চোরকাঁটা - ৮ম পর্ব
( আগের সংখ্যার পর )
আমি আর কি করব, বিছানা ছেড়ে উঠে পরলাম, ফ্রেশ হয়ে, মুখ, হাত পা ধুয়ে চা খেয়ে, বেরোতে বেরোতে সাতটা হয়ে গেল, বাইরে বেরিয়ে আবিষ্কার করলাম প্রকৃতির সে কি অপরূপ মনোরোম দৃশ্য। সোনা ঝরা রোদ এসে পড়েছে আমাদের কমপ্লেক্সের মাঠের ঘাসে, বৃষ্টির নামগন্ধ নেই এখন, কিন্তু জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। গুটিকয়েক বাচ্চা ফুটবল খেলছিল, চারিদিকে, পরিষ্কার নির্মল পরিবেশ, দূরে কতোগুলো শালিখ নিজেদের মধ্যে কলতান করছিল, ওফ, অসাধারন, আমি যদিও অফিসে যাবার সময়ে সকাল ০৯টার সময়ে বেরই, তাও কখনো খেয়াল করি নি, যদিও, বাবা বলছিল, সাড়ে সাতটাও নাকি অনেক বেশি, প্রকৃতির আসল রূপ দেখতে গেলে, ভোর বেলা সূর্য ওঠার সময়ে উঠতে হবে। এই সব দেখতে দেখতে কখন যে মনটা ভালো হয়ে গেল জানি না, মাঠের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে পাশ কাটিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে অর্কদের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। মন পড়েছিল কড়াইশুঁটির কচুরির দিকে।
কচুরি খেতে খেতে অর্ক প্রশ্ন করল, কি রে খুব ভয় পেয়েছিলিস বুঝি? আমি আড় চোখে অর্কর দিকে একবার তাকিয়েই আবার কচুরিতে মনোনিবেশ করলাম। অর্ক হেসে ল্যাপটপে কি সব লেখালেখি শুরু করল। কিছুক্ষন পরে আমার দিকে এগিয়ে এসে কানে কানে বলল – মৈনাক স্যর, একটু তাড়াতাড়ি খেলে ভালো হয়, থানাতে যেতে হবে, আশা করি কথাটা মনে আছে... আমি চমকে গিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম, তার মানে, ব্যাপারটা অর্কও জানে, তাহলে মেসেজটা অর্কও পেয়েছে। তার পরেও কোনও ভাবান্তর নেই ওর মনে? ওর কি ভয়ডর বলে কিছু নেই ? এত সহজ ও নিজেকে কি করে রাখতে পারে ? আমার লুচি খাওয়া মাথায় উঠল,
আমি বললাম – অর্ক...কি হবে ভাই? তোকেও কি তাহলে একই এস এম এস করেছে?।
অর্ক এতক্ষন হাসছিল, আমার কথা শুনে বলল – মানে? তোকে এস এম এস করেছে বুঝি, ওহ... বুঝলাম, মৈনাক স্যর ঘুম থেকে ওঠেনি বলে তাকে মেসেজ করে ভয় দেখানো হয়েছে। আচ্ছা, তোর ফোনটা একটু দেখি। আমার ফোনটা নিয়ে অর্ক মেসেজটা নেড়ে চেড়ে দেখে আবার ফেরত দিয়ে বলল – না আমাকে ফোনে বলেছে, একই কথা, তবে একটু ঘুরিয়ে।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, অর্ক বলল – গলার স্বরটা বেশ ভারী, সোজা বাংলায় হুশিয়ারি দিয়ে বলল যে আমরা যেন এই ব্যাপারে আর নাক না গলাই, না হলে, ভালো হবে না। যাই হোক, চল, এখন ওঠা যাক। একটা খারাপ খবর আছে, যেটা তোকে আমি এখনও বলিনি, আমি মুখে কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, খালি বললাম – আবার খারাপ খবর ? অর্ক ঘাড় নেড়ে বলল – হ্যাঁ। কাল রাত্রে, পরাণদা কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, পুলিশের সন্দেহ যে পরাণদাই নাকি মুকুলিকা কে খুন করেছে। আমি আবার তড়াক করে বসে পড়লাম, বললাম - কি বলছিস কি? কারণ?
