www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

চোরকাঁটা - ১৪ পর্ব

( আগের সঙ্খ্যার পর )



সারাটা দিন যথেষ্ট খাটুনির মধ্যে দিয়ে গেলো। সবে দিন পনেরো হয়েছে, অ্যাসাইনমেণ্টটা হাতে পেয়েছি, একটা মোবাইল সংস্থার কলার আইডির জন্য নির্দিষ্ট একটা অ্যাপলিকেশন বানাতে হবে। সবে কাজটা শুরু হয়েছে, এর মধ্যে আমাদের টিম যে লিড করছিলো, সে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, ব্যস আর কি, ম্যানেজমেন্ট আমাকেই মুরগী পেয়ে আমারই কাঁধে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। কি আর করা, সারাটাদিন চলে গেলো শুধু, কাস্টমার আর টিমমেম্বারদের নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সিংএ। কাজটাকে যে করেই হোক, তাড়াতাড়ি নামাতে হবে। অনেক টাকার চুক্তি। আবার এদিকে, মাথার মধ্যে অর্কর কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল, কি করছে ও কে জানে, আমার জন্য কি নিউজ অপেক্ষা করে আছে তাও বুঝতে পারছি না। কেসটার কতটা কি এগুলো তাও কিছু বলছে না ছেলেটা, যদিও, আমিও একটা ফোন করার সময় পাই নি আজকে।

হাতের কাজ শেষ করতে করতে সেই সাড়ে ছটা বেজে গেলো, এখান থেকে বাসে এখন যা জ্যাম পাব, তাতে সেই চিরা চরিত লেট লতিফ হয়ে যাব। তাই ঠিক করলাম ট্যাক্সি ধরে বেড়িয়ে যাব। যেমন ভাবা তেমন কাজ, বেরোতে না বেরতেই রাস্তার মুখেই ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম, সোজা খাল পাড়ের রাস্তা ধরে চিংরিহাটা হয়ে একদম চেম্বারের সামনের ক্রসিংএ গিয়ে হাজির হলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে চেম্বারের সামনে গিয়ে দেখি, যথারীতি ভেতরে লাইট জ্বলছে অর্থাৎ অর্ক হাজির।

আমি ভিতরে ঢুকে সবে কাঁধ থেকে ল্যাপটপের বোঝাটা নামাচ্ছি, দেখি অর্ক একমনে নিজের ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। হাঁফ ছেড়ে ভাবলাম যাক, আমার উপরে কোনও রাগ করেনি তাহলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি রে কি দেখছিস আর হাসছিস মনে মনে? নতুন কোনও কমেডি ফিল্ম নাকি? অর্ক চোখ না তুলেই বলল – হু, কমেডি ফিল্মই বটে, এদিকে এসে দেখ তাহলেই বুঝতে পারবি।  

আমি অর্কর পিছনে গিয়ে লাপটপে চোখ রেখে চমকে উঠলাম, মুকুলিকার ছবি গুলো নিয়ে একটা কোলাজ তৈরি করেছে অর্ক, তাও আবার নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গিমার, একটা রঙ্গীন তো তো প্রায় অনেকটা একই রকম ভাবে পোজ দেওয়া সাদা কালো ভিনটেজ ছবির স্টাইলে। কোনওটা বসা, কোনওটা দাঁড়ানো, কোনটা হাসছে, কোনটা কাদছে, এক্কেবারে ছোটবেলা তাও প্রায় বছর দুই-টুই থেকে এই বয়স অবধি প্রায় দশ বারো খানা রেডি করে ফেলেছে। আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে অর্ক এবারে সত্যি পাগল হয়ে গেছে, প্রশ্ন করলাম, কি রে এই দেখাবার জন্য তুই আমায় বললি, যে অনেক কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করবে...

অর্ক, এবারও চোখ না তুলে বলল – কেন এটা ভালো লাগছে না ? এটা একটা গেম বুঝলি, এই সন্ধ্যাবেলা আবিষ্কার করলাম। দারুণ লাগছে খেলতে, তুইও ট্রাই করে দেখতে পারিস একবার। আমি কোনও কথা না বলে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে ভাবলাম কি হল কি?  হঠাৎ দেখি, বাইকে করে ভদ্রদা হাজির।  আমার দিকে তাকিয়ে হাল্কা করে হেসে করে কোনও কিছু বলা বা শোনার সময় না দিয়ে চটজলদি সোজা ভিতরে প্রবেশ করে গেলেন। আমিও অগত্যা পিছনে পিছনে প্রবেশ করলাম...

