কেড়ে নিতে পারে নি
ঘুম আসছে না বাইরে বেরিয়ে এলাম। গাছপালা মাটি ঘাস সবকিছুই যেন জ্যোৎস্নার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। পূর্ণিমার শুভ্র আলোয় চিকচিক করছে নদীর জল।
ওকে আজও ভুলতে পারছি না। যদিও সে আজ আর নেই আমাদের মধ্যে তবুও আজ ওর কথা বারবার মনে আসছে। মনের অন্তরতম স্থান থেকে এক মন কেমন করা সঙ্গীত বেরিয়ে আসছে।
চন্দ্রার মা ব্যাপারটা জেনে যাবার পর ওদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পুষ্পকের। তার পরেও বেশ কিছুদিন সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে পুষ্পকের সাথে কতাবার্তা বলেছিল। হঠাত করে কথাবার্তা বন্ধ। ব্যাপারটা আগের মত সহজ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেও কোন ফল হয়নি পুষ্পকের। এভাবেই চলল মাস আটেক ।
১৯৯৬ সাল। চারিদিকে গ্রিটিংস কার্ড দেবার হিরিক। সময়টা ছিল জানুয়ারি মাসের সাত তারিখ। সোমবার। অনেকেই অনেককে কার্ড দিয়ে নতুন বছরের অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু পুষ্পকের পাঠান গ্রিটিং নিয়ে ঘোশালবাবুর কোচিং ক্লাসে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করে গেল চন্দ্রা। আমরা সবাই থ হয়ে গেলাম। ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ের সামনে সারাক্ষণই মাথা নিচু করেছিল পুষ্পক। হাল্কাভাবে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার মত কোন উত্তরই সে করে নি। রটনাপ্রিয় ছেলে মেয়েদের ফিসফাস সমালোচনা শুনতে না পেরে একসময় বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল।
চন্দ্রার এমন পরিবর্তনে শুধু অবাকই হই নি বরং ক্ষোভও হয়েছিল। থমথমে মুখ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াল চন্দ্রা। ওর সঙ্গ নিলাম, “এটা তুই কি করলি চন্দ্রা? এমনিই যদি করবার ইচ্ছা ছিল তাহলে ওকে ভাল কেন বাসতে গিয়েছিলি? ওর দিকটা একবারও ভেবে দেখেছিস কি?”
উত্তর না পেয়ে এবার আমি চুপ থাকলাম।, “আমাকে দিয়ে চিঠি দেওয়া নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল তোর? শেষে তুই কিনা এই প্রতিদান দিলি?”
কিছুক্ষন চলার পর গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিল, “ও যদি ভাল চায়, তাহলে আমাদের ওদিকে যেন না যায়।”
বাস স্ট্যান্ডের পথে লম্বা দেবদারু গাছটার নিচে দাঁড় করিয়ে ওঁদের সমস্ত কাহিনী চন্দ্রার চোখের সামনে তুলে ধরেছিলাম , কিভাবে সকলের সুযোগসন্ধানী দৃষ্টির আড়ালে বিভিন্ন কৌশলে খাতার মধ্যে চিঠি রেখে রোল করে পুষ্পকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলত ‘একটি প্রশ্ন থাকল’ অর্থাৎ চিঠি, কিভাবে সকলের আড়ালে দুজনার চোখাচোখি হতেই মৃদু হেঁসে মুখ নামিয়ে নিত চন্দ্রা, উল্টো রথে ওর জন্মদিনে মায়ের ক্ষনিক অনুপস্থিতে বলেছিল, ‘এই রান্নাতে চলবে তো, এর চেয়ে ভাল রান্না আমি জানি না’ এই সব কিছুই ঘটেছিল আমার সামনে।
