চোরকাঁটা - ৯ম পর্ব
( আগের সঙ্খ্যার পর )
রাস্তায় বেরিয়ে অর্ক হাতঘড়িটা দেখে বলল চল, একটু বেড়িয়ে আসি আগে, আমাদের পুরনো আড্ডার জায়গা থেকে, ওখানে অনেক বুদ্ধি খুলত আমাদের, দেখা যাক যদি একটু পার্কের হাওয়া খেয়ে যদি এই কেসটার কোনও দিকে আলোকপাত করতে পারি। আমি সাথে সাথে এক পায়ে রাজী হয়ে গেলাম, ওফ, অনেকদিন পর আবার সেখানে আমরা যাব, একটু নিরিবিলিতে বুদ্ধির গোঁড়ায় ধোঁয়া দেওয়া যাবে। পার্কে পৌঁছে, আমি আর অর্ক দুজনেই সিগারেটে সুখটান দিয়ে বেঞ্চে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসলাম। বেশ লক্ষ্য করলাম, সিগারেট খেতে খেতে অর্ক উদাস ভাবে তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। আমি আর সাহস পাচ্ছিলাম না কিছু জিজ্ঞাসা করার। শুধু মনে মনে বললাম, মনে হচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারব না এই কেসটা তে।
আমার মনের কথা হয়ত অর্ক শুনতে পেরেছিল, হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বলে উঠল, না , আমরা পারবই, আমাদের কে পারতেই হবে, পরাণদার জন্য, ওই ছোট্ট মেয়েটির জন্য। চল, আর দেরি না করে একটু কেসটা নিজেদের মত বিশ্লেষণ করে নি।
আমি বললাম, সেদিন তো করেইছিলাম, আবার নতুন করে কি বলব, অর্ক রেগে উঠে বলল, এতও তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারালে চলবে না মৈনাক, বার বার ভাবতে হবে আমাদের, কিন্তু যা করতে হবে তা তাড়াতাড়ি। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম – আচ্ছা বাবা, এবারে তুই বল তোর কি মনে হচ্ছে?
অর্ক গম্ভীর ভাবে বলে উঠল, দেখ মৈনাক, দুটো ব্যাপারে আমি একদম পরিষ্কার... প্রথমত, এই হত্যার পেছনে, অবিনাশ বাবুদের অতীতের কোনও সম্পর্ক নেই, আর দ্বিতীয়ত, আমরা হত্যাকারীর পরিচিত, হ্যাঁ তবে সে আমাদের পরিচিত কিনা তা সময় বলবে, আপাতত এতুকু নিয়েই আমরা এগুতে পারি। একটি বাচ্চা মেয়ে মাত্র সাতদিন হল একটি নতুন পাড়ায় এসে খুন হয়ে গেল, আর সেই খুনের পিছনে পরাণদার নাম জড়িয়ে গেল, জিনিসটা অস্বাভাবিক নয় কি? পরাণদার কি মোটিভ এতে... পরাণদাকেও এই ব্যাপারে ফাঁসানো হয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করে তুই এইব্যাপারে শিওর হলি? অর্ক হেসে বলল – দ্যাখ, খুব সোজা এবং সরল, প্রথম কারণ – অবিনাশবাবু বা তমালিকা দেবীর অতীত যদি এর পিছনে থাকত তাহলে এই ঘটনা অনেক আগেই ঘটতে পারত। আমার মনে হয় না, অবিনাশ বাবু বা তমালিকা দেবীর নিজের বাড়ির লোকেরা এই নিয়ে মাথা ঘামাবে, কারণ তারা অনেক আগেই ওনাদেরকে ত্যাজ্য করে শাস্তি দিয়ে রেখেছেন।
