চোরকাঁটা - ৬ষ্ঠ পর্ব
( আগের সংখ্যার পর )
তমালিকা দেবী এর উত্তরে যা বললেন, তা শুনে, আমার কনফিউশন আরও বেড়ে গেল। তমালিকা দেবী অত্যন্ত নিঃসঙ্কোচে, সহজ ও সাবলীল ভাবে পুরো ঘটনা যা বললেন তার সারমর্ম হল – অবিনাশ বাবু আর তমালিকা দেবী দুজনের প্রেম প্রায় ছোটবেলা থেকে, দুজনে একই সাথে পরাশুনা, খেলাধুলা করে বড়ো হয়েছেন, এক পাড়াতে তাদের দুজনারই বাড়ি। দুজনেই একই কলেজের থেকে বি এ পাস করে ভালবাসা করে বিয়ে করেছিলেন পরিবারের অসম্মতিতে, ফলে যা হয়ার তা হয়, দুজনকেই দুজনের পরিবার থেকে তজ্য সন্তান করে দেওয়া হয়, অবিনাশ বাবুর পারিবারিক সোনার বড় দোকান আছে গরিয়াহাট ও বউবাজারে। কিন্তু বাড়ির সমস্ত সম্পত্তির থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়।
অগত্যা তাদের গৃহত্যাগ ও নেতাজীনগর ভাড়া বাড়িতে আগমন। প্রথম দিকে, নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে এক ব্যাবসা করার চেষ্টা, ও তাতে অসফল হয়ে বেকার অবস্থায় কিছুদিন কাটানো। তারপর কিছু উপায় না পেয়ে ট্যাক্সিকে নিজেদের জীবন জীবিকার সঙ্গি করে তোলা। এর মাঝে আবার বিয়ের অনেকদিন পরেও কোনও সন্তান না আসাতে, অবিনাশ বাবু আর তমালিকা দেবী খুবই হতাশ হয়ে পরেছিলেন। কিছুতেই কিছু না হওয়াতে, তারা বেলেঘাটা সংলগ্ন এক অনাথ আশ্রমের শরনাপন্ন হন, তারপর অনেক চেষ্টা-চরিত্তির করে সেখান থেকে একটি ফুটফুটে মেয়েকে দত্তক নিয়ে আসেন, অবিনাশ বাবু নিজের মেয়ের নাম স্ত্রীর নামের সাথে মিলিয়ে রাখেন মুকুলিকা।
কিন্তু সেখানেও আর এক বিপদ, কলোনির লোকেরা এ জিনিস ভালো ভাবে মেনে নিল না, তারা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে অবিনাশ বাবুদের পাড়া ছাড়া করিয়ে ছাড়লেন। এক মাসের মেয়েকে নিয়ে অবিনাশ বাবুরা পরলেন ঘর বিপদে, কিছুদিন এক সুহৃদয় বন্ধুর দয়ায় ওই এলাকার কাছাকাছি অন্য পাড়াতে ঘর বাঁধলেন, ভালয় ভালয় কেটে গেল প্রায় এগারো বছর। মেয়ে বার হয়ে গেল। মনে হল যেন ওনাদের জীবনটা আবার গতিময় হয়ে উঠেছে।
কিন্তু আবার গতমাসে শুরু হল আবার বিপত্তি, পুরনো পাড়ার কোনও এক স্কুলের বন্ধুর কাছে মুকুলিকা শুনে আসে তার জন্ম ইতিহাস। অবিনাশ বাবু আর তমালিকা দেবীরা নাকি তার নিজের বাবা-মা নয়, সে মেয়ের কি জেদ, তার নিজের বাবা-মা কে খুঁজে বের করতেই হবে যে করে হোক। ফলে, আবার ঘরে অশান্তি শুরু, অনেক কষ্টে মেয়েকে বোঝান গেলেও, সে আর স্কুলে যেতে চায় না, কারণ স্কুলে সবাই তাকে খ্যাপায় তার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে।
এইটুকু মেয়েও তার অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগতে শুরু করল, শেষে অবিনাশ বাবু নিজেই স্থির করলেন ওই জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আবার শুরু খোঁজ মাথা গোঁজার জায়গা বার করার। শেষে, অনেক কষ্টে, মাত্র দশদিন আগে, এ পাড়াতে মিঃ পাকরাশীদের নিচের তলায় একটি টু রুমের ঘর ভাড়া নেওয়া, সঙ্গে একটি রান্নাঘর, বাথরুম ও একফালি বারান্দা। ঘরটা ছোটো, কিন্তু ওনাদের খুব পছন্দ হওয়াতে আর দেরি করেননি ওনারা, সাথে সাথে, ঘরটি ভাড়া নিয়ে নেন, সাতদিন আগেই এখানে ওনারা এসেছিলেন। পাড়ার সবার সঙ্গে পরিচয় ও হয়নি, শুধুমাত্র বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেদের সাথে পরিচয়পর্বটুকু হয়েছে। এর মাঝে এই ঘটনা যে কি করে ঘটে গেল, কিছুই বোঝা গেল না।
