রহস্যময় চুরি
রোববারে বিকেলবেলায় সবে চেম্বার খুলে আমি আর অর্ক দুজনে বসে দাবার বোর্ডের ঘুঁটি সাজাচ্ছি এমন সময়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ভদ্রদার আগমন । ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই টেবিলে রাখা জগটা তুলে কিছুটা জল গলাধঃকরণ করে আর কিছুটা নিজের উর্দিকে খাইয়ে সোফায় ধপ করে বসে বললেন - কেলো হয়েছে মশায়, এবারে একেবারে খোদ পুলিশের বাড়িতেই চুরি! আমরা অবাক হয়ে তাকাতেই বললেন, এই নিয়ে গোটা দশটা চুরির কেস হয়ে গেল কলকাতায় আর কাল রাত্রে তো খোদ আমাদের সার্কেল ইন্সপেক্টরের বাড়িতে গড়িয়ায়। আমি তো শুনে থ! শেষমেশ কিনা পুলিশের বাড়িতেও। হেসে বললাম, বড্ড জালাচ্ছে তো এই চোর বাবাজী। মনে মনে ভদ্রদার অবস্থা বুঝে হাসিও পাচ্ছিল খুব। অর্ক বলল খবরের কাগজে দেখেছি, প্রতিবার চুরির ধরণ একইরকম। গৃহস্থেরা বাড়িতে না থাকায়, ফাঁকা বাড়িতে মনের আনন্দে চুরি করে সব সাবাড় করে দিচ্ছে এই চোর বা চোরের দল। কিন্তু আপনাদের পুলিশ মহল কি করেছে এব্যাপারে?
জবাবে ভদ্রদা চোখ-মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন কি বলব মশায়? শুধু যদি চুরি হত, তো মানা যেত, সে আবার পুলিশকে চ্যালেঞ্জও করছে প্রতিটা চুরির পর। সব বাড়িতেই চুরি করে ইংরাজী “F” অক্ষর লিখে রেখে আসছে ঘরের দেওয়ালে, আয়নার কাঁচে। প্রথমে ভেবেছিলাম নগন্য চোর, যেখানে চুরি হচ্ছে তার আশে পাশে প্রতিটা জায়গায় রাত পাহারাও জোরদার করা হয়েছে। কোথাও না কোথাও চুরি করতে গিয়ে ধরা তো পড়বেই। কিন্তু কোথায় কি ? বুঝুন সাহস, এইবারে একেবারে মৌমাছির চা’কে ঢিল মেরেছে। এ চোর কোন সাধারণ চোর নয়। ঘাট হয়েছে মশায়, এবারে আপনি কিছু করুন, না হলে চাকরীটা আর বাঁচবে না।
অর্ক কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, চলুন আপনাদের ইন্সপেক্টরের বাড়ি ঘুরে আসি। চল মৈনাক, একবার এই চোরের কাণ্ড-কারখানা স্বচক্ষে দেখে আসি। আচ্ছা, আপনাদের সেই ইন্সপেক্টরের বাড়িও কি খালি ছিল? জবাবে ভদ্রদা বললেন - হ্যাঁ, ওনারাও এই গরমের ছুটিতে ঘুরতে গিয়েছিলেন পরিবারের সকলকে নিয়ে। গতকাল রাত্রে বাড়িতে ফিরে দেখেছেন এই কান্ড। অর্ক হুম বলে একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে উঠে পড়ল আর সাথে সাথে আমরাও।
একঘন্টা পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে, দেখি পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, ঘর একেবারে লন্ডভন্ড, আলমারীর তালা ভাঙ্গা, সব নিয়ে গেছে মালুম হল। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখি বড় করে লিপস্টিক দিয়ে ইংরাজী বড় হাতের “F” অক্ষর লেখা। অর্ককে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে একমনে সেটা দেখে একটা ছবি, নিজের ফোনে তুলে নিয়ে আমায় বলল, চল এবারে আমরা যাই। বেরোবার আগে ভদ্রদাকে বলল, এর আগে যে নয় জায়গায় চুরি হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটার ও বাড়ির মালিক ও পরিবারের অন্যান্য লোকেদের খুঁটিনাটি ডিটেলস, আর এই প্রতি জায়গায় দেওয়া এই চিহ্নটার ছবিগুলো আমাকে দিয়ে যান আজ রাত্রের মধ্যেই। আমি প্রতিটা মিলিয়ে দেখতে চাই। ওখান থেকে বেরিয়ে দুজনেই দুজনার আমার বাড়ি চলে এলাম। রাত্রে অর্ক ফোনে কনফার্ম করল, ভদ্রদা সবকটা ফাইলই ফোটোকপি করে ওকে দিয়ে গেছে গতকাল গভীর রাত্রে।
