চোরকাঁটা - ৭ম পর্ব
( আগের সংখ্যার পর )
এখন আমি আর অর্ক দুজনে টেবিলের দু দিকে মুখোমুখি বসে আছি, মুকুলিকার বাবা মা অনেকক্ষণ হল চলে গেছেন, ঘড়িতে প্রায় নটা বাজে। চেম্বারে একটা অদ্ভুত নীরবতার পরিবেশ, কেউ কোনও কথা বলছি না, ওনাদের যাবার পর থেকে। অর্ক নোট বইএ কি যেন সব কাটাকুটি করছে। হঠাৎ অর্ক আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল – কি মানিক চাঁদ? কি ভাবছ? কিছু বুঝতে পারলে? আমার অবস্থা তথৈবচ, আমি আর কি বলব, শুধু বললাম, সবই তো মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুই তো কানেক্ট করতে পারছি না, তমালিকা দেবীদের অতীত একটা বড় ফ্যাক্টর হতে পারে, কিন্তু তা এই কেসে কি ভাবে রিলেট হবে, কিভাবে...কিভাবে... বা আদৌ কোনও রিলেশন আছে কিনা, বুঝতে পারছি না বস। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তোর কি কিছু মনে হচ্ছে ?
অর্ক ঠোঁটের ডগায় হাল্কা একটা হাসি চেলে বলল - মাথাটা সব থেকে আগে ঠাণ্ডা করতে হবে, বুঝলি, আমিও এখনও পর্যন্ত কোনও আলো দেখতে পাচ্ছি না বটে, তবে, এটুকু বেশ বুঝতে পারছি যে আমাদের চোখ কান সব আরও বেশী করে খোলা রাখতে হবে, বুঝলি? যাই হোক চল, চট করে, একটা পুরো ঘটনাটার একটা রিক্যাপ করে নি ...
আমি বললাম – বল, শুনি, শুনেই অর্ক বলল, আজ্ঞে না, তুমি বলবে, আর আমি নোট করব, যদি কিছু মনে হয়, আমি সেখানে যোগ করে নেব। অগত্যা আর কি, কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, শুরু করলাম বেশ কাব্যিক ভাবে,
মিঃ আনিমেশ সিনহা তার পরিবার তমালিকা দেবী ও একমাত্র মেয়ে এগারো বছরের মুকুলিকাকে নিয়ে আমদের এই ওল্ড বালীগঞ্ঝ রোডের পাড়াতে মাত্র গত দশদিন আগে শিফট করেছেন সেই টালিগঞ্জ নেতাজীনগর থেকে, বলে অর্কর দিকে তাকালাম আর তাতেই ধাক্কাটা পেলাম, অর্ক গম্ভীর হয়ে বলল – দশ দিন নয়, ওনারা এ পাড়াতে এসেছেন, সবে সাতদিন হয়েছে, দশদিন আগে বাড়ি ভাড়া খোঁজ করতে এসেছিলেন। কি যে শুনিস না তুই...নে এবারে ঠিক করে বল।
শুরুতেই গোঁত্তাটা খেয়ে কাব্যিক ভাব উড়ে গেল, তাও আবার শুরু করলাম, তো গত বৃহস্পতিবার ওনাদের একমাত্র মেয়ে মুকুলিকা পাড়ার দোকানে বিকেলে ফুচকা খেতে গিয়েছিলো একা, কিন্তু সেখান থেকেই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। লোকমতে, তাকে নাকি কোনও এক অচেনা ছেলের সাথে দেখা গিয়েছিলো শেষ বারের মত। আজ শনিবার, পুলিশ পাড়ার এক পচা ডোবার পাশ থেকে মুকুলিকার ডেডবডি উদ্ধার করে। লাশ সনাক্তকরন হয়ে গেছে, কিন্তু ময়নাতঅদন্তের রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায় নি, প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান মেয়েটিকে শ্বাস রোধ করে মারা হয়েছে, দেহে আর কোনও ক্ষতচিহ্নের দাগ দেখতে পাওয়া যায় নি।, তবে আত্মহত্যাও হতে পারে, যা কিন্তু কেউ বলছে না, স্বাভাবিকভাবেই, মুকুলিকার মা-বাবা খুব ভেঙ্গে পড়েছেন এই গোটা ঘটনাতে, কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তাদের। এই অচেনা পাড়াতে, আকস্মিক এই বিপদের মোকাবিলা কি করে করবেন বুঝতে না পেরে আমাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছেন। এবারে যদি আমরা পিছনের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে অবিনাশ বাবু ও তমালিকা দেবীর অতীত এই কেসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকলেও থাকতে পারে।
