার আগে ওকে না জানিয়েই আনিসের সাথে দেখা করে কথাগুলো বলেছিল। সেদিন থেকে আনিসের কোনো খোজ নেই। অবন্তি অভিমানে, রাগে, ক্ষোভে ইচ্ছে করেই আনিসের খোজ নিচ্ছেনা।
অবন্তির রাগটা হচ্ছে যে, "আনিসতো জানত যে বাবা আসবে। আমাকে নিয়ে যাবে। আমার বিয়ের কথা চলছে। সব জেনেও কেন ও চুপ? কেনো আমার খবর জানতে চাইবেনা?"
ভোরের সূর্যটা আজ একটু আগেই বোধহয় উঠে গেছে। সূর্যের আলো চোখে পড়তেই বিছানা ছেড়ে নামলো অবন্তি। জানালার পর্দা পুড়োটা সরিয়ে দেখে যে বাড়ি সাজানোর কাজ চলছে। আচমকা বুকটা কেঁপে উঠল। আনিসের চেহারাটা ভেসে উঠল চোখে। আনিসের উপর প্রচণ্ড রাগ থেকে আনিসকে ইচ্ছে করেই আর ভাবতে চাচ্ছেনা।
আনিসের জন্য আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর কি হবে অবন্তি জানেনা।
৩ মাস পর.......
হাতিরঝিল। শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটা, বিশিষ্ট তরুণ শিল্পপতি রোহান সাহেব তার সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। দুজন পাশা পাশি হাটছে। হঠাৎ রোহান সাহেবের স্ত্রী থমকে দাড়ালো। রোহান সাহেব আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে?
কিন্তু তার স্ত্রী কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে একটু সামনে এসে দাড়ালো। রোহান সাহেব ও দৌড়ে এসে স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বলল- "কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?"
রোহান সাহেবের স্ত্রী মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে সামনের বেঞ্চে বসা ছেলে দুজনকে দেখালো।
রোহান সাহেব একবার স্ত্রীর দিকে একবার ছেলে দুটোর দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকালো এবং স্ত্রীকে বলল- কি হয়েছে? ওদের চিনো? ওরা কি তোমাকে ডিস্টার্ব করে?
এবারো কোনো উত্তর না দিয়ে রোহান সাহেবের স্ত্রী ছেলে দুটোর মাঝে কোঁকড়ানো লম্বা লম্বা চুল আর অগোছালো দাড়িগোঁফে ফ্যাকাসে চেহারার ছেলেটার কলার চেপে ধরে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো- "ভীতু, কাপুরুষ, বেঈমান তুই এখনো মরিস নাই?"
ছেলে দুটো এবং রোহান সাহেব কিছু বুঝে উঠার আগেই তার স্ত্রী বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
রোহান সাহেব লজ্জা ভরা দৃষ্টিতে ছেলে দুজনের উদ্দেশ্যে বলল- "প্লিজ কিছু মনে করবেননা। আচ্ছা আপনারা কি ওকে কোনো ভাবে চেনেন?"
কোনো উত্তর নেই। ওরা একে অপরের দিকে একবার চেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
বসা থেকে উঠে রোহান সাহেবের স্ত্রী দাড়িগোঁফে ফ্যাকাসে চেহারার ছেলেটার দিকে হাত ইশারা করে বলল- "ও হচ্ছে একটা বেঈমান, প্রতারক, ওর কি কথা বলার মুখ আছে?, আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছে ও।........."
রোহান সাহেবঃ তার মানে উনি আনিস?
এবার পাশের ছেলেটা প্রচন্ড রাগ নিয়ে কথা বলা শুরু করল।
তিহানঃ হ্যা ও আনিস। তবে ও বেঈমান বা প্রতারক নয়, ও প্রতারণার শিকার। আপনার ওয়াইফের প্রতারণার স্বীকার। ও এখন মানুষিক ভারসাম্যহীন। এখন একটু একটু ইম্প্রুভ হচ্ছে ওর। আমি বা আমরা চাইনা ও আবার নতুন করে দুর্ঘটনার স্বীকার হউক। প্লিজ আপনার ওয়াইফকে নিয়ে এখান থেকে যান।
অবন্তী তিহানের কথা গুলো শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলোনা তাই, দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে বসে কাঁদতে লাগলো।
বিপাকে পড়লেন রোহান সাহেব।
অবন্তি কোনো ভাবেই শান্ত থাকতে পারছেনা। শুধু আনিস আর আনিসের সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে মনে। মনমরা হয়ে নির্বাক বসে আছে অবন্তি এমন সময় রোহান পাশে এসে বসল এবং ওর কাধে আলতো ছুঁয়ে বলল- "এত ভেংগে পড়োনা। তুমিতো ওকে ভুলেই গিয়েছিলে। আমি সব শুনেছিলাম তোমার মুখ থেকে আমাদের বিয়ের রাতেই। এতদিনতো স্বাভাবিকই ছিলে। তুমিইতো বলেছিলে ওকে আর ভালোবাসোনা। তাহলে এখন এই অবস্থা কেনো তোমার? শুনো তুমি এসব ভুলে যাও। আনিস মানুষিকভাবে অসুস্থ্য। ধীরে ধীরে সুস্থ্য হচ্ছে, ওকে ওর মত থাকতে দাও, তুমি তোমার মত করে সুখে থাকার চেষ্টা কর।"
দু'দিন হলো অবন্তি খুবই চুপচাপ। কারো সাথেই কথা বলছেনা। রোহান সাহেব সব জেনে শুনে শুরু থেকে মেনে নিয়েছিল বলে এখন নিরবেই এই বিস্বাদ পরিস্থিতি হজম করছে। কিন্তু ভিতরটা স্বাভাবিক থাকছেনা, তুষের আগুনের ন্যায় জ্বলছে।
রোহান সাহেব ঠিক করল তিহানের সাথে যোগাযোগ করে আনিস আর অবন্তির সম্পর্কের এই অবস্থার বিস্তারিত কারণ জেনে নিবে। কিন্তু তিহানকে কিভাবে পাবে? অনেক ভাবনা চিন্তার পর ফেইসবুক গ্রুপ DSE (DO SOMETHING EEXCEPTIONAL) এর কল্যানে তিহানকে খুঁজে পেল।
রোহান সাহেব আর তিহান সামনা সামনি বসে আছে। রোহান সাহেব বুঝতে পারছেনা কি বলে শুরু করবে। এমন সময় তিহানই প্রশ্নবোধক মুখাবয়ব করে বলল- "আমায় ডেকে আনার কারণ?"
