স্বামী অদ্রীজানন্দ- ৫ম পর্ব (শেষ পর্ব)
( আগের সংখ্যার পরে )
অদ্রীজ হাত নেড়ে ইশারা করে বলল, সব বলব, পথে যেতে যেতে। কিছুক্ষণ পরে পরের সেশনটাও শেষ হয়ে গেল। অদ্রীজ তার দুজন অনুচরকে নিয়ে বেরিয়ে এল রুম থেকে। আমি আর পর্ণা বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম, ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অদ্রীজ ছেলেদুটোকে গাড়ি নিয়ে হোটেলে চলে যেতে নির্দেশ দিয়ে আমাদের কাছে চল, তোদের গাড়িতেই আমি হোটেলে যাব ।
গাড়িতে বসে, আমিই প্রথমে কথা শুরু করলাম, বললাম, বল এবারে শুনি, তোর এই তীর্থযাত্রার কথা, তুই তো পুরোপুরি ভোল বদলে সত্যি সত্যি যোগগুরু হয়ে গেছিস রে, অদ্রীজ? পর্না হেসে আমার কথার সমর্থন করল। অদ্রীজও সেই পুরোনো অট্টহাস্য করে বলল, দেখ এই হাসিটা কিন্তু একটুকুও বদলায়নি বসন্তবাবু... আমি কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মতবাদ নিয়েই চলেছি জীবনে। আসলে কি জানিস, মা মারা যাবার পর, আমিও একটু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হত ওই বাড়িটা যেন আমায় গিলে খেতে আসছে। একা থাকতে পারছিলাম না, আমি তাই ঠিক করলাম বাড়িটা ছেড়ে দেব, কিন্তু বেচব না, তাই শ্রীরামকৃষ্ণ সেবা সদনকে দানপত্রে লিখে দিলাম, কি করব, আমার তো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না, ততদিনে তোরা সবাই কলকাতায়। ভাবলাম আমিও কলকাতায় চলে যাই। তাই দান তো করে দিলাম, তবে বদলে কথা হল, ওরা আমাকে ওদের কলকাতার আশ্রমে থাকার যায়গা দেবে।
কলকাতায় এসে, ওদের আশ্রমে একটা মাথা গোঁজার যায়গা হল। ওখানকার স্বামীজীদের সাথে বেশ ভালো খাতিরও হয়ে গেল, প্রথম প্রথম বিভিন্ন রকম ফাই ফরমাশ খাটতাম, তোরা হয়ত জানিস না, আমার বাবা খুব ভালো যোগাসন করতে পারতেন, আর তার থেকেই আমিও যোগাসন শিখেছিলাম। ওখানে থাকতে থাকতে মাথায় আইডিয়া এলো, অবসর সময়ে যোগাসনটা চালিয়ে যাবার, কারণ আমি দেখেছিলাম আশ্রমে একটা যোগাসন সেণ্টার আছে, ওখানকার শিক্ষক হবার বাসনাটাই ছিল প্রধান। দীর্ঘ দু বছরের অধ্যাবসায়ের পরে স্বামীজীদের নজরেও পড়ে গেলাম, ওখানকার সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করলাম, হাতে কিছু হাতখরচাও আসতে লাগল। এই পয়সায়, আমি যোগ ও মেডিটেশনের উপরে বিভিন্ন বই কিনে পড়া শুরু করে দিলাম, শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পড়তে আরম্ভ করে দিলাম। কলকাতা ও তার ইতিহাস নিয়েও প্রচুর পড়াশুনো করলাম, কারণ হাতে সময় অঢেল। ভোর বেলায় উঠতে হত, প্রার্থণা করে বসে পড়তাম, আবার রাত্রে সন্ধ্যা থেকেই শুরু করে দিতাম। আশ্চর্য্যের ব্যাপার, কখনও নিরাশ হই নি, বরং, আরো বেশী পড়ার ক্ষুধা জন্মাত। সময় পেলে ওনাদের ফ্রী ইংরাজী ক্লাসেও গিয়ে বসে পড়তাম, কারণ আমি দেখেছিলাম, বিদেশী ভক্তের সংখ্যা প্রচুর, তার আসতেন, আর তাদের গাইড হিসাবে কলকাতা ও তার আশে পাশে ভ্রমণও করা যায়। আমার সে লক্ষ্যও পূরণ হল, চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই, আমি মোটামুটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলাম। তখনই হঠাৎ অঘটনটা ঘটল...।
অঘটন ? ...কিসের ? আমাদের দুজনের সমস্বর বিস্ময়! অদ্রীজ বলল, আসলে আমি ওটাকে, অঘটনই বলি, যার জন্য সেই তোদের অদ্রীজ আজ পুরো বদলে গেল। এক জন আমেরিকান ভক্তর সাথে আলাপ হয়েছিল, আমার কাছে যোগাসন শিখতেন এখানে আসলে, প্রতি বছরে প্রায় দুবার করে আসতেন। নাম–মিঃ ট্রেভর স্মিথ, খুব পয়সাওয়ালা লোক। একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পাসপোর্ট আছে কিনা, আমি না বলাতে আমাকে বললেন, যে, পাসপোর্ট করিয়ে নিতে। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, আমাকে ওনার খুব পছন্দ, তাই আমাকে উনি নিয়ে যেতে চান দুবাই। ওখানে ওনার নিজস্ব পাঁচতারা রিসর্ট ও স্পা আছে, ওনার ইচ্ছা আমি যদি ওখানে গিয়ে ওখানকার যোগা ও মেডিটেশন ডিভিশনের ম্যানেজার হিসাবে যোগ দিই। আমি তো শুনেই লাফিয়ে উঠলাম, কিন্তু বললেই তো আর হবে না, আগে স্বামীজীদের কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে, তারপরে আমি যা করার করতে পারব। স্বামীজীরা সব শুনে আমাকে বলল, ঠিক আছে তুমি পাসপোর্ট বানাতে দাও, আমরা দেখে জানাচ্ছি, ওনাদের দুবাইএর আশ্রম থেকে সব কিছু ভেরিফাই করে তবে আমাকে যাবার ছাড়পত্র দিলেন। দু মাসের মধ্যে আমার পাসপোর্ট এসে গেল, আর তার পনেরদিনে মধ্যেই আমার প্রথম বিমান যাত্রা টু দুবাই। এত অবধি বলে অদ্রীজ একটু দম নিল, আমি বলে উঠলাম-বাব্বা, এতো যেন সিনেমার গল্প শুনছি । পর্না বলে উঠল, এইজন্য বলে ভগবান আছে, যারা মানুষের ভালো করে তাদের ভালোও ভগবান করেন। আচ্ছা তারপর ?
অদ্রীজ বলল, তারপর আর কি, দুবাইতে চারবছর থাকলাম, পুরোপুরি প্রফেশনাল হয়ে গেলাম। তারপর সেখান থেকে নিয়মমাফিক ইন্টারভিউ দিয়ে, চলে গেলাম রাশিয়া, ওখানকার ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অফ মেডিটেশন ও যোগাতে লেকচারার ও স্পা-হেড হিসাবে। তারপর দুবছর অন্তর প্রমোশন- প্রথমে অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর ও পরে ডিরেক্টর। গত দুবছর ধরে আমি, লন্ডনের এই ইন্সটিটিউটে আছি ডিরেক্টর হিসাবে। এখন আমার কাজ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্থা, জায়গা, বা কর্পোরেট অফিসে গিয়ে যোগা ও মেডিটেশন সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়া, ভারতীয় যোগার এক মডিফায়েড রূপ, আমার করা রিসার্চের মাধমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া, যা আমার এই আশ্রমের অনুমদিত।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ভাই কি করেছিস? তুই তো বিশ্বজয় করেছিস রে? অদ্রীজ চোখ বন্ধ করে বলে উঠল, কতটা কি করেছি জানি না... তবে... এবারে তোদের কথা শুনি বল...
পর্না বলল, আমাদের কথা পরে হবে খন, আগে তোর স্ত্রী- মেয়ের কথা বল, কোথাকার মেয়ে তোর বউ? দুবাই, আমেরিকা, রাশিয়া না ইংল্যান্ড? আমার তো মনে হচ্ছে, ওই মিঃ স্মিথের মেয়ে টেয়ে কেউ হবে, না হলে কি আর এমনি এমনি তোকে নিয়ে গেছে? অদ্রীজ হেসে বলে উঠল, না’রে, খুব ভালো ভদ্রলোক। আমার সাথে এখনো যোগাযোগ আছে। খুব ভালোবাসে আমায়। তবে আমার কোন স্ত্রী নেই...
মানে?-আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, কি বলছিস কি তুই? স্ত্রী নেই মানে? তাহলে মেয়ে? ওহ!! তাহুলে লিভ টুগেদার করছিস নাকি ?
না, তাও না, আসলে আমি কখনো প্রেমে পড়িনি কারোর, একবারই প্রেমে পড়েছিলাম সেই কলেজ লাইফে, তবে আমার সেরকম অবস্থা ছিল না যে আমি কাউকে প্রোপজ করব, নিজের পেট চালানোই যেখানে কষ্টসাধ্য ব্যাপার, সেখানে কি করে অন্য কাউকে বিব্রত করব বল...। এই বলে কিছুক্ষণ চুপ করে, আবার বলে উঠল, তবে হ্যাঁ আমার একটা মেয়ে আছে, ওর জন্য একটা কেয়ারটেকারও রাখা আছে, যে সবসময় ওকে দেখে রাখে, এই আশ্রম থেকেই দেওয়া, আমার সাথেই সবসময় সবজায়গায় যায়, আসলে খুব ছোট্ট তো...সবে দুবছর বয়স... আমি আবার ওকে একদিনও না দেখতে পেয়ে থাকতে পারি না, এর মধ্যেই টকর টকর করে আধো আধো গলায় কথা বলে জানিস ? আমাদের দিকে তাকিয়ে অদ্রীজ বুঝল, ব্যাপারটা ঠিক আমাদের মস্তিস্কে ঢোকেনি। তাই বলল, আমি আসলে প্রতি বছরই চেষ্টা করি, কলকাতায় আসতে, আর আসলে, আশ্রমে যাবই যাব, স্বামীজীদের আশীর্বাদ নিতে, কারণ ওদের জন্যই তো আজ আমার এই পরিবর্তণ। শুনেছি, আমাদের জয়নগরেও বাড়িটাকেও ওরা আশ্রম বানাচ্ছেন । একবার দেখার ইচ্ছে আছে এইবারে, যাবি তোরা? জয়নগরটা ঘুরে আসতে চাই। আর হবে কিনা জানি না জীবনে...
