www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

স্বামী অদ্রীজানন্দ- ৪র্থ পর্ব

দুপুরবেলায় মা'এর হাতের তৈরী বিউলির ডাল, গন্ধরাজ লেবু সহযোগে, আলুপোস্ত, আর ট্যাংরা মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খাওয়া শেষ করে ছোট্ট একটা ভাত-ঘুম দিয়ে, উঠলাম ঠিক সাড়ে তিনটের সময়ে। তারপরে আধঘণ্টা ধরে, একবার এটা, একবার ওটা করে গোটা ছয় জামা বদলে, চুলে টেরি বাগিয়ে যখন ঘর থেকে বেরোলাম দেখি, হাতঘড়ি সময় বলছে বিকেল চারটে। এই রে, অনেক দেরী হয়ে গেল, পাঁচটা- সওয়া পাচটায় অন্ধকার হয়ে যাবে, তার আগেই যেতে হবে আমাদের। পাঁই-পাঁই করে সাইকেল চালিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যে, অদ্রীজের বাড়ি। দেখি, অদ্রীজ রেডী হয়ে বসেই আছে, আমাকে দেখেই, সাইকেল বার করে বলল, যার জন্য এত সাজগুজ, সেই যদি ভো-কাট্টা হয়ে যায়, তবে কি আর লাভ হবে কোনও ? এই হচ্ছে, তোদের প্রবলেম, তোরা প্রায়রিটি ম্যানেজমেন্ট জানিস না...

বুঝলাম, আবার ওর জ্ঞান শুরু হল বলে, মুখে বললাম, সেটা আবার কি? অনেক ম্যানেজমেন্টের নাম শুনেছি, কিন্তু এটা আবার কোন সাবজেক্ট? অদ্রীজ হেসে বলল, এটা কোনও সাবজেক্ট নয়, এটা সেলফ ম্যানেজমেণ্ট। অর্থাৎ কোন কাজটা তোর কাছে আর্জেণ্ট, সেটা তোকে নিজেকেই ঠিক করে এগুতে হবে, মানে কোনটা আগে করতে হবে, কোনটা পরে করলেও ক্ষতি নেই...যখন যেটা আর্জেন্ট, আগে সেটা করতে হবে।

মাথায় কিছু ঢুকছে না আর এখন, বললাম ভাই, ছাড় তোর জ্ঞান পরে শুনব, আমার এখন একটাই চিন্তা, লেট হয়ে যাবে না তো? অদ্রীজ মুচকি হেসে বলল, নো টেনশন ভাই, অমিয় কে বলা আছে, যতক্ষণ না আমাদের দেখা পাচ্ছে, ততক্ষণ বেরোবে না। পাঁচটা বাজার অনেক আগেই, আমরা পৌঁছে গেলাম পর্ণার বাড়ির কাছে, দূর থেকে দেখতে পেলাম, পর্ণা ও অমিয়, দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আমরা দুজনে একটু দূরে রাস্তার ধারে একটা ছাতিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়লাম, এইবারে কিছুক্ষণ টেকিং রেস্ট। মনের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়ছে।

জীবনের প্রথম প্রেমপত্র, তাও এইভাবে দেওয়া হবে, কি যে হবে তা ভেবেই বুকটা অস্থির হয়ে উঠেছে। অদ্রীজ আমার অবস্থা আন্দাজ করে বলে উঠল, বি কুল, বসন্তবাবু, বি কুল। হ্যাঁ কুলই তো বটে, টেনশনের চোটে কুল কুল করে তো ঘেমেই চলেছি। হঠাৎ দেখি, আমার ডানপায়ের প্যান্টের পিছনে নীচের দিকটা ধরে কে যেন টানছে, চমকে ঘুরে তাকাতে দেখি, একটা নাদুস নুদুস গরু, ঘাস খেতে খেতে, আমার সদ্য কেনা নতুন প্যান্টটা ধরে পরমানন্দে চিবোচ্ছে। আমি টানতে চেষ্টা করে দেখলাম, অলরেডী, বেশ খানিকটা চিবিয়ে উদরস্থ করে ফেলেছে। দেখে রাগে গা চিড়বিড় করে উঠল। অদ্রীজ এরমধ্যেও ফুট কাটতে ছাড়ল না, মনে হচ্ছে আজকে তোর দিন খুব ভালো, দেখ গরুটাও তোর প্রেমে পড়েছে মনে হয়। আমি কোনরকমে একটা হুস-হাঁস - হ্যাট করে তাড়ালাম...কিন্তু দেখে মনে হল যেন যাবার আগে আমাকে ভালো করে মেপে নিয়ে গেল।