ভদ্রদা, ধপ করে সোফাতে বসে পরে বললেন, বলুন মশাই, হঠাৎ এই জরুরী তলব? কিছু খবর আছে নাকি ? অর্ক তখনও একমনে অইসাব ছাই পাশ করে যাচ্ছিল, তারপর অর্কর দিকে একবার তাকিয়ে আবার আমার দিকে ভুরূ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন যে কি হয়েছে ? আমিও ঠোঁট উলটে বোঝালাম যে তিনিও যে তিমিরে, আমিও সেই তিমিরে। কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না,  ভদ্রদা কাছে এসে বললেন, মশায়, আপনার বন্ধুর জন্ম কি পাগলা নক্ষত্রে হয়েছিলো না পাগলা তিথিতে? আমি হেসে কিছু বলতে যাব,  তার আগেই উত্তর ভেসে এলো টেবিলের ওপার থেকে – দুটোই... আমরা চমকে অর্কর দিকে তাকাতে, অর্ক হেসে বলল – খুব বদনাম হচ্ছে না আমার নামে আমার বন্ধুর কাছে? জেনে রাখুন, আমার জন্ম লগ্ন, তিথি সবই ওই পাগলই... অতএব, আমি কিছু খারাপ মনে করি না,  তবে বেশ বলেছেন কিন্তু।

ভদ্রদা চুপ হয়ে আবার সোফাতে এসে বসে পরলেন, আর আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বসতে বললেন।  আমি হাসি চেপে ওনার পাশে বসে বললাম রাগিয়ে দিয়েছেন কিন্তু, এবার ঠ্যালা সামলানর পালা আপনার, ভদ্রদা মুখটা ফ্যাকাসে করে বললেন – কি করব মশায়, কিছু উপায় তো বলুন ?
কিছু উপায় নেই, আমি বললাম।

যাই হোক, শুনুন আপনাদেরকে যেজন্য ডেকেছিলাম, মনে হচ্ছে, এই কেসটার কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি, এবং অপরাধী কে তাও বুঝতে পেরেছি, তবুও আমার আপনার সাহায্য দরকার – অর্কর সহাস্য মন্তব্য।

ভদ্রদা ও আমি দুজনেই প্রায় এক সাথে ইয়া হুউউউউউউ বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে দেখলাম, ভদ্রদা পুলিশের লোক বলেই বোধ হয় চেঁচাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন, আর আমি বললাম – তুই পেরেছিস ? আমি জানতাম তুই পারবি,  কিন্তু কি ভাবে বল না...

ভদ্রদা বললেন, ওসব ঠিক আছে মশায়, পুরো লোক নামিয়ে দেব মশায়, কত লাগবে আপনি শুধু বলুন... ব্যাটাচ্ছেলেকে একবার পেলে হয়... এমন রুলের বাড়ি দেব না, বাবার নাম ভুলিয়ে দেব... শেষটুকু বোধ হয় ভদ্রদা খুব সিরিয়াসলি বললেন, আমরা একটু চুপ করে গেলাম, বুঝলাম মুকুলিকার মৃত্যুটা উনি ভালো ভাবে মেনে নিতে পারেননি। আসলে নিজের মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের মৃত্যুও যে পুলিশের মেজবাবুকেও নাড়িয়ে দেয়, তা ভদ্রদাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।

অর্ক ব্যাপারটাকে হাল্কা করে দিতে চেয়ে, ভদ্রদার হাতে হাত রেখে বলল - আমরা বুঝতে পারছি ভদ্রদা, আমি জানি যে আপনি নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন, তবে আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনে তারপর কাজ গুলো করবেন। আমি আপনাকে কিছু জিনিশ পত্র এখুনি দেব যা আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠিয়ে দিন, সেগুলোর সত্যতা জাচাই করার জন্য। এবারে আপনি বলুন আমরা সবচেয়ে কম সময়ে কখন এর রিপোর্ট পেতে পারি?