অপ্রস্তুত তবুও শান্ত স্বরে রোহান সাহেব বলল- "আপনার কি কিছুক্ষণ সময় হবে আমার সাথে কথা বলার?"
বিরক্ত তবুও নিজেকে সংযত রেখে তিহান বলল- "কোন প্রসংগে?"
রোহানঃ অবন্তি আর আনিসের ব্যাপারে।
তিহানঃ কি?
রোহানঃ অবন্তির মুখে যতটুকু শুনেছি তাতে বুঝেছি যে, ওদের খুব ভালো এবং দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ছিল।
তিহানঃ আপনিতো জানেনই।তো?
রোহানঃ মানে আমি জানতে চাচ্ছি ওদের সম্পর্ক নষ্ট হলো কিভাবে?
তিহানঃ ও আচ্ছা! এইটা বলেনি আপনার ওয়াইফ আপনাকে?
রোহানঃ আপনি বোধহয় বিরক্ত কিংবা রাগ হচ্ছেন। প্লিজ বিষয়টা ইতিবাচক ভাবুন।
তিহানঃ জ্বি, আচ্ছা বলুন।
রোহানঃ অবন্তির মাস্টার্স পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়েছিল সেদিন অবন্তির বাবা মানে আমার শ্বশুর ঢাকা এসে ওকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বিষয়টা রোহান জানতো। জেনেও কেনো সে অবন্তির সাথে দেখা কিংবা যোগাযোগ করলোনা? ও কি ইচ্ছে করেই ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেনি?
তিহানঃ এসব জেনে আপনার কি লাভ?
"লাভ!" বলে রোহান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তিহানঃ সেদিন আনিস যোগাযোগ করেনি। কিন্তু কেনো করেনি, নাকি করতে পারেনি এ বিষয়টা অবন্তি কৌতুহল বশতও কি জানতে চেয়েছিল?
রোহান সাহেব নিরুত্তর।
সেদিন জলিল সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ শেষে প্রচন্ড রাগ আর কষ্ট নিয়ে আনিস বাসায় ফিরেছিল। জ্বর জ্বর লাগছিলো বলে রাতে না খেয়েই শুয়ে গিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে অবন্তিকে ভাবছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো অবন্তিকে একটা কল করতে; কিন্তু কেমন যেনো একটা চাপা জিদ কাজ করছিলো এবং ক্ষানিক অভিমান হচ্ছিলো অবন্তির উপর এই ভেবে যে, "ওর বাবা এসে আমাকে ডেকে কথা শুনাবে এটা ও আমাকে আগে থেকে বললোনা কেনো? তাছাড়া সন্ধ্যা থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত একটিবারে জন্যও কেনো আমার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখালোনা। তার মানে ও ওর বাবার পছন্দে রাজি!" এসব ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড জ্বর বয়ে রাত পার করলো আনিস। কাউকে কিছু না বলেই খুব ভোরে আনিস অবন্তির খালার বাসার দিকে রওনা দিল। গতকাল পরীক্ষা শেষে অবন্তি হোস্টেল থেকে তার খালার বাসায় চলে এসেছিল; এইটা আনিস জানত। আজ সকাল নয়টা গ্রামের উদ্দেশ্যে ওরা ঢাকা ছাড়বে এটাও আনিস জানত। তাইতো খুব ভোরেই কাউকে কিছু না বলে আনিস অবন্তির সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়ল।
ভোর ৬টা। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। রিক্সায় করে যাচ্ছিল আনিস। বাসার গলি ছেড়ে রিক্সা যখন হাইওয়েতে উঠল ঠিক তখনই আচমকা পিছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে রিক্সা ধাক্কা দিল। বেশ অতিরিক্ত গতি ছিল প্রাইভেট কারটির। ধাক্কা লাগার সাথে সাথেই আনিস এবং রিক্সা চালক দুজিনই ছিটকে পড়ল। চোখের পলকেই গাড়িটি উধাও হয়ে গেল।
আনিসের যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পেল। আমি এখানে কেনো বলে লাফ দিয়ে যখন উঠতে গেল উঠতে পারলোনা। রিক্সা থেকে ছিটকে পড়ায় দু'পায়ের হাটু এবং বা'হাতে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে।
আনিসের জ্ঞান ফিরেছে দেখে নার্স এল। নার্সকে দেখে আনিস জানতে চাইলো -"আমাকে হাসপাতালে কে নিয়ে এল? আমার মোবাইল মানি ব্যাগ কোথায়?"
নার্সঃ আপনার অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। বেশি উত্তেজিত হবেননা। শান্ত থাকুন। আমি উনাকে ডেকে পাঠাচ্ছি।
নার্স যাবার পর তিহান এল। তিহানকে দেখে আনিস স্বস্তিবোধ করল।
আনিসঃ কিরে আমি এখানে কিভাবে?
তিহান সব বলল। শুনে আনিস আবারো জানতে চাইলো -"আমার মোবাইল কোথায়?"
তিহানঃ তোর নাম্বার থেকে কেউ একজন আমাকে ফোন করে লোকেশনসহ তোর এক্সিডেন্ট এর কথা জানালো। আমি এসে শুধু তোকে ফুটপাতের ধারে পড়ে থাকতে দেখলাম। তোর নাম্বারে ফোন দিয়ে মোবাইলের সুইচ অফ পেলাম।
আনিসঃ ব্যাটা চোর হলেও মানবিক ছিল। আচ্ছা রিক্সাওয়ালার কি অবস্থা?
তিহানঃ রিক্সা এবং রিক্সাওয়ালা আমি কাউকে দেখিনি।
আনিসঃ হুম! কয়টা বাজে দেখতো।
তিহানঃ ১০টা বাজে। কি খাবি বল।
আনিসঃ শীট্! ও এতক্ষণে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে।
তিহানঃ কার কথা বলছিস? আচ্ছা জ্বর নিয়ে এত ভোরে বেরিয়েছিলি কেনো আজ?