হুম, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে অর্ক বলল – দেখ, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে আমার মনে হয়, কেসটাতে সেরকম কিছু নেই, আমাদের কাজ হল প্রথমে, ওই ছেলেটাকে আইডেনটিফাই করা, একবার ছেলেটাকে ধরতে পারলে, আমাদের কাজটার অনেক সুবিধা হয়ে যাবে। তবে আমার মনে হয় পুলিশও তাই ভাবছে। একবার ভদ্রদার সাথেও কথা বলতে হবে। অর্ক কথাগুলো বলে নিজের মনেই কি যেন বিড়বিড় করতে লাগলো।
আমি বললাম, অর্ক একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস, ভদ্রমহিলা বা অবিনাশবাবু কেউ কিন্তু ছেলেটার কথা বিশ্বাস করতে চাইছেন না।
সেটা খুব স্বাভাবিক, অর্ক আমায় চুপ করিয়ে দিয়ে বলল - প্রথমত, কোনও বাবা-মা তাদের সন্তানের এই ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ত্ব দিতে চান না, আর এ ক্ষেত্রে মুকুলিকা খুবই ছোট, অতএব, বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না, কারণ একটা এগারো বছরের মেয়ে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে, এটা সত্যি অবিস্বাস্য একটা ব্যাপার। দ্বিয়ীয়ত, মুকুলিকা সম্পর্কে যা শুনলাম ওর বাবা-মার কাছ থেকে, তাতে মনে হয়, মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল, সে একটা অচেনা ছেলের সাথে চলে যাবে এটা বিশ্বাস হয় না, হ্যাঁ, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলেটি কি ওর পরিচিত ছিল আগে থেকে? যদি থাকে, তাহলে আলাদা কথা, তবে তাও, এরকম একটা ভালো মেয়ে যে বাবা-মার কষ্ট বোঝে, সে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যাবে, এটাও মন ঠিক নিতে পারছে না। তৃতীয়ত, যা শুনলাম, তাতে কিছু খটকা আমার মনে লেগেছে, যা আমাদের কে অতি তাড়াতাড়ি দূর করতে হবে।
আমি মনে মনে একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম, বললাম কি ধরনের খটকা?
একনম্বর হল টাইমিং বা সময়...দুনম্বর হল, কিছু কমিউনিকেশন গ্যাপ। সেটা কি স্বাভাবিক নাকি অন্য কিছু। আগে কিছু জিনিস কনফার্ম করতে হবে। কেন জানি না, আমার মন বলছে, যা আমরা ভাবছি ব্যাপারটা হয়তো তা নয়, এখনো অনেক কিছু বাকী আছে, এটা মোটেই সহজ কেস নয়। দেখা যাক, কি হয় ?
যথারীতি, এসব আমার মাথার উপর দিয়ে গেল, আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, কারণ অর্ক চটজলদি উঠেই বলল, চল চেম্বার বন্ধ করে বাড়ি যাই, আমি একটু বাজার হয়ে যাব, এখন সাড়ে নটা বাজে, আশা করি পেয়ে যাব, তুই বাড়ি চলে যা, কাল সকাল দশটার সময়ে বাড়িতে চলে আসিস, ওখান থেকেই আমরা একটু থানাতে চলে যাব। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, সেগুলোও করে নিতে হবে, সময় বেশি নেওয়া যাবে না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমরা চেম্বার বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারলাম, কি জবরদস্ত ঠাণ্ডায় কাঁপছে আমাদের এই শহর। বৃষ্টিটা এখন কমেছে একটু, বাইরে অসম্ভব কুয়াশা, পাঁচ হাত দুরের জিনিসও ঠাওর করা যাচ্ছে না, আমরা দুজনেই মাফলার দিয়ে নাক কান ঢেকে, মুখ গুঁজে রাস্তায় বেরিয়ে পরলাম, গলির শেষে, আমি আমার বাড়ির রাস্তা ধরলাম, আর অর্ক বাজারের দিকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশায়।
রাত্রে বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পরলাম, রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিটাও আবার বেড়েছে। কেন জানি না মনটা ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল, শুধু অবিনাশ বাবুদের কথা, কত কষ্ট সহ্য করেছেন এই জীবনে, তাও কেন ভগবান এই ধরনের মানুষদের সাথেই এই সব হতে দেন, এটা কি শুধুই অকস্মাৎ বিপদ, নাকি, কোনও পুরনো পাপের ফল? কিন্তু নিষ্পাপ মেয়েটির তো কোনও দোষ ছিল না। তাকে কেন এই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হল। তবে অর্কর মতো আমারও মন বলছে এর পিছনে এক গভীর রহস্য আছে, যা আমাদের চোখে পরছে না এই যা...এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়লাম বুঝতেই পারলাম না।
