www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

স্বামী অদ্রীজানন্দ - ১ম পর্ব

“ধূস!, বুঝলি বসন্তবাবু, তোর দ্বারা আর হবে না”- কথাটা বলে নিজের প্লেটের মোগলাই পরোটার শেষ টুকরোটা পরম মমতাভরে মুখে চালান করে দিয়েই আমার দিকে চেয়ে বলে উঠল অদ্রীজ, “আর কতোভাবে তোকে হেল্প করব বলবি একবার? তোর জন্য যা খাটছি, এই পরিশ্রম আমি নিজের পড়াশুনোতে দিলে, আর কেউ না হোক, অন্তত আমার মা-বাবা ধন্য হয়ে যেত”।

আমি বসন্তরঞ্জন চৌধুরী, ঠাকুমার দেওয়া নামের অপভ্রংশ করে বন্ধুমহলে চেষ্টা করেছি, শুধু রঞ্জন নামে পরিচিত হবার, কিন্তু চোরা কি আর শোনে ধর্মের কাহিনী? আমাকে বসন্তবাবু বলেই খ্যাপায় সকলে, নামটা একটু সেকেলে তো তাতে কি, তাই বলে কি উঠতে বসতে তা জানান দিতে হবে? কি আর করব, জানি এখন গালি খাবার সময়, মুখ নীচু করে মোগলাইয়ের প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে শুনছিলাম। অদ্রীজ বলেই চলল, আরে বাপু, সবকিছুরই একটা টাইম লিমিট আছে, বুঝলি হাঁদারাম? এই যে, এই যে তুই মোগলাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছিস, এই মোগলাইয়েরও তা আছে, আর কিছুক্ষণ পরে যখন ঠান্ডা হয়ে জুতোর সোল হয়ে যাবে, তখন চিবোতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাবি কথাটা। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়, যত ফেলে রাখবি, তত ঝামেলা।

আমি হাল্কা প্রতিবাদের সুরে বলতে গিয়েছিলাম যে আমি আর কি করব? আমি তো চেয়েছিলাম..., কথাটা শেষ না করতে দিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠল আবার – না, তুই আর কি করবি? কিছুই না, যা তুই নাকে তেল দিয়ে ঘুমো, আর সাহাপাড়ার ঐ অমিয় নামের বখাটে ছোঁড়াটা পাখি উড়িয়ে নিয়ে যাক খাঁচা থেকে। ফুঃ! - বলে সিগারেটটা ধরিয়ে আয়েস করে একটা সুখটান দিয়ে নিজের জ্ঞানদা ভাণ্ডারের সমস্ত জ্ঞান আমার দিকে ছুঁড়ে দিল- বুঝিস না, বুঝিস না, সময় কি জিনিস তোরা বুঝিস না, বলছি শোন, সময়ের জ্ঞান যার আছে, সে জানে তার মূল্য...

সময়ের মূল্য কি, তা যে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, হাতঘড়িতে অলরেডি রাত্রি নটা বাজে, বাড়ি ফিরতে রাত দশটা হলে বাবা আমার বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে এটা বিলক্ষণ জানি তাই, মোগলাইয়ের প্লেটের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আর একটা কারণ অবশ্য আর কিছুক্ষণ না খেয়ে ওর ভাষণ শুনলে সত্যিই আমাকে জুতোর সোল খেতে হবে। আমিও খেতে থাকলাম, আর স্বামী অদ্রীজানন্দ সমসাময়িক সময়ে, সময়ের উপরে বক্তৃতা চালিয়ে যেতে লাগল – শোন, সময় হল, ধনুকের তিরের মতো, একবার ছেড়ে গেলে আর ফিরে আসে না, বা থামানোও যায় না। এর দাম জানে তারা, যারা নিজস্ব নিজস্ব ক্ষেত্রে একবার করে ব্যর্থ হয়েছে, যেমন তুই, তুইও জানবি, যখন ব্যর্থ হবি, কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকবে না।

আমি পরোটাটা মন দিয়ে খেতে খেতেই আনমনে বলে ফেললাম – মানে? কারা ব্যর্থ হয়েছে ? আর তাদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? রসিকতা ছাড় ।

"মানে? ওয়েট, আচ্ছা? রসিকতা করছি আমি? ওকে, ঠিক হ্যাঁয়! তাহলে বল দেখি তুই, এক বছর, দশ মাস, এক মাস, এক দিন, এক ঘন্টা, এক মিনিট আর এক সেকেন্ড সময়ের দাম কতটা জীবনে?