ভদ্রদা ভেবে বললেন দেখুন, সমস্তটা হতে চার-পাঁচ দিন সময় লেগে যাবে, আর পাক্কা রিপোর্ট আসতে আসতে কম সে কম সাতদিন লাগবেই, তবে খুব আর্জেন্ট করে একটা প্রভিশনাল রিপোর্ট আনা যায়, তবে তাও দিন তিনেকের আগে হবে না।

হুম ঠিক আছে তবে তাই হোক, তবে আমাদের পাক্কা রিপোর্ট চাই, তার জন্য আমরা সাতদিন অপেক্ষা করতেও রাজী আছি। কথাটা শুনে আমার আর ভদ্রদার দুজনেরই চোখ কপালে উঠে গেলো, আমি তো বলেই ফেললাম, কি বলছিস, আর এত দিন ধরে আমরা আততায়ীকে খোলা ছেড়ে রেখে দেব?

অর্ক আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল – আমি কি তাই বললাম নাকি, আমি শুধু বললাম প্রমাণগুলো যেন পাক্কা হয়... কি কারণ জানিস ?
আমরা দুজনেই বলে উঠলাম, কি কারণ ? অর্ক হেসে বলল - আততায়ী যে বা যারা তারা খুব ধূর্ত তাতো তুই নিশ্চয়ই বুঝেছিস এতদিনে? ওদের বিপক্ষে যে প্রমাণ আছে, তা খুবই নগণ্য, আমরা অপরাধীদের ধরতে পারি শুধু পারিপার্শ্বিক এভিড্যান্স দিয়ে, কিন্তু সেগুলো খুব একটা জোরাল নয়। যাতে একেবারে হাত থেকে ফস্কে না যায়, তাই আমাদের এমন ভাবে চাপ দিতে হবে যাতে, তারা নিজেরা স্বীকার করে নেয় তাদের অপরাধের কথা। তারপর ফরেন্সিক রিপোর্টটাই আমাদের ও পুলিশের কাছে একমাত্র মারণ অস্ত্র হবে ওদের বিপক্ষে।

আমি বললাম – কিন্তু কি ভাবে ? অর্ক বলল- সেটা এখন ভাবি নি, তবে মনে হচ্ছে তোর আর কাল অফিস যাওয়া হবে না। দেখা যাক। তবে যাই করতে হবে কালকেই করতে হবে। ভদ্রদা, এই যে এই প্যাকেটটা আমি আপনার জন্য রেডি করে রেখেছি, এটা নিয়ে নিন , বলে অর্ক টেবিলের পিছন থেকে একটা মুখ বাঁধা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট ভদ্রদার হাতে ধরিয়ে দিল, তারপর বলল -  কালকে আপনাকে আমার দরকার সাথে আরও গোটা চার পাঁচ পুলিশের লোক কিন্তু সাদা পোশাকের। সময় আমি জানিয়ে দেব...ও হ্যাঁ, আর একটা কথা, আপনি নিশ্চই আমার আবেদন পত্রটা ঠিক করে পড়েছিলেন যা পরাণ দাকে ছাড়াবার সময় দিয়েছিলাম ? আপনার দুটো আর্মড লোক সাদা পোশাকে পরাণদার পিছনে থাকতে বলুন, আর কি ঘটছে, সব নোট করতে বলুন, ওদের কে সবসময় নজর রাখতে বলুন, আমার মনে হচ্ছে, পরাণদার জীবন সংশয় এর আশঙ্কা আছে। এটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে, এক্ষুনি বলে দিন আপনাদের স্পেশাল টিম কে, আর হ্যাঁ একটা কথা, পরাণদা যেন কখনো জানতে বা বুঝতে না পারে, যে ওর পিছনে পুলিশ প্রোটেকশন আছে, তাই কিছুক্ষন পরপর লোক চেঞ্জ করুন, কারণ পরাণদা জানতে পারলে, আততায়ীরাও তা বুঝে যাবে, কারণ আমার স্থির বিশ্বাস, ওরাও ওকে সবসময় নজরে রাখছে। যদি কিছু সেরকম হয়, তখন যেন দেরী না করে অ্যাকশন নিয়ে নেয় তাড়াতাড়ি। পরাণদার যেন কিছু না হয় কোনওমতেই।    