এইবার ভাব, খুনে নাম জড়াল কার, না পরাণদার। কেউ বা কারা পুলিশকে ফোনে পরাণদার ব্যাপারে জানিয়েছে, অর্থাৎ, পরাণদা আততায়ীর পরিচিত, কারণ একমাত্র তার পক্ষ্যেই জানা সম্ভব পরানদার দোকানের হাল-হকিকত, অর্থাৎ কোথায় স্কার্ফটি লুকিয়ে রাখা যায়, তা সে ভালো করে জানে, যেটা পরাণ দাও বুঝতে পারেনি। এইখানেই খটকা লাগছে রে, পরাণদার ফুচকার দোকানের ভিতরটা একদমই ছোট, আর দোকান খোলা আর বন্ধ পরাণদা নিজের হাতে করে, তো তাতেও পরাণদা কেন রক্তমাখা স্কার্ফটা দেখতে পেল না, যেটা পুলিশ চোখ বন্ধ করে গিয়ে নিএ এলো। আবার ভাব, মুকুলিকার মৃত্যুর কারণ হল শ্বাসরোধ, ওর সারা দেহে অন্য কোনও ক্ষতচিহ্ন ছিল না, তাহলে সেই স্কার্ফটাই বা রক্তমাখা হল কি ভাবে? এটাও ইচ্ছে করে সাজানো হয়েছে, সেটা বোধহয়, ভদ্রদাও বুঝতে পেরেছেন।
আমি এতক্ষনে উত্তেজনা অনুভব করছিলাম মনে মনে, বললাম – আরে , হতে পারে পরাণদা খেয়াল করে নি। অর্ক হেসে বলল – গুড, এটাই হবে। এইবার দ্বিতীয়কারণে আসি, কালকে রাত্রে পরাণদা গ্রেফতার হল, কিন্তু তাও খুনি, আজ কে সকালে আমাদের কে চ্যালেঞ্জ করল। তোকে এসএমএস করে আর আমাকে সরাসরি ফোন করে। তো এর থেকে কি বোঝা যায় ? আমি বিজ্ঞের মত বললাম – আমাদেরকে ভয় দেখাতে চেয়েছে যাতে আমরা কাজ না করি এই কেসে।
অর্ক আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – কিন্তু কেন... তাতে খুনির লাভ না লোকসান? আমরা কাজ না করলে, হত্যাকারীর লাভ, কারণ তাতে পরাণদা জেলের ঘানি টানবে । কিন্তু...
কিন্তু আবার কি ? এর মধ্যে আবার কিন্তু কোথা থেকে আসছে ? এটা তো জলের মত পরিষ্কার। আমি বিরক্তি চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞাসা করলাম।
অর্ক, হেসে বলল ছোটবেলায় পরিসনি - যেখানেই দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই...পাইলেও পাইতে পার অমুল্য রতন...। তাহলে? ব্যাপারটা যত সোজা আর সরল মনে হচ্ছে, তা না হতেও পারে... দেখ খুনি, প্রথমে পুলিশকে ফোন করে পরাণ দা কে আততায়ী হিসাবে গ্রেফতার করায় কাল রাত্রে। তারপর সকালে আমাদের কে ভয় দেখায়। এর মানে কি ? এর মানে হল, খুনি আমাদের কে জানে, বেশ ভালভাবে জানে... খুনি জানে আমরা পরাণদা কে ছাড়িয়ে নেব। তাই সে আমাদের দিকে খোলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, দু দুটো... ক্ষমতা থাকে তো পরাণদা কে ছাড়াও আর সাথে সাথে আমাকেও খুঁজে বার কর...। মনে হচ্ছে খুনি খুব চালাক...আর কৌশলী... এর থেকে কি বুঝলি...