এই রে, আচ্ছা বিপদে পড়া গেল দেখছি, এরকম করে তো কখনো ভাবি নি, সময়ের দাম আছে বলে জানি, কিন্তু একেবারে ধরে ধরে কখনো তো কেউ বলেই নি। আমি চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করলাম, কারণ জানি, কথা বা তর্ক, কোনোটাতেই আমি ওর সাথে পারবো না, সাধে কি আর অঙ্কের স্যর আর বন্ধুরা ওর নাম রেখেছি- স্বামী অদ্রীজানন্দ। একবার ওর জ্ঞান শুরু হলে আর রক্ষে নেই। টিচাররা অবধি ক্লাসে কানে তুলো গুঁজে রাখে পারলে।

যাই হোক, কথা আর না বাড়িয়ে, আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে জানি না। আমার মাথা নাড়ানো দেখে, মুখে একটা প্রশান্তির হাসি এনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল -  এক বছর সময়ের দাম আর ব্যথা সেই পরীক্ষার্থী জানে, যে ফেল করে একটা গোটা বছর নষ্ট করেছে, দশ মাস সময়ের দাম সেই মা জানে, যে দশমাস সময় ধরে এক নবজাতকের জন্মের জন্য অপেক্ষা করেছে, এক মাস সময়ের দাম সেই লোকটি জানে, যিনি আর একমাস পরে চাকরী থেকে রিটায়ার করবেন,

আমি খাওয়া ভুলে গিয়ে কেমন যেন তন্ময় হয়ে ওর কথা শুনতে লাগলাম, সত্যিই তো এরকম করে কেই বা ভেবেছে! অদ্রীজ চোখ বন্ধ করে বলে চলেছে, - এক দিন সময়ের দাম সেই ছেলেটা জানে, যার মাত্র একদিন সময় বেশী হয়ে যাবার জন্য চাকরীর পরীক্ষাটা দিতে পারলো না, একঘন্টা সময়ের দাম সেইসব বাচ্চা ছেলেরা জানে, যাদের একঘন্টা নীল ডাউন করিয়ে রেখে শাস্তি দেওয়া হয়, এক মিনিট – সেই লোকটা জানে, যে এক মিনিটের জন্য বাড়ি ফেরার রাতের শেষ ট্রেনটা মিস করেছেন আর এক সেকেন্ড সেই লোক জানে যে, এক সেকেন্ডের জন্য নিশ্চিত মৃত্যুর অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন।  

কখন আমার হাত দুটো খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে, নিজেও বুঝতে পারিনি, বক্তৃতা শেষ হবার পরে হাতদুটো আপনা থেকেই তালি দিয়ে উঠলে, সম্বিৎ ফিরে পেলাম, ততক্ষনে বাকিটা জুতোর সোলের মতোই শক্ত হয়ে গিয়েছিল, আমি ফেলে দিয়ে উঠে গদগদ কন্ঠে বললাম, ওহ! মাই গড, অদ্রীজ ! কি বললি রে মাইরী, এরকম একটা স্পীচ তো তোকে নোবেল প্রাইজ পাইয়ে দেবে। কি রিসার্চ করেছিস ভাই!

আমার গদগদ চেহারাটা দেখে ওর হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল মনে হয়, দেখলাম নিজেই দুজনের বিলটা মিটিয়ে দিল রেস্টুরেন্টের। দেখে আমিও বেশ খুশী হলাম, এমনিতেই, গত পনের দিন ধরে আজ এটা, কাল সেটা ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে পকেট প্রায় গড়ের মাঠ। টিউশনির টাকায় আর কত চালানো যায়? নিজের ঠ্যাকা তাই, নাহলে...

রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আমি আবার ওকে বললাম ভাই, তুই এসব চর্চা কখন করিস?, ও আস্তে করে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল- দেখ তুই আমার খুব কাছের বন্ধু বলেই বলছি, আর পাঁচকান করিস না, আসলে এটা আমারও কালেকশন বুঝলি, কারোর মুখে শুনেছিলাম, জাস্ট সুযোগ পেয়ে তোর কাছে ঝেড়ে দিলাম। বলেই হা হা হা হা হা করে এক বিকট অট্টহাস্য দিয়ে উঠল।  

রাগে আমার গা পুরো জ্বলে যাচ্ছিল, ওর পশ্চাৎদ্দেশে খুব জোরে নিজের পাদুকার স্ট্যাম্প বসাবো ভেবে পা তুলেই ফেলেছিলাম, কিন্তু পরক্ষণেই নিজের কার্য উদ্ধার ও রেস্টুরেন্টের বিল মেটানোর কথাটা মনে পড়ে যাওয়াতে, পা আবার যথাস্থানে ফিরে এলো। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে উঠলাম-যাক তুমিও তাহলে, বাড় খাও স্বামী অদ্রীজানন্দ, হুঁ, হুঁ। ঠিক আছে এবার থেকে তোমায় আমি কৌশলা করিয়া কাটিব। যাই হোক তখনকার মতো ওকে বিদায় করে, সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।  

পথে যেতে যেতে ভাবলাম, একটা কথা ঠিক বলেছে কিন্তু ও, সময় থাকতে থাকতে আমাকে পর্ণার সাথে কথা বলতেই হবে, নাহলে যা দিনকাল পড়েছে, আবার কখন দেখতে পাব, ঐ সাহাপাড়ার অমিয়টার সাথে হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু কি করে বলব সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না, কতবার চেষ্টা করলাম, এই তো আজকেও টিউশনি থেকে বেড়িয়ে সোজা ওর মুখোমুখি, দাঁড় করিয়ে দিল অদ্রীজ,  কিন্তু সেই এক যা-তা অবস্থা, অদ্ভুত এক ভয়ে আমার পা আর এক পা'ও এগুলো না, বুকের ভেতরে যেন হাজার ড্রাম বাজার আওয়াজ, অদ্রীজ অনেক হেল্প করেছে এই ব্যাপারে, বার দুয়েক সামনা-সামনি হয়েও কথা বলতে পারি নি, ওর সামনে গেলেই যেন বিশ্বব্রহ্মান্ড সব যেন আমার চোখের সামনে ঘুরতে থাকে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, তোতলাতে থাকি। কিন্তু এমনিতে আমি খুব স্মার্ট। এর আগেও বন্ধুদের হয়ে একে –ওকে- তাকে বলে দিয়েছি, সাকসেস রেট ৮০ শতাংশ, কিন্তু নিজের বেলায় কেন যে হাতগুলো পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না। পর্ণা আমাদের এই ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুর, জয়নগর তারাসুন্দরী কলেজে গত দুমাস হল জয়েন করেছে ইংলিশ অনার্সে – ফার্স্ট ইয়ার।

স্বামী অদ্রীজানন্দের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলাম যে, ওর বাবার নাকি ট্রান্সফেরেবেল সরকারী চাকুরী, পাঁচবছর অন্তর বদলি, তাই বাধ্য হয়েই এখানের কলেজে এসে ভর্তি হয়েছে ও, আর পড়াশুনোতেও ব্রিলিয়ান্ট। আর আমি, মানে আমরা হলাম গিয়ে সেকেণ্ড ইয়ার পাস কোর্স। অদ্রীজ একমাত্র আমাদের মধ্যে যে একবার চেষ্টা করেছিল, ইংরাজী নিয়ে নাড়া-চাড়া করার, কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে, আবার তিন মাসের মাথাতেই ভোলবদল করে আমাদের পাশে এসে বসে শেক্সপিয়ার, শেলী, কীটস সম্পর্কে ওর জ্ঞানের খাতা উপুড় করা শুরু করল। ওর অত্যাচারে আমরা কয়েকজন ক্লাসের ডেস্ক অবধি চেঞ্জ করে ফেললুম, কিন্তু তাতেও কি আর রক্ষে আছে? ওর জ্ঞানদা ভান্ডার ক্রমশই ক্লাসের সকলকে গ্রাস করে টিচারদেরও কাবু করা শুরু করেছিল।