*******
এইচ এস পরীক্ষার পর আর কোন অজুহাতেই যখন চন্দ্রাদের ব্যাচে থাকা সম্ভব হল না , তখন একমাত্র চন্দ্রার তৎপরতাতেই ভাইকে পড়ানোর অছিলায় দেখা করবার, সুযোগমত দু’চারটে কথা বলার বিরাট সুযোগ করে দিয়েছিল ঐ চন্দ্রাই। অথচ সেই চন্দ্রার এমন নির্লজ্জ আচরণে আশ্চর্য না হয়ে পারি নি সেদিন।
গভীরভাবে কাউকে কাছে পেতে চাওয়ার পর সেই প্রিয়জনের মুখে এরকম মন্তব্য শুনে আর পাঁচজনের যেমন ক্রোধী, হিংস্র এবং সর্বগ্রাসী উষ্ণ উত্তেজনা হওয়া উচিত তার বিন্দু মাত্রও আভাস পাইনি পুষ্পকের মধ্যে। থামতে না পেরে শেষে আমিই প্রতিবাদ করে উঠলাম, “তোকে এভাবে অপমান করে গেল আর ওর বিরুদ্ধে তোর কিছুই বলবার নেই, কিছুই করবার নেই? ”
*******
আমরা শুয়ে আছি নৌকায়। এক টুকরো সাদা মেঘের পাশ দিয়ে চাঁদ সড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেদিকেই চেয়ে শান্তভাবে বলল, “রাগ কি জন্য করব রে? ও তো সত্যি সত্যি ভেতর থেকে আমাকে দোষারোপ করে নি। আর তাছাড়া সংবিধানে মেয়েদের যতই স্বাধীনতা দেওয়া হোক না কেন ব্যক্তি জীবনে ওরা কিন্তু ততটা স্বাধীনতা পায় না, এদিক দিয়ে ওরা বড্ড অসহায়; আর তোকেও বলে রাখছি আমি যদি সত্যি সত্যিকারে ওকে ভালবেসে থাকি তাহলে ও কোনদিনও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না।”
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। বহু চেষ্টা করেও চন্দ্রার আর কোন কথা নিতে পারি নি। বহুবার ওদের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করেছি, পুষ্পক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চন্দ্রার দিকে তাকাতেই দুর্বলের মত হেঁটে চলে গিয়েছে চন্দ্রা।
“সে কেন এমন করল, এ প্রশ্নটির নিশ্চিত কোন উত্তর আজও পাই নি।”
শুধু নির্জন নদীতীরে দুলন্ত নৌকাটির হালের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আর পাড়ের ইঁদুরের খোঁড়া ঝুরঝুরে মাটিগুলি জলে পড়ার সরসর শব্দের মধ্যেও আমার প্রতিবাদী মনটা চন্দ্রার বিরুদ্ধে সম্ভব অসম্ভব কত কি ভেবে চলত।
সম্ভবত পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবেই তড়িঘড়ি করে সেই বছরের বৈশাখেই বিয়ে হয়ে গেল চন্দ্রার। এদিকে সম্পর্কটি ভেঙ্গে যাবার পর কোনোদিন চন্দ্রার ব্যাপারে দুঃখ করে কথা বলতে শুনি নি পুষ্পককে। অথচ ওদের সম্পর্কটি কতটা নির্ভেজাল, কতটা পবিত্র ছিল একথা মনে পরলে আজও দুচোখে জল এসে যায়।
ভাগলপুরে যাচ্ছি ল পড়তে। স্টেশনে অনেকেই সি অফ করতে এসেছিল। পুষ্পকও ছিল। আমার হার্টের ট্রাবল বেড়ে যাবার সময় ও আমার জন্য যা কিছু করেছে তা এ জীবন থাকতে ভুলতে পারব না। প্রিয় বন্ধু হলেও সৌজন্যতার খাতিরে বললাম, “দ্যাখ পুষ্পক, আমি জানি তুই এসব পছন্দ করিস না তবুও বলছি, তুই না থাকলে সেদিনই হয়ত আমার লাস্ট এট্যাক হত- বলতে পারিস এ জীবন তোরই দান- কোন রকম প্রয়োজন থাকলে বলিস।”
ব্যাস্ত যাত্রীদের মাঝে সেদিন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে হো হো করে হেঁসে উঠেছিল, “বাব্বা, খুব যে সৌজন্য বোধ দেখাচ্ছিস! এখনো তোর পাগলামি গেল না।”