সকাল তখন ছটা হবে, হঠাৎ কানের কাছে রাখা মোবাইলটা জোরে জোরে বেজে উঠে রোববারের ঘুমের দফা-রফা করে ছাড়ল। ঘুম জরানো চোখে, বালিশের নীচ থেকে মোবাইলটা বার করে দেখি তিনটে মিসড কল কোনও এক প্রাইভেট নম্বর থেকে, ফোন নম্বরটা দেখাচ্ছে না। প্রচণ্ড রাগে হাত দুটো নিশপিশ করে উঠল, সামনে পেলে ব্যাটাকে দেখে নিতুম একবার। ঘুরিয়ে যে ফোন করব, তারও উপায় নেই, কারণ ওই নম্বরে ফোন করা যাবে না, লাইন ডিসকানেকটেড হয়ে যাবে।
কি করব, কি করব ভাবছি, তখনই একটা মেসেজ ঢুকল ফোনে। সেই প্রাইভেট নম্বর । মেসেজটা অন করার সাথে সাথেই আমার ঘুমতো কেটে গেলই, সাথে একটা ঠাণ্ডা আতঙ্কের অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেম গেল। একটা সহজ সরল এস এম এস, কিন্তু তার ব্যাপ্তি বিশাল, লেখা ছিল –
“স্যর, ঘুমোচ্ছেন বুঝি? ভালো, ছুটির দিনে ঘুমানো ভালো, আরও ভালো, অন্যের কাজে নাক না গলিয়ে, নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে তো নাকি... নাক কেটে গেলে তখন কি হবে? আর নাকের সাথে যদি মাথাটাও......না না , স্যর অপরাধ নেবেন না, উপদেশ ভাবতে পারেন ... আশা করি কথাটা মনে থাকবে।”
ভয়ে সাথে সাথে মোবাইলটাই সুইচড অফ করে দিলাম চটজলদি ! কি করব, অর্ককে ফোন করে জানাব, কিন্তু কে এই মেসেজটা পাঠাল। কি কারনেই বা ? এটা কি এই কেসের সাথে যুক্ত? যদি তাই হয়, তাহলে, মুকুলিকার মৃত্যু রহস্যজট যে সহজে কাটবে না, তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা আবার অন করলাম, আর সাথে সাথেই অর্কর ফোন।... কি ব্যাপার... অর্ক তো এত সকালে কখনো ফোন করে না, তবে কি সেও ওই মেসেজটা পেয়েছে? যাই হোক, ফোনটা রিসিভ করতেই, অর্কর গলা পেলাম – বাবা মানিক চাঁদ ঘুম থেকে উঠেছিস? আমি ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলাম – হ্যাঁ, কিন্তু এত সকালে, তোর ফোন কি ব্যাপার বলত ?
অর্ক হেসে বলে উঠল, ঠিক ভেবেছি, নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছিস, তাই একবার ঝালিয়ে নিলাম, যাই হোক, ওই ফোন কলটার ব্যাপারে কারওর সাথে কিছু ডিসকাস করিস না এখন। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয় বাড়িতে, মা মটরশুঁটির কচুরি আর আলুর দম করছে টিফিনে, আর তারপর একবার থানাতেও যেতে হবে, বাকি কথা পরে বলব, তারপর আমাকে কোনও কিছু বলতে না দিয়ে, ফোনটা কেটে দিল।
(চলবে )
এখন আমি আর অর্ক দুজনে টেবিলের দু দিকে মুখোমুখি বসে আছি, মুকুলিকার বাবা মা অনেকক্ষণ হল চলে গেছেন, ঘড়িতে প্রায় নটা বাজে। চেম্বারে একটা অদ্ভুত নীরবতার পরিবেশ, কেউ কোনও কথা বলছি না, ওনাদের যাবার পর থেকে। অর্ক নোট বইএ কি যেন সব কাটাকুটি করছে। হঠাৎ অর্ক আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল – কি মানিক চাঁদ? কি ভাবছ? কিছু বুঝতে পারলে? আমার অবস্থা তথৈবচ, আমি আর কি বলব, শুধু বললাম, সবই তো মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুই তো কানেক্ট করতে পারছি না, তমালিকা দেবীদের অতীত একটা বড় ফ্যাক্টর হতে পারে, কিন্তু তা এই কেসে কি ভাবে রিলেট হবে, কিভাবে...কিভাবে... বা আদৌ কোনও রিলেশন আছে কিনা, বুঝতে পারছি না বস। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তোর কি কিছু মনে হচ্ছে ?