এই বলে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, বলল, দেড়বছর আগেও আমি যখন আসি, আশ্রমে এসেছিলাম, এখানেই স্বামীজীর কাছেই জানতে পারলাম পাঁচ মাস আগে আশ্রমে একটা ছোট্ট অনাথ শিশুকে নিয়ে আসা হয়েছে, স্বচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তান, কিন্তু বাবা-মা কোন এক আক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায়, শিশুটি অনাথ হয়ে যায়। বাড়ির আর কোন সদস্য না থাকার ফলে এই অনাথ মেয়েটিকে আশ্রমে নিয়ে আসা হয়। আমিই তখন স্বামীজীকে বলি, আমি চাই ওই মেয়েটিকে নিজের মেয়ে হিসাবে বড় করতে। আমার এই দুনিয়ায় আর কেউ ছিল না, তাই চেয়েছিলাম, নিজের কাউকে কাছে পেতে।
পর্ণা চোখ বড় করে বলে উঠল, তাহলে বিয়ে করলি না কেন? তাহলে তো সমস্যা হত না নিজের কাউকে পাবার, অবশ্য বিয়ে করলেই যে সমস্য হবে না, সেটাও গ্যারান্টি দিয়ে কেউ বলতে পারে না। বেশ বুঝলাম শেষ কথাটা আমার উদ্দেশ্যেই বলা, কি আর করব, চুপ করে রইলাম, অদ্রীজ একবার দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করল, আসলে জীবনের সাথে লড়াইতে আর করা হয়ে ওঠেনি, আর তাছাড়াও আমি কখনো আমার প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারি নি। কারোকে পারিনি সেইভাবে তার জায়গায় বসাতে, তাই আর করে ওঠা হয়নি হয়ত ! যাই হোক তারপর স্বামীজীরা রাজী হওয়াতে, আরো দুমাস লেগে গেল, সমস্ত দরকারী কাগজপত্র তৈরী করে অফিসিয়ালী অ্যাডপ্ট করে মেয়েকে কাছে পেতে, আর তারপর সোজা লন্ডন ! আদর করে মেয়ের নাম রাখলাম- অপর্ণা । আমার মায়ের নাম ছিল সুপর্না, তাই তার সাথেই নাম মিলিয়ে এই নামটা রাখলাম।
আমি বলে উঠলাম – কিন্তু কলেজের সেই মেয়েটি কে ? তাকে তাহলে বলিস নি কেন? নাহয় আমিই তোর হয়ে বলে দিতাম ...
ও হেসে বলল, বললেই কি আর সব হয় রে? সেই সময় আমার ভালোবাসার থেকেও জরুরী ছিল, মা’কে নিয়ে সংসার চালানো, আর সে যদিও রাজী হত, আমি কি করে জেনেশুনে আমার তখনকার অস্থির জীবনে তাকে প্রবেশ করতে দিতাম বল ? তখন আমার কাছে নিজেদের সংসার চালানোটা মোস্ট প্রায়রিটি ছিল। তাই আর ওদিকের পথ মাড়াইনি। আমার কাছে এর কোন উত্তর ছিল না, ছিল না পর্নার কাছেও, ওকে যত জানছি, যত বুঝছি, ওর সম্পর্কে শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যাচ্ছে । কত বড় ডিটারমিনেশন থাকলে মানুষ এরকম হতে পারে, অবিশ্বাস্য । জীবনের যে ভাগে আমরা হাসি ঠাট্টা-ইয়ার্কি মেরে কাটিয়ে দিয়েছি, সে অংশে অদ্রীজ নিজের জীবনের প্রায়রিটি ম্যানেজমেন্ট সেরে ফেলেছে! কিন্তু সেই সময় ওকে দেখলে কে বলবে, ও এত কিছু ভেবে কাজ করত। আমি শুধু মুখে বলে উঠলাম – ইউ আর গ্রেট, সিমপ্লি গ্রেট ম্যান!
আমরা ওর হোটেলে গিয়ে ওদের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের সাথে আবার গাড়িতে করে বাড়ির দিকে চললাম। পর্না পিছনের সীটে অদ্রীজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে ওর সাথে সাথে দুষ্টুমি করছে, পাশে অপর্নার কেয়ারটেকার মেয়েটি বসে আছে। গাড়ির আয়নায় পর্নার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন একমুহূর্তে বয়স আবার দশ বছর কমে গেছে। মনে হচ্ছে যেন আবার আগের পর্না কে দেখছি... আমার পাশের সীটে অদ্রীজ বসে আছে, আমার হাত ধরে জিজ্ঞসা করল, কি হয়েছে? আমি ইশারাতে বললাম, পরে বলব, তোর সাথে আমার অনেক জরুরী দরকার আছে।
রাত্রে খাবার পর পর্না অদ্রীজের মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়াতে আমি ও অদ্রীজ দুজনে ব্যাল্কনিতে এসে বসলাম, দুটো গ্লাসে ইম্পোর্টেড হুইস্কির পেগ বানিয়ে একটা অদ্রীজকে দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, আচ্ছা, তোর কখনো মনে হয় নি আমাদের কথা? আমাদেরকে তো চেষ্টা করলে খুঁজে পেতে পারতিস? অদ্রীজ আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে চীয়ার্স করে পাশে রেখে দিয়ে বলল, তোর জন্য হাতে নিলাম, নাহলে আমার খাওয়া বারণ, আশ্রমের নিয়ম-নীতিগুলো আমাদেরকে সব মেনে চলতে হয়, আমার জীবন আশ্রমে নামে সঙ্কল্প করে দিয়েছি অনেক আগেই, তাই আমাকে জোর করিস না ভাই!
তারপরে মুখ না তুলেই জবাব দিল, খোঁজ কি আর করিনি বলছিস? আগের বারই তোর একটা ইন্টারভিউ বেড়িয়েছিল কাগজে, দেখে রেখেছিলাম। তখনই তোর আর পর্নার সম্পর্কে সব খবর জোগাড় করে রেখেছিলাম। এবারে যখন তোদের কোম্পানীর থেকে অফারটা এলো, তাই লুফে নিলাম, কারণ জানতাম তোদের সাথে দেখা করার এটাই সেরা সুযোগ, আমারো অনেক দরকারী কথা আছে তোদের সাথে। অবশ্য তোদের কোম্পানী না ডাকলেও আমিই আসতাম নিজে থেকে তোদের সাথে দেখা করতে। সে ব্যাপারে পরে বলব, আগে তোদের ব্যাপারটা শুনি। আমি সংক্ষেপে সব গুছিয়ে বললাম অদ্রীজকে, আর শেষে এও বললাম, পর্নাকে বোঝাতে তুই আমায় সাহায্য কর ভাই! ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জীবন কি অদ্ভুত না? প্রথমে সমস্যায় জর্জরিত করে দেয়, তারপরে আবার কোনও একটা পথ আচমকাই খুলে দেয় তার সমাধানের জন্য... তাই না ? ঠিক আছে দেখছি কি করা যায়।
এরমধ্যেই পর্ণা ডাকতে চলে এলো, অদ্রীজকে বলল, তোর মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি, আমার মনে হয়, অদ্রীজ, তুই নিজে না চাস, কিন্তু এই ফুটফুটে শিশুটার জন্য তোর বিয়ে করা উচিত, ওর একজন মায়ের খুব দরকার, বিশেষ করে এই সময়ে । হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবছি অনেকদিন ধরে, আমিতো আজ এখানে, কাল ওখানে, এই করেই ঘুরে বেড়াই, কিন্তু এরপরে ওর পড়াশুনো শুরু হবে, আরো কত কি দরকার পড়বে, তাই ভাবছি এবারেই ওর জন্য একটা মায়ের ব্যাবস্থা করব। মানে? তুই বিয়ে করছিস তাহলে? পর্নার বিস্ময়ে ভরা প্রশ্ন ... উত্তরে অদ্রীজের শুধু ছোট্ট জবাব, দেখা যাক কি করি, যাই করি তোরা জানবি নিশ্চয়ই, এই বলে ও উঠে পড়ল, আর আমার মনটাও একটু হালকা হল যেন মনে হচ্ছে।
পরেরদিন রবিবার, সবাই মিলে প্ল্যান করা হল, জয়নগর যাওয়া হবে, সকাল বেলাতেই বেড়িয়ে পড়া হল, সারা দিন ঘুরেফিরে, অনেক আড্ডা দিয়ে, শেষে আমরা যখন আমরা বাড়ি ফিরছি, অদ্রীজ বলল, দে আমি এবারে গাড়ি চালাই, তুই পর্ণার পাশে গিয়ে বস পেছনের সীটে। আমি পর্নার পাশে পিছনে গিয়ে বসলাম, দেখলাম পর্নার চোখ-মুখে আবার সেই আগের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে, হঠাৎ, আমার হাত ধরে, পর্না কেঁদে ফেলে বলল – আই অ্যাম সরি রঞ্জন, পারলে আমাকে তুমি ক্ষমা কর, তুমি আমার জন্য এতটা ভাব, আর আমি কিনা নিজেও কষ্ট পেয়েছি আর তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি। আমরাও তো বিকল্প কোনো উপায় ভাবতে পারি তাই না... রিয়েলী সরি..., দেখ কি সুন্দর? অদ্রীজের মেয়ের দিকে ইশারা করে দেখাল আমায়। আমি দেখলাম, অপর্না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে, আমার মা বলত বাচ্চারা নাকি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভগবানের সাথে কথা বলে। ওইটুকু শিশুর হাসি দেখে মনে হল, বোধহয় আমার অজান্তেই কখন আমার এত বড় কাজ করে দিল ওর বাবা, তাই ও হাসছে।