কিছুক্ষণের মধ্যেই তাড়া দিয়ে উঠল অদ্রীজ, নে, নে চল, এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? সময় হয়ে গেছে যে। আমি তাড়াহুড়ো করে সাইকেলে উঠে দেখি অমিয়, পর্ণাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে, আর পর্ণা, গেটে হাত দিয়ে সামনের দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে পকেট থেকে, একটা কাগজের গোলা বার করে অদ্রীজ বলল, এই নে ধর, যেতে যেতেই এটাকে একদম নির্ভুল নিশানায় পর্নার পায়ের কাছে ফেলতে হবে, কি’রে পারবি তো ? আমি থতমত খেয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক পারব, কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, এই রে, কাগজটা বাঁ হাতে ঠিক করে যদি ছুঁড়তে না পারি? আর যা হয় হোক, এখন আর ভাববার সময় নেই, কাগজটা হাতে নিয়ে জয় শ্রী রাম বলে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলাম, পাশে থেকে অমিয় বেরিয়ে যেতে যেতে দেখলাম ও ডানহাতের বুড়ো আঙুল তুলে থাম্বস-আপ করে দেখাচ্ছে, এই রে আবার মনটা কু গাইল, ব্যাটা থাম্বস-আপ করছে নাকি ঠ্যাঙ্গা দেখাচ্ছে, বোঝার আগেই, পর্ণার বাড়ির সামনে চলে এলাম, আর তাড়াহুড়ো করে চিঠিটা বাঁ হাতে দিলাম ছুঁড়ে। অদ্রীজ আমার পেছনেই আসছিল, লক্ষ্য রাখার জন্য। একটু এগিয়েই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, পিছন ঘুরে দেখি, পর্ণা এখনও দাঁড়িয়ে আছে ওখানেই, কিন্তু কেন ? হিসাবমত ওটা তো পর্ণার তুলে নেওয়ার কথা, কিন্তু ওটা কোথায় গেল?

তুই সত্যি একটা গামবাট!, একটা কাগজের গোলাও ভালো করে ছুঁড়তে পারিস না? – অদ্রীজ আমার সামনে এসে বলল, - ঐ দেখ, কাগজটা গেট অবধিও পৌঁছায়নি, রাস্তার পাশে নরম ঘাসে কেমন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছে...। এই তুই ভালো ক্রিকেট খেলিস?

কি আর করব, আবার নতুন করে তো তুলে আনা যায় না, এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে পর্না, আহা-হা-হা, বেচারী ওয়েট করছে বোধহয় আমার জন্য। নিশ্চয়ই দেখেছে আমায়! কিন্তু এখনো নিচ্ছে না কেন? ওহ, এবারে দেখলাম, রাস্তার ওপারের সামনের বাড়ির কারোর সাথে কথা বলছে। তাই তুলতে পারে নি। মনটা একটু আশ্বস্ত হল। সামনের দিকে ঘুরে, একটা সিগারেট ধরালাম। আহ! কথা বলে নিক, তারপরে ঠিক তুলবে। ওফ ! আমার আনন্দে লাফিয়ে নাচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হঠাৎ অদ্রীজ হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল এমন জোরে, যে সিগারেট হাত ফস্কে গিয়ে পড়ল জামায়, আর জামার বোতামের ঠিক পাশে একটা গোল ফুটো হয়ে গেল, হা কপাল, কি হচ্ছে, এবারে এটাও গেল? বাবা দেখতে পেলে আজকে কপালে শনি আছে শিওর, এটুকু বেশ বুঝতে পারলাম।

আমি পিছনে না ফিরেই ও'কে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? চিঠিটা নিলো? --- শুনলাম অদ্রীজ যেন বলে উঠল – না, খেলো...। আমিও খেয়াল না করে আবার বললাম- ওহ! আচ্ছা, যাক! নিয়েছে তাহলে! অদ্রীজও সেরকমই ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠল, হ্যাঁ, এখন খাচ্ছে। আমি চমকে উঠে বললাম, মানে, চিঠিটা খাচ্ছে ? কি বলছিস ? গরু নাকি ? অদ্রীজ অট্টহাস্য করে বলে উঠল, এদিকে ফিরে দেখ, সব বুঝতে পারবি... আমি চকিতে পিছনে ফিরেই যা দেখলাম, তাতে আমার পিত্ত জ্বলে উঠল। দেখি, সেই গরুটাই ঘাস খেতে খেতে, এগিয়ে এসে আমার চিঠিটাকে উন্নততর ঘাস ভেবে গলাধঃকরণ করে পরমানন্দে আমার হৃদয়টাকেই যেন চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। আমি দ্বিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ওখান থেকেই – এই...হ্যাট...হ্যাট করে উঠলাম। অদ্রীজ হাসতে হাসতে বলল, আরে করছিস কি? ও কি আর তোর কথা শুনতে পাচ্ছে ?