অর্ক ঠোঁটের ডগায় হাল্কা একটা হাসি চেলে বলল - মাথাটা সব থেকে আগে ঠাণ্ডা করতে হবে, বুঝলি, আমিও এখনও পর্যন্ত কোনও আলো দেখতে পাচ্ছি না বটে, তবে, এটুকু বেশ বুঝতে পারছি যে আমাদের চোখ কান সব আরও বেশী করে খোলা রাখতে হবে, বুঝলি? যাই হোক চল, চট করে, একটা পুরো ঘটনাটার একটা রিক্যাপ করে নি ...
আমি বললাম – বল, শুনি, শুনেই অর্ক বলল, আজ্ঞে না, তুমি বলবে, আর আমি নোট করব, যদি কিছু মনে হয়, আমি সেখানে যোগ করে নেব। অগত্যা আর কি, কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, শুরু করলাম বেশ কাব্যিক ভাবে,
মিঃ আনিমেশ সিনহা তার পরিবার তমালিকা দেবী ও একমাত্র মেয়ে এগারো বছরের মুকুলিকাকে নিয়ে আমদের এই ওল্ড বালীগঞ্ঝ রোডের পাড়াতে মাত্র গত দশদিন আগে শিফট করেছেন সেই টালিগঞ্জ নেতাজীনগর থেকে, বলে অর্কর দিকে তাকালাম আর তাতেই ধাক্কাটা পেলাম, অর্ক গম্ভীর হয়ে বলল – দশ দিন নয়, ওনারা এ পাড়াতে এসেছেন, সবে সাতদিন হয়েছে, দশদিন আগে বাড়ি ভাড়া খোঁজ করতে এসেছিলেন। কি যে শুনিস না তুই...নে এবারে ঠিক করে বল।
শুরুতেই গোঁত্তাটা খেয়ে কাব্যিক ভাব উড়ে গেল, তাও আবার শুরু করলাম, তো গত বৃহস্পতিবার ওনাদের একমাত্র মেয়ে মুকুলিকা পাড়ার দোকানে বিকেলে ফুচকা খেতে গিয়েছিলো একা, কিন্তু সেখান থেকেই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। লোকমতে, তাকে নাকি কোনও এক অচেনা ছেলের সাথে দেখা গিয়েছিলো শেষ বারের মত। আজ শনিবার, পুলিশ পাড়ার এক পচা ডোবার পাশ থেকে মুকুলিকার ডেডবডি উদ্ধার করে। লাশ সনাক্তকরন হয়ে গেছে, কিন্তু ময়নাতঅদন্তের রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায় নি, প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান মেয়েটিকে শ্বাস রোধ করে মারা হয়েছে, দেহে আর কোনও ক্ষতচিহ্নের দাগ দেখতে পাওয়া যায় নি।, তবে আত্মহত্যাও হতে পারে, যা কিন্তু কেউ বলছে না, স্বাভাবিকভাবেই, মুকুলিকার মা-বাবা খুব ভেঙ্গে পড়েছেন এই গোটা ঘটনাতে, কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তাদের। এই অচেনা পাড়াতে, আকস্মিক এই বিপদের মোকাবিলা কি করে করবেন বুঝতে না পেরে আমাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছেন। এবারে যদি আমরা পিছনের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে অবিনাশ বাবু ও তমালিকা দেবীর অতীত এই কেসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকলেও থাকতে পারে।
হুম, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে অর্ক বলল – দেখ, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে আমার মনে হয়, কেসটাতে সেরকম কিছু নেই, আমাদের কাজ হল প্রথমে, ওই ছেলেটাকে আইডেনটিফাই করা, একবার ছেলেটাকে ধরতে পারলে, আমাদের কাজটার অনেক সুবিধা হয়ে যাবে। তবে আমার মনে হয় পুলিশও তাই ভাবছে। একবার ভদ্রদার সাথেও কথা বলতে হবে। অর্ক কথাগুলো বলে নিজের মনেই কি যেন বিড়বিড় করতে লাগলো।
আমি বললাম, অর্ক একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস, ভদ্রমহিলা বা অবিনাশবাবু কেউ কিন্তু ছেলেটার কথা বিশ্বাস করতে চাইছেন না।