আনিস তিহানকে সব বলল। শুনে তিহান বলল-
"তুই আমাকে বলতি। আমি সহ বেরুতাম। এই নে আমার মোবাইল থেকে ফোন দে ওকে। কথা বল।"
অবন্তিকে ফোন দেয়াতো দূরে থাক আনিস তিহানের মোবাইলটা ধরার আগ্রহও দেখালোনা।
তিহানঃ কিরে কথা বলবিনা অবন্তির সাথে?
আনিসঃ না।
তিহানঃ কেনো?
আনিসঃ অবন্তি নিজ থেকেই চাচ্ছেনা আমার সাথে থাকতে। আমি সিউর।
তিহানঃ বোকার মত কথা বলিস না।
আনিসঃ তা ই যদি না হত। তাহলে কেনো গতকাল সন্ধ্যা থেকে ওর কোনো খোঁজ নেই! কেনো কোনো ধরণের যোগাযোগই করছেনা আমার সাথে?
তিহানঃ তুই করেছিলি যোগাযোগ?
আনিসঃ আমারতো মন মেজাজ খারাপ করে দিয়েছিল ওর বাবা। তার উপর জ্বরে মরেছি সারারাত। আমার এমন অবস্থায় আমি কি আশা করতে পারিনা যে অবন্তি আমার খোঁজ নিবে, টেক কেয়ার করবে!
তিহানঃ মান অভিমান সেতো হৃদয়েরই টান। এত অভিমান করে থাকলে হয়, পাগলা!
আনিসঃ দেখ সব ভুলে গিয়ে ভোর বেলা আমিতো ওকে দেখার জন্য, ওর সাথে কথা বলার জন্যই বেরিয়েছিলাম। মাঝপথে একটা দুর্ঘটনার স্বীকার হলাম। ও ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে এক ঘন্টা হল। অথচ দেখ একবারের জন্যও আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করলোনা। ওর এমন আচরণে কি বুঝা যায়না যে ও আর আমাকে চায়না?
তিহানঃ বুঝলাম। এমনওতো হতে পারে তুই যেমন রাগ করে আছিস, অবন্তিও ঠিক তেমনি রাগ করে আছে?
আনিসঃ হতে পারে। শুধু শুধু রাগ করাটা ওর অভ্যাস, যা আমার এখন আর ভালো লাগেনা। দেখি কত দিন রাগ করে থাকতে পারে।
আনিস কিছুদিন পর যখন একটু সুস্থ হল, জানতে পারলো অবন্তির বিয়ে হয়ে গেছে। এই ভূগর্ভে এর আগে আনিস কখনো এমন কঠিন এবং কষ্টের সম্মুখীন হয়নি। আনিসের পৃথিবীজুড়ে রিখটার স্কেল এর সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়েও কয়েক গুন বেশি মাত্রার কম্পন হলো, যার স্থিতিকাল ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। তাতেই আনিসের সব স্বাভাবিকতা ধুমড়ে মুচড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল।
দীর্ঘদিনের সুন্দর এবং মধুর একটা সম্পর্ক শুধু মাত্র ইগো আর মাত্রাতিরিক্ত অভিমানের ফলে খুব সজেই শেষ হয়ে গেল। বিনিময়ে পৃথিবী পেল তিনজন অসুখী মানুষ।
পৃথিবী এমনটার পুনরাবৃত্তি আর চায়না।
সম্পর্কের এতগুলো বছরে তাদের বর্তমান অবস্থা সবাই ভালো জানলেও আলাদা আলাদা করে ওদের দুজনেরই মনের ভাবনা এক যে, "সম্পর্কটা আর আগের মত নেই।"
যে কোন সম্পর্কে সন্দেহ নামক ভাইরাসটা খুবই কমন একটা ইস্যু। আনিস আর অবন্তির মাঝে সে ভাইরাসটা নেই।
আনিস ব্যস্ততা কিংবা ঝামেলার জন্যে মাঝে মাঝে যথা সময়ে অবন্তির খোজ-খবর নিতে পারেনা। অনেক সময় ইচ্ছে করেই ফ্রি সময়ে অবন্তির সাথে যোগাযোগ না করে হাতের কাজটা শেষ করে নেয়। এক্ষেত্রে আনিস এর যুক্তি- "কয়েক মিনিটের ফ্রি সময় আমার জন্য যথেষ্ট নয় ওর সাথে যোগাযোগ করার জন্য, তাছাড়া তখন মাইন্ডটাও রিলাক্স থাকেনা, কথা বললে প্রশান্তির বিপরীতে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। ওর সাথে রিলাক্স মোডে আন্তরিক হয়ে মধুর কথা হবে। তাহলে অবন্তিও খুশি থাকলো, আমিও শান্ত থাকলাম।"
আনিস যথা সময়ে যোগাযোগ রাখছেনা। সারাদিনে একটুর জন্যও খোজ নিচ্ছেনা এ জন্য অবন্তির মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, আউলা-বাউলা চিন্তা ভাবনা শুরু করে। অবন্তি ভাবে আনিস ইচ্ছে করেই খোজ নিচ্ছেনা, ভাব দেখাচ্ছে, ওর কাছে বুঝি আমার মূল্য ফুরিয়ে আসছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ভাবে আর মাঝে মাঝে দু একটা টেক্স করে ফেবুতে, যার ভাষা থাকে খুবই কঠিন।
আনিস টেক্স গুলো নোটিফিকেশনেই দেখে পড়ে নেয়, সীন করার প্রয়োজন হয়না। টেক্স গুলো পড়ে আনিস হাসে। কেও বুঝেনা এ হাসি বিরক্তির নাকি সুখের। আনিস তাৎক্ষণিক কোনো রিপ্লাই দেয়না। এক্ষেত্রেও আনিস মুক্ত সময় খুজে।
রোমান্টিক কথা বার্তার ছেয়ে ওদের মাঝে সব সময় টম এন্ড জেরি টাইপ একটা ঝগড়া লেগেই থাকে। দুজনের জায়গা থেকে কারোরই দোষ নেই।