বসন্তের আগমনের আগেই চোখের সামনে নিজের মনের অস্ফুট প্রেমবসন্তের এমন পঞ্চত্বপ্রাপ্তি দেখে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। সাইকেল ছেড়ে, ধপাস করে রাস্তাতেই বসে পড়লাম। অদ্রীজের অনেক বোঝানোর পরে উঠে যখন বাড়ির দিকে ফিরে এলাম তখন দুচোখে শূণ্য ছাড়া আর কিছু ছিল না, সব আশা শেষ, আর নিজেকে খোরাক বানাবো না প্রতিজ্ঞা করে ফিরলাম। কিন্তু আমি নিজেকে বানাবো না, বললেও কি আর অন্যরা বানাতে ছাড়বে? যথারীতি সব কিছু চাউর হয়ে গেছে কলেজে, হাসাহাসির চোটে পরের সাতদিন কলেজে, টিউশনিতে কোথাও গেলাম না, কারোর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখলাম না, ঢের হয়েছে, এরা বন্ধু নয়, এদের থেকে শত্রুরাও ভালো। মা পর্যন্ত এসে বলে গেল, কি’রে তোকে এত শুকনো লাগছে কেন? কি হয়েছে, কলেজে কোন ঝামেলা হয়েছে? অবশ্য এর মাঝে, তিন দিন অদ্রীজ আমাদের বাড়িতে এসে, ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে আমাকে অনেক ভোকাল-টনিক গিলিয়ে গেছে । তাতে আমিও এখন একটু চাঙ্গা বোধ করছিলাম, ওকে তাই বলেই দিলাম, ঠিক আছে আমি সরস্বতী পূজোর দিনই কলেজে যাব ।  

সরস্বতীপুজার দিন যথারীতি, কলেজে গিয়ে প্রথমে বাগদেবীর আরাধনা করলাম, আমাকে দেখেই, দেখি একদৌড়ে অর্ণব এসে হাজির। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল-" বা-আ-আ-আআব্বা......... এ-এ-এ-এ-এই...... এ-এ-এ-এ-এ...ত-অ-অ........."

হ্যাঁ, এতদিন পরেই সময় হল, আমি বুঝতে পেরেছিলাম কি বলতে চাইছে ও, আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, তোরা সবাই ভাল আছিস তো ? ও উত্তর দেবার আগেই শুনি পিছন থেকে সেই মেয়েলী মিষ্টিগলায় কেউ বলল, হ্যাঁ আমরা ভালো আছি, তুমি কেমন আছো বসন্তবাবু ? আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি, গালে টোল ফেলা, গজদাঁতের মুক্তোঝরানো হাসি হেসে পর্ণা আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমাকেই জিজ্ঞাসা করছে। আমিও মুখে শুষ্ক হাসি হেসে বললাম, হ্যাঁ, ভালো আছি। তোতলা পাশ থেকে বলে উঠল - "জা-আ-আ-আনি-নিস............হ-অ-অ—অ-স-অ-অন-ত-অ-অ ... .........." - ওকে থামিয়ে বললাম তোকে আর বলতে হবে না, আমি জানি পর্ণা এখন তোদের গ্রুপে জয়েন করেছে। সাথে সাথে, পর্না আমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, মানে? তোদের মানে ? তুই বুঝি এখন আর এই গ্রুপে নেই?

আমি মাথা নেড়ে বললাম- না সরি, আমি আর কোনো গ্রুপেই নেই! এখন থেকে কলেজ, বাড়ি আর ক্রিকেট, এর বাইরে আর কোনোদিকে তাকাবার সময় দিতে পারব না, কথাটা বলেই গটগট করে হেঁটে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম, এসে পলাশদার দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে ভাবলাম, কি হল ব্যাপারটা, এতক্ষণে আমার বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড দুলে ওঠা উচিত ছিল, কিন্তু হল না কেন? আমি তো তোতলালাম না, আমি তো সহজভাবেই কথা বললাম। তাহলে আগে কেন ওরকম হত? ওহ... এবারে বুঝেছি, এইজন্যই বোধহয় বলে অদ্রীজানন্দ, কোনো কিছু পাওয়ার আশায় কিছু করতে গেলে, টেনশনেই সকলের ওরকম হয়। বুকে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। কলেজের গেটের দিকে তাকিয়ে দূর থেকে মনে হল যেন পর্ণা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসে কোনোরকম ভণিতা না করে বলল, দেখ রঞ্জন, তোর সাথে আমার একটু কথা আছে, কিন্তু একান্তে। এই বলে আমাকে নিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল একটু দূরের নিম গাছটার তলায়। আমি নিজের রঞ্জন নামটা নিজেই ভুলতে বসেছিলাম প্রায়, হঠাৎ করে পর্ণার মুখে ঐ নামটা শুনে, নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। গাছ তলায় পৌঁছে, আমার হাতে একটা মোচরানো কাগজের টুকরো দিয়ে বলল, এটা তোর দেওয়া ? আমি কাগজটা খুলেই চমকে উঠলাম, অস্ফূটস্বরে বলে উঠলাম, আরে এ কি করে হয়? এটা তো সেই চিঠিটা, তুই কোথায় পেলি? এতো সেই গরুটার পেটে... বলে দম নিতেই, পর্না মুচকি হেসে বলে উঠল, আজ্ঞে না, যেটা গরু খেয়েছে, সেটা একটা ফক্কা কাগজ, যেটা তোর হাতে ছিল, আর আসলটা ঐ অদ্রীজ ছুঁড়েছিল, তোর পিছন থেকে...