সেটা খুব স্বাভাবিক, অর্ক আমায় চুপ করিয়ে দিয়ে বলল - প্রথমত, কোনও বাবা-মা তাদের সন্তানের এই ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ত্ব দিতে চান না, আর এ ক্ষেত্রে মুকুলিকা খুবই ছোট, অতএব, বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না, কারণ একটা এগারো বছরের মেয়ে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে, এটা সত্যি অবিস্বাস্য একটা ব্যাপার। দ্বিয়ীয়ত, মুকুলিকা সম্পর্কে যা শুনলাম ওর বাবা-মার কাছ থেকে, তাতে মনে হয়, মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল, সে একটা অচেনা ছেলের সাথে চলে যাবে এটা বিশ্বাস হয় না, হ্যাঁ, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলেটি কি ওর পরিচিত ছিল আগে থেকে? যদি থাকে, তাহলে আলাদা কথা, তবে তাও, এরকম একটা ভালো মেয়ে যে বাবা-মার কষ্ট বোঝে, সে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যাবে, এটাও মন ঠিক নিতে পারছে না। তৃতীয়ত, যা শুনলাম, তাতে কিছু খটকা আমার মনে লেগেছে, যা আমাদের কে অতি তাড়াতাড়ি দূর করতে হবে।
আমি মনে মনে একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম, বললাম কি ধরনের খটকা?
একনম্বর হল টাইমিং বা সময়...দুনম্বর হল, কিছু কমিউনিকেশন গ্যাপ। সেটা কি স্বাভাবিক নাকি অন্য কিছু। আগে কিছু জিনিস কনফার্ম করতে হবে। কেন জানি না, আমার মন বলছে, যা আমরা ভাবছি ব্যাপারটা হয়তো তা নয়, এখনো অনেক কিছু বাকী আছে, এটা মোটেই সহজ কেস নয়। দেখা যাক, কি হয় ?
যথারীতি, এসব আমার মাথার উপর দিয়ে গেল, আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, কারণ অর্ক চটজলদি উঠেই বলল, চল চেম্বার বন্ধ করে বাড়ি যাই, আমি একটু বাজার হয়ে যাব, এখন সাড়ে নটা বাজে, আশা করি পেয়ে যাব, তুই বাড়ি চলে যা, কাল সকাল দশটার সময়ে বাড়িতে চলে আসিস, ওখান থেকেই আমরা একটু থানাতে চলে যাব। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, সেগুলোও করে নিতে হবে, সময় বেশি নেওয়া যাবে না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমরা চেম্বার বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারলাম, কি জবরদস্ত ঠাণ্ডায় কাঁপছে আমাদের এই শহর। বৃষ্টিটা এখন কমেছে একটু, বাইরে অসম্ভব কুয়াশা, পাঁচ হাত দুরের জিনিসও ঠাওর করা যাচ্ছে না, আমরা দুজনেই মাফলার দিয়ে নাক কান ঢেকে, মুখ গুঁজে রাস্তায় বেরিয়ে পরলাম, গলির শেষে, আমি আমার বাড়ির রাস্তা ধরলাম, আর অর্ক বাজারের দিকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশায়।
রাত্রে বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পরলাম, রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিটাও আবার বেড়েছে। কেন জানি না মনটা ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল, শুধু অবিনাশ বাবুদের কথা, কত কষ্ট সহ্য করেছেন এই জীবনে, তাও কেন ভগবান এই ধরনের মানুষদের সাথেই এই সব হতে দেন, এটা কি শুধুই অকস্মাৎ বিপদ, নাকি, কোনও পুরনো পাপের ফল? কিন্তু নিষ্পাপ মেয়েটির তো কোনও দোষ ছিল না। তাকে কেন এই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হল। তবে অর্কর মতো আমারও মন বলছে এর পিছনে এক গভীর রহস্য আছে, যা আমাদের চোখে পরছে না এই যা...এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়লাম বুঝতেই পারলাম না।