আমি ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থেকে বললাম কিন্তু তাতে খুনির লাভ ? মানিক চাঁদ, বুদ্ধিটায় একটু শান দে, এর মানে হল, আততায়ী আমাদের এখানকারই কেউ, যে বা যারা আমাদেরকে চেনে। তাই আমি বললাম, আমরা খুনির পরিচিত। এবারে দেখতে হবে সে আমাদের পরিচিত কিনা। একটা কথা ভাব, আততায়ী যদি, জানে যে অন্য একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে তার অপরাধের জন্য, তাহলে সে কি করতে পারে ...। আমি বললাম, হুম...সে চুপ করে সরে পরবে যাতে ওকে আর ধরা না যায়...আর বেশি চালাক হলে ঘটনার স্রোতের মধ্যেই মিশে থেকে সবার উপরে নজর রাখবে, আর তার করা ভুলত্রুটি মেরামত করার চেষ্টা করবে, অর্থাৎ এক কথায়, প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করবে।
গুড, এইতো বুদ্ধি খুলেছে, তাহলে এখানে আততায়ী আরও বুদ্ধিমান আর বেপরোয়া... সে আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ করছে, অর্থাৎ সে নিজেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ভাবে, আশা করি তার এই বেপরোয়াভাবই আমাদেরকে সাহায্য করবে তাকে ধরতে। তাই এখন সে যা চাইছে, সেই ভাবে কাজ করে এগোতে হবে।। আগে পরাণদা কে ছাড়াতে হবে। চল একটু তমালিকাদেবীদের বাড়িতে জাই...ওনাদের সাথে কিছু জরুরী কথা আছে।
অগত্যা আর কি করা? পার্ক থেকে বেড়িয়ে সোজা অবিনাশ বাবুদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম দুজনে। আবার বৃষ্টিটা শুরু হল, এতক্ষন টিপটিপ করে হচ্ছিল, আবার জোরে পরা শুরু হয়ে গেলো। ছাতা মাথায় দিয়ে পথে যেতে যেতে আমার মাথায় অর্কর কথাগুলোই বাজছিল। তাহলে হত্যাকারীকে আমরা চিনি ? কে সে ? কিন্তু এতে ওই একরত্তি মেয়েটার কি দোষ কি ছিল? আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল, খালি অর্ককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তুই কি কাউকে সন্দেহ করছিস? অর্ক ছোট্ট জবাব – সবাইকে, যা শুনে সব আবার খিচুরি পাকিয়ে গেল।
যাই হোক, এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অবিনাশবাবুদের ভাড়া বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ির মালিক পাকরাশীজ্যেঠু ও তার এক ভাড়াটে ঘোষবাবু অর্কর জ্যেঠুর বিশেষ বন্ধু। ওনারা একসাথে মর্নিংওয়াকে নিয়মিত যান আবার পাড়ার লাফিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও বটে। বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি পাকরাশী জ্যেঠু ও ওনার স্ত্রী বাগানের পাশে লাগানো চেয়ারে বসে নিজেদেরমত করে কথা বলছেন, দুটি বাচ্চা ছেলে, বয়স প্রায় সাত-আট হবে, খেলা করছিল ও আর একটি বাচ্চা ছেলে পাশে মাটিতে বসে বল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বাকিদের খেলা দেখছিল। আমাদেরকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে, পাকরাশীজ্যেঠু অর্ককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, কি হে গোয়েন্দামশাই, এদিকে হঠাৎ কি মনে করে? এস, এদিকে এস, বুড়োবুড়ির সাথে একটু কথা বলে যাও। আমরা ওনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম, অর্ক আগে এগিয়ে গিয়ে, পাকরাশীজ্যেঠুর কানে কানে কি কথা বলল কিছু বুঝলাম না, কিন্তু দেখলাম, পাকরাশীজ্যেঠু ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন ঠিক আছে, তোমরা যাও, আমি আসছি, সবাই কে বলে দেব।