আমার অবাক হবার পালা বাড়ছেই, পর্ণা একবার আমাকে বলল, কি বিশ্বাস হচ্ছে না? তারপরে গলা খাঁকরে, অদ্রীজজজজজজ বলে চেঁচিয়ে উঠল। কিন্তু আমি বিশ্বাসটা কোন ভরসাতে করি? নিজের চোখেই দেখলাম তো কাগজটা গরুর পেটে সেঁধিয়ে গেল, মাথা কাজ করছিল না। দেখতে পেলাম, ডাকামাত্রই, অদ্রীজও হাজির। খালি এটুকু, বুঝতে পারলাম, এটাও নিশ্চয়ই ওর কোন মতলব। কাছে আসার পরে আমার দিকে ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি বসন্ত বাবু, কেমন দিলাম? আমি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, মানে? এসব কি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না যে, জবাবে হা হা হা হা করে স্বামী অদ্রীজানন্দ সেই পেটেন্ট হাসিটা হেসে, বলল, তোর ঘটে যে ঢুকবে না, তা জানতাম, বসন্ত বাবু। শোন, বলে অদ্রীজ বকা শুরু করল - সেদিনকে তোকে এত টেন্সড দেখেই আমি বুঝেছিলাম যে তোর দ্বারা ঠিক করে ছোঁড়া হবে না চিঠি... তাই, আগে থেকেই সেটার একটা ফোটোকপি করে রেখে দিয়েছিলাম নিজের কাছে, তারপর তোকে সেইটা দিয়ে বললাম, ছুঁড়তে, তুই এতটাই ক্যালাস যে, একবারও খুলে দেখলি না, ওটা কি দিয়েছি তোর হাতে...তাই আমি প্ল্যান করলাম, তুই আগে যাবি আর আমি তোর পিছনে পিছনে, যা ভেবেছিলাম তাই, তোর ছোঁড়া কাগজ গিয়ে পড়ল, গরুর মুখের সামনে, আর সেই দেখে আমি দ্বিতীয় মিসাইলটা ছুঁড়লাম, একেবারে লক্ষ্যভেদ করে গিয়ে পড়ল, পর্ণার পায়ের কাছে। ব্যস ভেরি সিম্পল ! তারপর পর্ণার হাতে সেখান থেকে, আজকে তোর হাতে।

আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, হয়ত খুশী হবার কথা ছিল, কিন্তু কেন জানি না, ঠিক খুশী হতে পারছিলাম না, মুখ তুলে অদ্রীজকে বললাম, সেটা আমাকে সেদিনকে বললি না কেন তবে ? অদ্রীজ আমার এই কথার জবাবে, কিছু বলল না বলে, শুধু বলল, আরে ছাড় না, পাস্ট ইস পাস্ট, এখন সামনের দিকে তাকাবার সময় তোদের। জানিস তুই, তোর প্রপোজাল পর্ণা আক্সেপ্ট করেছে, বসন্তবাবু। ঐ জন্যই দেখ আমাদের টিমমেম্বার হয়ে গেছে। কি রে পর্না, কিছু বল...। আমি বুঝলাম কোন এক অজ্ঞাত কারণে অদ্রীজ আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। মাথাটা আরো গরম হয়ে গেল, এত কিছু ভাল হচ্ছে, কিন্তু আমার ভালো কেন লাগছে না কেন...ওফফফ! ভগবান, মনে হচ্ছে কতক্ষণে এখান থেকে পালাব ...

পর্ণা, এতক্ষণ চুপ করে আমাদের কথা শুনছিল... সব শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ রঞ্জন, যে যাই বলে ডাকুক, আমি তোকে রঞ্জন বলেই ডাকব। এতদূর বলার পরেই, অদ্রীজ আমাকে জড়িয়ে ধরে কঙ্গগ্র্যাচুলেশন করে বলল, এবার তোরা কথা বল, আমার এর মধ্যে থাকা আর উচিত হবে না, বলেই পিছন ফিরে হন হন করে হাঁটা দিল।

পর্ণা বলেই চলেছে “থাক! তোর দ্বারা আর প্রোপোজ করা হবে না, এই করেই আমাকে কৃতার্থ করেছিস। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এরকম ক্যাবলরাম একটা বয়ফ্রেন্ড জুটবে আমার জীবনে। তবে আমারো একটা শর্ত আছে। আমি কিন্তু সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস, আমার তোকে ভালো লাগে, কিন্তু তারপরেও পড়াশুনো, কেরিয়ার অনেক কিছু বাকি আছে। আগে নিজেরা পরস্পরকে ভালো করে বুঝি, আগে ভালো বন্ধু হই, তারপর যদি মনে হয়, এই সম্পর্ককে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব, তবেই এগুবো। আর এটা আমার মতো তোর কাছেও একরকম ভাবে প্রযোজ্য। হতেই তো পারে, তুই যেরকম জীবনসঙ্গিনী আশা করিস, কিছুদিন মেশার পর তোর মনে হল যে আমি আদৌ সেরকম নয়, তখন যাতে তুই আমাকে নির্দ্বিধায় সেকথা বলতে পারবি, কোনরকম হেজিটেশন না করে, সেরকম বন্ধুত্বই করতে চাই আমি আগে। তোর যদি কোন আপত্তি থাকে আমার কোন ব্যাপারে, খোলাখুলি জানাবি, আবার আমিও তাই করতে পারব, এই আশা রাখি। আমার মনে হয়, এরকম ভাবে চলতে পারলে, ঠিক নিজেরাই বুঝে যাব একদিন আমাদের ফাইনালি কি করা উচিত। এবারে তোর কথা বল।