এই বলে তমালিকা দেবী চুপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ঘরে তখন যেন ঠিক পিন ড্রপ সাইলেন্স। আমরা এতক্ষন চুপ করে শুনছিলাম সব কথা, এইবার অর্ক নিঃশব্দতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করল তমালিকা দেবী কে, আচ্ছা তমালিকা দেবী, মুকুলিকা যদি তার জন্মবৃত্তান্ত জেনেই গিয়ে থাকে, তাহলে আপনাদের সঙ্গে ওর আচরণ কেমন ছিল তারপর, মানে আপনাদের সম্পর্ক কি স্বাভাবিক হয়েছিলো নাকি...
অবিনাশ বাবু, এতক্ষনে মৌনভাব কাটিয়ে উঠেছেন, দেখে মনে হল, কারণ তিনিই উত্তরটা দিলেন – হ্যাঁ, প্রথমে আমাদের মেয়ে একটা গভীর শক পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ও সেটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠেছিল জানেন, আমায় নিজে ও বলেছিল, বাবা, তুমি ও মা আমার আসল বাবা-মা, আমার আর অন্য বাবা – মা এর দরকার নেই, তোমরাই আমার বাবা-মা ছিলে, আর থাকবে। খুব ভালো মেয়েটা ছিল আমার অর্ক বাবু, আপনাদের বলে আমি বোঝাতে পারছি না।
আমি বললাম – না আমরা বুঝেছি, আপনি শান্ত হন একটু। অর্ক তমালিকা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল – আপনাদের কাউকে সন্দেহ হয় এ ব্যাপারে? মানে ওই যে সবাই বলছে মুকুলিকাকে কোনও এক ছেলের সাথে দেখা গিয়েছিল শেষ বার সেই ব্যাপারে।
তমালিকা দেবী এবারে গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন, দেখুন অর্ক বাবু, আমরা জানি না, কেন এ কথা সবাই বলছে, আমার মেয়ে এতটাই ছোট সে এখন এইসব ব্যাপার বুঝত না, ওর কোনও ছেলে বন্ধুও ছিল না, আর এখানে এই সাতদিনে, ও সবে স্কুলে গেছে মোটে তিনদিন, তাও পাড়ার বালিকা বিদ্দ্যালয়ে, আমার সাথে ক্লাস সিক্সে ভরতির জন্য শুধুমাত্র। তা এরমধ্যে ছেলে বন্ধু কোথা থেকে ও জোটাবে? আমরা জানি না, এরকম কোনও ছেলের কথা, তাইতো আপনাদের কাছে এলাম, প্লীস খুঁজে বার করুণ না ওই ছেলেটিকে, যে আমাদের এত বড় সর্বনাশ করেছে। আমার তো ভয় হচ্ছে, আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে কি করেছে কে জানে ওই শয়তান।
ভগবানকে খালি ডাকছি, আবার অন্য কোনও বদনামের ভাগী না হতে হয় আমাদের মেয়েকে।
অর্ক বলল – পুলিশ কি বলেছে আপনাদের? এটা কি শুধু খুন নাকি... অবিনাশ বাবু হঠাৎ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না... অর্ক বাবু তা নয়। পুলিশ বলেছে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে শুধু মাত্র খুন করা হয়েছে, বাকিটা ময়না তদন্তর পর জানা যাবে।
হুম, অর্ক একটা স্বাস নিয়ে বলল – আপনাদের সত্যি আর কারওর সাথে পরিচয় হয় নি এখানে? কিন্তু মিসেস কাকলি কুণ্ডু যে বলছিলেন যে আপনাদের সাথে পরিচয় হয়েছে ওনার, ওনাদের সামনের বাড়িতেই তো আপনারা ভাড়া এসেছেন তাই না?