একবার ক্লাসে অঙ্কের স্যর কুশ কুমার কর মহাশয়, খুব রাশভারী লোক সংক্ষেপে কে. কে. কে. - যিনি ছাত্রমহলে “কান কাটা কুত্তা” নামেই অধিক জনপ্রিয় ছিলেন, সকলের পড়াশুনোর হাল দেখে, চেঁচিয়ে উঠে বললেন- অপগন্ডো সব, ক্যালাস, এরা পাস করবে কি করে, আরে তোরা কি কিছুই করবি না ভবিষ্যতে? গড্ডালিকা প্রবাহে বইছিস ? বাবার হোটেলে আর কতদিন থাকবি? নিজেদেরকে তো রোজগার করতে হবে নাকি...ছিঃ ছিঃ ছিঃ তোদের থেকে ক্লাস ফাইভের বাচ্চারাও ভালো অঙ্ক করে...

খুব স্বাভাবিক ভাবে সকলেই স্পিকটি নট, মাথা নীচু, হঠাৎ স্বামী অদ্রীজানন্দ হাত তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল- স্যর যদি অভয় দেন, তাহলে দুটো কথা বলতে চাই। কে. কে. কে. – এর চোখ যেন জ্বলে উঠল, দাঁত চেপে বললেন – বল কি বলতে চাও?

অদ্রীজ খুব শান্ত ভাবে বলল – স্যর যদি পারমুটেশন ও কম্বিনেশনে যাই, তাহলে, জানতে হবে ঠিক কত সেট ফাইভের বাচ্চা আমাদের থেকে ভালো অঙ্ক করতে পারবে, যদি না পাওয়া যায় তো কোনও কথা নেই, পাওয়া গেলে আরো দুটো কথা আছে। আমাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে চলেছে, অদ্রীজের কোন ভাবান্তর নেই, বলে চলেছে, যদি পাওয়া যায়, তাহলে স্যর কেন তারা ফাইভে পড়ছে, ডাইরেক্ট আমাদের জায়গায় নেওয়া হচ্ছে না কেন? যদি না নেওয়া হয় তাহলে কোন কথা নেই, যদি নেওয়া হয় তাহলে আরো দুটো কথা আছে। নেওয়া হলে অংক না হয় তারা করল, বাকি সাবজেক্ট তারা কি পারবে? যদি পারে তো কোনও কথা নেই, যদি না পারে তাহলে দুটো কথা আছে, যদি না পারে তাহলে ওরা আমাদের থেকে ভালো হবে কি করে, আবার আমরাও তো ক্লাস ফাইভ পাস করে এসেছি এখানে, তাহলে কারা বেশী ভালো? যদি আমরা ভালো হই তাহলে কোন কথা নেই, যদি তাও ওদেরকে ভালো বলা হয় তাহলে আরও দুটো কথা আছে,... পিথাগোরাসের উপপাদ্য অনুসারএ...আয়া ইক্কক !!

আমরা মিচকি করে হাসা শুরু করে দিয়েছিলাম, হঠাৎ এই ছন্দপতনে তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে, কান কাটা কুত্তা, পাগলা কুত্তা হয়ে উঠেছিলেন বোধহয়, হাতের চকটা সজোরে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন অদ্রীজের দিকে, আর একদম নির্ভুল নিশানায় ওটিও মালিকের নির্দেশ মেনে সোওওওজা এসে ঢুকে পড়ল, বেচারা অদ্রীজের মুখের ভিতরে আর যার ফলেই এই বিপত্তি।

কে. কে. কে কাছে এসে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে গেলেন, এই ইউ, এবারে আমি দুটো কথা বলছি,  মন দিয়ে শোনো, ফালতু কথা না বলে, মন দিয়ে পড়াশুনোটা কর, অঙ্কের খাতায় তো তোমার পারমুটেশন, কম্বিনেশন, পিথাগোরাস কিছুই দেখতে পাই না হে ছোকরা। কি কি হবে বড় হয়ে ভেবেছ কখনো?