কারণ মুকুলিকার গলার একটা রক্তমাখা স্কার্ফ নাকি পরাণদার দোকান থেকে উদ্ধার হয়েছে, দোকানের ভিতরে কোনও এক তাক থেকে সেটি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে, পরাণদার বক্তব্য আগে জানা দরকার। তবে এটুকুতো শিওর যে, পরাণদাকে ফাঁসানো হয়েছে, আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, নিশ্চয়ই, এ তাছাড়া আর কিছু না, যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আমাদেরকে এই করা মেসেজের আর ফোনের মানে কি ?
অর্ক মুচকি হেসে বলল – দুটো কারণ হতে পারে, এক, যে বা যারা প্রকৃতপক্ষে এই কাজ করেছে তারা নিজেরাও জানে না খবরটা এখনও, জানলে আর এই কাজটি করতো না অন্তত এখুনি। আর দুই, যদি তারা ঘটনাটা জানে, তাহলে তারা এটাও জানে, যে আমরা পরাণদা কে বাঁচাবার চেষ্টা করবো, তাই আগেই, সাবধানবাণী শুনিয়ে রাখল। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কেন? যাই হোক, তুই মেসেজটা ডিলিট করে দিস না আবার, কাজে লাগবে, আর একটা কথা, চিন্তা করিস না, আমি কলটা রেকর্ড করে রেখেছি, ফোনে, এইমাত্র তা ল্যাপটপে চালান করে দিলাম। এসে একবার এগুলো নিয়ে বসতে হবে। চল এখন থানায় যাই। অনেক কাজ আছে।
আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে থানায় পৌঁছলাম। যথারীতি থানায় ঢুকতেই দেখি ভদ্রদা বসে আছেন ঘর আলো করে। আমাদেরকে দেখে একগাল হেসে বলে উঠলেন, ওরে বাবা, আপনারা ? এ আমি কি দেখছি, এতো সকালে, কি মনে করে?
অর্ক উত্তরে একটু মিষ্টি করে হেসে বলল – কি করবো বলুন, আপনি তো আর আমাদের ওখানে যাবেননা, তাই আপনার একটু খোঁজ নিতে এলাম। ভদ্রদা মুখটা ব্যাজার করে বললেন - আরে আর বলবো কি? যা অবস্থা আমাদের, প্রচুর চাপে আছি ভাই। আমি হেসে বললাম – বলুন না , দেখি চেষ্টা করে যদি আপনার চাপটা হাল্কা করতে পারি।
ভদ্রদা আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলে উঠলেন, থাক, আমার ঘাট হয়েছে মশাই, সেদিনকে আপনাদের কে বলা, আপনারাতো সরাসরি না করে দিলেন, যত বিপদ আমার, এদিকে বড়বাবুর হুকুম, যে করেই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেসটাতে দাঁড়ি টানতে হবে। - আপনি কি মুকুলিকা সিনহা কেসটার কথা বলছেন ? অর্কর প্রশ্ন শুনে, ভদ্রদা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললেন, তবে আর কি এমনি এমনি মরছি, না এই থানা থেকে ট্রান্সফারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিতেই হবে এবারে, যত উদ্ভট সব কেস। অর্ক হেসে বলল – কেন আপনার কাজতো করেই ফেলেছেন, আসামিকে ধরে ফেলেছেন, কিন্তু কিছু কি বলল আসামি, কি কারণে মুকুলিকা কে ও খুন করেছে?