অর্ক হেসে পিছন ফিরে আমায় বলল চল আগে অবিনাশবাবুদের সাথে কথা বলে আসি। আমরা সোজা নীচের তলায় অবিনাশবাবুদের ঘরের সামনে উপস্থিত হয়ে দরজার বেল টিপলাম। ভিতর থেকে অবিনাশবাবুর গলার স্বর পাওয়া গেল – আসছি। অবিনাশ বাবু এসে দরজা খুলে আমাদেরকে দেখে প্রথমে অবাক হয়ে গেলেন, ও তারপর বললেন, ভালই হল আপনারা এসে গেছেন, আমরা ভাবছিলাম নিজেরাই যাব আজ বিকেলের দিকে। আসুন আসুন, ভিতরে এসে বসুন, বলেই আমাদের কে ভিতরে বসার জায়গা দেখিয়ে হাঁক দিলেন, তমালিকা, তাড়াতাড়ি এস, দেখ কারা এসেছে ? তমালিকা দেবী রান্নাঘরে ছিলেন, বেরিয়ে এসে আমাদেরকে দেখে শুকনো মুখে বললেন, ও আপনারা, বসুন বসুন, আপনারা কথা বলুন, আমি চা নিয়ে আসছি, বলে আবার রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।
আমরা দুজনে দুটো চেয়ারে বসলাম আর আমাদের মুখোমুখি খাটে বসলেন অবিনাশ বাবু। প্রথম কথা অর্কই শুরু করল, দেখুন, কিছু জিনিস জানার জন্য আমরা আপনাদের বিরক্ত করতে এসেছি। যেগুলো আমাদের মনে হয়, এই ঘটনার সাথে যুক্ত। আপনার এবং তমালিকা দেবীর সহযোগিতা এক্ষেত্রে আমাদের দরকার।
( চলবে )
রাস্তায় বেরিয়ে অর্ক হাতঘড়িটা দেখে বলল চল, একটু বেড়িয়ে আসি আগে, আমাদের পুরনো আড্ডার জায়গা থেকে, ওখানে অনেক বুদ্ধি খুলত আমাদের, দেখা যাক যদি একটু পার্কের হাওয়া খেয়ে যদি এই কেসটার কোনও দিকে আলোকপাত করতে পারি। আমি সাথে সাথে এক পায়ে রাজী হয়ে গেলাম, ওফ, অনেকদিন পর আবার সেখানে আমরা যাব, একটু নিরিবিলিতে বুদ্ধির গোঁড়ায় ধোঁয়া দেওয়া যাবে। পার্কে পৌঁছে, আমি আর অর্ক দুজনেই সিগারেটে সুখটান দিয়ে বেঞ্চে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসলাম। বেশ লক্ষ্য করলাম, সিগারেট খেতে খেতে অর্ক উদাস ভাবে তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। আমি আর সাহস পাচ্ছিলাম না কিছু জিজ্ঞাসা করার। শুধু মনে মনে বললাম, মনে হচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারব না এই কেসটা তে।
আমার মনের কথা হয়ত অর্ক শুনতে পেরেছিল, হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বলে উঠল, না , আমরা পারবই, আমাদের কে পারতেই হবে, পরাণদার জন্য, ওই ছোট্ট মেয়েটির জন্য। চল, আর দেরি না করে একটু কেসটা নিজেদের মত বিশ্লেষণ করে নি।
আমি বললাম, সেদিন তো করেইছিলাম, আবার নতুন করে কি বলব, অর্ক রেগে উঠে বলল, এতও তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারালে চলবে না মৈনাক, বার বার ভাবতে হবে আমাদের, কিন্তু যা করতে হবে তা তাড়াতাড়ি। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম – আচ্ছা বাবা, এবারে তুই বল তোর কি মনে হচ্ছে?
