অন্ধকার বাঁশবনে
অন্ধকার বাঁশবনে
কিছুদিন থেকে যেরকম অস্বাভাবিক হারে জল বাড়ছে এরকম আর চার-পাঁচ দিন চলতে থাকলে বাঁধ উপছে পদ্মার জল হুড়মুড় করে ঢুকে পুরো শহরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এদিকে বাঁধের ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অসম্ভব রকমের মুনাফা লুটছে। বাঁধ কেটে শহরটাকে ভাসিয়ে দেবার হিংস্র পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর বাঁধের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
“আজ কতটা জল বাড়ল?” এই একই কথা আজ বারো দিন থেকে আতঙ্কিত মানুষগুলোর মুখে মুখে ফিরছে। নিকটাত্মীয় যাদের আছে, তারা দিন সাতেক থেকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছে ।এখনও যাচ্ছে।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি যতই গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হচ্ছে, ভিটে সম্বল মানুষগুলোর অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে চুরি-ছিনতায়ের মাত্রাও বাড়ছে সমহারে।এমন পরিস্থিতির চাপে পড়ে নিজেদের শেষ অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখনও বেশ কিছু পরিবার রাক্ষুসী বন্যার সাথে ব্যর্থ মোকাবিলা চালিয়ে যাছে। এইসব অসহায় মানুষগুলোর পাশে রৌনকদের সংগ্রহীত সামান্য খাদ্য সামগ্রী নিয়েই ছিল ওদের অভিযান।
“দিদা... ও ... দিদা...” চারিদিকে জলময় ঘন বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে কোনোরকমে শোনা গেল এক অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর - চিন্তার রেশ হঠাৎ ছিঁড়ে গিয়ে একটু নড়েচড়ে উঠলো রৌনক। আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে অনুমান করে জল-কাদা ভেঙে আগাছার দল সরিয়ে পশ্চিমের পুকুরটার দিকে একটু এগিয়ে থামল। চুপচাপ !বামদিক থেকে দড়ির মত কি একটা এগিয়ে আসছে ।বজ্রবেগে মাথার উপরকার একটি কঞ্চি ভেঙ্গে নিয়ে সাবধানে সরিয়ে দিল দূরে। ওটা সাপ । ঝপঝপ আওয়াজে এগিয়ে চলল রৌনক।
মোটা শিমুল গাছটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রৌনক, “ কে? কে ওখানে?” কিছুটা দূরে তোলপাড় করা জলরাশির কাছ থেকে আগের মতই আর্তস্বর শোনা গেল, “দিদা, ও দিদা, তুমি কোথায়?”
কাছে এগিয়ে গেল রৌনক, “কে ? কে আপনি ? কোত্থেকে আসছেন ? কোথায় যাবেন ?”কথাটা সে শুনল কি শুনল না, কিছুই বুঝল না রৌনক। আগের মতই সে জল তোলপাড় করে পাগলের মতো আচরণ করতে লাগল, “দিদা ও দিদা, তুমি কোথায় ?”