তামালিকা দেবী শুনে বললেন, হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন, কাকলি দেবীর সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে, আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। উনি খুব ভালো মানুষ, ওনার একটা সাত বছরের ছেলেও আছে, হ্যাঁ, একমাত্র ওর সাথেই মেয়ে একটু খেলা ধুলা করত। খুব ভালো ছেলে, কাকলি দেবীই তো আমাদেরকে আপনাদের কথা বলেছেন। আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ আপনারা আমাদের একটু সাহায্য করুন, আমরা গরিব, কিন্তু ভয় নেই আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাদের ফীস দিতে।
কথাটা লুফে নিয়েই অবিনাশ বাবুর উক্তি – দেখেছেন, কি কাণ্ড, আমরা এতক্ষন ধরে কথা বলছি, কিন্তু আপনাদের ফীস তা জানা হয়নি। আপনাদের কত দিতে হবে যদি একটু বলে দেন।
আমি আর চুপ করে না থাকতে পেরে বললাম – দেখুন, আমরা যা কাজ করি তা পুরোপুরি প্রফেশনাল কাজ, তাই, আমরা আগে কিছু এডভান্স পেমেন্ট নি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা, এটা আমাদের পাড়ার কাজ, আর আপনারা আমাদের পাড়ার অতিথি, তাই এখন আপনাদের কিছু দিতে হবে না, আমরা আমাদের কাজ করে যাব, কাজ শেষ করতে পারলে, আপনাদের কে বলে দেব তার জন্য কত আপনাদেরকে দিতে হবে, চিন্তা করবেন না, বেশী হবে না। মাঝে যা খরচা হবে, তা আমরা ম্যানেজ করে নিত পারব আশা করি, যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে আপনাদেরকে জানাব।
তমালিকা দেবী বিস্মিত হয়ে বললেন, কি বলে যে আপনাদেরকে ধন্যবাদ দেব জানি না, তবে যদি কোনও কিছু লাগে অবশ্যই জানাবেন আমাদেরকে, অনেক আশায় রইলাম।
অর্ক হেসে বলল, আচ্ছা, আপাতত শেষ প্রশ্ন, মুকুলিকাকে যে কোনও ছেলের সাথে শেষ দেখা গিয়েছে, এটা আপনারা কোথা থেকে জানলেন? উত্তরে তমালিকা দেবী বললেন – হ্যাঁ, আমাদের বাড়ীর ভাড়াটেদের কাছে জানতে পেরেছি, যে মিসেস কুণ্ডু নাকি আজ থানাতেও ওখানকার এক অফিসারের কথা তুললেন, যা আমি বিশ্বাস করি না।
অর্ক মাথাটা উপর-নীচে হেলিয়ে বলে উঠল - দেখুন আপনারা এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, আর বাড়ি যান। আপাতত আপনাদের সময় ছাড়া আমাদের আর কিছু লাগবে না, তবে হ্যাঁ, এই কথাগুলো মনে রাখবেন, আপনারা যে আমাদেরকে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করতে দিয়েছেন, আর আমাদের সাথে কি কথা হয়েছে, বা হবে, তা যথাসাধ্য কাউকে জানাবেন না, ওই মিসেস কুণ্ডুকেও না। তবে তিনি তো জেনেই গেছেন যে আপনারা আমার কাছে আসবেন, তাই শুধু কথাবার্তাগুলো গোপন রাখবেন। শুধু বলবেন, আমরা বলেছি, যথাসাধ্য চেষ্টা করে দেখব। এবারে আপনারা আসতে পারেন। অর্ক নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালো।
অবিনাশ বাবু ও তমালিকা দেবী প্রতি নমস্কার করে আস্তে আস্তে দরজা দিয়ে গিয়ে বাইরের কনকনে ঠাণ্ডা আর বৃষ্টিতে রাতের কালো নিকষ অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
(চলবে)
তমালিকা দেবী এর উত্তরে যা বললেন, তা শুনে, আমার কনফিউশন আরও বেড়ে গেল। তমালিকা দেবী অত্যন্ত নিঃসঙ্কোচে, সহজ ও সাবলীল ভাবে পুরো ঘটনা যা বললেন তার সারমর্ম হল – অবিনাশ বাবু আর তমালিকা দেবী দুজনের প্রেম প্রায় ছোটবেলা থেকে, দুজনে একই সাথে পরাশুনা, খেলাধুলা করে বড়ো হয়েছেন, এক পাড়াতে তাদের দুজনারই বাড়ি। দুজনেই একই কলেজের থেকে বি এ পাস করে ভালবাসা করে বিয়ে করেছিলেন পরিবারের অসম্মতিতে, ফলে যা হয়ার তা হয়, দুজনকেই দুজনের পরিবার থেকে তজ্য সন্তান করে দেওয়া হয়, অবিনাশ বাবুর পারিবারিক সোনার বড় দোকান আছে গরিয়াহাট ও বউবাজারে। কিন্তু বাড়ির সমস্ত সম্পত্তির থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়।