এরমধ্যে দুদিন কেটে গেছে আমিও অফিসের কাজের চাপে ও’মুখো আর হতে পারি নি, এমন সময়ে অর্কর ফোন পেলাম। ফোন ধরতেই বলল, আজকে একবার চেম্বারে আসিস, কথা আছে। আমি তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ শেষ হওয়ার পরে সোজা চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পৌঁছে দেখি, ভদ্রদাও হাজির, সাথে আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মচারী ও সেই সার্কেল ইন্সপেক্টর। আমাকে দেখে অর্ক আমার উদ্দেশ্যে বলল, মৈনাক, তোদের বেলগাছিয়ার বাড়িটা তো ফাঁকাই আছে না? আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে, ও বলল, তোদের বাড়িটা দুদিনের জন্য লাগবে। একটা টোপ ফেলব। আমি চমকে উঠে বললাম, মানে ? ও হেসে ফেলে বলল, নো টেনশন মানিকচাঁদ, আমরাই থাকব, ভয়ের কিছু নেই। খালি তোর একটু সাহায্য লাগবে। আজকেই আমার সাথে স্টুডিওতে গিয়ে ঝটপট কটা ছবি তুলে নিতে হবে তোর। শুনে আমার অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
যেমন বলা তেমন কাজ, দুজনেই পাড়া থেকে বাইরে বেরিয়ে একটু দূরের স্টুডিওতে ছবি তুলতে গেলাম। পৌঁছে দেখলাম ওখানে আগে থেকেই, আরো দুজন ভদ্রমহিলা, একজন বয়স্ক বাবাগোছের লোক ও দুজন বাচ্চা সমেত একটা গোটা পরিবার আগে থেকেই রয়েছে। আমরা যেতেই তারাও উঠে দাঁড়ালেন, অর্কের কথাতে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হল না, আমাকে এদের মধ্যে মিশিয়ে ফ্যামিলি ছবি তোলানো হল, কখনো আমি, আবার কখনো আমার সাথে আমার স্ত্রী, আমার বাবা-মা, ও আমার বাচ্চা সাজিয়ে। ছবিও তোলা হল বেশ কায়দা করে, পেছনে কখনো বরফের দৃশ্য, কখনো পাহাড়ের, কখনো নদীর, এরকম করে গোটা সাত-আট ছবি তোলার পরে অর্ক ক্ষান্ত দিল। শীতবস্ত্রও দেখি স্টুডিওতে হাজির। সেগুলো পড়ে ছবি তোলা হলে অর্ক হাত তুলে বলল, থেমে যেতে। সব হয়ে গেলে সবাই যে যার মত চলে গেল, আর পড়ে রইলাম শুধু আমি। আমার মাথা কাজ করছিল না, চোর ধরতে গিয়ে আমার বাড়িটাকে বলি, তাও মানতে পারছিলাম, কিন্তু শেষমেশ আমাকেও ! চোর ধরতে গিয়ে আমার এইসমস্ত ছবি কি কাজে লাগবে তা মাথা কুটেও ভেবে পেলাম না, আবার এটাও জানি এখন ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে, কিছুতেই কোন উত্তর পাওয়া যাবে না, আর তাই শুধু ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুই কি বুঝতে পেরেছিস কে বা কারা এর পিছনে আছে ?
অর্ক আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার উপরে বিশ্বাস রাখ, আশা করি পরে তোকে সব বুঝিয়ে বলার সময় পাব।
পরের দিন রাত থেকেই আমাদের অপারেশন শুরু হল, সারা দিন বাড়ির বাইরেটা সাদা পোশাকের পুলিশ ও বাড়ির চারদিকে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে নজর রাখা হচ্ছিল, আর রাত্রি আটটার মধ্যে আমি, অর্ক, ভদ্রদা ও আরো দুজন পুলিশ কন্সটেবল, মোট পাঁচজন বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ভিতরে শুধু নাইটবাল্বগুলো জ্বলছিল। হালকা আলোতে পরস্পরের সাথে ফিসফিস করে যোগাযোগ রাখছিলাম। কিন্তু সারাটারাত মশা মারা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না। দ্বিতীয়দিনও একই ব্যবস্থা। সেদিনকে অর্ক দৃঢ়ভাবে বলল, চোর আসলে আজকেই আসবে নয়ত নয়। সেদিনও প্রায় রাত কাবার হওয়ার যোগাড়, এমন সময়ে ঘড়িতে তখন প্রায়, সাড়ে তিনটে বাজে, মনে হল যেন ঘরের বাইরের দরজাটায় খুটখুট করে আওয়াজ হচ্ছে, কেউ সেটার লক ভাঙ্গার চেষ্টা করে চলেছে। সাথে সাথেই ভদ্রদার পকেটে ভাইব্রেটে থাকা মোবাইলে মেসেজ এল “ঘরে দুজন ঢোকার চেষ্টা করছে, সতর্ক থাকুন”। ভদ্রদা মেসেজটা আমাদের সকলকে দেখিয়েই ফোনটা আবার পকেটে চালান করে দিল। অর্ক সকলকে হাতের ইশারায় চুপ করে থাকতে বলে অন্ধকারে মিশে গেল। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম দুজন ঘরে ঢুকে পড়ল, নিঃশব্দে হাতের কাজ সারা শুরু করল। মিনিট পনেরো থেকে কুড়ির মধ্যে, আলমারী, ড্রয়ার সব খুলে যখন বিশেষ কিছু পেল না, দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে বুঝে বেরিয়ে যাবার মনস্থির করে ফেলল। একজন এগিয়ে গেল বাইরের দিকে আর একজন একটা পেনের মতো কিছু বার করে দেওয়ালে ইংরাজী “F” অক্ষর লেখা শুরু করে দিল, লেখা যখন প্রায় শেষ, অর্ক বাঘের মত ক্ষিপ্র গতিতে তার পিঠের উপরে ঝাপিয়ে পড়ল। এক ঘুষিতে তাকে কাত করতেই আমরাও বেড়িয়ে এলাম আর দরজা খুলে অপরজনকে ধরতে যাওয়ার আগেই দেখলাম সার্কেল ইন্সপেক্টর অপরজনকে সাথে করে নিয়ে ঘরের ভিতরেই ঢুকলেন।
পুলিশের হাতে ধরা পড়ে একেবারে ভেজা বেড়ালরের মত অবস্থা চোরবাবাজীদের। ঘরেই আলো জ্বালিয়ে তাদেরকে একটা সোফাতে বসিয়ে, আমরা অপরদিকের সোফা, টেবিল ও চেয়ারে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে বসলাম। অর্কই শুরু করল, মহাপ্রভুদ্বয়, আপনাদের লীলা খতম। অনেক দৌড় করিয়েছেন পুলিশকে। আমার উদ্দেশ্য সফল, আপনাদের হাতেনাতে ধরার দরকার ছিল, সহজে প্রমাণ করার জন্য। আর তাই এই টোপটা আমিই সাজিয়েছিলাম আপনাদের শ্রীঘরে পোরার জন্য।
আমি মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললাম, এবারে কি তুই পুরোটা গুছিয়ে বলবি? অর্ক হেসে বলল, হ্যাঁ, বলছি। তারপর সার্কেল ইন্সপেক্টর ও ভদ্রদার দিকে তাকিয়ে বলল, আমায় ক্ষমা করবেন, কিন্তু আপনারা ও আপনাদের পুলিশের কর্তারা প্রথমেই ভুল করেছিলেন এনাদেরকে সাধারণ চোর ভেবে, আসলে এরা, অসাধারণ বা আরো ভালো করে বললে হাইটেক চোর। ভদ্রদার দেওয়া সমস্ত ফাইল ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, যে যখন সকলে বাড়িতে থাকছে না, অর্থাৎ পুরোবাড়ি ফাঁকা, সেই সুযোগে, দু’এক দিনের মধ্যেই চুরিটা করে ফেলা হচ্ছে। কোন সিস্টেম্যাটিক ভাবে না হলেও চুরিটা হচ্ছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম না কি ভাবে এরা সেই খবরটা পাচ্ছে ? লিঙ্কটা ঠিক ধরতে পাচ্ছিলাম না । অনেক ভেবে শেষে চিহ্নটার দিকে নজর ফেরালাম। সবকটা ছবি হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। প্রতিটা “F”ই বড় হাতের লেখা কিন্তু বিভিন্ন স্টাইলে, কিন্তু একজায়গায় ছোট হাতে লেখা। বোধহয় একবার ইচ্ছে করে অথবা মনের ভুলে ছোট হাতের অক্ষর লিখে ফেলেছিলেন ওনারা। আর হঠাৎ করে ছোটহাতের অক্ষরটা দেখেই আমার ফেসবুকের লোগোর কথা মনে পড়ে গেল আর সাথে সাথে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। ভদ্রদাকে ফোন করে যাদের বাড়ি চুরি হয়েছে, তাদের সকলের ফেসবুকের আই ডি আনালাম। প্রত্যেকের প্রোফাইল মিলিয়ে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম আর তাতেই বুঝলাম প্রতিটা বাড়ির কর্তা বা কর্ত্রীদের ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট পোস্ট দেখেই এরা খবর সংগ্রহ করছে যে কারা কবে পুরো ফ্যামিলি সমেত বাড়িতে থাকছে না !
ভদ্রদা চমকে উঠে বললেন, কি বলছেন অর্কবাবু ? এটা কি ভাবে সম্ভব ? কি ভাবেই বা আপনি বুঝতে পারলেন ?