ভদ্রদা মুখটা গম্ভীর করে বললেন, ওহ এই কারণে এত সকাল সকাল থানায় আগমন আপনাদের, তা আমি জানি তো আপনি বলেবন, আমরা ভুল করে পরাণ সাহাকে ধরে এনেছি, ওনাকে এক্ষুনি ছেড়ে দিতে হবে, কারণ আমরা তো ভালো কিছু করি না, শুধু ভুল করি।
আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান, মশাই, আপনি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন তো, আমরা তেমন কিছু কি বলেছি নাকি আপনাকে, একটু জল খেয়ে নিন, বুঝেছি, খুব চাপ আপনার, বলে অর্ক ভদ্রদার টেবিলের উপরে রাখা জলের গ্লাসটা ভদ্রদার দিকে বাড়িয়ে দিল। ভদ্রদা ঢকঢক করে জলটা পেটে চালান করে দিয়ে শান্ত ভাবে চেয়ারে বসে বললেন, যাক গে, বাদ দিন, এবারে বলুন, আপনারা কি ব্যাপারে?
অর্ক খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কি এসেছে? উত্তরে ভদ্রদা হেসে বললেন, না অফিসিয়ালি এখন হাতে পাই নি, কিন্তু আমাদের ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে, মেয়েটিকে, গলায় ওড়না জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তবে আর কোনও ক্ষতি করেনি, গায়ে অন্য কোনও ক্ষত নেই। গলায় কালশিটে একটা দাগ ছিল শুধু। এত জোরে ওকে হত্যা করা হয়েছে যে মেয়েটির কলার বোন ভেঙ্গে গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল, ওর ডান হাতের নখের মাঝে একফালি সুক্ষ ছেঁড়া চুলের অংশ পাওয়া গেছে, যা মুকুলিকার কিনা টা বোঝা যাচ্ছে না এখনই। আমরা পরাণ সাহার চুল পরীক্ষাতে পাঠিয়েছি। আশা করি এরও উত্তর পাওয়া যাবে পরীক্ষার পর।
হুম, অর্ক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আমি অবাক চোখে, অর্কর দিকে তাকাতেই, অর্ক, ভদ্রদাকে বলল – দেখুন আপনারা যা করার করুন, তবে আমাদের বিশ্বাস এই কাজ পরাণদার নয়, কেউ বা কারা ওনাকে ফাঁসিয়েছে। আপনারা মুকুলিকার কোনও ওড়না পেয়েছেন ঘটনাস্থল থেকে? আমি যতদূর জানি, পরাণদার দোকান থেকে তো আপনারা মুকুলিকার গলার একটা স্কার্ফ পেয়েছেন, ওড়না নয়, তবুও, ওটাও ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো প্রয়োজন, আপনি কি স্কার্ফটা পাঠিয়েছেন? আর একটা কথা, ওটা যে মুকুলিকার স্কার্ফ তা কিভাবে নিশ্চিত হলেন?
ভদ্রদা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, সব কাজ করা হয়ে গেছে বুঝেছেন মশাই? শুধু অপেক্ষা করছি রিপোর্টএর জন্য। একবার রিপোর্টটা হাতে পেলেই ব্যাটাকে কোর্টে চালান করতে হবে, আর আমরা ওটা মেয়েটির মা-বাবা কে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ভেরিফাই করিয়ে নিয়েছি।