আমার আর কথা ! আমার মুখ দিয়ে কোন কথা সরছিল না।।ও যাই বলল, তাতেই নব্বই ডিগ্রী কোণে মাথা নাড়িয়ে গেলাম...তবে মনটা ভালো হয়ে গেল। আচমকা একটা দমকা বাতাস এসে যেন মনের বদ্ধ জানলাটা খুলে দিল...সারা জীবনের সমস্ত খুশি একসাথে পেয়ে গেলে যেরকম মনে হয়, আমারও সেরকম মনে হচ্ছিল, আনন্দে নাচব না গাইব, না হাসব সব ভেবে পেলাম না। এতক্ষণ পরে পর্ণাকে ভালোভাবে দেখলাম, কি অপরূপ লাগছে দেখতে, বাসন্তী রঙের শাড়ীতে। ওফফ ! ভাবতেই পারছি না, পেছন থেকে, ঠিক তক্ষুণি মাথায় তোতলা অর্ণবের চাঁটি খেয়ে দেখলাম, সবকটা একসাথে, জড়ো হয়েছে, আর আমাকে দেখে তাদের সে কি হাসি.. অর্ণব অনেক চেষ্টা করে বলে ফেলল –
কিরররেরের...... আআ-আ-আ-আগে.........ক-ক-ক অ-অ-হ-অ-অনও ......অ-অ-অ-ল-ল-লণা -আ-আ-কে......... দে-এ-এ-এ-একিস নি ... তারপর ঢোক গিলে বলল- না-আ-আ-আকি ?

অদ্রীজ বলে উঠল, - কি বলছিস কি ? এরকম ভাবে কি আর আগে দেখেছে নাকি? বলতেই পর্ণা সমেত সকলে হো হো হো করে হেসে উঠেছিল। আমি লজ্জায় পরে আগে আগে চললুম আর সকলে পিছনে পিছনে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে একটু ফাঁকা পেয়ে অদ্রীজকে পাকড়াও করলাম – তোর উপরে এবারে সত্যি আমি রেগে গেছি জানিস? তুই এরকম করতে পারলি আমার সাথে? তুই একবারও জানালি না আমাকে এসব কথা? গত সাতদিন আমার উপর থেকে কি গেছে জানিস?

অদ্রীজ শান্ত ভাবে বলল, আগেই যদি বলে দিতাম, তাহলে আজকের এই আনন্দ আর এই শান্তিটা কি পেতিস? পৃথিবীটা এখন তোর কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে না? এই থ্রিলটার নামই তো জীবন। একে উপভোগ করতে না পারলে যে জীবনটাই অর্থহীন হয়ে যাবে রে। আমাকে ক্ষমা করিস, আমি যদিও বুঝতে পারি নি, যে তুই এতদিন আসবি না, ঐজন্য মাঝে মাঝে তোকে গিয়ে চাঙ্গা করে এসেছিলাম। জানতাম তুই আজকে আসবি, আর তাই সমস্ত কিছু রেডী করে তোকে সার্পরাইজ দিলাম। আমি আনন্দে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোকে বোঝা যে কি জিনিস, আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমি সত্যি ভাগ্যবান যে তোর মত বন্ধু পেয়েছি।

সবকিছুরই একটা সময় আছে... কোন কিছু নতুন শুরু হলে, পুরোনো
কিছু ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও দুটোকে ব্যালেন্স করে চলাটা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে আমাদের প্রেমটা জমে উঠল। ওদিকে আবার গ্রুপআড্ডার সময়টা কমতে কমতে ধীরে ধীরে শূণ্যে এসে দাঁড়াল। কলেজ শেষ হবার পরে কলকাতায় এসে, পর্না এমবিএ ও আমি কম্পিউটার আপ্লিকেশনের কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম, তারপর প্রেম, পড়াশুনো আর পরিস্থিতির চাপে সকলের সাথেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। তবে অদ্রীজের সাথে যোগাযোগ আমার ঠিকই ছিল, ওর মাধ্যমেই জয়নগরের খবর জানতে পারতাম। এরকমই হঠাৎ একদিন অদ্রীজের মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেলাম, ছুটে গিয়েছিলাম দুজনেই। মনে আছে সেই শেষবার ওর সাথে আমার দেখা। তার ও দুমাস পরে অমিয় জানালো সবচেয়ে বিস্ময়কর কথাটা, অদ্রীজ নিজেদের বাড়িটা রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানকে দান করে দিয়ে কোথাও যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কথাটা প্রথমে বিশ্বাস করিনি আমরা কেউই, তবে ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে হল...।