অদ্রীজ চকের টুকরোটা ঢক করে গিলে নিয়ে শান্ত ভাবে উত্তর দিল, স্যার আমি যাই করি না কেন, ঐ স্পিরিচুয়ালিটি নিয়েই থাকবো, মানে শ্রী রামকৃষ্ণের মতবাদ আমি খুব ভালোবাসি। ওনার কথা আমার কাছে অমৃতকথার সমান।

কে. কে. কে  আবার ভ্রূ কুঁচকে দেখে বললেন মানে, তুমি কি সন্ন্যাসী হবে নাকি ? স্বামী অদ্রীজানন্দ? আমরা সকলে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লাম। রামকৃষ্ণের কি বোঝ হে তুমি?

অদ্রীজ আরো শান্ত ভাবে বলল, না স্যর, বেশী কিছু বুঝি না, যেটুকু আমি বুঝি, তাও অনেকে বোঝেন না বলুনতো, শ্রীরামকৃষ্ণ একহাত নীচে পেটের কাছে হাতের তালু গোলাকার করে ও একহাত উঁচু করে দুটি আঙুল খাড়া করে যে ভঙ্গী আমাদের দেখিয়ে গিয়েছেন তার মানে কি? আচমকা এই প্রশ্নের জন্য, কে. কে. কে নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না, কিছু বুঝতে না পেরে বললেন – না জানি না,  কি বোঝাতে চেয়েছেন উনি?

অদ্রীজ হেসে বলে উঠল – বৎস্যগণের উদ্দেশ্যে ওনার এই ভঙ্গিমার অর্থ হল, দুটি রুটি ও একবাটি ডাল! অয়ন্তিকা সবে জলের বোতল খুলে জল ঢালতে শুরু করেছিল গলায়, অদ্রীজের এই কথাতে বিষম-টিষম খেয়ে একাকার কান্ড। অদ্রীজ বলে চলেছে, উনি যুগপুরুষ, উনি মহাসাধক, তাই দিব্যদৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু দুটি রুটি ও একবাটি ডালই আমাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। বাকি সব আমাদের লোভ। না হলেও চলবে। আবার সকলেই এই পন্থা অবলম্বন করলে, সকলের খাবারের আকালও ঘুচবে। অতিরিক্ত খাদ্য গরীবদের দেওয়া যেতে পারে, কেউ না খেয়ে থাকবে না।

ওর কথা শুনে ক্লাসরুমে তখন পিনড্রপ সাইনেন্স, হঠাৎ, হো হো করে হেসে উঠলেন আমাদের অঙ্কের স্যর কেকেকে । জীবনে এই প্রথম তাকে আমরা হাসতে দেখলাম। সাথে সাথে আমরাও কালবিলম্ব না করে ওনার সাথে জয়েন করলাম। অঙ্কের স্যর অদ্রীজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন – ব্রাভো,  এলেম আছে তোমার, স্বামী অদ্রীজানন্দ, চালিয়ে যাও, তোমার হবে, আচ্ছা তা এরপরে কি করবে তা বললে নাতো ?

অদ্রীজ বলল-, স্যর কি বলছেন? আমি অলরেডি শুরু করে দিয়েছি, জমি-বাড়ির দালালি, সব চেয়ে সেফ বিজনেস, লাভজনক, ইনভেস্টমেন্ট নিল, শুধু মোটা কমিশন, বেশী ইনকাম আর সবচেয়ে বড় কথা, সেলফ এমপ্লয়েড, কারোর চাকর না হয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করা, যাকে আপনারা বলেন এন্ত্রপ্রিউনরশিপ। নিজের খেয়াল খুশি ও সময় মত।

স্যর, চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, বুঝেছি, এর বেশী আর কি করবে তোমরা,  তা এর পিছনেও কি তোমার...? কথাটা শেষ না করতে দিয়েই অদ্রীজ বলে উঠল- একদম স্যর। উনি কবেই বলে গিয়েছিলেন যে “টাকা-মাটি, মাটি-টাকা”। এর মানে হল, মাটির চেয়ে দামী আর কিছু নেই আজকের দুনিয়ায়, যার যত জমী, সে তত বড়লোক। তাই এই বিজনেসেই এখন পয়সা বেশী। টাকা কামিয়ে মাটিতে ঢালো, মানে ইনভেস্ট করো, আবার মাটি বেচে, থুড়ি, জমি বেঁচে টাকা রোজগার কর। কি দূরদর্শিতা স্যর ভেবে দেখেছেন?