অগত্যা তাদের গৃহত্যাগ ও নেতাজীনগর ভাড়া বাড়িতে আগমন। প্রথম দিকে, নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে এক ব্যাবসা করার চেষ্টা, ও তাতে অসফল হয়ে বেকার অবস্থায় কিছুদিন কাটানো। তারপর কিছু উপায় না পেয়ে ট্যাক্সিকে নিজেদের জীবন জীবিকার সঙ্গি করে তোলা। এর মাঝে আবার বিয়ের অনেকদিন পরেও কোনও সন্তান না আসাতে, অবিনাশ বাবু আর তমালিকা দেবী খুবই হতাশ হয়ে পরেছিলেন। কিছুতেই কিছু না হওয়াতে, তারা বেলেঘাটা সংলগ্ন এক অনাথ আশ্রমের শরনাপন্ন হন, তারপর অনেক চেষ্টা-চরিত্তির করে সেখান থেকে একটি ফুটফুটে মেয়েকে দত্তক নিয়ে আসেন, অবিনাশ বাবু নিজের মেয়ের নাম স্ত্রীর নামের সাথে মিলিয়ে রাখেন মুকুলিকা।
কিন্তু সেখানেও আর এক বিপদ, কলোনির লোকেরা এ জিনিস ভালো ভাবে মেনে নিল না, তারা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে অবিনাশ বাবুদের পাড়া ছাড়া করিয়ে ছাড়লেন। এক মাসের মেয়েকে নিয়ে অবিনাশ বাবুরা পরলেন ঘর বিপদে, কিছুদিন এক সুহৃদয় বন্ধুর দয়ায় ওই এলাকার কাছাকাছি অন্য পাড়াতে ঘর বাঁধলেন, ভালয় ভালয় কেটে গেল প্রায় এগারো বছর। মেয়ে বার হয়ে গেল। মনে হল যেন ওনাদের জীবনটা আবার গতিময় হয়ে উঠেছে।
কিন্তু আবার গতমাসে শুরু হল আবার বিপত্তি, পুরনো পাড়ার কোনও এক স্কুলের বন্ধুর কাছে মুকুলিকা শুনে আসে তার জন্ম ইতিহাস। অবিনাশ বাবু আর তমালিকা দেবীরা নাকি তার নিজের বাবা-মা নয়, সে মেয়ের কি জেদ, তার নিজের বাবা-মা কে খুঁজে বের করতেই হবে যে করে হোক। ফলে, আবার ঘরে অশান্তি শুরু, অনেক কষ্টে মেয়েকে বোঝান গেলেও, সে আর স্কুলে যেতে চায় না, কারণ স্কুলে সবাই তাকে খ্যাপায় তার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে।
এইটুকু মেয়েও তার অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগতে শুরু করল, শেষে অবিনাশ বাবু নিজেই স্থির করলেন ওই জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আবার শুরু খোঁজ মাথা গোঁজার জায়গা বার করার। শেষে, অনেক কষ্টে, মাত্র দশদিন আগে, এ পাড়াতে মিঃ পাকরাশীদের নিচের তলায় একটি টু রুমের ঘর ভাড়া নেওয়া, সঙ্গে একটি রান্নাঘর, বাথরুম ও একফালি বারান্দা। ঘরটা ছোটো, কিন্তু ওনাদের খুব পছন্দ হওয়াতে আর দেরি করেননি ওনারা, সাথে সাথে, ঘরটি ভাড়া নিয়ে নেন, সাতদিন আগেই এখানে ওনারা এসেছিলেন। পাড়ার সবার সঙ্গে পরিচয় ও হয়নি, শুধুমাত্র বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেদের সাথে পরিচয়পর্বটুকু হয়েছে। এর মাঝে এই ঘটনা যে কি করে ঘটে গেল, কিছুই বোঝা গেল না।
এই বলে তমালিকা দেবী চুপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ঘরে তখন যেন ঠিক পিন ড্রপ সাইলেন্স। আমরা এতক্ষন চুপ করে শুনছিলাম সব কথা, এইবার অর্ক নিঃশব্দতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করল তমালিকা দেবী কে, আচ্ছা তমালিকা দেবী, মুকুলিকা যদি তার জন্মবৃত্তান্ত জেনেই গিয়ে থাকে, তাহলে আপনাদের সঙ্গে ওর আচরণ কেমন ছিল তারপর, মানে আপনাদের সম্পর্ক কি স্বাভাবিক হয়েছিলো নাকি...
