www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অচেনা আগুন্তুক

“ওরে বাব্বা, রাত আটটা বেজে গেল?” নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে খানিকটা হতাশ হয়েই সায়ক নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে উঠল, এর পরে আবার কখন ট্রেন আছে কে জানে ? একে শীতকাল, তারপর আবার রাত আটটা ! এখনও সায়ক ঠাই বসে আছে কাঁচরাপাড়া রেলস্টেশনে। পরপর দুটো গ্যালোপিন লোকাল চলে গেল চোখের সামনে দিয়ে, একটাও সোদপুর থামবে না, তাই আর ওঠা গেল না, সত্যি অনেক দেরী করে ফেলেছে ও । এতটা দেরী হবে অবশ্য ও নিজেও বুঝতে পারে নি। কিন্তু কারণটা কি করে বোঝাবে সায়ক তার মাসি-মেসোকে ? মাসি খুব কড়া, এমনিতেই সায়কের উপরে কড়া নজরদারী, কোনোরকম বেচাল হলেই সোজা মায়ের কাছে খবর পৌঁছে যাবে । ছ-ছটা মাস হয়ে গেল, সায়ক কলকাতায় থাকে, তাও মাসির এই নজরদারী এখনও কমল না একটুকু।  

মাসিরই বা কি দোষ, উনি তো সায়কের ভালো ভেবেই করেন। আসলে সায়ক এদিককার ছেলেই নয়, কলকাতার সাথে ওর কস্মিনকালেও কোনও সম্পর্ক ছিল না, ছোটবেলায় মাসি-মেসোর বাড়িতে ঘুরতে এসেছে ঠিকই এক-দুবার, তবুও এই শহর ও শহরের অন্তরের সাথে কোনোরকম আত্মীয়তা তো ওর ছিল না, একা একা কলকাতায় চলাফেরা ওর এই প্রথম । সায়কের বাড়ি কলকাতা থেকে অনেক দূরে বার্নপুর শহরে। সায়কের বাবা, ওখানকার হাইস্কুলের হেডমাস্টার। আরো প্রায় সাতবছর চাকরী আছে, মা হাইস্কুলেরই ইতিহাসের অধ্যাপিকা, বেশ স্বচ্ছল ও আধুনিক পরিবারের সন্তান। বড় আদরে মানুষ হয়েছে সায়ক, পড়াশুনায় সায়কও খুব ব্রিলিয়ান্ট ছোট থেকেই, তাই ফিজিক্স হনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন পাশ করার পরেও সায়ক যখন ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজমকে নিজের কেরিয়ার হিসাবে বেছে নিতে চাইল, বাবা-মা কেউ কোন আপত্তি করেন নি। বাবা বলেছিলেন, তুমি বড় হয়েছ, নিজের ভালো–মন্দ বিচার করার অধিকার তোমার আছে, আর আমাদেরও তোমার উপরে বিশ্বাস আছে। কিছু সাহায্য লাগলে আমাদের বলতে পার ।

এর ফলাফল, সায়কের কলকাতায় আগমন, ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজমের উপরে মাস্টার্স করার জন্য। ভালো বিজনেস স্কুলে ভর্তি হবার পরে সে থাকার জন্য মাসির বাড়ি সোদপুর চলে আসে থাকার জন্য। প্রথমে সায়ক আপত্তি করেছিল, বলেছিল মা’কে – স্কুলের হোস্টেলে থাকার কথা, কিন্তু বলাই বাহুল্য সে আপত্তি ধোপেও টেকে নি। মাসি-মেসোই এখন সায়কের কলকাতার লোকাল গার্জিয়ান। আর তাই মাসির এই চিন্তা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। মাসির মতে, যেহেতু সায়ক এখনো কলকাতার রাস্তা-ঘাট সম্পর্কে ওয়াকিবহল নয় এখনও, তাই ওর সাবধানে চলা ফেরা করা উচিত।