আমি বললাম, আচ্ছা জিনিশগুলো, কি একবার দেখা যায় ? ভদ্রদা বললেন, এর জন্য কালকে আসতে হবে, কারণ সব ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আজকে রাত্রে বা কাল সকালের মধ্যে পেয়ে যাব আশা করি।
হুম, অর্ক বলল - দেখুন আমার বিশ্বাস পরাণদা এতে জড়িত নয়, কেউ তাকে জড়িয়েছে। তাও আপনার পরীক্ষার উপরে আমাদের নজর থাকবে। আচ্ছা আপনারা কি করে জানতে পারলেন যে পরাণদার দোকানে ওই স্কার্ফটা আছে? ভদ্রদা বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, আরে কেউ একজন, থানার ল্যান্ডলাইনে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়েছিল। আমি এর ঠিক মিনিট দুই আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের এক কন্সটেবল ফোনটা ধরে এবং আমাদের খবরটা দেয়।
ওই কন্সটেবল কি এখন আছে? অর্কর প্রশ্ন। উত্তরে ভদ্রদা চারিদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, এই কে আছিস, যাতো বরুন কে একবার ডাকতো, বল মেজবাবু এক্ষুনি ডাকছে। আর এখানে তিন কাপ চা দিয়ে যা জলদি।
বরুন আসার আগেই চা চলে এলো, অর্ক চা খেতে খেতে ভদ্রদাকে উদ্দেশ্য করে আজকের সকালের ঘটনা বিস্তারিত বলে বলল – দেখুন এই কারণে আমার মনে হচ্ছে, পরাণদা এতে জড়িত নয়, কারণ যদি আততায়ী জানত, পরাণদাকে আপনারা ধরে নিয়েছেন, আমার বিশ্বাস তাহলে আর তার ফোন করার প্রয়োজন ছিল না, সে নিজেকে অন্তরালেই রাখতে পারত। কিন্তু তাও সে যখন আমাদের কে হুমকি ফোন করেছে, তার মানে সে পরাণদার ব্যাপারটা জানে না। আর তাই আমাদের কে সাবধান করে দিয়েছে।
আমি উত্তেজনা চেপে না রাখতে পেরে বলে উঠলাম, তাহলে পরাণদার দোকানে যে প্রমাণ রয়েছে, সেটা কে ফোন করে বলল? সে যদি আততায়ী হয় তাহলে, তার তো জানার কথা।
সব গুলিয়ে আছে রে মৈনাক, সব গুলিয়ে আছে, অর্কর স্তিমিত গলার স্বর। আমিও সেটাই ভাবছি, তাহলে কেউ একা নাকি অনেকে একসাথে, নাকি আবার অনেকে আলাদা আলাদা করে এই ঘটনার পিছনে রয়েছে। যেটাই হোক, তবে পরাণদা যে নেই এই ব্যাপারে পরিষ্কার। আশা করি পরাণদা কেও ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারব কালকে, বলে হেসে উঠে দাঁড়িয়ে অর্ক আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল -চল, অনেক কাজ আছে।
ভদ্রদা মুখটা একটু সামনে এনে নীচুস্বরে বললেন, হ্যাঁ মশাই, দেখুন যদি পারেন, বড়বাবু নেই, তাই আর কালকে চালান করতে পারছি না আদালতে, মঙ্গলবারের মধ্যে চালান করতে হবে আমাদের। ঠিক আছে বলে আমরা বেরোতে যাব, পিছন থেকে ভদ্রদা জিজ্ঞাসা করে উঠলেন, কিন্তু আপনারা কার হয়ে এই তদন্ত করছেন সেটা তো বলবেন ...