পরাণদার প্রতি অর্কর দায়বদ্ধতা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম... আমার মনের কথাটা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল অর্ক, বলল – কেন গরীব মানুষ বলে কি ওর জীবনের কোনও দাম নেই? আমি চুপ করে চোখ নামিয়ে ফেললাম, অর্ক সিগারেটটা ধরিয়ে বসল, আর ভদ্রদা সাথে অফিসে ফোনে করে আদেশ দিয়ে দিয়ে বললেন যে – তাকে আর অর্ক কে যেন প্রতি একঘণ্টা পর পর আপডেট করা হয় এই ব্যাপারে। ফোনে না পেলে অন্তত মেসেজ করে।

তারপর কিছুক্ষন গল্প করে, চা বিস্কিট খেয়ে ভদ্রদা প্রস্থান করলেন, শুধু যাবার আগে বলে গেলেন, আমাকে জানাবেন কালকে কখন আসতে হবে? লোক লস্কর নিয়ে আস্তে হবে তো, সময় সাপেক্ষ ব্যাপার , বলে চোখ মেরে হা হা হা করে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলেন বাইরে, আমি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি, আবার বৃষ্টিটা শুরু হয়ে গেছে।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- ওফ !! একে অফিসের সারা দিনের খাটুনি, তারপর সন্ধ্যা থেকে যা গেলো, শরীরটা এখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। মা একবার জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলো বটে, যে কিছু খাব কিনা, কিন্তু শরীর আর চলছে না, এবারে একটু রেস্ট দরকার। আমি ভিজে জামাপ্যান্ট ছেড়ে দিয়ে সোজা খাটের উপরে বসে বসে সবে ভাবছি অর্ককে একটা ফোন করব কিনা, ঠিক তক্ষুনি আমার নিজের ফোনটা বেযে উঠল, রিংটোন শুনেই বুঝতে পারলাম যে এটা অর্কর ফোন।

আমি মনে মনে অবাক হয়ে ফোন তুলে হ্যালো, বল বলতেই অর্ক ফোনের ওপার থেকে বলে উঠল,  মৈনাক শোন, কালকে তোর আর অফিস যাওয়া হবে না।  আমাদেরকে যা করতে হবে তা কাল সকালেই করতে হবে। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই, ওর কড়া নির্দেশ ভেসে এলো – যা বলছি শোন, কাল সকাল ঠিক সাতটার সময়ে তুই আমার সাথে সোজা অবিনাশবাবুর বাড়ির সামনে দেখা করিস। আমি ওখানেই থাকব। এই বলে ফোনটা ছেড়ে দিল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, ফোনে কথা বলে মনে হল, যেন ও ঘরে নেই, কোথাও বাইরে থেকে ফোনটা করল। কারণ ফোনের ভিতর থেকে, বৃষ্টির আওয়াজ আর হাল্কা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল, কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ না দিয়েই, ব্যাটা ফোন কেটে দিল। কি করি আরেকবার ঘুরিয়ে ফোন করতে গিয়ে দেখি, অর্কর ফোন বলছে সুইচড অফ। কি যে করে না ছেলেটা, এই তো আমার সাথে একসাথেই, বেরোল প্রথমে, চেম্বার থেকে, তাও প্রায় রাত্রি নটার সময়ে, বেড়িয়ে বলল – বৃষ্টি পড়ছে, চল একটু বাজারের দিকে যাই, বাজারে গিয়ে আমরা পরাণদার দোকানের পিছন দিকের একটি চায়ের দোকানে চা খেলাম, কিন্তু আম ঠিক খেয়াল করছিলাম, চা আর সিগারেট খেতে খেতে অর্কর নজর শুধু ছিল, পরাণদার দোকানের দিকে। আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে ও আমায় ইশারায় চুপ করতে বলে, হাতের ইশারায় চারদিকটা দেখিয়ে দিল। আমি ভালো করে নজর করতে বুঝলাম বিভিন্ন ভাবে খাকি উর্দির লোকেরাও ঠিক নজর রাখছে ওই দোকানের দিকে সাদা পোশাকে। কিছুক্ষন পর আমাদের পাড়ারই একদল মহিলা দল বেঁধে দেখলাম পরাণদার দোকানে ঢুকল। সবার হাতেই ছাতা, দলবেঁধে একসাথে, অন্য কোথাও থেকে এসে ফুচকা খেতে ঢুকল। বাবা, এই বৃষ্টিতেও এরা ফুচকা খেতে পারে। এ একমাত্র মেয়েদের দ্বারাই সম্ভব। আমি মুচকি হেসে অর্কর দিকে চোখের ইশারা করতে গিয়ে দেখি, অর্ক হাওয়া হয়ে গেছে ওখান থেকে। এর মধ্যে ছেলেটা যে কোথায় গেলো, খুঁজতে গিয়ে দেখি, পরাণদার দোকানের কোনাকুনি, একটি লোক একটি বন্ধ দোকানের পাশে ভেজা কম্বলমুড়ি দিয়ে বসে আছে, বাবু কখন যেন ওর কাছে পৌঁছে গিয়ে বিড়ী ধড়িয়ে দিব্যি সুখটান দিচ্ছে।
আমি আর কি করব, ওর কাছে যেতে হবে এই ভেবে, সোজা রাস্তা ধরলাম, আর তারপর পরাণদার দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখি, দোকানের মাঝে সবার মধ্যমনি হয়ে ফুচকা খাচ্ছেন আমাদের কাকলি বউদি। আমার সাথে চোখাচুখি হতে একটা মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে এসে বললেন, আরে কি ব্যাপার, তুমি? আর একজন কোথায়? আমি কিছু বলার আগেই, বলে বসলেন আগে হাঁ কর পরে কথা,  আমি হাঁ করতেই, নিজের হাতের ফুচকা আমার মুখে পুরে দিয়ে বললেন, কেমন খাসা ফুচকা করেছে বলতো? আমি গপ করে ফুচকা খেয়ে, বললাম, আরে আপনিও এখানে, সবার সাথেই নাকি? বউদি নিজের মুখে পরের ফুচকা দিয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। তারপর পিছন ফিরে নিজের বাঁদিকের মহিলাদেরকে দেখিয়ে বললেন, আরে এনাদের তো তুমি চেন, এনারা আমাদের পাড়ারই লোক আরে এনারা ভাড়া থাকেন আমাদের সামনের পাকরাশীকাকুদের বাড়িতে ।