দেখতে দেখতে ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা চলে এলো। সায়কের সীট পড়ল কলকাতার থেকে দূরে কাঁচড়াপাড়ার ক্যাম্পাসে অন্যান্য দের সাথেই। এই প্রথম ট্রেনে করে এতদূরে আসা ওর। আজকে শেষ পরীক্ষা ছিল বিকেল তিনটে থেকে। কিন্তু হলে পৌঁছেই ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র জাল হয়ে গেছে, আর তাই পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেছে,  নতুন পরীক্ষার দিনও কিছু বলা হয়নি। আর তাই নিয়েই সমস্ত পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল ক্যাম্পাসে। এর উপরে আগুনে ঘি ঢেলেছিল ক্যাম্পাস ম্যানেজারের বক্তব্য, উনি ঘোষণা করে দিলেন যে, এর জন্য সমস্ত পরীক্ষাই বাতিল করা হতে পারে, ব্যস আর যাবে কোথায়, সকলে মিলে বসে পড়েছিল ক্যাম্পাস ম্যনেজারের ঘরের সামনে। সেই বিক্ষোভ এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠল যে শেষ পর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়ল, পুলিশ এসেই লাঠিচার্জ করে সকলকে ছত্রভঙ্গ করে দিল। সায়কও বন্ধুদের সাথেই ছিল, কিন্তু তারপরে যা হয়, এক্ষেত্রেও তার কোন ব্যাতিক্রম হল না। সকলে যে যেদিকে পারলো ছুট লাগালো, আর বেচারা সায়ক, সে কোনদিকে যাবে ভেবে না পেয়ে লুকিয়ে পড়ল অন্য ক্লাসরুমের ভিতরে। বাইরের চিৎকার, কোলাহল যেন থামতেই চাইছিল না,  কতক্ষণ যে এর মধ্যে কেটে গেছে তা বুঝতেও পারে নি, অনেকক্ষণ পরে যখন সব চুপচাপ, সায়ক আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো, বাইরে বেরিয়ে সায়ক দেখে কেউ কোথাও নেই, খুব রাগ হল ওর বন্ধুদের উপরে, কেউ একবার খোঁজও করল না ওর।

ঘড়ি দেখে বুঝল সন্ধ্যে সাড়ে ছটা বেজে গেছে। বেশ বুঝতে পারল, যে আজকের পরীক্ষা লাটে উঠেছে। আস্তে আস্তে ও ক্যাম্পাস ম্যানেজারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, তখনো সেখানে দুজন পুলিশ কনস্টেবল মোতায়েন করা ছিল। তাদের কে ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চায় বলাতে তারা তাকে সার্চ করে ভিতরে যাবার অনুমতি দিল শেষপর্যন্ত । কিন্তু ভিতরে ঢুকেও ওনার দেখা পেল না সায়ক। উনি ব্যস্ত পরীক্ষা নিয়েই দরকারী মিটিং এ । শেষপর্যন্ত আরো ৪৫ মিনিট বসে থেকে পরীক্ষার পরের দিনের সময় জেনে বেরোতে বেরোতে ওর সাতটা কুড়ি বেজে গেল। তারপর ওখান থেকে কাঁচরাপাড়া স্টেশনে এসে এই সবে বসেছে, এরই মধ্যে আটটা বেজে গেল, এখনও ট্রেন পেল না, মাসির বাড়ি যেতে যেতে প্রায় রাত দশটা হয়ে যাবে আজকে। একে শীতকাল, তায় আবার দশটা বেজে গেলে, অটোও পাবে না সোদপুর থেকে। কি আছে কপালে, কে জানে ? আর কি করা যাবে যা হওয়ার তা’তো হবেই। অন্য কিছু নয়, মাসি কে নিয়েই চিন্তা শুধু সায়কের, খুব টেনশন করবে নিশ্চয়ই।