অর্ক গম্ভীর ভাবে বলে উঠল, দেখ মৈনাক, দুটো ব্যাপারে আমি একদম পরিষ্কার... প্রথমত, এই হত্যার পেছনে, অবিনাশ বাবুদের অতীতের কোনও সম্পর্ক নেই, আর দ্বিতীয়ত, আমরা হত্যাকারীর পরিচিত, হ্যাঁ তবে সে আমাদের পরিচিত কিনা তা সময় বলবে, আপাতত এতুকু নিয়েই আমরা এগুতে পারি। একটি বাচ্চা মেয়ে মাত্র সাতদিন হল একটি নতুন পাড়ায় এসে খুন হয়ে গেল, আর সেই খুনের পিছনে পরাণদার নাম জড়িয়ে গেল, জিনিসটা অস্বাভাবিক নয় কি? পরাণদার কি মোটিভ এতে... পরাণদাকেও এই ব্যাপারে ফাঁসানো হয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করে তুই এইব্যাপারে শিওর হলি? অর্ক হেসে বলল – দ্যাখ, খুব সোজা এবং সরল, প্রথম কারণ – অবিনাশবাবু বা তমালিকা দেবীর অতীত যদি এর পিছনে থাকত তাহলে এই ঘটনা অনেক আগেই ঘটতে পারত। আমার মনে হয় না, অবিনাশ বাবু বা তমালিকা দেবীর নিজের বাড়ির লোকেরা এই নিয়ে মাথা ঘামাবে, কারণ তারা অনেক আগেই ওনাদেরকে ত্যাজ্য করে শাস্তি দিয়ে রেখেছেন।
এইবার ভাব, খুনে নাম জড়াল কার, না পরাণদার। কেউ বা কারা পুলিশকে ফোনে পরাণদার ব্যাপারে জানিয়েছে, অর্থাৎ, পরাণদা আততায়ীর পরিচিত, কারণ একমাত্র তার পক্ষ্যেই জানা সম্ভব পরানদার দোকানের হাল-হকিকত, অর্থাৎ কোথায় স্কার্ফটি লুকিয়ে রাখা যায়, তা সে ভালো করে জানে, যেটা পরাণ দাও বুঝতে পারেনি। এইখানেই খটকা লাগছে রে, পরাণদার ফুচকার দোকানের ভিতরটা একদমই ছোট, আর দোকান খোলা আর বন্ধ পরাণদা নিজের হাতে করে, তো তাতেও পরাণদা কেন রক্তমাখা স্কার্ফটা দেখতে পেল না, যেটা পুলিশ চোখ বন্ধ করে গিয়ে নিএ এলো। আবার ভাব, মুকুলিকার মৃত্যুর কারণ হল শ্বাসরোধ, ওর সারা দেহে অন্য কোনও ক্ষতচিহ্ন ছিল না, তাহলে সেই স্কার্ফটাই বা রক্তমাখা হল কি ভাবে? এটাও ইচ্ছে করে সাজানো হয়েছে, সেটা বোধহয়, ভদ্রদাও বুঝতে পেরেছেন।
আমি এতক্ষনে উত্তেজনা অনুভব করছিলাম মনে মনে, বললাম – আরে , হতে পারে পরাণদা খেয়াল করে নি। অর্ক হেসে বলল – গুড, এটাই হবে। এইবার দ্বিতীয়কারণে আসি, কালকে রাত্রে পরাণদা গ্রেফতার হল, কিন্তু তাও খুনি, আজ কে সকালে আমাদের কে চ্যালেঞ্জ করল। তোকে এসএমএস করে আর আমাকে সরাসরি ফোন করে। তো এর থেকে কি বোঝা যায় ? আমি বিজ্ঞের মত বললাম – আমাদেরকে ভয় দেখাতে চেয়েছে যাতে আমরা কাজ না করি এই কেসে।
অর্ক আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – কিন্তু কেন... তাতে খুনির লাভ না লোকসান? আমরা কাজ না করলে, হত্যাকারীর লাভ, কারণ তাতে পরাণদা জেলের ঘানি টানবে । কিন্তু...