কাঁধ দুখানি ধরে বেশ জোরে ঝাঁকুনি দিল রৌনক, “ কি হয়েছে?” ভেজা ভেজা লম্বা চুলগুলির আড়াল থেকে দেখা গেল একটি আর্ত মুখ। অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো দুটি নারী চক্ষু । সেই চোখে বিশাল পৃথিবীতে একাকিত্বের অনুরণন উপলব্ধি করল রৌনক। প্রায় অন্ধকার বাঁশবনে বন্যার জলহাওয়ায় চাপা-গোঙান-ফোঁপান কান্নার মাঝে রৌনক যা বুঝল তার অর্থ এইরকম... “ জেহেনিনগর থেকে আসছিলাম, ঐ নালাটা পাড় হয়ে দিদাকে আর দেখতে পাচ্ছি না...” ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চারপাশে দেখে নিল রৌনক। ডুবে যাওয়া নালার উপরেও এক বুক জল এখন। প্রতি মুহূর্তেই জল বাড়ছে। প্রবল স্রোত সেখানে। সেদিকে এগিয়ে গেল। ঝানু শিকারির মতো এদিক ওদিক তাকাল। তারপরে একদিকে কিছুটা দূরে দৃষ্টি আটকে গেল- একটি মলিনপ্রায় পুঁটুলি স্রোতের ধাক্কায় ডুবতে ডুবতে দূরে চলে যাছে । অতি ব্যবহৃত একটি পুরনো লাঠিও দেখতে পেল।
মুহূর্তের মধ্যেই কত কি ভেবে নিল রৌনক।দ্রুত ছুটে গেল সেদিকে। মাছরাঙার মতো বেশ খানিক ডুব সাঁতার দিয়ে খোঁজা-খুঁজি করল; কিন্তু দিদাকে আর পাওয়া গেল না।
ফিরে এল । অনেক বোঝানোর পর অবশেষে অসহায়ভাবে ওর দিদাকে ফিরিয়ে আনার দুর্বল প্রতিশ্রুতি দিয়ে নালাটার কাছ থেকে একটু দূরে নিয়ে এল। এখানেও এক কোমর জল । চাপা কান্নার মধ্যে দিয়ে যে সমস্ত কথাগুলি রউনক উদ্ধার করল, সেগুলি এইরকমঃ বাপ-মা হারা শিউলি একমাত্র দিদার কাছেই মানুষ, দিদা ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ এ পৃথিবীতে নেই। অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয় ; শেষ পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিক ফাইনালটাও দিতে পারে নি। জেহেনিনগরে বন্যার জল ঢুকেছে আজ এগার দিন, মাটির ঘরগুলি সবই পড়ে গিয়েছে। শেষ দুদিন কোনোমতে মাচায় থাকবার পর আজ ওরা সরকারি স্কুল-কলেজের দিকে যাচ্ছিল কিছুদিনের আশ্রয়ের জন্য...তারপর এই অন্ধকার বাঁশবনে।
ব্যাঙের কটকট শব্দ ছাড়াও বন্যায় এই অন্ধকার বাঁশবনে বিভিন্ন শব্দের এক আশ্চর্য পটভূমি তৈরি হয়েছে। দুজনে কাছাকাছি, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ; কান্নার রেশ কাটেনি পুরোপুরি।
রউনক মুখ তুলল। আকাশ অন্ধকার। সন্ধ্যা নেমে পরবে একটু পরেই। বানের জল হাওয়ায় শীত বোধ হচ্ছে।
নৌকার দাঁড় পড়ার ছপছপ শব্দ শোনা গেল। আস্তে আস্তে তা আরও স্পষ্ট হল। শুনল দুজনই। ওদিক থেকে তাগিদ এল , ‘রৌনক, তুই কোথায় ?’ কঞ্চির দল সরিয়ে ধীরে ধীরে নৌকা এগিয়ে এল।
‘ওটা কি ? ওটা? দিদা, ও দিদা...’ পিছনে ফিরে তাকালো রৌনক । দেখল পাকা চুল ভর্তি একটি মাথা ভুস করে উপরে উঠেই আবার হারিয়ে গেল ঘূর্ণির মধ্যে। এক মুহূর্তেই রৌনক ভেবে নিল অনেককিছুই। একটি চোখ যখন গেছেই তখন তার প্রতিক্রিয়ায় অপর চোখটি হারানো উচিত নয়। শান্তভাবে শিউলির পিঠে হাত বোলাল রৌনক, ‘ওটা কিছু না, একটা আগাছার ঝোপ...’ রৌনকের ভেজা বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলল শিউলি। ওদের নৌকা চলল এগিয়ে।