আরে আর ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, এই যে এনারা বলে নিজের ডানদিকে দাঁড়ানো এক ভদ্রমহিলা আর এক কিশোরী মেয়ের দিকে দেখিয়ে বললেন, এরা হচ্ছে, আমার বোন ও বোনের মেয়ে এখানে থাকেন না, ওনারা এসেছেন, আজকে, তাই ওনাদের কে নিয়ে সবার সাথে একটা নাইট শো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে কি বলতো, কালকে থেকে আমরা আবার থাকছি না, কাল বিকেলে আমাদের ট্রেন, আসলে, এই যে আমার বোনের বায়না, বম্বে ওদের সাথে ঘুরতে, তা তোমার দাদা বলল, আর কি করবে, এত করে বলছে যখন ওরা, চল, ঘুরেই আসি একবার। আজকেই তৎকাল কোটাতে টিকিট কেটেও নিএ এলো তোমার দাদা। তাই আর কি, এদেরকে একটু ঘোরাচ্ছি।

আমি এতক্ষন হাঁ করে শুনছিলাম, হুশ ফিরল, অর্কর গলাতে, অর্ক কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারি নি। অর্ক হেসে জিজ্ঞাসা করে উঠল, এ বাবা, আপনারা চলে যাচ্ছেন, যা আমি তো ভাবছিলাম, যে আপনাদের বাড়িতে যাব আড্ডা মারা জন্য, নিমন্তন্নটা এখনও আছে তো নাকি? বউদি কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, ক্ষতি কি, চল না এক্ষুনি, সবে তো নটা ১৫ বাজে, এক ঘণ্টা আড্ডা দেব সবাই মিলে। আমাদের তো হয়েই গেছে প্রায়।

অর্ক আমার দিকে ফিরে বলল – কি রে যাবি নাকি তুই? তাহলে চল, এমনিতেও আমি একটু অবিনাশবাবুদের বাড়ির দিকে যেতাম, আমিও ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। অর্ক এবারে মুখটা বউদির কানের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল- আসলে আর কিছুই না, আমরা আসলে পাকরাশীজ্যেঠুর ভাড়াটেগুলোর উপরে নজর রাখতে চাই, বুঝলেন তাই এই কৌশল নিতে হচ্ছে, নাহলে আপনাকে এত রাত্রে ডিস্টার্ব করতাম না, বউদি।