এইসব ভাবতে ভাবতেই শিয়ালদহগামী আপ কল্যানী লোকালের ঘোষণা হয়ে গেল আর সায়ক হাঁফ ছেড়ে বাঁচল । এদিকে ক্ষিদেও পেয়েছে খুব, তাই প্ল্যাটফর্মের দোকান থেকেই ঝাল-মুড়ি কিনে নিয়ে ও ট্রেনে উঠে পড়ল। শীতকাল, তাই এদিকের লোকসংখ্যা খুব কম, সায়ক ট্রেনের গতিপথের উল্টোদিকে মুখ করে এক জানলার ধারে সীটে বসল । অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে আজকে, এইটুকু রাস্তা একটু আরাম করে বসে যেতে হবে এই ভেবে ব্যাগ সাইডে রেখে চোখ বন্ধ করে ঝাল-মুড়ি খেতে লাগল । কতক্ষণ যে হয়েছে খেয়াল নেই ওর, কিন্তু শুধু বুঝেছে, দুটো স্টেশন পেরিয়েছে সবে ট্রেনটা, তারমানে নৈহাটি ছাড়ল সবে। হঠাৎ একটা উগ্র পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগায়, আচমকা একটুকরো লঙ্কায় অজান্তে কামড় দিয়ে ঝাল ঠাউর হওয়ায়, সে চোখ খুলে দেখে, তার ঠিক সামনে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা এসে বসেছেন। ভদ্রমহিলার পুরো চেহারাটা সাদা শালে ঢাকা। তাই কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ।

তখনও কামরায় আরো দু চার জন ছিল, কিন্তু জগদ্দল ও শ্যামনগরে পুরো কামরাটাই ফাঁকা হয়ে গেল। সায়ক খেয়াল করল, কামরাতে সে আর বয়স্ক ভদ্রমহিলা ছাড়া আর কেউ নেই এই মুহূর্তে। গন্ধটা এখনও আছে, তার মানে কি গন্ধটা ওনার গা থেকেই আসছে ? কিন্তু ওনাকে আর ওনার বেশভূষা দেখে বেশ সম্ভান্ত্র ঘরের বলেই মনে হল সায়কের, মুখটা শালে ঢেকে নিচের দিকে করে বসে আছেন, মনে হচ্ছে শীতে কষ্ট পাচ্ছেন। সাদা চুলের সাম্বনের অংশ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না,  সায়কের দেখে মনে হল ভদ্রমহিলা বিধবা,  সাদা শাড়ি, সাদা মোজা, সাদা জু...... কিন্তু একি ? ওনার পা’দুটো একটু অস্বাভিক রকমের বাঁকা মনে হচ্ছে না, হ্যাঁ তাই’তো, দুটো পা যেন প্রায় ১৮০ ডিগ্রি হয়ে প্রায় সমান্তরাল হয়ে আছে। এটা কি করে সম্ভব ? অবশ্য হতেও পারে, কতজনের তো কতকিছুই না হয়, হয়তো রিকেট বা ওইটাইপের কিছু হবে, সায়ক মনে মনে ভাবল। কিন্তু তাও একটা খটকা মনে মনে খোঁচা মারছিল সায়কের। কিন্তু সেটা ঠিক যে কি, তা বুঝতে পারছিল না, ও অনেক কষ্টে বোঝার ভাবার চেষ্টা করতে লাগল, আর তক্ষুনি হঠাৎ ওর মনে হল, আরে, তাহলে ওনার হাঁটতে অসুবিধা হবে, বিশেষ করে এইবয়সে, তাহলে তো ওনার সাথে কোন লাঠি বা ক্ল্যাচ থাকার কথা, কিন্তু সেটাও তো দেখতে পারছে না ও, তবে উনি ট্রেনে উঠলেন কি করে, আর কি করেই বা চলছেন।