অর্ক পিছনে ঘুরে বলে উঠল – হুম... মুকুলিকা সিনহা, পরাণ সাহা আর মিঃ ভদ্র তিনজনের তরফ... অর্ককে পুরো কথা শেষ না করতে দিয়েই সাথে সাথে আমি ফুট কাটার সুযোগটা হাতছারা না করে বলে উঠলাম – তবে এটা বলতে পারব না, যে এদের একার হয়ে, নাকি আলাদা আলাদা করে সবার হয়ে নাকি সবার জন্য একসাথে... কারণ তা আমাদের কাছেও পরিষ্কার নয়। পরিষ্কার দেখতে পারলাম, ভদ্রদার মুখটা হাঁ হয়ে গেছে, চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেছে, কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই অর্ক হাত দেখিয়ে বলে উঠল, কালকে কথা হবে, চিন্তা করবেন না। এই বলে আমরা থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
(চলবে )
আমি আর কি করব, বিছানা ছেড়ে উঠে পরলাম, ফ্রেশ হয়ে, মুখ, হাত পা ধুয়ে চা খেয়ে, বেরোতে বেরোতে সাতটা হয়ে গেল, বাইরে বেরিয়ে আবিষ্কার করলাম প্রকৃতির সে কি অপরূপ মনোরোম দৃশ্য। সোনা ঝরা রোদ এসে পড়েছে আমাদের কমপ্লেক্সের মাঠের ঘাসে, বৃষ্টির নামগন্ধ নেই এখন, কিন্তু জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। গুটিকয়েক বাচ্চা ফুটবল খেলছিল, চারিদিকে, পরিষ্কার নির্মল পরিবেশ, দূরে কতোগুলো শালিখ নিজেদের মধ্যে কলতান করছিল, ওফ, অসাধারন, আমি যদিও অফিসে যাবার সময়ে সকাল ০৯টার সময়ে বেরই, তাও কখনো খেয়াল করি নি, যদিও, বাবা বলছিল, সাড়ে সাতটাও নাকি অনেক বেশি, প্রকৃতির আসল রূপ দেখতে গেলে, ভোর বেলা সূর্য ওঠার সময়ে উঠতে হবে। এই সব দেখতে দেখতে কখন যে মনটা ভালো হয়ে গেল জানি না, মাঠের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে পাশ কাটিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে অর্কদের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। মন পড়েছিল কড়াইশুঁটির কচুরির দিকে।
কচুরি খেতে খেতে অর্ক প্রশ্ন করল, কি রে খুব ভয় পেয়েছিলিস বুঝি? আমি আড় চোখে অর্কর দিকে একবার তাকিয়েই আবার কচুরিতে মনোনিবেশ করলাম। অর্ক হেসে ল্যাপটপে কি সব লেখালেখি শুরু করল। কিছুক্ষন পরে আমার দিকে এগিয়ে এসে কানে কানে বলল – মৈনাক স্যর, একটু তাড়াতাড়ি খেলে ভালো হয়, থানাতে যেতে হবে, আশা করি কথাটা মনে আছে... আমি চমকে গিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম, তার মানে, ব্যাপারটা অর্কও জানে, তাহলে মেসেজটা অর্কও পেয়েছে। তার পরেও কোনও ভাবান্তর নেই ওর মনে? ওর কি ভয়ডর বলে কিছু নেই ? এত সহজ ও নিজেকে কি করে রাখতে পারে ? আমার লুচি খাওয়া মাথায় উঠল,
আমি বললাম – অর্ক...কি হবে ভাই? তোকেও কি তাহলে একই এস এম এস করেছে?।
অর্ক এতক্ষন হাসছিল, আমার কথা শুনে বলল – মানে? তোকে এস এম এস করেছে বুঝি, ওহ... বুঝলাম, মৈনাক স্যর ঘুম থেকে ওঠেনি বলে তাকে মেসেজ করে ভয় দেখানো হয়েছে। আচ্ছা, তোর ফোনটা একটু দেখি। আমার ফোনটা নিয়ে অর্ক মেসেজটা নেড়ে চেড়ে দেখে আবার ফেরত দিয়ে বলল – না আমাকে ফোনে বলেছে, একই কথা, তবে একটু ঘুরিয়ে।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, অর্ক বলল – গলার স্বরটা বেশ ভারী, সোজা বাংলায় হুশিয়ারি দিয়ে বলল যে আমরা যেন এই ব্যাপারে আর নাক না গলাই, না হলে, ভালো হবে না। যাই হোক, চল, এখন ওঠা যাক। একটা খারাপ খবর আছে, যেটা তোকে আমি এখনও বলিনি, আমি মুখে কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, খালি বললাম – আবার খারাপ খবর ? অর্ক ঘাড় নেড়ে বলল – হ্যাঁ। কাল রাত্রে, পরাণদা কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, পুলিশের সন্দেহ যে পরাণদাই নাকি মুকুলিকা কে খুন করেছে। আমি আবার তড়াক করে বসে পড়লাম, বললাম - কি বলছিস কি? কারণ?