অবিনাশ বাবু, এতক্ষনে মৌনভাব কাটিয়ে উঠেছেন, দেখে মনে হল, কারণ তিনিই উত্তরটা দিলেন – হ্যাঁ, প্রথমে আমাদের মেয়ে একটা গভীর শক পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ও সেটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠেছিল জানেন, আমায় নিজে ও বলেছিল, বাবা, তুমি ও মা আমার আসল বাবা-মা, আমার আর অন্য বাবা – মা এর দরকার নেই, তোমরাই আমার বাবা-মা ছিলে, আর থাকবে। খুব ভালো মেয়েটা ছিল আমার অর্ক বাবু, আপনাদের বলে আমি বোঝাতে পারছি না।
আমি বললাম – না আমরা বুঝেছি, আপনি শান্ত হন একটু। অর্ক তমালিকা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল – আপনাদের কাউকে সন্দেহ হয় এ ব্যাপারে? মানে ওই যে সবাই বলছে মুকুলিকাকে কোনও এক ছেলের সাথে দেখা গিয়েছিল শেষ বার সেই ব্যাপারে।
তমালিকা দেবী এবারে গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন, দেখুন অর্ক বাবু, আমরা জানি না, কেন এ কথা সবাই বলছে, আমার মেয়ে এতটাই ছোট সে এখন এইসব ব্যাপার বুঝত না, ওর কোনও ছেলে বন্ধুও ছিল না, আর এখানে এই সাতদিনে, ও সবে স্কুলে গেছে মোটে তিনদিন, তাও পাড়ার বালিকা বিদ্দ্যালয়ে, আমার সাথে ক্লাস সিক্সে ভরতির জন্য শুধুমাত্র। তা এরমধ্যে ছেলে বন্ধু কোথা থেকে ও জোটাবে? আমরা জানি না, এরকম কোনও ছেলের কথা, তাইতো আপনাদের কাছে এলাম, প্লীস খুঁজে বার করুণ না ওই ছেলেটিকে, যে আমাদের এত বড় সর্বনাশ করেছে। আমার তো ভয় হচ্ছে, আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে কি করেছে কে জানে ওই শয়তান।
ভগবানকে খালি ডাকছি, আবার অন্য কোনও বদনামের ভাগী না হতে হয় আমাদের মেয়েকে।
অর্ক বলল – পুলিশ কি বলেছে আপনাদের? এটা কি শুধু খুন নাকি... অবিনাশ বাবু হঠাৎ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না... অর্ক বাবু তা নয়। পুলিশ বলেছে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে শুধু মাত্র খুন করা হয়েছে, বাকিটা ময়না তদন্তর পর জানা যাবে।
হুম, অর্ক একটা স্বাস নিয়ে বলল – আপনাদের সত্যি আর কারওর সাথে পরিচয় হয় নি এখানে? কিন্তু মিসেস কাকলি কুণ্ডু যে বলছিলেন যে আপনাদের সাথে পরিচয় হয়েছে ওনার, ওনাদের সামনের বাড়িতেই তো আপনারা ভাড়া এসেছেন তাই না?