সায়ক বেশ ভাবনায় পড়ে গেল, নিশ্চয়ই ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে এইসব ভাবছিল, হঠাৎ সায়ক শুনতে পেল, খুব গম্ভীর গলায় ভদ্রমহিলা শালের ভিতর থেকেই বলে উঠলেন –“কি ভাবছ? আমার লাঠি বা ক্ল্যাচ কোথায় গেল ? আমার ওইসব নেই, আমি ওইসব ছাড়াই বেশ ভালো চলতে পারি, আর অন্যের কথা না ভেবে নিজের কথা ভাব হে ছোকরা”।

সায়ক চমকে উঠল, ওর মনের কথা কি করে টের পেল মহিলা? ওর মুখ দেখে কি বোঝা যাচ্ছে যে অ এইসব ভাবছে, সায়ক লজ্জিত হয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠল, না আসলে আমি ভাবছিলাম বোধহয় আপনার কষ্ট হচ্ছে, তাই যদি আপনি, আমার জায়গায় এসে বসেন তাহলে ট্রেনের হাওয়াটা লাগবে না।

“না, তার দরকার নেই, গায়ে হাওয়া দিতে আমার ভালো লাগে” । আমার জন্য অত ভাবতে হবে না, নিজের জন্য ভাব। শেষের কথাটায় একটা ধমকের সুর ছিল, সায়ক ঘাবড়ে গেল,  কি করবে বুঝতে পারছিল না। এরইমধ্যে ট্রেন ইছাপুর স্টেশন পেরিয়ে গেল। সায়ক মনে মনে ভাবতে লাগল,  এরপরে পলতা, তারপরে ব্যারাকপুর...

সোদপুর এখনও অনেক দেরী, তাই না ছোকরা ? আবার ভদ্রমহিলা কর্কশ গলায় বলে উঠলেন। সায়ক এবারে রীতিমত ভয় পেয়ে গেল, এই মহিলা তার মনের কথা টের পাচ্ছে কি করে ? না আর ভালো লাগছে না, কেউ এই কামরাতে উঠছেও না, সায়ক একটু সহজ হবার জন্য বলতেই যাবে -  হ্যাঁ, এখনও দেরী আছে। আপনি কি সোদপুর যাবেন ?

“জাহান্নমে যাব, তুমি যাবে আমার সাথে?”- এইরকম একটা উত্তরের জন্য সায়ক একদমই প্রস্তুত ছিল না, ও বুঝে উঠতে পারলো না, কে ইনি, এরকম ভাবে মনের কথা কি করে বুঝে নিচ্ছেন? কোন তান্ত্রিক-টান্ত্রিক নাকি ? সায়কের এবারে ভয় করতে শুরু করল, সচরাচর সায়ক বন্ধুমহলে সাহসী ছেলে বলেই পরিচিত, কিন্তু এবারে ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, শীতের রাতেও ও ভেতরের উত্তেজনাতে  ঘেমে উঠেছে। ভদ্রমহিলা একদিকে বলছেন হাওয়া খেতে ভালো লাগে আবার অপরদিকে নিজেকে পুরোপুরি মুড়ে রেখেছেন, ভদ্রমহিলা ভেবেই হয়ত ভুল করেছে ও ।  

এইবার হঠাৎ ভদ্রমহিলা, গায়ের থেকে শালটা সরিয়ে বললেন – বড্ড অভদ্র ছেলে তো তুমি, তোমার জন্য কি আমি নিজে শাল গায়েও দিতে পারব না, সব কৈফিয়ত কি তোমাকে দিয়ে করতে হবে?

সায়কও সবে ব্যাগের মধ্যে থেকে নোটের কাগজগুলো বার করছিল, এই কথাটা শোনার পরে মুহুর্তের মধ্যে খুব রেগে গেল, একেই দুপুর থেকে কোনকিছুই ভালো হচ্ছে না, তারপর আবার এই অসময়ে যত বাজে কথা শুনতে হচ্ছে, কিছু না করেও। কাগজগুলোকে গুটিয়ে সীটের উপরে রেখে সমুচিত জবাব দিতে গিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতেই সায়কের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এক ঠাণ্ডা কাঁপুনির চোরাস্রোত পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে বেয়ে নেমে গেল।