অবন্তির কিছু পছন্দের ব্যাপার যা আনিস পছন্দ করেনা। আবার আনিসের কিছু পছন্দের বিষয় যা অবন্তি মেনে নিতে পারেনা।
শুরুর দিকে অবন্তির ব্যাপারে আনিসের অনেক অভিযোগ ছিল এবং প্রতিনিয়ত সে অবন্তিকে তা মনে করিয়ে দিত। অবন্তি খুব বিরক্ত হয়েও চেষ্টা করত সেসব মেনে চলতে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছিলনা।
ব্যাপারটা আনিস একটু দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিল এবং অবন্তিকে বলেছিল, "যেটা মন থেকে না আসে তা করার বৃথা চেষ্টা আর কোরোনা। এতে করে তুমি যেমন সুখ পাচ্ছোনা তেমনি আমিওনা।" তবুও আনিস ভেবেছিল অবন্তি ওর পছন্দ অপছন্দ মেনে চলার চেষ্টা করবে।
অবন্তি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে মূল্যায়নের চেষ্টা করছিল আনিসের পছন্দ অপছন্দকে। কিন্তু কিছুদিন পর সব আগের মত হয়ে যাচ্ছে অবন্তির।
এখনো প্রতিদিন কথা হয়। যখন তখন না। শুধু রাতে। রাত ১২টার আগে ওরা কথা শুরু করতে পারেনা। কারণ অবন্তির রুম মেইটরা না ঘুমালে অবন্তি কথা বলতে পারেনা। মেয়ে গুলো শুধু শুধু ডিস্টার্ব করে। আনিস অফিস শেষ করে বাসায় ফিরে রাত ৯টায়। এসে একটু রেস্ট নেয়, কখনো আবার বুয়া না এলে রান্না করতে হয়। অত:পর খেয়ে দেয়ে পড়াশুনা করার একটু ব্যার্থ চেষ্টা করে, যে চেষ্টা ফেইসবুকে গিয়ে থামে। এরপর অবন্তির জন্য অপেক্ষা।
অবন্তি সারাদিনই বাসায় ফ্রি থাকে। সন্ধার পর দুটা টিউশনি করে। বাসায় ফিরে রাত সাড়ে ৯টায়। এসে রুমমেইট বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেয়, মা বোনের সাথে ফোনে কথা বলে। ফেইসবুকে আসে। আনিস কেমন আছে, বাসায় আসছে কিনা এসব জানতে চেয়ে আনিসকে মেসেঞ্জারে টেক্স করে। আনিস অনলাইনে থাকলে হয়ত রিপ্লাই দেয়।
রাত ১২টা বেজে ২১ মিনিট। ফোনে রিং হচ্ছে আনিস ধরছেনা। এদিকে অবন্তি একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছে। খুব বিরক্ত হচ্ছে অবন্তি। আনিসের মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। আনিস অনলাইনে একটা জব এপ্লিকেশন ফরম ফিলাপ করছিল।
আনিস বিছানা ঘুছিয়ে শুয়ে অবন্তিকে কল ব্যাক করল। তিনবার কল দেয়ার পর অবন্তি রিসিভ করলো।
আনিসঃ কেমন আছো?
অবন্তিঃ ভালো আছি। তুমি?
আনিসঃ ভালো। আচ্ছা অবন্তি কয়বার কল দেয়ার পর রিসিভ করেছো?
অবন্তিঃ জানিনা। কেনো কোনো সমস্যা?
আনিস বুঝতে পারলো রিপ্লাই বুঝে শুনে দিতে হবে নয়তো কালবৈশাখী হতে পারে।
অবন্তিঃ কি ব্যাপার চুপ কেনো??
আনিসঃ না কোনো সমস্যা না। এমনি। খেয়েছো?
অবন্তিঃ সেটা জেনে তোমার কি?
উদ্ভট রিপ্লাই শুনে আনিসের খিটখিটে মেজাজ আরো উত্তেজিত হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
আনিসঃ মানে?
অবন্তিঃ কিসের মানে?
আনিসঃ প্রশ্ন করেছি, উত্তর না দিয়ে উলটা কথা বললে কেনো?
অবন্তিঃ বুঝোনা?
আনিসঃ কি বুঝতাম?
অবন্তিঃ এখন কয়টা বাজে দেখছোস?
আনিসঃ ১২টা ৫০।
অবন্তিঃ তোরে ফোন দিচ্ছিলাম কয়টা থেকে?
এবার আনিস একটু চওড়া গলায় বলল-
আনিসঃ যখন কল রিসিভ করছিনা তখন বুঝে নিতে পারোনা কেনো যে আমি ব্যস্ত আছি। ফ্রি হয়েতো ফোন দিবোই। এত অস্থির হয়ে যাও কেনো? সমস্যা কি তোমার? তুমি কি আমায় বুঝবেনা?
অবন্তিঃ আমারতো কমন সেন্সের অভাব!
আনিসঃ ধ্যাত্ আমি কি তা বলেছি নাকি? আজিব।
অবন্তিঃ এখন বলতে হবে কেনো আগেইতো বলেছো।
আনিসঃ ওহহো অবন্তি! ভাল্লাগছেনা এত রাতে ঝগড়া করতে। প্লিজ।
অবন্তিঃ আমিতো ঝগড়াইট্টা। ঝগড়াতো আমিই করি। সারাদিন আশায় থাকি এই মুহূর্তটার। তোমার সাথে কথা বলার জন্য। আর তার প্রতিদান প্রতিদিনই পাই এইরকম করে।
আনিসঃ আরে আজিব! আমি কি এমন খারাপ প্রতিদান দিলাম। প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা কর।
অবন্তিঃ কি বুঝব? কি বুঝাতে চাও? আমার ভালো কেও চায়না।
আনিসঃ আরে ভাই ন্যাকামি ছাড়ো
ভাল্লাগেনা।
অবন্তিঃ অই ন্যাকামি কারে কয় বুঝস?