*** পনেরো বছর পর এক শনিবার ******



কি’গো এতক্ষণ ধরে ঘুমোলে চলবে? কতক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছি...শুনলে তো আমার কথা? এই বলে পর্না আমার মুখের উপরে গ্লাসের জলের ছিঁটে দিয়ে দিল... আমি চোখমুখ কুঁচকে পর্ণার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, স্নান করে রেডী হয়ে আছে ও! এই এতদিন পরেও প্রায় একইরকম রয়ে গেছে ও! খালি একটু মোটা হয়েছে, এই পনেরো বছরে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম.. আটটা বেজে গেছে, না আর শুয়ে থাকলে হবে না... আমাদের দুজনেরই আজ, একটা ইম্পর্ট্যান্ট মেডিটেশনাল ট্রেনিং আছে, অফিসেরই বোর্ডরুমে। সমস্ত ডিপার্টমেন্টাল হেডদের প্রতি কড়া নির্দেশ, আমাদের সিইও –এর, কোনওভাবেই মিস করা যাবে না।  ঘটনাচক্রে দুজনেই এখন একই কোম্পানীর হেড অফিসে চাকরি করছি, আমি আই.টি হেড ও পর্ণা, এইচ.আর –এ ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে। কলকাতার সেক্টর ফাইভে ঝাঁ চকচকে অফিস আমাদের, দুজনের নিজস্ব নিজস্ব কেবিন, দেশের সর্ববৃহৎ নন-ব্যাঙ্কিং ফাইনান্সিয়াল কোম্প্যানী। বেশ স্বচ্ছল জীবন। কলকাতায় বড় কমপ্লেক্সে, নিজস্ব ফোর বিএইচকে ফ্ল্যাট, দুজনের তিনটে গাড়ি, সাজানো সুখের সংসার। বাবা-মা দুজনেই পরপর দুবছরের মাথায় গত হয়েছেন, তাই এখন আমি আর পর্ণা, জয়নগরের বাড়িটাও আছে, তবে সময়াভাবে আর যেতে পারি না, ভাবছি এবারে বিক্রি করে দেব।

আমি পর্ণার কোমল স্নিগ্ধচোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, সাজানো সংসার তো বটেই, কিন্তু সত্যি কি সুখের ? গত সাত বছর হল, আমরা বিয়ে করেছি, তার আগে চুটিয়ে প্রেম করেছি, কখন যে তুই থেকে তুমিতে পরিবর্তন হয়ে গেছে, নিজেরাও খেয়াল করি নি। কিন্তু এই গত সাতবছরে, পর্ণার মনের উপর দিয়ে কি ঝড় গেছে, শুধু আমি জানি, দু-দুবার মিস ক্যারেজ  একটা মেয়ের উপরে যে কি পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করে, তা ওকে এত কাছ থেকে জানি বলে আমি টের পাচ্ছি। মনে মনে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে পর্ণা। আর ওকে এভাবে দেখে আমিও নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না, আর তাই, জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যটা আমাকে ওর কাছ থেকে গোপন রাখতে হয়েছে, প্রতি মুহুর্তে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যেতে হচ্ছে। শেষের বার ডাক্তার রয় আমায় বলেই দিলেন, মিঃ চৌধূরী, সত্যি কথা বলতে আপনার স্ত্রীর ওভারীতে কিছু কমপ্লিকেশন থাকার জন্য ইট ইজ নট সেফ, কি উনি আবার নতুন করে গর্ভধারণ করুন। কনসিভ করলে ওনার শরীরের অপরিসীম ক্ষতি হতে পারে, এমনকি এতে ওনার জীবনসংশয় পর্যন্ত হতে পারে।এতবড় কথাটা কি করে আমি পর্ণাকে বলব, তা ভাবতে ভাবতেই ছমাস পেরিয়ে গেল, ও মানসিক ভাবে আবার প্রস্তুত করছে নিজেকে, কিন্তু আমি অবিচল, আমাদের সন্তান দরকার নেই, ওকে বলতেই হবে যে করেই হোক, অন্য অনেক উপায় আছে, কিন্তু কিছুতেই আমি ওকে হারাতে পারব না। এই নিয়ে একটা অদৃশ্য দ্বন্দ চলছে আমাদের দুজনার। পর্ণা এটাতে নিজেকেই দোষী মনে করে, আর তাই এই ছমাস আমরা পরস্পরের সাথে ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি, দুজনেই আপ্রাণ চেষ্টা করছি যাতে, কেউ কোনোকিছুতে আঘাত না পায়, জোর করে সম্পর্কটাকে সহজ করার চেষ্টা জোরকদমে চলছে দু তরফ থেকেই।  

পর্ণা আমার মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ল, ভেজা চুলটা দিয়ে আমার গালে সুরসুরি দিতে দিতে বলল, কি ব্যাপার স্যার, আজকে কি আর যাওয়া হবে না নাকি ? জানেনতো কে আসছেন ট্রেনিং দিতে?...চোখের কোনাটা টনটন করে উঠল, আমি পাশ ঘুরে শুয়ে বললাম, না আসলে, মেলটা ঠিক করে দেখার সময় পাই নি, কে আসছেন গো? আরে, লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ যোগা অ্যান্ড টাচথেরাপী থেকে, ওখানকার এক প্রোফেসর না ডিরেক্টর, কি নাম যেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পরেছে, মিঃ সোম বলে একজন আসছেন আমাদের এই বিশেষ ট্রেনিংএর জন্য। আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বললাম- বাব্বা, একেবারে লন্ডন থেকে, এ পোড়া দেশে কি কাউকে পেল না তোমাদের এইচ.আর ডিপার্টমেণ্ট। জবাবে পর্ণা কিছু না বলে, মুচকি হেসে, মাই ডিয়ার হাসব্যান্ড, অনেক সময় হল, এবারে উঠে আমাকে কৃতার্থ করুন, বলে উঠে চলে গেল।