একটু নির্জনের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিল, “দ্যাখ দিপু, আমাদের ব্যাপারটাই তুই একমাত্র নীরব সাক্ষী, এটা তুই কাউকে জানাস না যেন। কেননা এর উপর ওর সাংসারিক জীবনের সুখ শান্তি নির্ভর করছে। তোর তো আবার স্থান-কাল-পাত্র বেশিদিন মনে থাকে না, তাই বলছিলাম যে তোদের জম্পেশ আসরে এটাকে রসদ করে আমাদের সম্পর্কের পবিত্রতাটুকু নষ্ট করিস না। তুই আমার জুনিয়ার। তবু বলছি, প্লিজ দিপু, কথাটা আমার রাখিস।”
বন্ধুটির এভাবে ত্যাগ স্বীকার করায় বেদনা ভারাক্রান্ত মনে কোনোমতে বলতে পেরেছিলাম, ‘রাখব’।
এরপর মাঝে মাঝে চিঠি দিত। প্রায় চিঠিতে লিখত- ভাল থাকিস, পড়াশোনার কোন ক্ষতি করিস না। আমি ভাল আছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই বছরই কমার্স স্ট্রিমে স্কলারশিপ নিয়ে ভালভাবে বি, কম পাশ করল। ওর ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল কলকাতা গিয়ে C.A. (চার্টার্ড একাউন্ট) পড়ার। সে কলকাতা গিয়েছিল কিন্তু বহুদিনের দেখা এক স্বপ্নকে সার্থক রুপ দিতে নয়, অর্থ রোজগারের তাগিদে। কেননা ওদের বাড়িতে দীর্ঘদিনের ভাতৃস্নেহে ফাটল ধরেছিল। অন্তিম পরিণতি হিসাবে গ্রামের মাতব্বরের মধ্যস্থতায় বিবাহযোগ্যা বোন রাগিণীর ভরণপোষণ নিয়েছে বড়দা, অক্ষম বাবা পরেছে মেজদার ঘরে এবং প্যারালাইজড বৃদ্ধা মা পরেছে বেকার পুষ্পকের কাছে।
রাগিণী বিয়ের আগে পর্যন্ত এবং বৃদ্ধ বাবা সামান্য হলেও বাজারকরা, রেশন তোলা ইত্যাদি সাংসারিক ছোটখাটো কাজগুলি করে কিছুটা সুরাহা করতে পারবে। অবশ্য রাগিণীর বিয়ে এই মুখ তাকাতাকি দাদাদের দ্বারা আদৌ হবে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
কিন্তু শয্যাগত প্যারালাইজড মা যেহেতু সেসব কিছু দিতে পারবে না তাই বোন ও বাবাকে বেছে নেবার পর গড়াগড়ি যাবার মত এক বস্তুপিণ্ড হয়ে পড়ে রইল। অবশেষে তা বর্তাল উপার্জনহীন এক বেকার যবকের কাছে।
পাছে তার উপার্জনের সত্যিকারের পথ জেনে মা কষ্ট পায় তাই ‘কলকাতায় এক লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কশিপের এক কাজ পেয়েছি’ এই বলে দিন পনের আগে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল। ভীর বহুল রুক্ষ কলকাতার মত জায়গায় বোকাবোকা গোবেচারা ভাবুক গোছের একটা মানুষের পক্ষে একটা কাজ জোটান যে কি কষ্টকর তা বোধ হয় বলে বোঝাতে হবে না।
লোক মুখে শুনেছি, প্রথম দু তিন দিন নাকি স্থানীয় এক মাতালের প্ররোচনায় শরীরের রক্ত বিক্রি করে খোরাকি চালিয়েছিল। তারপর ব্লাড ব্যাঙ্কের লোকজন তার রক্তাল্পতা লক্ষণ দেখে আর তার রক্ত নেন নি। তারপর বহু ঘুরে, অনেক চেষ্টা চরিত্র করে গ্যারাজে গাড়ি ধোয়া মোছার একটা কাজ পায়।
সেখানে অর্ধাহার অনিয়মে একদিন যগ ডিস ব্যালান্স হয়ে একটি ট্যাক্সির পুরো ভার পড়েছিল ওর বুকের উপর। সেদিন থেকেই তার বাক শক্তি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সারা জীবনের মত।
একদিন সন্ধ্যার দিকে এক অজ্ঞাতপরিচিত শুভার্থী তার অসাড় রুগ্ন দেহখানি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে। কাঁচা উঠানে মাদুরের উপর শুয়ে শুয়ে কালশিটা পরা স্থির দুটি চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রুধারা বয়েছিল শেষ দিন পর্যন্ত।