ভদ্রমহিলা শাল খুলে রেখেছেন একদিকে, সোজা তাকিয়ে আছেন ওর দিকে, মুখের চামড়া পুরোপুরি কোঁচকানো, ঝুলে আছে, চোখে একটা চশমা, গোটা চার হরলিক্সের শিশির কাঁচ দিয়ে যদি চশমা তৈরী করা হয়, তাহলে হয়ত ওনার চশমার সমতুল্য হবে। যার ফলে চোখগুলো বেঢপ আকারের বড় বড় দেখাচ্ছে, মুখে কোন দাঁত নেই, তবুও যেন এক ক্রূর হাসি হেসে চলেছেন। সবচেয়ে ভয় পেয়ে গেল সায়ক ওনার হাতের দিকে তাকিয়ে, দুইহাতেই তিনি দস্তানার বদলে পায়ের মোজা গলিয়ে রেখেছেন, তাও দুইরকম, একনজরে পাগল বলে মনে হতে পারে, তবে সায়ক বেশ বুঝতে পারছে এ পাগল নয়।

সায়ক মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারলো না ওনাকে, নিজেও কিছু ভাবার আগেই সায়ক গট করে উঠে পরল সীট থেকে, উঠেই সে দ্রুত চলে আসল সীটের পাশে কমন করিডরে। কি করবে ভাবতে ভাবতেই আবার চোখ চলে গেল মহিলার দিকে, আর অবাক ও হয়ে দেখল মহিলা এখনো ওর দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন আর হাতের ইশারায় ওনার কাছে যেতে বলছেন। সায়ক প্রাণপণে মাথাটা দুদিকে নাড়িয়ে না বলে চলেই যেতে চাইছিল, দেখে মহিলা সায়কের সীটের নীচের দিকে ইশারায় ইশারা করছেন, অথচ, মুখে কিছু বলছেন না, সায়ক নীচে তাকিয়ে দেখে তাড়াহুড়োতে নীচে নোটসগুলো পড়ে গেছে আর মহিলা ওগুলোর কথাই বলছেন, নোটগুলো খুব দরকারী, কিন্তু তা কি ওর প্রাণের চেয়েও? সায়ক মনে মনে ভাবল, যদি নীচু হয়ে ও কাগজগুলো নিতে যায় আর...

“ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমার ঘাড় মটকাবো না, - মহিলা ঠিক তক্ষুণি এই কথাটা বলেই হা হা হা হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন।

সায়ক ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল, চোখগুলো লাল টকটক করছে, না এই মহিলা মানুষ হতেই পারেন না, আজ ওর কপালে কি’যে আছে কে জানে। সায়ক আস্তে আস্তে এগিয়ে আজ পর্যন্ত যা করে নি তাই করল, নীচু না হয়ে পা দিয়ে কাগজ গুলোকে দূর থেকে টেনে নিয়ে আসল নিজের কাছে, তারপর চট করে হাতে নিয়েই দৌড়ে চলে গেল ট্রেনের গেটের কাছে, এমন ভাবে দাঁড়াল, যাতে, ও মহিলার পিছনের দিকে চলে আসে, কিন্তু দাঁড়িয়েই এবারে আরো অবাক, কারণ ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, মহিলাও সীট বদলে ঠিক সায়কের দিকে বসেছে এমনভাবে যাতে সায়কের সাথে ওর চোখাচুখি হতে পারে। ওখানে বসেও উনি হাত নেড়ে ইশারাতে ওনার কাছে যেতে বলছেন সায়ককে । মুখে এখনও সেই হাসি লেগে আছে।  