জবাবে অর্ক শান্ত স্বরে বলে উঠল, বলছি ভদ্রদা, আমি যখন প্রত্যেকের ফেসবুক প্রোফাইল ঘাঁটছিলাম, তখনই দেখেছি, এনারা সকলেই, এবং এমন কি, ইন্সপেক্টরসাহেবও পরিবারের সকলের ছবির সাথে সাথে স্ট্যাটাস আপডেট পোস্ট করেছেন “এনজয়িং হলিডে, উইথ অল ফ্যামিলি মেম্বার অ্যাট লাদাখ !” আর তারপরে আমি এদের প্রত্যেকের সাথে কমন পোস্ট ও লাইক দেখলাম মাত্র দুজনার। এরা দুজনেই প্রথমে ফেসবুকে সার্চ করে দেখে কে কোথায় ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে গেছে, আর তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় বা পোস্টে লাইক ও মেসেজ করে জানান দেয় প্রথমে যে ঐ জায়গাটা তাদেরও খুব ফেভারিট। স্বভাবতই যে ঘুরতে গেছে, সেও এনাদের কমেন্ট দেখে খুব খুশী হয়, এবং তারপরে এরা জেনে নেয় কোথায় বাড়ি, কবে ঘুরতে গেছে, কবে ফিরবে এইসব খুঁটিনাটি ব্যাপার। আবার সাজেশনও দেয় – “ঐ জায়গাটা মিস করবেন না কিন্তু, বাবা-মাকে নিয়ে ওইখানে ফটো তুলবেন, আমি মিস করেছি” এইসব। এইভাবে খুব সহজেই সকলের সাথে মিশে যায় ও তারপরে রাত্রে নিজেদের অপারেশন শুরু করে। আমার দেখে সন্দেহ হল, কি ব্যাপার, যাদের বাড়িতে চুরি হয়েছে, তাদের সকলের সাথেই এনাদের পরিচয় আছে ? এনারাই শুধু কমন ফ্যাক্টর।
বুঝতে অসুবিধা হল না যে এই দুজনাই আছেন এর পিছনে, তাই ওনাদের নিজেদের প্রোফাইল দেখেই বুঝলাম দুজনে দুজনার ফ্রেন্ড। পুলিশের সাহায্যে ফেসবুকের কাছ থেকে এনাদের নিজেদের মেসেঞ্জ্যারের মেসেজগুলো পড়ে আরো সুনিশ্চিত হলাম। তবে নামগুলো জাল বলেই মনে হল আর তাই তোর একটা ফেক ফেসবুক আইডি বানিয়ে ছবি তুলিয়ে পোস্ট করে দিলাম এমনভাবে যাতে বাছাধনদের নজরে পড়ে। যেমন বুনো ওল হবে, বাঘা তেঁতুলকেও তো তেমনি হতে হবে নাকি ! কাল রাত্রে এনারা যে সরেজমিনে এখান থেকে ঘুরে গেছে তাও এনাদের নিজস্ব মেসেঞ্জ্যারের মেসেজ থেকে আজকে সকালে পড়ে ফেলেছি আর তাই নিশ্চিত ছিলাম আজকেই ওনারা আসবেন পদধূলি দিতে। দিনের বেলায় ফেসবুক ও ইন্টারনেট স্যাভি আর আর এদিকে রাতের আঁধারে খবর সংগ্রহ করে বাড়ি খুঁজে অপারেশন শুরু করে দেয়। সাথে মাস্টার কী, বা লকব্রেকার যাতীয় কিছু আছে, তাই দিয়েই একেবারে প্রফেশনালি চুরি করেই চম্পট। নে এবারে বল কি বলবি এনাদের তুই? ওনাদের নিজেদেরও ধারণা ছিল, কেউ ধরতে পারবে না, কারণ এক জায়গায় কখনো চুরি করত না এরা। এরা চুরি করত বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলো ভাবে। পুলিশও তাই খাবি খাচ্ছিল। আর এনারা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, পুলিশের দিকে, ঐ অক্ষরটা দিয়ে। আমি প্রথম থেকেই ভেবেছিলাম কিছু একটা যোগসূত্র এটাতে আছে, কিন্তু সেটা যা ফেসবুক হবে তা বুঝতে পারিনি প্রথমে। ঐ এক জায়গায় ভুল করে ছোটহাতে লেখাটাই কাল হয়ে গেল ওনাদের।
সকাল হতেই ভদ্রদা দুজনকেই হাতকড়া পরিয়ে, নিয়ে চলে গেলেন বলতে বলতে, এবারে চল, জেলে বসে বসে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দিও বাছাধনেরা। ওনার পেছনে পেছনে আমরাও বেরোলাম। সার্কেল ইন্সপেক্টর অর্ক ও আমার সাথে হাত মিলিয়ে ও ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন। ফাঁকা হতেই জিজ্ঞাসা করলাম ওকে, ভাই আমার যে ফেক আইডিটা খুললি, তার কি হবে ? অর্ক, বলল, হ্যাঁ আজকেই বন্ধ করে দেব। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, যাক বাবা, চোর ধরা পরে গেছে, বাঁচা গেল।