কিন্তু আবার কি ? এর মধ্যে আবার কিন্তু কোথা থেকে আসছে ? এটা তো জলের মত পরিষ্কার। আমি বিরক্তি চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞাসা করলাম।
অর্ক, হেসে বলল ছোটবেলায় পরিসনি - যেখানেই দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই...পাইলেও পাইতে পার অমুল্য রতন...। তাহলে? ব্যাপারটা যত সোজা আর সরল মনে হচ্ছে, তা না হতেও পারে... দেখ খুনি, প্রথমে পুলিশকে ফোন করে পরাণ দা কে আততায়ী হিসাবে গ্রেফতার করায় কাল রাত্রে। তারপর সকালে আমাদের কে ভয় দেখায়। এর মানে কি ? এর মানে হল, খুনি আমাদের কে জানে, বেশ ভালভাবে জানে... খুনি জানে আমরা পরাণদা কে ছাড়িয়ে নেব। তাই সে আমাদের দিকে খোলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, দু দুটো... ক্ষমতা থাকে তো পরাণদা কে ছাড়াও আর সাথে সাথে আমাকেও খুঁজে বার কর...। মনে হচ্ছে খুনি খুব চালাক...আর কৌশলী... এর থেকে কি বুঝলি...
আমি ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থেকে বললাম কিন্তু তাতে খুনির লাভ ? মানিক চাঁদ, বুদ্ধিটায় একটু শান দে, এর মানে হল, আততায়ী আমাদের এখানকারই কেউ, যে বা যারা আমাদেরকে চেনে। তাই আমি বললাম, আমরা খুনির পরিচিত। এবারে দেখতে হবে সে আমাদের পরিচিত কিনা। একটা কথা ভাব, আততায়ী যদি, জানে যে অন্য একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে তার অপরাধের জন্য, তাহলে সে কি করতে পারে ...। আমি বললাম, হুম...সে চুপ করে সরে পরবে যাতে ওকে আর ধরা না যায়...আর বেশি চালাক হলে ঘটনার স্রোতের মধ্যেই মিশে থেকে সবার উপরে নজর রাখবে, আর তার করা ভুলত্রুটি মেরামত করার চেষ্টা করবে, অর্থাৎ এক কথায়, প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করবে।
গুড, এইতো বুদ্ধি খুলেছে, তাহলে এখানে আততায়ী আরও বুদ্ধিমান আর বেপরোয়া... সে আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ করছে, অর্থাৎ সে নিজেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ভাবে, আশা করি তার এই বেপরোয়াভাবই আমাদেরকে সাহায্য করবে তাকে ধরতে। তাই এখন সে যা চাইছে, সেই ভাবে কাজ করে এগোতে হবে।। আগে পরাণদা কে ছাড়াতে হবে। চল একটু তমালিকাদেবীদের বাড়িতে জাই...ওনাদের সাথে কিছু জরুরী কথা আছে।
অগত্যা আর কি করা? পার্ক থেকে বেড়িয়ে সোজা অবিনাশ বাবুদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম দুজনে। আবার বৃষ্টিটা শুরু হল, এতক্ষন টিপটিপ করে হচ্ছিল, আবার জোরে পরা শুরু হয়ে গেলো। ছাতা মাথায় দিয়ে পথে যেতে যেতে আমার মাথায় অর্কর কথাগুলোই বাজছিল। তাহলে হত্যাকারীকে আমরা চিনি ? কে সে ? কিন্তু এতে ওই একরত্তি মেয়েটার কি দোষ কি ছিল? আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল, খালি অর্ককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তুই কি কাউকে সন্দেহ করছিস? অর্ক ছোট্ট জবাব – সবাইকে, যা শুনে সব আবার খিচুরি পাকিয়ে গেল।