আনিসঃ বুঝি বলেই বলেছি।
অবন্তিঃ ৮/১০টা মাইয়ার মত ন্যাকামি যদি দেখাইতাম তুইতো পাগল হইয়া যাইতি। ন্যাকামি ন্যাকামি করবিনা। অসহ্য লাগে।
আনিসঃ অকে বলবোনা।
অবন্তিঃ আর কিছু কইবি?
আনিসঃ কেনো? রেখে দিবে?
অবন্তিঃ অনেক রাত হইছে।
আনিসঃ তো? এ আর নতুন কি?
দুজনই চুপ। একের কানে অপরের নিখুঁত নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে। প্রায় ৫ থেকে ৮ মিনিট চুপ। অবন্তি চাচ্ছে ভালো করে আবার কথা স্টার্ট করতে, হ্যালো বলতে চেয়েও পারছেনা। তাই ইচ্ছে করই চুপ থাকছে। অবন্তি চাচ্ছে আনিস আগে কথা বলবে। আনিসের সিক্স সেন্স খুব ভালো। তাই সে বিষয়টা বুঝতে পারে সবসময়ই। তাই সে নিরবতা ভেংগে এক নিশ্বাসে কিছুক্ষন কথা বলে যায়। তারপর আবার কথা হয় দুজনের মাঝে। রিলেশনের কথা। রোমান্টিক কথা। সংসার বাধার স্বপ্নের কথা।
যতবারই দুজনের কথা হবে ততবারই ঝগড়া হবে। ঝগড়া শেষে আবার রোমান্টিকও হয়ে যেতে পারে ওরা। কিন্তু ইদানিং ঝগড়া বাধলে তা মিমাংসার আগে দুজনেই লাইন কেটে দেয়। রাগ করে কেও আগে ফোন ব্যাক করতে চায়না। আগে অবন্তি রাগ করে লাইন কেটে দিলে অবন্তি ফোন রিসিভ করা পর্যন্ত আনিস ১০০বার ২০০বার ফোন দিত।
এখন আনিস ক্লান্ত। আনিসের মনে হয়, " সব সময় আমাকেই কেনো আগে কল দিতে হবে? আমাকেই কেনো রাগ ভাঙাতে হবে? আমার প্রতি ওর কি কোনো রেসপন্সিবিলিটি নেই? রাগ দেখাবে, মেজাজ দেখাবে, কথার মাঝে লাইন কেটে দিবে! আর আমাকেই তোষামোদ করতে হবে??
এবার আমি চুপ করে থাকি, দেখি ও কি রিএকশন দেখায়!!"
প্রতিবার ঝগড়ার শেষেই অবন্তির মন্টা ভেংগে চুরমার হয়ে যায়। নিরব হিয়ে যাও। খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চিন্তা ভাবনার সমস্তটা জুড়ে শুধু আনিস। অবন্তি ভাবে, "আনিস আগের মত নেই। কেয়ারলেস হয়ে গেছে, আমার রাগ-অভিমান ওকে আর ভাবায়না, আমার সাথে যোগাযোগ না করে থাকতে পারলেই ও ভালো থাকে। দেখি কতদিন পারে আমাকে ফোন এসএমএস না দিয়ে থাকতে।"
এভাবেই ঝগড়া-ঝাটি, মান-অভিমান চলতে থাকে। ২৪ ঘন্টার মাঝেই হয় অবন্তি না হয় আনিস ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। কিন্তু আবার শুরু হয়।
ক্যারিয়ার, ফ্যামিলি, বিয়ে, অফিস আর দুজনের মাঝের প্রতিদিনের বুঝা বুঝির ভুলের দ্বন্দ্বে দুজনের মেজাজ এখন খিটখিটে থাকে। এখন ঝগড়া হলেই দুজনে ভাবে "এবার ব্রেকে যাওয়া উচিত।"
কিন্তু কেউ কাউকে বলার সাহস হয়না, কারণ অবন্তির চোখে আনিসের মত ভালো মনের মানুষ হয়না, আনিস অনেক কেয়ারফুল। অন্যদিকে আনিসের কাছে অবন্তির চেয়ে লক্ষি মেয়ে আর একটাও হয়না। অবন্তিকে হারাতে চায়না আনিস।
অবন্তি আনিসের সম্পর্কের কথা দুজনেরই মা বাবা না জানার মত করে জানে। অবন্তির মা বাবা দুজনেই আনিসকে খুব পছন্দ করত।
যখন অবন্তির বাবা অবন্তির বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করল, তখন আনিস অবন্তির বাবাকে বুঝাতে চেয়েছিল শুধু যে, ও অবন্তিকে পছন্দ করে। অবন্তির বাবা আনিসকে ডেকে নিয়ে বুঝালো যে, "দেখো বাবা, আমি জানি তুমি খুব ভালো ছেলে, অবন্তিও তোমাকে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু আমি চাইনা তোমাদের বিয়ে হউক। তুমি চাকুরি বাকরি করো, সংসারের হাল ধর, বয়সের হিসেবে যদিও তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে, তবে পারিপার্শ্বিক সব মিলিয়ে তোমার বিয়ের বয়স এটা না। তোমার করার এখনো অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। তুমি সংসারের বড়, তোমার ছোট আরো চারজন আছে। বোনের বিয়ের বয়স হয়েছে, বোনকে বিয়ে দাও, আমরা আছি দেখব। তোমার জন্য দোয়া থাকবে সব সময়। আর শুনো এ বিষয়ে তোমার কোনো মতামত শুনতে চাইনা এবং আমিও এর পরে এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে চাইনা। বললে তা শুনতে তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।"
আনিস অনিচ্ছা সত্ত্বেও অষুধ সেবনের ন্যায় জলিল সাহেবের সব কথা গিলেছে । খুব জিদ হচ্ছে অবন্তির বাবার উপর। কথা গুলো শুনার পর আনিসের মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর অর্ধেক এখন তার মাথার উপর। বসা থেকে উঠে দাড়াতে গিয়ে পড়ে যেতে লাগলো, কিন্তু না পড়ে জলিল সাহেবের সামনে থেকে দ্রুত পায়ে হেটে বেরিয়ে গেল।