কি আর করব, যেতে হবে যখন, তখন আর শুয়ে থেকে লাভ নেই, আমিও উঠে পড়লাম। অফিসের বোর্ডরুমে ঢুকে দেখি, প্রায় সকলেই এসে পড়েছে, আমরাও আসন নিলাম। ঘরটা আধা-আলো, আধা অন্ধকার করে রাখা আছে, একেবারে সামনে এক ভদ্রলোক, চেয়ারে বসে আছেন, আর তার দুই সহকারীকে নির্দেশ দিচ্ছেন, বুঝলাম প্রেজেন্টেশনের জন্য ল্যাপটপের সাথে প্রোজেক্টর ও স্ক্রীনকে একাত্ব করার চেষ্টা চলছে। পর্না আমার কানের কাছে মুখ এনে, ফিসফিসিয়ে বলল, মনে হচ্ছে, উনিই সে মিঃ সোম, আরে বসে আছো কেন? উঠে যাও না, তুমি আইটির হেড, ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞসা করে আসা উচিত তোমার কিছু প্রয়োজন আছে কিনা... হ্যাঁ তাইতো, ঠিক কথা বলেছে পর্ণা, যাই তাহলে একবার, পরিচয়টাও হয়ে যাবে। এগিয়ে গিয়ে কথা বলে এলাম ওনার সাথে, ভদ্রলোক বাঙ্গালী, নাম মিঃ এ সোম, পুরো নাম বললেন না, বেশ পাশ্চাত্য যোগাগুরুর বেশ-ভূষা, কোট, টাই, প্যান্ট, ব্ল্যাক শু, ব্যাকব্রাশ করা ব্রাউন চুল, দুর্দান্ত ফিজিক, দারুণ চোস্ত কথাবার্তা, পেছনে পনিটেল, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, হাতে দেখলাম রোলেক্সের হাতঘড়ি। ইংরাজী উচ্চারণেও পাশ্চাত্য প্রভাব বেশ ভালো অনুভব করলাম, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর ককটেল, বেশ ইম্প্রেসিভ পার্সোনালিটি!  


মিনিট পনেরোর মধ্যেই, সেশন শুরু হল, মিঃ সোম, মাউথপিস ধরে আমাদের দিকে অ্যাড্রেস করে, নিজের পরিচয় দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন- নমস্কার, আমি কি বাংলাতে কথা বলতে পারি, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে... কেউ কোন আপত্তি করে নি... উনি ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি অদ্রীজ সোম, এই পশ্চিমবঙ্গেরই ছেলে, তবে এত বছর বিদেশ-বিভুঁইতে থাকার ফলে, নিজের নামের উপর অনেক যন্ত্রণা সহ্য করে এখন এ সোম বলেই নিজের পরিচিতি দিয়ে থাকি সবাইকে। এখন আর  পুরো নামটা আর কারোকে বলি না এখন। সকলে আমাকে এ সোম বলেই চেনেন।

কথাটা শোনার সাথে সাথে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল, নামটা শোনা মাত্র আমি আর পর্না মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সোজা হয়ে বসলাম। আমি জানি, পর্ণা কি ভাবছে। আমি আর পর্না ও'কে অনেক খুঁজেছিলাম, না, মানে চেষ্টা করেছিলাম খোঁজার, কিন্তু সময় পাই নি, তখন সবে চাকরীতে ঢুকেছি, নিজেদের ভবিষ্যৎ এর চেয়ে কোনো কিছু বেশী ইম্পর্ট্যান্ট ছিল না, জীবন এগিয়ে চলল, অদ্রীজও শুধু রয়ে গেল মনের চিলেকোঠায়। যে কোন নস্ট্যালজিক মুহুর্তে আমি ও পর্ণা ওকে মিস করতাম, কিন্তু ব্যস ঐ পর্যন্তই। একটা অজানা অপরাধবোধ এ জন্য সারাজীবন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এখন যখন নামটা শুনলাম, মনটা খাঁ-খাঁ করে উঠল। ভাবলাম ইশ! যদি আজ অদ্রীজকে পেতাম ! আমার অন্তত ওকে খোঁজা উচিত ছিল। আজকে আমার আবার অদ্রীজকে যে ভীষণ দরকার। একমাত্র ঐ পারে পর্নাকে আবার আমার হয়ে বোঝাতে। কি করি কিছু ভালো লাগছিল না, তাই সেশন থেকে মাঝপথে উঠে বেড়িয়ে এলাম আমি। বাইরে এসে, স্মোকিং এরিয়াতে একটা ট্রিপল ফাইভ সিগারেট বার করে ধরাতেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম। মনে হল, আমার অন্তুত আরো খোঁজা উচিত ছিল, ওইভাবে স্বার্থপরের মতো গা-ঝেড়ে ফেলে কি ঠিক করেছি? নিজেকে অপরাধী মনে হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু এখনকার আমি বড় বেশী কর্পোরেট কালচারে ডুবে গেছি, কিন্তু পর্নাও কি তা হয়নি? না, মনে হয়, ওর অন্তরটা হয়ত এখনো আমার মত কঠিন হয়ে ওঠেনি।