বাড়ি ফিরে আসার পরে, অদ্রীজ মেয়ে কে আমাদের কাছে রেখে গেল আশ্রমে, সাথে কেয়ারটেকারকেও রেখে গেল, যাওয়ার আগে বলে গেল একটু কাজ আছে। আশ্রম থেকে ওকে আবার দু একজায়গায় নাকি যেতে হবে, তাই দিন কয়েক লাগবে ওর। ও চলে যেতেই, পর্না আবার মেয়েটাকে নিয়ে পড়ল, আমি লক্ষ্য করলাম, ইতিমধ্যেই, কেয়ারটেকারকে বেশ আরামে রেখে নিজেই লেগে পড়েছে, ওর কাজে। যেন এতদিন পরে একটা খেলার পুতুল পেয়েছে। নিজে হাতে করে সব কাজ করছে, যেন ওই ওর নিজের মা। বাচ্চাটাও ওকে দেখলেই হাসে, হাত বাড়িয়ে দেয়, গলা জড়িয়ে ধরে। আমাকে সেদিন বলল, জানোতো, আমায় না ও, সেদিন কে মাম্মাম বলে ডেকেছে। আমি বললাম, দেখো তুমি কিন্তু একটু বেশী অ্যাটাচড হয়ে যাচ্ছ মনে হচ্ছে, এরপরে অদ্রীজ ফিরে এলে তখন আবার কষ্ট পাবে তুমি, পর্না। পর্ণা হেসে বলল, সে আর নতুন কি, কষ্ট কি এতদিন কম পেয়েছি? তার জন্য এতটুকু মেয়েকে মা এর ভালোবাসা কেন দেব না বলতে পারো ? না আমি আর কিছু বলি নি... এদিকে সাতদিন হয়ে গেল, গত সাতদিনের মধ্যে পর্না অফিস গেছে মাত্র দু দিন, শরীর খারাপের অজুহাতে, ছুটি নিয়ে নিল অফিস থেকে। অদ্রীজটা যে কোথায় গেল কে জানে...ফোনও সুইচ অফ, আর নিজেও ফোন করছে না। কি করব, বুঝতে পারছি না, একবার যাব, আশ্রমে গিয়ে খোজ নেব? আচ্ছা ঠিক আছে, কাল সোমবার, অফিস থেকে ফেরার পথে একবার আশ্রমে চলে যাব।
রাত্রে সোফাতে বসে সবে গতকালের আর্টিকেলটা নিয়ে বসেছি, এমন সময়ে হঠাৎ ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠল। আমি বিরক্তি সহকারে ফোনটা তুলতেই অপরপ্রান্ত থেকে এক অপরিচিত মহিলার কন্ঠ আমার নাম কনফার্ম করে যা বলল, তাতে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল, আমি স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম, টেলিফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল, আর শব্দে পর্না ছুটে চলে এল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি পর্নার দিকে ফিরে বললাম, কুইক, তারাতাড়ি রেডি হয়ে নাও, গাড়িতে যেতে যেতে সব বলব, আমি গাড়ি বার করছি বলেই আমি ভিতরে চলে গেলাম, অদ্রীজের মেয়ের কেয়ারটেকারের কাছে। বাঙ্গালী বয়স্ক ভদ্রমহিলা, বললাম, আপনি এখানেই থাকুন অপর্ণার সাথে, আমার কাজের লোক নমিতাদি আছে, ওর কোন কিছু লাগলে, আপনি নমিতাদির কাছ থেকে চেয়ে নেবেন। আমি আর পর্ণা একটু জরুরী কাজ সেরে আসছি।
রাস্তার হাজারো ট্রাফিক আর পর্ণার প্রশ্নঝড় সামলে যখন গাড়িটা টাটা মেডিক্যাল সেন্টারের সামনে নিয়ে দাঁড় করালাম, ঘড়িতে তখন পৌনে এগারোটা বাজে। একছুটে কেবিন নম্বর ৪০১ এ পৌঁছে দেখি আশ্রমের স্বামীজীদের ভিড় অদ্রীজকে ঘিরে। ওনাদের কাছেই জানতে পারলাম গত একবছর ধরে অদ্রীজ একিউট লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত। ওর অনুরোধেই আমাদেরকে ডেকে পাঠানো হয়েছে । ভিড় সামলে কেবিনের ভিতরে আমি আর পর্ণা প্রবেশ করলাম ধীরে ধীরে । কি হাল হয়েছে ওর! গত সাতদিন ধরে যমে মানুষে টানাটানির ধকল চোখের সামনে স্পষ্ট । মাথা ন্যাড়া, রাইলস টিউব, স্যালাইন আর ব্লাডের ত্রিফলা যেন পুরো শরীরটাকে এই সাতদিনেই ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছি। আমাদের দেখে ও হাত নেড়ে কাছে যেতে বলাতে দুজনেই ওর মাথার কাছে দাঁড়ালাম । আমি অদ্রীজের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, তুই কি রে? মানুষ? নাকি অন্য গ্রহের প্রানী ? এতকিছুর একটুকুও জানতে দিলি না... অদ্রীজ হেসে আস্তে আস্তে বলল, বসন্তবাবু, জীবন বোধ হয় এরকম, প্রথমে সমস্যায় জর্জরিত করে দেয় আর তারপরে...বলে বালিশের তলা থেকে দুটো চিঠি বার করে স্বামীজীর হাতে দিল, বলল, এতে তোদের দুজনার জন্য কিছু লেখা আছে। প্রথমটা পড়ে যদি রাজী হস, তাহলে, দ্বিতীয়টা বলে স্বামীজীর দিকে আঙুল দেখিয়ে দিল। তারপর আমার আর পর্ণার হাতদুটো ধরে নিজের বুকের কাছে নিয়ে গিয়ে শুধু বলল,- তোরা আমার জীবনের খুব কাছের লোক, তাই............ অপর্ণার দায়িত্ব আমি তোর হাতে দিয়ে গেলাম । প্লীজ না করিস না । স্বামীজীদের সব বলা আছে, ওনারাই সব ব্যবস্থা করবেন । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল চললাম বসন্তবাবু, তোরা সুখে থাক। আজ আমি খুব খুশী যে...যাবার সময়ে আমার প্রিয় বন্ধুদের পাশে পেলাম। আমাদের দুজনার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। পর্ণা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল- তুই আর কি কি করবি আমাদের জন্য! আজ থেকে অপর্ণা আমাদেরই মেয়ে। অদ্রীজ চোখ বুজে বলল, তোর থেকে ভালো মা অপর্ণা কোনদিন পাবে না। তবে সত্যিটা কখনো ওর থেকে লুকোবি না। এটাই অনুরোধ.....
এতক্ষণে এক স্বামীজী আমাদেরকে বললেন প্রথম চিঠিটা তাড়াতাড়ি পড়ে দেখতে, আমি আমাদের নামলেখা চিঠিটা খুলে পর্ণাকে সাথে নিয়েই দেখলাম- তাতে লেখা, -
প্রিয় বসন্তবাবু ও পর্ণা,
জানি না, এই চিঠি তোরা যখন পাবি, বা পড়বি, আমি আর থাকব কিনা, তাও সেদিনকে যখন জানলাম যে তোদের এখনো কোন সন্তান নেই, তাই আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মেয়ে অপর্ণার দায়িত্ত্ব আমি তোদের হাতে দিয়ে যাব, জানি না ঠিক ভেবেছি কিনা, একা একাই ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি আসলে, হাতে আমার আর সময় নেই তো, আর পর্নার থেকে ভালো মা বোধহয় আর কোথাও আমার মেয়ে পাবে না, আর তোরাও তোদের সন্তান পেয়ে যাবি, কিন্তু অবশ্যই যদি তোরা রাজী থাকিস। আর তাই তোরা যদি রাজী হস, তাহলে স্বামীজীদের বললেই, ওনারা ব্যাবস্থা করে দেবেন। কাগজপত্র সব রেডী করাই আছে, আমার সই করাও আছে, খালি তোর আর পর্নার আক্সেপট্যান্সটা লাগবে। যদি তোরা রাজী হস, আমি মরেও শান্তি পাব। আর একটা কথা, আমাদের জয়নগরের বাড়িটা যে আশ্রম হয়েছে, তাতে সেখানকার ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসাবে আমার নাম কেটে আমার মেয়ে অপর্ণার নামে করে দিয়ে যাচ্ছি, তুই আর পর্ণা ওর লিগাল বাবা-মা হিসাবে যেকোন ডিশিশন নিতে পারবি, অবশ্যই, যা আশ্রমের ভালো জন্য হবে, এবং আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত স্বামীজীদের সাথে আলোচনা করে, যতদিন না অপর্না প্রাপ্তবয়স্ক হচ্ছে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তারপরে তাকেও আশরমের সাথে আলোচনা করেই কাজ করতে হবে। তার সমস্ত কাগজও রেডি করা আছে, তাই যদি নিঃস্বার্থ ও আনন্দের সাথে রাজী হলে আমি খুব খুশি হব।
তোদের অদ্রীজ
চিঠিটা পড়ে মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না, আমাদের, আমি পর্নার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, ওর সম্মতিটা সব থেকে আগে দরকার, আমি কিছু বলার আগেই দেখি, পর্ণা স্বামীজীকে, বলে উঠল, আমি রাজী, একেবারে নিঃস্বার্থ ভাবে। আমি অদ্রীজের দিকে তাকালাম, দেখলাম ওর চোখমুখে যেন একটায়া প্রশান্তির ছাপ লেগে রয়েছে...আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম...কিছু একটা বলতে চাইছিল ও...কিন্তু কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আমাদেরকে চিরতরে ছেড়ে চলে গেল ও। পর্ণা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, আর আমার মনে হল যেন নিজের আত্মাটাই দেহ থেকে বেরিয়ে গেল । কতক্ষণ কেটে গেছি জানি না, স্বামীজীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম । আমরা আইনী কাজ শুরু করার জন্য আগামীকালই আশ্রমে যাব বলে জানালাম ওনাদের।
পর্না হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙ্গে পড়ল। আমিও ভাবতেই পারছি না, সত্যি ও আমাদের জীবনে দেবদূত হয়ে এসেছিল যেন, জীবনের শেষ দিন অবধি আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে চলে গেল কেমন অনায়াসে...