বলাবাহুল্য, অঙ্কের স্যর আর কথা বাড়াবার রিস্কে গেলেন না,  চুপ করে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, আর আমরা সেদিন থেকেই ওর নাম দিলাম স্বামী অদ্রীজানন্দ। মুখে মুখে চারিদিকে ওর কীর্তিকলাপ চাউর হয়ে গেল, পরের দিন থেকেই লক্ষ্য করলাম বেশ একটা সেলিব্রেটি সেলিব্রেটি ভাব ওর চোখ- মুখে ফুটে উঠেছে। সকলের যে কোনো প্রবলেমে ওর বিশেষ টিপ্পনী কিছু না কিছুই থাকছেই। সেই ভরসাতেই আমিও পর্ণাকে আমার হৃদয়ের কথা বলার হবার জন্য ওর মুখাপেক্ষী হলাম। কিন্তু আমার কপাল, হেল্প ও করছে ঠিকই, কিন্তু একদিকে ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে আমার পকেট আর একদিকে আমার নিজের ক্যাবলামির ধাক্কায় প্রায় হাতছাড়া হবার জোগাড় আমার পর্না।

এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির মোড়ে পৌঁছে গেছি, বুঝতেও পারি নি, হঠাত খেয়াল হওয়াতে, দেখি সওয়া দশটা বাজে, তাড়াতাড়ি নিজেই সাইকেলের পিছনের চাকার হাওয়া বার করে দিয়ে, হাঁটাতে হাটাতে বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি, বাবা বাইরের বারান্দায় পায়চারী করছেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কি এতক্ষণে টিউশনী থেকে আসা হল, স্যর কি এক্সট্রা ক্লাস করাচ্ছিলেন নাকি?

আমি আমতা আমতা করে জবাব দিলাম, ইয়ে, না মানে টায়ারটা পাংচার হয়ে গেছে। হেঁটে হেঁটে ফিরতে হল। বাবা আমাকে একবার আর সাইকেলটাকে দেখে উত্তর দিল- তাহলে আর কি, আনন্দে নাচো! যাও, তাড়াতাড়ি হাত, মুখ ধুয়ে খেতে বস, মা কতক্ষণ ধরে বসে আছেন সে খেয়াল আছে?

মনে মনে, জয় শ্রী অদ্রীজানন্দ বলে ঘরে ঢুকে হাত-পা-মুখ ধুয়ে খেতে বসে পড়লাম, কারণ এই বুদ্ধিটাও যে অদ্রীজেরই দেওয়া, বরাত জোরে অনেক বড় কেলেঙ্কারির হাত থেকে রক্ষা পেলাম বাবা, যা চলছে মনে হচ্ছে আমি এবার না ওরই শিষ্য হয়ে যাই।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৬৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/০২/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রুমা ঢ্যাং ১৬/০২/২০১৬
    শান্তনু তোমার এইধরনের লেখা খুব ভাল হয় চালয়ে যাও। দারুন হয়েছে।
  • খুব ভালো। কোনো কথা হবে না।
    শান্তনু তোমার এই লেখাটি বিশেষ করে ভালো। তোমারা কজন মিলে তারুণ্যের লেখার একটা মান এনে দিয়েছ। সাধু।
  • বাহ! অনকে ভাল লাগলো।
  • গাজী তৌহিদ ১৩/০২/২০১৬
    অসাধারণ দাদা!
    খুব ভালো লাগল!
  • ধ্রুব রাসেল ১২/০২/২০১৬
    অসাধারণ লাগলো দাদা। আপনি পারেন বটে....!
  • মাহাবুব ১২/০২/২০১৬
    সুন্দর, ভালো লাগলো গল্পটা।
  • অভিষেক মিত্র ১২/০২/২০১৬
    শুরুটা দারুন হয়েছে।
  • আজিজ আহমেদ ১২/০২/২০১৬
    হা...হা...হা...। শান্তনু তোমার প্রেজেন্স অফ কমেডির একটা ভাল স্টাইল আছে। লাইট মুড। আমি খুব মজা পাচ্ছি গল্প টা পড়ে।

    এই ধরনের গল্প আমার দ্বারা হয়ই না...। দারুন। চালিয়ে যাও।
  • ভালো লাগলো॥
 
Quantcast