আজকের মত এমনই এক জ্যোৎস্না ভাসা মধ্যরাতে ওর জীর্ণ দেহ থেকে মহান আত্মাটি বেরিয়ে গিয়েছিল মহাশূন্যে। আজও হয়ত চন্দ্রা জানে না যে তার সুর-তাল-ছন্দময় সাংসারিক জীবনকে সাজিয়ে রেখে এক ত্যাগী সম্ভাবনাময় প্রাণ জনঅরণ্য থেকে নীরবে ঝরে পড়েছে।
দীর্ঘ ১৮ বছরের উকিল জীবনে কতই না বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখেছি কিন্তু পুষ্পকের মত এমন ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ দ্বিতীয়টি দেখি নি। মাঝে মাঝে অবসর কাটানোর সময় ওর জীবনের মুল্যায়ন করতে গিয়ে কতবার যে রুমাল ভিজিয়েছি তার তো হিসেবই নেই।
‘আমি যদি সত্যিকারে ওকে মন থেকে ভালবেসে থাকি তাহলে ও কোনদিনও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না’ সেদিনের পুষ্পকের এই কথাগুলির অর্থ আজকের কঠোর বাস্তব জীবনে অন্যভাবে করতে শিখেছি। জীবনের ভীড়ে চন্দ্রা পুষ্পককে হাড়িয়েছিল কিন্তু পুষ্পক চন্দ্রাকে হাড়ায় নি। সে ঠিকই বলেছিল, পুষ্পকের কাছ থেকে চন্দ্রাকে কেড়ে নিতে পারে নি আর পারবেও না কোনোদিন …….
ওকে আজও ভুলতে পারছি না। যদিও সে আজ আর নেই আমাদের মধ্যে তবুও আজ ওর কথা বারবার মনে আসছে। মনের অন্তরতম স্থান থেকে এক মন কেমন করা সঙ্গীত বেরিয়ে আসছে।
চন্দ্রার মা ব্যাপারটা জেনে যাবার পর ওদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পুষ্পকের। তার পরেও বেশ কিছুদিন সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে পুষ্পকের সাথে কতাবার্তা বলেছিল। হঠাত করে কথাবার্তা বন্ধ। ব্যাপারটা আগের মত সহজ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেও কোন ফল হয়নি পুষ্পকের। এভাবেই চলল মাস আটেক ।
১৯৯৬ সাল। চারিদিকে গ্রিটিংস কার্ড দেবার হিরিক। সময়টা ছিল জানুয়ারি মাসের সাত তারিখ। সোমবার। অনেকেই অনেককে কার্ড দিয়ে নতুন বছরের অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু পুষ্পকের পাঠান গ্রিটিং নিয়ে ঘোশালবাবুর কোচিং ক্লাসে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করে গেল চন্দ্রা। আমরা সবাই থ হয়ে গেলাম। ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ের সামনে সারাক্ষণই মাথা নিচু করেছিল পুষ্পক। হাল্কাভাবে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার মত কোন উত্তরই সে করে নি। রটনাপ্রিয় ছেলে মেয়েদের ফিসফাস সমালোচনা শুনতে না পেরে একসময় বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল।
চন্দ্রার এমন পরিবর্তনে শুধু অবাকই হই নি বরং ক্ষোভও হয়েছিল। থমথমে মুখ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াল চন্দ্রা। ওর সঙ্গ নিলাম, “এটা তুই কি করলি চন্দ্রা? এমনিই যদি করবার ইচ্ছা ছিল তাহলে ওকে ভাল কেন বাসতে গিয়েছিলি? ওর দিকটা একবারও ভেবে দেখেছিস কি?”
উত্তর না পেয়ে এবার আমি চুপ থাকলাম।, “আমাকে দিয়ে চিঠি দেওয়া নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল তোর? শেষে তুই কিনা এই প্রতিদান দিলি?”