কিছুদিন থেকে যেরকম অস্বাভাবিক হারে জল বাড়ছে এরকম আর চার-পাঁচ দিন চলতে থাকলে বাঁধ উপছে পদ্মার জল হুড়মুড় করে ঢুকে পুরো শহরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এদিকে বাঁধের ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অসম্ভব রকমের মুনাফা লুটছে। বাঁধ কেটে শহরটাকে ভাসিয়ে দেবার হিংস্র পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর বাঁধের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
“আজ কতটা জল বাড়ল?” এই একই কথা আজ বারো দিন থেকে আতঙ্কিত মানুষগুলোর মুখে মুখে ফিরছে। নিকটাত্মীয় যাদের আছে, তারা দিন সাতেক থেকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছে ।এখনও যাচ্ছে।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি যতই গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হচ্ছে, ভিটে সম্বল মানুষগুলোর অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে চুরি-ছিনতায়ের মাত্রাও বাড়ছে সমহারে।এমন পরিস্থিতির চাপে পড়ে নিজেদের শেষ অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখনও বেশ কিছু পরিবার রাক্ষুসী বন্যার সাথে ব্যর্থ মোকাবিলা চালিয়ে যাছে। এইসব অসহায় মানুষগুলোর পাশে রৌনকদের সংগ্রহীত সামান্য খাদ্য সামগ্রী নিয়েই ছিল ওদের অভিযান।
“দিদা... ও ... দিদা...” চারিদিকে জলময় ঘন বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে কোনোরকমে শোনা গেল এক অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর - চিন্তার রেশ হঠাৎ ছিঁড়ে গিয়ে একটু নড়েচড়ে উঠলো রৌনক। আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে অনুমান করে জল-কাদা ভেঙে আগাছার দল সরিয়ে পশ্চিমের পুকুরটার দিকে একটু এগিয়ে থামল। চুপচাপ !বামদিক থেকে দড়ির মত কি একটা এগিয়ে আসছে ।বজ্রবেগে মাথার উপরকার একটি কঞ্চি ভেঙ্গে নিয়ে সাবধানে সরিয়ে দিল দূরে। ওটা সাপ । ঝপঝপ আওয়াজে এগিয়ে চলল রৌনক।
মোটা শিমুল গাছটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রৌনক, “ কে? কে ওখানে?” কিছুটা দূরে তোলপাড় করা জলরাশির কাছ থেকে আগের মতই আর্তস্বর শোনা গেল, “দিদা, ও দিদা, তুমি কোথায়?”
কাছে এগিয়ে গেল রৌনক, “কে ? কে আপনি ? কোত্থেকে আসছেন ? কোথায় যাবেন ?”কথাটা সে শুনল কি শুনল না, কিছুই বুঝল না রৌনক। আগের মতই সে জল তোলপাড় করে পাগলের মতো আচরণ করতে লাগল, “দিদা ও দিদা, তুমি কোথায় ?”
কাঁধ দুখানি ধরে বেশ জোরে ঝাঁকুনি দিল রৌনক, “ কি হয়েছে?” ভেজা ভেজা লম্বা চুলগুলির আড়াল থেকে দেখা গেল একটি আর্ত মুখ। অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো দুটি নারী চক্ষু । সেই চোখে বিশাল পৃথিবীতে একাকিত্বের অনুরণন উপলব্ধি করল রৌনক। প্রায় অন্ধকার বাঁশবনে বন্যার জলহাওয়ায় চাপা-গোঙান-ফোঁপান কান্নার মাঝে রৌনক যা বুঝল তার অর্থ এইরকম... “ জেহেনিনগর থেকে আসছিলাম, ঐ নালাটা পাড় হয়ে দিদাকে আর দেখতে পাচ্ছি না...” ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চারপাশে দেখে নিল রৌনক। ডুবে যাওয়া নালার উপরেও এক বুক জল এখন। প্রতি মুহূর্তেই জল বাড়ছে। প্রবল স্রোত সেখানে। সেদিকে এগিয়ে গেল। ঝানু শিকারির মতো এদিক ওদিক তাকাল। তারপরে একদিকে কিছুটা দূরে দৃষ্টি আটকে গেল- একটি মলিনপ্রায় পুঁটুলি স্রোতের ধাক্কায় ডুবতে ডুবতে দূরে চলে যাছে । অতি ব্যবহৃত একটি পুরনো লাঠিও দেখতে পেল।