রাত ১টা বাজে। কেউ কাওকে ফোন দিচ্ছেনা। সন্ধ্যা থেকে আনিস খোজ নেয়নি দেখে অবন্তি অভিমান করে ফোন দিচ্ছেনা। অন্য দিকে আনিসের মন মেজাজ দুটোই খারাপ সন্ধ্যায় অবন্তির বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে। এদিকে অবন্তি কিছুক্ষন পর পর মোবাইল হাতে নিয়ে দেখছে কিন্তু আনিস লাপাত্তা।
দুদিন হয়ে গেল আনিসের খোজ নেই। এদিকে অবন্তির বিয়ের ডেট ফাইনাল। মানুষিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছে অবন্তি। অবন্তির মা অবন্তিকে বুঝাচ্ছে, "দেখ মা এভাবে কান্না কাটি করিসনা। দুদিনপর তোর বিয়ে। খেয়ে নে প্লিজ।"
অবন্তিঃ দুদিন পর আমার লাশের বিয়ে দিও।
মাঃ কি যা তা বলছিস।
অবন্তিঃ মা তুমি যাও এখান থেকে।
মাঃ দেখ মা তুই এমন করলে আমি ভালো থাকতে পারছিনা।
অবন্তিঃ মা আমিও ভালো থাকতে পারছিনা। পারলে আমাকে আনিসের কাছে পাঠিয়ে দাও নয়তো বিষ এনে দাও।প্লিজ মা প্লিজ।
মাঃ আনিসের মত একটা কেয়ারলেস ছেলেকে এখনো মনে ধরে আছিস? আজ এতদিন হল ও কি তোর কোন খোজ নিয়েছে? ওকে ভুলে যা। তোর বাবার পছন্দের ছেলেটাও অনেক ভালো এবং হ্যান্ডসাম।
অবন্তিঃ মা তুমি যাও। আমি একা থাকতে চাচ্ছি।
অবন্তি ভাবছে "আনিসের সমস্যাটা কি? ও কি আসলেই আমাকে চায়না? এভাবে ডুব দেয়ার মানে কি? ও কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? সিরিয়াস সময়ে ওর গায়েব হয়ে যাওয়া, খোজ না নেওয়াই কি প্রমাণ করে না যে ও আমাকে চায়না! এতদিন তাহলে আমার সাথে প্রতারণা করেছে?
দুদিন দেখবো ফোন এসএমএস দেয় কিনা। এর পর কপালে যা আছে তাই হবে।
অবন্তির মাষ্টার্স পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়েছিল তার পরের দিন অবন্তির বাবা ঢাকা এসে অবন্তির সাথে দেখা করার আগে ওকে না জানিয়েই আনিসের সাথে দেখা করে কথাগুলো বলেছিল। সেদিন থেকে আনিসের কোনো খোজ নেই। অবন্তি অভিমানে, রাগে, ক্ষোভে ইচ্ছে করেই আনিসের খোজ নিচ্ছেনা।
অবন্তির রাগটা হচ্ছে যে, "আনিসতো জানত যে বাবা আসবে। আমাকে নিয়ে যাবে। আমার বিয়ের কথা চলছে। সব জেনেও কেন ও চুপ? কেনো আমার খবর জানতে চাইবেনা?"
ভোরের সূর্যটা আজ একটু আগেই বোধহয় উঠে গেছে। সূর্যের আলো চোখে পড়তেই বিছানা ছেড়ে নামলো অবন্তি। জানালার পর্দা পুড়োটা সরিয়ে দেখে যে বাড়ি সাজানোর কাজ চলছে। আচমকা বুকটা কেঁপে উঠল। আনিসের চেহারাটা ভেসে উঠল চোখে। আনিসের উপর প্রচণ্ড রাগ থেকে আনিসকে ইচ্ছে করেই আর ভাবতে চাচ্ছেনা।
আনিসের জন্য আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর কি হবে অবন্তি জানেনা।
৩ মাস পর.......
হাতিরঝিল। শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটা, বিশিষ্ট তরুণ শিল্পপতি রোহান সাহেব তার সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। দুজন পাশা পাশি হাটছে। হঠাৎ রোহান সাহেবের স্ত্রী থমকে দাড়ালো। রোহান সাহেব আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে?
কিন্তু তার স্ত্রী কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে একটু সামনে এসে দাড়ালো। রোহান সাহেব ও দৌড়ে এসে স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বলল- "কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?"
রোহান সাহেবের স্ত্রী মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে সামনের বেঞ্চে বসা ছেলে দুজনকে দেখালো।
রোহান সাহেব একবার স্ত্রীর দিকে একবার ছেলে দুটোর দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকালো এবং স্ত্রীকে বলল- কি হয়েছে? ওদের চিনো? ওরা কি তোমাকে ডিস্টার্ব করে?
এবারো কোনো উত্তর না দিয়ে রোহান সাহেবের স্ত্রী ছেলে দুটোর মাঝে কোঁকড়ানো লম্বা লম্বা চুল আর অগোছালো দাড়িগোঁফে ফ্যাকাসে চেহারার ছেলেটার কলার চেপে ধরে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো- "ভীতু, কাপুরুষ, বেঈমান তুই এখনো মরিস নাই?"
ছেলে দুটো এবং রোহান সাহেব কিছু বুঝে উঠার আগেই তার স্ত্রী বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
রোহান সাহেব লজ্জা ভরা দৃষ্টিতে ছেলে দুজনের উদ্দেশ্যে বলল- "প্লিজ কিছু মনে করবেননা। আচ্ছা আপনারা কি ওকে কোনো ভাবে চেনেন?"
কোনো উত্তর নেই। ওরা একে অপরের দিকে একবার চেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
বসা থেকে উঠে রোহান সাহেবের স্ত্রী দাড়িগোঁফে ফ্যাকাসে চেহারার ছেলেটার দিকে হাত ইশারা করে বলল- "ও হচ্ছে একটা বেঈমান, প্রতারক, ওর কি কথা বলার মুখ আছে?, আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছে ও।........."
রোহান সাহেবঃ তার মানে উনি আনিস?