কাকলি বউদি হাঁ করে কথাটা শুনে বললেন, তোমাদের কি তাই মনে হয় যে ওদের কোনও ভাড়াটিয়া এই কাজ করেছে, অর্ক কিছু বলার আগেই আমি উত্তর দিলাম, আমার তো পাকরাশী বাবুকেও সন্দেহ হয়, যেমন ভাবে সব খবর রাখে, ওনাদের সাথেও তো ঝগড়া হয়েছিলো নাকি সেদিন।
অর্ক চোখটা টিপে বউদিকে আমার কথার সত্যতা ইশারা করে বোঝাল। সাথে সাথে বউদি, মুখে হাত দিয়ে ও- মা বলে চাপাস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

তারপর তাড়াতাড়ি পরাণদাকে টাকা মিটিয়ে, আমাদের দিকে ঘুরে বলল, না না, এটা ঠিক নয়, তোমরা এত অক্লান্ত পরিশ্রম করছ আর আমি তোমাদেরকে একটু সাহায্য যদি না করতে পারি, তাহলে হয় ?, নাও চলচল, আগে আমার বাড়ি চল। বলে প্রায় একরকম জোর করে আমাদেরকে টানতে টানতে নিয়ে চললেন নিজের বাড়ির দিকে, পেছন পেছন বাকি সবাই আসছেন।

বউদির বাড়ির ভিতরে ঢুকেই বুঝলাম বড়লোকি চাল কাকে বলে। বউদির হাসব্যানড যে প্রমোটারী করে প্রচুর পয়সা কামিয়েছেন, তা বোঝাই যাচ্ছে। ঘরের সিঁড়ি থেকে বাইরের বারান্দা সব ইটালিয়ান মার্বেল দিয়ে তৈরি। ঘরের ভিতরের আসবাবপত্র সব ইম্পপোর্টেড জিনিশ দিয়ে তৈরি। আমরা নীচের তলাতেই একটা বসার ঘরে গিয়ে বসলাম। অর্ক সাথে সাথে আরে বউদি কি করেছেন কি, বলে আগমার্কা হাসি হেসে, সারা ঘর ঢুঁ মারতে শুরু করল। অগত্যা আমাকেও ওর পিছন পিছন চলতে হল। বউদির ছেলের ঘর থেকে হঠাৎ চেঁচামেচি আর কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে আমরা সবাই ভিতরে গিয়ে দেখি, বউদির বোনের মেয়ে বউদির ছেলের হাত থেকে কিছু একটা কেড়ে নিয়েছে, ব্যাস তাতেই বিপত্তি। ব্যাপারটা ঠাওর করতে বুঝলাম, আর কিছুই নয়, এতদিন পরে বউদির বোন বাপের বাড়ি থেকে নিজেদের একটা পুরনো অ্যালবাম নিয়ে এসেছেন সাথে করে বম্বে নিএ যাওয়ার জন্য, আর সেটা নিয়েই, ভাই আর বোনের মারপিট। বউদি নিঃশ্বাস ছেড়ে বোনের মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন - কি রে দেবশ্রী, তুই তো বড় নাকি, তুই তোর ভাইএর থেকে এটা কেড়ে নিচ্ছিলি কেন? ওকেও তো একটু দেখাতে পারতিস নাকি। বউদির বোনও খুব জোরের সাথে দিদির বক্তব্য সমর্থন করলেন, বেচারী দেবশ্রী, মা ও মাসি দুজনের থেকেই বকুনি খেয়ে, কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে উঠল, আমি কি করব, আমি তো ফটোই দেখাচ্ছিলাম, কিন্ত ও যে দিদ্দি দিদ্দি করছে, আমি রেগে গিয়ে যত বলছি এগুলো আমার ফটো নয়, তবুও একই কথা বারে বারে বলে যাচ্ছে। তাইতো কেড়ে নিচ্ছিলাম।