বাইরে বেরিয়ে দুজনেই চুপ, কথা বলার ভাষাটাই হারিয়ে ফেলেছি যেন। দুঃসহ লাগছিল, স্বামীজীদের কাছেই শুনলাম, ও নাকি সমস্ত বডিপার্টস দান করে গেছে, তার জন্য সময় লাগবে। পর্ণার শরীরটা আর এই ধকল নিতে পারছিল না, তাই স্বামীজীদের সাথে কথা বলে নিলাম । বাড়িতে পর্নাকে শুধু ড্রপ করে আবার ফিরে আসব বাকি সব কাজ সারতে। রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ ও জিজ্ঞসা করল, আর একটা চিঠিতো দিল না ওরা, সেটাতে কি লেখা আছে কে জানে ? আমি পকেটথেকে আরেকটা চিঠি বার করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, এই নাও! তুমি যখন সই গুলো করছিলে, তখন অদ্রীজ আমার হাতে গুঁজে দিয়েছিল । আমি পড়ে নিয়েছিলাম তক্ষুনি, আর তোমাকে দেবার সময় পাই নি, এই নাও পড়ে নাও, দ্বিতীয়টাতে লেখা ছিল –
প্রিয় পর্না ও বসন্তবাবু,
অনেক আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আগে তোদেরকে আমার প্রস্তাবে রাজী হবার জন্য। যাক আমার মেয়ের জন্য কিছু একটা করা গেল, মেয়ের চিন্তাই আরো আমাকে শেষ করে দিল জানিস ? ওকে কোথায় রাখব, কোথায় দেব, কে দেখবে এসব ভেবে ভেবেই আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, তারপরেই বসন্তের ইন্টারভিউটা চোখে পরাতে আমি ঠিক করি তোদের সাথে একবার এই ব্যাপারে কথা বলব, কিন্তু এখানে এসে জানতে পারলাম যে তোরাও একটা মিষ্টি সন্তানের আশায় রয়েছিস, তাই ভাবলাম তোদেরকেই দিয়ে যাই আমার মেয়েকে দেখার ভার, অবশ্য এর পর থেকে তোদেরই মেয়ে হিসাবে বড় হবে ও। আমার মেয়েটাও কিন্তু কম মিষ্টি নয় কি বলিস? আর পর্না, তোকে দেখে মনে হল, আমার মেয়ে তোর চেয়ে ভালো মা আর পাবে না। কাজের কথা শোন, আমার সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সপত্তি আমার মেয়ের নামে করে গেলাম, যার লিগ্যাল গার্জিয়ান হবি তোরা, যতদিন না অপর্না প্রাপ্তবয়স্ক হয়, আর তার জন্য আমার জমা করা টাকা থেকে আশ্রমের তরফ থেকে প্রতিমাসে ওর পড়াশুনো ও অন্যান্য খরচা বাবদ কুড়ি হাজার টাকার চেক আসবে তোদের কাছে। জানি রেগে যাচ্ছিস, কিন্তু এটুকু আমার ওর প্রতি উপহার। একটাই রিকোয়েস্ট, বড় হলে ওর কাছে কোন কিছু গোপন রাখিস না, সব বলে দিস। আর একটা কথা, জীবনের সব থেকে বড় সিক্রেট আজ আমি তোদের কে বলছি, আমার জীবনের ভালোবাসার কথা, আমার কলেজ জীবনের ভালোবাসার কথা, যাকে আমি অনেক কারণেই নিজের মনের কথা বলি নি ইচ্ছে করেই, এখন মনে হয় না বলে ভালোই করেছি, তাহলে আমার বাবাও যেমন আমার মাকে পথে বসিয়ে চলে গিয়েছিলেন, আমিও তাই করতাম তার সাথে। যাই হোক, নাম আমি বলব না, কিন্তু তোরা বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই বুঝতে পারবি, শুধু আমার মায়ের নামের সাথে মিলিএই যে আমার মেয়ের নাম রেখেছি তা নয়, আর একজনের নামের সাথেও আমার নাম মিলিয়েও আমার মেয়ের নাম রেখেছিলাম– “অপর্ণা” ... এখন খোঁজ কে ছিল সে ? পরিশেষে, আবার বলি, তোদের হাতে আমার মেয়ের দায়িত্ত্ব সঁপে দিয়ে আমিও অনেক নিশ্চিন্ত হয়ে যাচ্ছি। ভালো থাকিস,
– তোদের অদ্রীজ
চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে, পর্না আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে ব্যাখ্যা করার কোন ভাষা আমার নেই... আমি কোন জবাব না দিয়ে বললাম, স্বামীজী আরো একটা কথা বললেন, যেটা তোমারও জানা দরকারী, আশ্রমের একনিষ্ঠ শিষ্য হবার জন্য, আশ্রমের যোগভাবনা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আর এর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য, আশ্রম থেকে ওর এক নতুন নাম দেওয়া হবে, “স্বামী অদ্রীজানন্দ”। অবিশ্বাস্য না ? আগামী মাসে জয়নগরে ওদের পুরনো বাড়িটার আশ্রমে রূপান্তরিত হবার নতুন নামকরণ করা হবে, “স্বামী অদ্রীজানন্দ ভবন”, তাই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হবার জন্য আমাদেরকে সেখানে সপরিবার হাজির থাকতে হবে। কি অদ্ভুত সমাপতন না ? আমিও ঠিক করলাম, আমাদের জয়নগরের বাড়িটাও আশ্রমকে দান করে দেব গেষ্টহাউস বানানোর জন্য। অদ্রীজের জন্য এটুকু ......কি বল তুমি ? ও আমার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকাল।
কথা বলতে বলতে ফ্ল্যাটের নীচে এসে গাড়ি দাঁড় করালাম। পর্ণার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল, আমি ওর হাতে হাত রেখে বললাম কি ভাবছ? পর্ণা উত্তরে বলল, ভাবছি কত বড়মনের মানুষ ছিল না ও? এত বড়মনের একজন বন্ধুকে আমরা এইভাবে হারাব, বুঝতেই পারিনি। কিন্তু শেষমুহুর্ত পর্যন্ত জীবনকে নিয়ে রসিকতা, হেঁয়ালি করেই কাটিয়ে গেল, কিন্তু.........। আমি বললাম, কিন্তু কি ? পর্না অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ওর শেষ হেঁয়ালি, ওর, মানে ওর প্রেম বা আমাদের মেয়ের নাম কি কারণে রাখা, সেটা কি কিছু বুঝতে পারলে?
আমি শান্ত গলায় শুধু বললাম, অপর্ণাকে ভাঙ্গলে কি হয় পর্ণা ? ও হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন, তারপর কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত ধরে চাপ দিয়ে আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি, আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি .........বলে গাড়ির দরজা খুলে, একছুটে উপরের দিকে চলে গেল,
আর আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আবার হাসপাতালের দিকে এগিয়ে চললাম, মনে মনে ভাবলাম, কোথায় আর সব হেঁয়ালি বুঝতে পারলাম পর্ণা, কিছু তো এখনো অজানাই থেকে গেল, অদ্রীজ কি সত্যি আমার জন্য চিঠিটা লিখেছিল, নাকি নিজেরটাও আমার নামে চালিয়ে দিয়েছিল? না হলে, সেটা আমাকে আগে বলে নি কেন? আবার সরস্বতী পূজোর দিনকে আমার প্রশ্নটা হঠাৎ এড়িয়ে গেল কেন? কেন ও আর কোন যোগাযোগ রাখল না আমাদের সাথে, কলকাতায় থেকেও? মনে হল কেউ যেন পাশ থেকে বলে উঠল জীবনের হয়ত সব হেঁয়ালির সমাধান হয় না রে বসন্তবাবু, কি হবে সমাধান করে? সবকিছু সমাধান না করেও দিব্যি বেঁচে থাকা যায় রে, আনন্দে জীবন কাটানো যায় !