ইচ্ছে করেই আর ঢুকলাম না ভিতরে, টেবিলের উপর থেকে ইকোনোমিকস টাইমটা নিয়ে নেড়ে চেড়ে কিছুক্ষণ দেখার পর আরো একটা সিগারেট ধরাতে যাবো, তক্ষুনি পেছন থেকে কেউ বলে উঠল- ডিয়ার মিঃ চৌধূরী, মে আই হ্যাভ ওয়ান টু জয়েন ইউ ? ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড... আমি পিছন ফিরে দেখলাম, মিঃ অদ্রীজ সোম। সাথে সাথে প্যাকেটটা ওনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম- ইয়েস, ইয়েস, সিওর, ইটস মাই প্লেজার টু হ্যাভ ইউ উইথ মি, অ্যান্ড ট্রাস্ট মি আই ক্যান গিভ ইউ আ গুড কোম্পানী। মিঃ সোম একটা অট্টহাস্য করে বলে উঠলেন – কিরে ইংরাজীটা দেখছি বেশ ভালোই বাগিয়েছিস, কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাকে তোরা চিনতে পারলি না বসন্তবাবু।

আমি যেন ভূত দেখার মতো করে চমকে উঠলাম। হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল। মুখ দিয়ে বেরল- তুই, তুই, তুই... পেছন থেকে পর্না বলে উঠল, হ্যাঁগো, দেখো, ওই আমাদের শ্রীমান স্বামী অদ্রীজানন্দ। দেখো কেমন চমকে দিয়েছে আমাদের...আমি আনন্দে আত্ত্বহারা হয়ে উঠলাম, অদ্রীজকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম, ভাই, কোথায় গিয়েছিলিস তুই আচমকা, তোকে কত খোঁজার চেষ্টা করেছি জানিস? আমাকে তো অন্তত জানিয়ে যেতে পারতিস।

নীচু গলায় অদ্রীজ বলে উঠল, সেই প্রায়শ্চিত্ত করতেই তো আসা, এবারে গেলে বলে যাব তোদেরকে নিশ্চয়ই। তোরা ওয়েট কর, আমি নেক্সট সেশনটা সেরে আসি। এটাই লাস্ট, তারপরে আমার হোটেল আর জমিয়ে আড্ডা। পর্ণা, মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠল, কোত্থাও না, সোজা আমাদের বাড়ি, তুই আমাদের বাড়িতেই থাকবি, কোনো হোটেলে না, হ্যাঁগো, তুমি কিছু বল...এবারে আমার দিকে তাকিয়ে অনুযোগের সুরে বলে উঠল। আমিও সাথে সাথে, নিশ্চয়ই, কোন কথা শুনব না, চ্যালা-চামুন্ডাকে হোটেলে পাঠিয়ে আমাদের বাড়ি চল আগে, আমারও কিছু প্রায়শ্চিত্ত বাকি আছে। অদ্রীজ হেসে বলল, তাহলেও আমাকে একবার হোটেলে যেতে হবে রে, আমার মেয়ে ওখানে একা আছে।। ওকে নিয়ে যেতে হবে।

মেয়ে ??? আমি আর পর্ণা একসাথে চিৎকার করে উঠলাম............


( চলবে )
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৭০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/০২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আজিজ আহমেদ ২৫/০২/২০১৬
    সুন্দর টার্ন শান্তনু।
    তবে 'রম-কমে' কমেডি চলে যাচ্ছে।
    • ধন্যবাদ আজিজদা। এটা আসলে রোমান্স, কমেডি ও ট্রাজেডির ককটেল । পরের পর্ব আগামীকাল দেব । শেষ পর্ব । পুরোটা পড়ে বল কেমন হয়েছে ...
  • রুমা ঢ্যাং ২৪/০২/২০১৬
    গল্পকার জানে ঠিক কোন জায়গায় বিরতি নিলে সারপ্রাইজ বজায় থাকে। ঠিক মোক্ষম জায়গায় থেমে গেলে। পরেরটা তাড়াতাড়ি দিও অপেক্ষায় রইলাম
  • চলবে তো বটেই। মজার গল্পটা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের মত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। এ গল্পের আকর্ষনীয় ব্যাপার গল্পের তথাকথিত নায়ক নায়িকার প্রেম নয় , গল্পটা অদ্রিজের। তাই শেষে তাকে থাকতে হবে।
  • অভিষেক মিত্র ২৩/০২/২০১৬
    দারুণ এগোচ্ছে শান্তনু দা।
 
Quantcast