এবারে কিন্তু সায়কের গা’টা কেমন যেন শিউরে উঠল। ও পরিষ্কার বুঝতে পারছিল যে ও আর নিজের মধ্যে নেই,  কোন একটা কিছু সায়ককে ওনার দিকে টানছিল, সায়ক দু কদম এগিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ট্রেন প্রচন্ড জোরে হুইশেল বাজাল একবার,  সায়ক বাইরে তাকিয়ে দেখল ট্রেন ব্যারাকপুরের কাছে ঢুকে গেছে, হঠাৎ ঘড়ঘড় আওয়াজে চোখ ঘুরিয়েই দেখে, মহিলা তার থেকে মাত্র চার কদম দূরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে রয়েছে। সায়কের চোখে তখন সর্ষেফুল, কিছুই বুঝতে পারছিল না কি করবে,  একবার ভাবল, মহিলা আর একপা এগোলেই, চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে দেবে, যা হবার তা হবে, পরক্ষণেই নিজের মনকে শক্ত করে ধরে রেখে ট্রেনের লোহার হাতলটা ধরে মনে মনে রাম নাম জপতে লাগল,
দুমিনিট পরে লোকাল যখন ব্যারাকপুর স্টেশনে ঢুকল, কোনদিকে না তাকিয়ে ট্রেন পুরোপুরি থামার আগেই সায়ক লাফিয়ে নেমে পড়ল, কোনো রকমে নিজেকে সামলে আরো তিনটে কামরা ছেড়ে যেখানে অনেক লোক আছে, এরকম একটা কামরায় উঠে পড়ল, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেল মহিলার শেষ কথাগুলো – আরে কোথায় যাবি, আবার দেখা হবে...

অন্য কামরায় উঠে একটু শান্তি পেল যেন সায়ক, লোকেদের সাথে কথা বলে তিনচারজনকে পেল যারা সোদপুর থেকে সায়কের নাসির বাড়ির দিকেই যাবে। যা ভেবেছিল ঠিক, সোদপুর স্টেশনে নেমে কোন অটো পেল না, তাই অগত্যা, ওনাদের সাথেই, হেঁটে যেতে হবে ওকে রাসমণি নগর । রাসমণি নগরের কথা মনে পড়তেই ওর মনে পড়ল গোশালার কথা, গোশালা এমন একটা জায়গা, যেটা পুরোপুরি একটা ফাঁকা জায়গা। ইংরেজ আমলের একটা গোশালা, এখন তার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, আর তার পাশ দিয়েই রাস্তাটা, শুধু একটা চা’য়ের দোকান আছে এলাকাটাতে যা রাতদিন খোলা থাকে। তবে এখন ওর সাথে লোক আছে, এটা ভেবেই নিশ্চিন্ত হল সায়ক।  
গল্প করতে করতে যেতে যেতে কখন যে গোশালার পাশে এসে পড়েছে বুঝতেই পারে নি ।

হঠাৎ চেনা একটা উগ্র পোড়া গন্ধে নাকটা জ্বলে গেল, গন্ধটা চিনতে মোটেই অসুবিধা হল না, এই গন্ধটাই সে পেয়েছিল ও একটু আগেই ট্রেনে সেই মহিলার গায়ের থেকে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল সাথে সাথে। পাশের লোকগুলোকে জিজ্ঞাসা করল – আপনারা কোন পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন এখানে ? সকলে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, সায়কের কথা শুনে, চারপাশে তাকিয়ে, গন্ধ শুঁকে বলল, না কোন গন্ধ তো নেই সেরকম। ততক্ষণে চারিদিকে আপনা থেকেই নজর ঘুরতে শুরু করল সায়কের । দেখতে দেখতে সেই চায়ের দোকানের বাইরের কালভার্টের দিকে নজর পড়তেই সায়ক চমকে উঠল, পরিষ্কার দেখতে পেল, ওখানে সেই মহিলা বসে আছেন আর সয়কের দিকে তাকিয়ে একইভাবে মিটিমিটি হেসে হাতের ইশারায় ওকে ডাকছেন, মহিলাকে দেখেই সায়ক পড়ি কি মরি করে এক ছুট, সোজা রাসমণি নগরের বাজারে এসে দাঁড়াল। পাশের লোকগুলো কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না, হঠাৎ ছেলেটি এত জোরে দৌড়ে চলে গেল কেন ?