চমকে পাশে তাকালাম, কিন্তু পরক্ষণেই টের পেলাম আমার মনের ভুল, অদ্রীজ আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, আমাদের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে সারাজীবন আমাদের মনেই থাকবে। গাড়ির জানলার কাঁচ খুলে বাইরে তাকালাম, দেখলাম আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, ভোরের আলোতে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস মনটা জুড়িয়ে দিয়ে গেল। মনের বাইরের ও ভিতরের সব ঝড় একসাথে থেমে গেছে বলে মনে হল । আমি আর কিছু চাই না, যা পেয়েছি, যতটুকু পেয়েছি, তাতেই আমি খুশি, আর পর্ণা, ওর আনন্দতো একটু আগেই দেখলাম । আমি আমার জীবনের গোল সেট করে নিয়েছি, অদ্রীজের ভাষাতে যা, প্রায়রিটি ম্যানেজমেন্ট, আজ থেকে অপর্ণা আমারও মেয়ে, না না এখন থেকেই । তাই পর্ণা ও অপর্ণার জন্য যা যা করার দরকার সব আমাকে করতে হবে। অদ্রীজের এই উপহার আমি আর কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। আর আমাদের জয়নগরের বাড়িটাও আশ্রমকে দান করে দেব, জয়নগর আশ্রমটার গেস্টহাউস করার জন্য। অদ্রীজের জন্য এটুকু তো আমি করতেই পারি । জানি এতে পর্নাও কোন আপত্তি করবে না, বরং খুশিই হবে। জীবনে এই প্রথমবার আমার মন এক গভীর শ্রদ্ধার সাথে জয় শ্রী অদ্রীজানন্দ বলে ডেকে উঠল । ভোরের শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে আমার নতুন কেনা হন্ডা সিটিটা রাত্রির কালো অন্ধকার চিরে ভোরের আলোর দিকে এগিয়ে চলল অটোমোডে ।।
( সমাপ্ত )
অদ্রীজ হাত নেড়ে ইশারা করে বলল, সব বলব, পথে যেতে যেতে। কিছুক্ষণ পরে পরের সেশনটাও শেষ হয়ে গেল। অদ্রীজ তার দুজন অনুচরকে নিয়ে বেরিয়ে এল রুম থেকে। আমি আর পর্ণা বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম, ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অদ্রীজ ছেলেদুটোকে গাড়ি নিয়ে হোটেলে চলে যেতে নির্দেশ দিয়ে আমাদের কাছে চল, তোদের গাড়িতেই আমি হোটেলে যাব ।
গাড়িতে বসে, আমিই প্রথমে কথা শুরু করলাম, বললাম, বল এবারে শুনি, তোর এই তীর্থযাত্রার কথা, তুই তো পুরোপুরি ভোল বদলে সত্যি সত্যি যোগগুরু হয়ে গেছিস রে, অদ্রীজ? পর্না হেসে আমার কথার সমর্থন করল। অদ্রীজও সেই পুরোনো অট্টহাস্য করে বলল, দেখ এই হাসিটা কিন্তু একটুকুও বদলায়নি বসন্তবাবু... আমি কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মতবাদ নিয়েই চলেছি জীবনে। আসলে কি জানিস, মা মারা যাবার পর, আমিও একটু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হত ওই বাড়িটা যেন আমায় গিলে খেতে আসছে। একা থাকতে পারছিলাম না, আমি তাই ঠিক করলাম বাড়িটা ছেড়ে দেব, কিন্তু বেচব না, তাই শ্রীরামকৃষ্ণ সেবা সদনকে দানপত্রে লিখে দিলাম, কি করব, আমার তো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না, ততদিনে তোরা সবাই কলকাতায়। ভাবলাম আমিও কলকাতায় চলে যাই। তাই দান তো করে দিলাম, তবে বদলে কথা হল, ওরা আমাকে ওদের কলকাতার আশ্রমে থাকার যায়গা দেবে।
কলকাতায় এসে, ওদের আশ্রমে একটা মাথা গোঁজার যায়গা হল। ওখানকার স্বামীজীদের সাথে বেশ ভালো খাতিরও হয়ে গেল, প্রথম প্রথম বিভিন্ন রকম ফাই ফরমাশ খাটতাম, তোরা হয়ত জানিস না, আমার বাবা খুব ভালো যোগাসন করতে পারতেন, আর তার থেকেই আমিও যোগাসন শিখেছিলাম। ওখানে থাকতে থাকতে মাথায় আইডিয়া এলো, অবসর সময়ে যোগাসনটা চালিয়ে যাবার, কারণ আমি দেখেছিলাম আশ্রমে একটা যোগাসন সেণ্টার আছে, ওখানকার শিক্ষক হবার বাসনাটাই ছিল প্রধান। দীর্ঘ দু বছরের অধ্যাবসায়ের পরে স্বামীজীদের নজরেও পড়ে গেলাম, ওখানকার সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করলাম, হাতে কিছু হাতখরচাও আসতে লাগল। এই পয়সায়, আমি যোগ ও মেডিটেশনের উপরে বিভিন্ন বই কিনে পড়া শুরু করে দিলাম, শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পড়তে আরম্ভ করে দিলাম। কলকাতা ও তার ইতিহাস নিয়েও প্রচুর পড়াশুনো করলাম, কারণ হাতে সময় অঢেল। ভোর বেলায় উঠতে হত, প্রার্থণা করে বসে পড়তাম, আবার রাত্রে সন্ধ্যা থেকেই শুরু করে দিতাম। আশ্চর্য্যের ব্যাপার, কখনও নিরাশ হই নি, বরং, আরো বেশী পড়ার ক্ষুধা জন্মাত। সময় পেলে ওনাদের ফ্রী ইংরাজী ক্লাসেও গিয়ে বসে পড়তাম, কারণ আমি দেখেছিলাম, বিদেশী ভক্তের সংখ্যা প্রচুর, তার আসতেন, আর তাদের গাইড হিসাবে কলকাতা ও তার আশে পাশে ভ্রমণও করা যায়। আমার সে লক্ষ্যও পূরণ হল, চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই, আমি মোটামুটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলাম। তখনই হঠাৎ অঘটনটা ঘটল...।
অঘটন ? ...কিসের ? আমাদের দুজনের সমস্বর বিস্ময়! অদ্রীজ বলল, আসলে আমি ওটাকে, অঘটনই বলি, যার জন্য সেই তোদের অদ্রীজ আজ পুরো বদলে গেল। এক জন আমেরিকান ভক্তর সাথে আলাপ হয়েছিল, আমার কাছে যোগাসন শিখতেন এখানে আসলে, প্রতি বছরে প্রায় দুবার করে আসতেন। নাম–মিঃ ট্রেভর স্মিথ, খুব পয়সাওয়ালা লোক। একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পাসপোর্ট আছে কিনা, আমি না বলাতে আমাকে বললেন, যে, পাসপোর্ট করিয়ে নিতে। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, আমাকে ওনার খুব পছন্দ, তাই আমাকে উনি নিয়ে যেতে চান দুবাই। ওখানে ওনার নিজস্ব পাঁচতারা রিসর্ট ও স্পা আছে, ওনার ইচ্ছা আমি যদি ওখানে গিয়ে ওখানকার যোগা ও মেডিটেশন ডিভিশনের ম্যানেজার হিসাবে যোগ দিই। আমি তো শুনেই লাফিয়ে উঠলাম, কিন্তু বললেই তো আর হবে না, আগে স্বামীজীদের কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে, তারপরে আমি যা করার করতে পারব। স্বামীজীরা সব শুনে আমাকে বলল, ঠিক আছে তুমি পাসপোর্ট বানাতে দাও, আমরা দেখে জানাচ্ছি, ওনাদের দুবাইএর আশ্রম থেকে সব কিছু ভেরিফাই করে তবে আমাকে যাবার ছাড়পত্র দিলেন। দু মাসের মধ্যে আমার পাসপোর্ট এসে গেল, আর তার পনেরদিনে মধ্যেই আমার প্রথম বিমান যাত্রা টু দুবাই। এত অবধি বলে অদ্রীজ একটু দম নিল, আমি বলে উঠলাম-বাব্বা, এতো যেন সিনেমার গল্প শুনছি । পর্না বলে উঠল, এইজন্য বলে ভগবান আছে, যারা মানুষের ভালো করে তাদের ভালোও ভগবান করেন। আচ্ছা তারপর ?
অদ্রীজ বলল, তারপর আর কি, দুবাইতে চারবছর থাকলাম, পুরোপুরি প্রফেশনাল হয়ে গেলাম। তারপর সেখান থেকে নিয়মমাফিক ইন্টারভিউ দিয়ে, চলে গেলাম রাশিয়া, ওখানকার ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অফ মেডিটেশন ও যোগাতে লেকচারার ও স্পা-হেড হিসাবে। তারপর দুবছর অন্তর প্রমোশন- প্রথমে অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর ও পরে ডিরেক্টর। গত দুবছর ধরে আমি, লন্ডনের এই ইন্সটিটিউটে আছি ডিরেক্টর হিসাবে। এখন আমার কাজ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্থা, জায়গা, বা কর্পোরেট অফিসে গিয়ে যোগা ও মেডিটেশন সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়া, ভারতীয় যোগার এক মডিফায়েড রূপ, আমার করা রিসার্চের মাধমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া, যা আমার এই আশ্রমের অনুমদিত।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ভাই কি করেছিস? তুই তো বিশ্বজয় করেছিস রে? অদ্রীজ চোখ বন্ধ করে বলে উঠল, কতটা কি করেছি জানি না... তবে... এবারে তোদের কথা শুনি বল...
পর্না বলল, আমাদের কথা পরে হবে খন, আগে তোর স্ত্রী- মেয়ের কথা বল, কোথাকার মেয়ে তোর বউ? দুবাই, আমেরিকা, রাশিয়া না ইংল্যান্ড? আমার তো মনে হচ্ছে, ওই মিঃ স্মিথের মেয়ে টেয়ে কেউ হবে, না হলে কি আর এমনি এমনি তোকে নিয়ে গেছে? অদ্রীজ হেসে বলে উঠল, না’রে, খুব ভালো ভদ্রলোক। আমার সাথে এখনো যোগাযোগ আছে। খুব ভালোবাসে আমায়। তবে আমার কোন স্ত্রী নেই...
মানে?-আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, কি বলছিস কি তুই? স্ত্রী নেই মানে? তাহলে মেয়ে? ওহ!! তাহুলে লিভ টুগেদার করছিস নাকি ?
না, তাও না, আসলে আমি কখনো প্রেমে পড়িনি কারোর, একবারই প্রেমে পড়েছিলাম সেই কলেজ লাইফে, তবে আমার সেরকম অবস্থা ছিল না যে আমি কাউকে প্রোপজ করব, নিজের পেট চালানোই যেখানে কষ্টসাধ্য ব্যাপার, সেখানে কি করে অন্য কাউকে বিব্রত করব বল...। এই বলে কিছুক্ষণ চুপ করে, আবার বলে উঠল, তবে হ্যাঁ আমার একটা মেয়ে আছে, ওর জন্য একটা কেয়ারটেকারও রাখা আছে, যে সবসময় ওকে দেখে রাখে, এই আশ্রম থেকেই দেওয়া, আমার সাথেই সবসময় সবজায়গায় যায়, আসলে খুব ছোট্ট তো...সবে দুবছর বয়স... আমি আবার ওকে একদিনও না দেখতে পেয়ে থাকতে পারি না, এর মধ্যেই টকর টকর করে আধো আধো গলায় কথা বলে জানিস ? আমাদের দিকে তাকিয়ে অদ্রীজ বুঝল, ব্যাপারটা ঠিক আমাদের মস্তিস্কে ঢোকেনি। তাই বলল, আমি আসলে প্রতি বছরই চেষ্টা করি, কলকাতায় আসতে, আর আসলে, আশ্রমে যাবই যাব, স্বামীজীদের আশীর্বাদ নিতে, কারণ ওদের জন্যই তো আজ আমার এই পরিবর্তণ। শুনেছি, আমাদের জয়নগরেও বাড়িটাকেও ওরা আশ্রম বানাচ্ছেন । একবার দেখার ইচ্ছে আছে এইবারে, যাবি তোরা? জয়নগরটা ঘুরে আসতে চাই। আর হবে কিনা জানি না জীবনে...