অর্ক হেসে বলল – দেবশ্রী ও তো ছোট তাই ভাবছে বোধহয় ওগুলো তোমার ফটোই। এর মধ্যেই আবার একবার কাকলি বউদি দুজনকেই বকুনি দিয়ে আমাদের বললেন – চল, দেখতেই তো পাচ্ছ কি কাণ্ড। বোন আমার সাধ করে ওটা নিয়ে এসেছে, নিয়ে যাবে বাড়ি পুরনো স্মৃতি রোমন্থনএর জন্য, আর সেই নিইয়েও লঙ্কা কাণ্ড। যতঃ সব।  

আমরা আবার বসার ঘরে ফিরে আসলাম। এসে দেখি, বউদির কাজের লোক ততক্ষনে দেখি লুচি, আলুর দম আর কষা মুরগির মাংস প্লেটএ করে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। অর্ক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বউদি বলে উঠলেন, দেখ আমি কিছু শুনতে চাই না, তোমাদের কে খেতেই হবে, এই বলে বোনের মেয়েকে বলে উঠলেন, এই দেবশ্রী, তুই এনাদের দিকে খেয়াল রাখ, আমি আরও কটা লুচি ভাজতে বলে আসি রাধার মাকে। আমরা হাত চালাতে শুরু করলাম,

কাকলি বউদি ফিরে আসতে অর্ক বউদি কে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা বউদি আপনারা তো অনেকদিনের বাসিন্দা এখানকার, এখানে কি কোনও ফ্যাক্টরি আছে, বলে জানেন আপনি বা নিদেন পক্ষে কোনও ছোট কারখানা ? কথাটা শুনে বউদি হেসে প্রায় কুটোপাটি হয়ে বললেন, সেকি, তোমরা শেষে খুনের তদন্ত ছেড়ে কারখানা নিয়ে পড়লে? অর্ক মুচকি হেসে বলল, যা ঘোল খাওয়াচ্ছে না এবারে, মনে হয়, এসব ছেড়ে এবারে কোনও কারখানাতে ঢুকে চাকরি বাকরি করি।  

বউদির হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেলো, বলল – না এখানে সেরকম কোনও, কারখানা নেই, তবে আমাদের বাড়ীর পিছনদিকে দুটো ঘর নিয়ে দুটি ব্যাকেলাইট মেশিন আছে, তবে ওটাকে কারখানা না বলে কুটিরশিল্প বলা ভালো। দুটো মেশিন বসিয়ে, সাকুল্যে চারজন শিফটে কাজ করে। ব্যাকেলাইট জানো তো কি জিনিশ ? কি কাজ হয় ওটাতে ? আমার দিকে তাকিয়ে বউদি প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।

আমি আমতা আমতা করছি দেখে অর্ক বলল – হুম, যতদুর আমি জানি, ব্যাকেলাইট পাউডার দিয়ে হিটের সাহায্যে ইলেকট্রিক কারেন্টের সুইচ তৈরি করা হয়। বউদি ঘাড় নেড়ে বলল – অনেকটা ঠিকই বলেছ, আসলে, এই দেখ এই জে আমাদের ঘরের সুইচবোর্ডটা দেখ, এখানে, গোলাকার যে সুইচটা আছে, দেখেছ? এর পিছনের কালো অংশটা হল ব্যাকেলাইট। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে বললাম, কিন্তু এগুলো তো এখন পুরনো হয়ে গেছে, এখনতো সব প্লাস্টিকএর সুইচ চলে এসেছে।

বউদি বলল – হ্যাঁ সে ঠিক, কিন্তু, এখন অনেক জায়গায় এই সুইচ ব্যাবহার করা হয়, বিশেষত গ্রামের দিকে এর রমরমা বাজার। তাছাড়া, এখন কিছু কিছু জিনিশ যেমন, একটু পুরনো বাড়িতে এই ধরনের সুইচ দেখতে পাবে, বিশেষ করে ইলেকট্রিক মিটারের মেইন সিউচ, পাম্পের সুইচ ইত্যাদি।