কিছুক্ষন চলার পর গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিল, “ও যদি ভাল চায়, তাহলে আমাদের ওদিকে যেন না যায়।”
বাস স্ট্যান্ডের পথে লম্বা দেবদারু গাছটার নিচে দাঁড় করিয়ে ওঁদের সমস্ত কাহিনী চন্দ্রার চোখের সামনে তুলে ধরেছিলাম , কিভাবে সকলের সুযোগসন্ধানী দৃষ্টির আড়ালে বিভিন্ন কৌশলে খাতার মধ্যে চিঠি রেখে রোল করে পুষ্পকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলত ‘একটি প্রশ্ন থাকল’ অর্থাৎ চিঠি, কিভাবে সকলের আড়ালে দুজনার চোখাচোখি হতেই মৃদু হেঁসে মুখ নামিয়ে নিত চন্দ্রা, উল্টো রথে ওর জন্মদিনে মায়ের ক্ষনিক অনুপস্থিতে বলেছিল, ‘এই রান্নাতে চলবে তো, এর চেয়ে ভাল রান্না আমি জানি না’ এই সব কিছুই ঘটেছিল আমার সামনে।
*******
এইচ এস পরীক্ষার পর আর কোন অজুহাতেই যখন চন্দ্রাদের ব্যাচে থাকা সম্ভব হল না , তখন একমাত্র চন্দ্রার তৎপরতাতেই ভাইকে পড়ানোর অছিলায় দেখা করবার, সুযোগমত দু’চারটে কথা বলার বিরাট সুযোগ করে দিয়েছিল ঐ চন্দ্রাই। অথচ সেই চন্দ্রার এমন নির্লজ্জ আচরণে আশ্চর্য না হয়ে পারি নি সেদিন।
গভীরভাবে কাউকে কাছে পেতে চাওয়ার পর সেই প্রিয়জনের মুখে এরকম মন্তব্য শুনে আর পাঁচজনের যেমন ক্রোধী, হিংস্র এবং সর্বগ্রাসী উষ্ণ উত্তেজনা হওয়া উচিত তার বিন্দু মাত্রও আভাস পাইনি পুষ্পকের মধ্যে। থামতে না পেরে শেষে আমিই প্রতিবাদ করে উঠলাম, “তোকে এভাবে অপমান করে গেল আর ওর বিরুদ্ধে তোর কিছুই বলবার নেই, কিছুই করবার নেই? ”
*******
আমরা শুয়ে আছি নৌকায়। এক টুকরো সাদা মেঘের পাশ দিয়ে চাঁদ সড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেদিকেই চেয়ে শান্তভাবে বলল, “রাগ কি জন্য করব রে? ও তো সত্যি সত্যি ভেতর থেকে আমাকে দোষারোপ করে নি। আর তাছাড়া সংবিধানে মেয়েদের যতই স্বাধীনতা দেওয়া হোক না কেন ব্যক্তি জীবনে ওরা কিন্তু ততটা স্বাধীনতা পায় না, এদিক দিয়ে ওরা বড্ড অসহায়; আর তোকেও বলে রাখছি আমি যদি সত্যি সত্যিকারে ওকে ভালবেসে থাকি তাহলে ও কোনদিনও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না।”
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। বহু চেষ্টা করেও চন্দ্রার আর কোন কথা নিতে পারি নি। বহুবার ওদের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করেছি, পুষ্পক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চন্দ্রার দিকে তাকাতেই দুর্বলের মত হেঁটে চলে গিয়েছে চন্দ্রা।
“সে কেন এমন করল, এ প্রশ্নটির নিশ্চিত কোন উত্তর আজও পাই নি।”
শুধু নির্জন নদীতীরে দুলন্ত নৌকাটির হালের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আর পাড়ের ইঁদুরের খোঁড়া ঝুরঝুরে মাটিগুলি জলে পড়ার সরসর শব্দের মধ্যেও আমার প্রতিবাদী মনটা চন্দ্রার বিরুদ্ধে সম্ভব অসম্ভব কত কি ভেবে চলত।