তামালিকা দেবী শুনে বললেন, হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন, কাকলি দেবীর সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে, আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। উনি খুব ভালো মানুষ, ওনার একটা সাত বছরের ছেলেও আছে, হ্যাঁ, একমাত্র ওর সাথেই মেয়ে একটু খেলা ধুলা করত। খুব ভালো ছেলে, কাকলি দেবীই তো আমাদেরকে আপনাদের কথা বলেছেন। আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ আপনারা আমাদের একটু সাহায্য করুন, আমরা গরিব, কিন্তু ভয় নেই আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাদের ফীস দিতে।
কথাটা লুফে নিয়েই অবিনাশ বাবুর উক্তি – দেখেছেন, কি কাণ্ড, আমরা এতক্ষন ধরে কথা বলছি, কিন্তু আপনাদের ফীস তা জানা হয়নি। আপনাদের কত দিতে হবে যদি একটু বলে দেন।
আমি আর চুপ করে না থাকতে পেরে বললাম – দেখুন, আমরা যা কাজ করি তা পুরোপুরি প্রফেশনাল কাজ, তাই, আমরা আগে কিছু এডভান্স পেমেন্ট নি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা, এটা আমাদের পাড়ার কাজ, আর আপনারা আমাদের পাড়ার অতিথি, তাই এখন আপনাদের কিছু দিতে হবে না, আমরা আমাদের কাজ করে যাব, কাজ শেষ করতে পারলে, আপনাদের কে বলে দেব তার জন্য কত আপনাদেরকে দিতে হবে, চিন্তা করবেন না, বেশী হবে না। মাঝে যা খরচা হবে, তা আমরা ম্যানেজ করে নিত পারব আশা করি, যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে আপনাদেরকে জানাব।
তমালিকা দেবী বিস্মিত হয়ে বললেন, কি বলে যে আপনাদেরকে ধন্যবাদ দেব জানি না, তবে যদি কোনও কিছু লাগে অবশ্যই জানাবেন আমাদেরকে, অনেক আশায় রইলাম।
অর্ক হেসে বলল, আচ্ছা, আপাতত শেষ প্রশ্ন, মুকুলিকাকে যে কোনও ছেলের সাথে শেষ দেখা গিয়েছে, এটা আপনারা কোথা থেকে জানলেন? উত্তরে তমালিকা দেবী বললেন – হ্যাঁ, আমাদের বাড়ীর ভাড়াটেদের কাছে জানতে পেরেছি, যে মিসেস কুণ্ডু নাকি আজ থানাতেও ওখানকার এক অফিসারের কথা তুললেন, যা আমি বিশ্বাস করি না।
অর্ক মাথাটা উপর-নীচে হেলিয়ে বলে উঠল - দেখুন আপনারা এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, আর বাড়ি যান। আপাতত আপনাদের সময় ছাড়া আমাদের আর কিছু লাগবে না, তবে হ্যাঁ, এই কথাগুলো মনে রাখবেন, আপনারা যে আমাদেরকে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করতে দিয়েছেন, আর আমাদের সাথে কি কথা হয়েছে, বা হবে, তা যথাসাধ্য কাউকে জানাবেন না, ওই মিসেস কুণ্ডুকেও না। তবে তিনি তো জেনেই গেছেন যে আপনারা আমার কাছে আসবেন, তাই শুধু কথাবার্তাগুলো গোপন রাখবেন। শুধু বলবেন, আমরা বলেছি, যথাসাধ্য চেষ্টা করে দেখব। এবারে আপনারা আসতে পারেন। অর্ক নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালো।
অবিনাশ বাবু ও তমালিকা দেবী প্রতি নমস্কার করে আস্তে আস্তে দরজা দিয়ে গিয়ে বাইরের কনকনে ঠাণ্ডা আর বৃষ্টিতে রাতের কালো নিকষ অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
(চলবে)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
দেবব্রত সান্যাল ৩০/০৯/২০১৫দত্তক নেওয়াটা কি আজকাল এতবড় issue যে পাড়া ছাড়া হতে হবে ? সাধারণত sentimental crisis বাচ্চা টার হয়। তবে গোয়েন্দা গল্পে কিছুটা ছাড় থাকতেই পারে। আগে কি হলো জানতে বসে আছি।
-
অভিষেক মিত্র ২৯/০৯/২০১৫হেব্বি চলছে।
-
রাশেদ খাঁন ২৭/০৯/২০১৫দাড়ুন
-
মুরাদ হোসেন ২৬/০৯/২০১৫মজার গল্প । চালিয়ে যান ।
-
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ২৫/০৯/২০১৫দাদা, তাড়াতাড়ি পরের অংশটা চাই। দেরী হলে চলবে না। উহ কি সাংঘাতিক রে বাবা !
ভীষণ ভীষণ ভালো লেখা। পাতা থেকে অন্যমনস্ক হওয়া যায় না। কোটিকোটি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন অর্ককে (উর্ফ শান্তনু ভাইকে ).
পড়াশুনা>, ত্যাজ্য>,