সকাল তখন ছটা হবে, হঠাৎ কানের কাছে রাখা মোবাইলটা জোরে জোরে বেজে উঠে রোববারের ঘুমের দফা-রফা করে ছাড়ল। ঘুম জরানো চোখে, বালিশের নীচ থেকে মোবাইলটা বার করে দেখি তিনটে মিসড কল কোনও এক প্রাইভেট নম্বর থেকে, ফোন নম্বরটা দেখাচ্ছে না। প্রচণ্ড রাগে হাত দুটো নিশপিশ করে উঠল, সামনে পেলে ব্যাটাকে দেখে নিতুম একবার। ঘুরিয়ে যে ফোন করব, তারও উপায় নেই, কারণ ওই নম্বরে ফোন করা যাবে না, লাইন ডিসকানেকটেড হয়ে যাবে।
কি করব, কি করব ভাবছি, তখনই একটা মেসেজ ঢুকল ফোনে। সেই প্রাইভেট নম্বর । মেসেজটা অন করার সাথে সাথেই আমার ঘুমতো কেটে গেলই, সাথে একটা ঠাণ্ডা আতঙ্কের অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেম গেল। একটা সহজ সরল এস এম এস, কিন্তু তার ব্যাপ্তি বিশাল, লেখা ছিল –
“স্যর, ঘুমোচ্ছেন বুঝি? ভালো, ছুটির দিনে ঘুমানো ভালো, আরও ভালো, অন্যের কাজে নাক না গলিয়ে, নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে তো নাকি... নাক কেটে গেলে তখন কি হবে? আর নাকের সাথে যদি মাথাটাও......না না , স্যর অপরাধ নেবেন না, উপদেশ ভাবতে পারেন ... আশা করি কথাটা মনে থাকবে।”
ভয়ে সাথে সাথে মোবাইলটাই সুইচড অফ করে দিলাম চটজলদি ! কি করব, অর্ককে ফোন করে জানাব, কিন্তু কে এই মেসেজটা পাঠাল। কি কারনেই বা ? এটা কি এই কেসের সাথে যুক্ত? যদি তাই হয়, তাহলে, মুকুলিকার মৃত্যু রহস্যজট যে সহজে কাটবে না, তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা আবার অন করলাম, আর সাথে সাথেই অর্কর ফোন।... কি ব্যাপার... অর্ক তো এত সকালে কখনো ফোন করে না, তবে কি সেও ওই মেসেজটা পেয়েছে? যাই হোক, ফোনটা রিসিভ করতেই, অর্কর গলা পেলাম – বাবা মানিক চাঁদ ঘুম থেকে উঠেছিস? আমি ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলাম – হ্যাঁ, কিন্তু এত সকালে, তোর ফোন কি ব্যাপার বলত ?
অর্ক হেসে বলে উঠল, ঠিক ভেবেছি, নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছিস, তাই একবার ঝালিয়ে নিলাম, যাই হোক, ওই ফোন কলটার ব্যাপারে কারওর সাথে কিছু ডিসকাস করিস না এখন। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয় বাড়িতে, মা মটরশুঁটির কচুরি আর আলুর দম করছে টিফিনে, আর তারপর একবার থানাতেও যেতে হবে, বাকি কথা পরে বলব, তারপর আমাকে কোনও কিছু বলতে না দিয়ে, ফোনটা কেটে দিল।
(চলবে )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শঙ্খদীপ মুসাফিরানা ঘোষ ০১/১০/২০১৫এগিয়ে চলুক
-
দেবব্রত সান্যাল ৩০/০৯/২০১৫এই সব গল্প পড়তে বসলে স্কুল জীবনে ফিরে যাই। দেশ পুজোর সংখ্যা বেরিয়ে গিয়েছে , ফেলুদার গল্পটা তাড়াতাড়ি পড়ে নিতে হবে। পরেরটা কবে ?
-
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ৩০/০৯/২০১৫মেসেজ টা পেয়ে আমার রক্ত চলাচল!!! না থাক ওসব কথা ।
গল্প্টা কেমন বলি । দারুন! !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
চালিয়ে যান, বেশি দেরি করবেন না প্লিজ ! আমার আবার প্রেসার আছে। -
তপন দাস ৩০/০৯/২০১৫আমি কিন্তু ঘুমাছিনা । আপনার গল্প পড়ছি।
হা হা হা !
খুব ভালো লাগছে। চলুক...