কথাটা শুনে অর্ক দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বলল, না মোটেও বাঁচা গেল না। সতর্ক হওয়া গেল। কারণ এরকম কত চোর চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে জানিস ? দুজন ধরা পড়েছে মানে এই নয় আর কেউ শুরু করবে না ! তার চেয়ে আমরা বরং এবার এধরনের স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়া বন্ধ করি। এটা অনেক বেশী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা একবারও ভেবে দেখি না, নিজেরাই কি ভাবে নিজের ও পরিবারের বিপদ ডেকে আনছি এসব করে। কি দরকার তোদের, নিজের ও পরিবারের ব্যক্তিগত সব তথ্য ও ছবি এই সব সোশালমিডিয়ার মাধ্যমে অপরের হাতে তুলে দেওয়ার, বুঝি না বাপু ! শেষের কথাটা যে আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলা, তা আর বুঝতে অসুবিধা হল না। কারণ আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এরকম প্রচুর পোস্টের ছড়াছড়ি। আমি মনে মনে ঠিক করে নিলাম আজকেই সমস্ত ছবি আর ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুক থেকে ডিলিট করে দেব।
জবাবে ভদ্রদা চোখ-মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন কি বলব মশায়? শুধু যদি চুরি হত, তো মানা যেত, সে আবার পুলিশকে চ্যালেঞ্জও করছে প্রতিটা চুরির পর। সব বাড়িতেই চুরি করে ইংরাজী “F” অক্ষর লিখে রেখে আসছে ঘরের দেওয়ালে, আয়নার কাঁচে। প্রথমে ভেবেছিলাম নগন্য চোর, যেখানে চুরি হচ্ছে তার আশে পাশে প্রতিটা জায়গায় রাত পাহারাও জোরদার করা হয়েছে। কোথাও না কোথাও চুরি করতে গিয়ে ধরা তো পড়বেই। কিন্তু কোথায় কি ? বুঝুন সাহস, এইবারে একেবারে মৌমাছির চা’কে ঢিল মেরেছে। এ চোর কোন সাধারণ চোর নয়। ঘাট হয়েছে মশায়, এবারে আপনি কিছু করুন, না হলে চাকরীটা আর বাঁচবে না।
অর্ক কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, চলুন আপনাদের ইন্সপেক্টরের বাড়ি ঘুরে আসি। চল মৈনাক, একবার এই চোরের কাণ্ড-কারখানা স্বচক্ষে দেখে আসি। আচ্ছা, আপনাদের সেই ইন্সপেক্টরের বাড়িও কি খালি ছিল? জবাবে ভদ্রদা বললেন - হ্যাঁ, ওনারাও এই গরমের ছুটিতে ঘুরতে গিয়েছিলেন পরিবারের সকলকে নিয়ে। গতকাল রাত্রে বাড়িতে ফিরে দেখেছেন এই কান্ড। অর্ক হুম বলে একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে উঠে পড়ল আর সাথে সাথে আমরাও।
একঘন্টা পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে, দেখি পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, ঘর একেবারে লন্ডভন্ড, আলমারীর তালা ভাঙ্গা, সব নিয়ে গেছে মালুম হল। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখি বড় করে লিপস্টিক দিয়ে ইংরাজী বড় হাতের “F” অক্ষর লেখা। অর্ককে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে একমনে সেটা দেখে একটা ছবি, নিজের ফোনে তুলে নিয়ে আমায় বলল, চল এবারে আমরা যাই। বেরোবার আগে ভদ্রদাকে বলল, এর আগে যে নয় জায়গায় চুরি হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটার ও বাড়ির মালিক ও পরিবারের অন্যান্য লোকেদের খুঁটিনাটি ডিটেলস, আর এই প্রতি জায়গায় দেওয়া এই চিহ্নটার ছবিগুলো আমাকে দিয়ে যান আজ রাত্রের মধ্যেই। আমি প্রতিটা মিলিয়ে দেখতে চাই। ওখান থেকে বেরিয়ে দুজনেই দুজনার আমার বাড়ি চলে এলাম। রাত্রে অর্ক ফোনে কনফার্ম করল, ভদ্রদা সবকটা ফাইলই ফোটোকপি করে ওকে দিয়ে গেছে গতকাল গভীর রাত্রে।