মুহূর্তের মধ্যেই কত কি ভেবে নিল রৌনক।দ্রুত ছুটে গেল সেদিকে। মাছরাঙার মতো বেশ খানিক ডুব সাঁতার দিয়ে খোঁজা-খুঁজি করল; কিন্তু দিদাকে আর পাওয়া গেল না।
ফিরে এল । অনেক বোঝানোর পর অবশেষে অসহায়ভাবে ওর দিদাকে ফিরিয়ে আনার দুর্বল প্রতিশ্রুতি দিয়ে নালাটার কাছ থেকে একটু দূরে নিয়ে এল। এখানেও এক কোমর জল । চাপা কান্নার মধ্যে দিয়ে যে সমস্ত কথাগুলি রউনক উদ্ধার করল, সেগুলি এইরকমঃ বাপ-মা হারা শিউলি একমাত্র দিদার কাছেই মানুষ, দিদা ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ এ পৃথিবীতে নেই। অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয় ; শেষ পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিক ফাইনালটাও দিতে পারে নি। জেহেনিনগরে বন্যার জল ঢুকেছে আজ এগার দিন, মাটির ঘরগুলি সবই পড়ে গিয়েছে। শেষ দুদিন কোনোমতে মাচায় থাকবার পর আজ ওরা সরকারি স্কুল-কলেজের দিকে যাচ্ছিল কিছুদিনের আশ্রয়ের জন্য...তারপর এই অন্ধকার বাঁশবনে।
ব্যাঙের কটকট শব্দ ছাড়াও বন্যায় এই অন্ধকার বাঁশবনে বিভিন্ন শব্দের এক আশ্চর্য পটভূমি তৈরি হয়েছে। দুজনে কাছাকাছি, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ; কান্নার রেশ কাটেনি পুরোপুরি।
রউনক মুখ তুলল। আকাশ অন্ধকার। সন্ধ্যা নেমে পরবে একটু পরেই। বানের জল হাওয়ায় শীত বোধ হচ্ছে।
নৌকার দাঁড় পড়ার ছপছপ শব্দ শোনা গেল। আস্তে আস্তে তা আরও স্পষ্ট হল। শুনল দুজনই। ওদিক থেকে তাগিদ এল , ‘রৌনক, তুই কোথায় ?’ কঞ্চির দল সরিয়ে ধীরে ধীরে নৌকা এগিয়ে এল।
‘ওটা কি ? ওটা? দিদা, ও দিদা...’ পিছনে ফিরে তাকালো রৌনক । দেখল পাকা চুল ভর্তি একটি মাথা ভুস করে উপরে উঠেই আবার হারিয়ে গেল ঘূর্ণির মধ্যে। এক মুহূর্তেই রৌনক ভেবে নিল অনেককিছুই। একটি চোখ যখন গেছেই তখন তার প্রতিক্রিয়ায় অপর চোখটি হারানো উচিত নয়। শান্তভাবে শিউলির পিঠে হাত বোলাল রৌনক, ‘ওটা কিছু না, একটা আগাছার ঝোপ...’ রৌনকের ভেজা বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলল শিউলি। ওদের নৌকা চলল এগিয়ে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শিস খন্দকার ০৯/০১/২০১৬ভালো লিখেছেন।
-
জুনায়েদ বি রাহমান ০৪/০১/২০১৬খুব ভালো লাগলো।
-
মাহাবুব ০১/০১/২০১৬বেশ সুন্দর।
-
অভিষেক মিত্র ৩১/১২/২০১৫বেশ লাগল।
-
পরশ ২৯/১২/২০১৫ভাল লাগলো
-
জে এস সাব্বির ২৯/১২/২০১৫অনেক ভাল লিখেছেন আপনি ।
-
মোঃ মুলুক আহমেদ ২৮/১২/২০১৫ভালো|
ভবিষ্যতে আরো ভালো আশা করব|
ভিতরের প্রতিভা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাও|
তারুণ্যে স্বাগতম| -
প্রদীপ কুমার দে ২৮/১২/২০১৫ভালো!
-
দেবব্রত সান্যাল ২৮/১২/২০১৫তারুণ্যে স্বাগত। ভবিষ্যতে আরও ভালো লেখার আশা করব।