কারণ মুকুলিকার গলার একটা রক্তমাখা স্কার্ফ নাকি পরাণদার দোকান থেকে উদ্ধার হয়েছে, দোকানের ভিতরে কোনও এক তাক থেকে সেটি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে, পরাণদার বক্তব্য আগে জানা দরকার। তবে এটুকুতো শিওর যে, পরাণদাকে ফাঁসানো হয়েছে, আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, নিশ্চয়ই, এ তাছাড়া আর কিছু না, যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আমাদেরকে এই করা মেসেজের আর ফোনের মানে কি ?
অর্ক মুচকি হেসে বলল – দুটো কারণ হতে পারে, এক, যে বা যারা প্রকৃতপক্ষে এই কাজ করেছে তারা নিজেরাও জানে না খবরটা এখনও, জানলে আর এই কাজটি করতো না অন্তত এখুনি। আর দুই, যদি তারা ঘটনাটা জানে, তাহলে তারা এটাও জানে, যে আমরা পরাণদা কে বাঁচাবার চেষ্টা করবো, তাই আগেই, সাবধানবাণী শুনিয়ে রাখল। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কেন? যাই হোক, তুই মেসেজটা ডিলিট করে দিস না আবার, কাজে লাগবে, আর একটা কথা, চিন্তা করিস না, আমি কলটা রেকর্ড করে রেখেছি, ফোনে, এইমাত্র তা ল্যাপটপে চালান করে দিলাম। এসে একবার এগুলো নিয়ে বসতে হবে। চল এখন থানায় যাই। অনেক কাজ আছে।
আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে থানায় পৌঁছলাম। যথারীতি থানায় ঢুকতেই দেখি ভদ্রদা বসে আছেন ঘর আলো করে। আমাদেরকে দেখে একগাল হেসে বলে উঠলেন, ওরে বাবা, আপনারা ? এ আমি কি দেখছি, এতো সকালে, কি মনে করে?
অর্ক উত্তরে একটু মিষ্টি করে হেসে বলল – কি করবো বলুন, আপনি তো আর আমাদের ওখানে যাবেননা, তাই আপনার একটু খোঁজ নিতে এলাম। ভদ্রদা মুখটা ব্যাজার করে বললেন - আরে আর বলবো কি? যা অবস্থা আমাদের, প্রচুর চাপে আছি ভাই। আমি হেসে বললাম – বলুন না , দেখি চেষ্টা করে যদি আপনার চাপটা হাল্কা করতে পারি।
ভদ্রদা আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলে উঠলেন, থাক, আমার ঘাট হয়েছে মশাই, সেদিনকে আপনাদের কে বলা, আপনারাতো সরাসরি না করে দিলেন, যত বিপদ আমার, এদিকে বড়বাবুর হুকুম, যে করেই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেসটাতে দাঁড়ি টানতে হবে। - আপনি কি মুকুলিকা সিনহা কেসটার কথা বলছেন ? অর্কর প্রশ্ন শুনে, ভদ্রদা একটা শুষ্ক হাসি হেসে বললেন, তবে আর কি এমনি এমনি মরছি, না এই থানা থেকে ট্রান্সফারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিতেই হবে এবারে, যত উদ্ভট সব কেস। অর্ক হেসে বলল – কেন আপনার কাজতো করেই ফেলেছেন, আসামিকে ধরে ফেলেছেন, কিন্তু কিছু কি বলল আসামি, কি কারণে মুকুলিকা কে ও খুন করেছে?