এরমধ্যে দুদিন কেটে গেছে আমিও অফিসের কাজের চাপে ও’মুখো আর হতে পারি নি, এমন সময়ে অর্কর ফোন পেলাম। ফোন ধরতেই বলল, আজকে একবার চেম্বারে আসিস, কথা আছে। আমি তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ শেষ হওয়ার পরে সোজা চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পৌঁছে দেখি, ভদ্রদাও হাজির, সাথে আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মচারী ও সেই সার্কেল ইন্সপেক্টর। আমাকে দেখে অর্ক আমার উদ্দেশ্যে বলল, মৈনাক, তোদের বেলগাছিয়ার বাড়িটা তো ফাঁকাই আছে না? আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে, ও বলল, তোদের বাড়িটা দুদিনের জন্য লাগবে। একটা টোপ ফেলব। আমি চমকে উঠে বললাম, মানে ? ও হেসে ফেলে বলল, নো টেনশন মানিকচাঁদ, আমরাই থাকব, ভয়ের কিছু নেই। খালি তোর একটু সাহায্য লাগবে। আজকেই আমার সাথে স্টুডিওতে গিয়ে ঝটপট কটা ছবি তুলে নিতে হবে তোর। শুনে আমার অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
যেমন বলা তেমন কাজ, দুজনেই পাড়া থেকে বাইরে বেরিয়ে একটু দূরের স্টুডিওতে ছবি তুলতে গেলাম। পৌঁছে দেখলাম ওখানে আগে থেকেই, আরো দুজন ভদ্রমহিলা, একজন বয়স্ক বাবাগোছের লোক ও দুজন বাচ্চা সমেত একটা গোটা পরিবার আগে থেকেই রয়েছে। আমরা যেতেই তারাও উঠে দাঁড়ালেন, অর্কের কথাতে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হল না, আমাকে এদের মধ্যে মিশিয়ে ফ্যামিলি ছবি তোলানো হল, কখনো আমি, আবার কখনো আমার সাথে আমার স্ত্রী, আমার বাবা-মা, ও আমার বাচ্চা সাজিয়ে। ছবিও তোলা হল বেশ কায়দা করে, পেছনে কখনো বরফের দৃশ্য, কখনো পাহাড়ের, কখনো নদীর, এরকম করে গোটা সাত-আট ছবি তোলার পরে অর্ক ক্ষান্ত দিল। শীতবস্ত্রও দেখি স্টুডিওতে হাজির। সেগুলো পড়ে ছবি তোলা হলে অর্ক হাত তুলে বলল, থেমে যেতে। সব হয়ে গেলে সবাই যে যার মত চলে গেল, আর পড়ে রইলাম শুধু আমি। আমার মাথা কাজ করছিল না, চোর ধরতে গিয়ে আমার বাড়িটাকে বলি, তাও মানতে পারছিলাম, কিন্তু শেষমেশ আমাকেও ! চোর ধরতে গিয়ে আমার এইসমস্ত ছবি কি কাজে লাগবে তা মাথা কুটেও ভেবে পেলাম না, আবার এটাও জানি এখন ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে, কিছুতেই কোন উত্তর পাওয়া যাবে না, আর তাই শুধু ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুই কি বুঝতে পেরেছিস কে বা কারা এর পিছনে আছে ?
অর্ক আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার উপরে বিশ্বাস রাখ, আশা করি পরে তোকে সব বুঝিয়ে বলার সময় পাব।
পরের দিন রাত থেকেই আমাদের অপারেশন শুরু হল, সারা দিন বাড়ির বাইরেটা সাদা পোশাকের পুলিশ ও বাড়ির চারদিকে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে নজর রাখা হচ্ছিল, আর রাত্রি আটটার মধ্যে আমি, অর্ক, ভদ্রদা ও আরো দুজন পুলিশ কন্সটেবল, মোট পাঁচজন বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ভিতরে শুধু নাইটবাল্বগুলো জ্বলছিল। হালকা আলোতে পরস্পরের সাথে ফিসফিস করে যোগাযোগ রাখছিলাম। কিন্তু সারাটারাত মশা মারা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না। দ্বিতীয়দিনও একই ব্যবস্থা। সেদিনকে অর্ক দৃঢ়ভাবে বলল, চোর আসলে আজকেই আসবে নয়ত নয়। সেদিনও প্রায় রাত কাবার হওয়ার যোগাড়, এমন সময়ে ঘড়িতে তখন প্রায়, সাড়ে তিনটে বাজে, মনে হল যেন ঘরের বাইরের দরজাটায় খুটখুট করে আওয়াজ হচ্ছে, কেউ সেটার লক ভাঙ্গার চেষ্টা করে চলেছে। সাথে সাথেই ভদ্রদার পকেটে ভাইব্রেটে থাকা মোবাইলে মেসেজ এল “ঘরে দুজন ঢোকার চেষ্টা করছে, সতর্ক থাকুন”। ভদ্রদা মেসেজটা আমাদের সকলকে দেখিয়েই ফোনটা আবার পকেটে চালান করে দিল। অর্ক সকলকে হাতের ইশারায় চুপ করে থাকতে বলে অন্ধকারে মিশে গেল। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম দুজন ঘরে ঢুকে পড়ল, নিঃশব্দে হাতের কাজ সারা শুরু করল। মিনিট পনেরো থেকে কুড়ির মধ্যে, আলমারী, ড্রয়ার সব খুলে যখন বিশেষ কিছু পেল না, দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে বুঝে বেরিয়ে যাবার মনস্থির করে ফেলল। একজন এগিয়ে গেল বাইরের দিকে আর একজন একটা পেনের মতো কিছু বার করে দেওয়ালে ইংরাজী “F” অক্ষর লেখা শুরু করে দিল, লেখা যখন প্রায় শেষ, অর্ক বাঘের মত ক্ষিপ্র গতিতে তার পিঠের উপরে ঝাপিয়ে পড়ল। এক ঘুষিতে তাকে কাত করতেই আমরাও বেড়িয়ে এলাম আর দরজা খুলে অপরজনকে ধরতে যাওয়ার আগেই দেখলাম সার্কেল ইন্সপেক্টর অপরজনকে সাথে করে নিয়ে ঘরের ভিতরেই ঢুকলেন।
পুলিশের হাতে ধরা পড়ে একেবারে ভেজা বেড়ালরের মত অবস্থা চোরবাবাজীদের। ঘরেই আলো জ্বালিয়ে তাদেরকে একটা সোফাতে বসিয়ে, আমরা অপরদিকের সোফা, টেবিল ও চেয়ারে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে বসলাম। অর্কই শুরু করল, মহাপ্রভুদ্বয়, আপনাদের লীলা খতম। অনেক দৌড় করিয়েছেন পুলিশকে। আমার উদ্দেশ্য সফল, আপনাদের হাতেনাতে ধরার দরকার ছিল, সহজে প্রমাণ করার জন্য। আর তাই এই টোপটা আমিই সাজিয়েছিলাম আপনাদের শ্রীঘরে পোরার জন্য।
আমি মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললাম, এবারে কি তুই পুরোটা গুছিয়ে বলবি? অর্ক হেসে বলল, হ্যাঁ, বলছি। তারপর সার্কেল ইন্সপেক্টর ও ভদ্রদার দিকে তাকিয়ে বলল, আমায় ক্ষমা করবেন, কিন্তু আপনারা ও আপনাদের পুলিশের কর্তারা প্রথমেই ভুল করেছিলেন এনাদেরকে সাধারণ চোর ভেবে, আসলে এরা, অসাধারণ বা আরো ভালো করে বললে হাইটেক চোর। ভদ্রদার দেওয়া সমস্ত ফাইল ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, যে যখন সকলে বাড়িতে থাকছে না, অর্থাৎ পুরোবাড়ি ফাঁকা, সেই সুযোগে, দু’এক দিনের মধ্যেই চুরিটা করে ফেলা হচ্ছে। কোন সিস্টেম্যাটিক ভাবে না হলেও চুরিটা হচ্ছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম না কি ভাবে এরা সেই খবরটা পাচ্ছে ? লিঙ্কটা ঠিক ধরতে পাচ্ছিলাম না । অনেক ভেবে শেষে চিহ্নটার দিকে নজর ফেরালাম। সবকটা ছবি হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। প্রতিটা “F”ই বড় হাতের লেখা কিন্তু বিভিন্ন স্টাইলে, কিন্তু একজায়গায় ছোট হাতে লেখা। বোধহয় একবার ইচ্ছে করে অথবা মনের ভুলে ছোট হাতের অক্ষর লিখে ফেলেছিলেন ওনারা। আর হঠাৎ করে ছোটহাতের অক্ষরটা দেখেই আমার ফেসবুকের লোগোর কথা মনে পড়ে গেল আর সাথে সাথে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। ভদ্রদাকে ফোন করে যাদের বাড়ি চুরি হয়েছে, তাদের সকলের ফেসবুকের আই ডি আনালাম। প্রত্যেকের প্রোফাইল মিলিয়ে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম আর তাতেই বুঝলাম প্রতিটা বাড়ির কর্তা বা কর্ত্রীদের ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট পোস্ট দেখেই এরা খবর সংগ্রহ করছে যে কারা কবে পুরো ফ্যামিলি সমেত বাড়িতে থাকছে না !
ভদ্রদা চমকে উঠে বললেন, কি বলছেন অর্কবাবু ? এটা কি ভাবে সম্ভব ? কি ভাবেই বা আপনি বুঝতে পারলেন ?