সম্ভবত পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবেই তড়িঘড়ি করে সেই বছরের বৈশাখেই বিয়ে হয়ে গেল চন্দ্রার। এদিকে সম্পর্কটি ভেঙ্গে যাবার পর কোনোদিন চন্দ্রার ব্যাপারে দুঃখ করে কথা বলতে শুনি নি পুষ্পককে। অথচ ওদের সম্পর্কটি কতটা নির্ভেজাল, কতটা পবিত্র ছিল একথা মনে পরলে আজও দুচোখে জল এসে যায়।
ভাগলপুরে যাচ্ছি ল পড়তে। স্টেশনে অনেকেই সি অফ করতে এসেছিল। পুষ্পকও ছিল। আমার হার্টের ট্রাবল বেড়ে যাবার সময় ও আমার জন্য যা কিছু করেছে তা এ জীবন থাকতে ভুলতে পারব না। প্রিয় বন্ধু হলেও সৌজন্যতার খাতিরে বললাম, “দ্যাখ পুষ্পক, আমি জানি তুই এসব পছন্দ করিস না তবুও বলছি, তুই না থাকলে সেদিনই হয়ত আমার লাস্ট এট্যাক হত- বলতে পারিস এ জীবন তোরই দান- কোন রকম প্রয়োজন থাকলে বলিস।”
ব্যাস্ত যাত্রীদের মাঝে সেদিন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে হো হো করে হেঁসে উঠেছিল, “বাব্বা, খুব যে সৌজন্য বোধ দেখাচ্ছিস! এখনো তোর পাগলামি গেল না।”
একটু নির্জনের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিল, “দ্যাখ দিপু, আমাদের ব্যাপারটাই তুই একমাত্র নীরব সাক্ষী, এটা তুই কাউকে জানাস না যেন। কেননা এর উপর ওর সাংসারিক জীবনের সুখ শান্তি নির্ভর করছে। তোর তো আবার স্থান-কাল-পাত্র বেশিদিন মনে থাকে না, তাই বলছিলাম যে তোদের জম্পেশ আসরে এটাকে রসদ করে আমাদের সম্পর্কের পবিত্রতাটুকু নষ্ট করিস না। তুই আমার জুনিয়ার। তবু বলছি, প্লিজ দিপু, কথাটা আমার রাখিস।”
বন্ধুটির এভাবে ত্যাগ স্বীকার করায় বেদনা ভারাক্রান্ত মনে কোনোমতে বলতে পেরেছিলাম, ‘রাখব’।
এরপর মাঝে মাঝে চিঠি দিত। প্রায় চিঠিতে লিখত- ভাল থাকিস, পড়াশোনার কোন ক্ষতি করিস না। আমি ভাল আছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই বছরই কমার্স স্ট্রিমে স্কলারশিপ নিয়ে ভালভাবে বি, কম পাশ করল। ওর ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল কলকাতা গিয়ে C.A. (চার্টার্ড একাউন্ট) পড়ার। সে কলকাতা গিয়েছিল কিন্তু বহুদিনের দেখা এক স্বপ্নকে সার্থক রুপ দিতে নয়, অর্থ রোজগারের তাগিদে। কেননা ওদের বাড়িতে দীর্ঘদিনের ভাতৃস্নেহে ফাটল ধরেছিল। অন্তিম পরিণতি হিসাবে গ্রামের মাতব্বরের মধ্যস্থতায় বিবাহযোগ্যা বোন রাগিণীর ভরণপোষণ নিয়েছে বড়দা, অক্ষম বাবা পরেছে মেজদার ঘরে এবং প্যারালাইজড বৃদ্ধা মা পরেছে বেকার পুষ্পকের কাছে।
রাগিণী বিয়ের আগে পর্যন্ত এবং বৃদ্ধ বাবা সামান্য হলেও বাজারকরা, রেশন তোলা ইত্যাদি সাংসারিক ছোটখাটো কাজগুলি করে কিছুটা সুরাহা করতে পারবে। অবশ্য রাগিণীর বিয়ে এই মুখ তাকাতাকি দাদাদের দ্বারা আদৌ হবে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
কিন্তু শয্যাগত প্যারালাইজড মা যেহেতু সেসব কিছু দিতে পারবে না তাই বোন ও বাবাকে বেছে নেবার পর গড়াগড়ি যাবার মত এক বস্তুপিণ্ড হয়ে পড়ে রইল। অবশেষে তা বর্তাল উপার্জনহীন এক বেকার যবকের কাছে।