ভদ্রদা মুখটা গম্ভীর করে বললেন, ওহ এই কারণে এত সকাল সকাল থানায় আগমন আপনাদের, তা আমি জানি তো আপনি বলেবন, আমরা ভুল করে পরাণ সাহাকে ধরে এনেছি, ওনাকে এক্ষুনি ছেড়ে দিতে হবে, কারণ আমরা তো ভালো কিছু করি না, শুধু ভুল করি।
আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান, মশাই, আপনি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন তো, আমরা তেমন কিছু কি বলেছি নাকি আপনাকে, একটু জল খেয়ে নিন, বুঝেছি, খুব চাপ আপনার, বলে অর্ক ভদ্রদার টেবিলের উপরে রাখা জলের গ্লাসটা ভদ্রদার দিকে বাড়িয়ে দিল। ভদ্রদা ঢকঢক করে জলটা পেটে চালান করে দিয়ে শান্ত ভাবে চেয়ারে বসে বললেন, যাক গে, বাদ দিন, এবারে বলুন, আপনারা কি ব্যাপারে?
অর্ক খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কি এসেছে? উত্তরে ভদ্রদা হেসে বললেন, না অফিসিয়ালি এখন হাতে পাই নি, কিন্তু আমাদের ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে, মেয়েটিকে, গলায় ওড়না জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তবে আর কোনও ক্ষতি করেনি, গায়ে অন্য কোনও ক্ষত নেই। গলায় কালশিটে একটা দাগ ছিল শুধু। এত জোরে ওকে হত্যা করা হয়েছে যে মেয়েটির কলার বোন ভেঙ্গে গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল, ওর ডান হাতের নখের মাঝে একফালি সুক্ষ ছেঁড়া চুলের অংশ পাওয়া গেছে, যা মুকুলিকার কিনা টা বোঝা যাচ্ছে না এখনই। আমরা পরাণ সাহার চুল পরীক্ষাতে পাঠিয়েছি। আশা করি এরও উত্তর পাওয়া যাবে পরীক্ষার পর।
হুম, অর্ক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আমি অবাক চোখে, অর্কর দিকে তাকাতেই, অর্ক, ভদ্রদাকে বলল – দেখুন আপনারা যা করার করুন, তবে আমাদের বিশ্বাস এই কাজ পরাণদার নয়, কেউ বা কারা ওনাকে ফাঁসিয়েছে। আপনারা মুকুলিকার কোনও ওড়না পেয়েছেন ঘটনাস্থল থেকে? আমি যতদূর জানি, পরাণদার দোকান থেকে তো আপনারা মুকুলিকার গলার একটা স্কার্ফ পেয়েছেন, ওড়না নয়, তবুও, ওটাও ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো প্রয়োজন, আপনি কি স্কার্ফটা পাঠিয়েছেন? আর একটা কথা, ওটা যে মুকুলিকার স্কার্ফ তা কিভাবে নিশ্চিত হলেন?
ভদ্রদা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, সব কাজ করা হয়ে গেছে বুঝেছেন মশাই? শুধু অপেক্ষা করছি রিপোর্টএর জন্য। একবার রিপোর্টটা হাতে পেলেই ব্যাটাকে কোর্টে চালান করতে হবে, আর আমরা ওটা মেয়েটির মা-বাবা কে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ভেরিফাই করিয়ে নিয়েছি।
আমি বললাম, আচ্ছা জিনিশগুলো, কি একবার দেখা যায় ? ভদ্রদা বললেন, এর জন্য কালকে আসতে হবে, কারণ সব ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আজকে রাত্রে বা কাল সকালের মধ্যে পেয়ে যাব আশা করি।
হুম, অর্ক বলল - দেখুন আমার বিশ্বাস পরাণদা এতে জড়িত নয়, কেউ তাকে জড়িয়েছে। তাও আপনার পরীক্ষার উপরে আমাদের নজর থাকবে। আচ্ছা আপনারা কি করে জানতে পারলেন যে পরাণদার দোকানে ওই স্কার্ফটা আছে? ভদ্রদা বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, আরে কেউ একজন, থানার ল্যান্ডলাইনে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়েছিল। আমি এর ঠিক মিনিট দুই আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের এক কন্সটেবল ফোনটা ধরে এবং আমাদের খবরটা দেয়।