এই বলে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, বলল, দেড়বছর আগেও আমি যখন আসি, আশ্রমে এসেছিলাম, এখানেই স্বামীজীর কাছেই জানতে পারলাম পাঁচ মাস আগে আশ্রমে একটা ছোট্ট অনাথ শিশুকে নিয়ে আসা হয়েছে, স্বচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তান, কিন্তু বাবা-মা কোন এক আক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায়, শিশুটি অনাথ হয়ে যায়। বাড়ির আর কোন সদস্য না থাকার ফলে এই অনাথ মেয়েটিকে আশ্রমে নিয়ে আসা হয়। আমিই তখন স্বামীজীকে বলি, আমি চাই ওই মেয়েটিকে নিজের মেয়ে হিসাবে বড় করতে। আমার এই দুনিয়ায় আর কেউ ছিল না, তাই চেয়েছিলাম, নিজের কাউকে কাছে পেতে।
পর্ণা চোখ বড় করে বলে উঠল, তাহলে বিয়ে করলি না কেন? তাহলে তো সমস্যা হত না নিজের কাউকে পাবার, অবশ্য বিয়ে করলেই যে সমস্য হবে না, সেটাও গ্যারান্টি দিয়ে কেউ বলতে পারে না। বেশ বুঝলাম শেষ কথাটা আমার উদ্দেশ্যেই বলা, কি আর করব, চুপ করে রইলাম, অদ্রীজ একবার দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করল, আসলে জীবনের সাথে লড়াইতে আর করা হয়ে ওঠেনি, আর তাছাড়াও আমি কখনো আমার প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারি নি। কারোকে পারিনি সেইভাবে তার জায়গায় বসাতে, তাই আর করে ওঠা হয়নি হয়ত ! যাই হোক তারপর স্বামীজীরা রাজী হওয়াতে, আরো দুমাস লেগে গেল, সমস্ত দরকারী কাগজপত্র তৈরী করে অফিসিয়ালী অ্যাডপ্ট করে মেয়েকে কাছে পেতে, আর তারপর সোজা লন্ডন ! আদর করে মেয়ের নাম রাখলাম- অপর্ণা । আমার মায়ের নাম ছিল সুপর্না, তাই তার সাথেই নাম মিলিয়ে এই নামটা রাখলাম।
আমি বলে উঠলাম – কিন্তু কলেজের সেই মেয়েটি কে ? তাকে তাহলে বলিস নি কেন? নাহয় আমিই তোর হয়ে বলে দিতাম ...
ও হেসে বলল, বললেই কি আর সব হয় রে? সেই সময় আমার ভালোবাসার থেকেও জরুরী ছিল, মা’কে নিয়ে সংসার চালানো, আর সে যদিও রাজী হত, আমি কি করে জেনেশুনে আমার তখনকার অস্থির জীবনে তাকে প্রবেশ করতে দিতাম বল ? তখন আমার কাছে নিজেদের সংসার চালানোটা মোস্ট প্রায়রিটি ছিল। তাই আর ওদিকের পথ মাড়াইনি। আমার কাছে এর কোন উত্তর ছিল না, ছিল না পর্নার কাছেও, ওকে যত জানছি, যত বুঝছি, ওর সম্পর্কে শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যাচ্ছে । কত বড় ডিটারমিনেশন থাকলে মানুষ এরকম হতে পারে, অবিশ্বাস্য । জীবনের যে ভাগে আমরা হাসি ঠাট্টা-ইয়ার্কি মেরে কাটিয়ে দিয়েছি, সে অংশে অদ্রীজ নিজের জীবনের প্রায়রিটি ম্যানেজমেন্ট সেরে ফেলেছে! কিন্তু সেই সময় ওকে দেখলে কে বলবে, ও এত কিছু ভেবে কাজ করত। আমি শুধু মুখে বলে উঠলাম – ইউ আর গ্রেট, সিমপ্লি গ্রেট ম্যান!
আমরা ওর হোটেলে গিয়ে ওদের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের সাথে আবার গাড়িতে করে বাড়ির দিকে চললাম। পর্না পিছনের সীটে অদ্রীজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে ওর সাথে সাথে দুষ্টুমি করছে, পাশে অপর্নার কেয়ারটেকার মেয়েটি বসে আছে। গাড়ির আয়নায় পর্নার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন একমুহূর্তে বয়স আবার দশ বছর কমে গেছে। মনে হচ্ছে যেন আবার আগের পর্না কে দেখছি... আমার পাশের সীটে অদ্রীজ বসে আছে, আমার হাত ধরে জিজ্ঞসা করল, কি হয়েছে? আমি ইশারাতে বললাম, পরে বলব, তোর সাথে আমার অনেক জরুরী দরকার আছে।
রাত্রে খাবার পর পর্না অদ্রীজের মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়াতে আমি ও অদ্রীজ দুজনে ব্যাল্কনিতে এসে বসলাম, দুটো গ্লাসে ইম্পোর্টেড হুইস্কির পেগ বানিয়ে একটা অদ্রীজকে দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, আচ্ছা, তোর কখনো মনে হয় নি আমাদের কথা? আমাদেরকে তো চেষ্টা করলে খুঁজে পেতে পারতিস? অদ্রীজ আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে চীয়ার্স করে পাশে রেখে দিয়ে বলল, তোর জন্য হাতে নিলাম, নাহলে আমার খাওয়া বারণ, আশ্রমের নিয়ম-নীতিগুলো আমাদেরকে সব মেনে চলতে হয়, আমার জীবন আশ্রমে নামে সঙ্কল্প করে দিয়েছি অনেক আগেই, তাই আমাকে জোর করিস না ভাই!
তারপরে মুখ না তুলেই জবাব দিল, খোঁজ কি আর করিনি বলছিস? আগের বারই তোর একটা ইন্টারভিউ বেড়িয়েছিল কাগজে, দেখে রেখেছিলাম। তখনই তোর আর পর্নার সম্পর্কে সব খবর জোগাড় করে রেখেছিলাম। এবারে যখন তোদের কোম্পানীর থেকে অফারটা এলো, তাই লুফে নিলাম, কারণ জানতাম তোদের সাথে দেখা করার এটাই সেরা সুযোগ, আমারো অনেক দরকারী কথা আছে তোদের সাথে। অবশ্য তোদের কোম্পানী না ডাকলেও আমিই আসতাম নিজে থেকে তোদের সাথে দেখা করতে। সে ব্যাপারে পরে বলব, আগে তোদের ব্যাপারটা শুনি। আমি সংক্ষেপে সব গুছিয়ে বললাম অদ্রীজকে, আর শেষে এও বললাম, পর্নাকে বোঝাতে তুই আমায় সাহায্য কর ভাই! ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জীবন কি অদ্ভুত না? প্রথমে সমস্যায় জর্জরিত করে দেয়, তারপরে আবার কোনও একটা পথ আচমকাই খুলে দেয় তার সমাধানের জন্য... তাই না ? ঠিক আছে দেখছি কি করা যায়।
এরমধ্যেই পর্ণা ডাকতে চলে এলো, অদ্রীজকে বলল, তোর মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি, আমার মনে হয়, অদ্রীজ, তুই নিজে না চাস, কিন্তু এই ফুটফুটে শিশুটার জন্য তোর বিয়ে করা উচিত, ওর একজন মায়ের খুব দরকার, বিশেষ করে এই সময়ে । হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবছি অনেকদিন ধরে, আমিতো আজ এখানে, কাল ওখানে, এই করেই ঘুরে বেড়াই, কিন্তু এরপরে ওর পড়াশুনো শুরু হবে, আরো কত কি দরকার পড়বে, তাই ভাবছি এবারেই ওর জন্য একটা মায়ের ব্যাবস্থা করব। মানে? তুই বিয়ে করছিস তাহলে? পর্নার বিস্ময়ে ভরা প্রশ্ন ... উত্তরে অদ্রীজের শুধু ছোট্ট জবাব, দেখা যাক কি করি, যাই করি তোরা জানবি নিশ্চয়ই, এই বলে ও উঠে পড়ল, আর আমার মনটাও একটু হালকা হল যেন মনে হচ্ছে।
পরেরদিন রবিবার, সবাই মিলে প্ল্যান করা হল, জয়নগর যাওয়া হবে, সকাল বেলাতেই বেড়িয়ে পড়া হল, সারা দিন ঘুরেফিরে, অনেক আড্ডা দিয়ে, শেষে আমরা যখন আমরা বাড়ি ফিরছি, অদ্রীজ বলল, দে আমি এবারে গাড়ি চালাই, তুই পর্ণার পাশে গিয়ে বস পেছনের সীটে। আমি পর্নার পাশে পিছনে গিয়ে বসলাম, দেখলাম পর্নার চোখ-মুখে আবার সেই আগের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে, হঠাৎ, আমার হাত ধরে, পর্না কেঁদে ফেলে বলল – আই অ্যাম সরি রঞ্জন, পারলে আমাকে তুমি ক্ষমা কর, তুমি আমার জন্য এতটা ভাব, আর আমি কিনা নিজেও কষ্ট পেয়েছি আর তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি। আমরাও তো বিকল্প কোনো উপায় ভাবতে পারি তাই না... রিয়েলী সরি..., দেখ কি সুন্দর? অদ্রীজের মেয়ের দিকে ইশারা করে দেখাল আমায়। আমি দেখলাম, অপর্না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে, আমার মা বলত বাচ্চারা নাকি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভগবানের সাথে কথা বলে। ওইটুকু শিশুর হাসি দেখে মনে হল, বোধহয় আমার অজান্তেই কখন আমার এত বড় কাজ করে দিল ওর বাবা, তাই ও হাসছে।