বাড়ি ফিরে যদিও মাসিকে কিছু মুখ ফুটে বলতে হয় নি, সায়কের, ওর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখেই মাসি –মেসো বুঝতে পেরেছিল, নিশ্চয় কিছু অঘটন ঘটেছে রাস্তায়, তাই আর কিছু বলল না। যদিও কেন জানে না আজকে সায়ক চাইছিল, ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হোক, তবুও কেউ কিছুই জিজ্ঞাসা করল না, শুধু মাসি বলল, বুঝতে পারছি, তুই খুব ক্লান্ত, তাই আর আজ কোন কথা নয়, তাড়াতাড়ি খেয়ে বিছানায় চলে যা, কাল সকালে সব কথা হবে।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সায়কের ঘুম আসছিল না, এখনো ভয়ে ও উত্তেজনায় ওর গায়ের লোম খাড়া হয়ে আছে । আসলে কিছু উত্তর অবশ্য সায়কের কাছেও ছিল না, যেমন ওই মহিলা, কি’ভাবে সায়কের মনের কথা টের পেয়ে যাচ্ছিলেন, বা সায়কদের আগেই কি করে ওইরকম পা’ নিয়ে ওখানে এসে বসেছিলেন ? ওর গায়ের গন্ধটাই বা এতটা উগ্র হয়ে সায়কের নাকে এলো কি করে রাস্তার অন্যান্য গন্ধও ছাপিয়ে ? ওর পাশেও তো অন্যরা ছিল রাস্তায়, তবে কেউ ওনাকে খেয়াল করল না কেন? গন্ধটাই বা শুধু সায়ক কেন পেল ? তবে কে উনি ? উনি কি মানুষ নাকি .........।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১১৬৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/০১/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • হাসান কাবীর ০১/০৩/২০১৬
    সুন্দর সাবলিল উপভোগ্য।
  • তপন দাস ১৬/০২/২০১৬
    দাদা "হনার্স" না "অনার্স" ?

    খুব সুন্দর লাগলো।
  • দারুন। গঠন মূলক।
  • অভিষেক মিত্র ১৪/০১/২০১৬
    ভালো লাগলো শান্তনু দা।
  • জে এস সাব্বির ১৪/০১/২০১৬
    ভৌতিকতার ভয়ও দেখালেন ,আবার ধাধাও রেখেগেলেন !!
    ব্যক্তিগতভাবে ,কোন ভৌতিক গল্পের সমাধান করে দিলে সেটা পড়ে অনেক বেশী তৃপ্তী পাই ।

    লেখায় ভাল লাগা জানবেন
    • ধন্যবাদ দাদা, ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগল।
      নিশ্চয়ই , ঠিক বলেছেন আপনি, আমার এর আগের গল্পটা পড়লে সেটা বুঝতে পারবেন । এই গল্পতে আসলে আমি এটার ভার পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছি । অনুসন্ধান করার জন্য ।
  • আজিজ আহমেদ ১৪/০১/২০১৬
    বেশ ভয়ের গল্প।
    লেখা ভাল লেগেছে।

    হাইসকুলের শিক্ষিকাকে কি অধ্যাপিকা বলা যায়?
  • ধ্রুব রাসেল ১৪/০১/২০১৬
    অনেক ভাল লাগলো।
  • ডিটেলের কাজ তোমার লেখার শক্তি। তাতে পরিবেশটা বিশ্বাসযোগ্য হয় আর চোখের সামনে একটা ছবিও পাওয়া যায়। ভয় দেখিয়েছো কিন্তু ভয়ের রহস্য ছেড়েছ পাঠকের হাতে। সে বেচারা ভেবে ভেবে কাতর হবে এই ভেবে যে মহিলা কি ছিল ?
    ভালো গল্প। লিখে যাও।
 
Quantcast