এবার পাশের ছেলেটা প্রচন্ড রাগ নিয়ে কথা বলা শুরু করল।
তিহানঃ হ্যা ও আনিস। তবে ও বেঈমান বা প্রতারক নয়, ও প্রতারণার শিকার। আপনার ওয়াইফের প্রতারণার স্বীকার। ও এখন মানুষিক ভারসাম্যহীন। এখন একটু একটু ইম্প্রুভ হচ্ছে ওর। আমি বা আমরা চাইনা ও আবার নতুন করে দুর্ঘটনার স্বীকার হউক। প্লিজ আপনার ওয়াইফকে নিয়ে এখান থেকে যান।
অবন্তী তিহানের কথা গুলো শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলোনা তাই, দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে বসে কাঁদতে লাগলো।
বিপাকে পড়লেন রোহান সাহেব।
অবন্তি কোনো ভাবেই শান্ত থাকতে পারছেনা। শুধু আনিস আর আনিসের সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে মনে। মনমরা হয়ে নির্বাক বসে আছে অবন্তি এমন সময় রোহান পাশে এসে বসল এবং ওর কাধে আলতো ছুঁয়ে বলল- "এত ভেংগে পড়োনা। তুমিতো ওকে ভুলেই গিয়েছিলে। আমি সব শুনেছিলাম তোমার মুখ থেকে আমাদের বিয়ের রাতেই। এতদিনতো স্বাভাবিকই ছিলে। তুমিইতো বলেছিলে ওকে আর ভালোবাসোনা। তাহলে এখন এই অবস্থা কেনো তোমার? শুনো তুমি এসব ভুলে যাও। আনিস মানুষিকভাবে অসুস্থ্য। ধীরে ধীরে সুস্থ্য হচ্ছে, ওকে ওর মত থাকতে দাও, তুমি তোমার মত করে সুখে থাকার চেষ্টা কর।"
দু'দিন হলো অবন্তি খুবই চুপচাপ। কারো সাথেই কথা বলছেনা। রোহান সাহেব সব জেনে শুনে শুরু থেকে মেনে নিয়েছিল বলে এখন নিরবেই এই বিস্বাদ পরিস্থিতি হজম করছে। কিন্তু ভিতরটা স্বাভাবিক থাকছেনা, তুষের আগুনের ন্যায় জ্বলছে।
রোহান সাহেব ঠিক করল তিহানের সাথে যোগাযোগ করে আনিস আর অবন্তির সম্পর্কের এই অবস্থার বিস্তারিত কারণ জেনে নিবে। কিন্তু তিহানকে কিভাবে পাবে? অনেক ভাবনা চিন্তার পর ফেইসবুক গ্রুপ DSE (DO SOMETHING EEXCEPTIONAL) এর কল্যানে তিহানকে খুঁজে পেল।
রোহান সাহেব আর তিহান সামনা সামনি বসে আছে। রোহান সাহেব বুঝতে পারছেনা কি বলে শুরু করবে। এমন সময় তিহানই প্রশ্নবোধক মুখাবয়ব করে বলল- "আমায় ডেকে আনার কারণ?"
অপ্রস্তুত তবুও শান্ত স্বরে রোহান সাহেব বলল- "আপনার কি কিছুক্ষণ সময় হবে আমার সাথে কথা বলার?"
বিরক্ত তবুও নিজেকে সংযত রেখে তিহান বলল- "কোন প্রসংগে?"
রোহানঃ অবন্তি আর আনিসের ব্যাপারে।
তিহানঃ কি?
রোহানঃ অবন্তির মুখে যতটুকু শুনেছি তাতে বুঝেছি যে, ওদের খুব ভালো এবং দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ছিল।
তিহানঃ আপনিতো জানেনই।তো?
রোহানঃ মানে আমি জানতে চাচ্ছি ওদের সম্পর্ক নষ্ট হলো কিভাবে?
তিহানঃ ও আচ্ছা! এইটা বলেনি আপনার ওয়াইফ আপনাকে?
রোহানঃ আপনি বোধহয় বিরক্ত কিংবা রাগ হচ্ছেন। প্লিজ বিষয়টা ইতিবাচক ভাবুন।
তিহানঃ জ্বি, আচ্ছা বলুন।
রোহানঃ অবন্তির মাস্টার্স পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়েছিল সেদিন অবন্তির বাবা মানে আমার শ্বশুর ঢাকা এসে ওকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বিষয়টা রোহান জানতো। জেনেও কেনো সে অবন্তির সাথে দেখা কিংবা যোগাযোগ করলোনা? ও কি ইচ্ছে করেই ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেনি?
তিহানঃ এসব জেনে আপনার কি লাভ?
"লাভ!" বলে রোহান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তিহানঃ সেদিন আনিস যোগাযোগ করেনি। কিন্তু কেনো করেনি, নাকি করতে পারেনি এ বিষয়টা অবন্তি কৌতুহল বশতও কি জানতে চেয়েছিল?
রোহান সাহেব নিরুত্তর।
সেদিন জলিল সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ শেষে প্রচন্ড রাগ আর কষ্ট নিয়ে আনিস বাসায় ফিরেছিল। জ্বর জ্বর লাগছিলো বলে রাতে না খেয়েই শুয়ে গিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে অবন্তিকে ভাবছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো অবন্তিকে একটা কল করতে; কিন্তু কেমন যেনো একটা চাপা জিদ কাজ করছিলো এবং ক্ষানিক অভিমান হচ্ছিলো অবন্তির উপর এই ভেবে যে, "ওর বাবা এসে আমাকে ডেকে কথা শুনাবে এটা ও আমাকে আগে থেকে বললোনা কেনো? তাছাড়া সন্ধ্যা থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত একটিবারে জন্যও কেনো আমার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখালোনা। তার মানে ও ওর বাবার পছন্দে রাজি!" এসব ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড জ্বর বয়ে রাত পার করলো আনিস। কাউকে কিছু না বলেই খুব ভোরে আনিস অবন্তির খালার বাসার দিকে রওনা দিল। গতকাল পরীক্ষা শেষে অবন্তি হোস্টেল থেকে তার খালার বাসায় চলে এসেছিল; এইটা আনিস জানত। আজ সকাল নয়টা গ্রামের উদ্দেশ্যে ওরা ঢাকা ছাড়বে এটাও আনিস জানত। তাইতো খুব ভোরেই কাউকে কিছু না বলে আনিস অবন্তির সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়ল।
ভোর ৬টা। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। রিক্সায় করে যাচ্ছিল আনিস। বাসার গলি ছেড়ে রিক্সা যখন হাইওয়েতে উঠল ঠিক তখনই আচমকা পিছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে রিক্সা ধাক্কা দিল। বেশ অতিরিক্ত গতি ছিল প্রাইভেট কারটির। ধাক্কা লাগার সাথে সাথেই আনিস এবং রিক্সা চালক দুজিনই ছিটকে পড়ল। চোখের পলকেই গাড়িটি উধাও হয়ে গেল।
আনিসের যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পেল। আমি এখানে কেনো বলে লাফ দিয়ে যখন উঠতে গেল উঠতে পারলোনা। রিক্সা থেকে ছিটকে পড়ায় দু'পায়ের হাটু এবং বা'হাতে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে।
আনিসের জ্ঞান ফিরেছে দেখে নার্স এল। নার্সকে দেখে আনিস জানতে চাইলো -"আমাকে হাসপাতালে কে নিয়ে এল? আমার মোবাইল মানি ব্যাগ কোথায়?"