জবাবে অর্ক শান্ত স্বরে বলে উঠল, বলছি ভদ্রদা, আমি যখন প্রত্যেকের ফেসবুক প্রোফাইল ঘাঁটছিলাম, তখনই দেখেছি, এনারা সকলেই, এবং এমন কি, ইন্সপেক্টরসাহেবও পরিবারের সকলের ছবির সাথে সাথে স্ট্যাটাস আপডেট পোস্ট করেছেন “এনজয়িং হলিডে, উইথ অল ফ্যামিলি মেম্বার অ্যাট লাদাখ !” আর তারপরে আমি এদের প্রত্যেকের সাথে কমন পোস্ট ও লাইক দেখলাম মাত্র দুজনার। এরা দুজনেই প্রথমে ফেসবুকে সার্চ করে দেখে কে কোথায় ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে গেছে, আর তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় বা পোস্টে লাইক ও মেসেজ করে জানান দেয় প্রথমে যে ঐ জায়গাটা তাদেরও খুব ফেভারিট। স্বভাবতই যে ঘুরতে গেছে, সেও এনাদের কমেন্ট দেখে খুব খুশী হয়, এবং তারপরে এরা জেনে নেয় কোথায় বাড়ি, কবে ঘুরতে গেছে, কবে ফিরবে এইসব খুঁটিনাটি ব্যাপার। আবার সাজেশনও দেয় – “ঐ জায়গাটা মিস করবেন না কিন্তু, বাবা-মাকে নিয়ে ওইখানে ফটো তুলবেন, আমি মিস করেছি” এইসব। এইভাবে খুব সহজেই সকলের সাথে মিশে যায় ও তারপরে রাত্রে নিজেদের অপারেশন শুরু করে। আমার দেখে সন্দেহ হল, কি ব্যাপার, যাদের বাড়িতে চুরি হয়েছে, তাদের সকলের সাথেই এনাদের পরিচয় আছে ? এনারাই শুধু কমন ফ্যাক্টর।
বুঝতে অসুবিধা হল না যে এই দুজনাই আছেন এর পিছনে, তাই ওনাদের নিজেদের প্রোফাইল দেখেই বুঝলাম দুজনে দুজনার ফ্রেন্ড। পুলিশের সাহায্যে ফেসবুকের কাছ থেকে এনাদের নিজেদের মেসেঞ্জ্যারের মেসেজগুলো পড়ে আরো সুনিশ্চিত হলাম। তবে নামগুলো জাল বলেই মনে হল আর তাই তোর একটা ফেক ফেসবুক আইডি বানিয়ে ছবি তুলিয়ে পোস্ট করে দিলাম এমনভাবে যাতে বাছাধনদের নজরে পড়ে। যেমন বুনো ওল হবে, বাঘা তেঁতুলকেও তো তেমনি হতে হবে নাকি ! কাল রাত্রে এনারা যে সরেজমিনে এখান থেকে ঘুরে গেছে তাও এনাদের নিজস্ব মেসেঞ্জ্যারের মেসেজ থেকে আজকে সকালে পড়ে ফেলেছি আর তাই নিশ্চিত ছিলাম আজকেই ওনারা আসবেন পদধূলি দিতে। দিনের বেলায় ফেসবুক ও ইন্টারনেট স্যাভি আর আর এদিকে রাতের আঁধারে খবর সংগ্রহ করে বাড়ি খুঁজে অপারেশন শুরু করে দেয়। সাথে মাস্টার কী, বা লকব্রেকার যাতীয় কিছু আছে, তাই দিয়েই একেবারে প্রফেশনালি চুরি করেই চম্পট। নে এবারে বল কি বলবি এনাদের তুই? ওনাদের নিজেদেরও ধারণা ছিল, কেউ ধরতে পারবে না, কারণ এক জায়গায় কখনো চুরি করত না এরা। এরা চুরি করত বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলো ভাবে। পুলিশও তাই খাবি খাচ্ছিল। আর এনারা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, পুলিশের দিকে, ঐ অক্ষরটা দিয়ে। আমি প্রথম থেকেই ভেবেছিলাম কিছু একটা যোগসূত্র এটাতে আছে, কিন্তু সেটা যা ফেসবুক হবে তা বুঝতে পারিনি প্রথমে। ঐ এক জায়গায় ভুল করে ছোটহাতে লেখাটাই কাল হয়ে গেল ওনাদের।
সকাল হতেই ভদ্রদা দুজনকেই হাতকড়া পরিয়ে, নিয়ে চলে গেলেন বলতে বলতে, এবারে চল, জেলে বসে বসে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দিও বাছাধনেরা। ওনার পেছনে পেছনে আমরাও বেরোলাম। সার্কেল ইন্সপেক্টর অর্ক ও আমার সাথে হাত মিলিয়ে ও ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন। ফাঁকা হতেই জিজ্ঞাসা করলাম ওকে, ভাই আমার যে ফেক আইডিটা খুললি, তার কি হবে ? অর্ক, বলল, হ্যাঁ আজকেই বন্ধ করে দেব। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, যাক বাবা, চোর ধরা পরে গেছে, বাঁচা গেল।
কথাটা শুনে অর্ক দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বলল, না মোটেও বাঁচা গেল না। সতর্ক হওয়া গেল। কারণ এরকম কত চোর চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে জানিস ? দুজন ধরা পড়েছে মানে এই নয় আর কেউ শুরু করবে না ! তার চেয়ে আমরা বরং এবার এধরনের স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়া বন্ধ করি। এটা অনেক বেশী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা একবারও ভেবে দেখি না, নিজেরাই কি ভাবে নিজের ও পরিবারের বিপদ ডেকে আনছি এসব করে। কি দরকার তোদের, নিজের ও পরিবারের ব্যক্তিগত সব তথ্য ও ছবি এই সব সোশালমিডিয়ার মাধ্যমে অপরের হাতে তুলে দেওয়ার, বুঝি না বাপু ! শেষের কথাটা যে আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলা, তা আর বুঝতে অসুবিধা হল না। কারণ আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এরকম প্রচুর পোস্টের ছড়াছড়ি। আমি মনে মনে ঠিক করে নিলাম আজকেই সমস্ত ছবি আর ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুক থেকে ডিলিট করে দেব।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ২৬/১১/২০১৬খুব ভালো লাগলো।
-
Saurav Goswami ০৯/০৬/২০১৬দারুন