বাড়ি ফিরে আসার পরে, অদ্রীজ মেয়ে কে আমাদের কাছে রেখে গেল আশ্রমে, সাথে কেয়ারটেকারকেও রেখে গেল, যাওয়ার আগে বলে গেল একটু কাজ আছে। আশ্রম থেকে ওকে আবার দু একজায়গায় নাকি যেতে হবে, তাই দিন কয়েক লাগবে ওর। ও চলে যেতেই, পর্না আবার মেয়েটাকে নিয়ে পড়ল, আমি লক্ষ্য করলাম, ইতিমধ্যেই, কেয়ারটেকারকে বেশ আরামে রেখে নিজেই লেগে পড়েছে, ওর কাজে। যেন এতদিন পরে একটা খেলার পুতুল পেয়েছে। নিজে হাতে করে সব কাজ করছে, যেন ওই ওর নিজের মা। বাচ্চাটাও ওকে দেখলেই হাসে, হাত বাড়িয়ে দেয়, গলা জড়িয়ে ধরে। আমাকে সেদিন বলল, জানোতো, আমায় না ও, সেদিন কে মাম্মাম বলে ডেকেছে। আমি বললাম, দেখো তুমি কিন্তু একটু বেশী অ্যাটাচড হয়ে যাচ্ছ মনে হচ্ছে, এরপরে অদ্রীজ ফিরে এলে তখন আবার কষ্ট পাবে তুমি, পর্না। পর্ণা হেসে বলল, সে আর নতুন কি, কষ্ট কি এতদিন কম পেয়েছি? তার জন্য এতটুকু মেয়েকে মা এর ভালোবাসা কেন দেব না বলতে পারো ? না আমি আর কিছু বলি নি... এদিকে সাতদিন হয়ে গেল, গত সাতদিনের মধ্যে পর্না অফিস গেছে মাত্র দু দিন, শরীর খারাপের অজুহাতে, ছুটি নিয়ে নিল অফিস থেকে। অদ্রীজটা যে কোথায় গেল কে জানে...ফোনও সুইচ অফ, আর নিজেও ফোন করছে না। কি করব, বুঝতে পারছি না, একবার যাব, আশ্রমে গিয়ে খোজ নেব? আচ্ছা ঠিক আছে, কাল সোমবার, অফিস থেকে ফেরার পথে একবার আশ্রমে চলে যাব।
রাত্রে সোফাতে বসে সবে গতকালের আর্টিকেলটা নিয়ে বসেছি, এমন সময়ে হঠাৎ ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠল। আমি বিরক্তি সহকারে ফোনটা তুলতেই অপরপ্রান্ত থেকে এক অপরিচিত মহিলার কন্ঠ আমার নাম কনফার্ম করে যা বলল, তাতে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল, আমি স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম, টেলিফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল, আর শব্দে পর্না ছুটে চলে এল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি পর্নার দিকে ফিরে বললাম, কুইক, তারাতাড়ি রেডি হয়ে নাও, গাড়িতে যেতে যেতে সব বলব, আমি গাড়ি বার করছি বলেই আমি ভিতরে চলে গেলাম, অদ্রীজের মেয়ের কেয়ারটেকারের কাছে। বাঙ্গালী বয়স্ক ভদ্রমহিলা, বললাম, আপনি এখানেই থাকুন অপর্ণার সাথে, আমার কাজের লোক নমিতাদি আছে, ওর কোন কিছু লাগলে, আপনি নমিতাদির কাছ থেকে চেয়ে নেবেন। আমি আর পর্ণা একটু জরুরী কাজ সেরে আসছি।
রাস্তার হাজারো ট্রাফিক আর পর্ণার প্রশ্নঝড় সামলে যখন গাড়িটা টাটা মেডিক্যাল সেন্টারের সামনে নিয়ে দাঁড় করালাম, ঘড়িতে তখন পৌনে এগারোটা বাজে। একছুটে কেবিন নম্বর ৪০১ এ পৌঁছে দেখি আশ্রমের স্বামীজীদের ভিড় অদ্রীজকে ঘিরে। ওনাদের কাছেই জানতে পারলাম গত একবছর ধরে অদ্রীজ একিউট লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত। ওর অনুরোধেই আমাদেরকে ডেকে পাঠানো হয়েছে । ভিড় সামলে কেবিনের ভিতরে আমি আর পর্ণা প্রবেশ করলাম ধীরে ধীরে । কি হাল হয়েছে ওর! গত সাতদিন ধরে যমে মানুষে টানাটানির ধকল চোখের সামনে স্পষ্ট । মাথা ন্যাড়া, রাইলস টিউব, স্যালাইন আর ব্লাডের ত্রিফলা যেন পুরো শরীরটাকে এই সাতদিনেই ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছি। আমাদের দেখে ও হাত নেড়ে কাছে যেতে বলাতে দুজনেই ওর মাথার কাছে দাঁড়ালাম । আমি অদ্রীজের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, তুই কি রে? মানুষ? নাকি অন্য গ্রহের প্রানী ? এতকিছুর একটুকুও জানতে দিলি না... অদ্রীজ হেসে আস্তে আস্তে বলল, বসন্তবাবু, জীবন বোধ হয় এরকম, প্রথমে সমস্যায় জর্জরিত করে দেয় আর তারপরে...বলে বালিশের তলা থেকে দুটো চিঠি বার করে স্বামীজীর হাতে দিল, বলল, এতে তোদের দুজনার জন্য কিছু লেখা আছে। প্রথমটা পড়ে যদি রাজী হস, তাহলে, দ্বিতীয়টা বলে স্বামীজীর দিকে আঙুল দেখিয়ে দিল। তারপর আমার আর পর্ণার হাতদুটো ধরে নিজের বুকের কাছে নিয়ে গিয়ে শুধু বলল,- তোরা আমার জীবনের খুব কাছের লোক, তাই............ অপর্ণার দায়িত্ব আমি তোর হাতে দিয়ে গেলাম । প্লীজ না করিস না । স্বামীজীদের সব বলা আছে, ওনারাই সব ব্যবস্থা করবেন । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল চললাম বসন্তবাবু, তোরা সুখে থাক। আজ আমি খুব খুশী যে...যাবার সময়ে আমার প্রিয় বন্ধুদের পাশে পেলাম। আমাদের দুজনার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। পর্ণা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল- তুই আর কি কি করবি আমাদের জন্য! আজ থেকে অপর্ণা আমাদেরই মেয়ে। অদ্রীজ চোখ বুজে বলল, তোর থেকে ভালো মা অপর্ণা কোনদিন পাবে না। তবে সত্যিটা কখনো ওর থেকে লুকোবি না। এটাই অনুরোধ.....
এতক্ষণে এক স্বামীজী আমাদেরকে বললেন প্রথম চিঠিটা তাড়াতাড়ি পড়ে দেখতে, আমি আমাদের নামলেখা চিঠিটা খুলে পর্ণাকে সাথে নিয়েই দেখলাম- তাতে লেখা, -
প্রিয় বসন্তবাবু ও পর্ণা,
জানি না, এই চিঠি তোরা যখন পাবি, বা পড়বি, আমি আর থাকব কিনা, তাও সেদিনকে যখন জানলাম যে তোদের এখনো কোন সন্তান নেই, তাই আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মেয়ে অপর্ণার দায়িত্ত্ব আমি তোদের হাতে দিয়ে যাব, জানি না ঠিক ভেবেছি কিনা, একা একাই ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি আসলে, হাতে আমার আর সময় নেই তো, আর পর্নার থেকে ভালো মা বোধহয় আর কোথাও আমার মেয়ে পাবে না, আর তোরাও তোদের সন্তান পেয়ে যাবি, কিন্তু অবশ্যই যদি তোরা রাজী থাকিস। আর তাই তোরা যদি রাজী হস, তাহলে স্বামীজীদের বললেই, ওনারা ব্যাবস্থা করে দেবেন। কাগজপত্র সব রেডী করাই আছে, আমার সই করাও আছে, খালি তোর আর পর্নার আক্সেপট্যান্সটা লাগবে। যদি তোরা রাজী হস, আমি মরেও শান্তি পাব। আর একটা কথা, আমাদের জয়নগরের বাড়িটা যে আশ্রম হয়েছে, তাতে সেখানকার ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসাবে আমার নাম কেটে আমার মেয়ে অপর্ণার নামে করে দিয়ে যাচ্ছি, তুই আর পর্ণা ওর লিগাল বাবা-মা হিসাবে যেকোন ডিশিশন নিতে পারবি, অবশ্যই, যা আশ্রমের ভালো জন্য হবে, এবং আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত স্বামীজীদের সাথে আলোচনা করে, যতদিন না অপর্না প্রাপ্তবয়স্ক হচ্ছে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তারপরে তাকেও আশরমের সাথে আলোচনা করেই কাজ করতে হবে। তার সমস্ত কাগজও রেডি করা আছে, তাই যদি নিঃস্বার্থ ও আনন্দের সাথে রাজী হলে আমি খুব খুশি হব।
তোদের অদ্রীজ
চিঠিটা পড়ে মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না, আমাদের, আমি পর্নার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, ওর সম্মতিটা সব থেকে আগে দরকার, আমি কিছু বলার আগেই দেখি, পর্ণা স্বামীজীকে, বলে উঠল, আমি রাজী, একেবারে নিঃস্বার্থ ভাবে। আমি অদ্রীজের দিকে তাকালাম, দেখলাম ওর চোখমুখে যেন একটায়া প্রশান্তির ছাপ লেগে রয়েছে...আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম...কিছু একটা বলতে চাইছিল ও...কিন্তু কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আমাদেরকে চিরতরে ছেড়ে চলে গেল ও। পর্ণা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, আর আমার মনে হল যেন নিজের আত্মাটাই দেহ থেকে বেরিয়ে গেল । কতক্ষণ কেটে গেছি জানি না, স্বামীজীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম । আমরা আইনী কাজ শুরু করার জন্য আগামীকালই আশ্রমে যাব বলে জানালাম ওনাদের।
পর্না হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙ্গে পড়ল। আমিও ভাবতেই পারছি না, সত্যি ও আমাদের জীবনে দেবদূত হয়ে এসেছিল যেন, জীবনের শেষ দিন অবধি আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে চলে গেল কেমন অনায়াসে...