নার্সঃ আপনার অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। বেশি উত্তেজিত হবেননা। শান্ত থাকুন। আমি উনাকে ডেকে পাঠাচ্ছি।
নার্স যাবার পর তিহান এল। তিহানকে দেখে আনিস স্বস্তিবোধ করল।
আনিসঃ কিরে আমি এখানে কিভাবে?
তিহান সব বলল। শুনে আনিস আবারো জানতে চাইলো -"আমার মোবাইল কোথায়?"
তিহানঃ তোর নাম্বার থেকে কেউ একজন আমাকে ফোন করে লোকেশনসহ তোর এক্সিডেন্ট এর কথা জানালো। আমি এসে শুধু তোকে ফুটপাতের ধারে পড়ে থাকতে দেখলাম। তোর নাম্বারে ফোন দিয়ে মোবাইলের সুইচ অফ পেলাম।
আনিসঃ ব্যাটা চোর হলেও মানবিক ছিল। আচ্ছা রিক্সাওয়ালার কি অবস্থা?
তিহানঃ রিক্সা এবং রিক্সাওয়ালা আমি কাউকে দেখিনি।
আনিসঃ হুম! কয়টা বাজে দেখতো।
তিহানঃ ১০টা বাজে। কি খাবি বল।
আনিসঃ শীট্! ও এতক্ষণে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে।
তিহানঃ কার কথা বলছিস? আচ্ছা জ্বর নিয়ে এত ভোরে বেরিয়েছিলি কেনো আজ?
আনিস তিহানকে সব বলল। শুনে তিহান বলল-
"তুই আমাকে বলতি। আমি সহ বেরুতাম। এই নে আমার মোবাইল থেকে ফোন দে ওকে। কথা বল।"
অবন্তিকে ফোন দেয়াতো দূরে থাক আনিস তিহানের মোবাইলটা ধরার আগ্রহও দেখালোনা।
তিহানঃ কিরে কথা বলবিনা অবন্তির সাথে?
আনিসঃ না।
তিহানঃ কেনো?
আনিসঃ অবন্তি নিজ থেকেই চাচ্ছেনা আমার সাথে থাকতে। আমি সিউর।
তিহানঃ বোকার মত কথা বলিস না।
আনিসঃ তা ই যদি না হত। তাহলে কেনো গতকাল সন্ধ্যা থেকে ওর কোনো খোঁজ নেই! কেনো কোনো ধরণের যোগাযোগই করছেনা আমার সাথে?
তিহানঃ তুই করেছিলি যোগাযোগ?
আনিসঃ আমারতো মন মেজাজ খারাপ করে দিয়েছিল ওর বাবা। তার উপর জ্বরে মরেছি সারারাত। আমার এমন অবস্থায় আমি কি আশা করতে পারিনা যে অবন্তি আমার খোঁজ নিবে, টেক কেয়ার করবে!
তিহানঃ মান অভিমান সেতো হৃদয়েরই টান। এত অভিমান করে থাকলে হয়, পাগলা!
আনিসঃ দেখ সব ভুলে গিয়ে ভোর বেলা আমিতো ওকে দেখার জন্য, ওর সাথে কথা বলার জন্যই বেরিয়েছিলাম। মাঝপথে একটা দুর্ঘটনার স্বীকার হলাম। ও ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে এক ঘন্টা হল। অথচ দেখ একবারের জন্যও আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করলোনা। ওর এমন আচরণে কি বুঝা যায়না যে ও আর আমাকে চায়না?
তিহানঃ বুঝলাম। এমনওতো হতে পারে তুই যেমন রাগ করে আছিস, অবন্তিও ঠিক তেমনি রাগ করে আছে?
আনিসঃ হতে পারে। শুধু শুধু রাগ করাটা ওর অভ্যাস, যা আমার এখন আর ভালো লাগেনা। দেখি কত দিন রাগ করে থাকতে পারে।
আনিস কিছুদিন পর যখন একটু সুস্থ হল, জানতে পারলো অবন্তির বিয়ে হয়ে গেছে। এই ভূগর্ভে এর আগে আনিস কখনো এমন কঠিন এবং কষ্টের সম্মুখীন হয়নি। আনিসের পৃথিবীজুড়ে রিখটার স্কেল এর সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়েও কয়েক গুন বেশি মাত্রার কম্পন হলো, যার স্থিতিকাল ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। তাতেই আনিসের সব স্বাভাবিকতা ধুমড়ে মুচড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল।
দীর্ঘদিনের সুন্দর এবং মধুর একটা সম্পর্ক শুধু মাত্র ইগো আর মাত্রাতিরিক্ত অভিমানের ফলে খুব সজেই শেষ হয়ে গেল। বিনিময়ে পৃথিবী পেল তিনজন অসুখী মানুষ।
পৃথিবী এমনটার পুনরাবৃত্তি আর চায়না।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৩/১০/২০১৮ভাল লাগল।