ওই কন্সটেবল কি এখন আছে? অর্কর প্রশ্ন। উত্তরে ভদ্রদা চারিদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, এই কে আছিস, যাতো বরুন কে একবার ডাকতো, বল মেজবাবু এক্ষুনি ডাকছে। আর এখানে তিন কাপ চা দিয়ে যা জলদি।
বরুন আসার আগেই চা চলে এলো, অর্ক চা খেতে খেতে ভদ্রদাকে উদ্দেশ্য করে আজকের সকালের ঘটনা বিস্তারিত বলে বলল – দেখুন এই কারণে আমার মনে হচ্ছে, পরাণদা এতে জড়িত নয়, কারণ যদি আততায়ী জানত, পরাণদাকে আপনারা ধরে নিয়েছেন, আমার বিশ্বাস তাহলে আর তার ফোন করার প্রয়োজন ছিল না, সে নিজেকে অন্তরালেই রাখতে পারত। কিন্তু তাও সে যখন আমাদের কে হুমকি ফোন করেছে, তার মানে সে পরাণদার ব্যাপারটা জানে না। আর তাই আমাদের কে সাবধান করে দিয়েছে।
আমি উত্তেজনা চেপে না রাখতে পেরে বলে উঠলাম, তাহলে পরাণদার দোকানে যে প্রমাণ রয়েছে, সেটা কে ফোন করে বলল? সে যদি আততায়ী হয় তাহলে, তার তো জানার কথা।
সব গুলিয়ে আছে রে মৈনাক, সব গুলিয়ে আছে, অর্কর স্তিমিত গলার স্বর। আমিও সেটাই ভাবছি, তাহলে কেউ একা নাকি অনেকে একসাথে, নাকি আবার অনেকে আলাদা আলাদা করে এই ঘটনার পিছনে রয়েছে। যেটাই হোক, তবে পরাণদা যে নেই এই ব্যাপারে পরিষ্কার। আশা করি পরাণদা কেও ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারব কালকে, বলে হেসে উঠে দাঁড়িয়ে অর্ক আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল -চল, অনেক কাজ আছে।
ভদ্রদা মুখটা একটু সামনে এনে নীচুস্বরে বললেন, হ্যাঁ মশাই, দেখুন যদি পারেন, বড়বাবু নেই, তাই আর কালকে চালান করতে পারছি না আদালতে, মঙ্গলবারের মধ্যে চালান করতে হবে আমাদের। ঠিক আছে বলে আমরা বেরোতে যাব, পিছন থেকে ভদ্রদা জিজ্ঞাসা করে উঠলেন, কিন্তু আপনারা কার হয়ে এই তদন্ত করছেন সেটা তো বলবেন ...
অর্ক পিছনে ঘুরে বলে উঠল – হুম... মুকুলিকা সিনহা, পরাণ সাহা আর মিঃ ভদ্র তিনজনের তরফ... অর্ককে পুরো কথা শেষ না করতে দিয়েই সাথে সাথে আমি ফুট কাটার সুযোগটা হাতছারা না করে বলে উঠলাম – তবে এটা বলতে পারব না, যে এদের একার হয়ে, নাকি আলাদা আলাদা করে সবার হয়ে নাকি সবার জন্য একসাথে... কারণ তা আমাদের কাছেও পরিষ্কার নয়। পরিষ্কার দেখতে পারলাম, ভদ্রদার মুখটা হাঁ হয়ে গেছে, চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেছে, কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই অর্ক হাত দেখিয়ে বলে উঠল, কালকে কথা হবে, চিন্তা করবেন না। এই বলে আমরা থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
(চলবে )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মৃণ্ময় আলম ২১/১০/২০১৫অপেক্ষায় আছি। পরবর্তী সংখ্যার। চমৎকার
-
দেবব্রত সান্যাল ০৫/১০/২০১৫কলার বোন্ ভাঙ্গলো কেন ? রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে , পরেরটা কবে ?
-
দেবর্ষি সিংহ ০৩/১০/২০১৫Porer angso r apekkhay roilam