অর্ক চোখ গোলগোল করে বলল – বা বা, বউদি আপনি কত কিছুর খবর রাখেন দেখছি। উত্তরে বউদি বলল, আসলে কি জানো তো, এটা তোমার দাদা, আর ওর পার্টনারের সবথেকে পুরনো ব্যাবসা, রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসায় আসার আগে থেকেই দুজনে মিলে, এটা শুরু করেছিল, তাই তোমার দাদা চায় না, যে এটা বন্ধ হোক, আমিও কতবার বলেছি, এখন আর সেরকম চাহিদা নেই, এবারে এইটা বন্ধ কর, উত্তরে তোমার দাদা কি বলে জানো, বলে, দেখ বন্ধ তো আমি করে দিতে পারি, কিন্তু আমার এই যে প্রতিপত্তি, পয়সা, এর মুলে কিন্তু এই ব্যাবসা, আজ যে তোমরা এত আরামে আছ, তা এই ব্যাবসার কল্যানে। আমি যতদিন বেঁচে আছি, এই ব্যাবসা বন্ধ হবে না, এটা আমার কাছে লক্ষী।

অর্ক ঘাড় নেড়ে বলে উঠল, ঠিকই তো বলেছেন দাদা, না না এটা বন্ধ করা উচিত হবে না। আমিও এই কারখানা দেখতে চাই একবার নিজের চোখে। আপনি দাদাকে বলে একটু ব্যাবস্থা করে দিন না, বউদি হেসে বলল, আরে এতে আর জিজ্ঞাসা করার কি আছে? এক কাজ কর, আমরা তো কালকে চলে যাচ্ছি, মুম্বাই, আমার বোনের বাড়ি,  আমরা সাতদিন পরেই ফিরে আসব, তখন না হয় একদিন এস, তবে সকাল বেলা আসলেই ভালো হয়, ভালো করে সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।  

অর্ক ঘাড় নেড়ে বউদির কথাতে সায় দিয়ে বলল,  আচ্ছা বউদি, আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করব, আপনার সাথে তো অবিনাশবাবুদের সম্পর্ক এত ভালো হয়ে গিয়েছিলো, এই সাত – দশ দিনে, আপনার ছেলে মুকুলিকার সাথেই খেলত শুনলাম, মুকুলিকাও আপনাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করত, তবুও ও কখনো বলেনি আপনাকে বা আপনাদের এই রকম কোনও ছেলের কথা?

বউদি কিছুক্ষন চুপ করে বললেন, না , মানে এইরকম কোনও কথাতো আমাদের মধ্যে আলোচনা হতো না হয়ত তাই... তবে, আমার কিন্তু খুব সন্দেহ হতো। অর্ক ভুরূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, কেন ? বউদি হেসে বললেন, না মানে আর কিছুই না, আসলে এত অল্প বয়সে এত সুন্দরী দেখতে ছিল যে এখনকার দিনে এইসব না থাকার কোনও কথা নয়।

হুম, আপনাকেও কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে বউদি, কমবয়সে, আপনিও খুব সুন্দরী ছিলেন তাই না ? – আমার সহাস্য প্রশংসায়, বউদি খুব খুশি হবে আশা করেছিলাম, কিন্তু মনে হল যেন বউদি, একটু থতমত খেয়েই, আবার নিজের ফর্মে ফিরে বললেন এই জানো আমার বয়স কত? দাদা কে বলে দেব কিন্তু,  বলে হো হো করে হেসে ফেললেন।

আমরা দুজনেই সেই হাসিতে যোগদান করলাম, তারপর আমরা উঠে, বউদি অসংখ্য ধন্ন্যবাদ দিয়ে ওনাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম, বাইরে বেরিয়ে দেখি, বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। অর্ক ও আমি একসাথেই যে যার বাসার দিকে যাবার জন্য নিজের নিজের রাস্তা ধরে নিয়েছিলাম,

 
কিন্তু অর্ক এখন বাইরে কি করছে? আমি একবার বেরবো ? কিন্তু কোথায় বা দেখব ওকে? কে জানে , ধুর যাই ঘুমাতে যাই। কাল সকালে দেখা যাবে।


(চলবে )
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৭৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/১১/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • দারুন !
  • নির্ঝর ০৪/১১/২০১৫
    ভাল হয়েছে অনেক
  • NIRJHOR ০৪/১১/২০১৫
    সাধারন
  • এখন একটু একটু তল পাচ্ছি , বোধ হয়। গল্পটা আর আনন্দমেলার জন্য রইলো না মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে জল গোটাচ্ছেন , ভালো।
 
Quantcast