যাই হোক, এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অবিনাশবাবুদের ভাড়া বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ির মালিক পাকরাশীজ্যেঠু ও তার এক ভাড়াটে ঘোষবাবু অর্কর জ্যেঠুর বিশেষ বন্ধু। ওনারা একসাথে মর্নিংওয়াকে নিয়মিত যান আবার পাড়ার লাফিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও বটে। বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি পাকরাশী জ্যেঠু ও ওনার স্ত্রী বাগানের পাশে লাগানো চেয়ারে বসে নিজেদেরমত করে কথা বলছেন, দুটি বাচ্চা ছেলে, বয়স প্রায় সাত-আট হবে, খেলা করছিল ও আর একটি বাচ্চা ছেলে পাশে মাটিতে বসে বল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বাকিদের খেলা দেখছিল। আমাদেরকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে, পাকরাশীজ্যেঠু অর্ককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, কি হে গোয়েন্দামশাই, এদিকে হঠাৎ কি মনে করে? এস, এদিকে এস, বুড়োবুড়ির সাথে একটু কথা বলে যাও। আমরা ওনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম, অর্ক আগে এগিয়ে গিয়ে, পাকরাশীজ্যেঠুর কানে কানে কি কথা বলল কিছু বুঝলাম না, কিন্তু দেখলাম, পাকরাশীজ্যেঠু ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন ঠিক আছে, তোমরা যাও, আমি আসছি, সবাই কে বলে দেব।
অর্ক হেসে পিছন ফিরে আমায় বলল চল আগে অবিনাশবাবুদের সাথে কথা বলে আসি। আমরা সোজা নীচের তলায় অবিনাশবাবুদের ঘরের সামনে উপস্থিত হয়ে দরজার বেল টিপলাম। ভিতর থেকে অবিনাশবাবুর গলার স্বর পাওয়া গেল – আসছি। অবিনাশ বাবু এসে দরজা খুলে আমাদেরকে দেখে প্রথমে অবাক হয়ে গেলেন, ও তারপর বললেন, ভালই হল আপনারা এসে গেছেন, আমরা ভাবছিলাম নিজেরাই যাব আজ বিকেলের দিকে। আসুন আসুন, ভিতরে এসে বসুন, বলেই আমাদের কে ভিতরে বসার জায়গা দেখিয়ে হাঁক দিলেন, তমালিকা, তাড়াতাড়ি এস, দেখ কারা এসেছে ? তমালিকা দেবী রান্নাঘরে ছিলেন, বেরিয়ে এসে আমাদেরকে দেখে শুকনো মুখে বললেন, ও আপনারা, বসুন বসুন, আপনারা কথা বলুন, আমি চা নিয়ে আসছি, বলে আবার রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।
আমরা দুজনে দুটো চেয়ারে বসলাম আর আমাদের মুখোমুখি খাটে বসলেন অবিনাশ বাবু। প্রথম কথা অর্কই শুরু করল, দেখুন, কিছু জিনিস জানার জন্য আমরা আপনাদের বিরক্ত করতে এসেছি। যেগুলো আমাদের মনে হয়, এই ঘটনার সাথে যুক্ত। আপনার এবং তমালিকা দেবীর সহযোগিতা এক্ষেত্রে আমাদের দরকার।
( চলবে )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ১৩/১০/২০১৫নো সাসপেন্স প্লিজ ! আরো কি অপে......।।
-
দেবর্ষি সিংহ ১০/১০/২০১৫Bhalo dourachhe...
-
বিকাশ দাস ১০/১০/২০১৫ভালো লাগছে
-
তপন দাস ০৮/১০/২০১৫জমে উঠেছে... টান টান উত্তেজনা। দেখা যাক কী হয়!
-
শুভাশিষ আচার্য ০৮/১০/২০১৫লেখা কিন্তু এগিয়ে চলেছে জোর কদমে।
আমিও তারুন্যে লেখা দিলাম। -
দেবব্রত সান্যাল ০৮/১০/২০১৫খুব সাসপেন্সে রাখছেন কিন্তু। পাঠকরা ক্লাইম্যাক্সে যাবার জন্য ছট ফট করছে।
-
শিমুল শুভ্র ০৭/১০/২০১৫অসম্ভব দারুণ আপনার মেধার তেজ দাদা। এই এপিসট গুলো দিয়ে উপন্যাস নির্মাণ করতে পারেন , ভালো থাকুন।