পাছে তার উপার্জনের সত্যিকারের পথ জেনে মা কষ্ট পায় তাই ‘কলকাতায় এক লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কশিপের এক কাজ পেয়েছি’ এই বলে দিন পনের আগে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল। ভীর বহুল রুক্ষ কলকাতার মত জায়গায় বোকাবোকা গোবেচারা ভাবুক গোছের একটা মানুষের পক্ষে একটা কাজ জোটান যে কি কষ্টকর তা বোধ হয় বলে বোঝাতে হবে না।
লোক মুখে শুনেছি, প্রথম দু তিন দিন নাকি স্থানীয় এক মাতালের প্ররোচনায় শরীরের রক্ত বিক্রি করে খোরাকি চালিয়েছিল। তারপর ব্লাড ব্যাঙ্কের লোকজন তার রক্তাল্পতা লক্ষণ দেখে আর তার রক্ত নেন নি। তারপর বহু ঘুরে, অনেক চেষ্টা চরিত্র করে গ্যারাজে গাড়ি ধোয়া মোছার একটা কাজ পায়।
সেখানে অর্ধাহার অনিয়মে একদিন যগ ডিস ব্যালান্স হয়ে একটি ট্যাক্সির পুরো ভার পড়েছিল ওর বুকের উপর। সেদিন থেকেই তার বাক শক্তি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সারা জীবনের মত।
একদিন সন্ধ্যার দিকে এক অজ্ঞাতপরিচিত শুভার্থী তার অসাড় রুগ্ন দেহখানি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে। কাঁচা উঠানে মাদুরের উপর শুয়ে শুয়ে কালশিটা পরা স্থির দুটি চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রুধারা বয়েছিল শেষ দিন পর্যন্ত।
আজকের মত এমনই এক জ্যোৎস্না ভাসা মধ্যরাতে ওর জীর্ণ দেহ থেকে মহান আত্মাটি বেরিয়ে গিয়েছিল মহাশূন্যে। আজও হয়ত চন্দ্রা জানে না যে তার সুর-তাল-ছন্দময় সাংসারিক জীবনকে সাজিয়ে রেখে এক ত্যাগী সম্ভাবনাময় প্রাণ জনঅরণ্য থেকে নীরবে ঝরে পড়েছে।
দীর্ঘ ১৮ বছরের উকিল জীবনে কতই না বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখেছি কিন্তু পুষ্পকের মত এমন ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ দ্বিতীয়টি দেখি নি। মাঝে মাঝে অবসর কাটানোর সময় ওর জীবনের মুল্যায়ন করতে গিয়ে কতবার যে রুমাল ভিজিয়েছি তার তো হিসেবই নেই।
‘আমি যদি সত্যিকারে ওকে মন থেকে ভালবেসে থাকি তাহলে ও কোনদিনও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না’ সেদিনের পুষ্পকের এই কথাগুলির অর্থ আজকের কঠোর বাস্তব জীবনে অন্যভাবে করতে শিখেছি। জীবনের ভীড়ে চন্দ্রা পুষ্পককে হাড়িয়েছিল কিন্তু পুষ্পক চন্দ্রাকে হাড়ায় নি। সে ঠিকই বলেছিল, পুষ্পকের কাছ থেকে চন্দ্রাকে কেড়ে নিতে পারে নি আর পারবেও না কোনোদিন …….
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
pradip kumar ray ১৬/০২/২০১৬একটু মজা হোক পরের লেখাটায়।
-
বিদ্রোহী ফাহিম খান ১৫/০২/২০১৬সহমত
-
শান্তনু ব্যানার্জ্জী ১৫/০২/২০১৬গল্পটির অভ্যন্তরের ব্যথা অনুভব করলাম হৃদয় দিয়ে।
তবে টাইপোগুলো শুধরে নিলে আরো ভালো লাগবে দাদা। -
দেবব্রত সান্যাল ১০/০২/২০১৬গল্পটা সম্পূর্ণ করেছেন , ভালো কথা। প্রচুর বানানে ভুল রয়েছে , যা পড়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুদ্ধ করে নিন।
-
দেবব্রত সান্যাল ০৮/০২/২০১৬অনেক ছাপার ভুল আছে , শুদ্ধ করা প্রয়োজন। গল্প অসম্পূর্ণ মনে হয়।