বাইরে বেরিয়ে দুজনেই চুপ, কথা বলার ভাষাটাই হারিয়ে ফেলেছি যেন। দুঃসহ লাগছিল, স্বামীজীদের কাছেই শুনলাম, ও নাকি সমস্ত বডিপার্টস দান করে গেছে, তার জন্য সময় লাগবে। পর্ণার শরীরটা আর এই ধকল নিতে পারছিল না, তাই স্বামীজীদের সাথে কথা বলে নিলাম । বাড়িতে পর্নাকে শুধু ড্রপ করে আবার ফিরে আসব বাকি সব কাজ সারতে। রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ ও জিজ্ঞসা করল, আর একটা চিঠিতো দিল না ওরা, সেটাতে কি লেখা আছে কে জানে ? আমি পকেটথেকে আরেকটা চিঠি বার করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, এই নাও! তুমি যখন সই গুলো করছিলে, তখন অদ্রীজ আমার হাতে গুঁজে দিয়েছিল । আমি পড়ে নিয়েছিলাম তক্ষুনি, আর তোমাকে দেবার সময় পাই নি, এই নাও পড়ে নাও, দ্বিতীয়টাতে লেখা ছিল –
প্রিয় পর্না ও বসন্তবাবু,
অনেক আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আগে তোদেরকে আমার প্রস্তাবে রাজী হবার জন্য। যাক আমার মেয়ের জন্য কিছু একটা করা গেল, মেয়ের চিন্তাই আরো আমাকে শেষ করে দিল জানিস ? ওকে কোথায় রাখব, কোথায় দেব, কে দেখবে এসব ভেবে ভেবেই আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, তারপরেই বসন্তের ইন্টারভিউটা চোখে পরাতে আমি ঠিক করি তোদের সাথে একবার এই ব্যাপারে কথা বলব, কিন্তু এখানে এসে জানতে পারলাম যে তোরাও একটা মিষ্টি সন্তানের আশায় রয়েছিস, তাই ভাবলাম তোদেরকেই দিয়ে যাই আমার মেয়েকে দেখার ভার, অবশ্য এর পর থেকে তোদেরই মেয়ে হিসাবে বড় হবে ও। আমার মেয়েটাও কিন্তু কম মিষ্টি নয় কি বলিস? আর পর্না, তোকে দেখে মনে হল, আমার মেয়ে তোর চেয়ে ভালো মা আর পাবে না। কাজের কথা শোন, আমার সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সপত্তি আমার মেয়ের নামে করে গেলাম, যার লিগ্যাল গার্জিয়ান হবি তোরা, যতদিন না অপর্না প্রাপ্তবয়স্ক হয়, আর তার জন্য আমার জমা করা টাকা থেকে আশ্রমের তরফ থেকে প্রতিমাসে ওর পড়াশুনো ও অন্যান্য খরচা বাবদ কুড়ি হাজার টাকার চেক আসবে তোদের কাছে। জানি রেগে যাচ্ছিস, কিন্তু এটুকু আমার ওর প্রতি উপহার। একটাই রিকোয়েস্ট, বড় হলে ওর কাছে কোন কিছু গোপন রাখিস না, সব বলে দিস। আর একটা কথা, জীবনের সব থেকে বড় সিক্রেট আজ আমি তোদের কে বলছি, আমার জীবনের ভালোবাসার কথা, আমার কলেজ জীবনের ভালোবাসার কথা, যাকে আমি অনেক কারণেই নিজের মনের কথা বলি নি ইচ্ছে করেই, এখন মনে হয় না বলে ভালোই করেছি, তাহলে আমার বাবাও যেমন আমার মাকে পথে বসিয়ে চলে গিয়েছিলেন, আমিও তাই করতাম তার সাথে। যাই হোক, নাম আমি বলব না, কিন্তু তোরা বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই বুঝতে পারবি, শুধু আমার মায়ের নামের সাথে মিলিএই যে আমার মেয়ের নাম রেখেছি তা নয়, আর একজনের নামের সাথেও আমার নাম মিলিয়েও আমার মেয়ের নাম রেখেছিলাম– “অপর্ণা” ... এখন খোঁজ কে ছিল সে ? পরিশেষে, আবার বলি, তোদের হাতে আমার মেয়ের দায়িত্ত্ব সঁপে দিয়ে আমিও অনেক নিশ্চিন্ত হয়ে যাচ্ছি। ভালো থাকিস,
– তোদের অদ্রীজ
চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে, পর্না আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে ব্যাখ্যা করার কোন ভাষা আমার নেই... আমি কোন জবাব না দিয়ে বললাম, স্বামীজী আরো একটা কথা বললেন, যেটা তোমারও জানা দরকারী, আশ্রমের একনিষ্ঠ শিষ্য হবার জন্য, আশ্রমের যোগভাবনা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আর এর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য, আশ্রম থেকে ওর এক নতুন নাম দেওয়া হবে, “স্বামী অদ্রীজানন্দ”। অবিশ্বাস্য না ? আগামী মাসে জয়নগরে ওদের পুরনো বাড়িটার আশ্রমে রূপান্তরিত হবার নতুন নামকরণ করা হবে, “স্বামী অদ্রীজানন্দ ভবন”, তাই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হবার জন্য আমাদেরকে সেখানে সপরিবার হাজির থাকতে হবে। কি অদ্ভুত সমাপতন না ? আমিও ঠিক করলাম, আমাদের জয়নগরের বাড়িটাও আশ্রমকে দান করে দেব গেষ্টহাউস বানানোর জন্য। অদ্রীজের জন্য এটুকু ......কি বল তুমি ? ও আমার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকাল।
কথা বলতে বলতে ফ্ল্যাটের নীচে এসে গাড়ি দাঁড় করালাম। পর্ণার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল, আমি ওর হাতে হাত রেখে বললাম কি ভাবছ? পর্ণা উত্তরে বলল, ভাবছি কত বড়মনের মানুষ ছিল না ও? এত বড়মনের একজন বন্ধুকে আমরা এইভাবে হারাব, বুঝতেই পারিনি। কিন্তু শেষমুহুর্ত পর্যন্ত জীবনকে নিয়ে রসিকতা, হেঁয়ালি করেই কাটিয়ে গেল, কিন্তু.........। আমি বললাম, কিন্তু কি ? পর্না অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ওর শেষ হেঁয়ালি, ওর, মানে ওর প্রেম বা আমাদের মেয়ের নাম কি কারণে রাখা, সেটা কি কিছু বুঝতে পারলে?
আমি শান্ত গলায় শুধু বললাম, অপর্ণাকে ভাঙ্গলে কি হয় পর্ণা ? ও হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন, তারপর কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত ধরে চাপ দিয়ে আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি, আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি .........বলে গাড়ির দরজা খুলে, একছুটে উপরের দিকে চলে গেল,
আর আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আবার হাসপাতালের দিকে এগিয়ে চললাম, মনে মনে ভাবলাম, কোথায় আর সব হেঁয়ালি বুঝতে পারলাম পর্ণা, কিছু তো এখনো অজানাই থেকে গেল, অদ্রীজ কি সত্যি আমার জন্য চিঠিটা লিখেছিল, নাকি নিজেরটাও আমার নামে চালিয়ে দিয়েছিল? না হলে, সেটা আমাকে আগে বলে নি কেন? আবার সরস্বতী পূজোর দিনকে আমার প্রশ্নটা হঠাৎ এড়িয়ে গেল কেন? কেন ও আর কোন যোগাযোগ রাখল না আমাদের সাথে, কলকাতায় থেকেও? মনে হল কেউ যেন পাশ থেকে বলে উঠল জীবনের হয়ত সব হেঁয়ালির সমাধান হয় না রে বসন্তবাবু, কি হবে সমাধান করে? সবকিছু সমাধান না করেও দিব্যি বেঁচে থাকা যায় রে, আনন্দে জীবন কাটানো যায় !
চমকে পাশে তাকালাম, কিন্তু পরক্ষণেই টের পেলাম আমার মনের ভুল, অদ্রীজ আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, আমাদের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে সারাজীবন আমাদের মনেই থাকবে। গাড়ির জানলার কাঁচ খুলে বাইরে তাকালাম, দেখলাম আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, ভোরের আলোতে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস মনটা জুড়িয়ে দিয়ে গেল। মনের বাইরের ও ভিতরের সব ঝড় একসাথে থেমে গেছে বলে মনে হল । আমি আর কিছু চাই না, যা পেয়েছি, যতটুকু পেয়েছি, তাতেই আমি খুশি, আর পর্ণা, ওর আনন্দতো একটু আগেই দেখলাম । আমি আমার জীবনের গোল সেট করে নিয়েছি, অদ্রীজের ভাষাতে যা, প্রায়রিটি ম্যানেজমেন্ট, আজ থেকে অপর্ণা আমারও মেয়ে, না না এখন থেকেই । তাই পর্ণা ও অপর্ণার জন্য যা যা করার দরকার সব আমাকে করতে হবে। অদ্রীজের এই উপহার আমি আর কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। আর আমাদের জয়নগরের বাড়িটাও আশ্রমকে দান করে দেব, জয়নগর আশ্রমটার গেস্টহাউস করার জন্য। অদ্রীজের জন্য এটুকু তো আমি করতেই পারি । জানি এতে পর্নাও কোন আপত্তি করবে না, বরং খুশিই হবে। জীবনে এই প্রথমবার আমার মন এক গভীর শ্রদ্ধার সাথে জয় শ্রী অদ্রীজানন্দ বলে ডেকে উঠল । ভোরের শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে আমার নতুন কেনা হন্ডা সিটিটা রাত্রির কালো অন্ধকার চিরে ভোরের আলোর দিকে এগিয়ে চলল অটোমোডে ।।
( সমাপ্ত )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ২৬/১১/২০১৬অনেকবার পড়েছি। খুব ভালো লাগে, এটা বারবার পড়তে। চোখে জল চলে আসায় মন্তব্য দিতে পারিনি। শুভেচ্ছা জানাই প্রিয় বন্ধুকে।
-
শুভাশিষ আচার্য ১৫/০৩/২০১৬এটা পড়েছি আগেই। খুব ভালো লেখা শান্তনু।
-
মৃণ্ময় আলম ০৯/০৩/২০১৬বেশ ভাল দাদা
-
রুমা ঢ্যাং ২৯/০২/২০১৬গল্পটার রেশ বেশ রয়ে গেলো পড়ে। অদ্রীজানন্দ চরিত্রটার খুব ভাল ফুটে উঠেছে। অপূর্ব হয়েছে। মুগ্ধ হলাম
-
মৃণ্ময় আলম ২৬/০২/২০১৬ভাল লাগলো দাদা
-
প্রদীপ চৌধুরী. ২৬/০২/২০১৬বা খুব ভাল লাগলো
-
আজিজ আহমেদ ২৬/০২/২০১৬শেষ দুই পর্বে আর একটা গল্প জুড়ে গেল শান্তনু। বেশ ভাল লাগলো।
সুন্দর ফিনিশিং।
আশ্রম থেকে ওর এক নতুন নাম দেওয়া হবে। "নাম" মিসিং। (টাইপো) -
ধ্রুব রাসেল ২৬/০২/২০১৬অনেক ভাল লিখেছেন।
-
অভিষেক মিত্র ২৬/০২/২০১৬দারুণ লাগল শান্তনু দা। কিন্তু মনটা একটু বিষন্ন হয়ে গেল।
-
দেবব্রত সান্যাল ২৬/০২/২০১৬শান্তনু এ কি করলে ? বিধাতার মত নিষ্ঠুর হলে ! অদ্রিজানন্দকে মেরে ফেললে। আমরা যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।শুনেছি , " মৃত্যুই জীবনের শেষ সার আবিষ্কার আর শিব নীলকন্ঠ। "